তণ্ডুলাদালিসংমিশ্রা লবণার্দ্রকহিঙ্গুভিঃ |
সংযুক্তাঃ সলিলে সিদ্ধাঃ কৃসরা কথিতা বুধৈঃ ||৯||
(চাউল ও দালি মিশ্রিত করিয়া লবণ, আদা ও হিঙ্গুযুক্ত করণে সলিলে পাক করিলে তাহাকে জ্ঞানীজনেরা কৃসরা বলিয়া থাকেন।) —ভাবপ্রকাশ নিঘণ্টু, পূর্বখণ্ড, মিশ্রপ্রকরণ — কৃতান্নবর্গ
সুপ্রাচীন দক্ষিণদেশে খিচুড়ির হদিশ না মেলায় আমরা হতাশ হয়েছি। দক্ষিণ ভারতে আমরা অবশ্যই ফিরব খিচুড়ির খোঁজে। কিন্তু সে একেবারে মধ্যযুগে। আপাতত চোখ বুলানো দরকার প্রাচীন ভারতের আর-এক গোত্রের পুথিপত্তরের ওপর যা এ দেশে সেই সময়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার নানা প্রচেষ্টার আশ্চর্য উদাহরণের পাশাপাশি অজস্র খানার উল্লেখে ভরপুর। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র।
প্রাচীন থেকে মধ্যযুগীয় সময় বিজ্ঞানের এই ধারায় যে বিপুল সংখ্যক কেতাব লিখিত, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত হয়েছে ভারতে তার সরজমিন তদন্ত ছাড়া এ উপমহাদেশের খানাখাজানার কোনো কিস্সা সম্পূর্ণ হতেই পারে না। ৮০০ পূর্বসাধারণাব্দ থেকে ১০০০ সাধারণাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কালকে ধরা হয় ভারতীয় প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের ‘স্বর্ণযুগ’১ বলে। আর এই গোত্রের পুথির কথা উঠলেই অবধারিত ভাবে প্রথমেই উঠবে চরক এবং সুশ্রুত সংহিতার কথা। দুটিই শত শত বছর ধরে লিখিত, পুনর্লিখিত, পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়েছে। কাজেই এ দুই মহাকেতাবের রচনার সুনির্দিষ্ট তারিখ স্থির করা সম্ভব হয়নি। মোটামুটি ধরা হয় যে রূপে চরক সংহিতা মিলেছে আধুনিক কালে সেটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল ১০০ সাধারণাব্দের মধ্যে২। আর সুশ্রুত সংহিতা আরও বেশ কিছুটা পরে—৭০০ সাধারণাব্দ নাগাদ৩।
ইংরেজি তরজমায়৪ দুটিই খুঁজে দেখেছি, দুটিতেই মিলেছে কৃসরার উল্লেখ। চরকে যেমন পিনস, মানে ক্রনিক সাইনাসাইটিসের চিকিৎসায় আরও বহু কিছুর মধ্যে কৃসর সেবনের কথা বলা হয়েছে। কিংবা যাঁদের তেল সহ্য হয় না, বা যাঁদের তেল সহ্য হলেও পাতলা পায়খানা হয়, অথবা যাঁরা দুর্বল শরীরের, বা যাঁরা মদ্যাসক্ত তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নানা অন্যান্য খানার সঙ্গে তেল মিশিয়ে খেতে। যেমন—তিতির, ময়ুর, হাঁস, রাজহাঁস, শুয়োরের মাংস, গোরুর মাংস, ছাগলের মাংস, ভেড়ার মাংস, মাছ ইত্যাদি। প্রাচীনকালের বৈদিক মনু-পূর্ব, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মনু-উত্তর কালেরও পুথিপত্তর যতই পড়েছি, ততই স্তম্ভিত হয়েছি আমাদের পূর্বজরা কী সাংঘাতিক মাংসাষী ছিলেন তার অকাট্য সব প্রমাণ দেখে! আমরা তো আজকাল সে তুলনায় একেবারে নিরীহ গোবেচারা বলা যায়! যাইহোক ওই পথ্যের তালিকাতে রয়েছে কৃসরও৫। অগ্নিমান্দ্যতে যেমন রয়েছে কৃসর খাওয়ার উপদেশ, তেমনই কফজাত ডায়াবিটিস বা অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যাওয়ার মতো রোগে-ভোগাদের বারণ করা হয়েছে বারবার কৃসর সাবড়াতে।
মুশকিল হল যা বুঝেছি চরকে কৃসর-র কোনো রেসিপি বা বিবরণ নেই। তরজমাকার অবিনাশচন্দ্র কবিরত্ন ফুটনোটে বা বন্ধনীতে কৃসরর মানে এক এক জায়গায় এক এক রকম লিখেছেন, তা আমার খুব নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি। সুশ্রুতে আবার বলা আছে তলপেটে টিউমারে ঘা হলে ঘি দিয়ে রাঁধা কৃসর বা মাংসের পুলটিশ কাজে দেয়। কিংবা ‘বাতজ শিরোরোগ’ হলে বলা আছে মাথার তালুতে কৃসর লেপে রাখার কথা! কিংবা শিশুদের পুতনা রোগে, অর্থাৎ স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি না হলে, পুতনা ডাইনিকে শান্ত করতে খিচুড়ি নৈবেদ্য দেওয়ার উপদেশ আছে। আলসার হলে বারণ করা আছে কৃসরা খেতে। কৃসর আর পায়েস, সুশ্রুত-মতে, কদাচ একসঙ্গে খাবেন না। এ বইয়ের তরজমাকার কুঞ্জলাল ভিষগরত্ন বন্ধনীতে লিখে দিচ্ছেন কৃসর হল—A composition prepared with sesame, masha pulse and rice৬। চাল-তিল-মাষকলাই দিয়ে তৈরি খানা।
আনন্দের তেকাটুলায়াগুতেও আমরা পেয়েছিলাম চাল-তিল-ডালের তৈরি কৃসর-র কথা। এবার কথা হল, তিল ব্যাপারটাকে বাদ দিয়ে নিখাদ চাল-ডালের কৃসর হয়ে খিচুড়িতে যাব কোন্ পথে? একটা পথ খুলে গেল মনিয়ার উইলিয়াম্স অভিধানের খিচ্চা এন্ট্রিটি ভালো করে দেখতে গিয়ে। তার পাশে খুদি খুদি অক্ষরে লেখা আছে—Npr। কী এই Npr? আনাড়ির নাড়িজ্ঞান নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা দারুণ সাইট, যেখানে দেওয়া আছে অভিধানে ব্যবহৃত নানা সংস্কৃত নামের আদ্যক্ষরের অর্থ। আর তাতেই কপাল ঠুকে Npr সার্চ করে পেয়ে গেলাম—‘Nighaṇṭuprakāśa’৭। কী এই নিঘণ্টু প্রকাশ? ভাবপ্রকাশনিঘণ্টুর আর-এক নাম। আর ধাক্কাটা খেলাম তার খোঁজ করতে গিয়েই।
প্রথমেই জানা দরকার নিঘণ্টু কী। সহজ করে বললে কথাটার দুটো মানে। এক, ব্যাকরণগত ভাবে নিঘণ্টু হল সুপ্রাচীন কিছু বৈদিক শব্দের সংকলন। পাণিনিরও আগে ‘নিরুক্ত’ নামে একটি সংকলন তৈরি করেন বৈয়াকরণ যাস্ক, নিঘণ্টু তারই অন্তর্গত। সাধারণ ভাবে পণ্ডিতেরা মনে করেন তাঁর জীবৎকাল ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ পূর্বসাধারণাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে, মানে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে। তবে কি এই নিঘণ্টুরই কোনো অংশ ভাবপ্রকাশ? তবে কি অন্তত আড়াই হাজার বছর পিছিয়ে গেল খিচ্চার ইতিহাস?
না। ভাবপ্রকাশ যে নিঘণ্টু, তা এটা নয়। সে নিঘণ্টু আয়ুর্বেদের বিপুল এক রচনাবলি, যার এক একটি নিঘণ্টু এক এককালে রচিত। শত শত বছর ধরে। এক একটি নিঘণ্টুতে রয়েছে ওষুধ, উদ্ভিদ, প্রাণী, খনিজ—মোটামুটি মানুষ খাদ্য এবং ওষুধ হিসেবে যা কিছু শরীরে গ্রহণ করতে পারে বলে সে সময়ে মনে করা হত, তার তালিকা, বর্ণনা ও গুণাগুণ। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র তেওয়ারি নিঘণ্টুকে বলছেন ‘দ্রব্যগুণ বিজ্ঞান’৮। এই রচনাবলি রচনাকালের বিচারে দু-ভাগে বিভক্ত—প্রাচীন ও মধ্যযুগীয়। এই দ্বিতীয় দফার নিঘণ্টুগুলি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এই কারণেই যে এগুলিতে দ্রব্যের সঙ্গে বলা হয়েছে তাদের গুণাগুণ, শরীরের ওপর তাদের প্রভাব, পথ্য ও ওষুধে তাদের ব্যবহার ইত্যাদি। এই মধ্যযুগীয় নিঘণ্টুগুলির মধ্যেই রয়েছে ধন্বন্তরীনিঘণ্টু, যার রচনাকাল দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে কোনো একসময়ে৯। আর এই গোত্রের নিঘণ্টুগুলির মধ্যে ‘যুগান্তকারী’১০ হিসেবে ধরা হয় ভাবপ্রকাশ নিঘণ্টুকে। এতে যেমন আছে উদ্ভিজ্জাত দ্রব্যের ফার্মাকোপিয়া, তেমনই রয়েছে ধাতুজাত ও খনিজ ওষুধের তালিকা, সেগুলি তৈরির প্রকরণ এবং সেগুলির ব্যবহার।
আর তারই সংস্কৃত পাঠ খুলে পেয়ে গেলাম দুটি শ্লোক। প্রথমটি একটি পথ্যের সংজ্ঞা, আর একবার শুনে নিই:
তণ্ডুলাদালিসংমিশ্রাল বণার্দ্রকহিঙ্গুভিঃ |
সংযুক্তাঃ সলিলে সিদ্ধাঃ কৃসরা কথিতা বুধৈঃ ||৯||
চাউল ও দালি মিশ্রিত করিয়া লবণ, আদা ও হিঙ্গু / যুক্ত করণে সলিলে পাক করিলে তাহাকে জ্ঞানীজনেরা কৃসরা বলিয়া থাকেন। এ শ্লোক সহজবোধ্য। কিন্তু এর পরেরটা বেশ খটোমটো—
কৃসরা শুক্রলা বল্যা গুরুঃ পিত্তকফপ্রদা |
দুর্জরা বুদ্ধিবিষ্টম্ভমলমূত্রকরীস্মৃতা || ১০।।১১
আন্দাজ মিললেও নাগাল মিলল না। সংস্কৃতের অধ্যাপক বিজয়া গোস্বামীর কাছে পাঠাতে তিনি মানে করে দিলেন— ‘কৃসরা শুক্র এবং বল করায়, গুরুপাক এবং পিত্ত ও কফ বৃ দ্ধিকরে। জরা নাশ করে, বুদ্ধি বিষ্টম্ভিত (বাধাপ্রাপ্ত) করায় এবং মলমূত্র বৃদ্ধি করে।’
বুকের মধ্যে ঘোড়দৌড়! কৃসরা থেকে তিল বাদ চলে গেছে। আনন্দের তেকাটুলায়াগু-র চাল ও ডাল রয়ে গিয়েছে, আদাও। আবার মরিচদ্বয়কে ফেলে দিয়ে আনা হয়েছে অন্য একটি সুপ্রাচীন ভারতীয় মশলা—হিং। এবার এই পুস্তকটির রচনাকাল জেনে নিলেই খিচুড়ির সুপ্রাচীন ইতিহাসের বেশ বিশ্বস্ত একটা ছবি মিলে যাবে।
কোন্ সময় রচিত এই আয়ুর্বেদিক মহাগ্রন্থটি, যা আমাদের দিয়েছে কৃসরার ওই অপূর্ব রেসিপি? যে রেসিপি থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে খাঁটি নিরামিষ খিচুড়ির সুগন্ধ। দেখে চমকে উঠলাম। রচয়িতা ভাবমিশ্র। রচনাকাল ষোড়শ শতক১২—খাস মুঘল আমলে, হুমায়ুন কিংবা মহামতি আকবরের জমানায়। ইসলামি শাসনকালে প্রাচীন হিন্দু বিজ্ঞানশাস্ত্রের চর্চা গলা টিপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই হিন্দুত্ববাদী প্রচারের গালে একটি বিরাশি সিক্কার চড় এই ভাবপ্রকাশনিঘণ্টু। মুঘল আমলে রচিত এ কেতাবকেই পণ্ডিত ও গবেষকেরা মনে করেন ‘আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মেটেরিয়া মেডিকা’১৩ তবু খিচুড়ির প্রাচীনতার রহস্য ভেদের খোঁজে তা ধাক্কা। ধাক্কা এই কারণেই যে, এই কৃসরা, যে কৃসরা আমাদের নিরামিষ আধুনিক খিচুড়ির ঠিক আগের প্রজন্ম, তা তো মধ্যযুগীয়, একে তো মোটেই প্রাচীন বলা যাচ্ছে না। এ যে চাল ও ডালের লবণ ও মশলা দেওয়া খিচুড়ির সুস্পষ্ট রেসিপি তা নিয়ে তো কোনো ধন্দ নেই। কিন্তু তবে কী বিশ্বাস করতে হবে আজ এই একবিংশ শতকে আমরা ভারতীয়রা খিচুড়ি বা খিচড়ি বলতে যা বুঝি, তা কি তবে এতই নাদান?
পুথিপত্তর ঘেঁটে তো আমি তাই পেয়েছি। মানে মুদ্গৌদন—স্রেফ চাল-ডাল ফোটানো—যে অর্থে প্রাচীন, মশালেদার খিচুড়িও যে তেমনই সে প্রমাণ আমি পাইনি। মশলা দেওয়া খিচুড়িকে প্রামাণ্য ভাবে অবশ্য পিছিয়ে নিয়ে যেতেই হবে আরও বেশ কয়েকশো বছর। অন্য কয়েকটি মোক্ষম ক্লু ধরে। সেজন্য আমাদের ঢুকে পড়তে হবে দুর্ধর্ষ কিছু ভ্রমণবৃত্তান্তে। এবং এই ভাবপ্রকাশনিঘণ্টু থেকে শ-খানেক বছর পিছিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়তে হবে এমনই এক হেঁশেলে, যেমন আজগুবি হেঁশেল ভূভারতে আর কখনও কোত্থাও ছিল বলে তো আমার জানা নেই। এমনই আজগুবি যে তাকে হেঁশেল না বলে খানা-পরীক্ষাগারও বলা যেতে পারে! তবে হ্যাঁ, সেখানেও নয়, এই খিচুড়ির মহারহস্যের অ্যাডভেঞ্চারে এ খানার অজুত রঙের রোশনাই যদি দেখতে হয়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে খিচুড়ির ‘মুঘল গার্ডেন্স’-এ!! আমাদের এই খিচুড়ি মহা-অ্যাডভেঞ্চারে আগে সেই রসনা-পরীক্ষাগারে ঢুকব, তারপরে ফিরে যাব সমসাময়িক, মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতে আরও একবার, সেখান থেকে ঢুকব খিচুড়ির মুঘল গার্ডেন্সে, আর তারপরে তুলে নেব সেইসব রোমহর্ষক ভ্রমণকাহিনি।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)
খিচুড়ি নিয়ে আর কতো! এর চেয়ে গরমাগরম খেয়ে ফেলতে বেশী রাজী।
আজকে পরের পর্ব এলো না যে? আসবে না?
সরি। সামনের সপ্তাহে আসবে। আপডেট দেওয়া হয়নি। আগামীকাল একটা স্পেশাল ইস্যু বেরোবে। সেইজন্য।