ছবিটা কীসের হতে পারে? আন্দাজ করতে থাকুন। উত্তর যাকে বলে যথাস্থানে পেয়ে যাবেন! ততক্ষণে আমরা খিচুড়ি মহারহস্য অ্যাডভেঞ্চারে পিছিয়ে এগিয়ে যাই!! পিছিয়ে এগিয়ে যাই? ঠিক তাই!
জাহাঙ্গিরের খিচড়ি আস্বাদন দিয়ে আমরা এ রহস্য-অ্যাডভেঞ্চার শুরু করেছিলাম। আবার সেখানেই ফিরলাম। জাহাঙ্গিরকে নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? না। হচ্ছে না এই কারণেই যে, খিচুড়ির দীর্ঘ-দীর্ঘ ইতিহাসে একমাত্র ‘খিচড়ি দাউদখানি’ ও ‘খিচড়ি জাহাঙ্গিরি’ ছাড়া আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তির নামাঙ্কিত কোনো খিচুড়ি নেই। আর আছে ঈশ্বরের নামাঙ্কিত ‘জগাখিচুড়ি’, সে এক দীর্ঘ রহস্যময় অধ্যায়। কিন্তু যে দুই রক্তমাংসের মানুষের নাম খানদানি কুকবুক-এ খিচুড়িশোভিত হয়েছে তাঁরা হলেন জাহাঙ্গির ও দাউদ খান। তাও দাউদখানি খিচুড়ি নির্ঘাৎ দাদখানি— মানে দাউদখানি—চালের খিচড়ি, চাল থেকে নাম। সে চর্চা আমরা করব, যথাস্থানে।
না, একটু ভুল হচ্ছে। দীর্ঘকাল আমার নানা রসনা-অ্যাডভেঞ্চারের দোসর দীপঙ্কর দাশগুপ্ত জানাল, আর-একজনের নামাঙ্কিত একটি খিচুড়ি আছে, একটা নামকরা জনপ্রিয় কেতাবে—আজিজুল হক খিচুড়ি! কী করে এমন নাম হল, সে কিস্সাও শুনব যথাসময়ে। এখন এইটুকুই যে এই নামটিও ওই কুকবুকের লেখিকা রেণুকা দেবী চৌধুরানীর শখ করে দেওয়া নাম। এই যেমন আমি এতক্ষণ ‘খিচড়ি আকবরি’ বলে আসছি, অনেকটা সেরকম। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে তার সোনা-মুগ দাগ এখনও পড়েনি!
অন্যদিকে, ‘খিচড়ি জাহাঙ্গিরি’ উল্লিখিত হয়েছে যুগে যুগে, একের পর এক কুকবুকে। শাহজাহান বাদশার সময়ে, মানে সপ্তদশ শতকের গোড়া থেকে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি এবং এক্কেবারে শেষে প্রকাশিত দু’ দুটি ডাকসাইটে বাংলা পাকপ্রণালীর বইয়ে পর্যন্ত। নাম একই—খিচড়ি জাহাঙ্গিরি—কিন্তু বদলে বদলে গিয়েছে তার রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ। এবং অবশেষে তাও ভ্যানিশ করে গিয়েছে। তার পরে, কী আশ্চর্য, আবার একটিবার কালের গহিন থেকে টুকি মেরে, ওই রেণুকা দেবী চৌধুরানীর বইতেই১, ২০০৩ সালে, ফের ডুব মেরেছে কে জানে কোথায়। আজকের কোনো রেস্তোরাঁর—পাঁচতারা থেকে ফুটপাথ—কোনো মেনুতে, কোনো আধুনিক কুকবুক-এ আমার চোখে পড়েনি খিচড়ি জাহাঙ্গিরি। কাজেই এর কিস্সা জমজমাট, রহস্য-সংকুল!
প্রথম রহস্য হল—১৬১৭ সালের শেষে গুজরাট অভিযানের সময় খমভট থেকে আহমেদাবাদের পথে যে ‘বাজরা খিচড়ি’ ওরফে ‘লাদরা’ খেয়ে উৎফুল্ল হয়ে তাকে নিজের দস্তরখওয়ানে পাকাপাকি জায়গা করে দিয়েছিলেন জাহাঙ্গির বাদশা, সেই বাজরা খিচড়ি ব্যাপারটা কী? সমস্যা হল, জাহাঙ্গির বাদশার আমলের কোনো প্রামাণ্য কুকবুক মানে পাকপ্রণালীর কেতাব আমি কোত্থাও পাইনি। মুঘলখানা-তহজ়িব এবং বিশেষত সেআমলের কুকবুক নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করেছেন দিব্যা নারায়ণ২। এই দুরন্ত গবেষণায় জাহাঙ্গির বাদশার সময়ের দরবারি খানা-সংস্কৃতির হদিশ পেতে তিনি মূলত নির্ভর করেছেন জাহাঙ্গিরনামা: তুজ়ুক-ই-জাহাঙ্গিরি-র ওপর। আর এই জাহাঙ্গিরনামা ঘেঁটে ঘুঁটে দেখেছি বাজরাখিচড়ি ছাড়া আর অন্য কোনোরকমের খিচুড়ির উল্লেখ সে কেতাবে নেই। এই যে বাদশা ঘটা করে লিখছেন, ‘বৃহস্পতিবার আর রবিবারে আমি মাংস খাই না—বৃহস্পতিবার খাই না কারণ ওই দিনে আমার অভিষেক হয়েছিল, এবং রবিবার, কারণ ওইদিনে আমার মহামহীম পিতা জন্মেছিলেন, এবং উনি এ ব্যাপারটাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন,’ এবং যেমনটা আমরা আগেই দেখেছি, সপ্তাহের ওই দিনগুলিতে, ১৬১৭-র ৩০ ডিসেম্বরের পর থেকে, তিনি প্রায়শই খেতেন বাজরাখিচড়ি, সেই বাজরাখিচড়ি বা লাদরা খাদ্যবস্তুটা কী? সে এক গভীর রহস্য। প্রামাণ্য কোনো সমাধান পাইনি। কেন পাইনি? দীর্ঘ রঙিন কিস্সা!
এই কিস্সার মূলে রয়েছে একটি খানা যার নাম বিভিন্ন ডাকসাইটে রাজা-বাদশার হেঁশেলের পাকপ্রণালীর রীতিমতো প্রামাণ্য কেতাবে উল্লিখিত হয়েছে— ‘জাহাঙ্গিরি খিচড়ি’। কী তবে এই ‘জাহাঙ্গিরি খিচড়ি’? একে একে খোঁজ করা যাক।
সে খোঁজের জন্য প্রথমেই আমরা ঢুকে পড়ব জাহাঙ্গির বাদশাহের পুত্রের হেঁশেলে—শহেনশা অস্-সুলতান অল-আজ়ম-ও-অলখাকান অল-মুকর্রম, মালিক-উল-সুলতানত, অলা-হজ়রত আবু’লম জ়ফ্ফর শাহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঐহিক বিলাস-ব্যাসনের, রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের বেমিসাল শওকিন খুররম বাদশাহের হেঁশেল নিয়ে কিন্তু বিশেষ কিছুই জানা যায় না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আকবরনামার (‘আইন’ আসলে যার অন্তর্গত তিনটি খণ্ড) মতো কোনো মহাকেতাব তাঁর আমলে রচিত হয়নি। আরও দুঃখের কথা ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭-এর মধ্যে ব্রিটিশ সরকার শাহজাহানের লালকেল্লার যে পঞ্চাশটি ইমারত ভেঙে ফেলে সৈন্যদের ব্যারাক, বসতবাড়ি, হাসপাতাল ইত্যাদি তৈরি করেছিল, তার মধ্যে ছিল শাহিমতবখ বা হেঁশেলগুলিও, যে হেঁশেল ছিল মুঘলাই ভারতীয় বৈচিত্র্যে ভরপুর খানা-সংস্কৃতির পীঠস্থান। ভাবলে কষ্ট হয়, একইরকমের বিপুল হেঁশেল সুন্দর করে সাজিয়ে মিউজিয়াম করে রাখা রয়েছে ইস্তানবুলের তোপকাপি প্রাসাদে। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে তাক লেগে গিয়েছিল।
তোপকাপি প্রাসাদের শাহিমতবখ-এর দুটি অংশ। লালকেল্লায় ছিল এমনই হেঁশেল—বৈচিত্র্যে ভরা মুঘলাই-ভারতীয় খানার পীঠস্থান। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার
লালকিলার মতবখ-এর কোনো বর্ণনাও পাইনি কোথাও, কিন্তু সে হেঁশেল কেমন হয়ে থাকতে পারে তা আন্দাজ করে নেওয়া যেতে পারে অন্য একটি কেতাব থেকে। আশ্চর্য এই কেতাব ফারসিতে লেখা। ১৯৫৬ সালে ছেপে তা প্রকাশ করে গভার্নমেন্ট ওরিয়েন্টাল ম্যানাস্ক্রিপ্টস লাইব্রেরি, ম্যাড্রাস। কেতাবের একটি উর্দু ভূমিকা লেখেন সৈয়দ মহম্মদ ফজ়ল উল্লাহ্। এই ভূমিকা থেকে এ কেতাব সম্পর্কে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারি। এক, এটি শাহজাহানের খাসহেঁশেলের রেসিপি-বুক। দুই, এটি কে লিখেছিলেন তা জানা যায় না, কিন্তু যেমনটা জানাচ্ছেন কেতাবটির সম্পাদক ফজ়লউল্লাহ সাহেব, এ কেতাবের ‘গোড়ার অনুচ্ছেদেই লিখিত ‘‘শাহজাহান পাদিশাহ্-র সরকারের খানাদানার রন্ধনপ্রণালীর ওজন সমেত নির্দেশাবলি’’ থেকে বোঝা যায় এই বই এমন একজন ব্যক্তি লিখেছেন যিনি শাহজাহানের বাদশাহি দস্তরখওয়ানের যাবতীয় খানাদানার বিষয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল ছিলেন। এবং তিন, এই কেতাবদুটি পাণ্ডুলিপি থেকে তৈরি—একটি চেন্নাইয়ের গভর্নমেন্ট ওরিয়েন্টাল ম্যানাস্ক্রিপ্ট্স লাইব্রেরিতে আছে, যার শিরোনাম নুসখা-ই-শাহজাহানি এবং অন্যটি লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রাখা, যার শিরোনাম নান-ও-নমক। দুটির লেখা প্রায় একই, কেবল লন্ডনের পাণ্ডুলিপিতে কিছু অতিরিক্ত পদের রান্নার কথা রয়েছে। ভালো কথা, ফারসি শব্দ ‘নুসখা’-র একটি মানে রেসিপি, পাকপ্রণালী। শাহজাহানের হেঁশেলের পাকপ্রণালী। আর ‘নান-ও-নমক’ তো সোজা, রুটি ও নুন! আর এই কেতাবের পাতা ওলটালেই মালুম চলবে শাহজাহান বাদশার রকাবদারেরা কী কাণ্ডই না করছিলেন এ খানাটিকে নিয়ে।
সে বিচ্ছুরণের পূর্ণাঙ্গ ছবি ক্রমে ফুটে উঠবে। আপাতত পাখির চোখ—বাজরা খিচড়ি আর খিচড়ি জাহাঙ্গিরি। ‘আর’ শব্দটা ব্যবহার করলাম কেন? যে খিচড়ির এত শওকিন জাহাঙ্গির বাদশা, তার নামই তো হওয়া উচিত জাহাঙ্গিরি খিচড়ি! দুটো তো সমার্থক হওয়াই যুক্তিযুক্ত। তাই কি? যেহেতু জাহাঙ্গিরনামাতে তাঁর প্রিয় খিচড়িটি পাকানোর কোনো তরিকা বলা নেই, ‘জাহাঙ্গিরি খিচুড়ি’ নামটার উল্লেখ যেখানে প্রথম মেলে খুলি সেই ফার্সি নুসখা-ই-শাহজাহানি৩। পাতা ওলটাই। সে এক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার—একপাতা থেকে আর-একপাতা, শাহিমতবখ—বাদশাহি হেঁশেলের একমহল থেকে অন্যমহল, এক খুশবু থেকে আর-এক সুবাস! তবে এখন তাতে মাতোয়ারা হওয়ার সময় আমাদের নেই, কারণ আমরা খিচুড়ির খোঁজে, সুনির্দিষ্ট ভাবে জাহাঙ্গিরি খিচড়ি আর বাজরার খিচড়ি। কাজেই আর সব কিছু টপকে আমরা হাজির হই শাহজাহানি খিচুড়ির হেঁশেলে৪—একেবারে যাকে বলে খিচুড়িমেলা, যে মেলা সত্যিকারের টেক্কা দেবে দুশো বছর পরের আর-এক হেঁশেল, যা ছিল মুঘল হেঁশেলের মতোই বৈচিত্র্যে ভরপুর—এই উত্তর কলিকাতার ঠাকুরবাড়ির হেঁশেল! কিন্তু সে কিস্সাও আপাতত তোলা থাক। তোলা থাক শাহজাহানি নুসখার খিচুড়িমেলাও। এখন শুধু একটির কথা—নুসখার ১০৭ পৃষ্ঠায় পাঁচনম্বরটির নাম খিচড়ি জাহাঙ্গিরি, যদিও মুদ্রণপ্রমাদে তা ছাপা আছে ‘জানগিরি’ বলে। কেন আমি নিশ্চিত যে এটি মুদ্রণপ্রমাদ, তা আমরা কিছু পরে দেখব। কিন্তু আগেভাগে এখন দেখে নেওয়া দরকার এর পাকপ্রণালী। আমি হুবহু তরজমা করে দিলাম—
খিচড়ি জাহাঙ্গিরি (নুসখা-ই-শাহজাহানি)
‘মাংস — ১ শের (৮৩৭ গ্রাম)৫
খিচড়ি মুগডাল — ১ শের (৮৩৭ গ্রাম) — ফের মুদ্রণপ্রমাদে ছাপা আছে ‘কিছড়ি’!
তেল — ৩ পোয়া (৬২৭ গ্রাম)
দারুচিনি — ২ মাশা (১.৯৪ গ্রাম)
ছোটোএলাচ — ২ মাশা (১.৯৪ গ্রাম)
লবঙ্গ — ২ মাশা (১.৯৪ গ্রাম)
পেঁয়াজ — ১/৪ শের (২০৯ গ্রাম)
আদা — ১ দাম (২০.৯ গ্রাম)
ধনে — ১ দাম (২০.৯ গ্রাম)
প্রথমে তেলে পেঁয়াজ ভেজে নিন। মাংস টুকরো টুকরো করে নিন। ভালো করে সাঁতলান। নুন ও ধনে দিন। ওলট-পালট করে নেড়ে নিন। জল দিন। একটু পরে খিচড়ি ধুয়ে দিয়ে দিন। ভালো করে রান্নার হয়ে গেলে, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ বাকি তেলের সঙ্গে দিন। (দুটো শব্দ দুষ্পাঠ্য) ঢেলে নিন।
বোঝো। প্রথমেই তো সাংঘাতিক জটিল রহস্য—এ খিচড়ি পেঁয়াজে ভাজা মাংসের গন্ধে ভরপুর। সুফিয়ানা দিনে এ খিচড়ি দস্তরখওয়ানে পড়লে মীর বকাওয়ল তো কোন্ ছার, শাহি মতবখ-এর প্রত্যেকের গর্দান যাওয়া কে আটকায়! এ হেন খিচুড়ির নাম ‘খিচড়ি জাহাঙ্গিরি’ কী করে হল? কূলকিনারাহীন রহস্য!
কিন্তু এখানেই শেষ নয়, আরও আছে—রহস্যের পর রহস্য, লক্ষ করুন, এ খিচড়িতে চাল ব্যবহারের কোনো উল্লেখ নেই! বিরিঞ্জ্ শব্দটাই স্রেফ নেই। চাল ছাড়া স্রেফ মুগডালের খিচুড়ি? এই প্রথম কোনো কুকবুকে এমন খিচুড়ির উল্লেখ পেলাম, যা আমরা পরে দেখব একটি বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক পুস্তকে যে পরম্পরাগত খিচুড়ির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে তাকেই চ্যালেঞ্জ করে!
আবার আর-এক জায়গায় লক্ষ করুন বলছে ‘খিচড়ি ধুয়ে দিয়ে দিন’! আন্দাজ করছি বলতে চাওয়া হয়েছে, খিচড়িমুগ ধুয়ে দিয়ে দিন। খিচড়িমুগটা কী জাতীয় মুগ সে আবার আর-এক রহস্য। আমি বহু খুঁজেও সঠিক উদ্ধার করতে পারিনি। যদিও অন্যান্য আরও কয়েক কিসিমের খিচড়ির রেসিপিতেও উল্লিখিত হয়েছে এই খিচড়ি মুগডালের কথা। কিন্তু একটা আন্দাজ করতে পারছি, মগজাস্ত্র প্রয়োগ করে, আইন-ই-আকবরি-র ব্লোচমানের করা তরজমা থেকে। আকবরি হেঁশেলে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রীর দামের যে তালিকা আইনে দেওয়া হয়েছে সেখানে ‘মুঁগ’ কথাটির পাশে ব্লোচমান ইংরেজিতে লিখে দিয়েছেন—Black gram (পৃষ্ঠা ৬৫)। যাকে আমরা বাংলায় বলি কাঁচা মুগ। তাহলে সম্ভবত, খিচড়ি মুগ হল ছাড়ানো, যাকে আমরা বলব সোনামুগ। আমার অনুমান যে ঠিক সেপ্রমাণও পরে পেয়েছিলাম। দু-বার!
আর লক্ষ্যণীয় এই যে, এ খিচড়ি হবে ‘রোগন’ মানে তেল দিয়ে, ‘রোগন-জ়র্দ’ মানে ঘি দিয়ে নয়। কী তেল? নুসখায় তার কোনো হদিশ নেই। মুশকিল হল, এর আগে আবু’ল ফজ়লও তার কোনো হদিশ দেননি। স্রেফ তেল বলেই ছেড়ে দিয়েছেন। ভারতে পরম্পরাগত ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে তিল তেল, সরষের তেল, বনস্পতি তেল এবং নারকোল তেল, অন্তত এই চারধরনের তেলের বিপুল ব্যবহার রয়েছে। রান্নার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর মধ্যে নারকোল তেল সাধারণ ভাবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা নয় খিচুড়ি পাকানোয়, কিন্তু বাকি তিনটের যে-কোনোটিই ব্যবহার হওয়া সম্ভব। সঠিক খুঁজে পাইনি।
আরও রহস্য আছে। এ খিচড়িতে মুখ্য উপাদান ‘গুশ্ত’, মাংস। কিন্তু কী মাংস? ফের ধন্দ। আমি যত মুঘল জমানার কুকবুক দেখেছি প্রত্যেকটিতে এ ধন্দ রয়েই গিয়েছে—কী তেল, আর কী মাংস? খুব কম রেসিপিতেই তা ভেঙে বলা আছে। কোনোধরনের খিচুড়ির রেসিপিতে তা কখনও বলা নেই। কিন্তু একটা জিনিস প্রায় নিশ্চিত—গোরুর মাংস নয়। গোরুর মাংস বাদশাহি দস্তরখওয়ানে পড়ত না বলেই আমার নিশ্চিত ধারণা। মহামতি আকবর বাদশার আমলে মুঘলসাম্রাজ্যের বহু অঞ্চলে গোহত্যা নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি প্রভাবশালী মুসলমানরাও এ আইন ভাঙলে পার পেতেন না। মুঘল যুগের বিশিষ্ট ইতিহাসকার ইকতিদার আলমখান প্রামাণ্য নথি উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন আকবর বাদশার জমানায় এক বিখ্যাত মুসলমান ধর্মগুরুকে (বর্তমান হরিয়ানা রাজ্যের) থানেসর থেকে (বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের) ভাক্করে নির্বাসিত করা হয়েছিল গোহত্যার অপরাধে। আলমখান জানাচ্ছেন শাহজাহানের আমল পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। পরের দিকে শাহজাহান সার্বিক ভাবে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও, মুঘল প্রশাসন এবং স্থানীয় উজির নবাবরা শহরাঞ্চলে গোহত্যার অনুমতি দিতেন না৬। অন্যদিকে, মুঘল বাদশাহি হেঁশেল ‘গুশ্ত-ই-গাও’—গোমাংস—ব্যবহৃত হওয়ার একটিও প্রামাণ্য নথি আমি কোত্থাও পাইনি। বরং আইন-ই-আকবরি হেঁশেলে ব্যবহৃত মাংসের যে তালিকা দিচ্ছে (পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭) তাতে গোমাংস সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আকবরি শাহি ‘মতবখ’-এ কী কী পশু-পাখির মাংস পাকানো হত?— দাশমন্ডি ভেড়া, আফগানি ভেড়া তিনপ্রকার, কাশ্মীরি ভেড়া, হিন্দুস্তানি ভেড়া, বরবারি ছাগল দু-প্রকার, ছাগল, রাজহংসী, হাঁস, তুঘদারি—যাকে ব্লোচমান তরজমা করেছেন ‘হুবারা বাস্টার্ড’ পাখি বলে, কুলাঙ্গ্—সারস পাখি, জর্জ়—আর-একপ্রকার বাস্টার্ড, দুররাজ—কালোতিতির, কাবক—চকোর এবং বুদন—কোয়েল।
পড়েই চোখছানা বড়া! সে কী! মুরগি কোথায়? আমাদের এত সাধের চিকেন? স্রেফ নেই। মুঘল রাজন্যদের পাতে গোরু বা চিকেন কোনোটাই পড়ত না। তাহলে মুর্ঘমসন্নম (যাকে আমরা মুসল্লম বলে চালাই)? সে অনেক পরের গপ্পো, এবং আমি একশো ভাগ নিশ্চিত নই, তবে সম্ভবত সেখানা অওধের হেঁশেলের জাঁকজমকের অঙ্গ। আকবরাবাদি বা শাহজাহানাবাদি—মানে আগ্রা দিল্লির খানা সে নয়।
গুশ্ত বলতে অবশ্য পশুর মাংসই বোঝানো হয়েছে। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি এ খিচড়িতে পড়ত হয় ভেড়া নয় পাঁঠা। তবে যে সে ভেড়া নয়, সে ভেড়া আসত আফগানিস্তানের দাশমন্ডি ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, কাশ্মীর থেকে ও মূল ভারত ভূখণ্ডের নানা জায়গা থেকে। আর বরবারি ছাগল হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের এখনও আকছার পাওয়া যায়। কিন্তু এর মধ্যে কোন্ মাংসটি বাদশা পছন্দ করতেন তাঁর খিচড়িতে, বা এক-একরকম খিচুড়িতে এক-একরকম মাংস পড়ত কি না, বলা অসম্ভব।
ইত্যাকার তথ্যে বলীয়ান হয়ে শাহজাহানি হেঁশেলে জাহাঙ্গিরি খিচড়ি নামে যে খানাটি তৈয়ার হল, তারই ছবি দিয়ে, বিশ্বাস করুন, এ কিস্তি শুরু করেছি। হ্যাঁ, ওটিও নাকি ‘খিচড়ি’!! আর-একবার দেখুন—
এই খিচড়ি জাহাঙ্গিরিতে ব্যবহার করলাম, বনস্পতি সাদা তেল, রেয়াজি পাটনাই খাসি, আর সোনা মুগডাল। স্বাদ মোটামুটি কীরকম? খুব সহজে বলতে পারি আজকে যে খানাকে ‘ডাল-গুশ্ত’ বলা হয়ে থাকে তার এক অতি, অতি, অতীব উপাদেয় নমুনা। আর বোঝা গেল, যে খিচড়ি খেয়ে জাহাঙ্গির বাদশা, আমাদের বাঁকুড়ার ভাষায় যাকে বলে ‘বকবক খুশি’ হয়েছিলেন তার, কিংবা ঝমঝমে বর্ষায় যে খিচুড়ি পাতে না পড়লে বাঙালির মনখারাপ হয়, নিজের বাপের নামে তৈয়ার খুররম বাদশার হেঁশেলের খিচড়ির সঙ্গে তার কোনোই তালুকাত নেই। তবু আমাদের নুসখার হেঁশেলে আরও খানিক্ষণ ঘুরঘুর করতে হবে। সে অ্যাডভেঞ্চারের কিস্সা পরের বিষ্যুদবার…
দারুন দারুন। এই খানা তল্লাশির পুরো রিপোর্ট নিচ্ছি প্রত্যেক বেষ্পতিবার করে। পরের শুনানির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
দুর্ধর্ষ হচ্চে।
আবারো ভালো লাগা। এত সব অজানা তথ্য! সুন্দর পরিবেশনা। ঠিক জাহাঙ্গিরের দস্তরখোয়ানের তরিজুতের মতই।
দারুন লাগছে। ইতিহাস টা উপরি পাওনা। মোগল শাসনের বেশ কিছুটা সময় গোহত্যা নিষিদ্ধ ছিল জানা ছিল না। লালকেল্লার অনেকগুলি ইমারত ইংরেজরা ধ্বংস করেছিল অজানা ছিল।