এর আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছিলাম বিনয় পিটকের যে তরজমা করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউহ্যাম কলেজের ফেলো এবং অ্যাসোসিয়েট, আই বি হর্নার, তাতে ‘তেকাটুলায়াগু’ নামে একটি খাদ্যের বিষয়ে তিনি জানাচ্ছেন তার স্বাদ কটু। এবং ফুটনোট দিয়ে এও জানাচ্ছেন, কটু হল তিন উপকরণে—আদা, ও দুইপ্রকার মরিচ! আর এ জন্য তিনি উদ্ধৃত করছেন বিনয়-র একটি প্রাচীনতর তরজমা—এফ ম্যাক্সমুলার সম্পাদিত ‘The Sacred Books of the East’-এর অন্তর্গত Vinaya Texts, Part II। তরজমাকার টি ডব্লিউ রাইস ডেভিড্স এবং হেরমান ওল্ডেনবার্গ।
অমনি এসে পড়ছে আর-একটা গল্প, এই বিনয় পিটকেরই—‘তারপর ভগবান পরিব্রাজন করতে করতে যথাসময়ে রাজগহতে এসে পৌঁছলেন। বেণুবনে যেখানে কাঠবিড়ালিদের খাওয়ার জায়গা সেইখানে রইলেন তিনি। সেইসময় তাঁর উদরে বায়ু-বিকার দেখা দিল। তখন প্রণম্য আনন্দ ভাবলেন, ‘‘গতবার ভগবনের উদরের বায়ু-বিকারের উপশম করেছিল কটু স্বাদের তেকাটুলায়াগু।’’ তিনি নিজে তিল, তণ্ডুল ও মুগ নিয়ে, কক্ষের অন্দরেই তা পরিশুদ্ধ করে, কক্ষের মধ্যেই পাক করে তা ভগবানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘ভগবন এই তেকাটুলায়াগু পান করুন।’’…
‘তারপরে ভগবান শ্রদ্ধেয় আনন্দের উদ্দেশে বললেন, ‘‘এই জাউ এল কোথা থেকে, আনন্দ?’’ প্রণম্য আনন্দ গোটা ঘটনাটা ভগবানকে বললেন।
রাজগহ-র গিজ্ঝকূট। বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে রাজগহ শহরে এলে এখানেই থাকতেন গোতম বুদ্ধ।
‘বুদ্ধ, ভগবান, তখন তাঁকে তিরস্কার করলেন এই বলে, ‘‘আনন্দ, এ কাজ তোমায় মানায় না, এ উপযুক্ত নয়, যথাযোগ্য নয়, সন্ন্যাসীর যোগ্য কাজ এ নয়, এ কাজ অনুমোদনযোগ্য নয়, এ কাজ করা যাবে না। আর এই বাহুল্যের জন্য কী করে পরিশ্রম করলে তুমি? তা ছাড়া, আনন্দ, যা কক্ষের অভ্যন্তরে শুচি করা হয়েছে তা অনুমোদনযোগ্য নয় এবং যা কক্ষের মধ্যে পাক করা হয়েছে তা অনুমোদনযোগ্য নয়, এবং স্বয়ং যা পাক করা হয়েছে তাও অনুমোদনযোগ্য নয়। যাঁরা (এখনও) প্রীত নন তাঁদের প্রীত করতে এ নয়, আনন্দ।…’’
তাঁকে তিরস্কার করে তিনি ভিক্ষুদের উদ্দেশে বললেন, ‘‘ভিক্ষুগণ, যা কক্ষে শুচি করা হয়েছে, পাক করা হয়েছে, যা স্বয়ংপাক করা হয়েছে তার ব্যবহার করা উচিত নয়।…’
এইভাবে কাহিনির মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে বুদ্ধের বাণী, এবং একান্ত কূতুহলীদের জন্য বলে রাখি, শেষপর্যন্ত রাজগহ, অর্থাৎ রাজগৃহে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, এবং নানা সমস্যার কথা শুনে বুদ্ধ ভিক্ষুদের তিনটিরই অনুমোদন দেন। কিন্তু এ সবের গূঢ় অর্থ হৃদয়ঙ্গম আমাদের এ মুহূর্তের খোঁজ নয়। আমাদের এ মুহূর্তের খোঁজ খিচুড়ির প্রাচীনতার রহস্যভেদ। আর সেই প্রসঙ্গেই আমাকে বলতে হবে, এই তরজমা আমি বিনয় পিটকের খন্ধক অংশের মহাবগ্গ পর্বের দুটি পৃথক ইংরেজি তরজমা থেকে নিয়েছি। একটি হল— The Book of Discipline. Vinaya-Pitaka. Volume IV. (Mahavagga). তরজমা করেছেন আই বি হর্নার১। অন্যটি—Vinaya Texts. The Mahavagga. Sixth Khandhaka. On Mendicants. পালি থেকে তরজমা করেছেন টি ডব্লিউ রাইস ডেভিড্স এবং হেরমান ওল্ডেনবার্গ২। দ্বিতীয়টির তরজমাকারদ্বয় তেকাটুলায়াগু-তে ফুটনোট দিয়ে লিখছেন — ‘That is, gruel containing the three pungent (katu) substances, which are explained to be ginger and two kinds of pepper.’৩ পালিভাষা ও বৌদ্ধ টেক্স্ট-এর বিষয়ে তিন প্রতিষ্ঠিত মহাপণ্ডিত। দুটি পৃথক বইতে বলছেন তিল-চাল-মুগ ছাড়াও এ জাউতে পড়ত আদা আর দু-ধরনের মরিচ। দু’ ধরনেরমরিচ? আলবৎ — তখনতোদু’ ধরনেরমরিচইচলত এ মহাভারতে — ‘ব্ল্যাকপেপার’ (পাইপার নিগ্রাম), গোলমরিচ, আর ‘লংপেপার’ (পাইপার লংগাম), যার কোনো বাংলা নেই। আয়ুর্বেদে খুব ছিল তার ব্যবহার। হিন্দিতে পিপলি। আমাজনে গেলেই মিলে যাবে, গোলমরিচের থেকে অনেকটা বেশি দাম অবিশ্যি। তখন এ দিয়েই আনা হত রান্নায় ঝাঁঝ। লঙ্কা তো সেদিনের ছোকরা ভূভারতে, পঞ্চদশ শতকের শেষে, পর্তুগিজদের আনা। একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, কোথায় ‘এক্সপ্লেন’ করা হচ্ছে যে কটু স্বাদের উপকরণগুলি আদা ও দুই মরিচ? মানতেই হবে, আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু ম্যাক্সমুলার তো বটেই রাইস ডেভিড্স, ওন্ডেনবার্গ২ এবং হর্নার, সকলেই এমনই বিদগ্ধ পণ্ডিত যে, আস্থা রাখতে দ্বিধা হচ্ছে না। কাজেই পেয়ে যাচ্ছি তেকাটুলায়াগু নামেই একেবারে অন্য একটি খানার রেসিপি—
আনন্দ তেকাটুলায়াগু (আমার আধুনিকীকরণের পর)
উপকরণ — গোবিন্দভোগ চাল, সমপরিমাণ সোনামুগ ডাল, এ দুইয়ের চারভাগের একভাগ সাদা তিল, আদা, গোলমরিচ, পিপলি। লবণ।
পদ্ধতি — প্রথমে পরিমাণ মতো আদাবাটা শুকনো পাত্রে হালকা করে ভেজে নিন। মুগডাল দিয়ে দ্রুত সাঁতলান। অল্প জল দিয়ে ডাল আধসিদ্ধ করুন। তিল ও চাল দিয়ে দ্রুত একটু নেড়েই প্রয়োজনমতো আরও জল ও নুন দিন। সুসিদ্ধ করুন। পরিমাণ মতো দুধরনের মরিচই একসঙ্গে দিয়ে ভালো করে নাড়ুন। প্রায় ঘাঁটা হবে এবং পাতলা হবে। নামিয়ে গরম পরিবেশন করুন।
রাঁধলাম। বিচিত্র স্বাদ! তবে মনে রাখতে হবে এই দুই তেকাটুলায়াগুই কিন্তু ‘পান’ করার জিনিস। তা বলে স্যুপ বা জলের মতো নয়। চিবোতে যেন না লাগে। যাকে বলে গলা-গলা।
বুদ্ধঘোষের তেকাটুলায়াগু নয়, খিচুড়ির যাত্রাপথে এক মোক্ষম মোড় আনন্দের তেকাটুলায়াগু। এবং এর দ্বিতীয়টির স্বাদই কটু, প্রথমটির হতে পারে না। নাম একই হওয়ায়, হর্নার সাহেব একটু গোলমাল করে ফেলেছেন বলেই আমার ধারণা। যে যাত্রা শাঙ্খায়ন আরণ্যকে শুরু করেছিল চাল আর মুগডাল মিলে, পথে জুটে গিয়েছিল সঙ্গী তিল, এতক্ষণে তাদের সেই পুষ্টিকর যাত্রা নানা মশলার অ্যাডভেঞ্চারে চটপটা হয়ে উঠল বুদ্ধের তিরস্কার কপালে নিয়ে!
কিন্তু কোন্ ক্ষণে? নির্ভরযোগ্য আন্দাজের একটা উপায় গোতম বুদ্ধের জীবৎকাল—অধিকাংশ ইতিহাসকারের মতে পূর্বসাধারণাব্দ ষষ্ঠ থেকে পূর্বসাধারণাব্দ চতুর্থ শতকের মধ্যে। কাজেই সেটাই ধরা যেতে পারে তেকাটুলায়াগুর সময়কাল, কারণ তাঁকেই তো পরিবেশন করা হয়েছিল এই তেকাটুলায়াগু। অথবা আরও সুনিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে বিনয় পিটকের মহাবগ্গ অংশটি রচনার কালে। কখন সেটা? এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্তর তর্ক আছে। তবে বহু বিবেচনা করে টি ডব্লিউ রাইসডেভিড্স এবং হেরমান ওল্ডেনবার্গ তাঁদের বিনয়-র তরজমার ভূমিকায় লিখছেন, এক ‘পরিবার’ অংশটি বাদ দিয়ে, বিনয় পিটকের বিভঙ্গ এবং খন্ধক অংশগুলি—মহাবগ্গ যার অন্তর্গত—অন্তত ‘৩৬০ বা ৩৭০ পূর্বসাধারণাব্দের তিরিশ বছর আগে বা পরের’ মধ্যে রচিত, পাতিমোক্খ আরও প্রাচীন।
কাজেই একটু সরল করে বলতে পারি, রসনার নিরিখে ৬০০ পূর্বসাধারণাব্দ থেকে ৩৫০ পূর্বসাধারণাব্দ পর্যন্ত এই সাড়ে তিনশো বছরের মধ্যে খিচুড়ি প্রথমে চালে-মুগডালে চলা শুরু করে, কিছুকাল চালে-তিলে-ডালে মিলেমিশে থেকে অবশেষে আদা মরিচের মশালেদার খানায় রূপান্তরিত হল আরণ্যকীয় ধর্মভাবনার দিনকাল থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদের দমবন্ধ দাপট হয়ে বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে বৌদ্ধ মঠের অনুশাসনে। যদিও তখনও, এবং তার বহুদিন পর পর্যন্ত সে নিজেকে কী নামে জাহির করবে তা ঠিক করে উঠতে পারছিল না, কারণ ভাষাতাত্ত্বিকেরা খাতায় তার যে নাম তুলে দিয়েছেন সে নামে চলছিল একেবারেই অন্য কিসিমের একটা খানা। কিন্তু আমরা দেখব, এই ‘কানাছেলের নাম পদ্মলোচন’ সমস্যার একটা সমাধান দিব্যি হয়ে গিয়েছিল, কালে কালে।
আনন্দের তেকাটুলায়াগু চাল-ডালের খিচুড়ির রহস্যের উপর খানিকটা আলো ফেলল, খানিকটা এগোনো গেল। সেখানায় আমরা ফিরব, কিন্তু তার আগে আমাদের তদন্তের ভৌগোলিক পরিসরটাকে আর-একটু বড়ো করে নিতেই হবে, ভাষা, সংস্কৃতি, খানাদানার তৌর-তরিকার পরিসরটাকেও। এতক্ষণ আমরা ছানবিন করেছি মূলত উত্তর, পশ্চিম, মধ্য ও পূর্ব ভারতের বেশ একটা বড়ো অঞ্চল জুড়ে। এবার টপকানো দরকার বাধার বিন্ধ্যাচল। দক্ষিণ ভারত। টপকাব, পরের অধ্যায়ে!
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)
পিপুল
অদ্ভুত বিষয়। খুব ভালো। কত কিছু জানতে পারলাম
অদ্ভুত বিষয়। খুব ভালো। কত কিছু জানতে পারলাম
পিপলি বাংলায় পিপুল আয়ুর্বেদে আজও ব্যবহৃত হয়