বিভিন্ন শাস্ত্র ছাড়াও কৃসর-র বারংবার উল্লেখ মেলে হরেক কিসিমের পুরাণে। যেমন গরুড়পুরাণে। একাধিক জায়গায়। রম্ভা-তৃতীয়া ব্রত পালনের সময় আর পাঁচ রকম ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে কৃসরা সাবড়ালে কপাল ফিরে যাবে১! কিংবা যেমনটা দেখছি এই পুরাণেরই ‘ধন্বন্তরি সংহিতা’ অংশে, ‘এমনকি শূদ্রের নিকট হইতেও গ্রহণ করা যাইতে পারে কাঞ্জিকম২, দই, দুধ, ঘোল, মাংস, মধু এবং কৃসর কোনো রূপ শাস্তি ছাড়াই’। চমৎকার, শূদ্র বলে গালমন্দ করি তো কী, সে যদি ভালো ভালো জিনিস দেয়ই, নেব না? তা হয়?! তবে তার পরের বাক্যটি আমার কাছে আরও চমৎকার মনে হল, ‘কোনও ব্রাহ্মণ যদি গৌড়ী, পৈষ্ঠী কিংবা মাধ্বীকম৩ জাতীয় মাদক পানীয় পান করেন তবে তিনি তাঁহার পাপস্খলন করিতে পারিবেন অগ্নিবর্ণের মদিরা অথবা গোষ্পদ কিংবা গোমূত্র পান করিয়া!’ শাবাশ! বিকল্পগুলি অনবদ্য—আগুন-রঙামদ, গোবর কিংবা গোরুর মূত্র! কোন্ সময়ের এই গরুড়পুরাণ? বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত লুডো রচারও এ বিষয়ে নিশ্চিত নন, তবে তিনি এস বি চৌধুরী এবং এ সি ব্যানার্জি-কে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন, সব প্রক্ষিপ্ত অংশ ধরে নিয়ে এর সময়কাল ‘দশম বা একাদশ শতকের আগে নয়’৪।
হিন্দু পৌরাণিক টেক্সটগুলোতে ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপট কায়েম রাখার হরেক কিসিমের ফন্দিফিকির আর তার সঙ্গে কৃসর-র জড়িয়ে পড়ার বেশ মজাদার প্লটটা অব্যহত স্কন্দপুরাণেও। যেমন এ পুরাণের আবন্ত্য খণ্ডে, যেখানে মার্কণ্ডেয় মুনি রাজনকে শোনাচ্ছেন নানা তীর্থ-মাহাত্ম্যের কথা, কামদতীর্থ পরিচ্ছেদের কিছুটা এ রকম—‘তৎপরে, হে রাজন্, সেই স্বর্গীয় তীর্থে যাওয়া উচিত যে তীর্থে গমন করিলে নারী ও পুরুষ উভয়েই দাম্পত্যের পরমানন্দ লাভ করিবে।
‘হে মহারাজন্, কোনও হতভাগ্য পুরুষ অথবা নারী পবিত্র স্নান সারিয়া ঊমা ও রুদ্রের স্তব করিলে সে দাম্পত্যসুখ লাভ করিবে।
‘উক্ত ব্যক্তিকে নিজ ইন্দ্রিয়ের সংযম বজায় রাখিতে হইবে, তৃতীয়ায় এক দিবস ও এক রাত্রি উপবাসে থাকিতে হইবে। সুদর্শন এক ব্রাহ্মণ ও তাঁহার স্ত্রীকে আমন্ত্রণ করিতে হইবে।
‘সুবাসিত মাল্য পরিয়া, সুমিষ্ট গন্ধের ধূপ ইত্যাদি জ্বালাইতে হইবে এবং সুন্দর বস্ত্র পরিহিত হইয়া থাকিতে হইবে।
‘পবিত্র চিত্তে তাহাকে পায়েস ও কৃসর খাওয়াইতে হইবে এবং তাহাকে যথাযথ ভাবে চক্রাকারে পরিক্রমণ করাইতে হইবে…
‘এবং উক্ত ব্রাহ্মণ দম্পতিকে গৌরী ও শিবের মানবরূপ জ্ঞান করিয়া, সেই ব্যক্তি তাঁহাদিগকে শ্বেত, লোহিতবর্ণ ও পীতবর্ণের অপূর্ব বস্ত্রদান করিবে। তাঁহাদিগকে বিবিধ পুষ্প ও অতি সুগন্ধী ধূপ জ্বালাইয়া আপ্যায়ন করিতে হইবে। একটি স্বর্ণহার উপঢৌকন দিতে হইবে। তাঁহাদিগের শরীরে জাফরান প্রলিপ্ত করিতে হইবে। এইরূপ সুন্দরভাবে তাঁহাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া, তাঁহাদিগকে কঙ্কন, কর্ণাভরণ, কণ্ঠহার এবং অঙ্গুরীয় উপঢৌকন দিতে হইবে। সপ্তপ্রকার শস্য দান করিয়া তাঁহাদিগকে আহার করাইতে হইবে, হে মহান রাজন্।
‘তীর্থক্ষেত্রে ভক্ত অন্যান্য কিছুও দান করিতে পারেন…
‘পুত্রহীন পুত্র লাভ করিবে। ধনহীন ধনবান হইবে। হে মহারাজন্ এই তীর্থ, যাহা সকল বাসনা পূর্ণ করিতে পারে, তাহা নর্মদা তীরে অবস্থিত।’৫
এ কোন্ কালের কথা? স্কন্দপুরাণ যুগ যুগ ধরে রচিত হয়েছে। সুপণ্ডিত হ্যান্স বেকার অনুমান করেছেন এর যে পাণ্ডুলিপিগুলি মেলে সেগুলি নবম শতকের একেবারে গোড়া থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচিত৬। ভালো কথা পণ্ডিত গণেশ বাসুদেব রাও তাগাড়ে, যাঁর ইংরেজি তরজমা অনুসরণ করেই আমার এই ছোট্ট অনুচ্ছেদটির বাংলা তরজমা, তিনি ‘কৃসর’ শব্দটির পাশে বন্ধনীতে লিখে দিচ্ছেন—Sweet balls made of white gingelly seeds. সাদা তিলের মিঠা লাড্ডু! মানে তিলের নাড়ু!
হিন্দুধর্মের অষ্টাদশ প্রধান পুরাণের অন্যতম পদ্মপুরাণের স্বর্গ খণ্ডের ৫৬ নম্বর অধ্যায়ে, সাফ বলে দেওয়া আছে কী কী খেলে ব্রাহ্মণের স্বর্গলাভের সম্ভাবনা মাটিংচার হয়ে যেতে পারে। তার প্রথম বাক্যই বলে দিচ্ছে, ‘কোনও দ্বিজর মায়া বা আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হইয়া শূদ্রের অন্ন গ্রহণ করা উচিত নহে। বিপাকে না পড়িয়াও তাহা করিলে উক্তজন পরজন্মে শূদ্র হইয়া জন্মিবে। যে দ্বিজ ছয় মাস ধরিয়া শূদ্রের নিষিদ্ধ আহার ভক্ষণ করিবে সে ইহকালেই শূদ্র হইয়া যাইবে ও পরজন্মে কুক্কুর হইয়া জন্মিবে৭।’ বিপাকের ফাঁকটা লক্ষ করে মজা লাগল। পদ্মপুরাণের খানাদানার বিধিনিষেধের তালিকা দীর্ঘ আর সে তালিকা এই পুরাণ রচয়িতাদের মতে আদর্শ হিন্দুসমাজের এক আশ্চর্য ছবি। এ মহাভারতের বিচিত্র ইতিহাসে সে সমাজ তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল কি হয়নি তা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু আনুমানিক চতুর্থ শতক থেকে একেবারে সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষ্যে লেখা পদ্মপুরাণের লেখক তথা হিন্দুধর্মের হর্তাকর্তারা যে সমাজ গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন, এই হারাম-খানার তালিকা সেই সমাজের এমনই এক পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি যে এন এ দেশপাণ্ডের ইংরেজি তরজমা থেকে কয়েকটি অনুচ্ছেদ বাংলায় তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না—‘তিনি ছয় (প্রকার) খাদ্য পরিহার করিবেন: রাজার খাদ্য, নর্তক-নর্তকীর খাদ্য, হিজড়ার খাদ্য, জুতা প্রস্তুতকারকের খাদ্য, বহু ব্যক্তির জন্য প্রস্তুত করা খাদ্য, গণিকার খাদ্য। তিনি পরিহার করিবেন তৈলিকের খাদ্য, রজকের খাদ্য, তস্করের খাদ্য, মদ্য প্রস্তুতকারীর খাদ্য, গায়ক-গায়িকার খাদ্য, কর্মকারের খাদ্য এবং মৃত ব্যক্তির (দ্বারা অশুচি হইয়া যাওয়া) খাদ্য। (তিনি পরিহার করিবেন) কুম্ভকারের অথবা চিত্রশিল্পীর খাদ্য, এবং কুসীদজীবীর অথবা পতিত ব্যক্তির খাদ্য, তেমনই যে বিধবা পুনরায় বিবাহ করিয়াছে তাহার পুত্রের খাদ্য, ছত্রবাহকের খাদ্য, তেমনই পরিহার করিবেন যে ব্যক্তি অভিশপ্ত তাহার খাদ্য, স্বর্ণকারের খাদ্য, অভিনেতার খাদ্য, শিকারীর খাদ্য, নিঃসন্তান নারীর খাদ্য এবং যে নারী দুর্দশাগ্রস্ত হইয়াছে তাহার খাদ্য; তেমনই (তিনি পরিহার করিবেন) চিকিৎসকের খাদ্য, অপবিত্র মহিলার খাদ্য এবং লগুড়হস্ত ব্যক্তির খাদ্য। (তিনি পরিহার করিবেন) তস্করের খাদ্য, ঈশ্বরে অবিশ্বাসীর খাদ্য, দেবতাগণের নিন্দা করিয়া থাকেন এমন ব্যক্তির খাদ্য, জলবিক্রেতার খাদ্য এবং বিশেষ করিয়া চণ্ডালের খাদ্য। (তিনি পরিহার করিবেন) স্ত্রৈণ ব্যক্তির খাদ্য, সেই ব্যক্তির খাদ্য যে তাঁহার স্ত্রীর প্রেমিক হইয়াও তাঁহার গৃহে বসবাস করেন; তেমনই তাহার (খাদ্যও) যে পরিত্যক্ত হইয়াছে, যে অতি প্রশংসা করিয়া থেকে, তেমনই তাহার খাদ্যও যে (অন্যের) উচ্ছিষ্ট আহার ভক্ষণ করিয়াছে। (তিনি পরিহার করিবেন) পাপিষ্ঠের আহার, একত্রে বসবাসকারী একাধিক ব্যক্তির দ্বারা প্রস্তুত করা খাদ্য, এবং পেশাদার সৈন্যের খাদ্যও। (তিনি পরিহার করিবেন) ভীতব্যক্তির খাদ্য, ক্রন্দনরত ব্যক্তির খাদ্য, নিম্নমানের ও অপচয় করা হইয়াছে এমন খাদ্য। (তিনি পরিহার করিবেন) তেমন ব্যক্তির খাদ্য যে ব্রাহ্মণ (অথবা বেদ) ঘৃণা করিয়া থাকে, যে পাপ করিয়া আনন্দ লাভ করে, শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতকৃত খাদ্য, অথবা মৃতব্যক্তির (উদ্দেশে আয়োজিত আচারের জন্য প্রস্তুত) খাদ্য, অথবা যে খাদ্য অকারণে প্রস্তুত করা হইয়াছে, তেমনই সেই খাদ্যও যা মৃতদেহের (দ্বারা অশুচি হইয়াছে) অথবা দুর্দশাগ্রস্তের খাদ্য। (তিনি পরিহার করিবেন) নিঃসন্তান মহিলাদের খাদ্য৮, তেমনই অকৃতজ্ঞ ব্যক্তির খাদ্যও; (তিনি পরিহার করিবেন) বিশেষ রূপে কারূকের খাদ্য, এবং অস্ত্রের বাণিজ্যকারীর খাদ্য। (তিনি পরিহার করিবেন) সুরাসক্ত ব্যক্তির খাদ্য, ঘণ্টাবাদকের খাদ্য, তেমনই চিকিৎসকের খাদ্যও; বিদ্দ্বজ্জনের সন্তানের খাদ্য, তেমনই সেই ব্যক্তির খাদ্যও যে তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহের পূর্বেই বিবাহ করিয়াছে। (তিনি পরিহার করিবেন) বিশেষ রূপে যে বিধবা পুনরায় বিবাহ করিয়াছে তাহার খাদ্য, এবং যে নারী দ্বিতীয়বার বিবাহ করিয়াছে তাহার স্বামীর খাদ্যও। (তিনি পরিহার করিবেন) ঘৃণ্য খাদ্য, অন্যের প্রত্যাখ্যাত খাদ্য এবং (যাহা প্রস্তুত করা হইয়াছে) ক্রোধ ও সন্দেহের বশবর্তী হইয়া। যদি তাঁহার গুরুর খাদ্য শুচি করা না হইয়া থাকে তবে তাহাও তিনি খাইবেন না। একজন ব্যক্তির যাবতীয় কুকর্ম তাহার খাদ্যে জমিয়া থাকে।
‘যিনি অন্য ব্যক্তির খাদ্যগ্রহণ করিয়া থাকেন তিনি তাহার পাপও ভক্ষণ করিয়া থাকেন। যে বন্ধু মিশ্র জাতের, অথবা নিম্ন পরিবারের, যে রাখাল, যে মুটে, যে নরসুন্দর তাহাকে শূদ্রদের মধ্যে (অর্থাৎ শূদ্রদের সহিত) আহার পরিবেশন করিতে হইবে; তেমনই যে নিজেকে জাহির করিয়া থেকে তাহাকেও। চারণকবি, কুম্ভকার, ও কৃষকের মেধা কত সামান্য তাহা লক্ষ করিয়া জ্ঞানীজন তাহাদের আহার শূদ্রদের সহিত পরিবেশন করিবেন। দুগ্ধে পাক করা চাউল, তেমনই (যে খাদ্য) তৈলে রন্ধন করা হইয়াছে, দধি (অথবা ঘোল), যবের অন্ন, তৈলের খোল এবং তৈল ব্রাহ্মণেরা শূদ্রদের নিকট হইতে গ্রহণ করিতে পারিবে।
‘কিন্তু (তিনি পরিহার করিবেন) বর্ত্তুকা, পদ্মের কাণ্ড, কুসুম্বগুল্ম, সোনা অথবা রূপা, পলাণ্ডু, গৃঞ্জন, অম্লমণ্ড; তেমনই ছত্রাক (মাশরুম), বন্য শূকর, বাচ্চা প্রসব করিয়াছে এ রূপ গাভির পরবর্তী সাত দিবসের দুগ্ধ, বিলয় (একপ্রকার দুগ্ধজাত খাদ্য), এবং বিবিধ ছত্রাক। লোহিত বর্ণের ক্ষুদ্র গৃঞ্জন, কিংশুক পুষ্প৯, অলাবু, উদুম্বর১০ ভক্ষণ করিলে দ্বিজ পতিত হইবেন। তেমনই তিনি পরিহার করিবেন কৃসর, গমের আটার পিঠা, দুগ্ধের পিঠা, যজ্ঞের জন্য হত্যা করা হয় নাই এ রূপ (পশুর) মাংস, তেমনই দেবতাগণের উদ্দেশে নিবেদিত খাদ্য, অম্ল মণ্ড, লেবু, কোনও আচারের প্রয়োজনে হত্যা করা হয় নাই এরূপ মৎস্য; তেমনই অতিসাবধানে পরিহার করিবেন কদম্ব পুষ্প, বিল্ব, উদুম্বর, তৈল নিষ্কাশিত হইবার পর তৈলের খোল এবং ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত শস্য।
‘রাত্রিকালে তিনি সাবধানে দধি সহযোগে তিল আহার থেকে বিরত থাকিবেন। তিনি দুগ্ধ ও ঘোল একত্রে পান করিবেন না; তিনি নিষিদ্ধ কোনও আহার ভক্ষণ করিবেন না। তিনি কীট অথবা চিন্তা দ্বারা নষ্ট হইয়া যাওয়া এবং মৃত্তিকার সংস্পর্শে আসা আহার পরিহার করিবেন। তিনি সর্বদাই কীটপতঙ্গ দ্বারা নষ্ট হইয়া যাওয়া খাদ্য এবং অসুস্থ বন্ধু দ্বারা প্রস্তুত করা খাদ্য পরিহার করিবেন। কুক্কুর যে খাদ্যের ঘ্রাণ লইয়াছে তাহা পরিহার করিবেন। পরিহার করিবেন দ্বিতীয়বার রন্ধন করা খাদ্য ও যে খাদ্যের দিকে চণ্ডাল দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়াছে। তেমনই যে খাদ্য ঋতুমতী নারী, অথবা পতিতজন অথবা গাভি ঘ্রাণ করিয়াছে। (যথাযথ রূপে) সংগৃহীত হয় নাই, পচন ধরিয়াছে অথবা ছড়াইয়া ফেলা রহিয়াছে এ রূপ খাদ্য তিনি সর্বদা পরিহার করিবেন; তেমনই তিনি কাকের ও কুক্কুটের স্পর্শ করা ও কীটপূর্ণ খাদ্য পরিহার করিবেন; তেমনই সে খাদ্যও যাহা কোনও মানুষ ঘ্রাণ করিয়াছে অথবা কুষ্ঠরোগী স্পর্শ করিয়াছে।
‘ঋতুমতি, পতিতা ও অসুস্থ কিংবা অপরিষ্কার বস্ত্র পরিহিতা নারীর নিকট হইতে তিনি খাদ্য গ্রহণ করিবেন না। তিনি অপরের বস্ত্র (ব্যবহার) পরিহার করিবেন। মনু কহিয়াছেন যে, যে-গাভির বাছুর নাই, অথবা দশদিনের কম বয়স্ক বাচ্চা রহিয়াছে এরূপ ছাগীর অথবা এরূপ ভেড়া বা গাভি যাহা সবে সঙ্গম করিয়াছে তাহাদিগের দুগ্ধ পানের যোগ্য নহে।
‘তিনি সারসের, বলাকার, রাজহংসের, ডাহুক পক্ষীর, চড়াই পক্ষীর, শুক পক্ষীর, তেমনই বক পক্ষীর, তিতির পক্ষীর, হংসীর, কোকিলের, বায়সের, দোয়েল পক্ষীর, বাজের, শ্যেনের, তেমনই পেঁচার, ব্রাহ্মিণী হংসের, শ্যেনের (অথবা কুক্কুটের), পারাবতের, কপোতের, টিট্টিভ পক্ষীর, গৃহপালিত কুক্কুটের, সিংহের, ব্যাঘ্রের, মার্জারের, শুকরের, শৃগালের, বানরের এবং গাধার মাংস ভক্ষণ করিবেন না। তিনি সর্প, মৃগ, ময়ুর, জলচর ও স্থলচর প্রাণী ভক্ষণ করিবেন না। ইহাই স্থির বিধি। হে শ্রেষ্ঠজন, প্রজাপতি মনু কহিয়াছেন, পঞ্চ নখবিশিষ্ট নিম্নোক্ত পশু সর্বদাই ভক্ষণ করা যাইতে পারে: কুম্ভীর, কুর্ম, শশক, তৈতিল ও শল্লকী। শল্ক রহিয়াছে এরূপ মৎস্য, রুরুমৃগ১১, ভক্ষণকরাচলিতেপারেঈশ্বর ও ব্রাহ্মণদের উদ্দেশে দান করিয়া, নচেৎ নহে। হে মহান ব্রাহ্মণগণ, তেমনই রূপে ভক্ষণ করা যাইতে পারে ময়ূর, টিট্টিভ, পারাবত, চাতক, তৈতিল, সারস পক্ষী এবং রাজহংস। প্রজাপতি এমনই কহিয়াছেন। নিম্নোক্ত মৎস্যসকল ভক্ষণযোগ্য বলিয়া নির্দেশ রহিয়াছে: শফরী, সিংহতুণ্ড, পঠীন এবং রোহিত। দ্বিজের (সম্মান অব্যহত রাখিবার) আকাঙ্ক্ষা হইলে তিনি এই মৎস্যসকল জল ছড়া দিয়া খাইতে পারেন, মৃত্যুমুখে পতিত হইলেও তঁহাকে ইহাদের ব্যবহার যথাযথ রূপে করিতে হইবে। তিনি কোনও পরিস্থিতিতেই মাংস ভক্ষণ করিবেন না। যাহা অবশিষ্ট রহিয়াছে তাহা কেহ ভক্ষণ করিলে তাঁহার দেহে (পাপ) লাগিবে না। তিনি দুর্বল হইয়া পড়িলে ঔষধ রূপে, অথবা অন্যের আদেশে, অথবা যজ্ঞের প্রয়োজনে মাংস ভক্ষণ করিতে পারিবেন। শ্রাদ্ধে আমন্ত্রিত হইয়া অথবা কোনও ভগবানের পূজাচারের কালে মাংস ত্যাগ করিলে তিনি ওই পশুটির দেহে যে কয়টি রোম রহিয়াছে সেই সংখ্যক দিবস নরকে যাইবেন (অর্থাৎ বাস করিবেন)। নির্ধারিত বিধি এই যে, দ্বিজ মদ্যপান করিবেন না, দান করিবেন না, স্পর্শ করিবেন না, দর্শন করিবেন না। অতএব তিনি সর্বত সচেষ্ট হবেন মদ্যপানে বিরত থাকিতে। মদ্যপান করিলে তিনি পতিত হইবেন এবং বাক্যালাপের যোগ্য থাকিবেন না। যে আহার ও পানীয় নিষিদ্ধ তাহা পরিত্যাগ না করিয়া গ্রহণ করিলে দ্বিজ (সম্মানলাভের) উপযুক্ত থাকিবেন না। তিনি (ওইসকল পান ও আহার) করিতে থাকিলে রৌরব (নরকে) নিক্ষিপ্ত হইবেন।’
খানাদানার উপর প্রতিফলিত ব্রাহ্মণ্যবাদের এই পুরুষতান্ত্রিক দাপট জারির আপ্রাণ চেষ্টার পটভূমিতেই শতকের পর শতক ধরে কৃসর বা কৃসরার বেড়ে ওঠা। পুরাণের পর পুরাণ উদ্ধৃত করে আমি একাহিনি চালিয়ে যেতে পারি, কিন্তু তা ডালের ফেনার মতো অপ্রয়োজনীয়, পরিহার্য। নিতান্ত আগ্রহীদের জন্য শুধু বলে রাখি, এই তিন পুরাণ ছাড়াও আমি কৃসর-র উল্লেখ পেয়েছি, ব্রহ্মপুরাণ, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, শিবপুরাণ এবং নীলমতপুরাণে। এর মধ্যে নীলমত নিয়ে দু-কথা বলতেই হয়, কারণ তা সুনির্দিষ্ট ভাবে ইঙ্গিত করে আনুমানিক ৬০০ এবং ৮০০ সাধারণাব্দের মধ্যে এ পুরাণ রচিত১২ হওয়ার সময় কাশ্মীরিরাও কৃসর খাচ্ছিলেন। এটি ‘কাশ্মীরীপুরাণ, কলহন যার উল্লেখ করেছেন কাশ্মীরের প্রাচীন ইতিহাসের একটি সূত্র হিসেবে১৩। এ পুরাণ শুরুই হচ্ছে বৈশম্পায়নকে জনমজয়ের করা একটি মোক্ষম প্রশ্ন দিয়ে—মহাভারতের যুদ্ধে কাশ্মীরের রাজা অংশ নিলেন না কেন? আর এরই ৩৯৪ নম্বর শ্লোকে দেওয়া হচ্ছে নিকুম্ভকে কৃসর নৈবেদ্য দিয়ে পুজো করার নির্দেশ১৪। মনে মনে নোট করলাম, মহাভারতের মহাযুদ্ধেও কাশ্মীর পৃথকই ছিল, যুদ্ধ যেখানে তাকে সঙ্গে নিতে পারেনি, রসনা তার সঙ্গে তৈরি করল একটা যোগসূত্র।
এই সমস্ত কিছু থেকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যেতেই পারে—আজকের খিচুড়ির যে মৌলিক রূপ, চাল ও ডালের যুগলবন্দি, প্রণম্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যে কৃসরাকে বলছেন খিচুড়ির পূর্বজ, প্রাচীনকালে বিস্তীর্ণ সময় ধরে কাশ্মীর থেকে পাঞ্জাব, মধ্যভারত, পশ্চিমভারত পর্যন্ত বিপুল ভূখণ্ডে, ১০০ পূর্ব সাধারণাব্দ থেকে ৯০০ সাধারণাব্দ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ সময়কালে সেই কৃসর বা কৃসরা তা ছিল না। বরং বলা যেতে পারে তা ছিল চাল-তিলের যৌথ সঙ্গীত, যাতে কখনো-কখনো সংগত করত দুধও। তাতে কী মশলাপাতি পড়ত, বা আদৌ পড়ত কি না, তার কোনো প্রামাণ্য উত্তর নেই।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)
সঙ্গে আছি, চলুক, চলুক।