কিছুদিন আগে বাংলা রসনাকল্পদ্রুম উদ্যানের এক অতিবিলাসী মালাকার রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কিছুদিন আগে একটি আলোচনার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দাদা এই যে বিহারিরা বলেন ‘খিচড়িকে হ্যায়ঁ চার ইয়ার/দহি পাপড় ঘি আচার’ এ প্রবচন কোথা থেকে এল? বলেছিলাম, একদম জানি না। যদি কখনও জানতে পারি তোমায় পাক্কা জানাব। গত পর্ব থেকে ইসলামি জমানার যে অসাধারণ কুকবুক ‘নিমতনামা’ ও তাতে খিচুড়ির হাল-হকিকত নিয়ে আলোচনা চলছে, সেই নিমতনামাতেই মিলে গেল রজতের প্রশ্নের অর্ধেক উত্তর। বা দুই তৃতীয়াংশ উত্তর।
গত পর্বে যে দুই খিচুড়ির উল্লেখ করেছি, তা ছাড়া এ কেতাবে আর তেরো জায়গায় খিচড়ি-র উল্লেখ আছে। আর তার মধ্যেই আছে এক ভারী গোলমেলে রহস্য, যা আমি তো কোন্ ছার কেতাবটির তরজমাকার ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত টিটলি মেমসাহেবও সমাধান করতে পারেননি। আসলে, এই যে ১৫ জায়গায় উল্লিখিত ‘খিচড়ি’, তার মধ্যে রয়েছে পাঁচ কিসিমের খিচড়ির রেসিপি—১। মেথি দিয়ে ঘি সুবাসিত করে রাঁধা খিচুড়ি, ২। কড়হরি খিচড়ি, ৩। ঘি বা বাদাম তেলে বা তাজা মাখনে রাঁধা খিচুড়ি, ৪। দুঘ বা কঞ্জি বা লেবুর রস বা তেঁতুলের রস বা টক কমলার রস বা সুবাসিত জল বা পুদিনার রস বা আমলকির রস বা কুমড়োর রস বা কাঁঠালের রস বা ডেউয়া ফলের রস, বা কর্পূরের জল বা কস্তুরীর জলে চাল আর মুগডাল ভিজিয়ে রেখে তৈরি খিচুড়ি এবং ৫। দই দেওয়া গমের খিচুড়ি।
এর মধ্যে কয়েকটি শব্দ একটু ভেঙে বলা দরকার। দুঘ। এককথায় ঘোল। ইরানে গিয়ে পদে পদে ঘোল খেয়েছি। আর তুরস্কে এই ঘোলই খেয়েছি আয়রান নামে, এবং গ্রিসে ঘোল খেয়েছি আরিয়ানি নামে। অবশ্য এ পানীয়তে কিছুটা পাতলা দইও থাকে। কঞ্জি, তামিল শব্দ, চাল সিদ্ধ করে তৈরি লপসি। এখন ইংরেজিতে Conjee নামে চলে। ঠিক কড়ি আর ‘কারি’-র মতো। কড়হরি যে কী তা আমি মোটেই ঠাওর করে উঠতে পারিনি। টিটলি ফুটনোট দিয়েছেন—একধরনের বাদাম। এবং আন্দাজ করেছেন, সম্ভবত তা বেটে দেওয়া হত। ভালো কথা, ঘিয়াসউদ্দিন সুলতানের আজগুবিপনা যে নানা খানার পাকে চলকে চলকে পড়েছে বিভিন্ন মাত্রায়, এখানে উল্লিখিত তৃতীয় নম্বর খিচুড়িটি তার একটি বই কি!
তবে আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে দু-নম্বর খিচড়ির কথা। এতেই আছে রজতেন্দ্রর প্রশ্নের উত্তর।—
ঘিয়াৎশাহি খিচড়ি, এককিসিম
খিচড়িটাকে ঘি-তে ভেজে ফেলুন অথবা কাঠবাদাম তেলে বেক করে নিন কিংবা তাজা মাখনে ভেজে নিন তারপরে জল আর নুন দিয়ে রান্না করুন এবং প্রচুর পরিমাণে বেক করা হিং দিন। একটা থালায় হরেক কিসিমের আচার এবং পরতে পরতে পাপড় আর তারও পরে আদাকুচি ও পেঁয়াজকুচি দিন।
শাবাশ! আচার আর পাঁপড়ভাজা দিয়ে খিচুড়ি সাবড়ানোর একটা নথিভুক্ত সময়কাল মিলে গেল তাহলে— পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে! সঙ্গে ঘি তো আছেই। হ্যাঁ সঙ্গে দেওয়া মূলপাঠ ফোলিও ৫২-৫২(এ)-তে গিয়ে মিলিয়ে দেখেছি পষ্ট লেখা আছে ‘পাপড় ও আচার’! কিন্তু মূলপাঠ দেখতে গিয়ে এও লক্ষ করেছি টিটলি ‘রোঘান’ বলতে ঘি লিখেছেন, ‘বেরিশ্তেহ্’ বলতে ‘fry’ এবং ‘বিরিয়ান’ বলতে ‘bake’ বুঝিয়েছেন। বেরিশ্তেহ্ মানে কিন্তু সাধারণভাবে ‘গ্রিল’ আর বিরিয়ান মানে ‘ভাজা’। আর রোঘন-এ-বাদাম বলতে ‘almond oil’ লিখেছেন।
এইবারে আসি সেই রহস্য-কথায়—‘খিচড়ি’। খিচড়িটাকে ভেজে ফেলুন মানে? টিটলি মেমসাহেব ফুটনোটে আন্দাজ করেছেন বোধহয় বোঝানো হয়েছে চাল-ডালের মিশ্রণটাকে। আমি একশো ভাগ একমত।
এই পাঁচরকমের খিচড়ি ছাড়া এ কেতাবে আছে আর-একটি খানার উল্লেখ—খিচড়া! সর্বনাশ, বেশ কিছুকাল আগে বিহারের তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব, এক মহামিছিল ডেকে বলেছিলেন, র্যালি তো ছোটি হোতি হ্যায়, ইয়ে হোগা র্যালা!! খিচড়ি নয় খিচড়া?! তাকে রান্না করতে বলা হয়েছে ঠিক আগে দেওয়া ‘থুমড়া জ়রত’ নামের আর-একটি খানার মতো করে। সে রেসিপি এরকম—
থুমড়া জ়রত
শুখা জ়রত রাঁধুন, ঘি-তে ভাজুন। মধু, এলাচ আর কর্পূর দিয়ে পরিবেশন করুন।
টিটলি জ়রত শব্দটিই রেখেছেন। যদিও জ়রত মানে ভুট্টা। এখানে রাঁধুন মানে নিশ্চয়ই সিদ্ধ করুন। আর খিচড়ার ক্ষেত্রে সেটা নিশ্চয়ই চাল-ডাল সিদ্ধ করে ভেজে নিতে হবে। আর তারপরেই বলা আছে এ ভাবেই রাঁধতে হবে ‘ভাত’, হ্যাঁ মূলপাঠেও ‘ভাত’ কথাটাই আছে। চাল ভেজে সিদ্ধ করে তাতে মধু, এলাচ আর কপ্পুর দিয়ে খেতে কেমন লাগবে তা খাওয়ার আগে আন্দাজ করা অসম্ভব! বাঙালি যে ভেতো বাঙালি বলে দুনিয়া-খ্যাত সেও কখনও এমন বিচিত্র সুবাসের ভাত খেয়েছে বলে মনে হয় না।
এখানে খিচুড়ি থেকে দু-দণ্ড সরে ঘিয়াৎশাহি সুলতানের হেঁশেলের ‘ভাত’ নিয়ে একটু চর্চা করার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। এ কেতাবে যেসব বৈচিত্র্যময় ‘ভাতের’ কথা আছে তা ভেতো বাঙালিকে পদে পদে অপ্রস্তুত করবে! যেমন, চিনি মেশানো গোলাপজল কিংবা গোলাপ-গন্ধী চিনি (গুলশকর) দেওয়া ভাত, জংলি আঞ্জির দেওয়া ভাত, তালমিছরি দেওয়া ভাত, ‘দুটি সোনার মোহরের মাপে চাকা চাকা করে কাটা দশটি কলা আর দুই শের কিশমিশ দেওয়া ভাত’, সেঁকা ছোলা আর সেঁকা তিল দেওয়া ভাত, দুঘ কিংবা রস কিংবা সুগন্ধি জল কিংবা কুমড়োর রস মেশানো ভাত, সেঁকা তিল, মেথি, এলাচ, লবঙ্গ, লেবুর রস, নুন, ঘি এবং ঘিয়ে ভাজা হিং দেওয়া ভাত, দুঘ আর রসুন দেওয়া ভাত, বড়ি, মাংস আর লেবু দেওয়া ভাত, টক কমলার রস, কুমড়োর রস, লেবুর রস, মিষ্টি কমলার রস, পোমেলোর (সদাফল) রস কিংবা কামরাঙার রস মেশানো আলাদা আলাদা কিসিমের ভাত…। আর ভাতের গুণকীর্তণে পষ্ট বলা রয়েছে, ‘তেষ্টা দূর করে, জ্বর কমায়, শরীর বলবান করে এবং বীর্য প্রবাহিত করায়’।
যাক, খিচুড়িতে ফিরি, পনেরো জায়গার মধ্যে বাকি যে দশ জায়গায় খিচড়ি-র উল্লেখ রয়েছে, তা রয়েছে বিচিত্র নানা তেল, সুগন্ধী এবং অন্যান্য খানা তৈরির উপাদান হিসেবে। বুঝুন! খিচুড়ি সেখানে খানা নয়, অন্য সামগ্রী তৈরির নানা মাল-মশলার একটি।
খিচড়ির এত ছড়াছড়ি কেতাবময়, তবুও আমি একে খিচড়ির সেরা রোশনাই বলব না। লক্ষ করুন, ঘিয়াৎশাহি খিচড়িতে এত কিছু পড়ল, কিন্তু কোত্থাও মাংস পড়ল না। এমনকি পেঁয়াজ বা রসুনও নয়! খিচুড়ি এখনও খাঁটি নিরামিষ পদ। মুসলমান হেঁশেলেও। কাজেই ধর্মের সঙ্গে আমিষ-নিরামিষির কোনো সম্পর্কের সেতু তৈরির চেষ্টা হলে, নিমতনামার খিচুড়ি তাতে জোর ধাক্কা। এই রহস্যেরও সমাধান করে উঠতে পারিনি আমি, নব্য-বৈদিক-জৈন-বৌদ্ধ ধর্মের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে খিচড়ি যে হাজার হাজার বছর ধরে একটি নিরামিষ পদ হয়েই থেকে গিয়েছে এ মহাভারত ভূখণ্ডে, এটা আমাকে তেমন অবাক করেনি। কিন্তু সেই রসনা ধারায় যখন এসে মিলল তথাকথিত ‘খাঁটি আমিষ’ মুসলমান খানা-তহজ়িব, তারপরেও একেবারে পঞ্চদশ শতকের শেষ—মানে পাক্কা চারশো বছর পরেও কেন সর-জ়মিন-এ-হিন্দের খিচড়িতে মাংস পড়ল না এ রহস্যভেদ আমার দ্বারা হয়নি।
১৪৯৫ থেকে ১৫০০-র মধ্যে লেখা এই কেতাব যেমন ‘খিচড়ি’ নামে খিচুড়ির প্রথম নথি বলেই আমি মনে করি। তবে একেবারে গায়ে গায়ে খিচুড়ি তৈরি হচ্ছিল আর-এক রাজ-হেঁশেলেও—দক্ষিণ ভারতে। সেজন্য আমাদের খুলতে হবে আর-একটি দুরন্ত কেতাব—সুপশাস্ত্র। লেখক তৃতীয় মঙ্গরস। খুলব, ও রাঁধব পরের সপ্তাহে।
(ক্রমশ…)