নীলাঞ্জন হাজরা — জয়ন্তকাকু তুমি তো বল তুমি হরেক কিসিমের মাংস খেয়ে দেখছ। দু-একটা গল্প বলো…
জয়ন্ত মণ্ডল — শোনো, এই জায়েরেরই কথা। কানাঙ্গা থেকে কঙ্গো নদী বেয়ে লঞ্চে করে রাজধানী কিনশাশা যাচ্ছি। সাইকেল নিয়েই উঠেছি। দু-দিনের যাত্রা। লঞ্চ মানে কলকাতা-হাওড়ার মধ্যে হুগলি নদীর ওপরে যে লঞ্চ চলে তার থেকে একটু বড়ো, আর দোতলা। তো আমার জন্য একটা কেবিনের ব্যবস্থা হয়েছিল। যাইহোক, তাতে তো দেখি এত লোক উঠল যে আমার মনে হল নির্ঘাত ডুবে যাবে! আমার কেবিনেও দেখি এক ভদ্রলোক ঢুকে পড়লেন। ব্যবসায়ী। কিনশাশাই যাবেন। আমার কেবিনটা ছিল লঞ্চের রান্নাঘরটার ঠিক পাশে। তো প্রথমদিন সন্ধেবেলা খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়েছি।
পরের দিন সকালে উঠেই দেখি কেবিনের সামনে একটা চামড়া পড়ে আছে। মনে হল বাঁদরের। যে কুক ছিল, রান্নাঘরটা পাশে হওয়ায় আমার সঙ্গে তার একটা ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমি মানুষের সঙ্গে মিশতে খুব ভালোবাসি। যেখানেই যাই ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সকলের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলতাম। তো সেই কুককে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোথা থেকে এল? গন্ধ ছাড়ছে তো। এখানে এল কী করে? তো বলল, কেন এটাই তো কাল রাত্রে রান্না করেছিলাম। তুমি খেলে তো ডিনারে! আমি বললাম, মাই গড! কী এটা, বাঁদর? তখন সে তাড়াতাড়ি বলে, না-না-না-না! বাঁদর নয়, বাঁদর নয়। বেবুন! সেই শুনে আমি হো-হো করে হেসে ফেলেছিলাম, এমন ভাবে বলল, যেন বাঁদরের মাংস কেন হতে যাবে, তার থেকে অনেক ভালো—বেবুন!
নী.হা. — কেমন লেগেছিল?
জ.ম. — একদম আর পাঁচটা মাংসের মতোই। আমি খালি বলেছিলাম, শোনো ভাই, এরকম অদ্ভুত মাংস আর কখনও রাঁধলে আমাকে দয়া করে একটু আগে থেকে জানিয়ে দেবে। তাতে আবার ও বলল, না, আর তো সুযোগ হবে না। খানিকক্ষণ পরেই তো আমরা কিনশাশা পৌঁছে যাব!
কঙ্গোতে এ ধরনের মাংস খুব স্বাভাবিক খাদ্যের মধ্যেই পড়ে। স্থানীয়রা একে ‘বুশমিট’ বলেন।
নী.হা. — এরকম আর কী খেয়েছ?
জ.ম. — জেব্রার বিরিয়ানি খেয়েছি! তাও আবার এক বাঙালির বাড়িতে! রোয়ান্ডার রাজধানী কিগালি। উঠেছি যাঁর বাড়িতে তাঁর নাম দয়াময় গুহ। তিনি কাজ করতেন আইএলও-তে (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগ্যানাইজেশন)। রোয়ান্ডায় আইএলও-র প্রধান ছিলেন। তাই ডিপ্লোম্যাটিক কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ভারতীয় অফিসাররা বাড়িতে আসত। তাঁদের ক্লাবেও আমাকে নিয়ে যেতেন। তো আমি লক্ষ করতাম, বুঝলে, অদ্ভুত একটা নাকউঁচু ভাব তাদের মধ্যে, মানে—অ্যাঃ! ওরা তো বস্তিতে থাকে। তো সেইখানে মিসেস গুহ একদিন বললেন, আমি জেব্রার বিরিয়ানি করছি, খাবে তো। খেলাম। যতগুলি মাংসের পিস পাতে পড়েছিল, বুঝলে, চিবিয়ে চিবিয়ে ফেলে দিতে হয়েছিল। খুব ছিবড়ে। উনি বললেন, দোকানেই কিনতে পাওয়া যায় জেব্রার মাংস।
আর-একবার একটা পাইথনের মাংস খেয়েছিলাম। ময়াল সাপ। এটা কিগালির বাইরে। আমি মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। আশেপাশের জায়গায় চলে যেতাম। ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে দূরে। মিস্টার গুহকে বলে যেতাম, রাতে না ফিরলে যেন চিন্তা না করেন। তো সেইভাবে একজনের সঙ্গে পরিচয় হল তিনি অ্যাফ্রো-আরব। একটা গ্রামে। খুব তেষ্টা পেয়েছিল। ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে জল চাইলাম। সেই থেকে আলাপ-পরিচয় হল। তারপরে বললেন, শোনো, তুমি আজ আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে যাবে। তা রান্না করতে করতে রাত হয়ে গেল। আমি থেকেই গেলাম রাতটা। তা উনি বলেই দিয়েছিলেন, ডিনারে পাইথন! কাজেই জেনেই খেয়েছিলাম। এবং বলছি তোমায়, একেবারে আর পাঁচটা মাংসের মতোই। খুব নরম। তারপরের দিন সকালে উনি আমাকে পাইথনের চামড়াটাও দেখালেন—প্রায় ১২ ফুট লম্বা, ১৫-১৬ ইঞ্চি চওড়া! জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেলেন? বললেন, জঙ্গল থেকে এনেছি।
পাইথনের মাংস দুনিয়ার বহু দেশেই খাওয়া হয়। এ ছবিটি উত্তর-পূর্ব ভারতের।
নী.হা. — জঙ্গল থেকে সাপ ধরে এনে খেয়ে ফেলল?
জ.ম. — দ্যাখো, আমি অত জিজ্ঞেস করিনি। এটা আমার আর-একটা বড়ো শিক্ষা—অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাবে না। মানুষের প্রাইভেসিকে সম্মান করতে শিখতে হবে। সেটা আমি খুব মেনে চলতাম।
নী.হা. — বেবুন, জেব্রা, পাইথন, আর… ?
জ.ম. — জাম্বিয়াতে একটা গ্রামে গিয়েছিলাম, বুঝলে। তা সেখানে সকলেই ইংরেজি বলতে পারে। সন্ধের একটু আগে। কাউকে চিনি না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বাড়িতে দরজা খটখট করলাম। তো এক ভদ্রলোক বেরোলেন। দেখলাম খুবই গরিব পরিবার। আমি, খাবার চাওয়াতে বললেন, ঘরে তো কিছু নেই। কাজেই রাতটা ওখানেই কাটল, কিন্তু খাওয়া জুটল না। পরের দিন কোথা থেকে জানি না, ভদ্রলোক অনেকটা মাংস নিয়ে এলেন। আর আমাকে খেতে দিলেন ওঁরা বাড়িতে যা খাচ্ছিলেন—সেটা হল কাসাভা।
নী.হা. — কাসাভা? সেটা কী?
কাসাভা। আফ্রিকার খুব সাধারণ সবজি
জ.ম. — কাসাভা হল একরকমের উদ্ভিদের শিকড়। শাঁকালুর মতো দেখতে, বা খামালুর মতো, কিন্তু অনেক বড়ো। সেইটা চটকে আফ্রিকানরা তৈরি করে দু-রকমের খাবার সিমি আর ফুফু। লঙ্কা-তেল-নুন দিয়ে কাসাভা চটকে সকলে মিলে খাওয়া হল। তারপর মাংস রান্না হল। তবে আমাদের মতো রান্না নয়। আগুন জ্বালিয়ে ঝলসানো। তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কীসের মাংস, এত থলথলে? বলল, জলহস্তি! আমি বললাম, মাই গড!
নী.হা. — বোঝো। যাক এইবার বলো তোমার সেই হাতি শিকার করে খাওয়ার কাহিনি।
জ.ম. — আচ্ছা। তাহলে তোমাকে একটু পিছনে ফিরতে হবে। সেই যে মনে আছে বটসোয়ানা যাওয়ার পথে হাতির পালের মধ্যে পড়ে একটা ট্রাকে উঠে পড়েছিলাম? সারারাত চললাম?
নী.হা. — হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলো।
জ.ম. — তো পরের দিন সকালে তো আমাকে ড্রাইভার ভদ্রলোক ছেড়ে দিলেন একটা জনপদে। আদিবাসী গ্রাম। চারপাশে ঘাসজঙ্গল। আর মাঝে মাঝে ওকগাছের মতো দেখতে বড়ো বড়ো গাছ। একরাত্রি রইলাম। সেইখানে আমার দেখা হল এক ডাচ মহিলার সঙ্গে। তিনি আফ্রিকার ওপর গবেষণা করছেন। তারপরের দিন, ওই গ্রামেই এসে হাজির হল জনা চারেক নরওয়েজিয়ান। কী ব্যাপার? না, ওই গ্রাম থেকে গাইড নেবে। গাইড কেন? বলল, আমরা হাতি শিকার করতে যাচ্ছি। সেই শুনে, আমি বললাম, আমাকে নাও তোমাদের সঙ্গে। তো ওরা আমার সাইকেল-টাইকেল দেখল। তারপর বলল, আসতে পার, কিন্তু আমরা তো আজ নাও ফিরতে পারি। বললাম, আমি তোমাদের সঙ্গেই থেকে যাব। বলল, আমাদের হয়তো গাড়িতেই থাকতে হবে। আমি বললাম, আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
তো তার পরের দিন, ভোররাত্রে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম। দুটো গাড়ি। চললাম কালাহারি মরুভূমির একটা পাশ ধরে। আর সেইখানে দেখলাম গাইড ভদ্রলোকের খেলা। একবার বলছে এদিকে চলো, একবার বলছে ওদিকে চলো। কী ব্যাপার? না, চোরাবালি। গাইড না থাকলে ওখানে যাওয়া অসম্ভব। তবু একটা জায়গায় গিয়ে চাকাগুলো ফেঁসে গেল। একটা গাড়ির পিছন দিকটা বালির ভিতরে ঢুকে গেল। মনে আছে, হঠাৎ আমার মধ্যে একটা অবিশ্বাস্য রকমের বিস্ময় আর ভয় মেশানো ভাব দেখা দিল। চোরাবালি?! আমরা সব নেমে পড়লাম। তখন কেবলই মনে হচ্ছে, আমি যেন ঢুকে না যাই। তাড়াতাড়ি করে আর-একটা গাড়ির সঙ্গে এই গাড়িটাকে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। টেনে টেনে তোলা হল। যত সহজে তোমায় বলে দিলাম তত সহজ কিন্তু হয়নি। যতবার টেনে তোলা হয় খানিকটা, আবার ঢুকে যায়। যাই হোক, অবশেষে সেটাকে তুলে যেখানে হাতি দেখা যাবে সেখানে পৌঁছোলাম। সকাল সাড়ে সাতটা-আটটা নাগাদ হাতির দেখা মিলল। আমরা একটু কাছে ভিড়বার চেষ্টা করতেই হাতিটা আমাদের দিকে তেড়ে আসতে শুরু করল। আর অমনি গুলি। ঠিক মাথায়, দু-চোখের মাঝখানে। যাকে ইংরেজিতে ‘টেম্পল’ বলে। তো হাতিটা, বুঝলে, সামনের পা দুটো মুড়ে বসে পড়ল। চোখের সামনে দেখলাম। তারপরে আস্তে আস্তে ঢলে পড়ল।
আর তারপরে সেই বিশাল হাতিকে—কয়েক টন হবে— টুকরো টুকরো করে কেটে তার মাংসকে কীভাবে নিয়ে আসা হল তা বিশ্বাস করতে হলে তোমায় আমার তোলা ছবিগুলো দেখতে হবে। আমাদের দলে যে আফ্রিকানরা ছিলেন, তাঁদের কাছে সাংঘাতিক ধারালো সব ছুরি-ছোরা ছিল। আমি তোমাকে বর্ণনা করছি, মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করো—সেই ধারালো ছুরি দিয়ে প্রথমে পেটটা কেটে ফেলল। তারপর টেনে টেনে ইন্টেস্টাইনগুলো বার করে কেটে ফেলল। তারপরে একজন লম্বা লোক সেই পেটের মধ্যে একটা গুহায় ঢোকার মতো ঢুকে গেল। আর ভিতর থেকে মাংসগুলো কেটে কেটে বাইরে ছুড়ে ছুড়ে ফেলতে লাগল।
হাতির মাংসও আফ্রিকায় দুর্লভ নয়
নী.হা. — ভয়াবহ। সে তো রক্তারক্তি ব্যাপার একেবারে?
জ.ম. — তা তো বটেই। আর সেই মাংস ইন্টেস্টাইনের টুকরোর মধ্যে ঢুকিয়ে দুদিক বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হতে থাকল। এইসব ছবি আমার কাছে আছে। খুঁজে বার করতে হবে আমায়। যাই হোক, সন্ধের মধ্যে দুটো গাড়ি ভরতি করে মাংস নিয়ে আসা হল। সেই মাংস, কিছু ঝলসে, কিছু সিদ্ধ করে খাওয়া হল! আমিও খেলাম। সাধারণ মাংসর মতোই, তবে একটু ছিবড়ে।
(ক্রমশ…)
মানুষের মতো হিংস্র আর সর্বভুক প্রাণী বুঝি নেই। দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর অভিযান, সন্দেহ নেই।
এরপরেও হাতি শিকারের সচিত্র বর্ণনায় বুকের ভেতরে কাঁটা বিঁধে গেল যেন। ওহ কি নিষ্ঠুরতা!
অভিযানের বর্ণনা খুব সংবেদী