
১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর। বাঁকুড়ার ছোট্ট মফস্সল শহর বিষ্ণুপুর থেকে বিশ্বভ্রণে বেরিয়ে পড়লেন দুই তরুণ। গন্তব্য—আফ্রিকা। একজন হাল ছাড়েন কিছু পরেই। অন্যজন চলতে থাকেন—১৭ বছর। ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। ১৫৪ টি দেশ। আজও এ কীর্তিতে তিনি অদ্বিতীয়। এই প্রথম দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সে পরমাশ্চর্য সফরের অনুপুঙ্খ কাহিনি শোনাচ্ছেন জয় মণ্ডল। আলাপে নীলাঞ্জন হাজরানীলাঞ্জন হাজরা — এতাবৎ তোমার আফ্রিকাভ্রমণের কথা যা শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে যে, তুমি বাঙালিদের দেখা পেয়েছ দেখছি বহু জায়গায়…
জয়ন্ত মণ্ডল — সব জায়গায়। উগান্ডাতে এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে ছিলাম, কমলদা, সেটা তো তোমায় আগেই বলেছি। সেখানে খুব ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটেছিল।
নী.হা. — কীরকম?
জ.ম. —কমলদা একদিন বললেন, শোনো, তোমরা সাইকেল নিয়ে এসেছ, ভালো। কিন্তু এই সাফারি পার্কে সাইকেল নিয়ে ঢোকার চেষ্টাও করবে না। যেতে দেবেও না অবশ্য। চলো তোমাদের আমি নিয়ে যাব। আমরা কয়েকদিন থেকে লায়ন্স ক্লাব, আরও কয়েক জায়গায় লেকচার দিয়ে কিছু টাকা তুললাম।
তারপর একদিন কমলদা, ওঁর স্ত্রী, দুই ছোটো ছোটো মেয়ে, আর আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আট-দশ ঘণ্টার রাস্তা। ভালো কথা, তখন উগান্ডাতে ইদি আমিনের রাজত্ব! একঝলক দেখেছিলাম, সে গপ্পো পরে বলছি। তা পথে আবার এক জায়গায় গাড়ির ক্লাচ খারাপ হয়ে গেল। ঠেলেঠুলে গাড়িটাকে কাছেই একটা জায়গা ছিল সেখানে নিয়ে গিয়ে সারানোর ব্যবস্থা হল, আমরা এক রাত কাটালাম। সাফারি পার্কের জায়গাটার নাম ইশাশা। জায়ের আর উগান্ডার বর্ডারে। ইশাশা বিশেষ ভাবে বিখ্যাত কারণ, এইখানে সিংহগুলো গাছে থাকে! খুব বিরল। ট্রি-টপ লায়ন বলে।

ইশাশা অভয়ারণ্যে গাছে-চড়া সিংহের দল (ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
আর-একটা জায়গাতেই কেবল এমন গেছো সিংহ দেখেছি, লেক মানিয়ারা বলে তানজানিয়াতে একটা জায়গায়। তো ইশাশায় পার্কের গাড়িতে করে ঘুরছি, হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেল। উঁচু ল্যান্ডরোভার গাড়ি। ছাদটা খোলা। সাভানা ঘাসজমি। বিরাট উঁচু ঘন ঘাস, যত দূর দেখা যায়। তার মধ্যে গাছে গাছে সিংহ শুয়ে আছে। একটা তো দেখি একেবারে আরাম করে ঘুমোচ্ছে গাছের ওপরেই। হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। হাতি শিকার করে অবশ্য পরে খেয়েও ছিলাম, বটসোয়ানায়।
নী.হা. — শিকার করে খেলে, হাতির মাংস?
জ.ম. — হ্যাঁ! সে গল্প আর-একদিন বলব। যাই হোক, তো গাছে গাছে ওরকম সিংহ দেখে আমি একেবারে অবাক হয়ে গেছি। হুঁশই নেই। একের পর এক ছবি নিয়ে চলেছি। কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। করলাম কী আস্তে করে গাড়ির দরজাটা খুলে নেমে পড়লাম। যেমনি নেমেছি, একেবারে সামনে সিংহের গর্জন। ওই লম্বা লম্বা এলিফ্যান্ট গ্রাসের আড়ালে যে সিংহ লুকিয়ে আছে বুঝতেই পারিনি। লাফ দিয়ে কোনোমতে গাড়িতে উঠেছি, পা-টা তখনও বাইরে ঝুলছে। সেই অবস্থাতেই তাড়াতাড়ি দরজাটা টানলাম একেবারে পায়ের ওপর। সাংঘাতিক লাগল। কিন্তু তার থেকেও মুশকিল হল, এই হুড়োহুড়িতে ক্যামেরাটা গেল হাত থেকে নীচে পড়ে! এদিকে ড্রাইভার তো আমাকে এই মারে তো সেই মারে। কমলদা, ভয়ংকর বকাবকি করলেন—তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই! আমি তো কাঁচুমাচু হয়ে সরি-টরি বললাম। ওদিকে সিংহটা সেখানে দাঁড়িয়ে কেবলই লেজটা মাটিতে আছড়াচ্ছে আর গর্জন করছে। ড্রাইভারটা আমাকে বলল, যাও, ক্যামেরাটা কুড়িয়ে আনো। আমি বললাম, অসম্ভব, আমার দ্বারা হবে না! সিংহ আর কিছুতেই সরে না সেখান থেকে। আমরাও দাঁড়িয়ে আছি। আবার ইঞ্জিন বন্ধও করা যাবে না, সেটাই নিয়ম। কারণ, তখন মোবাইল তো ছেড়ে দাও সঙ্গে ওয়াকি-টকিও ছিল না। যদি কোনো কারণে গাড়ি একবার বন্ধ করলে আর স্টার্ট না নেয়, তাহলে অবস্থা খারাপ। অত হাজার স্কোয়্যার কিলোমিটারের পার্ক, খুঁজেই পাওয়া যাবে না। প্রায় দেড়-দুঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পরে, ড্রাইভার-কাম-গাইড কোনোভাবে গাড়ির সামনেটাকে ক্যামেরাটার একেবারে পাশে এনে, দরজাটা খুলেই লম্বা হাত বাড়িয়ে ছোঁ মেরে ক্যামেরাটা তুলে নিতে পারল।
নী.হা. — তাও ভালো যে ক্যামেরাটা পাওয়া গেল। এবার ইদি আমিনকে দেখার গল্পটা বলো।
জ.ম. — আসলে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় যাঁর বাড়িতে উঠেছিলাম তিনিও বাঙালি! ডক্টর ঘোষ। ভারতীয় হাইকমিশনারের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তো তাঁর বাড়িতে একদিন সন্ধ্যায় টিভিতে ইদি আমিনের ভাষণ শুনলাম। ইংরেজিতে। কী বললেন শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে!

ইদি আমিন। ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
নী.হা. — কী বললেন?
জ.ম. — ইদি আমিন বললেন, নিজের দেশের লোকদের, আমি তোমাদের জন্য দেশ থেকে ইন্ডিয়ানদের তাড়িয়েছি। কারণ তারা সব লুটেপুটে খাচ্ছিল। তাদের দোকান, কল-কারখানা, সম্পত্তি সব বাজেয়াপ্ত করেছি। সেসব তোমাদের মধ্যে ডিস্ট্রিবিউট করেছি। তোমরা কিন্তু দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে না। প্রত্যেকদিন সন্ধে হলেই তোমরা বিয়ার নিয়ে বসে যাও। নাচ-গান-বিয়ার-আর-ঘুম! তারপরে বললেন, ‘You Black Patels are worse than the real Patels who were in this country!’ তো তারপরে ড. ঘোষের স্ত্রী বললেন, আরে, ওদের একটু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও! আমি ভাবলাম, এটা কী হল! ইদি আমিনের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও?! তারপর জানতে পারলাম, তিনি ইদি আমিনের ডাক্তার। এটা কিন্তু আমাদের হাইকমিশনার বলেননি! তো ডক্টর ঘোষই ব্যবস্থা করে দিলেন। এন্টেবি বলে একটা জায়গা আছে, লেক ভিক্টোরিয়ার পাড়ে। সেইখানে ছিল ইদি আমিনের প্রাসাদ। কাম্পালা থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। তো আমাদের সেইখানে যেতে বলা হল। ওনার সঙ্গে দেখা হবে। উনি সময় দিয়েছেন। সাইকেল নিয়ে ওঁর সঙ্গে ছবি তুলব। কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি, রাস্তাটা এত পাহাড়ি রাস্তা, যে পৌঁছোতে যা ভেবেছিলাম তার থেকে অনেক বেশি সময় লেগে গেল। আধঘণ্টা দেরিতে পৌঁছোলাম। আমরা পৌঁছেছি, ঠিক তখন উনি অন্য কোথাও বেরিয়ে যাচ্ছেন। তা আমাদের সাইকেলগুলো দেখে বুঝেছিলেন বোধহয়, একবার হাত নাড়লেন। সেই একঝলক দেখেছিলাম।
নী.হা. — জয়ন্তকাকু, এবারে আমি একটা একটু অ্যাবস্ট্রাক্ট প্রশ্ন দিয়ে শুরু করতে চাই—এই যে ১৯৭০-৮০-র দশকে ছোট্টো মফস্সলের একটি যুবক সাইকেল চালিয়ে আফ্রিকা ঘুরতে শুরু করল, এটা আমার কাছে খুব অদ্ভুত লাগে। ইউরোপ, আমেরিকা, এসব জায়গায় আমরা অনেক গেছি। আমি নিজেও বেশ কিছু জায়গায় গেছি। কিন্তু আফ্রিকার ৪৯-টা দেশ! আফ্রিকা আমাদের সাধারণ মানুষদের মনে আফ্রিকাই। তো আমার প্রশ্ন হল এই যুবকটি যখন আফ্রিকার মুখোমুখি হল, তার মনে কী ছাপ পড়ল?
জ.ম. — শোনো, তুমি ‘কোরা কাগজ’ বলে কথাটা জান তো? আনকোরা! আমি ছিলাম ঠিক তাই। কিছুই জানতাম না। কোনো জ্ঞান ছিল না। শুধু জানতাম, আমার একটা সাইকেল আছে! আর রাস্তা আছে, যে রাস্তা ধরে আমাকে চলতে হবে। আর জোগাড় করতে পেরেছিলাম একটা মিশেলিন ম্যাপ১। ভালো কথা, সেই ম্যাপ ব্যবহার করতে গিয়ে আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, একে তো দুনিয়ার সেরা ম্যাপ বলা যায় না। পরে ভেবে দেখেছি, আসলে মিশেলিনের দোষ নয়, সেসময় বহু জায়গায় কোনো রাস্তাই ছিল না, কোনো রাস্তা না। চলতে চলতে দেখেছি, মাঝপথে রাস্তাটা ভ্যানিশ করে গেল। জাস্ট নেই!
নী.হা. — তখন কী করতে?
জ.ম. — তখন কাছাকাছি কোনো গ্রাম খুঁজে খুঁজে বার করতাম। তারপর বাঁদরের মতো হাবভাব শুরু করতাম! প্রাণপণে হাত নেড়ে, মুখ নেড়ে, পা নেড়ে, হাতে করে পেডাল চালানোর ভঙ্গি করে বুঝিয়ে যে আমি সাইক্লিস্ট… আর অধিকাংশ জায়গায় গ্রামের বাচ্চারা সবার আগে আমাকে ঘিরে ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত! এই দ্যাখো, হঠাৎ মনে পড়ে গেল… জায়ের২-এ কানাঙ্গা বলে একটা জায়গায় পৌঁছে আমি এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম যে একটা গাছের তলায় বসে গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে রেস্ট নিচ্ছি। একটা লোক আমায় দেখে চলে গেল। একটু পরে দেখি একটা বাচ্চা, পাঁচ-ছ- বছরের, দূর থেকে আমাকে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখছে, বুঝলে। তারপরে একে একে বাচ্চার সংখ্যা বাড়তে লাগল—দুটো, তিনটে, পাঁচটা, একটা পুরো দল! অবাক হয়ে আমাকে দেখছে আর কী সব বলছে, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তারপরে আমি যেই একটু উঠেছি অমনি পোঁ-পাঁ দৌড়! সব পালাচ্ছে! আমি ভাবলাম, মাই গড! আমার এই ৫ ফুট ৪ ইঞ্চিকে দেখে এরা ভয় খেয়ে পালাচ্ছে?! পরে চিন্তা করে দেখলাম, তা নয়। তা নয়, আসলে ওরা আমার মতো কাউকে কখনও দেখেনি। আমার মতো চামড়ার রং, বড়ো বড়ো চুল, একমুখ দাড়ি! এই দেখেছি আফ্রিকার গ্রামে গ্রামে, বুঝলে।
আবার, একেবারে হাড়-হিম-করা ঘটনাও শুনেছি, অন্যের কাছে। এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জায়েরেই। গুজরাটি। তাঁর বয়স তখন নব্বইয়েরও বেশি। তাঁকে আমি এমনি কথায় কথায় প্রশ্ন করেছিলাম, গুজরাটিরা সবাই নিরামিষাশী কেন বলুন তো? তখন উনি বললেন। বললেন, আমি ভেজিটেরিয়ান ছিলাম না মোটেই। তোমাদেরই মতো মাছ-মাংস সব খেতাম। ১৯২০-র দশকের একসময়ে আমি প্রথম সরকারি কাজ নিয়ে আফ্রিকা আসি। তো কিছুদিন পরে, আমার কোলিগ ছুটি নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি গেল। কিছুদিন পরে সে একজনকে দিয়ে খবর পাঠাল, আমার বাড়িতে একটু এসো, একটা অনুষ্ঠান আছে। তো আমি গেলাম। সে নদী, জঙ্গল সব পেরিয়ে যেতেই দু-তিন দিন লেগে গেল। যাইহোক, পৌঁছে দেখি, বাড়িতে লোকজন, অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। তারপর খেতে বসলাম। খাওয়াদাওয়া চলছে। মাংস দিয়েছে। তখন আমার কোলিগ আমাকে বলল, শোনো, দু-তিনদিন আগে আমার মা মারা গেছেন। তো আমরা মায়ের দেহটা রেখে দিয়েছিলাম। তোমার জন্য আজ স্পেশালি রান্না করেছি! সেই থেকে আমি আর মাছ-মাংস খেতে পারি না!
নী.হা.—এটা সত্যি ঘটনা?!
জ.ম. — উনি আমায় বলেছিলেন এটা সত্য।
নী.হা. — কিন্তু এ তো ক্যানিবালিজম!!
জ.ম. — অফ কোর্স! তার জন্যেই তো যখন লোকেরা জিজ্ঞেস করে, তুমি গোরু খাও? আমি মজা করে বলি, যে সারা আফ্রিকা ঘুরে আমি সবরকমের মাংস খেয়েছি, কিন্তু আমি ক্যানিবাল নই। এটা অবশ্য একদম মজা করে বলা।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি ২৫ ফেব্রুয়ারি)
র২হ | 49.206.***.*** | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:৫০102453হিন্দু গুজরাটিরা তো অধিকাংশ এমনিতেই নিরামিষাশী... তাই নয় কী?
অপূর্ব
সম্রাট মণ্ডল | 2409:4061:481:58a7::26a0:***:*** | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২৩:৪১102875দারুন লাগছে চলতে থাকুক