নীলাঞ্জন হাজরা — তাহলে তোমার ওয়ার্ল্ড ট্যুর শুরু হল আফ্রিকা দিয়ে! নাইরোবি…
জয় মণ্ডল — হ্যাঁ! নাইরোবিতে আমাদের একটা পরিচিতি বেরিয়ে গেল, বুঝলে—আমাদের বিষ্ণুপুর হাই স্কুলে দু’-তিন বছরের সিনিয়র ছিল প্রসেনজিৎ পাঠক। সে আমাদের ট্যুরের কথা শুনে বলল, শোন আমার এক সম্পর্কের দাদা আছে নাইরোবিতে, তাকে তুই লেখ। তো আমাদের পৌঁছোবার তারিখ দিয়ে তাঁকে লিখে দিলাম। তিনি কোনো উত্তর দিলেন না। যাই হোক যখন নাইরোবি এয়ারপোর্টে প্রথম নামলাম, সবার আগে আমার চোখে কী লেগেছিল জান? মানুষের গায়ের রং! জানি না কী করে সেই অনুভূতিটা বর্ণনা করব, আর কোনো চামড়ার রঙের কোনো মানুষ নেই, সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। ছোটো ছোটো চুল, প্রায় নেড়া। দিল্লিতে মাঝে মাঝে কিছু আফ্রিকান মানুষকে আগে দেখেছি। কিন্তু চারপাশে সবাই কৃষ্ণাঙ্গ এ দৃশ্য তো আগে কখনও দেখিনি, একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম দেখে! যাই হোক, সাইকেলগুলোর ব্যাপারে এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে খোঁজ করাতে বলল, সবে নেমেছে তো, দেরি লাগবে, তোমাদের ঠিকানা রেখে যাও আমরা পৌঁছে দেব। এরপর, গেটের কাছে দেখি একজন ভারতীয়, আমাকে দেখেই বললেন, জয় মণ্ডল? আসলে আমার গেঞ্জির ওপর লেখা ছিল—ওয়ার্ল্ড সাইকেল ট্যুরিস্ট, ক্যালকাটা, ইন্ডিয়া। সেইটা দেখেই ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছেন। প্রবীর চক্রবর্তী। আমার থেকে বয়সে একটু বড়ো, আমাদের গোড়া থেকেই ‘তুমি’ করে কথা বলতে লাগলেন। বললেন, আমার তো গাড়ি নেই, ইনি আমার সঙ্গে এসেছেন, ধীরেন দে, আমরা মেসোমশাই বলি, ওনার গাড়িতে আমরা যাব।
তো আমরা, প্রবীরদার বাড়িতেই উঠেছিলাম। আর কাছেই ধীরেন মেসোমশাইয়ের বাড়ি ছিল, সেখানেই খাওয়াদাওয়া করতাম বেশির ভাগ সময়ে। ওনার আবার নয় মেয়ে, এক ছেলে! সবাইকার সঙ্গে, মাসিমার সঙ্গে, একেবারে নিজের পরিবারের মতো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মেসোমশাইয়ের কথা বিশেষ করে বলছি এই কারণে যে উনি একবার আমায় একটা ছোট্টো কথায় বিশাল শিক্ষা দিয়েছিলেন, বুঝলে। একবার খেতে বসেছি, মাসিমা করলা ভাজা দিয়েছেন। ছোটোবেলা থেকেই আমার খাওয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেদিন দেখি করলাটা কাঁচা-কাঁচা আছে। তা আমি খাইনি। সেই দেখে মেসোমশাই বললেন, জয় তুমি করলাটা খেলে না কেন? আমি বললাম, কাঁচা আছে, ভাজা হয়নি ঠিক মতো। সেই শুনে উনি আমাকে বলেছিলেন, তোমার আর ওয়ার্ল্ড ট্যুর হবে না। আমি বললাম, কেন বলছেন এ রকম? উনি বললেন, এই করলা কাঁচা বলে তুমি খেতে পারছ না? রাস্তায় কত জায়গায় দেখবে খাওয়া জুটবে না। এ রকম করলে, না খেয়ে থাকতে হবে তোমায়! বিরাট শিক্ষা, বুঝলে। আমি সেদিন করলাটা কষ্ট করে খেয়ে নিলাম। প্রায় গিলে নিয়েছিলাম। সেই থেকে আমি সব খাই। সব। শুধু মানুষের মাংস খাইনি, ক্যানিবাল নই। আর খাবার সব খেতে পারি। সবই কি আমার ভালোলাগে? না। কিন্তু ঠিক খেয়ে নিই।
নী.হা. — তারপর তোমরা নাইরোবি থেকে বেরলে কবে?
জ.ম. — আরে সব জোগাড়যন্ত্র করতেই প্রায় তিন সপ্তাহ লেগে গেল। কিছু টাকাপয়সা তুললাম। ওদের ওখানে ইন্ডিয়ানদের কাছে লেকচার দিয়ে, মানে আমাদের ঘোরার অভিজ্ঞতা। এটা বরাবরই করেছি—লেকচার দেওয়া আর ছবি দেখানো। ভারতীয় এমব্যাসিতে, নানা অ্যাসোসিয়েশনে, ক্লাবে। এই করে পয়সা জোগাড় করেছি। সেসময় একটা জিনিস দেখেছিলাম, জানো, ওখানে যে ভারতীয়রা আছেন, অনেক বছর ধরে আছেন—দু-পুরুষ, তিনপুরুষ— তাঁরা কিন্তু সংস্কৃতির দিক দিয়ে ভারতীয়দের থেকেও বেশি ভারতীয়! তা সেই সব করছি। শহরটা ঘুরে দেখছি। ম্যাপ জোগাড় করছি। আর লোকজন ভীষণ ভয় দেখাচ্ছে—তোমরা যাবে? রাস্তা কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে। বুনো হাতি আছে। সিংহ আছে। চিতা আছে। আর যেটাকে আমি সব থেকে ভয় পেতাম—বিষধর সাপ, বিশেষ করে ব্ল্যাক মাম্বা। একেবারে লেজের ওপরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সে একবার দেখেছিলাম, তানজানিয়ার জ্যানজিবারে। একটা সুড়ঙ্গ আছে। তার ভিতরে ক্রীতদাসদের রাখা হত, জ্যানজিবার বন্দর থেকে পাচার করার আগে। সেই সুড়ঙ্গের ভিতর আমি ব্ল্যাক মাম্বা দেখেছিলাম।
যাই হোক, এই সমস্ত শুনে মনের মধ্যে যেমন একটা ভয় হত, তেমনি একটা রোমাঞ্চও হত। বাবা! এ সবের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হবে? কারণ, আমি তো তখন দুনিয়ার কিছুই দেখিনি। কিছু পড়িওনি। একেবারে আনকোরা। একেবারে অচেনা, অজানা আফ্রিকা!
নী.হা. — দ্যাখো, সাধারণ মানুষের আফ্রিকা বললেই যেটা সবার আগে মনে পড়ে সেটা গভীর জঙ্গল আর বন্য পশু—যেমন তুমি বললে, হাতি, সিংহ, চিতা… আমি শুনেছি, তোমাকে বেশ কয়েকবার তাদের মুখোমুখিও হতে হয়েছে। প্রথম তেমন অভিজ্ঞতা কোথায় হয়েছিল?
জ.ম. — সে সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। তখন আমি একা। মনমোহন ফিরে গেছে। জাম্বিয়া ঘুরে বর্ডার পেরিয়ে বটসোয়ানায় ঢুকছি সেদিন। এই বর্ডারটা হল জাম্বেজি নদী। নদীটা ফেরিতে পার করে বটসোয়ানায় ঢুকব।
নী.হা. — এই জায়গাটার নাম কী?
জ.ম. — নাম? দাঁড়াও, মনে করি। (একটু ভেবে) মনে পড়েছে, ইয়েস, কাজুঙ্গুলা! এই ফেরিটাকে বলে কাজুঙ্গুলা ফেরি। কী আশ্চর্য, তুমি প্রশ্নগুলো করছ, আর এত বছর পরে স্মৃতিগুলো ফিরে আসছে! যাই হোক, সেই ফেরি পার করে ইমিগ্রেশন অফিস। তো সেখানে অফিসাররা আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছি। বললাম, সাইকেল ট্যুর করছি। তো ওরা হাসাহাসি শুরু করল। বিশ্বাসই করল না যে আমি সাইকেলে ওই রাস্তায় যাব। একজন বলল, তোমার সাইকেলটা দেখি। তো দেখল, সত্যিই বোঁচকা-বুঁচকি বাঁধা। তারপরে সে আমাকে সাবধান করে বলল, তুমি বলছ তোমার পরের স্টপ ফ্র্যান্সিস টাউন। সে তো বহুদূর। আমি ম্যাপে দেখেছিলাম, সেখান থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। বলল, একেবারে চেষ্টাই কোরো না। বন্য জানোয়ারে ভরতি। পথে কিচ্ছু পাবে না…
কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। কারণ, আগেও আমাকে পথে এরকম লোকে বলেছে। অথচ আমি প্রায় সব জায়গাতেই আদিবাসীদের গ্রাম পেয়েছি। ভাষা জানি না একবর্ণ। কথা বলতে পারতাম না। হাত মুখ নেড়ে কথা বলতাম। কিন্তু সবাই আমায় থাকতে জায়গা দিয়েছে। জেন্টল, নাইস পিপল। তাই আমি বললাম, দেখা যাবে।
তখন বেলা তিনটে-সাড়ে তিনটে বাজে। তারপর তো সাইকেল চালিয়েই যাচ্ছি। যতদূর মনে পড়ছে জুন বা জুলাই মাস। দিব্যি ওয়েদার। কিন্তু পথে আর-একটাও গ্রাম-টাম কিচ্ছু পড়ছে না। আর সব থেকে মুশকিল হল, রাস্তাটাকে রাস্তা বলা যায় না, বুঝলে। পাথরের নুড়িতে ভরা। তার ওপর দিয়ে সাইকেল চালাতে হচ্ছে। কেবলই মনে হচ্ছে এখুনি টায়ার পাংচার হয়ে যাবে। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি…
নী.হা. — আর দুপাশে জঙ্গল?
জ.ম. — জঙ্গল মানে, ঘাসজমি বুঝলে। সাভানা। তার মধ্যে মধ্যে বড়ো বড়ো গাছ। আফ্রিকায় যে কথায় বলে, দিনের আলো ঢোকে না। ডার্ক কন্টিনেন্ট। সেটা একমাত্র কঙ্গোতে দেখেছি আমি। আর জায়ের। সে কঙ্গোর ঘটনা বলব। অন্য কোথাওই আমার ডার্ক কন্টিনেন্ট বলে মনে হয়নি। যাই হোক, চলছি তো চলছি। সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। আমি শুধু আলো খুঁজছি। আলো মানে গ্রাম। ২৫-৩০ কিলোমিটার সাইকেল করে ফেলেছি। কোথাও আলো দেখতে পাচ্ছি না। আসতে আসতে গা ছমছম করতে শুরু করল। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, বুঝলে। কোথাও কোনো বাঁক নেই। হঠাৎ মনে হল কিছুটা দূরে রাস্তার মাঝখানে একটা বিশাল ঢিবির মতো। আমি ভাবলাম কী হতে পারে? এতক্ষণ আসছি, কোথাও তো পাহাড়ি জমি দেখিনি। হঠাৎ দেখি বস্তুটা নড়ে উঠল। আমি একা, বুঝতে পারছ। কেউ কোত্থাও নেই। তো সেই দেখেই আমি সাইকেল থেকে নেমে পড়েছি। তখনও পুরো অন্ধকার হয়নি। আবছা দেখা যাচ্ছে। আমি খুব ভালো করে দেখলাম —মাই গড! বিশাল একটা দাঁতাল হাতি!
আমি সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলটাকে ঘুরিয়ে পিছনের দিকে চললাম। প্রাণপণে চালাচ্ছি। আর মাঝেমাঝেই পিছন ফিরে দেখছি। শুধু মনে হচ্ছে পিছন থেকে আসছে। হঠাৎ যেন শব্দ পেতে শুরু করলাম একটা—ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় করে। আমি তখন চালাচ্ছি আর ঠাকুরকে ডাকছি, এই সময় যেন পাংচার না হয়। তারপরেই হঠাৎ দেখি দু-পাশে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে, শুধু হাতি। হাতির পাল। দু-পাশেই। কিন্তু সেই দেখে আমার মনে একটু সাহস এল! কারণ, আমি শুনেছিলাম, বিপজ্জনক হল একটা দলছুট দাঁতাল হাতির মুখে পড়ে যাওয়া। তাহলে বুঝতে হবে ‘রোগ এলিফ্যান্ট’। কিন্তু হাতি যদি দলে থাকে তাহলে ওরা মানুষকে ঘাঁটায় না সাধারণত। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সঙ্গে একটা টর্চ ছিল। সেটা কোনোরকমে বার করে, আবার চলতে শুরু করলাম। সাইকেল চালাচ্ছি, আর মাথার মধ্যে নানারকমের ভাবনা আসছে—এবার যদি আমাকে ধরে ফেলে শুঁড়ে করে ছুড়ে দেয়! ইঁদুরের মতো! আমাকে যখন মেরে দেবে আমার বাড়ির কেউ জানতেও পারবে না, কোথায় আমার বাড়ি, আর আমি এই আফ্রিকার রাস্তায় জঙ্গলের ধারে মরে পড়ে থাকব! এই সমস্ত ভাবনায় মনটা প্রথমে ভীষণ উদ্বেগে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল, তারপর সেই উদ্বেগ বদলে গেল ভয়ে, ভীষণ ভয়। আর তারপরেই আমার মনে হতে লাগল, কেন মরতে এই ওয়ার্ল্ড ট্যুরে এলাম। বাড়িতে থাকলে হয়তো জীবনে কিছু একটা করতে পারতাম। কত লোক আমাকে কত কথা বলেছিল, সেইসব মনে পড়ছে। একজন বলেছিল, অ্যাডভেঞ্চার ঠিক আছে, কিন্তু বাড়াবাড়ি করতে যেও না। শুনিনি। একসময় মনে হল, আমাকে এখন যদি কেউ বাঁচিয়ে দিয়ে বলে তোমায় তার পরিবর্তে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে থাকতে হবে, আমি বলব, তাই হবে, আমাকে বাঁচাও। বটসোয়ানার জঙ্গলে আমি একা একা মরতে চাই না!
এখানে একটা কথা বলি, জানি না সেটা কতটা অ্যাকসেপ্টেবল হবে তোমার কাছে। পৃথিবীতে তো কতরকমের মানুষ আছে, আমার ভাবনা যে সবসময় তোমার ভাবনার সঙ্গে মিলবে তার কোনো মানে তো নেই…
নী.হা. — কিচ্ছু যায় আসে না, তুমি যা বলতে চাইছ বলো।
জ.ম. — সেই। আমি জীবনে বেশ কয়েকবার এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, কিন্তু আমার গায়ে একটা আঁচড় লাগেনি, বেরিয়ে চলে এসেছি। তারপর আমি উপলব্ধি করেছি একটা সুপার ন্যাচরাল পাওয়ার আছে। যেটা আমাকে রক্ষা করেছে। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, আমাদের ক্লাসে শাঁখারিবাজারের ছেলে একজন পড়ত। তুমি তো জান, ওইপাড়ায় শিল্পীরা শাঁখের ওপর অসাধারণ খোদাইয়ের কাজ করেন, পৃথিবীবিখ্যাত। তো সে একদিন শাঁখের ওপর অপূর্ব খোদাই করা একটা মা-কালীর মুখ পরে ক্লাসে এসেছিল। লকেট। সেটা দেখে আমি ওকে বলেছিলাম এরকম আমিও একটা করাতে চাই, তো ও আমাকে করিয়ে দিয়েছিল। পরে আমার এক পিসতুতো দাদা সেটা রুপো দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিল। ওইটা আমি সারাক্ষণ গলায় পরে থাকতাম। ওয়ার্ল্ড ট্যুর করার সময়েও। সকালবেলা উঠে মা-কালীকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়তাম। এবং আমি বারবার বেঁচে গিয়েছি।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন ২৪ ডিসেম্বর)
এইটা দারুন হচ্ছে - চালিয়ে জান, পড়ছি।
ধুত্তোর -"যান" - অটোকারেক্ট !!!
অনবদ্য।
দারুণ
অপেক্ষায় রইলাম পরের কিস্তির , দারুণ লাাাগছে।
ভালোলাগা