দ্বিতীয় পর্ব—বিশ্বজয়ের আগে ভারতভ্রমণ
নীলাঞ্জন হাজরা — আচ্ছা শোনো, আমার মনে আছে তুমি একবার বলেছিলে যে দিল্লিতে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তোমার একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে দেখা হয়েছিল। সেটা কী ভাবে?
জয় মণ্ডল — সেই ঘটনাটা তোমাকে একটু আগের থেকে বলতে হবে, বুঝলে। আমি সেবার দিল্লিতে হন্যে হয়ে ঘুরছি, আমার ওয়ার্ল্ড ট্যুরের জন্য ফরেন এক্সচেঞ্জ কী করে জোগাড় করা যায়, আর কোথায় একটু থাকা যায় সেই চেষ্টায়।
নী.হা. — তার মানে তুমি সেই ১৯৭৩ থেকেই দুনিয়া ঘোরার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছ?
জ.ম. — না-না-না-না। এটা তার পরে। এটা ১৯৭৫ সালের কথা। আমি আর আমার এক বন্ধু, বিষ্ণুপুরেরই, মনমোহন চক্রবর্তী, বেরিয়ে পড়েছিলাম, যে সারা ভারত আগে সাইকেলে ঘুরব, তারপর বিদেশ চলে যাব। তারিখটা কখনও ভুলব না — ১৯৭৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। সেটা করেও ছিলাম, তবে মনমোহন একেবারে গোড়াতেই আফ্রিকায় আট-দশটা দেশ ঘুরে সেখান থেকেই ফিরে চলে আসে, আফ্রিকার ৪৯টা দেশ, ইউরোপ, উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, মানে বাকি দুনিয়া ঘোরাটা আমি একাই করেছিলাম। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে দেখাটা সেবারের কথা। মানে, ১৯৭৫ সালে যখন আমরা দুজন দুনিয়া ঘোরার আগে ভারত ট্যুর করছি, তখনকার…
নী.হা. — আচ্ছা, এবারে পরিষ্কার হল। এবার বল…
জ.ম. — হ্যাঁ। হন্যে হয়ে ঘুরছি, কী করে ওইসব ব্যবস্থা করা যায়। যেখানেই যেতাম কন্ট্যাক্ট তৈরি করার চেষ্টা করতাম। দিল্লিতে কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হল, তারা হয়তো আরও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এই ভাবেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল, তিনি কেরালাইট, কিন্তু তাঁর স্ত্রী বাঙালি। তাই বোধহয় আমাদের প্রতি একটা সফ্ট কর্নার তৈরি হয়েছিল। তিনি আমায় সেসময়ে প্রণব মুখার্জির দপ্তরের ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) যিনি ছিলেন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রণববাবু তখন ইন্দিরা গান্ধির সরকারে মিনিস্টার অফ স্টেট ফর ব্যাংকিং অ্যান্ড রেভিনিউ। যদ্দূর মনে আছে সেসময় তিনি ১১ আকবর রোডের বাড়িতে থাকতেন।
তো সেই ভদ্রলোক আমায় বললেন, ঠিক আছে আপনি আসুন ওনার বাড়িতে। গেলাম। দেখা হল না। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। ওই আর একটা জিনিসও পথে বেরিয়ে শিখেছি, জানো, সহজে হাল না ছাড়া। লেগে থাকতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে। কাজেই এরপর আমি প্রতিদিনই যেতে শুরু করলাম। সেসময় একজন ছিলেন, গাঙ্গুলিবাবু, সম্ভবত প্রণববাবুর পিএ। খুব ভদ্রলোক। আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন। তিনি আমাকে বলতেন, আসুন, একটু বসে চা খেয়ে, গল্প করে যান। যাই। কিন্তু দেখা আর কিছুতেই হয় না। একদিন বাড়ির পিছন দিকের মাঠে এক ভদ্রমহিলা বসেছিলেন। একজন এসে বলল, আপনাকে ম্যাডাম ডাকছেন। গেলাম। বললেন, আমি দেখি প্রত্যেকদিনই তুমি আসো। ‘তুমি’ দিয়েই শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়? কী চাও? বললাম যে সাইকেলে করে ঘুরছি। শুনে বললেন, তাই নাকি! তারপর একজনকে বললেন, আরে ওর জন্য একটু কিছু খাবার নিয়ে এসো। সেই শুরু। তিনি হলেন শুভ্রা মুখার্জি। প্রণববাবুর স্ত্রী।
শুভ্রা মুখোপাধ্যায় ও প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবিসৌজন্য https://www.aramva.co/
তা, ওনার কাছে দু-তিনদিন যাওয়ার পর জানতে পারলাম দিল্লিতে কালীবাড়ি বলে একটা জায়গা আছে। আমাদের তখন থাকার খুব অসুবিধা হচ্ছে। উনি বললেন, না-না। চিন্তার করো না, আমি কালীবাড়িতে বলে দিচ্ছি। গাঙ্গুলিবাবু, কালীবাড়িতে মিস্টার বাগচীকে বলে দিন তো। তারপর তো গেলাম সেখানে। আমাদের মিস্টার বাগচী বললেন, আপনারা কিন্তু তিনদিনের বেশি থাকতে পারবেন না। ওদের ওখানে তখন দুপুরে খাওয়া পাওয়া যেত—ভাত, ডাল, মাছ, একটা সবজি আর চাটনি। একটা কুপন নিতে হত দু-টাকা দিয়ে। কিন্তু আমাদের কাছে তখন দু-টাকাও থাকত না। মিস্টার বাগচী আমায় বললেন, ঠিক আছে খাবার সময় চলে আসবেন আপনাদের প্রত্যেক দিন একটা করে কুপন দেওয়া হবে। আর ওদের গেস্টরুমে আমাদের দু-জনকে একটা ঘর দেওয়া হল।
তিনদিনের দিন বাগচী বললেন, কাল আপনাদের ঘর ছেড়ে দিতে হবে। আমি বললাম, আর-একটা-দিন থাকতে দিন। উনি বললেন, না। হবে না। আমি আবার গেলাম মিসেস মুখার্জির কাছে। উনি বললেন, সে কী! একটা বাঙালি ছেলে এসেছে… বাগচীকে ফোনে ধরে আমাকে দিন তো গাঙ্গুলিবাবু। আমার থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু বুঝলাম, মিস্টার বাগচী খুব বিরক্ত হয়েছেন। বললেন, খেতে হলে এবার থেকে কুপন কিনে খাবেন। সাইকেল ট্যুরে বেরিয়েছেন, এ সব ব্যবস্থা করে আসেননি কেন? কী আর করব। আমাদের কাছে তো দু-টাকা দিয়ে কুপন কেনার টাকা নেই। কিন্তু আমি কাউকে কিছু বলিনি। একদিন ফের গেছি প্রণববাবুর সঙ্গে দেখার আশায়, হঠাৎ মিসেস মুখার্জি বললেন, কী খাওয়া-দাওয়া হয়েছে? আমি বললাম, সকালে ব্রেড পকোড়া খেয়েছি ব্রেকফাস্টে। তখন দিল্লিতে খুব পাওয়া যেত, ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হতো, গরীব মানুষরা খেত খুব। এখনও পাওয়া যায়? ব্যাসন দিয়ে পাঁউরুটি ভাজা। উনি বললেন, কেন? ওরা খেতে দিচ্ছে না। আমি বলতে চাইনি, জানো নীলাঞ্জন, কিন্তু কী আর করি, বলতে বাধ্য হলাম ব্যাপারটা। সঙ্গে সঙ্গে উনি আবার ফোনে ধরলেন। তো এইভাবে চলল…
যেদিন ছেড়ে যাব, তার আগের রাত। তখন প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। দেখি দরজায় কে ঠকঠক করছে। আমিই খুললাম। খুলে দেখি এক ভদ্রলোক। বললেন, আপনি একটু আসবেন আমার কাছে, এই পিছনের রুমটায়। একটু সাহায্য লাগত… । তাড়াতাড়ি গেলাম। ভীষণ শীত দিল্লির। গিয়ে দেখি ঘরের মেঝে বমিতে ভরতি। তারপর আমি বালতি করে জল ঢাললাম, আর উনি একটা ঝাড়ুতে করে ঘরটা পরিষ্কার করলেন। তখন দেখি এক ভদ্রলোক বিছানায়। খালি গা। একেবারে টিকটিকে রোগা। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি খেয়েছেন? বললাম, খেয়েছি। তা তিনি বললেন, ওই দেখুন আমাকে ভাত দিয়ে গেছে। আমি খাব না। কিন্তু আমি ভাত নষ্ট করতে চাই না, আপনি খেয়ে নিন! যে ভদ্রলোক আমায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে বললাম, আমি তো খেতে পারব না। তিনি বললেন, ঠিক আছে। কিছু বলতে হবে না। চলুন। বাইরে চলুন।
বাইরে এসে পরিচয় হল। আমি সাইকেল ট্যুরের কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী করেন? বললেন, আমি অভিনয় করি। আর উনি? উনি ডিরেক্টর। বললাম, কী নাম ওনার? বললেন, উনি ঋত্বিক ঘটক! আমি ভাবলাম, মাই গড! আমি একজন লিজেন্ডকে এখুনি দেখে এলাম!! তারপর জানলাম, ঋত্বিক ঘটকের ছবির একটা রেট্রোস্পেকটিভ হচ্ছে দিল্লিতে, তাই উনি এসেছেন। আর এই ভদ্রলোক ওঁর অযান্ত্রিক ছবিতে একটা ছোট্টো রোল করেছিলেন। সেই রাতে আমি ডাইরিতে লিখলাম—Unexpected meeting with a legend!
তো পরের দিন সকালে উঠেই আমি চলে গেলাম সেই ঘরে। দেখলাম, ঋত্বিকবাবু আমাকে দেখে একটু অস্বস্তি বোধ করছেন। বুঝলাম, আগের রাতের কথা ওনার খেয়াল আছে। যাই হোক, সেই অভিনেতা ভদ্রলোক…
নী.হা.— কার কথা বলছ বলো তো? কী নাম?
জ.ম. — নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না, অভিনেতা ছিলেন। অযান্ত্রিক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। বড়ো কোনও রোলে নয়… তা যাই হোক, তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বললাম, আমার এই লগবুকে আপনি যদি কিছু লিখে দেন দয়া করে! উনি বললেন, ও! সাইকেলে করে! কোথা থেকে? বললাম, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর থেকে। বললেন, খুব ভালো জায়গা। খুব ভালো জায়গা। ধ্রুপদসংগীতের পীঠস্থান। টেরাকোটা তো আছেই। কিন্তু আপনি সংগীতের রাজ্য থেকে এসেছেন। তারপর উনি ছোটো করে লিখলেন, আশা করি আপনার বিশ্বভ্রমণ সফল হবে। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে। ঋত্বিক ঘটক। আর নিজের নামটা সই করলেন প্রায় পাতা জুড়ে! জানো, পাঁচ-ছ-মাস আগে হঠাৎ ডাইরিটা খুঁজে পেলাম!
(ক্রমশ। পরের কিস্তি পড়ুন ২৯ অক্টোবর…)
বা:
দুর্দান্ত