প্রথম পর্ব—প্রস্তুতি (পূর্বপ্রকাশিত অংশের পর...)
নীলাঞ্জন হাজরা—শুনেছিলাম এই ভারত ঘোরার সময়েই তোমাদের চম্বলের ডাকাতে ধরেছিল। তুমি ওই চম্বলের অভিজ্ঞতাটা বলো।
জয় মণ্ডল—তখন আমরা সিমলা থেকে ফিরছি। নারকাণ্ডা থেকে নাহান হয়ে একেবারে এটাওয়ার দিকে চলেছি। বেশ বেলা আছে। তো একটা জায়গায় একজনকে জিজ্ঞেস করলাম জায়গাটার নাম কী? বলল পাওন্টা সাহিব। পাশ দিয়ে যমুনা নদী বইছে। তো কথায় কথায় বলল, যে এর উলটোদিকেই হল চম্বল। তো, আমি বললাম, এখানে চম্বল? বলল, হ্যাঁ, এখান থেকেই চম্বল উপত্যকা শুরু হয়েছে। আমরা তখনই ঠিক করলাম, এটোয়ার দিকে না গিয়ে সাইকেল ঘুরিয়ে চম্বলে যাব। চম্বলের দিকে চলতে শুরু করলাম।
তো সেই চম্বলে গিয়ে যখন পৌঁছোলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।১ সেইখানে একজন এসে বলল, তোমরা আর যাবে না। আমার সঙ্গে আমার বাড়িতে যাবে।
নী.হা.—দাঁড়াও। আর একটু পরিষ্কার করে বুঝি। তোমরা একটা গ্রামে পৌঁছোলে?
জ.ম.—হ্যাঁ। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশে যেরকম ছোটো ছোটো গ্রাম হয়। চারপাশে পাহাড়, আর গিরিখাত। সব দেয়ালে ঘুঁটে দেওয়া। লোকটা আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে গেল, সেখানে দেখি সকলের হাতে বন্দুক। তো সে আমাদের নিয়ে একটা ঘরে সবে ঢুকেছে, দেখি আর একটা লোক এসে হাজির। এরপর ওদের দু-জনের মধ্যে কী যে কথা হল দেহাতি ভাষায় কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু তারপরেই সেই লোকটা বলল, ইহাঁসে চলিয়ে আপলোগ! আমি বললাম, কোথায় যাব? বলল, আপ আইয়ে। হামারে তেহশিলদার সাহাব আপকো বুলা রাহা হ্যায়।
তা আমি তো ভাবলাম থানার তহশিলদার ডেকে পাঠিয়েছে। ওমা, কোথায় থানা? থানা-টানা নেই। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটা বিশাল চেহারার লোকের কাছে। তার খুব যত্ন করা বিশাল গোঁফ। মোটা-সোটা। লম্বা। ধুতি পরে আছে। চল্লিশের শেষের দিকের মতো বয়স। সেটা শীতকাল। ফেব্রুয়ারির গোড়া। সে তো আমাদের একটা ঘরে বসাল। চারপাইয়ের ওপর। বলল, বাব্বা, তোমরা তো অনেক বড়ো কাম করছ। সাইকেলে করে আসছ বাংগাল থেকে। আরও নানা কথা। তো আমি বললাম, আপনার কী নাম? বলল, তেহশিলদার সিং!! আমি বললাম, আমাদের এখানে আনলেন কেন? বলল, উয়োলোগ বদমাশ হ্যায়। ডাকু হ্যায়! আমি খবর পেলাম যে তিনটে বাচ্চা ছেলে এসেছে সাইকেলে করে, তাদের রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ওদের লক্ষ্য হল বন্দি করে তারপর পণ চাইবে। আমি বললাম, তোমার কথাতেই ছেড়ে দিল? বলল, হ্যাঁ, আমি আমার শাগরেদকে পাঠিয়েছিলাম তো। ও কিন্তু নিজের বিষয়ে কিছুই বলল না।
রাত্রিবেলায় রুটি খেলাম। জীবনে প্রথম বাজরার রুটি খেলাম। বিশুদ্ধ নিরামিষ খানা, বুঝেছ। আর একটার বেশি রুটি খেতে পারলাম না। এত মোটা মোটা সেই রুটি। তো তাই দেখে উনি রসিকতা করলেন, বাঙ্গালিলোগ খেতে পারে না, ওইজন্য এত ছোটো ছোটো চেহারা! তারপর বলল, কিন্তু বাঙালিরা মাছ খায়, তাই ওদের অত্যন্ত বুদ্ধি হয়! তারপর রাত্রে গল্প করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী করেন? তো বলল, আমি কিছু করি না। তবে আমার বাবা এই অঞ্চলের খুব নাম-করা মানুষ ছিলেন। বললাম, কী নাম আপনার বাবার? বলল, ডাকু মান সিং!!
তখন আমি বললাম, সে কী? কী বলছেন? বলল, হ্যাঁ। আমার বাবার নাম মান সিং! আর তাউজি-র নাম নবাব সিং! আমি ভাবলাম, মাই গড! দু-জনেরই তো নাম শুনেছি। বলল, আমার বাবা তো মারা গেছেন। কিন্তু তাউজি এখনও বেঁচে আছেন। কাল তোমাদের নিয়ে যাব। বারান্দায় চারপাই পেতে দিল, কম্বল দিয়ে দিল।
পরের দিন ভোরবেলা পাশেই চম্বল নদীর পাড়ে প্রাতঃক্রিয়া সেরে টেরে, হাত-মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে, ওর জ্যাঠামশাইয়ের কাছে গেলাম। দেখলাম সত্তরের মতো বয়স। তাঁর চোখগুলো নেই। তো আমি জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, প্রথম থেকেই অন্ধ? উনি আবার যা বলছিলেন তার অর্ধেক বুঝতে পারছিলাম না, দেহাতি ভাষায় কথা বলছিলেন। তেহশিলদার সিং ট্র্যান্সলেট করে দিচ্ছিল। তো বললেন, না। আমাদের পুলিশ টর্চার করত তো, আর কে আছে বল্ তোদের দলে, আমরা বলতাম না, তখন আমাদের ওপর টর্চার করা হত। তো একবার চোখের মধ্যে শিক ফুঁড়ে দিয়েছিল। আমি বললাম, কী বলছেন? বলল, হ্যাঁ। তারপর ওনার ছবি তুললাম। তেহশিলদার সিংয়ের ছবি তুললাম। তারপর তেহশিলদার আমাদের একেবারে মেন রাস্তা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে গেল, দুপুরের খাবার খাইয়ে।
নী.হা. —তারপর?
জ.ম. —তারপর বিকেলের দিকে চা-টা খাবার জন্য একটা পুলিশস্টেশনে দাঁড়ালাম। পুলিশস্টেশনে দাঁড়াতাম কারণ তাহলে বিকেলের খাবারটা ফ্রি-তে হয়ে যেত, একটা সিঙাড়া, কী একটু পকোড়া, যা হোক। নিজেদের খরচ করতে হত না। তো যাই হোক, আমি তেহশিলদার সিংকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলাম যে আমরা গেছি। সেটা আমি দারোগাকে দেখালাম। সে বলে, ইয়ে তেহশিলদার সিং উয়ো তেহশিলদার সিং?! মান সিং-কা বেটা?! আমি বললাম, হ্যাঁ। বলল, তুম উনকো মিলে হো? আমি বললাম, হ্যাঁ। কেন? বলল, আরে উয়ো তো কিসিসে ভি মিলতা নেহি। আমি বললাম, আমাদের তো রাস্তা থেকে একটা লোক ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর তেহশিলদার সিং নিজেই লোক পাঠিয়ে ডেকে নিল। তখন সেই দারোগা বলে, ‘আচ্ছা! তো উয়ো তুম থে?’ তা আমি বললাম, কেন? বলল, আমাদের কাছে খবর এসেছিল তিনটে ছেলে সাইকেলে এসেছে বাইরে থেকে, উসকো উঠাকে লে গয়া। ওরা এরকমই করে। ধরে রাখে তারপর র্যানসম চাইবে। কিন্তু তারপর আমরা আর ট্রেস করতে পারলাম না! আচ্ছা, তো তুম থে?
তো সেই পুলিশ অফিসার এত প্লিজ্ড হয়েছিল, বুঝলে নীলাঞ্জন, যে বলল, এখন তো চারটে বেজে গেছে, এখন আর কোথায় যাবে? আপ ইধরহি ঠহর যাইয়ে। পুলিশস্টেশনের পাশেই ছিল ওর কোয়ার্টার। কোথা থেকে মুরগি আনিয়ে, রান্না করে আমাদের খাওয়াল। খাওয়ার সময় বিবিকে পর্যন্ত বলছে, ‘সুনতি হো, ইয়ে তেহশিলদার সিংকো মিলকে আয়েঁ হ্যায়ঁ!!’ তখন আমি বুঝলাম তেহশিলদার সিংয়ের এলেমটা! এই হল আমাদের চম্বলের সামান্য অভিজ্ঞতা!
নী.হা.—বেশ, আমি এও শুনেছি যে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গেও তুমি সেসময় দেখা করেছিলে বহু কষ্টে, সেটা কী করে সম্ভব হল?
জ.ম.—প্রথমে সেটা সম্ভব হয়নি। সেসময় মিসেস গান্ধি ১ নং সফদরজং রোড-এ থাকতেন। যেটা এখন মিউজিয়াম। মিসেস গান্ধি সেসময় দরবার বসাতেন। তো, সেই জেনে আমি তো সফদরজং রোডে চলে গেলাম। আমাকে ঢুকতেই দিল না। আমি তারপর রেলভবনের এক বড়ো অফিসার, নাম ছিল আর কে গোয়েল, তাঁর কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ‘সাইকেলমে হিন্দুস্তান সয়ের কর রহে হো তো কেয়া? প্রাইম মিনিস্টারকে সাথ মিলনে কা জরুরত কেয়া হ্যায়। কোয়ি জরুরত নেহি। চলো ইঁহাসে! টাইম বরবাদ করতা হ্যায়!’ এই বলে আমাদের বার করে দিলেন।
এবার, এনসিসি করতাম তো। তো যিনি আমাদের গ্রুপ ক্যাপ্টেন ছিলেন তাঁর নাম ছিল গুরদয়াল সিং। সেনাবাহিনী থেকে এনসিসি-তে ডেপুটেশনে ছিলেন। তো তিনি আমাদের এই কাশ্মীরের ট্রিপটার শুরুর সময় সি-অফ করেছিলেন। যাই হোক, এর মধ্যে গুরদয়াল সিংকে সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার্স-এ ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছিল। তো আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তিনি একটা বুদ্ধি দিলেন—বললেন তুমি একটা চিঠি লেখো। তাতে লেখো, আমরা সাইকেলে ভারত তো ঘুরছিই, কিছু অর্থও জোগাড় করছি, তার থেকে সামান্য কিছু হলেও, কিছুটা টাকা প্রাইম মিনিস্টার্স রিলিফ ফান্ডে দিতে চাই। সেটা নিয়ে আবার গোয়েলের কাছে যাও। উনিই চিঠিটার ড্রাফ্ট করে দিলেন। তো আমি একটা মানি অর্ডার চেক তৈরি করে ফের চলে গেলাম।
গোয়েল সব দেখে-টেখে বললেন, তুমলোগ তো বহত তঙ্গ কর রহে হো। ঠিক হ্যায় কাল সুবে আ যাও। আমরা চলে গেলাম সকালবেলাতেই তিনজনেই। গোয়েল দেখলাম সেখানে রয়েছেন। তিনি বলেদিলেন। ঘরে ঢুকে দেখি বেশ কিছু লোক বসে আছে। পঞ্চাশ-ষাটজনেরও বেশি। মাটিতে তিরপল পাতা। আমরা একেবারে সামনের সারিতে গিয়ে বসলাম। মিসেস গান্ধি এলেন। আমি তো থ। কী যে লাবণ্যময়ী! তো উনি বাঁদিক থেকে সবাইকার সঙ্গে একে একে এক-দুমিনিট কথা বলতে বলতে এগোচ্ছিলেন। যেই আমাদের সামনে এলেন আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবাই আমায় বসিয়ে দিতে চাইছিল, কিন্তু আমি শুনিনি। আমি সেই চিঠি আর মানিঅর্ডারের রিসিপ্ট শুদ্ধু খাম ওঁর হাতে দিয়েদিলাম। উনি সেটা পাশের লোকের হাতে চালান করে দিলেন। এইবার আমি লগ-বুকটা ওনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। উনি তাতে শুধু দুটি জিনিস লিখলেন। কী লিখলেন শুনলে তুমি অবাক হবে—উনি শুধু লিখলেন ইন্দিরা গান্ধি। প্রথমে ইংরেজিতে। তারপর পরিষ্কার বাংলা হরফে! এরপর আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা! তো তোমরা সাইকেলে ঘুরছ? আমি বললাম, হ্যাঁ। আর সেই সুযোগে এটাও বলেদিলাম যে এবার দুনিয়াও ঘুরতে চাই। তো উনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা সারা ভারত দেখেছ? বললাম, না। বললেন, আগে সেটা দেখো। এতরকমের মানুষ, এতধরনের সংস্কৃতি, খাওয়া-দাওয়া। এটাই তো একটা দুনিয়া। আগে নিজের দেশটাকে চেন। বিশ্বাস করো, আজও ওনার সেই গলাটা আমার কানে বাজে—ওই কথাটা! এবং আমি কিন্তু সেটা পরে করেও ছিলাম। সেসব কথাও তোমায় বলব। যাই হোক, তারপরে উনি আমাদের আর আরও কয়েকজনের সঙ্গে ছবি তুলে চলে গেলেন। সেই ছবি এখনও আমার কাছে আছে। দেখলে আমাকে চিনতেই পারবে না!
অপূর্ব
দারুন! ভবিষ্যতে ছবি দেখার কৌতুহলও রইল।
তেহশিলদার সিং পড়ে সিনেমায় দেখা সুবেদার সিং - পান সিং তোমর মনে পড়লো।
একটাই অস্বস্তি - এত চমৎকার বিভাগটার নাম ঘুমক্কড় না হয়ে আরেকটু বাংলা কোন শব্দ হতে পারতো না?
সাক্ষাৎকারটি — মানে আসলে জয় মণ্ডলের কাহিনি — পড়ে যাঁদের ভাল লাগছে তাঁদের পাঠপ্রতিক্রিয়াই আমাদের উৎসাহের আসল উৎস। সকলকে ধন্যবাদ। ‘ঘুমক্কড়’ নামটা অনেক ভেবে রেখেছি। সেটা প্রণম্য রাহুল সাংকৃত্যায়নের একটি দুরন্ত বইয়ের নাম থেকে সরাসরি নেওয়া। এ শব্দটার মধ্যে যে দ্যোতনা আছে ঠিক সেটা বোধকরি কোনও ‘বাংলা’ শব্দে পাওয়া মুশকিল। অজস্র আরবি ফারসি ইংরেজি পোর্তুগিজ শব্দতো বাংলা হয়েই গিয়েছে। ঘুমক্কড়কেও একাত্ম করে নিলে ক্ষতি কী। যেহেতু জয়ন্ত মণ্ডলকে ৪০ বছরেরও বেশি চিনি মানুষটাকে এক মহাঘুমক্কড় ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না!! পড়তে থাকুন মতামত দিতে থাকুন।
আরো কিছু দূর প্যাডেল করার সাহস পেলাম...
অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
দু চাকায় দুনিয়া পড়েছিলাম। এটা পড়ে ভালো লাগলো। পরবর্তী কিস্তির আশায় রইলাম।
অপেক্ষার শুরু. ....কি যে ভালো লাগছে ।
দারুণ
ঘুমক্কড় = ?
ঘুমক্কড় শব্দটির কাছাকাছি বাংলা প্রতিশব্দ হল "ভবঘুরে"।
আজকে সবকটি পর্ব পড়ে ফেললাম, একটানা।
অসাধারণ। অবশ্যই ""দুচাকায় দুনিয়া" মনে পড়বে।
কিন্ত জয়ের সহায় সম্বল কম, পরিশ্রম বেশি।
দারুন। পড়ে চলেছি