শীতের হাওয়ার লাগল নাচন............
শীত এলেই এই শহরে পিকনিকের ধুম পড়ে যায়। অবশ্য শীত কালটা হয়ও খুব সুন্দর। কনকনে ঠান্ডা রাত্রি, ঝলমলে রোদের দিন, ঝকঝকে নীল আকাশে ভাসে দূর পাহাড়ের বরফ চূড়া। আগে তো শীতের শুরুতেই হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়ে, রেজাল্ট বেরোতো ক্রিসমাসের ছুটির আগে। ছুটিটা তাই মজায় ভরা থাকত, এমনিতে ক্যাম্পাসে একটু সাহেবিয়ানা বেশী বেশী, লোকে হরদম বিদেশ যাচ্ছে পড়তে বা পড়াতে, বিদেশী ছাত্রছাত্রীও আছে বেশ কিছু, তাই ক্রিসমাসের শুরুতেই সেজে ওঠে ঘর বাড়ি রাস্তা। এর ওপরে আবার এই শহর জুড়ে আছে বেশ কয়েকটা পুরনো নামী চার্চ। ঝিমলিদের স্কুলের চ্যাপেলও সেজে ওঠে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই, সাজানোর কাজে সিস্টারদের সাহায্য করে ছাত্রীরা যারা আর্টস আর ক্রাফটে ভালো, অনুর মত। আর অনু যেখানে সেখানে ঝিমলি থাকবেই। প্রতি বছরই ওরা খুব ভালোবেসে টাইনি টটের সিস্টাররা যারা এর দায়িত্বে থাকে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। ক্লাস টেনের পর থেকে তো ওদের পরীক্ষার সময়গুলো সব উল্টোপালটা হয়ে গেছে, এসময় ওদের ছুটি, আর ছুটির পরে প্রিবোর্ড, তাই এই দু বছর আর ওরা ক্রিসমাস ডেকরেশনে নেই, এমনকী ছুটি পড়ার দিনের সকালে যে প্রোগ্রামটা হয় প্রতি বছর সেটাও বোধহয় আর এ জন্মে দেখা হবেনা। গত বছর থেকে ওদের ক্লাসের সরিতা আর সান্টা সাজেনা, শুনছিল, ছোটরা নাকি সান্টার বদলটা ঠিকমত বুঝতে না পেরে, জিজ্ঞেস করেছে, “সান্টা দিদি, তুমি এত রোগা হয়ে গেছ কেন?”
সরিতা অবশ্য এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিল। স্পেশ্যাল ক্লাসে সবাই এ নিয়ে মজা করছিল যখন ও ঘুরেফিরে সবাইকে দেখাচ্ছিল ও কত রোগা হয়ে গেছে, আবার তাও নাকি পড়াশোনার চাপে। এমন কথাকে আদৌ কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না। সরিতা এ শহরের ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে, এরকম যে কটি মেয়ে ওদের ক্লাসে পড়ে বা অন্যান্য ক্লাসেরও যারা, সবাই মোটামুটি জানে যে ওরা কোনক্রমে পাশ করে এ শহরের কলেজে ভর্তি হলেই ওদের বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে। তাই গুটিকয়েক ছাড়া ওরা খুব একটা পড়াশোনার ধার দিয়ে যায়না। সরিতা আবার এই দলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফাঁকিবাজ, সাজগোজ পোশাকআশাক এসবেই দিন কাটে। চেহারাটাও লম্বা চওড়া গোলগাল, ঝিমলি বা অনুর পাশে তো বড় দিদির মত লাগে। এখন ক্লাস এইটের মনপ্রীত সান্টা সাজছে, ও সর্দারনী বলে লম্বা, কিন্তু খুব ভালো অ্যাথলীট, তাই রোগা পেটানো চেহারা, সরিতার মত নাদুসনুদুস নয়। অনু আবার সিস্টারকে বলে এসেছে পরের বার থেকে ও গিয়ে মনপ্রীতকে মোটা সান্টা বানিয়ে দেবে, ড্রেসটাতে তুলো ভরে আর পেটে বালিশ বেঁধে, সিস্টার শুনে খুব খুশী।
ঝিমলিরই বরং মন খারাপ হল এই ভেবে যে অনু এখানেই রয়ে যাবে, এই শহরে থেকে স্কুল, আর তার চারধারে ওদের সবকিছুর সাথে জড়িয়ে, অথচ তার এখানে থাকা হবেনা। এখানে তো বাইরে শুধু ওই ডিগ্রি কলেজ। ক্যাম্পাসে যদি চান্স পায় তাহলে এক কথা, তবে সেটা শক্ত, ওদের সেন্ট্রাল বোর্ড আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা গুলোর সিলেবাস রাজ্যের বোর্ডের অনুযায়ী, অনেক আলাদা। তাই এখানে ওদের স্কুলের থেকে পাওয়া খুব কঠিন যদিনা কেউ শুধু এখানের জন্যেই আলাদা করে প্রিপেয়ার করে।
শীতের ছুটি পড়ে গেলে ওরা ছোটরাও নিজের নিজের দলে ভাগ হয়ে ছোটখাটো পিকনিক করে। শহরের শেষপ্রান্তে একটু উঁচু টিলা মত আছে যেখান থেকে দূরের পাহাড়কে খুব কাছের মনে হয়, ফাঁকা জমিটায় সবুজ সিল্কের চাদরের মত ঘাস বিছানো। বাড়ি থেকে কিছু কিছু খাবার আর পেতে বসার চাদর, গেমস নিয়ে সকাল সকাল সাইকেলে রওনা দেয়। জায়গাটা ক্যাম্পাসের চৌহদ্দির মধ্যে পড়ে আর তাই বাইরের লোকজন ঢুকতে পারেনা বলে ফাঁকাই পাওয়া যায়। অনেকজন মিলে ওখানে আসার মত নয়, আর কাছে পিঠে জলের ব্যবস্থা নেই বলে ভেতরের পিকনিক পার্টিরাও আসেনা। সব মিলিয়ে ওদের পছন্দের জায়গা এটা, আগে আরো ছোট ছিল যখন, ব্যাডমিন্টন নিয়ে আসত। বড় ক্লাসে ওঠার পর গল্পই এত থাকে যে খেলার কথা মনেই হয় না। বাড়িতে মা, আন্টি, স্কুলের টিচাররা সবসময় অনুযোগ করে, দেখা হলেই নিজেদের মধ্যে বলে, “এদের কী এত গল্প বলুন তো? সবসময়, ক্লাসের মধ্যে, বাইরে, বাড়িতে, পড়তে গিয়ে, রাস্তায় চলতে গিয়ে, এত কী কথা বলে! আবার শোয়ার সময় বাদ দিলে যেটুকু সময় আলাদা থাকে তাতেও ফোন।“
ক্রিসমাস এবারে আনন্দ আর দুঃখ দুই নিয়েই এসেছে। জয় বাড়ি এসেছে আর এদিকে কদিন পরেই তার প্রিবোর্ড, প্র্যাকটিকাল বাকী, স্পেশ্যাল ক্লাস, স্কুলে যেতে হচ্ছে, শেষবেলার চরম ব্যস্ততা। দেখা সাক্ষাত দূরের কথা, দূর থেকে ফোনে যা কথা হত তাও হচ্ছে না। অনু ওকে ক্লাসে আসতে দেখলেই খ্যা খ্যা করে হাসছে, বেচারা ঝিমলির এমন একজন জুটেছে যে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে দেখা করার কথা শুনলে আঁতকে উঠবে। অবশ্য ঝিমলি নিজেও খুব একটা উদ্যোগ নিচ্ছে না, এত সিলেবাস স্কুলের পরীক্ষা, ভর্তির পরীক্ষা, সব মিলিয়ে নিজেকে খুব দিশেহারা লাগছে। জয় এসে পৌঁছনোর আগে একটা ভালোলাগা কাজ করছিল, কিন্ত আসার পরে বুঝল যে এত কাছে থেকেও দেখা হওয়া সহজ নয়। খুব আশা করেছিল বাসু আন্টি হয়ত নিজেই ওকে বাড়ি আসতে বলবে, কিন্তু কোথায় কী। সেই দেওয়ালির পর থেকে আন্টি ওকে দেখলেই আদর করবে, গলে পড়বে কিন্তু মুখে শুধু বলবে, “ভালো করে পড়াশোনা কর সোনা, তোরা দুজনে এক জায়গায় থাকলে আমার খুব নিশ্চিন্ত লাগবে।“ অর্থাৎ সব শেয়ালের এক রা, মা ছেলে দুজনেরই শুধু কাজ ঝিমলিকে পড়তে বলা। এরকম তো বাড়িতে মা দাদাও করে না, তারা ভাবে মোটামুটি রেজাল্ট করে একটা ঠিকঠাক জায়গায় পড়লেই হবে। প্রেমের নেসেসারী আর সাফিশিয়েন্ট কনডিশন যে এরকম একটা টপ ইন্সটিটিউটে চান্স পাওয়া এ জিনিস ঝিমলি জন্মে শোনেনি, অনুও না।
অথচ বাসু আঙ্কল, যিনি নিজে অতবড় প্রফেসর, তিনি ভুলেও পড়াশোনার কথা বলেন না। বরং ঝিমলিকে দেখলেই ওনার মজার মজার গল্প মনে পড়ে, অবশ্য গল্পগুলোতে মজা কোথায় তা ঝিমলি অনেক সময় বুঝে উঠতে পারে না কিন্তু আঙ্কল গল্প বলে নিজেই হেসে সারা, আর তখন ঝিমলি না বুঝেই হাসি হাসি মুখ করে থাকে। এমনিতে শহরের বাঙালি মহলে আঙ্কল কে নিয়েই অনেক মজার গল্প হয়। একবার আন্টি হবিজ ক্লাবের জন্যে নাচের রিহার্সাল করাচ্ছিল নিজের বাড়িতে। ছুটির দিন, রিহার্সালের ফাঁকে রান্না সারতে হচ্ছিল। কড়াইতে তেলে পেঁয়াজকুচি দিয়ে আঙ্কলকে বলেছে ভাজতে, পেঁয়াজের রঙ বাদামী হয়ে আসলে তাকে যেন ডাকে। এবার আন্টির নাচ শেখাতে শেখাতে খেয়াল হয়েছে বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেছে, এতক্ষণে তো পেঁয়াজের বাদামী হয়ে যাওয়ার কথা, তো চেঁচিয়ে আঙ্কলকে ডেকেছে, “কী হল, বাদামী হয় নি এখনো?”
আঙ্কলও রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উত্তর দিচ্ছে, “ না বাদামী হয় নাই, কালা হইসে।“
এহেন আঙ্কলকে ঝিমলির খুব পছন্দ। আজকাল আবার আঙ্কল ওর বাড়ির লোকেদের দেখাদেখি ওকে ঝিম বলে ডাকতে শুরু করেছে। ভাগ্যিস দু বাড়ির মধ্যে তেমন আলাদা করে দেখা সাক্ষাতের চল নেই, নাহলে মায়ের যা চোখ আর কান, ঠিক খেয়াল করে জেরা করা শুরু করত। লক্ষ্মীপুজোয় ডাকাটা নিয়ে তেমন শোরগোল তোলেনি এই ভেবে যে মিষ্টি কিনে দিয়েছিল তাই।
বাঙালী দলের শীতের পিকনিক প্রতি বছর চব্বিশে ডিসেম্বরের দুপুরে হয়। এমনিতে অন্যান্য বছর ঝিমলি যেতে চায় না। ওর বয়সী কেউ নেই, আর মাম্পিদি, মেঘলা দিদিদের মত বড়রা কেউ যেতনা। ক্লাস এইট অবধি তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হত, নাইন থেকে সে পুরো বিদ্রোহ করে বসল। নিয়ে গিয়ে তো খেলার কিছু নেই, সঙ্গীও নেই। বেশীরভাগই যাওয়া হত ক্যানালের ধারের জঙ্গলে নয়ত দূর গ্রামের আমবাগানে। ও একটা বই নিয়ে যেত, সারাদিন গাছের ছায়ায় বসে বই পড়ে, খেতে ডাকলে খেয়ে বেজার মুখে দিন কাটাতো, আর মা বাড়ি ফিরে মহা বকুনি দিত এই নিয়ে, ঝিমলি নাকি একদম অসামাজিক, কারোর সাথে মিশতে পারে না, সবাই কী মনে করছে, এরকম প্রবাসে সবাই পরিবারের মত, না গেলে খারাপ দেখায়। ক্লাস নাইনে জোর করলেও টেন থেকে মা নিজেই আর যেতে বলে নি।
বড় ক্লাসে ওঠার পর জয়কে কখনো পিকনিকে দেখেছে বলে মনে পড়ে না। চব্বিশে কোনো ক্লাসও নেই, পিকনিকে গেলে দুজনের দেখা হতে পারে। যদি একটু সুযোগ করে দূরে গ্রামের ভেতরে চলে যায় তাহলে বড়রা হট্টগোলে খেয়াল করবে না, অন্তত অনেকটা হাঁটা তো যাবে একসাথে। জয়ের বয়সী যারা আছে তারাও কেউ যায়না, তাদেরকে না জানালেই হবে। এমনিতে এ শহরে একটু দাঁড়িয়ে এক জায়গায় দুটো ছেলেমেয়ে কথা বললেই সেটা খবর হয়ে আকাশে বাতাসে রটে যায়। সে দেখলে বাঙালীদের পিকনিক নিয়ে অত কথা হবেনা আর সেখানে দুটো বড় ছেলেমেয়ে বোর হয়ে নিজেদের বয়সী সঙ্গী না পেয়ে একসাথে সারাদিন গল্প করলে সেটাকে উপস্থিত পাঁচজনে অত ধর্তব্যের মধ্যে আনবে না। সাত পাঁচ ভেবে ঝিমলির প্ল্যানটা বেশ খাসা মনে হল, মা কে দু বার জিজ্ঞেসও করে ফেলল, এবারে ওইদিনে প্রতিবারের মত পিকনিক হচ্ছে কিনা। মা এবার যাবেনা তার জন্যে শুনে সে মাকে নানা যুক্তি দিয়ে রাজী করাতে চেষ্টা করল, এবং মোটামুটি নিমরাজী করেও ফেলল। এটাই তো শেষ বছর, আর কবে এরকম পিকনিকে যেতে পারবে, বড়রা সবাই ওকে কত ভালোবাসে, কবে কে কোথায় চলে যাবে, আবার এভাবে জমায়েত আড্ডায় দেখা কবে হবে, ইত্যাদি আবেগঘন হাল্কা মোলায়েম যুক্তি তর্কে মা বেশ নরম হল, মেয়ে এতদিনে সমাজের গুরুত্ব, লোকজনের মর্ম বুঝেছে বলে।
এর পরের কাজটা সহজ বলে মনে হয়েছিল। একবার অনুদের বাড়ি থেকে জয়কে ফোন করে বলে দেওয়া পিকনিকে যাওয়ার জন্যে। দুদিন আগে স্কুল থেকে সোজা অনুর বাড়িতে গেল তাই, মাকে না বলেই। অনু এর আগে অনেকবার বলেছে ওর বাড়ি থেকে ফোন করতে কিন্ত জয়ের বাড়ির লোকেরা যদি কিছু ভাবে! আর এছাড়া ঝিমলির অল্প অল্প অভিমানও জমছিল, ওদিক থেকেও তো কোন সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয়না। আসার একদিন পরেই ওদের বাড়ি এসেছিল, দাদার সাথে কী একটা প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে, তখন এক ফাঁকে একবার ওর ঘরে ঢুকেছিল, কী একটা বই আছে কিনা দেখতে। সেই পড়া নিয়ে কথা শুরু করেছে কী করেনি, দু মিনিটের মাথায় সবাই চিৎকার করে আপ্যায়ন শুরু করে দিয়েছিল এমন, কফির কাপ, মিষ্টি আর কেকের থালা নিয়ে ঘরে চলে এল, কিছু বলাই হল না। আর মাঝে একদিন ফোন করেছিল, দাদার সঙ্গে কথা বলে ওকে ফোন দিতে বলায়, সবার কত প্রশ্ন, কী বলছিল, ঝিমলির সাথে কী কথা, তা ঝিমলি একটু পরীক্ষার ব্যাপারে পরামর্শ নিল না কেন, শুধু হুঁ হা করে ফোন রেখে দিল কেন!!
অনু তার রোমান্টিক নভেলে ভরা মাথা দিয়ে এই বুদ্ধিটাও দিয়েছিল, এই কদিন ওদের বাড়ি গিয়ে ওর কাছে পড়া বুঝে নেওয়ার বাহানায় দেখা করতে। ঝিমলি অবশ্য এটা খারিজ করার আগে এক মুহূর্তও ভাবেনি। প্রথমত ওর বাড়িতে এমন তুখোড় দাদা যার কাছে জয়ও পড়া বুঝতে আসত, সে ডাকলেও যে মেয়ে বইখাতা খুলতে চায়না, তার এত পড়ার চাড় যে দুদিনের ছুটিতে আসা একজনের বাড়ি পড়তে যাচ্ছে, বাড়ির লোক ছেড়ে সারা শহর এ নিয়ে কথা বলবে। যদি সেটাও মেনে নেয়, ঝিমলির বাড়ির লোক বিশেষ করে মা কিছুতেই যেতে দেবেনা এই বলে যে দুদিনের জন্যে আসা ছেলেটা তার মা বাবার জন্যে রাখা সময় নষ্ট করে ঝিমলিকে পড়াবে, এটা কখনোই হতে দেওয়া যায়না।
শুধু ঝিমলি আর অনুই ক্লাস ও প্র্যাকটিকালের ফাঁকে ফাঁকে, “দেখা করার হাজার উপায়” নিয়ে মাথা খারাপ করছে এমন যে ওই শিরোনামে বই পর্যন্ত লিখে ফেলতে পারে, অথচ ওদিক থেকে এ নিয়ে কোনো উদ্যোগই নেই। অনু বরং রোহিতের কল্যানে বেশীবার দেখে ফেলেছে, বন্ধুদের বাইকের পিছনে বসে অনুদের বাড়িতে রোহিতকে ডাকতে এসেছে, কোনো প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্যে। শীতে এই এক চলে সারা শহর জুড়ে, দের রাত অবধি গানের বা অন্যান্য প্রোগ্রাম, নানা হোটেল, ক্যাম্পাসের ভেতরে হস্টেলে, হবিজ ক্লাবে, ছুটির মেজাজে উৎসবে মাতে সবাই। রাতের প্রোগ্রাম দেখতে যাবার অনুমতি ঝিমলিরা কখনো পায়না, কলেজের আগে কেউই পায় না শুধু রোহিতের মত আলালের ঘরে দুলাল বখাটে দু চার জন ছাড়া।
মাঝে মাঝে তো ঝিমলির সন্দেহ হয়, তাদের মধ্যে যা আছে তা প্রেম তো! অনু তো মুখে না বললেও বেশ হতাশ, ওর পড়া কোনো বইয়ের সাথেই এদের ব্যাপারস্যাপার মেলে না। আবার কাউকে জানানোও যাবেনা, দিব্যা, বন্দনাদের মত বিশেষজ্ঞদের মতামত নেবে তারও উপায় নেই!
ফোন শুধু বেজেই গেল, কেউ তুলল না। আশ্চর্য, বাড়িসুদ্ধ লোকজন সব গেল কোথায়! ঝিমলি হতাশ হয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা, মাকে বলে যে আসেনি সে কথাও ভুলে গেল। একদিন পরেই পিকনিক, মাকে বলে দিয়েছে যাবে, তার উৎসাহেই যাওয়া ঠিক হয়েছে, এখন কারণটাই তো ভেস্তে যাচ্ছে! বাড়িতে ফোন করে দিয়ে, সন্ধ্যে অবধি বসে রইল অনুর বাড়ি। বার বার ফোনে চেষ্টা করছে এমন যে রেখা আন্টিরও টনক নড়েছে। অনু অবশ্য দীপাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, জরুরী খাতা আছে ওর কাছে, এইসব বলে নিজের মাকে সামাল দিল। ফোনের গণ্ডগোলের ব্যাপারটা বাদ দিলে অনুর বাড়ি শীতকালে খাবারদাবারের মজার জন্যে যে কোনো দিন থাকতে ভারী ভালো লাগে। এত কিছু আয়োজন থাকে, সর্বক্ষণ হয় দাদী কিছু আনছে, ফ্রুট চাট, শীতের সবজির পকোড়া, আবার আন্টি নিয়ে আসছে গুড়ের পায়েস, গরম গরম পরোটা, আচার, বাড়িতে বানানো নানাবিধ লাড্ডু, তিলের গুড়ের মিষ্টি। আজও শীতকালের স্পেশ্যাল সব খাবার আসতে থাকল এমন যে মনের দুঃখে না খেয়ে থাকবার প্রতিজ্ঞাও বেশীক্ষণ টিকল না।
এই নাকি ক্রিসমাসের মজা, এর অপেক্ষায় ছিল এতদিন ধরে! দূর থেকে যাই কাঠ কাঠ কথা বলুক, কেজো লেখাপড়ার কথা শুধু, কাছে এসে নিশ্চয়ই দুটো অন্য কথা বলবে, সারপ্রাইজ দেবে, ফুল চকলেট আর আর্চির কার্ডের অপেক্ষায় বসে বসে শেষে এই, সাতদিন কেটে গেছে, আর সাতদিন বাকী, এখনো সেভাবে দেখলই না কেউ কাউকে, অথচ বন্ধুদের সঙ্গে দেদার ঘুরে বেড়াচ্ছে, ক্যান্টীন, ক্যাফে, ক্যানাল রোড সর্বত্র তাকে দেখছে লোকে এবং এদিক ওদিক থেকে শোনা যাচ্ছে তার মা তার সম্বন্ধে সবাইকে ফোন করে করে কী বলছে। ঝিমলি ঠিক করল আজ থেকে সাত দিন বাড়িতে কোনো ফোন এলে কান বন্ধ করে রাখবে।
অনুর বাড়ি থেকে এত খেয়ে এসে পেট ভর্তি ছিল বলে আর ডিনার করল না, বসে বসে দুটো কমলালেবু খেয়ে ফেলল। ঝিমলি ভীষণ কমলা ভালোবাসে, এই শীতকালে তার ভারী মজা, যত লেবু আসে তার বেশীরভাগই ও খেয়ে নেয়, এমনকি বাড়ির একরত্তি খুদেটার জন্যেও রাখেনা। অবশ্য এই একটা খাবারের ওপর এত টান বলে সবাই পারলে তাদের ভাগও ওকে দিয়ে দেয়। কমলালেবু দেওয়া সব খাবার ওর প্রিয়, কমলাক্ষীর, অরেঞ্জ কেক, পুডিং, কমলাসন্দেশ সব। পিকনিকের কথাটা ভুলেই গেছিল, এমন সময় মা দুধ নিয়ে এসে লেবু খাচ্ছে দেখে বকুনি শুরু, “এই তুই কমলালেবু খাচ্ছিস কেন, জিজ্ঞেস না করে, ওগুলো আমি বেছে রেখেছি, কাল সন্দেশ বানাবো, পিকনিকে পরশু নিয়ে যেতে বলেছে। ওগুলো পিকনিক ফান্ডের।“ ব্যস, হয়ে গেল, নিজের পায়ে কুড়ুল নিজেই মেরে রেখেছে, সে না জোর করলে এবার বাড়ির কেউ যেত না। এখন আবার না করতে গেলে মা এত বকবে, ঝিমলি আবার গুছিয়ে মিথ্যে ভালো করে বলতে পারে না যে, বিশেষ করে মা তো মুখের দিকে তাকালেই ধরে ফেলে।
পিকনিকে যাওয়া হল আমবাগানে। এমনিতে বাঙালি পিকনিক বলে খাওয়াদাওয়া ভালো হয়, মিষ্টি পোলাও মাংস, মাছও থাকে তবে মাছ ঝিমলি খায় না। অনুদের বাড়ির উল্টোদিকে মোটাসোটা সরকার মাসীমা থাকেন, উনি দলে সবার থেকে বড়, খুব উৎসাহে আসেন প্রতি বছর। মেসো এখানে চাকরি করতেন, রিটায়ার করে এখানেই বাড়ি করে রয়ে গেছেন, জায়গাটা এত পছন্দ হয়েছিল। মাসীমা নীচে শতরঞ্চিতে বসতে পারবে না বলে একটা টুল এনেছে, সেটা এত ছোট যে সবাই তাই নিয়ে হাসাহাসি করছে, ওইটুকু টুলে উনি তো অর্ধেকও ধরবেন না। অবশ্য কর্মকর্তার দল কিছু গার্ডেন চেয়ারের ব্যবস্থা এরকম যারা নীচে বসতে পারবেনা তাদের জন্যে আগেই করে রেখেছিল। ঝিমলি যথারীতি বই নিয়ে এসেছিল, গল্পের, আজকাল তো আর পড়াই হয়না, অনেক নতুন বই জমে গেছে উপহারের, সবাই ওকে বইই দেয় জন্মদিনে বা অন্য কিছুতে। মনে হতেই আবার দুঃখ উথলে উঠল, আচ্ছা কার্ড ফুল নাহয় এসব পড়াকু ভালো ছেলেরা দেয়না, তা একটা বই দিতে কী হয়েছিল, কিছু তো একটা দেবে, যেটা দেখলেই ওর মন ভরে যাবে বা ওরকম কিছু হবে, মানে বইয়ে তেমনটা হয় না?
তবে বই পড়ার জো আছে, তাকে খালি বসে থাকতে দেখে কাকুরা বাচ্চাদের গেমস খেলানোর দায়িত্ব দিয়ে দিল, “বড় হয়েছিস, এখনো কিছু কাজ করবিনা, তা হয় নাকি”। প্রথমটা বেজার মুখে শুরু করলেও একটু পরে ও মেতে গেল, বাচ্চাদের সঙ্গে, এত মজার কান্ডকারখানা করে সবাই, সবাইকে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বেলা হয়ে গেল আর খুব খিদে পেয়ে গেল। খাওয়ার সময় ওকে বাচ্চাদের সাথেই আগে বসিয়ে দেওয়া হল, ও আপত্তিও করলনা, তবে সেই কারণে বড়দের খাবার সময় ওকে পরিবেশনে সাহায্য করতে হল। তখনই শুনল জয়ের মামারা এসেছে বলে ওরা সবাই মিলে দিল্লী গেছে। বাসু আন্টি এইরকম প্রোগ্রামে খুব সক্রিয় থাকে, তাকে সবাই মিস করছিল।
যেখানে খুশী যাক, ঝিমলি আর এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না ঠিক করেছে। ক্রিসমাস ইভের রাত্তিরটা এত সুন্দর হয়, ও চুপচাপ অনেকক্ষণ জেগে থাকে, সব চার্চের ঘন্টাগুলো একসাথে বেজে ওঠে শীতের রাতের ঘন নিস্তব্ধতা ভেদ করে, এত জোরে আওয়াজ অথচ এত সুর ভরা থাকে যে একটুও চমকে উঠবে না কেউ, বা যারা গভীর ঘুমে, ঘন্টার শব্দ তাদের ঘুম ভাঙায় না। ঝিমলির বুকটা কেমন ভরে যায় এই শব্দের জাদুতে আর সেইসাথে একটা গভীর দুঃখ বা অন্য কিছু সারা শরীর মনকে ভেতর থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। স্কুলে ঢুকতেই সিঁড়ির মুখে ক্রুশবিদ্ধ ওই মূর্তিটার ছবি চোখে ভাসে, সবকিছু ছেড়ে শুধু চোখদুটো, কী গভীর বেদনাময় অথচ ক্ষমাসুন্দর অভিব্যক্তি!
দুটো দিন কেটে গেল মন্দে ভালোয়, এবারে তো আর কিছুই নেই, শুধু পড়া আর পড়া, দুদিন পরে আবার ক্লাস চালু হতে যেন শান্তি। ছুটিতে ঘরে বন্দী থাকার চেয়ে ক্লাসে এলে তবু বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ব্যস্ততার ফাঁকেও একটু দুদন্ড সুখদুখের কথা হয়। শুক্রবার ক্লাস শেষে অনু ওর বাড়ি এল, দুজনে অনেকক্ষণ লেপের তলায় আড্ডা মারল, রোহিত দুদিন মামাবাড়ি গেছিল, মীরাট। ওখান থেকে মামা অনুর জন্য দুটো বড় পোস্টার পাঠিয়েছে ওদের প্রিয় ক্রিকেটার এর। অনু ওকে একটা নিতে বলল, ঝিমলির বাড়িতে এসব পোস্টার দেওয়ালে আঁটা যাবেনা, অনুমতি নেই, ওর এই অভ্যেসই নেই। একবার দাদাকে একটা ইন্ডিয়া ট্যুডে ম্যাগাজিন এনে দিতে বলেছিল তার ভেতরে একজন বিখ্যাত মডেলের পোস্টার ছিল বলে। এবার দাদা ভেবেছে কোনো বিশেষ প্রবন্ধ পড়বে বলে চাইছে। এনে দেওয়ার পরে যখন শুনল কারণ, লাগাতার সাতদিন ধরে ছি ছি করেছিল! ঝিমলি অবশ্য ওর বাড়ির বাড়াবাড়িকে খুব একটা পাত্তা দেয়না, তবে ওর নিজেরই ইচ্ছা করেনা।
একথা সেকথায় অনু বলল, কাল শনিবার, চল দুজনে মিলে টিলার ওপর পিকনিক করতে যাই। এরপর কে কোথায় থাকব, তাছাড়া ছোটবেলাও তো শেষ হয়ে যাবে, তখন কী আর লাঞ্চবক্স নিয়ে সাইকেল চালিয়ে টিলার ওপর পিকনিক করতে যাওয়া মানাবে, না যাব আমরা। এমন করে বলল অনু, ঝিমলির মনে হল সত্যি তো, ওদের কত পছন্দের ছিল এরকম হঠাৎ করে পিকনিক যাওয়া। মা আর আন্টি কত কী বানিয়ে দিত, অবশ্য শুধু দুজনে কখনো যায়নি, আরো বন্ধুরা থাকে। অনুকে অন্যদের কথা বলায় সে একবাক্যে নস্যাৎ করে দিল, সবার নানা রকম টিউশন টাইম আছে, সবার সময় ম্যাচ করাতে গেলে যাওয়াই হয় না। মা কে কয়েক ঘন্টা দুপুরের সময়টুকু যাবে বলাতে একটু গাইগুই করে যাইহোক রাজী হয়ে গেল।
ভালো রোদ ওঠেনি, সকাল থেকে মেঘলা আকাশ, একটা সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া বইছিল, একটু কনকনে তবে খুব মিষ্টি। দূর থেকে টিলার ওপরটা যেন আরো সবুজ লাগছিল আর দূরের পাহাড়চূড়া মেঘের আড়ালে, মাঝে মাঝে রোদের ঝিলিক, বরফের ওপর পড়ে সোনালী চমক। এতটা ঠান্ডা হবে বুঝতে পারেনি, শুধু সোয়েটার পরে এসেছে, ভেবেছিল রোদে গরম লাগবে, কিন্তু ঠান্ডায় বেশ কাঁপুনি দিতে থাকল। সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে টিলার উপর উঠেছে, দেখে নাম না জানা গাছটার গুঁড়ির আড়াল থেকে লং জ্যাকেট গায়ে পরিচিত অবয়ব বেরিয়ে এল, সরু চশমার ফ্রেমের কাঁচের আড়াল থেকে ঝকঝকে হাসি, কিছুটা কটাক্ষের কিছুটা প্রশ্রয়ের চাহনি, ঝিমলির মেঘলা দুপুরকে নিমেষে রোদ ঝলমল করে দিল। ও পাশে অনুকে খুঁজতে গিয়ে দেখে, সে তখন সাইকেল ঘুরিয়ে পুরো উল্টোপথে, দৌড়চ্ছে, হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে।
দুজনে দুজনের দিকে যেতে যেতে ঝিমলির মনে হল, না বলা উপহারগুলো বুঝি এমনই হয়, কার্ড বা গোলাপ ফুল নিয়ে কী হবে তার, এরকম একটা মুহূর্তের জন্যে গিফট শপের হাজার গিফট কুরবান, আর অনুর মত একটা বন্ধু যেন সবার হয়।
এরকম একটা পিকনিক, হয়ত টিলার ওপরে এই শেষ পিকনিক, এখানেই ছোটবেলার শেষ আর বড়বেলার শুরু,এই তো আসল উপহার। কথায় কথায় খেয়ালই হয়না কখন যেন মেঘ ঘন হয়ে এসেছে, হাওয়াতে জলীয় বাস্পের গন্ধ, কিন্তু তারা এসব টের পেলে তো। যখন বুঝল তখন তাড়াতাড়ি করে সব গুছিয়ে তুলতে তুলতে বৃষ্টি নেমে গেছে। দৌড়ে এসে দুজনে গাছের তলায় দাঁড়ায়। কেমন গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা বৃষ্টি পড়ছে অনেকটা বরফগুঁড়ির মত। ঝিমলি শীতে কাঁপছে দেখে, পুরো কায়দা করে জ্যাকেটটা দিয়ে দুজনকে ঢেকে দিল, একজনের ডান হাত আর অন্যজনের বাঁ হাত ঢাকল। অর্থবহ চোখে তাকাতেই ঝিমলির মনে পড়ল, “তাই তো, এটা তো প্রায় আমার স্বপ্নের মত, এরকম বরফের মত বৃষ্টি, একটা কোটের মধ্যে আমরা দুজন, গাছের সারির মাঝে হেঁটে চলেছি”।
বৃষ্টির ছাটে ভেজা নরম হয়ে ওঠা এক শান্ত অথচ দৃঢ় চোখের দৃষ্টি ঝিমলির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন বলে, এভাবেই অনেক অনেক নাম না জানা পথ চলবে তারা, তাদের প্রত্যেকটা স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়ে অনন্তের পথে।