এই সাইটটি 37,699,804 বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • তখন ছোঁয়া অষ্টাদশীর - পর্ব চার

    শ্রাবণী রায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৫ এপ্রিল ২০২৫ | ৩৩৯ বার পঠিত

  • (৪)


    হিমের রাতের দীপগুলি............

    দেওয়ালিতে এবার তার বাজি পোড়ানো বারণ, ঝিমলির তাই মুখ বেজার। সেই টেনের বোর্ডের আগে থেকে এ এক আপদ শুরু হয়েছে। এবার তো আবার তার সাথে কলেজে ভর্তির সব পরীক্ষা, বারো ক্লাস বলে কথা , কত দায়দায়িত্ব, বাজিটাজিতে হাত পুড়ে কিছু একটা হলে!
    কলেজে উঠে যাও তারপরে যত খুশী আশ মিটিয়ে বাজি পোড়াও, দোল খ্যালো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারো, আমরা কিচ্ছু বলতে যাবনা।
    কথার ওপর কথা বলতে গেলে মা বলবে সবকিছুতে ঝিমলির নাকি যত কুযুক্তি, আর নিজেদের এইসব যুক্তি তাহলে কী?
    কলেজে উঠে গেলে বন্ধুরা তখন কে কোথায় থাকবে তার কোনো ঠিকানা আছে, নিজেই বাড়িতে আর থাকবে কিনা কে জানে! দেখছে তো অন্যদের অবস্থা, সিনিয়রদের সবাইকে। কার কখন ছুটি হয় কে কখন বাড়ি আসছে, কোনো ঠিক নেই, এর সেমিস্টার একসময় শেষ হয় তো ওর প্রজেক্ট তখন মাঝখানে। যেসব দাদা দিদিরা এককালে জুনিয়র বলে তাদের পাত্তাই দিতনা, তারা আজকাল ছুটিতে এসে একা একা ঘোরে, আর তাদের কাউকে দেখলেই পাকড়াও করে সাত গল্প জুড়ে দেয়, ছাড়তেই চায় না। বন্ধুদের দলবল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এককালের শহর কাঁপানো সিংহের দল সব এখন ভেজা বিল্লির মত মিউ মিউ করে ঘুরে বেড়ায়।

    বন্ধুদের দল সাথে না থাকলে উৎসবে কোনোরকম মজা আনন্দ কিছুই যে আর থাকেনা সে এদের দেখে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে ঝিমলি, ও বড়রা যাই বলুক না কেন!
    কলেজ জায়গাটা তার মোটেই সুবিধের মনে হয়না। যা আনন্দ সে এখানেই যত দিন মেয়াদ আছে তার মধ্যেই করে নিতে হবে।
    সে তাই ঠিক করেছে বাজি কিনবেই এবং বাড়িতে না এনে ওগুলো অনুর বাড়ি রেখে দিয়ে আসবে। ওদের বাড়ির বড়রা অনেক ভালো, ব্যবসা দোকান এসব নিয়েই ব্যস্ত, পড়াশোনা বলতে ওদের কাছে শুধু পাশ আর ফেল। ফেল করলে খুব রেগে যাবে সবাই, পিঠে ডান্ডা ভাঙবে, কিন্তু পাশ করলেই গলে জল, মিষ্টি পায়েস খাইয়ে, পয়সা দিয়ে একাকার। কেমন পাশ, কী পাশ কোথায় চান্স পেল, এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না একদম এবাড়ির বড়দের মত!

    তবে একটাই বাজে ব্যাপার হল, মায়ের কাছে বাজির পয়সা চাওয়া গেল না, নিজের জমানো পয়সা খরচ করতে হল। তা জমানো পয়সাও তো আবার বেশীর ভাগটাই মায়ের কাছে থাকে। কেউ হাতে পয়সা দিলে মা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে নেয়।
    “তোমার কাছে থাকলে তো সব দিয়ে গোলগাপ্পা আর চাট খাবে নয়ত হাবজিজাবজি জিনিস কিনে শেষ করবে। তার চেয়ে জমা থাকুক, কিছুটা জমলে তাই দিয়ে ভালো কিছু কিনিস।“
    সে জমা পয়সা দিয়ে ভালো কিছু তেমন কেনা কোনোকালে হয়না, দরকারই পড়েনা, চাইলে মোটামুটি সবই পাওয়া যায়, আর ভালো কিছু যে ঠিক কী সে জানেনা।
    দরকার তো পড়ে ওই ভেল্‌, গোলগাপ্পা, চাট, খেতেই বেশী। পয়সা জমা যাই থাক, ওগুলোর জন্যে মাকে সেই কাকুতিমিনতি করে বার করতে হয়।

    ক্লাস টেনের পর থেকে অবশ্য তার হাতে অল্পস্বল্প টাকা দেওয়া হচ্ছে। স্কুলে আজকাল বাড়ির টিফিন নিয়ে যায়না, উঁচু ক্লাসে কেউই নাকি নেয় না। স্কুলের ঐতিহ্য অনুসারে সবাই দল বেঁধে টিফিন করে বানরুটি আর সমোসা দিয়ে, যা প্রেম চাচার ক্যান্টিনে পাওয়া যায়।
    বানের মাঝামাঝি চিরে শিঙাড়া ঢুকিয়ে দেশী বার্গার, তার স্বাদ মোটামুটি ওদের কাছে অমৃতর কাছাকাছি, উনিশ বিশ হবে বলেই মনে হয়। টিফিনবেলার একটু আগে থেকে সারা চত্বর “এ প্রেম, ওয়ে প্রেম” রবে মুখরিত থাকে, বান সমোসার এমন চাহিদা!
    বারো ক্লাসে ওঠার এটাও একটা ধাপ, একজন দুজন ছাড়া কেউই টিফিন বক্স নিয়ে ঘোরেনা, তারা সব ক্যান্টিনের রেগুলার খদ্দের হয়ে যায়, কলেজ যাওয়ার মহড়া শুরু হয় আর কী! তা এ নিয়ম এ শহরে অনেককাল চলে আসছে বলে, বাড়ির লোকেরাও তেমন আপত্তি করেনা।
    ওই অখাদ্য বান সমোসায় যে কী স্বাদ পায় এরা কে জানে, বলে মুখ বাঁকালেও টিফিনের পয়সা হাতে দিয়ে দেয়। আর কদিন বাদে তো একা একা কলেজ গেলে নিজেদের পয়সাকড়ির হিসেবের দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হবে, এখন থেকে অভ্যেস হলে মন্দ কী!
    তা হাতে রোজ দু তিনটাকা আসে টিফিন বাবদ। তার থেকেও বাঁচে আর আজকাল সবার দেওয়া টাকা সবসময় মা নেয়ও না, সেও হয়ত ওই একই কারণে, বড় হয়েছে তাই হাতে পয়সা রাখা অভ্যেস করুক।
    এছাড়া সাইকেল সারাই, হাওয়া ভরা, খারাপ হয়ে গেলে টিউশন থেকে রিকশায় ফেরা বাবদ টাকা দেওয়া থাকে, সেইসব জমিয়ে নিজের হাতে যা ছিল তাই দিয়ে বেশ কতক চকোলেট বোম আর রকেট কিনল। অন্যান্যবারে সবাই বাজি কেনার পয়সা দেয়, বারে বারে কেনা হয় প্রচুর, এবারে তেমনটা হল না। চেনা দোকানদার বাবলু ভাইয়া একটু অবাক, সে জানে ঝিমলির বাজিপ্রীতির কথা, তার দোকানের বচ্ছরকার খদ্দের।
    “কী ঝিমলি দিদি, এবারে এতো কম কেন?”
    আসল কথাটা তো আর বলা যায়না, বাড়ির চেনা দোকান, বাড়ির লোকের অমতে কিনছে জানলে যদি বলে দেয়, বা বাজি দিতে রাজী না হয়। তাই সে একটু গোঁজ হয়ে বলে,
    “কী যে বল ভাইয়া, বড় হয়ে গেছি, এখনো বাজি পোড়াবো? এগুলো তো ওই আশেপাশের বাচ্চাদের দেব তাই।“
    ভাইয়া এমনিতে সাদাসিধে তবু বলে,
    “তা বাচ্চাদের জন্যে তাহলে কয়েকটা ফুলঝরি, চরকি, আর রংমশাল নিয়ে নাও। বোম ফাটাতে ভয় পাবে, সবাই কি আর তোমার মত সাহসী নাকি”।
    নিজের সাহসের প্রশংসা শুনে দিব্যি লাগল বলে বিরক্ত হতে পারল না, তবু বেজার হল। এত কথা বলে ভাইয়াটা! নেহাত এদের বাজি খুব ভালো হয়, আর চেনা দোকান বলে, না জ্বলা বাজি ফেরত নেয় বা বদলে দেয়, তাই আসা, নাহলে ঝুঁকি নিয়ে এখান থেকে কিনত নাকি!
    বাজি কিনে অনুদের বাড়িতে রেখে এল। অনু বোম ফাটাতে ভয় পায়, দূরে দূরে থাকে। ঝিমলির আবার চকোলেট বোম হাতে নিয়ে না ফাটালে পোষায় না। এটা জানে বলেই বাড়িতে এত কড়াকড়ি, এত বারণ। ঠান্ডা এবার আগেভাগে পড়ে গেছে বলে অনুদের বাড়ির উঠোনে চারপাই পাতা থাকছে সর্বক্ষণ। দাদীর আচার, আমলকি, পাঁপড় রোদে শুকোচ্ছে, ওর বাজি রোদে দেওয়ার দায়িত্বও দাদী নিল।

    পূজো শেষ হওয়ার পর থেকেই এ শহরে একটু একটু করে ঠান্ডা ঘনিয়ে আসে। সন্ধ্যে থেকে রাতভোর আকাশে জড়ানো কুয়াশার চাদরে, দূরে ক্যানাল বা নহরের ওপর ধোঁয়া ধোঁয়া আবছায়া, জলে সাদা হিমের সর, গঙ্গার দিক থেকে ভেসে আসা বাতাসে হিমেল হাওয়া।
    রাতের আলো কেমন মলিন দেখায়, রাস্তার বাল্বগুলো মনে হয় টিমটিমে মাটির প্রদীপ। মনখারাপের সময় বোধহয় এমনিই হয়। তারপরে আস্তে আস্তে একটি দুটি করে ঘরের বারান্দা দুয়ারে, রাস্তার দুধারের গাছ জড়িয়ে টুনি বাল্বের ঝাঁক জ্বলে ওঠে, আঁধারের গায়ে জোনাকির মত, দেওয়ালির প্রস্তুতি শুরু। মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে শুরু করে, উৎসবের ছোঁয়া লেগে আলোকিত হয়।
    অবশ্য ঝিমলির মন আজকাল বেশীরভাগ সময়ই কেমন যেন কেমন কেমন করে। চারিদিকে উৎসব উৎসব ভাবটা যখন জাঁকিয়ে ওঠে, সে পুজো হোক বা দেওয়ালি, ভালো লাগা যখন দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, তখন মনের ঘর খালি খালি লাগে, দরজা আর খোলা হয়না।
    অনু সেদিন টের পেয়ে মুচকি হেসে বলেছিল, “তোর দেওয়ালি তো আসলে ক্রীসমাসের ছুটিতে হবে, তাই না?“

    এখানে দেওয়ালির সন্ধ্যেয় অবাঙালিরা লক্ষ্মীপুজো করে, অনেক বাঙালি বাড়িতেও পুজো হয়। ঝিমলিদের বাড়িতে পুজো হয় না। প্রতি বছর ও সন্ধ্যেবেলায় সেজেগুজে বাড়িতে মায়ের সাথে প্রদীপ জ্বালিয়ে, দু একটা বাজি ফাটিয়ে, বাজির ব্যাগ কাঁধে সোজা চলে যায় অনুদের বাড়ি, সেখানে পুজো হয়। লাড্ডু হালুয়া এইসব প্রসাদ ছাড়াও অনুর দাদী আর মা মিলে নানারকম ভুজিয়া, মঠরি, চাট, দইবড়া ইত্যাদি নানা সুস্বাদু খাবার বানিয়ে রাখে, নিমন্ত্রিত অভ্যাগতদের জন্যে।
    সেসব খেয়ে, কয়েকজন বন্ধু মিলে ওদের বাগানে বাজি পোড়ায়, তারপর সবাই মিলে যায়, আর্মির প্যারেড গ্রাউন্ডের দেওয়ালি মেলায়। ওখানে মেলায় ঘুরে, তারপরে গ্যালারিতে বসে হি হি হা হা করতে করতে আর্মির ফায়ার ক্র্যাকার শো দ্যাখে। শোটা শুধু যে দারুন হয় তাই না, সারা শহরের উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা ওখানে জড় হয়, আর্মিতে যাদের চেনা আছে সবাই। দেওয়ালির আড্ডা প্রেম ইত্যাদির জন্যে শহরের তরুণ তরুণী দের মিলনমেলা হল প্যারেড গ্রাউন্ড।
    একটা ভালো ব্যাপার হল, আর্মির অফিসাররা ছাড়া, অন্য বড়রা সপরিবারে কেউ খুব একটা ওখানে ওদিন আসেনা, দেওয়ালির সন্ধ্যেয় সবাই বাড়িতেই পুজো, অতিথি অভ্যাগত, এর ওর বাড়ি মিষ্টি খাবার বিলোনো, এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
    মায়ের কড়া নিয়মে ওদিন রাত নটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়। ফিরে রাতে মায়ের সঙ্গে সরস্বতী মন্দিরে যাওয়া হয়, বাঙালি অ্যাসোশিয়েসনের কালি পুজো দেখতে। ওখানে লুচি তরকারী আর পায়েস মেনু, রাতের খাওয়া সব বাঙালিরা মোটামুটি ওখানেই সারে, বেশী সদস্য নেই তাই সবাই আসে। ঝিমলি অবশ্য কখনো জেগে পুরো পুজো দেখতে পারেনা, সারাদিনের হুটোপাটির পরে। খুব ঘুম পেয়ে গেলে কারুর একটা সঙ্গে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ওকে।

    দেওয়ালির আগের দিনকে বলে “ছোটি দিওয়ালি”, সেদিনও ওরা বাজি পোড়ায়, বাড়ি বাড়ি প্রদীপও জ্বলে। এবারে ও আর বেরোলো না, মা বারণ করেছে বলে নয়, ইচ্ছেই করল না। তাছাড়া বন্ধুরা কেউ যাবেনা অনুর বাড়ি এবার, দেওয়ালির পরের দিন থেকে কোচিং ক্লাসে মক টেস্ট শুরু হবে। তবু দেওয়ালির দিন কারুর তেমন পড়া হবেনা বলে আগের দিন সবাই বেশী করে পড়ছে।
    অনু কোনো এন্ট্রান্সেই বসবে না, এখানকার কলেজে যে সাবজেক্ট পাবে তাতেই ভর্তি হবে, ওর বাবা মা ওকে বাইরে পাঠাবে না। দুপুরে ফোন করল, ঝিমলির বাজি দাদী যত্ন করে রোদে দিয়ে গুছিয়ে রেখেছে, সন্ধ্যেয় কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আয়, বাজি পোড়াব।
    সরাসরি না বলতে পারল না বন্ধুকে, তবে হ্যাঁও বলল না। বাড়ির সবাইকে অবাক করে দিয়ে সারাদিন পড়ল।
    সন্ধ্যেবেলায় মা জোর করে তুলে দিল পড়ার টেবিল থেকে।
    “চোখ খারাপ হবে এতক্ষণ একটানা পড়লে, যা অনুর সঙ্গে একটু ঘুরে আয় দুই বন্ধু, চারিদিকে সুন্দর আলো দিয়ে শহর সেজেছে, ঘুরে দেখে আয়।“

    মেন রোড পেরিয়ে সিভিল লাইন্সে অনুদের বাড়ি যাবার রাস্তার ধারে, ক্যাম্পাসের শেষ সারিতে, বাসুআন্টির গাছপালা ঘেরা বাড়ি লাল নীল আলোয় সুন্দর সাজানো।
    কী করে ঠিক ওখানেই সাইকেলের চেনটা আটকে গেল। নেমে চেনটা ঠিক করছে, ঠিক সেই ক্ষণে সুইটির বাবার পুরনো ফিয়েট গাড়িটা এসে আন্টিদের গেটের সামনে দাঁড়ালো। এমনি দিনে গেটের আলো খুব জোরালো নয় বলে জায়গাটা আধো অন্ধকার থাকে, কিন্তু আজ চারিদিকের আলোয়, গাড়ি থেকে নেমেই সুইটির চোখ ওর ওপরে পড়ল।
    সুইটি একটা মভ ঘাগরা আর সবুজ চোলি পরেছে, ছোট চুলে কীভাবে একটা ফাঁপিয়ে স্টাইল করেছে, মুখে হাল্কা মেকআপ, কানে গলায় ভারি রুপোর সেট। নিয়মিত নাচ করে বলে ও ভালো সাজতে জানে, এই দেওয়ালি স্পেশাল সাজে ওকে দারুন দেখাচ্ছে।
    ঝিমলি চেন ঠিক করা ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সুইটির মা বাবা ও ছোট ভাইটা সাথে। এমনি স্কুলের প্রোগ্রামে বা পার্টিতে সুইটিকে দেখেছে সাজতে, কিন্তু আজ যেন সেসবের থেকে আলাদা লাগছে। এমনিতে সুইটি খুব স্মার্ট ও দেমাকী, ভালো নাচে বলে টিচারদের কারুর কারুর প্রিয়, সবার সাথে মেশেনা, কথা বলেনা।
    ঝিমলিকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসছে, ঠিক তখনই গেট খুলে আঙ্কল, আন্টি হইহই করে বেরিয়ে এল। তারপর সুইটির বাবা মা, সবাইকে কী খাতির। ঝিমলি বুঝল যে ওদের সম্ভবত ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে জয়ের বাবা মা। ও দ্রুত পাঁচিলের একপাশে অন্ধকারে সরে গেল, যাতে আন্টির নজরে না পড়ে। সুইটিকে দেখে আন্টির চোখেমুখে মুগ্ধতা, বারবার গাল টিপে দিচ্ছে, সুইটিও তাতে লজ্জা লজ্জা মুখ করে একেবারে লুটিয়ে পড়ছে।
    ঝিমলির পরনে একটা পুরনো সাদা টপ আর নীল ডেনিমের স্কারট, চুলটা গুটিয়ে মাথার টঙে তোলা, তেলতেলে মুখ। কানে সরু রিং আর হাতে একটা ঘড়ি। এবেশে আন্টি ওকে দেখলে বিশেষ করে সুইটির পাশে, সারাজীবনেও আর মুখ ফিরিয়ে তাকাবেনা।

    দলটা ভেতরে ঢুকে যেতেই ঝিমলি সাইকেল ছোটালো অনুর বাড়ির দিকে। গেট খুলে সাইকেল রেখে বারান্দায় উঠে দেখল, অনু ভেতর থেকে ওকে ইশারা করে তাড়াতাড়ি এসে ফোন ধরতে বলছে।
    অন্যদিনের মত দ্রুতপায়ে গেল না, আস্তে আস্তে গিয়ে অনুর হাত থেকে রিসিভারটা নিল।
    অনু এই কারণেই হয়ত ওকে বার বার আজ আসতে বলেছিল। মজার একটা মুখভঙ্গি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, উঠোনের দিকে, সেখানে সবাই প্রদীপ জ্বালাচ্ছে, ফুলঝুরি তুবড়ি রংমশাল!
    ফোন হাতে মুখে কথা এলনা, মনটা খুব এলোমেলো হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে দেখা সুইটিদের পরিবারের সঙ্গে আন্টিদের অন্তরঙ্গ দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল!
    অকারণে চোখে জল এসে যায়, ওদিক থেকে কথার পর কথা ভাসে, ও চুপ।
    শেষে “হ্যাপি দিওয়ালি“ বলে ফোন নামিয়ে রেখে ওখানে বসেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। মনখারাপের মেঘ যত বৃষ্টি হয়ে ঝরে।

    “মন কেমন করে, আমার মন কেমন করে”।
    বাজিগুলো একটা ব্যাগে ভরে সাইকেলের কেরিয়ারে বেঁধে নেয়। মেন বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটির আঙ্কলকে দিয়ে দেবে, মজদুরদের ব্যারাকের বাচ্চাদের বিলিয়ে দিতে। দেখেছে ঝিমলি, বাচ্চাগুলো দেওয়ালির পরের দিন রাস্তা, সামনের লন, এসব জায়গায় পোড়া বাজির স্তুপের মধ্যে নাজ্বলা বাজি খুঁজে বেড়ায়। ওরা এগুলো পেলে খুব খুশী হবে, দেওয়ালির রাতেই বাজি জ্বালাবে এবার।
    সত্যি তো এতদিন কেন এই ভাবনাটা মনে আসেনি। প্রতিবছর কিছু বাজি তো ওদের কিনে দেওয়া যায়, সবাই মিলে চাঁদা তুলে। মনের মেঘ কেটে বেশ হাল্কা লাগল।
    ঝিমলি আসলে এমনই, দুঃখ, অভিমান, এসব ওর ঠিক বেশীক্ষণের জন্যে পোষায় না কোনোকালেই। ছোটবেলায় কোন কারণে মা বকলে, অভিমান হল, খানিকক্ষণ হয়ত কোথাও লুকিয়ে থাকল, বা ঘরে চুপ করে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল। খানিক বাদে আবার মায়ের কাছে গিয়ে নিজেই বলত, “ওমা, এট্টু আদর করে দাওনা।“ আসলে মায়ের আদর ছাড়া রাগ ভাঙলে সেটা ঠিক সম্মানের হয়না তো তাই!

    বাজিগুলো সিকিউরিটি আঙ্কলকে দিয়ে বাড়ি ফিরল, মা তখন লুচির ময়দা মাখছে। অনুর মা অনেক খাইয়েছে, খিদে নেই একেবারে, কিন্তু বাড়িতে না খেলে মা খুব রেগে যাবে।
    জামাটামা পালটে ঘর অন্ধকার করে গান চালালো। এখন পড়তে ইচ্ছে করছে না, রাতের খাওয়ার পরে বসবে আবার বই নিয়ে। দূরে সিভিল লাইন্সের ওদিক থেকে বাজি পটকার আওয়াজ ভেসে আসছে। বাগানের অন্ধকারে রাতের ঝিঁ ঝিঁ ডাক, বন্ধ জানালার ঘসা কাঁচে রাস্তার লাইটের মিটমিটে হলুদ আলো পড়ে, ছায়াবাজি কত রকমের, সেই দিকে তাকিয়ে রইল খানিক। বসার ঘরে ফোন বেজে উঠল। ঝিমলি আবছা শুনতে পেল দাদা কথা বলছে, তারপরেই জোর গলার হাঁক,
    “ঝিম, এদিকে আয়, জয়ের ফোন।“
    সন্ধ্যের দুঃখ অভিমান তো কখন জল হয়ে গেছে, তাই প্রথমেই মনে হল, বাড়িতে ফোন করেছে, একী কেলেংকারি! দাদা বা মা কেউ জিজ্ঞেস করলে কী বলবে? মা যদি টের পায় তবে মরেই যাবে, মেয়ের এ হেন অধঃপতন দেখে। হে ভগবান, কেন যে সন্ধ্যেবেলায় ঠিক করে কথা বলল না। ওর মা সুইটিকে আদর করেছে, তার বাবামাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করেছে, তাতে ওর কী দোষ! এরকম বুদ্ধিহীন বলেই ঝিমলির কিচ্ছু হবেনা, সব পরীক্ষায় গোল্লা পাবে।
    নিজেকেই দুষতে দুষতে গেল, মুখটাকে বেজার করে দাদার হাত থেকে ফোন নিল। দাদা কিছু বলল না, টিভি দেখছিল, মা বউদি এরাও রান্নাঘরে ব্যস্ত।

    দেওয়ালির ভোর থেকে একেবারে লক্ষ্মী মেয়ের মত পড়ার টেবিলে। আজকাল পড়তে বসলে মা ব্রেকফাস্ট টেবিলেই এনে দেয়। রুটি, আলুভাজা আর একটা বরফি প্লেটে নিয়ে মা ঢুকল।
    “আমাদের ঝিমবুড়ি তাহলে এবারে সত্যিই বাজি পোড়াবে না?”
    ঝিমলি খাতা থেকে মাথা না তুলেই প্লেটের রুটি ছিঁড়ে আলু মুড়ে মুখে দিল। মা উত্তর না পেয়ে এবার সরাসরি বলে,
    “আমি টাকা দিচ্ছি, তোর দাদাও দিয়েছে, যা বাবলুর ওখান থেকে বাজি কিনে নিয়ে আয়। এত ভালোবাসিস, এখানে বাড়ির সামনেই জ্বালা, আশেপাশের বাচ্চাদের সঙ্গে। শুধু এবার ওই টইটই করে সারা দুপুর রাত বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াস না।“
    ঝিমলি একটু অপ্রস্তুত হল, মিথ্যে বলা বিশেষ করে মার কাছে, আবার মা যখন এমন নরম হয়ে থাকে, খুব খুব মুশকিল। মুখ তুলে মায়ের আঁচলটা ধরে যতদূর সম্ভব গলাটা নরম আদুরে করে বলে,
    “সরি মা, আমি না তোমাদের না বলে বাজি কিনেছিলাম ভাইয়ার দোকান থেকে। কাল গার্ড আঙ্কলকে দিয়ে দিয়েছি, মজদুর মহল্লার বাচ্চাদের জন্যে। “
    মা রেগে যেতে গিয়েও হেসে ফেলল, মেয়েটার কী যে হবে, বয়স হচ্ছে, বড় আর হচ্ছেনা।
    “ভগবান যা করে ভালোর জন্যে। তাহলে পয়সা নিয়ে যা, আরো বাজি আর কিছু মিষ্টি কিনে বাচ্চাগুলোকে দিয়ে আয়। তোর ওই কটা বাজিতে আর ওদের কী হবে!
    উৎসবের দিনে তোকে এত গুম হয়ে পড়তে দেখে আমারই কেমন লাগছে। খেয়ে চানটান করে একটু বাজার ঘুরে আয়। রাতে পুজো দেব, তার জন্যেও মিষ্টি নিয়ে আসিস।”

    বাজির দোকানে যা মজা হল। একে তো বিক্রির শেষ বেলা তায় ও কাদের জন্যে বাজি কিনছে শুনে, ভাইয়া আর তার বাবা সস্তায় বাচ্চাদের জন্যে অনেক ফুলঝুরি চরকি দিয়ে দিল। খুশীমনে মিষ্টির দোকানে ঢুকতে গিয়ে দেখে ভিড় দোকান ছাপিয়ে রাস্তার ওপরে। ভিড়ের জন্যে মোহন সুইটস রাস্তার ওপর চাঁদোয়া খাটিয়ে স্পেশ্যাল স্টল করেছে, প্রতিবারের মত। মিষ্টি ভেতর থেকে আসছে আর উড়ে যাচ্ছে। রোগাপাতলা মেয়ে, এদিক ওদিক ফাঁক দিয়ে ঢুকে কোনোরকমে কাউন্টারে পৌঁছে গেল, এত হাঁকডাক চিৎকারে একটু ভেবেচিন্তে কিনবে তারও উপায় নেই।
    টাকা বার করছে, এমন সময় শুনল বাসু আঙ্কলের গলা, ভেতরে ঢুকতে না পেরে, উল্টোদিকের খালি জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বাঁশের ঘেরার ওদিক থেকে তাকে ডাকছে।
    “ঝিমলি, আমাদের দু কেজি মোতিচুরের লাড্ডু আর দু কেজি কাজু বরফি নিয়ে নে তো।“
    সেইমত নিজেদের ও বাসু আঙ্কলের মিষ্টি নিয়ে দু হাতে প্যাকেট ঝুলিয়ে গলদঘর্ম হয়ে বেরিয়ে এল। আঙ্কলের মুখে হাসি আর ধরেনা,
    “ভাগ্যিস, তুই ছিলি। তোকে দেখেই তো আমি লাইন ছেড়ে দিয়ে ঘেরার ওদিকটায় গেলাম। তোর আন্টির আজ লক্ষ্মীপুজো, আরো কত কী কিনতে দিয়েছে, ক্যানালের ওপারের বাজারে যেতে হবে। বাজার ঘুরে মিষ্টির দোকানে এলে, এখানে কিছুই বেঁচে থাকত না। আবার এই লাইনে দাঁড়িয়ে এখানের কেনাকাটা মিটিয়ে, বাজারে গেলে, বাজার উঠে যেত। “
    ঝিমলি সাইকেল এনেছে দেখে আঙ্কল ওকে বলল মিষ্টিগুলো ওনার বাড়ি পৌঁছে দিতে, উনি তাহলে সোজা বাজারে চলে যাবেন।

    ইচ্ছে ছিলনা, কালকের সন্ধ্যের পর আজ সকালেই ওবাড়ি যেতে। তবু চট করে না করতে পারলনা, ঝিমলিকে তো সবাই ভালো মেয়ে বলেই জানে, এটুকু কাজ করতে আপত্তি করবে না জানে বলেই আঙ্কল বলেছে।
    সাইকেলটা গেটের ভেতরে নিতে হল, নাহলে ওর নিজের মিষ্টি কুকুরে নিয়ে যাবে। গেট বন্ধ করে লন পেরিয়ে পোর্টিকোয় উঠে দাঁড়ালো, চারিদিকে প্রচুর মরশুমী ফুল লাগিয়েছে আন্টি, টবে বাগানে।
    বেল বাজানোর আগেই দরজা খুলল, আন্টির কাজের মেয়ে সোমবতী, গেট খোলার শব্দ পেয়েছে বোধহয়।
    আন্টি চানে গেছে, ঝিমলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কালকের সুইটিকে আদরের ঘটার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসছে। নাহয় একটু সরে দাঁড়িয়েছিল, তবু তার দিকে একবার তাকিয়েও দেখল না আন্টি, সুইটির রূপে এমনই ধাঁধিয়ে ছিল চোখ!
    সোমবতীর হাতে প্যাকেট দিয়ে দুড়দাড় করে পালিয়ে এল।

    ভাতে আজ মা চোদ্দশাক বানিয়েছে। এখানে বাজারে সব পাওয়া যায়না বলে মা আগে ওকে এদিক ওদিকে পাঠাতো, এর ওর বাগানে যা পাওয়া যায়। মুলো শাক, সজনা পাতা, ডাক্তার কাকুর বাড়ির কুমড়ো পাতা। এবারে মা নিজেই কীভাবে করেছে, ওকে কোথাও পাঠায়নি।
    দুপুরে পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। একে ভোরে উঠেছে, তায় বাজারের, মিষ্টির দোকানের অত মেহনত, ক্লান্তি এসে কখন চোখ জুড়ে বসেছে, বুঝতেও পারেনি।
    মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল যখন বেলা পড়ে গেছে।
    “হ্যাঁরে তুই কি মিসেস বাসুর পুজোর মিষ্টি এনে দিয়েছিস নাকি? কই বলিস নি তো?”
    ঝিমলি মুখ ধুতে ধুতে ভাবল, এই এক শহর হয়েছে, গ্রামেরও বাড়া। কোনোকিছুই কারুর জানতে বাকী থাকেনা।
    রান্নাঘরে নিজের জন্যে চকোলেট গুলতে গুলতে ও মুখ ব্যাজার করল,
    “এতে আবার বলার কী আছে, মা। এত ভিড় দোকানে, আঙ্কল লাইনের অনেক শেষে ছিল, আমায় বলল, আমি কিনে দিলাম।“
    “না, সে ভালো করেছিস। মুশকিল হয়েছে উনি ফোন করে বললেন তোকে যেন সন্ধ্যেবেলায় পাঠিয়ে দিই, পুজোয় তুই ওনাকে সাহায্য করলে ভালো হয়। একটু ঘুরে আয়, দ্যাখ কী সাহায্য লাগে।“
    এমনিতে বাসু আন্টি পুজো করে ঝিমলি তাই জানত না, কোনোদিন ওদের বলেও নি। অবশ্য দিওয়ালির দিনে বাঙালিদের সবার কালিপুজোতে দেখা হয়ে যায় বলে, খুব ঘনিষ্ঠ না হলে বাড়ি যাতায়াত নেই।

    “মা, তুমি বললে না কেন, আমার পড়া আছে? তুমিই তো সন্ধ্যেয় এবারে বেরোতে বারণ করেছো।“
    মা একটু আমতা আমতা করে।
    “সে তো বটেই। কিন্তু এটা তো অন্য ব্যাপার, একটু গিয়ে দ্যাখ, কখনো তো বলেনা, এবারে বলল যখন নিশ্চয়ই দরকার বলেই ডেকেছে। অবশ্য তুই কীরকম কাজের ধুচুনি সে তো আর উনি জানেন না। সামনের বার থেকে আর ডাকবে না।“
    ঝিমলির মুখটা তেতো তেতো লাগছে। মাগো, চকোলেট পাউডারটা নির্ঘাত পুরনো হয়ে গেছে। মাকে বললেও এটা ফ্রিজে রাখবে না!
    কেন, উনি সুইটিকে ডাকতে পারতেন তো। সুন্দরী, ছেলের বউ করার উপযুক্ত মেয়ে। এছাড়া লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে নাচ ফ্রি!
    রাগ রাগ মুখ করে সাজতে বসল। মাকে অবাক করে দিয়ে বউদির চওড়া গোলাপি পাড়ের হলুদ সাউথ সিল্ক পরল, চুলের সামনেটা স্টাইল করল, টিপ পরল, কানে গত জন্মদিনে মায়ের দেওয়া ঝুলনো ময়ূর ঝুমকো। নিজে নাচ না করলে কী হবে এতকাল ধরে স্কুলের হাউস কমপিটিশনের সময় ওদের গ্রীন হাউসের মেয়েদের সাজায় তো ও আর অনু। অনুর আঁকার হাত, সাজানোর হাত ভীষণ ভালো, আর ঝিমলি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট, বিদ্যে কাজে লেগে গেল। যাই হোক, আন্টি দেখুক সে সুইটি না হলেও, কম যায়না!

    বসার ঘরের সোফা টেবিল সরিয়ে পুজোর ব্যবস্থা হয়েছে, ভট্টাচার্য জেঠু আসবে পুজো করতে। আন্টি আলপনা দিচ্ছিল, লক্ষ্মীর পা, পদ্মফুল। ওকে দেখে একহাতে জড়িয়ে ধরে, অন্য হাতে তুলি আর আল্পনার বাটি ধরিয়ে দিল।
    “ওমা, দেখে যাও, আমাদের লক্ষ্মী তো পুজোর আগেই এসে গেছে। নে বাকী আলপনা দিয়ে দে।“
    কেমন লজ্জা লজ্জা গলায় ঝিমলি বলে,
    “আমি পারিনা তো।“
    “ঠিক পারবি, আমি যতটা দিয়েছি, দেখে দেখে বাকীটা করে ফেল। এভাবেই শিখবি তো। আমি ভোগটা দেখে আসি ততক্ষণ”।
    আঙ্কলও বেরিয়ে এসেছে, ধুতি পাঞ্জাবিতে সেজেগুজে তৈরি। ঝিমলির দিকে তাকিয়ে কেমন মায়াজড়ানো হাসি হাসে, চোখে জল এসে যায় ওর। বাবা থাকলে হয়ত এমনটাই তাকাতো, শাড়িপরা মেয়েকে দেখলে। কত বড় অবধি বাবা ওকে কোল থেকে নামাতো না, কতদিন হয়ে গেল বাবা ডাকটা জীবন থেকে হারিয়ে গিয়ে!
    আলপনা দিয়ে ও নিজেই অবাক, কীভাবে যে ঠিক আন্টির মত হল, কে জানে।
    ভোগের জিনিসগুলো রান্নাঘর থেকে হাতে হাতে নিয়ে এল দুজনে। পুজোর ওখানে সবাই বসেছে, ফল ফুল গোছগাছ করতে করতে আন্টি বলল,
    “সামনের বছর ছেলেটাকে বলব, দেওয়ালির সময় যেন আসে। তোরা দুজন সব করবি, আর আমরা শুধু দেখব, দুজনকেই তো শিখতে হবে বাড়ির নিয়ম কানুন।“

    পায়ে পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে মেয়েটা। ফুল আর পাতায় হিমপড়া গন্ধ, শীত শীত ভাব, শাড়ির আঁচলটা টেনে গায়ে জড়ায়। নিজেকে কেমন বড়দের মত লাগে। ভেতরে পাঁচালি পড়া হচ্ছে। এই সুরটায় কেমন একটা ঝিমধরা ভাব আছে, পরম মমতায় মানিপ্ল্যান্ট জড়ানো দেওয়ালে দু হাত রাখে, ইট পাথরের বাড়িটা সজীব হয়ে ভালোবাসার ওম ওর সারা দেহে চারিয়ে দেয়।

    বসন্তে কুঁড়ি ধরে, বর্ষার জলে সবুজ হয়ে, শরত আকাশের নীল মেখে, এই হেমন্তে, ঝিমলির ভালোবাসা আজ ঘর পেয়েছে। শাঁখ আর কাঁসরের আওয়াজ, ধূপের ধোঁয়া, বাতাসে মিশে, হিমেল রাতে ছড়িয়ে পড়ে কোন দুরান্তে। সেই হাওয়া কোনো এক হস্টেলের ঘরের জানালাতে বুঝি বা দূত হয়ে পৌঁছে যায়।
    পরম মমতায় চারিদিকে তাকিয়ে, চৌকাঠে পা রাখে, আঁচলটা বড়দের মত গলায় জড়িয়ে, পুজো শেষ, প্রণাম করতে হবে।



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৫ এপ্রিল ২০২৫ | ৩৩৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • a | 115.64.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:০২542129
  • পড়ছি জমিয়ে জমিয়ে রেখে। 
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৫২542143
  • কৈশোরের প্রেম, anxiety , ভালো  লাগছে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি 37,699,806 বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন