লাগল যে দোল.....
পরীক্ষার মাঝে হোলি, এমন অনাসৃষ্টি ভাবা যায়, তবু হচ্ছে,প্রতিবছরই। অন্যবছর যেমন তেমন, এবছর যে বোর্ড, সব পরীক্ষার বাপ! ভাবলেই কান্না পেয়ে যাচ্ছে ঝিমলির।
এই হয়ে গেল শেষের শুরু, দেখছে তো আশেপাশে। এবছর বোর্ড, সামনের বছর ইলেভেন তরতরিয়ে কেটে গিয়ে ভয়ংকর বারো ক্লাস, এনট্রান্স ইত্যাদিতে হোলি কোথায় হারিয়ে যাবে! আর তারপরেই বাজবে বিদায়ের বাঁশী, বন্ধুবিচ্ছেদ, সম্ভবত সুখের নীড়ছাড়াও।
অবশ্য স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা বরাবরই হোলির কিছুদিন পরেই হয়ে এসেছে, সিনিয়র ক্লাসে আসা ইস্তক, তাই হোলি খেলায় হাল্কা বাধা নিষেধ থাকত প্রতি বছরই,
"জল খেলবেনা, শুকনো আবীরে খ্যালো, নাহলে ঠান্ডা লেগে জ্বর বাধালে পরীক্ষা মাটি"।
ওইসব সাবধানবাণীতে ঘাড় নেড়ে একবার বাড়ি থেকে বেরোতে পারলেই কথাগুলো আর কারুর মনে থাকতনা। বড়রাও ঐ বিধিসম্মত সতর্কবাণী দিয়েই খালাস, সেসব মানামানির খতিয়ান কে করে, তারা নিজেরাও যে হোলি মেজাজে ভরপুর থাকত, বন্ধুবান্ধব তো সব বয়সের সবারই আছে, নাকি!
তবে এবছরের ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। কেউ যেখানে এবার ঝিমলির শুকনো আবীর খেলার সম্ভাবনার কথা মনেও আনছেনা, তখন সে নিজে সে কথা মুখে আনে কী করে!
অন্যান্য বছর এদিন সকাল থেকে বাড়িতে লোক সমাগম হয়, সামনের বারান্দায় চেয়ার পাতা হয়, টেবিলে আবীর, মিষ্টি, নোনতা, জগে বাদামের শরবত আর ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের গেলাসের থাক।
"হোলি মুবারক", "দোলের শুভেচ্ছা", কোলাকুলি, কপালে আবীর চলে। তারা ছোটরা, বাঙালী বড়দের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করে।
বেলা পড়লে বাড়ির সবাই বেরিয়ে আশেপাশে ঘনিষ্ঠদের বাড়ি ঘুরে, সব শেষে সরস্বতী মন্দিরে যায়। সেখানে তখন একইভাবে ক্যাম্পাসের আরো অনেকে জড়ো হয়েছে। মন্দির চত্বরে শুকনো ভিজে সব দোলের আয়োজন থাকে কতৃপক্ষের তরফে, গুজিয়া, ভাজিয়া, ভাংয়ের শরবত। মেয়েরা একদিকে, পুরুষেরা অন্য আর একদিকে, ছোটরা নানা বয়সের নানা দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে যায়। ঢোলক বাজে, গান হয়, "হোলি আয়ি রে আয়ি হোলি .... "
এইভাবে বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে যে যার বাড়ি ফেরা। ব্যস, এরপরে আর কেউ রঙের হোলি খেলেনা। বড়জোর, যারা কোনো কারণে সকালে খেলেনি বা খেলবেনা, তারা কেউ কেউ সন্ধ্যেবেলা এমনিই আসে শুভেচ্ছা জানাতে। এলে মিষ্টি খাওয়ানো হয়, বাইরে বসন্তের হাওয়ায়, চাঁদের আলোয় বসে গল্প হয়, কিন্তু বচ্ছরকার হোলিখেলা ঐ দুপুরে সরস্বতী মন্দিরেই শেষ হয়ে যায়।
আজ লোকজন বাড়ি বাড়ি আসতে শুরু করার আগেই, বাড়ির সবাই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ল মন্দিরের দিকে। পথে অবশ্য দু একটা বাড়ি ঘুরে যাবে। মোটকথা সে যাই হোক, যেখানেই যাক,এবাড়ীতে হোলিখেলা নেই এবছর, ক্লাস টেনের পরীক্ষা না!
ঝিমলি চুপচাপ নিজের ঘরে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর বায়োলজি বইখানা খুলে, খোলা পাতার দিকে তাকিয়ে, সবার চলে যাওয়া শুনল। কাল রাতের আলোচনার ফলাফল অনুযায়ী সদর দরজায় বড় তালা লাগিয়ে যাওয়া হবে। বেরোবার আগে মা এসে ওর ঘরের জানালার নীচের পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে গেল, যাতে বাইরে থেকে কেউ দেখে না ফেলে। জানালার নীচেই ওর পড়ার টেবিল পাতা। এ নিয়েও নিত্য অশান্তি হয় বড়দের সাথে। তাদের অনুযোগ, ও নাকি পড়া ছেড়ে জানালা দিয়ে বাইরের গাছপালা পাখপাখালির দিয়ে তাকিয়ে থাকে অদ্ধেক সময়। কোথাও কোনো বিষয়ে নম্বর একটু কম হলেই, মা সর্বাগ্রে জানালার নীচ থেকে টেবিল সরানোর ধুয়ো তোলে। তবে কিভাবে যেন এব্যাপারে শেষ রায়টা মুলতুবিই থেকে গেছে এখনো পর্যন্ত।
চারদিক শান্ত হয়ে যেতে ঝিমলি ড্রইংরুমে এল। বন্ধ জানালার ঘসা কাঁচের ভেতর দিয়ে লন পেরিয়ে বড় রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এখনো লোক চলাচল তেমন নেই। আজকে মোড়ের সাইকেল সারানোর দোকান খোলেনি, পোস্টাপিসও বন্ধ, কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া চারধার। অন্যান্যবার সকালে সামনের লনে চার বাড়ির ছোটোরা পিচকারী নিয়ে নামে, এবারে কেউ নেই। তার আর শেষের বাড়ির টিনুর তো বোর্ড, মাঝের দুটো বাড়ির লোকজন বোধহয় এবার বাইরে গেছে, ওদের বাচ্চারা প্রাইমারীর, তাদের পরীক্ষা শেষ।
চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে একেবারে জানালার ধারে নিয়ে গিয়ে বসল রাস্তার দিকে মুখ করে। ঘসা কাঁচের মজা হল, বাইরে থেকে ভেতর দেখা যায়না। স্কুল বন্ধ হওয়া থেকে ও দিনের মধ্যে বেশ কবার নিজের ঘর ছেড়ে এই ঘরে এসে বসে, কখনো বই খাতা নিয়ে, কখনো বা এমনিই। সকালে খবরের কাগজটা আদ্যোপান্ত পড়ে। অন্যসময় কাগজ তেমন ছুঁয়ে দেখেনা, কিন্তু পরীক্ষার সময় আলাদা কথা। অন্যান্য গল্পের বই পড়া বারণ, কিন্তু কাগজ পড়লে কেউ কিছু বলেনা, তাই ও খুঁটিয়ে কাগজ পড়ে এসময়, বিজ্ঞাপন, নিরুদ্দেশ সম্বন্ধে ঘোষণা, কিচ্ছু ছাড়েনা, যতটা ফাঁকি মারা যায় আর কী! কিছুক্ষণ রাস্তা দেখে আবার ঘরে গেল, বায়োলজির বইয়ের মধ্যে থেকে নার্ভাস সিস্টেম তাকিয়ে আছে ওর দিকে, মুখটা ঘুরিয়ে নেয়!
বাড়ির পেছনের লাগোয়া মজদুর মহল্লা থেকে একটা হল্লা ভেসে আসে, হোলি শুরু হয়ে গেল। ওদের মত মজা করে হোলি আর কেউ খেলেনা। ওদিকে ঝিমলিরা কেউ যায়না সচরাচর, এমনিতে বারণ কিছু নেই, তবুও। তবে যেটুকু দেখেছে তাতে মজদুর মহল্লাটা বেশ মজার। এই সাজানো গোছানো ক্যাম্পাসের নিখুঁত নিভাঁজ বাড়ি, রাস্তা, ঘর, বিল্ডিং দেখলে, এর ভেতরের মজদুরদের স্টাফ কোয়ার্টারের এলাকার চিত্রটা কেউ কল্পনাই করতে পারবেনা। ঝিমলি অনেকসময় দুপুরে পড়তে পড়তে বোর হয়ে গেলে উঠোনে গিয়ে চেয়ারের ওপর উঠে, পাঁচিলের এপার থেকে ওদের জীবনযাত্রা দ্যাখে, একদম কোনো ছবির গ্রামের মত মনে হয়।
একটা বড় উঠোন মত জায়গা ঘিরে সারি সারি এক কামরার কোয়ার্টার, গায়ে গায়ে লাগানো। উঠোন টা মাটির, নিকোনো মতন, মাঝখানে একটা বড় পীপল মানে অশুত্থগাছ, তার নীচেটা বাঁধানো, সেখানে বড় বুড়োরা এসে বসে, গালগল্প ধূমপান চলে। উঠোনে ইতস্তত দড়ির খাটিয়া পাতা,খাটিয়ায় বসে মেয়েরা চাল ডাল বাছছে গল্প করতে করতে,বাচ্চারা খেলছে বা কেউ কেউ পড়ছে। ঘরের ভেতর জায়গা অকুলান হয় বলে সবাই ঐ উঠোনেই থাকে সব সময়, সব কাজ ওখানেই। একপাশে একটা বড় চৌবাচ্চা আর কলতলা আছে। সেখানে মেয়েরা জল ধরে, কাপড় কাচে, কাচতে কাচতে ঝগড়া করে বা গল্প করে। সন্ধ্যের দিকে দেখা হয়নি কোনোদিন, কিন্তু আওয়াজ শুনে বোঝা যায় কাজ থেকে ফেরা পুরুষদের জমায়েত হচ্ছে গাছতলায়, উঠোনে পাতা খাটিয়ায়।
কাল হোলি ইভে মহল্লায় ফাংশন হচ্ছিল রীতিমত চাঁদোয়া খাটিয়ে, বড় আলো, মাইক ইত্যাদি লাগিয়ে। চাঁদোয়ার মাথা দেখা যাচ্ছিল এবাড়ি থেকে, আলোর আভাও। রাত হলে শুরু হল মাইকের গান। মা চিন্তিত, বিরক্ত, মেয়েটার পড়ায় বাধা পড়ছে, কিন্তু কিছুই করার নেই, হোলি বলে কথা। গলাটলা শুনে মনে হচ্ছিল, রঙ শুধু বাইরে নয়, সকলের ভেতরেও টইটম্বুর।
এমনিতে এসব দিকে সাতদিন আগে থেকেই হোলি শুরু হয়ে যায়, ক্যাম্পাসের মধ্যে বলে বোঝা যায়না। সিভিল লাইনসের দিকে গেলেও অতটা নয়, তবে বাজার বা ক্যানালের পাড়ে গেলে খুব সাবধানে, সতর্ক থাকতে হয়। এ অঞ্চলের নিয়মে হোলিতে কেউ গায়ে রঙ দিলে আপত্তি করতে নেই,মেনে নিতে হয়........."বুরা না মানো, হোলি হ্যায়"।
বাড়ির আর সবাই বিরক্ত হলেও ঝিমলির বেশ মজা লাগছিল। ইদানীং টিভি দেখা বন্ধ, তার জায়গায় ফাংশান শুনতে মন্দ লাগছিল না। সবই গান, এবং পুরুষ কন্ঠে। দরজা জানালা বন্ধ করেও, মাইকের শব্দ এড়ানো যায় নি। রাত একটু বাড়তে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে শুধু এদের গানের হুল্লোড়। ওর চোখ বইয়ের পাতায়, কান মাইকে। বেশীরভাগ হোলির গান, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের লোকগীতি ধরণের, তার মাঝে মাঝে পপুলার হিন্দী সিনেমার প্রচলিত হোলি সঙ্গীতও শোনা যায়।
"আভি আপকে সামনে অগলা কলাকার গীত পেশ করনে আ রহা হ্যায়, সাগুন - সাগুন কে লিয়ে তালিয়া"।
রীতিমত প্রফেশন্যাল কায়দায় ঘোষণা, অনেকটা দুরদর্শনের ঘোষকদের মত স্টাইল। সাগুনের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাড়ুদার, আর সাগুন ঝিমলিদের ও আশেপাশের চার বাড়ির মেথর। বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মহা ফাঁকিবাজ, সপ্তাহে তিনদিন আসার কথা। প্রায়ই একদিন ফাঁকি মেরে দেয়, ওকে দেখলেই সবাই বকাবকি করে, ঝিমলিও। উঠোনের নালা আর বাথরুম পরিস্কার করে, উঠোন ঝাঁট দেয়। ঝিমলির সঙ্গে ওর ঝামেলা লাগে জাম নিয়ে। উঠোনের বড় জাম গাছটায় খুব মিষ্টি জাম হয়, আর সাগুন এ বাড়ির কাজের লোক হওয়ার সুবাদে সর্দারি করে গাছে উঠে প্রায়ই ওর পুরো মহল্লাকে জাম খাওয়ায়, মালিকদের ভাগটাগ দেয়না। এদিকে ঝিমলির বন্ধুদেরও খুব প্রিয় এ বাড়ির গাছের জাম। বন্ধুরা এলে সাগুনকে জাম পেড়ে দিতে বললে দিতে চায়না, তানানানা করে।
সেই সাগুন গান ধরল, "রঙ বরসে ভিগী চুনরিয়া", না দেখেও বুঝতে পারছিল শ্রোতা বা দর্শককূল পুরো মোহিত, মনে হয় কিছু লোক নাচছিলও গানের তালে, কারণ বার বার গাইতে বলে চেঁচাচ্ছিল সবাই, "সাগুন ফির সে, সাগুন আবার"।
অমিতাভর হেঁড়ে গলা হলেও, এই গানটা ওর খারাপ লাগেনা বিশেষ করে হোলির সময়ে, কথাগুলো তো খুব ভালো লাগে। সিলসিলা সিনেমাটাও ভালো, টিভিতে দিয়েছিল যখন দেখেছে। ওরকম একটা ফুলের বন দিয়ে সাদা বা হলুদ সালোয়ার কামিজ পরে ওড়না উড়িয়ে ছুটে যাওয়া কেমন স্বপ্নের মত লাগে, রেখাকে দারুন লাগছিল। আর "ফুল ভি হো দর্মিয়াঁ তো ফাসলে হুয়ে", এই লাইনটা তো কেমন গায়ে কাঁটা দেওয়া রোম্যান্টিক মনে হয়।
মনে পড়তেই মনটা কেমন কেমন করে উঠল। আবার ছুটে আসে বাইরের ঘরে, চোখ রাখে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে। যদিও জানে আজ শরাফ স্যরের কোচিন বন্ধ, জয় আজ এসময় ম্যাথস করে ফিরবেনা। তবু তবু তাকিয়েই থাকে, যদি ভুল করেও সে আসে এই পথে? যদি হঠাৎ দেখে লম্বা চেহারায় একটু কুঁজো হয়ে বাঁই বাঁই করে কেউ সাইকেল ছোটাচ্ছে, চির পরিচিত সেই ভঙ্গীতে?
দুর, কী যে ভাবছে, জয় আজ কোথা থেকে আসবে! তার তো আবার শুধু বোর্ড নয়, মহাবোর্ড। আইআইটি ও আরো কত কী!
জয়ের তো আই আইটি বাঁধা, ওদের স্কুলের ফার্স্ট বয়রা সব সময় আইআইটিতে পায়। সে কি আর হোলির দিনে পড়াশোনা না করে ঘর থেকে বেরোবে! ফার্স্ট বয় হলে কী হয় জয়ের ওপর ঝিমলিদের ক্লাসের কোনো মেয়েই ফ্ল্যাট নয়। এমনিতে এখানের সব মেয়েরাই সবসময় এক বা একাধিক জনের ওপর ফ্ল্যাট থাকে। দীপার দিদি কল্পনার ক্লাসমেট জয়, দীপাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে। দীপা ঝিমলিদের ক্লাসের একজন পান্ডাগোছের। সেদিন ব্রেকে ব্রাদারদের গিনিপিগ, খরগোশ আর ময়ূরের খাঁচার সামনের ছোট মাঠটায় বসে জয়ের সম্বন্ধে বলেছিল,
"দ্যাট বাসু বয়, ও পড়াশোনায় ভালো হতে পারে, কিন্তু কী ফিজিক, ঐ তালঢ্যাঙা শুঁটকে চেহারা, চোখে দেখা যায়না, প্যাথেটিক"।
কথাটা উঠেছিল কল্পনার বার্থ ডে পার্টি নিয়ে। পার্টিতে ঝিমলির প্রাণের বন্ধু অনুও গিয়েছিল, দীপাদের সঙ্গে ওর খুব ভালো সম্পর্ক। অনুর অবশ্য সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক, সে সবার বাড়ি যায়। মূলত মিলস অ্যান্ড বুনসের রোমান্টিক বইয়ের সার্কুলেশন ক্লাবের অনু একজন উৎসাহী মাতব্বর। ক্লাস স্কুল নির্বিশেষে সবার সাথে যোগাযোগ রেখে কার কাছে কী বই এল নতুন, সেটা কখন কে পাবে, এসব বিলিব্যবস্থা দায়িত্বের সঙ্গে করে থাকে। তাদের ক্লাস থেকে শুধু অনু আর বন্দনা ছিল পার্টিতে, বন্দনা দীপার বেস্ট ফ্রেন্ড, যেমন ঝিমলির অনু।
সেখানে শালিনী থাপর নাকি খুলে আম জয়ের সঙ্গে ফ্লার্ট করছিল। শালিনী দারুন চোস্ত মেয়ে, যেমন সুন্দরী, তেমন স্মার্ট। তার জন্য যে ও পক্ষের প্রচুর ফ্ল্যাট লোকজন আছে, তা এশহরের কোনো স্কুলের জনতারই জানতে বাকী নেই। সে অনেক মেয়েরই আইডল, স্কুলের অ্যানুয়াল ফ্যাশন শোয়ের লাগাতার শো স্টপার। শালিনীর এহেন পছন্দে মেয়েরা মর্মাহত। ঝিমলির তো আবার দ্বিগুণ আঘাত, জয়ের চেহারার নিন্দে শুনেও কান চাপতে পারছেনা, ওদিকে শালিনী থাপর আর জয়!
এত শত ব্যথা নিজেই ছাই বুঝতে পারেনা তো আনজনে কোথা থেকে বুঝবে!
জয়কে তো কবে থেকেই দেখছে, সব বাঙালী অনুষ্ঠানে, পূজোয়, যেখানে চারটে বাঙালী এক হয় সেখানেই। তেমন আলাদা করে কোনোদিন তাকিয়ে দ্যাখেনি, দেখার কথা মনেই হয়নি। ক্লাসে দু চারজন খুব গোঁড়া, শহর থেকে পড়তে আসা, ব্যবসায়ীদের মেয়ে ছাড়া, বাকী মেয়েরা সবাই মোটামুটি এক বা একাধিকের ওপরে ফ্ল্যাট থাকে। বেশীরভাগই সিনিয়র, অথবা কখনো ছিটকে আলাপ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর্মির মেয়েদের তালিকায় সদ্য গোঁফ ওঠা ক্যাপ্টেনও আছে একটি দুটি। তবে মোটের ওপর এই স্কুল বা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছেলেদেরই বাজারদর বেশী, আসলে তো সবাই তিনটি ক্যাম্পাসেরই ছেলেমেয়ে। স্কুলের বাইরে একাধিক জায়গায়, নানা অনুষ্ঠানে, দেখাসাক্ষাত হচ্ছে সবসময়।
অনু আবার এসবে নেই, তার হৃদয়েশ্বর সব তার মিলস অ্যান্ড বুনসের হীরোরা। এইসব প্যাংলা স্কুল বয়েজদের দেখলেই সে নাক সিঁটকোয়, টল ডার্ক হ্যান্ডসাম অর্থাৎ তাদের ভাষায় টীডিএইচ ছাড়া কোনো ফ্ল্যাট হওয়ার গল্প নেই। সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হীরোদের ওপর ফ্ল্যাট থেকে থাকে, ইদানীং "লেপার্ড ইন দ্য স্নো" র হীরোর পালা চলছে। অনুর জগৎ মিলস অ্যান্ড বুনসময়। ও কাউকে প্রশংসা করতে হলে বলে, অমুক বইয়ের হিরোয়িনের মত লাগছিস। এমনকি নিজের বাবার চল্লিশ বছরের জন্মদিনে বলেছিল,
"পাপা, তুমি তো এখন ঐ বইয়ের হীরোর বয়সী হয়ে গেলে, দারুন ব্যাপার"।
আঙ্কল ধরে গাঁট্টা লাগিয়েছিল কখানা। অনুর বাড়ির লোকেরা জানে ঝিমলির জন্যেই অনুর পড়াশোনা যা কিছু হয়, নাহলে কী যে হত!
ঝিমলি সব ব্যাপারে অনুর কথামত চললেও, দুজনের পড়াটা ঐ জোর করে করায়। অনুকে ছাড়া ক্লাস সে ভাবতেই পারেনা সেজন্য তাকে পাস করানোর গরজ ওরই বেশী।
প্রাণের বন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেও চিরকাল সেরকমটাই ভাবতে চেষ্টা করে এসেছে, টল ডার্ক হ্যান্ডসাম ছাড়া ফ্ল্যাট হওয়া যায় না। তাই কেউ কারোর ওপর ফ্ল্যাট হয়েছে শুনলেই, ওরা দুজনে মিলে নাকটাক কুঁচকে একাকার করত।
সব কেমন পালটে গেল দু বছর আগে জয়ের টেনের বোর্ডের ওই দুর্দান্ত রেজাল্টের পর।
জয়েদের বাড়ি তো প্রায়ই যেত। বাসু আন্টি সব অনুষ্ঠানেই নাচের প্রোগ্রামের দায়িত্বে থাকে। এমনিতে ঝিমলি কিছু এমন নৃত্যপটিয়সী নয়, দেখতেও ছিরি নেই, একমাত্র বাঙালী হওয়ার সুবাদেই আন্টির .নাচের দলে চান্স পায়। তাও লম্বা হওয়ার দরুন ওকে সবসময় পাগড়ী বেঁধে একখানা ছেলের নাচ দেওয়া হয়। আগে কিছু মনে করত না, কিন্তু এই দুবছর আগে থেকে কেমন ছেলে সাজতে লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। ওদের বাড়িতেই রিহার্সাল, যদি জয়ের চোখে পড়ে যায়।
অবশ্য জয়কে সে কোনোদিন রিহার্সালের আশেপাশেও দ্যাখেনি। শেষ দুটো প্রোগ্রামের জন্য যখন ওবাড়ি গিয়েছিল কবার, তখনো চোখে পড়েনি। রিহার্সালের ফাঁকে দু একবার ঢুকে পড়ত জয়ের ঘরে, ওর বই খাতা গুলোকে ছুঁয়ে দিত। কী সব পোস্টার রেখেছে ঘরে, বক্সিং চ্যাম্পিয়ন, ব্রুস লী, বিদিকিচ্ছিরি!
খুব ইচ্ছে হয়েছিল তখন, আন্টি ওকে নাচে নায়িকার রোলটা দিক, ও সুইটির মত সেজেগুজে স্টেজে আসুক, জয় ওকে সুন্দর দেখুক। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কী আর সব হয়! আন্টির নাচে সুইটির নায়িকার রোল বাঁধা। সুইটি ঝিমলিদের ক্লাসেই পড়ে,বিহারী, দারুন নাচে, দেখতেও ভালো, মানে সবাই বলে মুখটা তেমন সুন্দর নয়, তবে চেহারা রঙ এসব তাকিয়ে দেখার মত। বাসু আন্টির মানসকন্যা সুইটি, তাকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই, আর সুইটিরও তাই গরবে পা মাটিতে পড়েনা। অনেকে এনিয়ে হাসাহাসি করে, বলে যে মিসেস বাসু সুইটিকেই ছেলের বউ করবে। বুক ভাঙার কি একখানা কারণ!
যাইহোক ইদানীং ঝিমলি আর নাচে থাকেনা, পড়ার চাপ দেখিয়ে বারণ করে দেয়। আন্টিদের উল্টোদিকের বাড়িতে কেরলকার ম্যামের কাছে অঙ্ক বুঝতে যায় যখন, তখন মাঝে মাঝে আন্টি ধরে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্যে।
"একটু খ্যাল না রে আমার সাথে, কী যে মুটকি হয়ে যাচ্ছি আমি"।
ও খ্যালে, আবার ভাবে, শাশুড়ীদের একটু মোটাসোটা হওয়াই ভালো,ছিমছাম স্মার্ট শাশুড়ী একদম পছন্দ নয়।
এবারে পুজোয় পিঙ্ক সালোয়ার কামিজ পরেছিল, কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ। আন্টি দেখে বলল, "বা:, ঝিমলিকে তো টিপ পরলে বেশ লাগে। পরিস না কেন সালোয়ার কামিজ?" এমনিতে সালোয়ার কামিজ, টিপ চুড়ি এসব দুচক্ষের বিষ, তবু তারপরে দু একদিন ম্যামের কাছে যাবার সময় ওসব পরে গিয়েছিল, তা আন্টির সঙ্গে দেখাই হলনা।
আন্টিকে নিয়ে খুব মজা হয় বাঙালী মহলে। গয়ার মেয়ে, তাই বাংলাটা কেমন একটা করে বলে। আন্টির শ্বশুরবাড়ি কলকাতার খুব ভালো নামকরা পরিবার। বিয়ের পরে নাচ শিখেছে, রবীন্দ্রসঙ্গীতও। তবু এখনো মাঝে মাঝে বাংলায় গন্ডগোল করে ফেলে। পুজোর পর বিজয়া সম্মিলনীতে সেবার যেমন কী নিয়ে বলতে গিয়ে বলল, "আমাদের ফল্গু নদী জানো তো, অন্তঃসত্ত্বা"!
সবাই তো এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, তারপর শুক্লা কাকীমা উদ্ধার করল যে আন্টি আসলে "অন্ত:সলিলা" বলতে চাইছে। তখন সে কী হাসির হুল্লোড়! সবাই মজা করলেও ঝিমলির আন্টিকে ভালোই লাগে, জয়ের মা বলে কথা!
টেনের রেজাল্ট বেরোনোর পর থেকেই জয় এই শহরের হীরো হয়ে গেল, যে বাড়িতে যাও, সেখানেই শুধু তাকে নিয়ে আলোচনা। একদিন দাদার কাছে এসেছিল ইলেভেনের ফিজিক্সের কী ডিফিকাল্টি বুঝে নিতে। রাস্তায় জিজ্ঞেস করতে দাদাই বাড়িতে এসে ভালো করে বুঝে নিতে বলেছিল। সে কী বিপত্তি, মা দাদা বৌদি সব এসে জড়ো হল।
তার মধ্যে দাদার চিৎকার,
"দ্যাখ, এভাবেই ওরকম রেজাল্ট হয়, জয় এসেছে পড়া বুঝে নিতে আর তোকে ডেকে ডেকেও বই নিয়ে বসানো যায়না।"
মাও মহা উৎসাহে যোগ দেয়,
"শুধু কী তুই, কারুর কাছেই তো পড়তে চায়না, কী যে হবে ওর! এই তো জয় শরাফ স্যরের কাছে অংক করছে, শহরের সব ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা তার কাছে অংক করে ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিক্যাল পায়। আর এই মেয়ে একদিন গিয়ে বলে, শরাফ স্যর নাক খোঁটে, ওর কাছে পড়বনা। বালাসুন্দরমের কাছে কেমিস্ট্রী পড়বেনা কেন না সে এম কে ইয়াম আর এন কে ইয়ান বলে, কে বি গুপ্তা নাকি বই মুখস্থ করায়। হাজারটা বায়নাক্কা এর, এমন মেয়ে দেখেছিস জয়?"
চশমার সরু স্টাইলিশ ফ্রেমের আড়ালে ঝকঝকে উজ্জ্বল চোখের, আপাতগম্ভীর মুখে কি চাপা হাসির আভাস?
কিন্তু সে ছাই ভালো করে দেখার উপায় আছে এদের জ্বালায়! কী যে ভাবছে ওর সম্বন্ধে, ধরণী দ্বিধা হও ব্যাপার স্যাপার, ঝিমলি মানে মানে সরে পড়ে সেখান থেকে। ভাবছে কি, হয়ত ভাবছেই না, বয়ে গেছে তার, ওর মত বিচ্ছিরি, লেখাপড়ায় ফাঁকিবাজ, কোনোকিছুতেই ভালো নয় মেয়ের কথা ভাবতে!
বাইরে হোলি পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। উঠোনে চেয়ারে উঠে কিছুক্ষণ পাঁচিলের ওপারে সাগুনদের হোলি খেলা দেখল। পুরো চৌবাচ্চাটায় রঙ গুলেছে, ঝপাঝপ লোকজনকে সেই চৌবাচ্চায় ফেলছে। মহিলাদের জটলা একটু দুরে আলাদা, ঘোমটার ভেতরে, যদিও রঙ মেখে পুরো ভুত। বাচ্চারা অবশ্য ছেলে মেয়ে একসঙ্গেই খেলছে।
ওদের উঠোনটা পুরো কাদা হয়ে গেছে, বয়স্ক কয়েকজন গাছের নীচে বসে হুঁকো টানছে আর কীসব হা হা হি হি করছে। দু তিনটে বড় টিনের বালতিতে বোধহয় ভাংয়ের শরবত গোলা। ছেলেরা সব গ্লাস ভরে ভরে একে ওকে দিচ্ছে, মহিলারা ঘোমটা আড়াল করে শরবতে চুমুক মারছে, আর খিলখিল হেসে উঠছে। কে একটা জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে পাশের ড্রেনে গড়িয়ে পড়ল। দু তিনজন তাকে ঘিরে রইল কিন্তু তোলার চেষ্টা করল না কেউই। মেয়ের দল রকম দেখে এ ওকে ঠেলতে ঠেলতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ঝিমলির দেখে শুনে মনে হল ওটা সাগুন, সাগুন দেখা যাচ্ছে এপাড়ার একখানা হীরো বিশেষ!
কারা যেন বেল বাজালো, ঝিমলি তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে মাঝের বেডরুমে এসে বসে রইল। বাইরের দলটা এবার জোরে জোরে ধাক্কা মারছে দরজায়। কেমন একটা ভয় ভয় করছে আবার বিচ্ছিরিও লাগছে। কী অদ্ভুত, এভাবে সামনে তালা লাগিয়ে ভেতরে বসে থাকা যায়! পড়া তো যা হচ্ছে তা আর বলার মত নয়, এর চেয়ে বেরিয়ে হোলি খেললেই ভালো ছিল। এসব বড়দের কে বোঝাবে!
কাল রাত থেকে অনুদের বাড়িতে চলে গেলে ভালো হত। ওদের বাড়ি সিভিল লাইন্সে, সামনেই বোট ক্লাব। ক্যাম্পাসের ভেতরে যেমন সরস্বতী মন্দির, বাইরে তেমনিই বোট ক্লাব। সব শেষে শহরের তাবড়েরা সেখানে জুটে একসাথে হোলি খেলে। অনুর সাথে পড়তে ওর বাড়ি প্রায়ই যায় ও, ওখানে পড়বে বললে বাড়িতে কেউ আপত্তি করত না, অনু বলেওছিল অনেক করে।
একটাই বিরক্তিকর ব্যাপার, রোহিত, অনুর দুবছরের বড় ভাই। এনডিএ তে ফেল টেল মেরে এখন তাদের সাথে বোর্ড দিতে এসেছে। ফেলতু হলে কী হবে প্রচুর পপুলার ছেলে, শহরের সব বয়সের সব ছেলেরা ওর বন্ধু, তাদের অনেকেই নির্ঘাত ওদের বাড়ি আসবে হোলি খেলতে।
রোহিত আবার অনু আর ঝিমলির ব্যাপারে ভীষণ কড়া, সবসময় নানাব্যাপারে হুইপ জারি করে থাকে ওদের ওপর, এটা করবিনা, ওর সঙ্গে কথা বলবিনা, ঐ ছেলেটা এরকম, ধারেকাছে যাবিনা, ইত্যাদি হাজারটা বাধা নিষেধ। অনুদের বাড়িতে গেলে হয়ত রোহিতই ওদের ছাদের ঘরে বন্ধ করে দিত, পাছে ছেলেরা এসে ওদের সাথে হোলি খেলতে চায়। নিজে অজস্র মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে বেড়াবে, কিন্তু এই দুই বোনের ধারেকাছে ছেলেদের ঘেঁসতে দেবেনা!
এবছর হোলিটা কেমন বেকার হয়ে গেল। অন্যান্য বছর হোলি আসবে হোলি আসবে, কী উত্তেজনা, কী হয় কী হয় ভাব। আগের রাতে হোলিকা জ্বালানোর সময় থেকে শুরু হয় ধুকপুক। সরস্বতী মন্দিরে কত কান্ড, কত গল্পের শুরু, কোথাও আবার শেষও বটে। স্কুল খুললে ব্রেকে বা গেমস পিরিয়ডে ছোট মাঠে বসে নতুন খবরের আদানপ্রদান ও দীপা বন্দনা দিব্যার মত নানা বিশেষজ্ঞের মতামত। বন্দনা দীপা যা মতামত দেয় তাই শেষ কথা হয়, এমনকি অনুও মেনে নেয় সেসব।
তাই তো অনুকে জয়ের কথা বলা যায়না। দীপা যাকে প্যাংলা প্যাথেটিক বলে, তার ওপর প্রিয়বন্ধুর ফ্ল্যাট হওয়া অনু কিছুতেই মেনে নেবেনা।
তবে মাঝে মাঝে মিলস অ্যান্ড বুনস আর পড়াশোনার ফাঁকে অনু যখন অন্য কোনো বিষয়ে ভেবে মতামত দেয় (খুবই সামান্য সেসব ফাঁক), তা কিন্তু বেশ চমক লাগানোর মত।
যেমন শালিনী থাপর আর জয়ের ব্যাপারটাতে অনু বলল, শালিনী বারো ক্লাসের জন্যে একেবারে আন্ডার প্রিপেয়ারড, শুধু মস্তি করে বেরিয়েছে দুবছর, অথচ ওর বাবা মা খুব কড়া। এখন উপায় না দেখে ফার্স্ট বয়কে ধরে বারো ক্লাস পার হওয়ার চেষ্টা করছে, জয়ের ব্যাপারে আসলে ও সিরিয়াস নয়।
দীপারাও এযুক্তি কাটার মত চট করে কিছু বলতে পারেনি সেদিন। অজান্তেই প্রিয় বন্ধুর মাথা থেকে কতটা বোঝা প্রায় নামিয়েছিল, অনু বোধহয় কল্পনাও করতে পারবেনা!
হোলির পর স্কুলে বেশ কয়েকদিন এইসব নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা চলে। এবারে আর স্কুলে যাওয়া নেই। ইলেভেনের ক্লাস শুরু হতে হতে হোলির খবর সব বাসী হয়ে যাবে! ☹
আগে ভেবেছিল এবার তারা না বেরোলেও লোকজন তো বাড়িতে আসবেই, যদি জয়ও আসে ওর বাবা মার সাথে? এটাই হয়ত শেষ বছর, তাই আসতেও পারে। একবার সাহস করে একটু আবীর কি লাগিয়ে দিতে পারবেনা?
গতবছর সাদা কুর্তার ওপর রামধনু রঙের বাঁধনি ওড়না জড়িয়ে হোলি খেলতে গিয়েছিল মন্দিরে। কে যেন মাথায় মুখে লাল আবীর মাখিয়েছিল খুব করে। পরে আয়নায় নিজেকে দেখে লাল আবীর আর মুছতেই ইচ্ছে করছিল না। সুইটি, শালিনী থাপরের মত না হলেও নিন্দের নয় একেবারেই, বরং বেশ লাগছিল, কনে কনে।
জয়কে আবীর দিতে যাওয়ার আগে নিজেই নিজেকে একটু লাল আবীর মাখিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবনায় ছিল। তাই হোলির বাজার করতে গিয়ে মাকে দিয়ে জোর করে লাল আবীর কিনিয়ে, আবীরের প্যাকেট থেকে অনেকটা আলাদা করে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছে।
তালা দেখেও কত লোকে এসে বেল বাজিয়ে যাচ্ছে, প্রথম প্রথম পর্দার আড়াল থেকে ঘসা কাঁচের মধ্যে দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বুঝতে চেষ্টা করছিল কারা, এখন সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে। একবার ফোন করল অনুকে, বেজেই গেল, ওদের বাড়িতে কেউ ফোন তুলল না। দু:খে চোখে জল এসে গেল, অনুটাও বেরিয়েছে খেলতে, অথচ কাল এসে বলল এবারে ওকেও বেরোতে দেবেনা, শুধু রোহিত বাড়ির একমাত্র ছেলে বলে তাকে দাদু অনুমতি দিয়েছে। অনু খুব চেঁচামেচি করছিল সেই নিয়ে। শেষমেশ দ্যাখো, ঠিক বেরিয়েছে, বিশ্বাসঘাতক!
সবার ওপরে রাগ হতে হতে খিদে পেয়ে গেল। ডাইনিং টেবিলে গুজিয়া মিষ্টি পায়েস রাখা আছে তার জন্যে, দোলের মিষ্টি, তাই ছুঁতেও ইচ্ছে হল না। ফ্রিজ খুলে দু পিস পাঁউরুটি বার করে তার মাঝখানে একটা সলামী রাখল, তার ওপরে একটা চীজের পাতা। খেতে খেতেই মনে হল গল্পের বই পড়বে, তাকে পড়ার জন্যে হোলি খেলতে দেওয়া হয়নি, তাই সে কিছুতেই পড়ার বই পড়বেনা, বায়োলজি পেপারের যা হয় হোক।
খুঁজে পেতে একটাও পড়ার মত গল্পের বই পেলনা বাড়িতে,পছন্দের বই সব সরানো আছে, ট্রাঙ্কে তুলে তালা দেওয়া, সামনের ঘরের দেওয়াল আলমারিটাতেও তালা। কাঁচের মধ্যে দিয়ে "ডেথ অন দ্য নাইল" তাকিয়ে আছে তার দিকে।
দাদার ঘরে বিছানার ওপর একখানা পেরী ম্যাসন পড়ে আছে, অগত্যা তাই নিয়ে এসে শুল বিছানায়। মাথার দিকে একটা ছোট জানালা, রাস্তার ওপর। এখন রাস্তা দেখতেও আর ইচ্ছে করছেনা।
পেরী ম্যাসন এমনিতে ওর বিচ্ছিরি লাগে, রহস্য তেমন নেই, শুধু আইনের কচাকচি। তাও যদি ডেলার সঙ্গে একটু আছোঁয়া নাছোঁয়া প্রেম করত, তাহলেও কিছুটা মানুষের মত হত গল্প গুলো।
পড়তে পড়তে কখন ঘুম ধরে গেছে। দুরে কোথাও যেন টানা বেল বেজে যাচ্ছে, পাশের বাড়িতে বোধহয়। জানালায় ঠকঠক জোরে, ঘুম ভেঙ্গে ধড়পড়িয়ে উঠে পড়ে। দরজার দিকে যেতে গিয়ে মনে পড়ে যায় সদরে তালা, থেমে যায়।
শব্দটাও থেমে গিয়ে সব চুপচাপ। চারধারের হোলির হট্টগোলে কিছুটা ভাটা পড়েছে মনে হয়, ঘড়ির দিকে তাকায়। উঠে পড়ার টেবিলে এসে বসল। মায়েদের ফেরার সময় হয়নি, আর কতক্ষণ খেলা হবে মন্দিরে?
জানালার ওধারে গেটের কাছে কতগুলো সাইকেল নড়াচড়ার ধাতব শব্দ, কারা যেন কথা বলছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওপরের আধখোলা পাল্লায় চোখ রাখে, একটু আড়াল থেকে।
"কিরে জয় কী করবি? তোর মেহবুবাকে তো কোথাও পাওয়া গেলনা। মন্দিরে নেই, রোহিতদের বাড়িতে নেই, এখন শেষমেশ ওদের বাড়িতে এলাম, সেখানেও নেই। জিন পরী নাকি, উবে গেছে? এবার কোথায় যাবি?"
"চল, একবার শেষ বোট ক্লাবে দেখি। রোহিতের বোনকেও দেখলাম না। হয়ত দুজনে কোথাও লুকিয়ে আছে। কিন্তু রোহিতকে বলা যাবেনা, ও বোনেদের ব্যাপারে প্রচুর সেনসিটিভ।"
উত্তর কী এল শোনা গেলনা, তবে কিছু একটা এল। আবার একটা অন্য গলা শোনা গেল,
-"আরে না ইয়ার, তোর জন্যে জান হাজির। এসব ব্যাপারে ফেলে রাখতে নেই, মওকা দস্তুর সব হ্যায়, আজকেই বলে দে যা বলার। এরপরে তো বাইরে চলে যাওয়া, রিস্ক নিয়ে লাভ নেই।"
ঝিমলি চুপ, ঝিমলি অসাড়। সাইকেল চলে যাওয়ার আওয়াজ আসে।
"তাহলে বোট ক্লাব তো?" "হ্যাঁ, বোট ক্লাব"।
...........
" .... একি, সাইকেল নিয়ে রেডি? এখন আবার কোথায় বেরোবি? মন্দিরে সব শেষ, ওখানে কেউ নই। তোমার বন্ধুরা কেউ আসেনি, সবাই পড়ছে। একবছর হোলি না খেললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবেনা।
....................
... একি, একি, দ্যাখো কান্ড মেয়ের! হুড়মুড় করে, পড়ে যাবি। দ্যাখো, কী জোরে সাইকেল চালালো, একটা কথা যদি শোনে। আজকের দিনে পরীক্ষার সময় পড়েটড়ে গেলে কেলেংকারি হবে।
আচ্ছা ও হোলি খেলল কখন, দরজা তো আমরা এই খুললাম? ওর সারা মাথায় গালে লাল আবীর কে মাখালো? .......... "।