বছর ঘুরে আর এক ফাগুন............
স্কুল গ্রাউন্ডের ঠিক মাঝবরাবর দাঁড়িয়ে, একবার গোল ঘুরে চারধারটা দেখে নিল। কী সুন্দর রঙিন লাগছে, রোদ ঝলমল নীল আকাশের নীচে, মাটিতে যেন রামধনু নেমে এসেছে। সীমানা বরাবর মাঠের দুই ধারে সারি সারি স্টল,যেমনটা হয় প্রতিবার। বাইরের লোক আসা শুরু হয়নি এখনো, স্টলে স্টলে শেষমুহূর্তের প্রস্তুতির উত্তেজনা তুঙ্গে। অন্যান্যবারে তারাও এই সময় নিজের নিজের স্টলে ব্যস্ত থাকত, টিচারদের বকাবকি, হাঁকডাক, এটা ভুলে যাওয়া সেটা ভুলে যাওয়া, স্টলের সাজ, নিজেদের সাজ, সবেতে শেষ মুহূর্তের ছোঁয়া দিয়ে নেওয়া। অবশ্য নিজেদের সাজ বলতে পরণে সেই স্কুল ড্রেস, তবু এত লোক আসবে, এই বিশেষ দিনে, তাই ওরই মাঝে সম্ভব হলে চুলের ছাঁটে সামান্য হেরফের, মাথায় শ্যাম্পু, নখে পালিশ, হাল্কা লাইনার, কড়া ডিসিপ্লিনের টীচাররাও এদিন ওটুকু নাদেখা করে দেয়।
এবছর ফেটে মানে মেলার দায়িত্বে বারো ক্লাস নেই, বরাবরই থাকেনা। এর আগে কোনোদিন বোঝেনি এই ক্লাসের দিদিদের দুঃখটা। আজ এই মাঠে দাঁড়িয়ে কেমন কান্না পেয়ে গেল, এভাবেই বুঝি সব আনন্দ, সব মজা, এক এক করে দূরে সরে যায়? এই যদি বড় হওয়া হয়, তবে এ ভারী বিচ্ছিরি বড় হওয়া!
সে একটু তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে, প্রাণের বন্ধুর এখনো দেখা নেই। একা একা এ ভাবে মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে অদ্ভুত লাগছে, অনেকেই স্টলের কাজ থেকে মুখ তুলে তার দিকে এমন করে তাকাচ্ছে, যেন কে না কে!
তাদের ক্লাসের অন্য আর কাউকেও দেখছে না এ চত্বরে। কী রে বাবা, সবাই কি পড়াশুনা করছে নাকি এসময়, শেষে মেলায় কেউ আসবে না নাকি? তাহলে আজ যা বকুনি খেতে হবে না মায়ের কাছে। মা যদি এসে দেখে মেলায় তার ক্লাসের অন্যরা নেই, সে একা পড়া ফাঁকি দিয়ে এসেছে, খুব রাগ করবে! এমনিতেই আজকাল বাড়ি থেকে সব জায়গায় যাতায়াতের ব্যাপারে কড়া নিয়ম নিষেধ জারি হয়েছে। পরীক্ষার আর মাস দুই বাকী, এখন পিরান কালিয়ার মেলা? এবছর আর হবিজ ক্লাবের ফাংশানে গিয়ে সময় নষ্ট করবেনা, পিকনিকে যাবে কী, পরীক্ষা না! কাছাকাছি বন্ধুদের জন্মদিনগুলো তে শুধু যেতে দেয়,তাও প্রচুর কান্নাকাটি তর্ক বিতর্কের পর, এই একটা ব্যাপারে কার্ফু কিঞ্চিৎ শিথিল করা গেছে!
ফেটে তে আসা নিয়েও মা গাঁইগুই করেছিল, কিন্তু ঝিমলি নাছোড়। স্কুলের বচ্ছরকার ফেটে তাদের প্রাণের অনুষ্ঠান, সারা বছর ধরে এই নিয়ে কত পরিকল্পনা প্রতি বছর, কোন স্টলের ভার পড়বে, টিচার কে থাকবে। তারপর শুরু হত প্রস্তুতির পালা, রঙ তুলি কাগজ, স্টল সাজাবার নানা সরঞ্জাম, পরীক্ষার পরের দিনগুলো এভাবেই মজার ব্যস্ততায় ভরে থাকত। কতদিনের কত সুখস্মৃতি আছে এই মেলাকে ঘিরে। এর পরে কে কোথায় থাকবে তার ঠিক নেই, এবারের ফেটে তাই কিছুতেই মিস করা যাবে না।
ক্লাসের বন্ধুরা সবাই মিলে প্ল্যান করা হয়েছিল আজ আসার, অথচ এখনো কারোর দেখা নেই! কদ্দিন পরে স্কুলে আসছে সব, একটু আগে আগে আসতে কী হয়েছিল! ক্লাসরুমগুলো তালা দেওয়া না থাকলে ক্লাসে গিয়ে নিজের ডেস্কে একটু বসত। বন্ধ দরজার সামনে থেকেই ফিরে আসতে হল। জানালা দিয়ে দেওয়াল আলমারিটা দেখা যায়। নরম হয়ে আসা চোখে তাকিয়ে দেখল পাল্লার ওপর মলিন হয়ে আসা অনুর আঁকা বরফচূড়ার ছবি আর তার মিকিমাউসের স্টিকারটা এখনো রয়ে গেছে!
স্টলগুলোর দিকে এগোতে এগোতে ঝিমলির মনে হল, ভুল হয়ে গেছে, অনুর বাড়ি হয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো হত। একা একা এমন ভুতের মত ঘুরতে হত না। এখনো তো ওরা এই স্কুলেরই ছাত্রী, সবে মাসখানেক হল স্কুলে আসা বন্ধ হয়েছে, এর মধ্যেই নিজেকে কেমন বাইরের লোক মনে হচ্ছে, চারিদিকের এত ব্যস্ততা, এত আয়োজন, এসবে তাদের কোনো ভূমিকা নেই, ইস!
সামনে কাপুর টীচারের রিং টসের স্টল, ক্লাস নাইনের রিচা আর ইলেভেনের প্রিয়াংকা টেবিলের ওপর প্রাইজগুলো সাজাচ্ছে, টীচার রসিদের বই আর পয়সার বাক্স চেক করছেন। এই স্টলে শহরের দুষ্টু ছেলেরা ভিড় করে আসে। এক একজন সব এমন ওস্তাদ ছেলে আছে, যাদের লক্ষ্য থাকে তাড়াতাড়ি সব প্রাইজ শেষ করে, স্টল উঠিয়ে দেওয়ার দিকে। এমনিতে নিয়ম করা আছে যে একজন তিনবারের বেশী খেলতে পারবেনা, কিন্তু এরা দল বেঁধে আসে, মেয়েরা ও টীচার এদের সাথে পেরে ওঠেনা। সেজন্য প্রতিবার এখানে একজন স্যরকে রাখা হয়, এছাড়া সিকিউরিটি ভাইয়াদের কেউ একজন থাকে ভিড় সামলাতে।
ঝিমলি দেখল সিস্টার এলেন্স হনহন করে এদিকে আসছে, সঙ্গে কেমিস্ট্রি ল্যাবের প্রকাশ স্যর। ও ওখান থেকে দ্রুত সরে এল, সিস্টার দেখলেই আর ছাড়বে না, নির্ঘাত কোনো আজেবাজে কাজে লাগিয়ে দেবে। অনু আসছে কিনা দেখার জন্যে গেটের দিকে যেতে যেতে স্টলগুলোতে উঁকি দিতে থাকল। সবাই কাজে ব্যস্ত, কেউ ওকে তেমন খেয়াল করল না, দু একজন ছাড়া, তবে দুদন্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় নেই কারোরই। অভিমানে ঝিমলির ঠোঁট উলটে গেল, এর মধ্যেই স্কুল পর করে দিল তাদের!
অ্যাসেম্বলী হলের সামনের বাঁধানো স্টেজটার ওপর টেবিল চেয়ার, রেকর্ডপ্লেয়ার, মাইক, মাইক্রোফোন সাজিয়ে সুনিতা টিচার আর রেণু টিচার বসে আড্ডা মারছে। এবারে “ডেডিকেট আ সং” স্টলের দায়িত্বে ওরা দুজন। হাল্কা একটা মিউজিক বাজছে, মৃদু মধুর স্বরে। চিট আর পয়সা নেওয়ার দায়িত্বে ক্লাস এইটের চারু আর ক্লাস সেভেনের নাজনীন, দুজনে একটা র্যাকে রেকর্ড সাজিয়ে রাখছে। লোকের যাতে গান বেছে নিতে সুবিধে হয়, তাই হাতে লেখা গানের তালিকা টাঙ্গানো রয়েছে। ঝিমলির ওই তালিকাটাতে চোখ বোলাতে খুব ভালো লাগে, বেশীরভাগই রোমান্টিক গান থাকে, কয়েকদিন আগেই ভ্যালেন্টাইনস ডে গেছে, বাতাসে এখনো তার রেশ! তবে আজ গান দেখতে যাওয়া চলবে না, রেণু টিচার বসে আছে। ওদের ক্লাসের সঙ্গে এই টিচারের আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক, ওকে দেখলে কী বলে বসবে তার ঠিক নেই!
রেণু টিচার এই স্কুলের ছাত্রী নয়, ক্যানালের ওপারের হিন্দি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। সেইজন্যে কিনা কে জানে ওদের স্কুলের মেয়েদের, বিশেষ করে বড় ক্লাসের মেয়েদের ওপর তার খুব রাগ। নাইনে ঝিমলিদের অঙ্ক করাতে এসেছিল, কেরলকার টিচার ছুটিতে যাওয়ায়। কারণে অকারণে শাস্তি দিত, বাঁকা বাঁকা কথা শোনাতো খালি। “এই স্কুলের মেয়েরা খুব পাকা, একটু ইংরেজী বলতে পারে বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে” ইত্যাদি বলে। ওরাও বিরক্ত হয়ে শেষে টিচারকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে শুরু করল। টিচার শ্যাম্পু করে চুল খুলে, দুহাতে নখ পালিশ লাগিয়ে ক্লাসে এসেছে, ওরা পিছন থেকে গান ধরল “শায়দ মেরী শাদি কা খ্যাল............”। শুনে এত রেগে গিয়েছিল যে কোনো কিছু না দেখে সঙ্গে সঙ্গে পিছনের রো ধরে সবাইকে বাইরে । বাইরে বার করে দিলে ওদের অবশ্য ভালোই লাগত, এমন কিছু আহামরি পড়াতো না যে ক্লাস না করলে ক্ষতি হয়ে যাবে!
রেণু টিচার ইংরেজী বলে একদম হিন্দির আক্ষরিক অনুবাদ করে। একবার ক্লাস টেস্টে সবাইকে ফেল করাতে, ওরা পরদিন ক্লাস শুরুর আগে ব্ল্যাকবোর্ড জুড়ে রেণু টিচার আর তার হবু বরের কারটুন বানিয়ে, লিখল, “আফটার রিডিং মাই লাভ লেটার, ইউ ডোন্ট গেট অ্যাংগ্রি, বিকজ ইউ আর মাই লাইফ, বিকজ ইউ আর মাই লাইফ”। “মেরা প্রেম পত্র পড়কে, তুম নারাজ না হো না” র সে যা ভয়ংকর অনুবাদ করেছিল, বন্দনা, ঝিমলি এরা মিলে। তারপর সারা স্কুলে ছড়িয়ে পড়ল সে গান, নীচু ক্লাসের বাচ্চারা কিছু না বুঝে মজা পেয়ে গাইতে লাগল, সে এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার! টিচার ভয়ানক রেগেমেগে ক্লাস নাইনের সবাইকে প্রিন্সি কল করালো। সিস্টার এমিলি নিজের ঘরে ডেকে ওদের খুব বকেছিল । বকুনি টকুনি দিয়ে, রেণু টিচারকে শান্ত করে ক্লাস নিতে পাঠিয়ে, শেষে মিটি মিটি হেসে বলে,
“এত বাজে ইংরেজী অনুবাদ? একবছর পরে বোর্ড দেবে না তোমরা? কাল থেকে আমি ছুটির পরে গ্রামারের স্পেশ্যাল ক্লাস নেব।"
সেই শুনে ঝিমলিদের মাথায় বাজ, তখন দীপা মরিয়া হয়ে বলে কিনা, “ওটা আসলে আমরা রেণু টিচারের হয়ে অনুবাদ করেছি, ওনার মতো করে।" সবাই ইশারা করে, পিছন থেকে চুল টেনে, কোনোরকমে থামায় দীপাকে!
প্রচুর কাকুতিমিনতি, অনুরোধ সত্বেও সিস্টার শাসিয়ে রাখল, একটু সময় করতে পারলেই গ্রামারের স্পেশ্যাল ক্লাস শুরু করবেন, তবে শেষ অবধি সে যাত্রা আর ক্লাস করতে হয়নি। ক্লাস টেনে অংকের জন্যে আবার কেরলকার টিচার ফিরে এলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল!
ফেটের দায়িত্বে থাকে সিস্টার এলেন্স। সিস্টার বড় মেয়েদের গানের স্টলে রাখে না। এমনিতে এই স্টল ফেটের অন্যতম লাভজনক স্টল, খাবার স্টলের পরেই, এখানেও শহরের ছেলেদের বেজায় ভিড় হয়।। স্টলটা অনেকটা অনুরোধের আসরের মত। পয়সা দিয়ে চিটে গান, কার জন্য এবং কে ডেডিকেট করছে, মেসেজ সহ লিখে দিলে, মাইকে মেসেজ ও নামধাম পড়ে নির্দিষ্ট গানটি বাজানো হয়। তবে বেশীরভাগই নামহীন মেসেজ আসে, বিশেষ করে মেয়েদের জন্যে হলে। এ হল বিফল বা আশাবাদী প্রেমিকপ্রবরদের নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করার ধরণ, সাহস করে নাম লিখতে পারে না বেচারারা। বড় ক্লাসের মেয়েরা তাই নিজেদের স্টলের ব্যস্ততার মাঝেও কান খাড়া রাখে, কার জন্যে গান বাজছে অথবা কার জন্যে কতগুলো গান বাজল!
এই সংখ্যা দিয়ে বছরে জনপ্রিয়তার নিরিখে কে এগিয়ে রইল সে নিয়ে কিছুদিন স্কুলের আড্ডাঘর সরগরম থাকে। দু একটা নতুন গল্পকথার শুরুও হতে দেখা গেছে গানে গানে। কিছু অসমসাহসী অবশ্য থাকে যারা প্রকাশ্যে নামধামসহ গানের মাধ্যমে নিজেদের মনের কথা জানায়, তবে তারা ওই নাদিমের মতো হাতে গোণা কয়েকজন । এদের নিয়ে খুব একটা কেউ মাথা ঘামায় না, বাকী কিছু স্বীকৃত অফিশিয়াল জুটির কেউ থাকে, যাদের নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকেনা। এছাড়া অন্যরাও গানের খেলায় অংশ নেয়, অভিভাবকরা, মেয়েরা নিজেদের মধ্যেও গান ডেডিকেট করে থাকে। বিশেষ করে বেলাশেষে, দর পড়তির দিকে গেলে, স্টলের লোকজন যখন ডাকাডাকি করতে থাকে, তখন এই স্কুলের ছাত্রীরা নিজেদের পছন্দের গান বন্ধুদের, টীচারদের ডেডিকেট করতে জড় হয়। সেরকম ধরণের গান শুরু হলেই মেয়েরা বোঝে এবছরের মত এ খেলা শেষ, এবার কার ভাগে কী পড়ল, হিসেব নিকেশের পালা শুরু!
রেণু টিচারকে দেখেই ঝিমলির মনে হল, “প্রেমপত্র পড়কে” গানটা লিস্টে আছে কিনা কে জানে, আর মনে হতেই হাসি পেয়ে গেল! আহা, তাদের সেই নানা রঙের দিনগুলি, টিচারকে রাগিয়ে যা মজা হত!
সুনিতা টিচার আবার এদের সিনিয়র, এই স্কুলেরই ছাত্রী, সুনিতাদিদি বলেই ডেকে এসেছে তাকে এরা চিরকাল, তার সাথে ঝিমলিদের সবার খুব ভাব । সুনিতা টিচার দেখে ফেললে ডাকবে, অনেকদিন দেখা হয়না, তখন যেতেই হবে। ঝিমলি মাথা নীচু করে চুপিচুপি, স্টলের পিছন দিকে, গোলাপ বাগানের ধার দিয়ে, পেরিয়ে গেল জায়গাটা।
এই স্কুলের বড় ক্লাসের বেশীরভাগ মেয়েরই স্বপ্ন থাকে যে কোনো একদিন কেউ একজন তার জন্যে গান ডেডিকেট করবে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে অনামী গোলাপ পাওয়া আর ফেটে তে অজানা গান পাওয়া,দুইই এই শহরের উঠতি বয়সী মেয়েদের উইশ লিস্ট বলা যায়। ক্লাস এইট নাইন থেকে মেয়েরা সেই আশায় যে স্টলেই থাকুক না কেন, কান খাড়া করে গান শোনে। ঝিমলিরাও এতদিন শুনে এসেছে, যদি কখনো একটা গান তাদের কারো জন্যে হয়। স্কুলজীবন শেষ প্রায়, আজ অবধি এত বছরে তার বা অনুর, দুজনের মধ্যে একজনের ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়ল না! সে কথা মনে হতে মুখের হাসি মুছে মন উদাস হয়ে গেল, হায়!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে গানের স্টলটা পেরিয়েছে, দূর থেকে দেখল অনু গেট দিয়ে ঢুকছে। লাফিয়ে সেদিকে যেতে যাবে, মূর্তিমান বাধার মত সেলাইয়ের স্টলের প্রীতি টিচার পথ আটকালো। এই টিচারের প্রতি আবার ঝিমলির একটু দুর্বলতা আছে, এড়িয়ে পালাতে পারল না। অনুকে হাতের ইশারায় সেদিকে আসতে বলে, কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে গেল।
ক্লাস এইটে ওদের এসইউপিডাব্লিউ তে সেলাই করিয়েছিল প্রীতি টীচার, কিসের একটা ঢাকনা। সেখানে টিচারই আবিস্কার করে ঝিমলির হাতে সুতোর নকশা খুব ভালো ওঠে, একবার দেখিয়ে দিলেই যে কোনো সেলাই সে শিখে নেয়। সেই থেকেই টিচার ঝিমলিকে একটু বেশী মনোযোগ দিতে শুরু করে। এর পরে ক্লাসের সিলেবাসে আর সেলাই ছিলনা যদিও, কিন্তু প্রতি ফেটেতে বিক্রি করার জন্যে প্রীতি টিচার ওকে কিছু না কিছু বানাতে দিত, টেবল ম্যাট, ডাচেস সেট, এরকম ছোটখাটো জিনিস। ফেটের স্টল থেকে যা লাভ হয় পুরোটাই স্কুলের বিভিন্ন চ্যারিটিতে যায় বলে, মাও এ ব্যাপারে বারণ না করে বরং উৎসাহ দিত।
“আজেবাজে কত কিছুতেই তো সময় নষ্ট করিস, এটা অন্তত একটা ভালো কাজ, করে দে না”।
ঝিমলি যদিও খুব একটা পছন্দ করেনা, সেলাইয়ের ধৈর্য ওর নেই, তবে চটপট হয়ে যায় বলে, ছোট জিনিস তৈরি করে দিত। সেই থেকে দেখা গেল ফাঁকিবাজির জন্যে বকাবকি করলেও, কেন জানি ঝিমলি টিচারের বেশ প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছিল। এবারে বারো ক্লাস বলেই বোধহয় প্রথমে টিচার ওকে ফেটের জন্যে সেলাই দেয়নি। অন্যসময় বলে বলে সারা হয়, ঝিমলি গড়িমসি করে, ফাঁকি মারে। এবারে উলটে টিচার ডাকছে না বলে ওর এত মন খারাপ হল, যে শেষে নিজেই যেচে গিয়ে সেলাই নিয়ে এল। একটা ডাচেস সেট, লাল কাপড়ের জমিতে গোলাপি আর সবুজ রেশমী সুতোয় বোনা গোলাপের ঝাড়।
সামনের টেবিলের ওপর যত্ন করে সাজানো আছে ওর সেলাইটা। টিচার খাতায় জিনিসের নাম ও দাম লিখতে লিখতে মুখ তুলে বলল,
“তুই একটু এই স্টলে থাকবি, আমাকে উদ্বোধনের সময় গেটে যেতে হবে, দুটো বাচ্চা মেয়ে, এরা নজর রাখতে পারবেনা। কত ধরণের লোক ঘোরে আজ, কেউ এসে কিছু তুলে নিয়ে চলে যেতে পারে।"
ওদের কথার মাঝে অনু এসে পড়েছে। ঝিমলি ইতস্তত করছে দেখে, অনু ওর স্বভাবমত তরতর করে বলে ওঠে, “না টিচার, আমরা এখন ঘুরব, এটা আমাদের শেষ বছর। এতকাল প্রত্যেক বছর তো স্টলে থাকতে হত বলে মেলা দেখাই হতনা ঠিকমত, সব খাবার ফুরিয়ে যেত। এবারে আর আমরা স্টলে বসব না।"
প্রীতি টিচার অনুকে পাত্তাই দিলনা, “এই, বেশী কথা বললে পুরো সময় বসিয়ে রাখব স্টলে, সিস্টার এলেন্সকে বলে। একটু থাকতে বলছি, থাক এখানে, পালাবি না একদম।"
বলে চোখে মজার ভঙ্গী করে দুজনকে বলল, “এখুনি গান শুরু হয়ে যাবে, পাশের স্টলে। এখান থেকে ভালো শুনতে আর দেখতেও পাবি।"
অনু ফিক করে হেসে ফেলল, ঝিমলি যেন বুঝতে পারেনি এমন ভান করে ডাচেস সেটটা ছুঁয়ে বলল, “টিচার, এটা মা কিনবে বলেছে। আমার সেলাই করা কিছু বাড়িতে নেই তো তাই, এটা রেখে দিও মায়ের জন্যে।"
প্রীতি টিচার স্টল থেকে বেরিয়ে গেটে যেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্যে এক এক করে সবাই জড় হচ্ছে, সেদিকে যেতে যেতে বলল, “না, ওটা আমি কিনব। তুই পরীক্ষা হয়ে গেলে তোর মাকে আর একটা বানিয়ে দিবি।"
টিচারের হাসিটা এত আদর জড়ানো লাগল যে ঝিমলির প্রায় কান্না চোখ! ইস, এইসব আদর প্রশ্রয়, এত এত ভালোবাসার সবকিছু ছেড়ে কোথায় যাবে তারা, কেন যে সময় থেমে থাকেনা!
দু একজন করে তাদের ক্লাসের মেয়েরা ঢুকছে এবার। দীপা এসে অনুকে ধরল, সবাই মিলে স্কুলকে ডেডিকেট করে একটা গান দেওয়া হবে। সুনিতা টিচার অনুর পড়শি, তাছাড়া ওর মিলস এন্ড বুনস সার্কুলেশন ক্লাবের মেম্বার। অনু বললে কিছু ছাড় দিতে পারে। ওরা হই হই করে গানের স্টলের দিকে গেল, রেকর্ড দেখে গান পছন্দ করবে। ঝিমলি রইল বসে, সেলাইয়ের স্টল আগলে। চিফ গেস্ট আসেনি এখনো, সবাই গেটের সামনে জটলা করছে, উদ্বোধন হয়নি বলে মেন গেট সবার জন্যে খোলা হয়নি। শুধু পাশের ছোট দরজাটা খোলা, সেখান দিয়ে একজন দুজন করে ঢুকছে।
গানের স্টল থেকে ওরা সবাই আবার এদিকে সেলাইয়ের স্টলে এসে ঢুকল, খুশীতে উজ্জ্বল মুখ সব। ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে অনু জানালো যে টিচাররা ওদের গান বিনা পয়সায় বাজাবে বলেছে। এখন বন্দনা, সুনিতা টিচারের সাথে বসে মেসেজ লিখছে। উদ্বোধন শেষ হয়ে, সিস্টার এমিলি, যখন অতিথিদের নিয়ে স্টলের দিকে আসবে তখন প্রথম গানটাই ওদের গান বাজবে।
“কী গান দিলি রে?”
দীপা জানালো তেমন কোনো মানানসই গানের রেকর্ড না পেয়ে শেষমেশ সিস্টার এমিলির পছন্দের গান, “মর্নিং হ্যাজ ব্রোকেন......” গানটা দিয়ে এসেছে। ঝিমলির মনে পড়ে গেল সিস্টার এমিলির ঘরে এই গানটা প্রথম শোনার কথা। উনি তখন সদ্য আফ্রিকা থেকে এসেছেন এই স্কুলে, সিস্টার রোজালিন এর জায়গায়। ওনার পাশের ঘরটাই মিউজিক রুম, ওদের তখন ক্লাস সেভেন। মিউজিক ক্লাস, এদিকে বর্ধন স্যর আসেননি সেদিন। বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই, ওরা মিউজিক রুমে বসেই হল্লা করছিল, নতুন প্রিন্সি এসে ঢুকলেন, সবাই ভয়ে চুপ। মনেই ছিলনা যে রোজালিন সিস্টারের বদলি নতুনজন এসে গেছে, হট্টগোল টা একটু জোরেই হয়ে গেছিল। প্রথম দিন, সিস্টার বকলেন তো নাই, উলটে সবাইকে নিজের ঘরে ডাকলেন। ওরা সবাই লালচে মেঝেতে শতরঞ্চির ওপর বসে, সিস্টার সোফায়। রেকর্ড চালিয়ে দিলেন, ওনার খুব প্রিয় গান, আফ্রিকায় ওনার এক ছাত্র, আসার সময় রেকর্ডটা উপহার দিয়েছিল। গানের কথাগুলো সবাইকে লিখে নিতে বলে, দু তিনবার নিজে গেয়ে সুরটা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, মানে চল্লিশ মিনিটের ক্লাসে যতটা হয় আর কী!
গেটে হাততালির শব্দ, প্রধান অতিথি ও আরো অনেকে ঢুকল, বাচ্চা মেয়েরা টীকা ইত্যাদি পরিয়ে বরণ করল। এই স্টল থেকে গেটটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, ওরা সবাই দেখল অনুষ্ঠান শেষে সিস্টার এমিলি ও অন্যান্য টিচার আর সিস্টারেরা অতিথিদের নিয়ে এদিকে আসছে। বন্দনাকে সুনিতা টিচার ইশারা করতে সে মাইকে মেসেজ পড়তে শুরু করল,
“ট্যু অল আওয়ার টিচারস, সিস্টারস, স্টাফস, আমাদের বন্ধু জুনিয়র সিনিয়রদের সবাইকে ক্লাস অফ ......... এর সবার পক্ষ থেকে এই গান। মূল্যবান এই সম্পর্কের মেয়াদকাল, বারো বছরের বিগত প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণীয় করে তোলার জন্যে, ভালোবেসে, সব সময় পাশে থেকে, এই যাত্রাপথ আদরে বকুনিতে মায়াময় করে তোলার জন্য, জীবনের আগামী দিনগুলো যাতে আমরা সঠিক ভাবে, সঠিক পথে চলতে পারি............স্কুল ফরএভার উই উইল চিয়ার”।
তাড়াতাড়িতেও বেশ গুছিয়ে লিখেছে বন্দনা, শুনতে শুনতে কেমন একটা মৃদু তোলপাড় উঠল চারিদিকে। অবশ্য বাইরের লোকেরা তেমন বুঝতে পারলনা, কিন্তু স্কুলের সবাইয়ের বিশেষ করে বড়দের হাবভাবে মায়াবী ছোঁয়া, হাসিকান্না চোখমুখ। টিচাররা, সিস্টাররা, স্যরেরা, কেউ খুশীতে হেসে কেউ বা আবার একটু উদাস চোখে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। গান শুরু হল,
“মর্নিং হ্যাজ ব্রোকেন লাইক দ্য ফার্স্ট মর্নিং, ব্ল্যাক বার্ড হ্যাজ স্পোকেন লাইক দ্য ফার্স্ট বার্ড............”।
সিস্টার এমিলি স্টেজে উঠে বন্দনাকে জড়িয়ে ধরল। গত বছরই বন্দনা সিস্টারের কাছে বকুনি খেয়েছিল প্রচন্ড, একটাও স্পেশ্যাল ক্লাস করেনি বলে। ও ওর বাবার কাছে পড়ে, এনট্রান্সের প্রস্তুতির জেরে ইলেভেন ট্যুয়েলভে স্কুলের স্পেশ্যাল ক্লাস করেইনি প্রায়। টিচাররা এবার নিজেদের মধ্যে হাসছে, ঘাড় নেড়ে কী সব বলাবলি করছে। প্রীতি টিচার এসে ঝিমলির হাতটা ধরল, চোখে জল। সিস্টার এলেন্সের বদরাগী খিটখিটে মুখোশটা সরে গিয়ে, হাসি হাসি মুখ, ওদের দলটার দিকে দু হাত নেড়ে, “গড ব্লেস, গড ব্লেস” বলতে বলতে এগিয়ে গেল।
গান শেষ হওয়ার পরেও কিছুক্ষণ ওরা অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, চুপচাপ। সবার মন ভরে আছে মন খারাপে, দু চোখে বর্ষার মেঘ, একটা টোকা দিলেই যেন ঝরে পড়বে। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কেটে গেল, তারপর বাইরের লোকজন স্টলে আসতে শুরু করছে দেখে ওরা আস্তে আস্তে সেখান থেকে বেরিয়ে এল। এসবের মাঝে একটা জিনিস ভালো হল, প্রীতি টিচার ঝিমলিকে ধরে তার স্টলে বসাতে ভুলে গেল।
খানিকক্ষণ দলবেঁধে ঘোরাঘুরি করল এ স্টল ও স্টল, সত্যি এভাবে বোধহয় কখনো স্কুলের ফেটেতে ঘোরার সুযোগ হয়নি, অন্তত বড় ক্লাসে ওঠা ইস্তক! তার মাঝে মজা করে গানগুলো শুনতে লাগল, নানাবিধ মন্তব্য আর হাসির হররা ছুটল দলে। নাইনের রিচার জন্যে দুখানা গান হয়ে গেল, রিচা আর্মির মেয়ে, প্রচন্ড স্টাইলিশ এবং পপুলার। ওদের ক্লাসের মধ্যে একমাত্র বন্দনার নামে একটা শোনা গেল, কোচিং ক্লাসের ছেলে বন্ধুদের তরফে জন্মদিনের উইশ। বারো ক্লাসের গানের বাজার বেশ মন্দা দেখা গেল, দুঃখে হইহই করে সবেধন নীলমণি বন্দনার ঘাড় ভেঙ্গে তাই আইসক্রিম খাওয়া হল, গানের ট্রিট আর জন্মদিনেরও বটে!
কিছুক্ষণ দলে ঘোরার পরে ঝিমলি আর অনু আলাদা হয়ে বেরোলো মায়ের খোঁজে, টাকা লাগবে, সঙ্গে বেশী টাকা নেই ওর। । মাকে পেয়ে গেল প্রীতি টিচারের স্টলে, তর্কে মশগুল। মা ডাচেস সেটটা কিনবেই, টিচারও দেবেনা, হাসি মুখে বাদানুবাদ চলছে। ওকে দেখতে পেয়ে মা চেঁচিয়ে উঠল,
“প্রীতি, তোমার কী মনে হয়, স্কুল শেষ হয়ে গেলে, তোমার তাড়া ছাড়া এই মেয়ে আর কোনোদিন সেলাই নিয়ে বসবে? অন্তত আমি বললে তো বসবেই না। এটা আমিই রাখব, পাত্রপক্ষ এলে দেখাতে হবে না, মেয়ে সেলাই জানে!”
মা মজা করছে, মুড ভালো। ঝিমলির এই তর্কে কে জেতে দেখার সাধ নেই, ও এই সুযোগে মায়ের পার্স থেকে টাকা বার করে নিয়ে ওখান থেকে সরে পড়ল। কুলফি খেতে খেতে ওরা দুজনে রিং টসের স্টলে এল, ছেলেদের ভিড় প্রকাশ স্যর সামলাতে পারছে না। একে রিং, তায় রিচা, দুয়ে মিলে এ স্টল একেবারে হটকেক!
কাপুর টিচারের জোরালো গলার, “ইন আ লাইন প্লিজ, দিস সাইড” চাপা পড়ে যাচ্ছে, ভিড়ের আওয়াজে। ওরা উঁকি মেরে দেখল প্রায় অর্ধেক টেবিল এর মধ্যেই শেষ। রিচা অনুর মিলস এন্ড বুনস সারকুলেশন ক্লাবের সক্রিয় সদস্য, ও নিজে অনেক বই কেনে বলে, অনু ওকে খুব খাতির করে চলে, ইশারায় ভেতরে ডাকল ওদের দুজনকে। অনু হাত দেখিয়ে পরে আসছে বলে সরে এল।
“কে ঢুকবে এখন ওই মারামারির ভেতর। তার চেয়ে চল চাট কিনে সীসম গাছের নীচের বেদীতে বসে খাই, মাঠে বড্ড ভিড়।"
এই স্কুলের ফেটেতে সারা শহরের লোক ভিড় করে আসে, ওরা এতদিন স্টলের মধ্যে ব্যস্ত থাকত বলে আগে টের পায়নি কখনো।
চাটের স্টলে তানেজা টিচার ছিল, দুজনকে ধরে ক্যাশে বসিয়ে দিল।
“আমায় একটু বেরোতে হবে, কিছুক্ষণ তোরা সামলা। “ক্লাস নাইনের মিঠু চাটের দায়িত্বে, অনু মিঠুকে বলল ওদের দুজনের জন্য আলাদা করে রাখতে, টিচার ফিরে এলে নেবে। রেখা আন্টী, অনুর মা, এল স্টলে। ভালোই হল, চাটের পয়সা আর ওদের দিতে হলনা। তানেজা টিচার ফিরল বেশ দেরীতে, মওকা পেয়ে একটু ঘুরে, এ স্টল ও স্টল আড্ডা মেরে এল বোধহয়। এইসবের মাঝেই ঝিমলি গান থেকে কান সরায় নি, এইটের মন্নুর বাবা, চন্দ্রা আঙ্কল, ওর মা সুহাস আন্টির জন্য একটা কী মিষ্টি হিন্দি গান বাজালো, ওদের বিবাহবার্ষিকী আজ, তাই, মেসেজটাও খুব সুন্দর।
মিঠুর কাছ থেকে চাটের প্লেট নিয়ে দুজনে সীসম গাছের তলার বাঁধানো চত্বরটায় বসে গল্প করতে করতে খেতে থাকল। মিঠু মেয়েটা খুব ভালো, স্পেশ্যাল চাট বানিয়ে দিয়েছে, বেশী করে চাটনি দিয়ে। ইতিমধ্যে গানে ওদের ক্লাসের দ্বিতীয় হিট, দিব্যার জন্যে গান ডেডিকেট করেছে অনুপ, এগজামের জন্য বেস্ট উইশেস।
“অনুপটা কীরকম ধুরন্ধর দেখেছিস, জানে এগজামের নামে কেউ কিছু মনে করবে না। এদিকে গানটা দ্যাখ, লাভ সং।"
অনু মুখ বাঁকিয়ে মন্তব্য করল। ও একদম পছন্দ করেনা অনুপকে, দিব্যার পেছনে পড়ে থাকে সবসময়। রোহিতের আবার দিব্যার জন্য একটু ব্যথা আছে, অনুর রাগ সেজন্যে। দিব্যা অবশ্য দুজনের কাউকেই বিশেষ পাত্তা দেয় না । ও ছোটবেলায় বিদেশে থাকত, কতদিনে আবার বিদেশে ফিরে যাবে সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে সারাক্ষণ।
অনেকেই এসে এ জায়গাটায় একটু বসে, বিশ্রাম নিয়ে, আবার ঘুরতে যাচ্ছে, তাতে এদের নানা জনের সঙ্গে দেখা ও হাল্কা আড্ডা মারা হয়ে যাচ্ছে। রোহিত এল দলবল নিয়ে, দুজনের প্লেট থেকে এক এক চামচ খেয়ে, দুটো মাথায় গাঁট্টা মেরে চলে গেল। অনু কোথাও এক জায়গায় স্থির হয়ে বসেনা বেশীক্ষণ, ছটপট করে, একটু পরেই তাড়া দিল, ওঠ, ওঠ, খেয়ে শেষ কর তাড়াতাড়ি। ঝিমলির আবার খেতে সময় লাগে, বাড়িতে মা তাই ওকে সবার আগে খেতে বসায়, যাতে শেষটা সবার সাথে হয়। কোনোরকমে চাট শেষ করে সামনে রাখা ডাস্টবিনে প্লেটদুটো ফেলতে যাবে, সেখানেই থেমে গেল।
“ট্যু দ্য ক্রেজিয়েস্ট ওয়ান ইন আ মিলিয়ন”, সুনিতাদিদি মেসেজ পড়ছে, আর তার সঙ্গে রেকর্ডে বেজে উঠল,
“ওহ বাট লাভ গ্রোজ, হোয়ার মাই রোজমেরী গোজ, নোবডি নোজ, লাইক মি”।
কী আশ্চর্য, এই গানের রেকর্ড আছে? কিন্তু এর আগে এখানে কখনো ও শোনেনি কেন এই গান? আর আজই বা কেন বেজে উঠল এ গান, যে গানে আজকাল ওরা বুঁদ হয়ে আছে দিনরাত!
কিছুদিন আগে রোহিত কার থেকে যেন এই রেকর্ড করা ক্যাসেটটা এনেছিল, বাছা বাছা পুরনো গানের কালেকশন। বেশ কয়েকটা ভালো ভালো গান ছিল তাতে, কিন্তু এই গানটা কেমন যেন ওর শরীর মনে বাসা বেঁধে ফেলে। দিনরাত হয় গান শুনছে নয় গুনগুন গাইছে। ওর ভালো লাগা ছড়িয়ে যায় অনুর মনেও। দুজনেরই এখন সবথেকে পছন্দের গান এই গান। এই তো আগের সপ্তাহেই রোহিত ক্যাসেট ফেরত চাইলে, ও বাজারে সুদেশ ভাইয়ার দোকানে গিয়ে ক্যাসেটটার দুটো কপি করিয়ে নিল, যাতে রোজ শোনা বন্ধ না হয়। আজ সকালেও বাড়িতে এ গান চলেছে!
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরোটা শুনে অনুর কাছে ফিরতে ফিরতে ভাবল, এত বছরে একবারও তাদের জন্যে কেউ কোনো গান তো দিলই না, আবার এই শেষ বেলায় ওদেরই পছন্দের গান অন্য একজনের জন্যে বাজল, কী জালিম দুনিয়া, এতই কী হেলাফেলার তারা!
অনুও নিশ্চয়ই গানটা শুনেছে। কথাটা অনুকে বলতে যাবে, দ্যাখে ক্লাস ইলেভেনের কয়েকটা মেয়ে ওকে ঘিরে কলকল করছে, আর বলা হল না।
যাক, আলোচনার অনেক সময় পাওয়া যাবে পরে, কারণ আজ বৃহস্পতিবার। এমনিতেও এদিন তার অনুর বাড়িতে পড়তে আসার দিন। আর আজকে তো মায়ের পারমিশন নেওয়া আছে, ফেটের পরে অনুর বাড়িতেই থাকবে রাতে।
মেলায় ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে বার বার গানটার কথাই মনে হয়। যতক্ষণ না অনুর সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে পারছে, ততোক্ষণ শান্তি হচ্ছে না। এদিকে অনুকে দেখে তো বিনদাস মনে হচ্ছে, হ্যা হ্যা গল্প সমানে চালিয়ে যাচ্ছে। ঝিমলির মনে একটা আলগা সন্দেহ খেলতে থাকে। গানটা তবে কি অনুর জন্যে ছিল? অনু কি সেটা জানে?
সন্দেহের কারণ হিসেবে ইদানীং অনুর জীবনে একটি উৎপাত হাজির হয়েছে। রাঘব, রোহিতের ক্লাসমেট, তার নাকি অনুকে খুব মনে ধরেছে। অনু এদিকে রাঘবের নাম শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। নাহার পাড়ের বাজারে ওর বাবার শাড়ির দোকান আছে। মাঝে মাঝে আবার পান খায়। জন্মদিনে রোহিতের আর এক বন্ধু সুখির হাত দিয়ে হিন্দি গানের ক্যাসেট আর গান্ধীজীর বই পাঠিয়েছিল। বেচারা, অনু রেগেমেগে প্যাকেটও খোলেনি, সুখির হাতেই পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়েছে। রোহিতও এ ব্যাপারে বেশী মাথা ঘামায়নি, কারণ জানে রাঘবের মত ছেলেকে অনু কোনোদিন পাত্তাই দেবেনা। বরং ঝিমলির সাথে জোট বেঁধে মাঝে মাঝে সেও অনুকে রাগায় এ নিয়ে, মিলস এন্ড বুনসের হিরোরা যার আইডল, তার কপালে কিনা শেষে “পান খায়ে সৈঁয়া হামার”!
কিন্তু রাঘব অনুকে এমন গান ডেডিকেট করবে, সেও কি সম্ভব? ধ্যত, কী যে ভাবছে, রাঘব তো ইংরেজীও হিন্দীতে বলে, অমন মেসেজ লেখা ওর কম্ম নয়!
তবে অন্য কেউও তো হতে পারে। রোহিতের জন্য অনুদের বাড়িতে শহরের প্রায় সব ছেলেদেরই আসা যাওয়া। তাদের মধ্যে কেউ? কিন্ত এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, জানলে অনু তাকে বলবে না? আড়চোখে বন্ধুর মুখটা দেখে নেয় একবার, গল্পে মশগুল, মুখ বেশ হাসি হাসি তবে সেটা রাজ্যের লোক নিয়ে গসিপে, না গানের কারণে, বোঝা দায়। ঝিমলিই বরং সাতপাঁচ ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করছে, ভালো করে মজা করতে পারছেনা।
নিজের মনেই প্রতিজ্ঞা করে নিল, আপাতত এ নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না, পরে দেখা যাবে। আড্ডায়, গল্পে, স্টলে ঘুরে খেতে খেতে, কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেল। অনুর দাদাজী দুজনকে দেখতে পেয়ে দুটো আইসক্রিম কিনে দিল। ক্লাস ফোর আর ফাইভের ব্যানারজী টিচার আর গোস্বামী টিচার দুজনে মালপোয়া আর জিলিপির স্টল দিয়েছে, দারুন খেতে। অন্যবারে মেলা শেষে ছুটি পেত যখন, খাবারের স্টলে কিছুই বাঁচতনা, এবারে এতকালের সমস্ত না পাওয়া সুদে আসলে উসুল করে নিচ্ছে।
মেলা প্রায় শেষের দিকে, গানের স্টল বন্ধ করে সেখানে হাউজি শুরু হয়েছে। একতলার ক্লাসরুমগুলো থেকে চেয়ার বার করে পেতে দিয়েছে সিকিউরিটি ভাইয়ারা। সবাই ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসে গল্প করতে করতে হাউজি খেলছে। এমনিতে ও আর অনু হাউজি তেমন পছন্দ করেনা, আন্টিদের কিটির খেলা। তবে আজ ওর ফেরার তাড়া নেই, অনুর বাড়ি স্কুলের কাছেই। হাউজির ওখানে ক্লাসের সবাই আবার জড়ো হয়েছে মেলা ভাঙার বেলায়। পিছনের রো তে খালি চেয়ারগুলোতে বসে গল্প চলতে থাকল। রেণু টিচার হাউজি খেলাচ্ছে, সুনিতা টিচার স্টেজ ছেড়ে এসে ওদের আগের রোয়ে বসেছে, হাতে দুটো হাউজির টিকেট । টিচারকে একা দেখে ঝিমলির মাথায় গানের পোকাটা আবার নাড়া দিল। ও উঠে গিয়ে গুটিগুটি টিচারের পাশে বসল। খেলা জমে উঠেছে, ওকে দেখে সুনিতা টিচার ওর হাতে একটা টিকেট ধরিয়ে দিল। ঝিমলির জন্মেও হাউজি লাগেনা আর আজ শুরুতেই প্রথম রো মিলে গেল। টিচার খুশীতে লাফিয়ে উঠল, তারই টিকেট তো। এই সুযোগে ও আস্তে করে কথাটা তুলল, “ও টিচার, ওই গানটা শুনেছিলে, সুন্দর না? তুমিই তো মেসেজটা পড়ছিলে, তোমার মনে আছে, কে ওটা দিয়েছিল?” সুনিতা টিচার প্রথমে টিকিট থেকে মুখ না তুলেই বলল, “না, সারাদিন কত গান বাজল, কে দিল না দিল, ভিড়ের মাঝে অত খেয়াল করিনি।"
তারপর কী খেয়াল হতে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে “এই, কোন গান, কী মেসেজ, তুই এতসব জিজ্ঞেস করছিস কেন রে? কী হবে জেনে, তোর নাম ছিল নাকি মেসেজে?”
ঝিমলি আমতা আমতা করে, “না, আমার নাম থাকবে কেন? মানে, গানটা খুব ভালো ছিল, আগে শুনিনি, তাই জানতে চাইছিলুম আর কী, এমনিই।"
“হ্যাঁ, সেই, তুই তো ভালো মেয়ে বলেই জানি, আবার ওসব গান টানের চক্করে তুই কেন? সামনে পরীক্ষা না? ভালো করে পড়, তোর থেকে আমরা ভালো রেজাল্ট আশা করি।"
ঝিমলি মুখ গোমড়া করে সরে এল ওখান থেকে। সব শেয়ালের এক রা। খুব মজা লাগে, না, বারো ক্লাস দেখলেই ফ্রিতে পরীক্ষা নিয়ে জ্ঞান দিয়ে দেওয়া যায়? নিজে তো এই সেদিন পর্যন্ত স্কুলে মস্তি করেছে, মহা ফাঁকিবাজ ছিল, সবাই জানত। এখনই বা কী করে, টাইনি টটের টিচার, পড়ানোর কোনো চাপ নেই, বিয়ের দেখাশুনা চলছে, ঠিক হলেই চাকরি ছেড়ে দেবে। রেণু টিচারেরও বিয়ের কথা চলছে, অনেককাল, তাই দুজনের খুব ভাব ইদানীং। পড়াশোনা করে কী হাতিঘোড়া হয়েছে, সেই তো বিয়ে করে সংসার করবে!
হাউজি শেষ হয়ে স্কুল থেকে বেরোতে বেরোতে সাতটা বেজে গেল। এর মধ্যে আবার মা এসে বাড়ি ফিরে যেতে বলছিল, “এত গল্প আড্ডা হয়েছে, আজ আর থাকতে হবে না। সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে পড়াশোনা তো ছাই হবে, একটু পরেই ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়বি, তার চেয়ে বাড়ি চল, পরে কখনো রাতে থাকবি অনুর কাছে।"
ভাগ্যিস রেখা আন্টিও সেখানেই ছিল সেইসময়। মার কথা একেবারে নস্যাৎ করে দিল, “আমি ছোলে বানিয়েছি, ভটুরের আটা মেখে এসেছি, ঝুম বেটি ভালোবাসে বলে। অনেকদিন বাদে রাতে থাকবে বলেছে, সবসময় তো পড়ছে, আজ থাক আমার কাছে।"
আন্টিকে এই কারণে ঝিমলি যা ভালোবাসে না, কখনো কখনো মায়ের থেকেও একটু বেশী।
বাড়ি ফিরে ওরা দুজনে কিছুতেই আলাদা বসার সুযোগ পাচ্ছিল না। প্রথমে আন্টির বিখ্যাত দুধ মালাই দেওয়া চা খেতে হল। ঝিমলি এটা একদম ভালোবাসেনা, কিন্তু আন্টি জোর করে খাওয়ায়, মাথা নাকি ভালো থাকে! চায়ের আড্ডায় রোহিত এসে জুটে কিছুক্ষণ বকবক করল। চা শেষ করে বইখাতা নিয়ে গুটিগুটি অনুর ঘরে ঢুকতে যাবে, জয়ের ফোন এল। রিসিভার হাতে নিয়ে ঝিমলির মনে হল, অন্য সময় যেমন এই ফোনের অপেক্ষায় থাকে সারাদিন, আজকে ফেটের উত্তেজনায়, সেই অপেক্ষাটা ছিলনা। এমনিতে নির্দিষ্ট সময়ের কিছুটা পরেই এসেছে ফোন, অথচ সে এই দেরীটা ও খেয়ালই করেনি।
একটু অনুতপ্ত চিত্তেই কথা শুরু করল, প্রথমটা ফেটে নিয়ে দু চারটে প্রশ্নর জবাব হুঁ হাঁ তেই সেরে দিল। সপ্তাহে এই একবার ফোনে কথা, এমনিতে এসময় বুক জুড়ে ভালো লাগা আর খারাপ লাগা দুয়ের যেন রিলে রেস চলে। আজকে কেন জানি খারাপ লাগা অনেক এগিয়ে জিতে গেল। স্কুলের শেষ ফেটে, একথা মনে করলেই শুধু মন কেমন করছে। বন্ধুদের সঙ্গে কতকাল পরে এত আড্ডা গল্প হল, আবার কবে এমন নির্ভেজাল মিলনমেলায় থাকার সুযোগ হবে কে জানে!আর কদিন পরেই কে যে কোথায় চলে যাবে, হয়ত জীবনেও আর দেখা হবেনা। মায়ের কাছে শোনা গল্পের হারিয়ে যাওয়া স্কুল কলেজের বন্ধুদের মত তার বন্ধুরাও হারিয়ে যাবে নাকি?
ওদিক থেকে দু একটা কথার পরেই শুরু হল পরীক্ষা নিয়ে, এন্ট্রান্স নিয়ে কচাকচি। এ মাসের আগরওয়াল সব হয়ে গেছে কিনা, শরাফ স্যরের কাছে যাচ্ছে কিনা। দাদাকে কী দরকারে ফোন করেছিল, দাদা নাকি বলেছে ঝিমলি একদম পড়ছে না। আট ন ঘন্টা টানা না পড়লে এখন হয় নাকি!
অন্যদিন ঝিমলি ধৈর্য ধরে মন দিয়ে শোনে, দরকার মত পড়ার কথা জিজ্ঞেসও করে নেয়। ওর নিজের ভাবনাতেও থাকে সামনের দিনগুলোর চিন্তা, আগে গিয়ে কী হবে না হবে। মনে মনে জানে যে ও যদি একই জায়গায় পৌঁছতে পারে, অনেককিছু সহজ হয়ে যাবে জীবনে। তবু আজ কেন জানি, ভেতর থেকে একটা অভিমানের সুর গুমরে উঠল।
“সারাক্ষণ তোমাদের এই পড়া নিয়ে কথা, আমার আর ভালো লাগেনা। আমি এন্ট্রান্স দেবনা, কোনো পরীক্ষা দেব না। সবাইকে একরকম হতে হবে কেন, আমি তোমার মত লেখাপড়ায় ভালো নই, জোর করে ভালো হতেও চাইনা।“ ওদিকের উত্তর শোনার আগেই দুম করে ফোনটা নামিয়ে রেখে দিল।
অনু মুখে বাবল গাম গুঁজে অঙ্ক খাতা খুলে বসেছিল। সাধারণত ঝিমলি সারা সপ্তাহ ধরে বৃহস্পতিবারের ফোনের অপেক্ষায় থাকে আর ফোনে কথা বলার পর খুশী চোখে মুখে উপচে পড়ে, প্রায় উড়তে উড়তে ঘরে ঢোকে। আজ ধীর পায়ে এরকম মেঘলা মুখ আর কান্নাঝরা চোখে আসতে দেখে অবাক হল।
“কীরে কী হয়েছে? কাঁদছিস নাকি?”
ঝিমলি বিছানায় উলটে পড়ে গরগর করে,
“না, কাঁদতে যাব কেন! আমি রেগে আছি। খালি পড়া ছাড়া আর কথা নেই। আমার বাড়ির লোকেদের সঙ্গেও আমার প্রিপারেশন নিয়ে গল্প করছে আজকাল।"
“সেকী রে, তাই নাকি? কিন্তু তাতে হঠাত এত রাগলি কেন? জয় তো ওরকমই, সবসময় পড়া নিয়ে কথা বলে। অন্যসময় তো তুই তাই শুনেই গলে যাস, আজ কী হল?”
“মোটেই জয় ওরকম না, আজই একটু বেশী পড়া পড়া করছিল। আমারও কেমন যেন রাগ হয়ে গেল শুনে। আসলে সব দোষ ওই গানটার। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে বার বার মনে হচ্ছিল, স্কুল শেষ হয়ে গেল, আমাকে কেউ কখনো একটাও গান ডেডিকেট করল না। তারপর যখন মাইকে আমার প্রিয় গান বেজে উঠল তখন থেকেই রাগ হচ্ছে, মনে হচ্ছিল, যদি এটা জয় হত, আমার জন্যে আমার প্রিয় গান ডেডিকেট করত যদি! হতেও তো পারত, এসব না করে শুধু গুরুঠাকুরের মতো কথাবার্তা! ও মনে হয় এসব ছেলেমানুষি, বোকা বোকা মনে করে, অথচ আমার এই সব কিছু এত ভালো লাগে, কী যে করি, ভাল্লাগে না!”
অনু কিছুটা অবাক হয়ে যায়, পর মুহূর্তে ওকে একটা ঠেলা দিয়ে বলে,
“সেকীরে। এদিকে আমি তো ভাবলাম আজকের রোজমেরী গানটা জয়ই তোর জন্যে ওর কোনো বন্ধুকে দিয়ে ডেডিকেট করিয়েছে।"
ঝিমলি উঠে বসল,
“তুই তাই ভেবেছিস? আবার আমি ভাবলাম ওটা তোর জন্যে ছিল।"
“ধুর, আমাকে কে গান ডেডিকেট করবে? আমার মনে হল জয় বুঝি তোকে ফোনে বলবে সারপ্রাইজটার কথা, আর তুই লাফাতে লাফাতে আমাকে এসে বলবি। সত্যি কিছু বলেনি জয়? কিন্তু জয় ছাড়া আর কে হবে?"
“নাঃ, বলেনি। জয় ওরকম কিছুতেই করবেনা, কোনো বন্ধুকে দিয়ে আমার জন্যে ফেটে-তে গান বাজাবে, অসম্ভব। তাছাড়া এই গানটা যে আমার খুব ভালো লেগেছে তাই বা ও জানবে কী করে? ওর সাথে গান নিয়ে কথাই হয়নি।”
অনু বালিশটা কোলে নিয়ে গুছিয়ে বসে বলল,
“সেটাই তো। আমি তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। গত সপ্তাহে তুই সুদেশ ভাইয়ার দোকান হয়ে এসেছিলি বলে তোর দেরী হয়েছিল। প্রথমবার জয়ের ফোন আসে যখন তুই ছিলিনা, আমি ওকে তোর দেরী কেন হচ্ছে বলতে গিয়ে ক্যাসেটের কথা বলেছিলাম, ভাইয়া হয়ত ক্যাসেট রেডি রাখেনি তাই দেরী হচ্ছে। জয় তখন কী ক্যাসেট জানতে চাইলে আমি ওই গানের কথা বললাম। তারপর তুই তো বললি জয়কে বলেছিলি এই সপ্তাহে ফেটে আছে, তুই রাতে এখানে থাকবি, ও যখন খুশী ফোন করতে পারে। আজ গানটা বাজালো যখন তখনই মনে হল জয়ের কথা। আমার কাছে গানের কথা শোনার পরে ফেটের কথা জেনেছে যখন, তখনই হয়ত প্ল্যান করেছে। জয় ছাড়া আর কে জানে তোর পাগলামির কথা। শহরের আমজনতা তো তোকে মহা শান্তশিষ্ট ভালো মানুষ বলেই মনে করে।"
এক এক সময় ভাবেভোলা অনু এমন অকাট্য যুক্তি খাড়া করে যে ঝিমলিরও তাক লেগে যায়। মুহূর্তের জন্যে ধন্দে পড়ে গিয়ে, অনুর শেষ বাক্যটার সাথে হ্যা হ্যা হাসিটা অত খেয়াল করল না। আবারও মনে মনে একটু আগের ফোনের কথোপকথন মনে করে। নাঃ, ফেটে নিয়ে কথা শুরুতেই হয়েছে, পড়া নিয়ে ওর রেগে যাওয়ার আগে। চাইলে জয় গানের কথা তুলতে পারত, সময় ছিল, কিন্তু তোলেনি।
“ নারে বুদ্ধু, জয় যদি হত তাহলে বলত। আর জয় ছাড়া কে আবার কী? আমার এখন পাক্কা মনে হচ্ছে গানটা আসলে তোর জন্যে ছিল।"
অনু চোখ সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়,
“মানে? তুই কী বলতে চাস?”
মনের মেঘ কেটে আসছে, ঝিমলি একটু মুচকি হেসে বইয়ের দিকে হাত বাড়ায়।
অনু রাগ রাগ মুখে ওর দিকে একটা বই তাক করে বলে,
“খবরদার, নাম নিবিনা ওই পান খাওয়া শাড়িওয়ালার। তোকে আমি মেরেই ফেলব তাহলে।"
“আরে, আমি কী কারও নাম নিয়েছি নাকি? তুইই বরং নাম নিলি। ও ছাড়া অন্য কেউও তো হতে পারে। আমাকে যেমন কেউ পাগল বলে জানেনা, তোকে তো আবার শহরসুদ্ধু লোক পাগলছাড়া কিছু ভাবেনা! এমন পাগল আর মিষ্টি মেয়ে আর দুটি আছে নাকি এদেশে!
দ্যাখ, এমনও তো হতে পারে রোহিতের চেনা, কাছের কেউ। রোহিতের ভয়েই সামনে এসে বলতে পারেনা।"
বলতে বলতে মাথায় যুক্তিগুলো কেমন আপসেই সেজে ওঠে,
“ তাছাড়া ক্যাসেটটা তো রোহিতই এনেছিল কোথা থেকে। ওর বন্ধু নিশ্চয়ই সে কথা জানে, গানের কথাও রোহিতের কাছেই জেনেছে। এটাই ঠিক, তুই এবার থেকে যারা বাড়িতে আসবে তাদের খেয়াল করিস। একটু খুঁটিয়ে দেখলে, ব্যবহারে অন্যরকম কিছু নির্ঘাত টের পাবি।"
অনু এবার ঝিমলির মাথায় বইয়ের বাড়ি বসিয়েই দিল।
“গোয়েন্দা গল্প পড়ে পড়ে তোর মাথাটা গেছে, রোহিতকে তুই একেবারে ভিলেন বানিয়ে দিচ্ছিস, হিন্দি সিনেমার ভাই, বোনের প্রেমের পথের বাধা, হাঃ। এরকম কেউ থাকলে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। ভুলে যাস না, আমি মিলস এন্ড বুনসের অথরিটি, প্রেম নিয়ে আমার না-পড়া ডিগ্রি আছে।
এখন বাদ দে তো, হয়ত আমাদের কারোর জন্যেই ছিলনা গানটা। ছোট শহর, একটা ক্যাসেট একই সময়ে সবাইয়ের হাত ঘুরতে থাকে। অনেকেরই ওই এক গান প্রিয় হতে পারে। ফালতু গান গান করে আজ সন্ধ্যের আড্ডাটাই মাটি। চল এবার একটু পড়ে নি, আমার কতগুলো প্রবলেম তোর থেকে দেখে নেওয়ার আছে। মা একটু পরেই খেতে ডাকবে।"
অনু ঠিকই বলছে। গান নিয়ে পাগলামি করতে গিয়েই, জয়ের কথায় মেজাজ খারাপ করল। বেচারা নির্ঘাত ঘাবড়ে গেছে ওর অদ্ভুত ব্যবহারে। জয় তো এরকম করেই কথা বলে বরাবর। সবসময় সিরিয়াস হয়ে বলে তাও নয়। ঝিমলিকে রাগাতে চেয়েও বলে, জানে ও ফাঁকিবাজ তাই মজা করে। আগে কখনো ও জয়ের কথায় এভাবে রিয়্যাক্ট করে নি। বেচারা ঘাবড়ে গিয়ে কী করবে কে জানে। বাড়িতে ফোন না করলেই হল। মাকে ওর বিশ্বাস হয়না, মা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায়.........
মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনুকে বলতে, প্রেমের ডিগ্রিধারী পেনসিল চিবুতে চিবুতে রায় দিলেন,
“অত মন খারাপ করার কী আছে। একটু মেজাজ দেখানো ভালো। আমার তো বিরক্ত লাগে, তুই কেমন যেন জয়ের কথায় গলে গলে যাস সবসময়। গল্পে এরকম হয় না, ঝগড়া হবে, অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি। দুজনে আলাদা হয়ে গিয়ে, কেউ এক তৃতীয়জন আসবে মাঝখানে, তারপর আবার মিল হবে, তবে না! এতদিন খুব বোরিং ছিলি তোরা, এবার ব্যাপারটা ঠিকঠাক লাগছে।"
অনুর এসব কথায় বেশী পাত্তা দিতে নেই, মাথায় প্রেমের গল্প ঠাসা, নিজে সেজন্যেই বোধহয় প্রেমে পড়েনা। ঝিমলি অংকে মন দিল। পরে সময় করে রোহিতের সঙ্গে বসতে হবে। রোহিতের মাথায় এই গানের ব্যাপারটা ঢোকালে, সে ঠিক খুঁজে বার করে ফেলবে, কে কাকে এই গান ডেডিকেট করতে পারে, শহরের কোণায় কোণায় তার চর ছড়িয়ে আছে!
ছোলে ভটুরে আর লেবুর মিষ্টি চাটনি ছিল ডিনারে, সব ওর ফেভারিট, তবু ঝিমলির কেমন যেন খেতে ইচ্ছে করছিল না। ইস, কেন যে জয়ের সাথে অমন বাজে করে কথা বলল। কবে আবার কথা হবে, আজকের জন্যে কিভাবে সরি বলবে, সেই চিন্তায় মন ভারী হয়ে এল।
সারাদিনের হুটোপাটির ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা মিলে ঝিমলির মনে হল মায়ের গলা জড়িয়ে শুতে পারলে হত। এত রাত্তিরে আন্টি বা এরা কিছুতেই বাড়ি যেতে দেবেনা। রোহিত ছেড়ে আসতে পারে বললে, কিন্তু কী বলবে!
এমনিতে ঝিমলি রাতে যখনি এ বাড়িতে থাকে, ঠিক ভোরে উঠে নিজের বাড়ি চলে যায়। অনু বা আন্টি রাগ করলে বা সাধলেও থাকেনা। আসলে এটা ওর অভ্যেস, সকালে উঠেই মা কাছে না থাকলে ওর হয় না। জানে এরপরে বাইরে যেতে হবে, মা সঙ্গে যাবে না, তবু এত কাছে বাড়ি, সকালে বাড়ি না গিয়ে থাকতে পারে না।
অনু শুয়ে শুয়ে নানা গল্প করতে লাগল। মেলাতে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, অনেক খবর জানা গেছে সেইসব নিয়ে। অন্যদিন হলে ঝিমলি প্রচুর আগ্রহ নিয়ে শুনত, কিন্তু আজ তার একেবারে গসিপে উৎসাহ নেই। অনু অবশ্য সেটা খেয়াল করল না, বকবক করে গেল, ঘুম না আসা অবধি।
রাতে ঘুম হল ছেঁড়া ছেঁড়া। ঘুম যখন ভাঙল, বাইরে তখনো আবছা অন্ধকার। চুপচাপ শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে একটু একটু করে ভোরের আলো ফোটা দেখতে থাকল। স্কুল নেই যবে থেকে তবে থেকে আর ভোরে ওঠাই হয় না, রাত জেগে পড়া অভ্যেস, তাই উঠতে পারেনা। হিমালয়ের কাছের এ শহরে কাগজেকলমে বসন্তে এলেও ঠান্ডা থাকে অনেকদিন, কম্বলের তলা থেকেই আবছা আলোয় কোকিলের ডাক শুনল খানিকক্ষণ।
দাদাজীর গেট খুলে বেরনোর আওয়াজ পেতে, তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠল। অনুকে জাগাবে না, সে উঠলে আন্টিকে ওঠাবে, আন্টি তখন “চা খেয়ে যা, নাহলে দুধ খেয়ে যা” শুরু করবে। কাল দুপুরে রোদে গরমের জামা পরে আসেনি, এই ভোরে বেশ ঠান্ডা লাগছে, সাইকেল চালাতে গেলে ভালোই শীত করবে। অনুর সোয়েটার নেওয়া যায়, কিন্তু আলমারির আওয়াজে ও উঠে পড়বে। ঝিমলি এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়। কাল ফোনের ব্যাপারটার পরে মন ভালো নেই।
আস্তে আস্তে দরজা খুলে লিভিং রুম পেরিয়ে, পা টিপে টিপে বাইরে এল। সাবধানে একটুও শব্দ না করে, গেট খুলে, সাইকেলটা বার করল। সাইকেলটা রাস্তায় নামিয়ে এক পা প্যাডেলে ঠেকিয়েছে, পাশের বাড়ির গেটটা খুলে গেল। চোখে চশমা, ঝাঁকড়া চুল, অরেঞ্জ জ্যাকেট পরা পাশের বাড়ির ছেলেটা বেরিয়ে এল, কাঁধে গীটার, হাতে ধরা সাইকেলের হ্যান্ডেল।
“ঝিমলি, চলে যাচ্ছ ?”
চেনা মুখ, অনুদের বাড়ির অনুষ্ঠানে দেখেছে অনেকবার, মাঝে মাঝে দু একটা কথাও হয়েছে। হাতের গীটারটা দেখে মনে পড়ল, সবাই বলে বটে ভালো গান করে, ও শোনেনি কখনো।
সাইকেলে আর ওঠা হয় না, হ্যান্ডেলটায় হাত রেখে ভদ্রতা দেখিয়ে বলে,
“হ্যাঁ। তুমি এত ভোরে কোথায় চললে ?”
“স্টেশনের ওদিকে, নাহার পেরিয়ে একটা জঙ্গল আছে, এই ফাগুনে সেখানে অনেক পলাশ ফুল ফুটে থাকে। এই ভোরে জায়গাটা খুব সুন্দর লাগে,চারিদিক নির্জন, আমি মাঝে মাঝে ওখানে যাই, পাতার শব্দ, পাখির ডাকের সাথে সুর মেলাতে চেষ্টা করি । “
সাইকেল নিয়ে ঝিমলির ঠিক পাশে এসে হাঁটার উপক্রম করে।
ঝিমলি মনে মনে একটু অবাক হয়, বাবা, এযে ভয়ানক শিল্পীমানুষ দেখা যাচ্ছে। ও কিছু না বলে সাইকেলটা নিয়ে হাঁটতে শুরু করে, ছেলেটাও পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।
ঝিমলির অবাক হওয়াটা কেমন করে যেন বুঝতে পেরে, হেসে বলে,
“ নাহ, তেমন গানটান জানিনা, ওই ভালোবেসে চেষ্টা করি আর কী। অনু তোমায় বলেনি বুঝি? আমি অনুকে অনেকবার বলেছি আমার গানের অনুষ্ঠানে যেতে, ও যায়নি কখনো, বলে আমি নাকি খুব বাজে গান করি, শুনলে মজা হয়না দুঃখী দুঃখী লাগে। রোহিত ওর বন্ধুদের নিয়ে যায় মাঝে মাঝে। আমি তো হবিজ ক্লাবের প্রোগ্রামেও গেয়েছি।"
ঝিমলি কখনো অনুর মুখে এর গানের প্রোগ্রামের কথা শোনেনি। এমনিতে বাড়ির পাশে বলে হবিজ ক্লাবের প্রোগ্রাম ও খুব একটা বাদ দেয় না, সেখানে কখনো একে দেখেছে বলে মনে পড়ল না।
আবার যেন মনের কথা পড়তে পারে এই গানওয়ালা।
“না, তুমি দেখনি আমার প্রোগ্রাম, তুমি অডিয়েন্সে থাকলে আমি জানতে পারতাম।"
ঝিমলি কিছু বলেনা। ছেলেটা তো স্টেশনের দিকে যাবে বলল, তাহলে যায়না কেন? সাইকেল নিয়ে কতদুর হাঁটবে রে বাবা তার সাথে, দেরী হয়ে যাচ্ছে, তাহলে আর এত ভোরে ওঠার কী মানে হল!
“তুমি কাল এখানে আছ বুঝেছিলাম। রোহিত তোমার সাইকেলটা ভেতরে ঢুকিয়ে রাখছিল। তাছাড়া আন্টির ঝুম ঝুম ডাক শুনলেই আমরা বুঝতে পারি, অনুর বন্ধু এসেছে।"
ঝিমলির মনের হাল্কা বিরক্তি সরে গিয়ে, এবার ও হেসে ফেলল,
“হ্যাঁ আন্টি ছোটবেলা থেকে আমাকে কেন জানিনা ঝুম বলে ডাকে। আগে খুব অপছন্দ হত, বিশেষ করে রোহিত যখন “ঝুম বরাবর ঝুম শরাবী” বলে রাগাতো। এখন খারাপ লাগেনা, বরং আন্টি ঝুম না ডেকে আমার পুরো নামে ডাকলেই খারাপ লাগবে।"
তাই তো, এরা অনুদের খুবই ঘনিষ্ঠ, আন্টির বন্ধু এর মা, তাছাড়া পাশের বাড়ি, এক দেওয়াল। কথা বললে নিশ্চয়ই সব শুনতে পায় এরা, তাদের কথা সবই জানে হয়ত। ঝিমলি অথচ এদের কথা কিছুই তেমন জানেনা।
“আমি না এবার যাব। মানে বাড়িতে একটু কাজ আছে, তাই ভোরে বেরিয়েছি। দেরী হয়ে যাচ্ছে।"
“আরে তাই তো। সরি, তোমাকে দেরী করিয়ে দেওয়ার জন্যে। আসলে একটা জিনিস তোমাকে দেওয়ার ছিল। তাই বাগানে ওয়েট করছিলাম, জানি তুমি ভোরে চলে যাবে।"
“জিনিস মানে, কী জিনিস?"
বলতে বলতে ঝিমলি দেখল ছেলেটা হাত বাড়িয়েছে, হাতে চেনা গানের ক্যাসেট।
“রোহিত বলছিল এই ক্যাসেটের গান তোমার ভালো লেগেছে।"
“এটা তোমার ক্যাসেট? রোহিত বলে নি তো, অনুও জানত না। থ্যাঙ্ক ইউ, কিন্তু আমরা তো এই ক্যাসেটের কপি করিয়ে নিয়েছি সুদেশ ভাইয়ার দোকান থেকে।"
ঝাঁকড়া চুলে ঘেরা মুখটা একটু ম্লান হয়ে গেল কি? মৃদু অনুনয়ের সুরে বলে উঠল,
“আমি কাল চলে যাচ্ছি। আগ্রার কলেজে মিউজিক নিয়ে পড়তে যাচ্ছি। এতদিন বাবা রাজী হচ্ছিল না, এখন পারমিশন দিয়েছে। তুমিও তো এরপরে বাইরে পড়তে চলে যাবে। আর কোনোদিন দেখা হবেনা। এই ক্যাসেটের সব গান আমারও খুব প্রিয়, আমি এগুলো গাই নানা অনুষ্ঠানে। তোমার ভালো লেগেছে শোনা থেকেই ভেবেছি তোমাকে এটা দিয়ে দেব। তোমার কপি করা ক্যাসেটটা নাহয় অন্য কাউকে দিয়ে দিও।"
“কিন্তু এটা তো তোমারও প্রিয় ক্যাসেট বললে, আমাকে দিলে তোমার কাছে থাকবেনা।"
“বললাম না, আমি তো কবে থেকে এই গানগুলো গাই। সব গানের কথা সুর আমি হৃদয়ে নিয়ে বাঁচি, ক্যাসেট লাগবে না। এই ক্যাসেটে আমি তোমার নাম লিখে দিয়েছি, আমাকে একজন বন্ধু ভেবে তুমি এটা তোমার কাছে রাখলে আমি খুব খুশী হব, প্লিজ।"
কেমন যেন মায়া জড়ানো কথাগুলো, গানের মত শোনাচ্ছে। গানওয়ালা তো, হয়ত কথাও আহির ভৈরবেতে বলছে।
অনেক কিছু বলে চলে, থেমে থেমে, ধীর স্বরে। গান ভালোবেসে তা নিয়ে পড়তে সুযোগ পাওয়ায় কত খুশী, সেই কথা। এতদিনের ছোট সুন্দর শহর ছেড়ে, আপনজনেদের ছেড়ে, চলে যেতে কেমন লাগবে, কতটা খারাপ লাগবে, সেই কথাও। শুনতে শুনতে ঝিমলি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, সব ঠিক শোনাও হয় না । এ যেন তারই কথা, এই চেনা চারধার, অমলতাস আর ইউক্যালির সারি দুপাশে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া পথ, দুরের বরফ জড়ানো পাহাড়চূড়া, চেনা মানুষজন, ছেড়ে যেতে হলে ওরও কি এমন লাগবে, কে জানে!
একেই বোধহয় বলে সুরে সুর বাঁধা। চলতে চলতে ওরা পথের বাঁকে এসে পড়ে, ডানদিকে স্টেশনের রাস্তা, সামনে ঝিমলিদের ক্যাম্পাসের গেট। আকাশে ছড়ানো সূর্য ওঠার আগের গোলাপি লাল রঙের বাহারি, সামনে রজনীদের গেটের লাল বটল ব্রাশের ঝাড়, একটা মৃদু সুগন্ধে ভরে আছে জায়গাটা। ইস কী বিষণ্ণ সুন্দর লাগছে আজকের দিনের শুরুটা।
এমন মুহূর্তে জীবনে না শব্দটা আপনিই নিরুদ্দেশে চলে যায়। ঝিমলি তাই আর কথা না বাড়িয়ে, হাত বাড়ালো।
“বন্ধুর উপহার নিলাম আমি। খুব ভালো থেকো তুমি, আর গানে ভরে থাকুক জীবন। স্বপ্নগুলো যেন সদা থাকে তোমার হাতের মুঠোয়, আমার বেস্ট উইশেশ। পরের বার এখানে এলে, হবিজ ক্লাবে প্রোগ্রাম করলে, জানিও। যদি তখন থাকি, ঠিক হাজির হব, মিস করব না, প্রমিস।"
“জানাবো। তুমি থাকো বা না থাকো, পরের প্রোগ্রাম, তোমার নামে।"
ঝিমলি এর উত্তরে কিছু বলেনা, শুধু হেসে এগিয়ে যায়। রাস্তার ধারের বাড়িটার বন্ধ গেটের সামনে থমকে দাঁড়ায়। ওপারে তার স্বপ্নগুলো নানা রঙের ফুল হয়ে ফুটে আছে, ইচ্ছেগুলো হলুদ প্রজাপতির মত ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে। সৌম্যদর্শন মানুষটা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে নীচু হয়ে বারান্দায় পড়ে থাকা কাগজটা তুলে নিল। সেদিকে তাকিয়ে ঝিমলির বুকটা মায়ায় ভরে ওঠে। এই ফুল পাতা সবুজ লন প্রজাপতির পাখা, গাছগাছালি আর ওই সুন্দর মানুষগুলো সুরে বাঁধা হয়ে যে গান হয়ে ওঠে, সেই গান তার জন্যে শুধু তারই জন্যে, এর চেয়ে ভালো “ডেডিকেট আ সং” আর কী হতে পারে! নাঃ, আজ বাড়ি থেকে ফোনটা সেই করবে, হস্টেলের নাম্বারটা আছে তো খাতায় লেখা। এমন সকালে দূরের একজনের জন্যে শুধু ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই মনে আসছে না। আর মাকে সব কথা বলতে হবে আজকেই, আর লুকিয়ে রাখবে না সে তার ভালোবাসাকে।
বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ের এপার থেকে বাড়ির ভেতরের কারুর চোখে চোখ পড়ার আগেই সে ওখান থেকে সরে এসে সিটে উঠে পেডালে চাপ দেয়। বসন্তের ভোরে রোদের কাঁচা হলুদ রঙ মেখে সে যেন বাগানের হলুদ প্রজাপতির মতই উড়ে চলে, ভালোবাসার বসন্তে।
আর ঝাঁকড়া চুলো ছেলেটা? সে তখনো বিভোর হয়ে এক হাসিতে ভোরের আকাশ দেখে, পাখির কলকাকলি, ঝরনার রুমঝুম শুনতে পায়। তার চোখের আয়না সেই হাসির ছবি তুলে রেখে দেয়, হয়ত বা চিরদিনের জন্যে।
আর তার মন বলে ওঠে,
“ঝিমলি, তুমি এমনিই থেকো, ভালো থেকো, অল দ্য বেস্ট। ঝরনার জলের মত স্বচ্ছ, ওয়ান ইন আ মিলিয়ন, পাগলী মনটাকে এমনিই সবুজ রেখো চিরটাকাল।"
বৃষ্টির ছাটে ভেজা নরম হয়ে ওঠা এক শান্ত অথচ দৃঢ় চোখের দৃষ্টি ঝিমলির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন বলে, এভাবেই অনেক অনেক নাম না জানা পথ চলবে তারা, তাদের প্রত্যেকটা স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়ে অনন্তের পথে।