এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • উত্তর ভারতের খাপজাতি পঞ্চায়েত, অনার কিলিং - জানা অজানা কিছু কথা

    শ্রাবণী রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ৩০ আগস্ট ২০১০ | ১০২১ বার পঠিত

  • খাপ বা জাতি পঞ্চায়েত এই শব্দ গুলো আজকাল প্রায়শই দেখা যাচ্ছে হেডলাইনে, বিশেষ করে হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ,রাজস্থানের বিভিন্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া জঘন্য অপরাধ অনার কিলিং সম্পর্কে। টিভি চ্যানেলে দেখছি সাদা ধুতি কুর্তা, সাদা পাগড়ি, হাতে লাঠি, হুক্কা চারপাই সভার তাবড় নেতালোগ লাঠি উঁচিয়ে উঁচিয়ে হরিয়ানভী হিন্দীতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে,অনার কিলিং, স্বগোত্রে বিয়ের অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি,এসবের সপক্ষে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে এরা কারা, এ কোন যুগের ভাষায় কথা বলছে? কিছুদিন আগেও দেশের অর্ধেক লোকে যা নিয়ে কিছুই জানতনা, কোথাও কোনো খবরে যার কোনো উল্লেখ হতনা, সেই অনার কিলিং আজ প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের রোজের খবর। তাহলে কি হালেই বেড়ে গেছে সামাজিক রীতিবহির্ভূত বিয়ের সংখ্যা আর তা নিয়ে সমাজশাসক বা পরিবারের আক্রোশের বহর? এমন হতে পারে যে এ হয়েই আসছে, শুধু আগে মিডিয়ায় এনিয়ে হইচই হয়নি। অথবা এ আই ডি ডাব্লিউ এর ( অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রাটিক উইমেনস অ্যাসোসিয়েশন) মত সংস্থারা আজকাল বেশী সক্রিয় হয়ে এধরণের ঘটনা সারা দেশের জনসমক্ষে বেশী করে নিয়ে আসছে। অন্যান্য কারণ যাই হোক, একটি প্রধান কারণ হল হাইকোর্টে বাবলি-মনোজ অনার কিলিংয়ের কেসে অভিযুক্ত পাঁচজনের মৃত্যুদন্ডের রায়। এই প্রথম বহুবছরের বহুল প্রচলিত খাপ আদালতের অন্যায় নির্ণয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দেশের আইন খাপের নির্দেশ পালনকারীদের এত কঠোর দন্ড দিল। এই রায় নিয়ে মিডিয়া রিপোর্ট,খাপ নেতাদের স্বগোত্র বিবাহ বন্ধ করার জন্য আইন প্রণয়নের দাবী এবং তাদের আরও নানা কর্মকান্ড, সব মিলে এই সমস্যার প্রতি দেশের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নি:সন্দেহে জঘন্য সব ব্যাপার, আজকের উত্তর ভারতের সবচেয়ে উন্নত ক্ষেত্র রাজধানী দিল্লী ও তার আশেপাশের চোখধাঁধানো সব শিল্পনগরীর আলোকমালার আনাচেকানাচে অন্ধ সমাজের অন্ধা কানুনের ডেরার আঁধার! নানা নতুন শব্দ খাপ গোত্রখাপ,অনার কিলিং, মহাখাপ,ভাইচারা আমাদের জীবনে ঢুকে পড়ে আমাদের চিন্তা ভাবনাকে কেমন উল্টেপাল্টে দিতে থাকে। এ নিয়ে মিডিয়া রিপোর্টের এই হঠাৎ বাঁধভাঙা বন্যায় আমরা দিশেহারা। হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশ রাজস্থানের এই খাপ বা জাতি সমস্যা কিভাবে সারা দেশে,বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতে যে জাতপাত বর্ণ নিয়ে নানা সমস্যা তার থেকে ভিন্ন?

    জাতপাতের কড়াকড়ি উত্তর ভারতের এই রাজ্যগুলি ছাড়াও ভারতবর্ষের আরও অনেক রাজ্যে প্রবল, কিন্তু সেসব জায়গায় এই খাপ নেই। হরিয়ানা, ইউপি, রাজস্থান আর পাঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকাতেই খাপের সর্বাধিক রমরমা। কোনো জায়গায় ভৌগোলিক ভাবে আশেপাশের একাধিক গ্রাম নিয়ে একটি খাপ হয়। চুরাশিটা গ্রাম নিয়েও খাপ হয় আবার সাত বা চোদ্দটা নিয়েও হতে পারে। এইসব গ্রামে বিভিন্ন জাতের লোক থাকতে পারে কিন্তু তাদের খাপ হল এক। খাপের নিয়ম অনুযায়ী একটি খাপের মধ্যে পরস্পরের বিয়েশাদী একেবারেই অচল তা সে যে জাতেরই লোক হোক না কেন। এভাবেই খাপকে বলা হচ্ছে গোত্র খাপ এবং হিন্দু সমাজের বিধি অনুযায়ী ঠিক যে ভাবে স্বগোত্রে বিবাহ নিষেধ,এখানেও ঠিক সেইভাবেই একই খাপ গোত্রের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। খাপ হল জাতি বা গোষ্ঠী আর জাঠ পণ্ডিত দলিত গুর্জর রাজপুত ইত্যাদি হল জাত। খাপ হল মূলত ভৌগোলিক হিসেব আর জাত হল বংশানুক্রমিক বা কৌলিক হিসেব। দুটোর কোনোটাতেই বিয়ে সম্ভব নয়। অর্থাৎ অন্য খাপবিহীন এলাকায় যেখানে সামাজিক নিয়মে বিয়ে দিতে গেলে শুধু স্বজাত খুঁজতে হয় সেখানে এই ক্ষেত্রে খাপ বহির্ভূত স্বজাত খুঁজতে হয়। একটি খাপের আওতায় যেসব গ্রাম আসে সেখানে প্রতিটি ছেলেমেয়ে পরস্পরের ভাই বোন, অতএব তাদের মধ্যে বিয়ে সম্ভব নয়, এটাই খাপের নিয়ম, একে বলে "ভাইচারা"। খাপের অভিধানে এটি একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দ এবং প্রায়শই ব্যবহৃত হয় খাপমন্ডলী তে।

    নরিন্দরের বাস হরিয়ানার বাহাদুরগড়ে। তারা যে খাপের অন্তর্গত তার নাম হল দালাল। প্রায় চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ টি গ্রাম নিয়ে এই দালালদের খাপ। দালাল জাঠেদের একটি শ্রেণী। এরকমই আছে মোর খাপ, বেনিওয়াল খাপ, সব জাঠেদেরই শ্রেণী। এর মানে কি তাদের খাপে এইসব গ্রামে শুধু জাঠেরাই রয়েছে?

    তা নয়, দেশের অন্যান্য গ্রামের মত এসব গ্রামেও অন্য অনেক জাতের লোক থাকে, পণ্ডিত, দলিত, কায়স্থ, রাজপুত, চামার এরা। আবার জাঠেদেরই একাধিক শ্রেণীও থাকতে পারে একই খাপে। কিন্তু যে শ্রেণীর আধিপত্য ওই এলাকায় বেশী তাদের নামে খাপের নাম হয়। এককথায় দালালদের খাপে আশেপাশে বেশ কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে সেই গ্রামগুলি আসছে যেসব গ্রামে দালালদের সংখ্যা বা প্রভাব বেশী। নরিন্দর নিজে দালাল নয়, পণ্ডিত। এভাবেই যে সব এলাকায় রাজপুত বা গুর্জরের যে শ্রেণীর সংখ্যা বা প্রভাব বেশী সেখানে তাদের নামে খাপ। নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা, গাজিয়াবাদের প্রায় ষাটটা গ্রামে নাগর আর ভাটীদের খাপ। মায়াবতীর গ্রাম বাদলপুর নাগর খাপের মধ্যে পড়ে। এগুলি গুর্জরদের খাপ।

    ভৌগোলিক সীমারেখায় বাঁধা এই খাপ প্রথার প্রাসঙ্গিকতার আলোচনায় আসার আগে একটু ইতিহাস দেখা যাক। বিশেষ করে যেখানে স্বগোত্রে বিয়ে হিন্দু সমাজে কোথাও আকাঙ্খিত নয়। এ যুগেও আমাদের বাংলা পাত্রপাত্রী কলামে দেখা যায় "স্বগোত্র চলিবে না" অথবা গোত্রের উল্লেখ থাকে এজন্যই যাতে স্বগোত্রের পাত্রপাত্রীরা না যোগাযোগ করে। খুব মোটা ভাবে বললে মনে করা হয় গোত্র এক মানে তারা একই জাতি বংশ কূলের লোক, সম্পর্কটাও সেক্ষেত্রে ভাই বোনের। তাহলে সব পাখির মধ্যে মাছরাঙাসদৃশ খাপেরই বদনাম কি অন্যায়? না, কারণ খাপের সঙ্গে এদের একটা বড় পার্থক্য যে এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সমাজে এটাকে ব্যক্তিগত ব্যাপার মানা হবে, জানা গেলে বড়জোর ঠিক বেঠিক নিয়ে আত্মীয়, পাড়াপড়শীরা গলা তুলে আলোচনা করবে, গ্রামঘরে নিন্দে হবে, কিন্তু কেউ ফতোয়া জারী করবেনা। সমাজের ধুয়ো তুলে শাস্তিবিধান করা হয়না খাপ নেতাদের মত। তবে অনেক জায়গায় এক্ষেত্রে শাস্তিপ্রদান পরিবারের লোকেদের দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে, যার ফলস্বরূপ আমরা দেখি নানা অনার কিলিং য়ের ঘটনা। হালে দিল্লীতে কর্মরত বিহারের এক মহিলা সাংবাদিক নিরুপমার হত্যার ঘটনা যেখানে পুলিশের সন্দেহের তীর তার পরিবারের,বিশেষ করে মেয়েটীর মার দিকে, একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরন।

    আবার যদি এই ভৌগোলিক সীমায় বাঁধা জাঠ শ্রেণীর খাপ ভাইচারার অদ্ভুত যুক্তি বাদ দিয়ে শুধু গোত্রের ব্যাপারটা দেখি তাহলে বিষয়টি কিন্তু আর অনন্য থাকেনা। জাতের বাইরে বিয়ে বা স্বগোত্রে বিয়ে এদেশে অনেক হিন্দুসমাজেই নিষিদ্ধ। অনেক আধুনিক সমাজ এসব না মানলেও গ্রাম সমাজে বা ভারতের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্‌চিম যে কোনো দিকেই গোঁড়া রক্ষণশীল পরিবারে এখনো এসব নিয়ম অত্যন্ত যত্নসহকারে পালন করা হয়। সময়বিশেষে এ গোঁড়ামি নেয় ভয়ানক চেহারা। নানাদিক থেকে অনার কিলিংয়ের বা এ সম্বন্ধীয় অন্যান্য শাস্তির যাসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, বিহার দিল্লী তামিলনাড়ু সর্বত্র,তাতে এ শুধু খাপ প্রথার অধীন চার রাজ্যের সমস্যা এবং খাপ পঞ্চের নির্দেশেই হয়ে থাকে তা মনে হয় না, শিক্ষা,জাতিধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি সমাজের গভীরে কোথাও না কোথাও এই অসুখ বাসা বেঁধে আছে।

    সাম্প্রতিককালের একটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে আমাদের বাংলাও এব্যাপারে পিছিয়ে নেই। বীরভূমের একটি আদিবাসী মেয়ে ভালোবেসেছিল তার জাতের বাইরের একটি ছেলেকে। সেই অপরাধে মেয়েটিকে উলঙ্গ করে প্রায় আট কিলোমিটার ঘোরানো হয়, গ্রামের লোক বাজনাবাদ্যি সহ মিছিল করে তার পিছনে চলে। পরিক্রমার সাথে সাথে মেয়েটিকে শুধু যে ছড়ি দিয়ে মারা বা তার দিকে পাথর ছোঁড়া হয় তাই নয়, প্রায় একশ জন পুরুষ নানাভাবে তার শ্লীলতাহানি করে চলে। পুরো ব্যাপারটি ঘটে সেগ্রামের পঞ্চায়েতের গোচরে। তবু তারা কোন ব্যবস্থা নেয় না বা পুলিশকে খবর দেয় না! মেয়েটীর বয়স মাত্র সতের বছর। এর পরে সে বেঁচে হয়ত থাকবে, কিন্তু কেমন হবে সে বাঁচা? অনার কিলিংয়ে মৃত্যুর চেয়ে এ শাস্তি অনেক অনেক বেশী ভয়ংকর নয় কি?এধরনের শাস্তিবিধান জাতধর্ম রক্ষার আড়ে সমাজের কিছু মানুষের বিকৃতমনস্কের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা। নাহলে যেখানে যত এই ধরণের শাস্তির কথা শোনা যায় তা সবসময় মহিলাদের সঙ্গেই কেন হবে! তাই এ ব্যাপারে আধুনিক বঙ্গের তথাকথিত সরল আদিবাসী সমাজের পুরুষ ও হরিয়ানার সেকেলে খাপ নেতাদের মধ্যে কোনো তফাত নেই!

    দক্ষিন ভারতীয় সংস্থা প্রজ্ঞার ২০০৯ এ প্রকাশিত জেন্ডার ভায়োলেন্স রিপোর্টে অনার কিলিংয়ের সেকশন পড়লে জানা যায় তামিলনাড়ুতে বিগত তিন বছরে প্রায় ষাট টি এধরণের অপরাধ হয়েছে। অনার কিলিং নিয়ে সরকার বা অন্যান্য দের টনক নড়েছে খাপ কান্ডের পর থেকে, কিন্তু আদত সত্যি হল যে আমাদের দেশে এ সমস্যা রয়েছে অনেক বছর ধরে। এই ধরণের অপরাধ সামনে না আসার প্রধান কারণ হল পুলিশ প্রশাসনের এধরণের হত্যাকে সাধারণ হত্যা বা মহিলাদের ওপর অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা। হত্যার শ্রেণীবিভাগে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (এন সি আর বি) তথ্যে অনার কিলিং নেই তাই এ অপরাধের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। এ আই ডি ডাব্লিউ এ র একটি সার্ভে অনুযায়ী দেশের দশ শতাংশ অনার কিলিংয়ের ঘটনা ঘটে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে। পাঞ্জাব পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী গত দুবছরে সে রাজ্যে মোট চৌত্রিশটি অনার কিলিং হয়েছে।

    দেশের আইনের হিসেবে অবশ্য বম্বে হাইকোর্টের ১৯৪৫ সালের এক রুলিং এ স্বগোত্র বিবাহকে আইনসম্মত বলা হয়েছে। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের হিসেবে স্বগোত্র বিবাহে কোনো বাধা নেই।

    বাকী হিন্দু সমাজের মতই উত্তর ভারতের জাঠ গুর্জর রাজপুত এদের সমাজে স্বগোত্র বিয়ে নিষিদ্ধ হলেও এদের গোত্র বা গোত্র খাপ এর সংজ্ঞা ঠিক বাকীদের গোত্রের সঙ্গে খাপ খায়না। সঠিক হিসেব না থাকলেও যেখানে অন্য হিন্দুদের মধ্যে গোত্রর সংখ্যা মোটামুটি কয়েকশর মধ্যে আছে সেখানে জাঠেদের গোত্র সংখ্যা প্রায় ২৭০০। এরমধ্যে রাজস্থানেই জাঠেদের প্রায় ১৪০০ গোত্র আছে। এগুলি বাকী হিন্দুদের মত ঋষি গোত্র নয়।

    কিছু ঐতিহাসিকদের মতে এরা মূলত যাযাবর জাতি। খ্রীষ্ট্র পূর্ব প্রথম শতাব্দীতে পাঞ্জাবের দিক দিয়ে এদেশে ঢোকে সম্ভবত সেন্টাËল এশিয়া থেকে। পরে এরা নানা উপজাতিতে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে যায়। হিন্দু সমাজের সঙ্গে মিশে গেলেও এদের এই জাতি উপজাতির বিশেষত্ব রয়ে যায় গোষ্ঠী পরিচয়ের মধ্যে। এদের গোত্র সম্ভবত উপজাতি গোষ্ঠীর নাম আর তাই বাকী হিন্দু সমাজের গোত্র থেকে আলাদা। অবশ্য খাপ মহাসভার মতে তারা ভারতের সত্যিকারের ভূমিপুত্র,বাকীরা বহিরাগত! এদের দাবী যে বিভিন্ন সময়ে যখন বিভিন্ন জাতি এ দেশ আক্রমণ করেছে তখন খাপেরা মিলে এদের বাধা দিয়েছে সাচ্চা দেশপ্রেমিকদের মত। আবার ইতিহাসে এও দেখা যায় যে উত্তর ভারতে বিভিন্ন খাপ গোষ্ঠী চুরি লুঠতরাজে লিপ্ত হয়ে দেশের শাসকগণকে উত্যক্ত করেছে সময় সময়ে।

    সেভাবে দেখতে গেলে প্রাচীনকালে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই মানুষ নানা ছোট ছোট গোষ্ঠীতে ভাগ হয়েছিল পেশা ভৌগোলিক অবস্থান ইত্যাদি নানা ভিত্তিতে। আদি যুগে যখন কোনো শাসন, নির্দিষ্ট আইন ইত্যাদি ছিলনা তখন নিজেদের সুরক্ষার জন্যেই মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে থাকত। প্রতিটি গোষ্ঠীর নিজস্ব সামাজিক নিয়মকানুন ছিল, আপসে দ্বন্দও ছিল, মীমাংসা হত নিজেদের মধ্যেই নিজেদের নিয়মে। বৃহত্তর সমাজব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে সেই সময়ের হিসেবে তা ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও গণতান্ত্রিক অবস্থান। পরে রাজতন্ত্রে এরকম নানা গোষ্ঠীর নানা বিষয়ে দেশের বা রাজ্যের নানা গঠনমূলক কাজে, যুদ্ধ ইত্যাদিতে গুরুত্বপুর্ণ অবদানের নজির সে দেশের বা রাজ্যের ইতিহাসে বিরল নয়। অর্থাৎ যা নিয়ে নবীন জিন্দলের মতো খাপ সমর্থকরা বড়াই করছে, সেরকম দৃষ্টান্ত সারা বিশ্ব ছেড়ে আমাদের দেশেও বহু দেখা যায়। আধুনিক পৃথিবীতে যখন দেশ কালের গন্ডী, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, মানুষের অবস্থান, সমস্তকিছুর সময়ের সাথে নিত্য আমূল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, তখন পুরনো সামাজিক ব্যবস্থা, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন এসে যায়।

    মধ্যযুগে হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশ পাঞ্জাব ও রাজস্থানের অনেক এলাকায় এরকম নানা খাপ ছিল। দেশের অন্যত্র যখন রাজা বাদশাদের রাজত্ব চলত তখন এইসব এলাকায় গোষ্ঠীপতিদের বা খাপ পঞ্চায়েতের শাসন চলত। যেহেতু এক একটি খাপ অনেক গ্রাম নিয়ে হত, খাপেদের নেতা দেশের শাসকদের চোখে প্রভাবশালী বলে গণ্য হত। খাপের পঞ্চায়েত গঠিত হত নির্বাচনের মাধ্যমে, সভায় সমস্ত গ্রামবাসীরা উপস্থিত থাকত। এসব কারণে জমিদারী বা রাজাদের তুলনায় এদের শাসনকে অনেক গণতান্ত্রিক মানা হত সে যুগে।

    কতগুলি গ্রাম নিয়ে যেমন একটি খাপ হত,তেমনি অনেকগুলি খাপ নিয়ে হত সর্বখাপ। দেশের শাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ কথাবার্তা সবকিছু হত সর্বখাপদের মাধ্যমে। উত্তরপ্রদেশের মুজফ্‌ফরনগর জেলার একটি গ্রামে একটি পরিবার আছে,যাদের পুর্বপুরুষ বংশানুক্রমে সর্বখাপের নেতা হত। সময়বিশেষে এরা দেশের শাসকদের যুদ্ধবিগ্রহ, দেশশাসনে সহযোগিতা করেছে। খাপের সমর্থক বিশেষ করে জাঠেরা এসমস্ত গৌরবগাথা খুব বড়মুখ করে বলে থাকে। যা তারা বলেনা তা হল সর্ব খাপের যা কাগজপত্র সে যুগের পাওয়া যায়, তার থেকে প্রমাণিত হয় যে সে আমলে খাপের মধ্যে জাতপাতের বিভেদ অনেক কম ছিল। খাপের মধ্যে সব জাতই প্রায় সমান ক্ষমতা ভোগ করত। আজকের মত একদিকে খাপের ভাইচারার কথা বলে অন্যদিকে খাপের মধ্যেই নীচুজাত, দলিতের ওপর অত্যাচার, ফতোয়া দেওয়া, এসব ছিলনা। এছাড়া অনেকের মতে সেযুগে খাপের পরিচালক মন্ডলীতে মহিলাদেরও স্থান ছিল যা এখন একেবারেই নেই। এখন মহিলা ও নীচুজাতির লোকেদের খাপের সভায় কোনো জায়গা নেই অথচ খাপের অধিকাংশ ফতোয়া,বিধিনিষেধই তাদের বিরুদ্ধে!

    আধুনিক কালে খাপের অন্তর্ভুক্ত স্বতন্ত্র গ্রামগুলি পরিচালনার জন্য নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত থাকে আর পাঁচটা গ্রামের মতো। দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতই নির্বাচিত কোনো একটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি সদস্যরা থাকে পঞ্চায়েতে। একই খাপের ছেলে মেয়ে বিয়ে করে খাপের নিয়ম ভঙ্গ করলে তাদের বিচারে বসে দুই গ্রামের খাপ নেতারা। গ্রামের অন্য সমস্যাও সেই গ্রামেরই খাপ নেতারা সমাধান করে, খুব বেশী জটিল হলে অন্যান্য খাপের নেতাদের ডাকা হয়, পরামর্শ নেওয়া হয়। খাপের নেতা বা মিডিয়ার ভাষায় খাপ পঞ্চায়েত যারা,তারা গ্রামবাসীর দ্বারা নির্বাচিত হয়না, বংশানুক্রমে বা বিত্ত প্রতিপত্তি অনুযায়ী এরা খাপের নেতা নির্বাচিত হয়। অতএব এখনের সামাজিক কাঠামোয় এই প্রথাটিকে সঠিক মানে গণতান্ত্রিক বললে গণতন্ত্র নিয়েই প্রশ্ন করতে হয়!

    খাপের অধিবাসীদের মতে মিডিয়া যেমন খাপের ভেতর অনার কিলিংয়ের রিপোর্ট করে ঠিক করছে, তেমনিই কিছু "গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল" গোছের নেতাদের খাপ লীডার বলে প্রচারের আলোকে নিয়ে আসছে, তাদের বদমাইশীতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। খাপ অনেক আছে, সব খাপই এরকম গোঁড়া অনুন্নত নয়, আজকাল অনেক খাপ নিজেদের নিয়ম কানুন সময়ের সাথে শিথিল করে সমাজের মূল স্রোতে মিশে গেছে। অনার কিলিং, কন্যাসন্তানদের প্রতি নানারকম অন্যায় সামাজিক বাধানিষেধ, কন্যা ভ্রুন হত্যা যার ফলে এইসব অঞ্চলে বিশেষ করে হরিয়ানায় সেক্স রেশিওর দুরবস্থা, জাতপাতের ভেদাভেদ, নীচু জাত দলিতদের উপর অত্যাচার - এসব নানা সমস্যায় জর্জরিত এই খাপ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি। এসবেরই ফায়দা তুলছে কিছু প্রভাবশালী লোক, খাপের নাম করে। এখন খাপ প্রথার জন্য এইসব নানা সমস্যা না কি এই সমস্যাগুলি সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে খাপ পঞ্চায়েতের এত বাড়বাড়ন্ত তা হল প্রায় সেই মুরগী ও ডিমের তর্কেরই সমান!

    খাপের নানা কর্মকান্ডের রিপোর্টে নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েতের কোনো উল্লেখ হয়না কোথাও। অথচ আজকাল অনেক শিক্ষিত যুবক রাজনীতিক রা এই দায়িত্বে আছে। যেরকম নরিন্দরের গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান মধ্য তিরিশের একজন উকিল। তাহলে যখন খাপ থেকে কোনো ফতোয়া বা নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তা পালন করতে গিয়ে অপরাধ সংঘটিত হয় তখন গ্রামের পঞ্চায়েত কি চুপ করে থাকে? তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা, আর্থিক ও প্রশাসনিক, তারা গ্রামের মানুষের ভোটে পঞ্চায়েত হয়েছে। তারা কেন খাপ পঞ্চায়েতকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনা? খাপের এইসব নানা কুকীর্তি প্রসঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েতের ভূমিকা একটা বড় প্রশ্ন। হয় তারা নির্বাক দর্শক নাহলে গ্রামবাসীদের কথা মেনে নিয়ে বলা যায় তারাও এই খাপ পঞ্চায়েতের স্বেচ্ছাচারিতার অংশ। তাহলে যেসব রাজনৈতিক দলকে তারা প্রতিনিধিত্ব করছে সেসব দল নিজেদের দায়িত্ব এড়ায় কি ভাবে!

    আজকের যুগে খাপের প্রাসঙ্গিকতা বা যৌক্তিকতা নিয়েও অনেকে সঠিকভাবেই সন্দেহ প্রকাশ করছে। আগেকার দিনে একটি গ্রামে বা এলাকার সমস্ত গ্রামে একই গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস ছিল পুরুষানুক্রমে। তাদের মধ্যে বিবাহসম্বন্ধ নিয়ে যেসব নিয়মকানুন তদানীন্তন সমাজ স্থির করেছিল তা আজকের দিনে খাটে না এজন্য কারণ আজকের গ্রাম আর সেদিনের গ্রাম নেই। দিল্লী, হরিয়ানা এসব জায়গায় শহর আর গ্রামের সীমানা বেশ আবছা।শিল্পের বিকাশের জন্য অনেক গ্রামই আজ শহরাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তার ফলে সেখানে এখন এক বা একাধিক খাপ নির্দিষ্ট বিশেষ সম্প্রদায়গুলো ছাড়া বহিরাগতদেরও বসবাস, যারা কোনোভাবেই গ্রামের আদি বাসিন্দাদের নিয়ম কানুনের দায়রায় আসতে পারেনা। এভাবে আজ এইসব গ্রামের সমাজ এক মিশ্র সমাজ যা কখনোই প্রাচীন নিয়মে একই গোষ্ঠী বা খাপের অধীন বা তাদের ভাই বিরাদর হতে পারেনা।

    ঝাজ্ঝরের ধরানা গ্রামের গেহলট জাতের রবীন্দর বিয়ে করেছিল পানিপতের সিওয়া গ্রামের শিল্পাকে যে কডীয়াঁ জাতের। এরা কোনো ভাবেই এক খাপের নয়। খাপ পঞ্চায়েত রায় দেয় যেহেতু শিল্পার কিছু আত্মীয় এ গ্রামে বাস করে তাই শিল্পা আর রবীন্দর ভাই বোন ও তাদের বিয়ে খাপ আইনবিরুদ্ধ। শাস্তিস্বরূপ বিয়ে নাকচ হয়ে যায় ও রবীন্দরের পুরো পরিবারকে গ্রাম থেকে নির্বাসিত করা হয়। রবীন্দর আত্মহত্যা করতে গিয়ে বিফল হয়ে শেষে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দূরে এক আত্মীয়ের গ্রামে থাকতে বাধ্য হয়।

    আপাতদৃষ্টিতে খাপের এসব রায় তালিবানী, শিবঠাকুরের আপন দেশের আইন মনে হলেও এর মধ্যে অনেকসময়ই সুক্ষ্ম গ্রাম্য রাজনীতি থাকে, সম্পত্তি জমিজমার ব্যাপার থাকে। এমনও হয় যে এক পরিবারের সঙ্গে কোনো আরেকজনের জমিজমা সংক্রান্ত গোলযোগ চলছে, বা কোনো কারণে এদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে কারো লাভ আছে। তখন সেই পক্ষ খাপেদের টাকা খাইয়ে কোনো একটা ধুয়ো তুলে এই রায় বার করে। হয় নির্বাসিত করে নয় সামাজিক বয়কট করে জমিতে চাষ আবাদ করতে দেওয়া হয়না। এভাবে এদের জমিজমা সম্পত্তি কব্জা করতে সুবিধে হয়।অনেকক্ষেত্রেই খাপের আদালত ও তার রায় এরকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়, কিন্তু খাপ নেতারা প্রভাবশালী হয়, তাদের মাথার ওপর রাজনৈতিক নেতাদের হাত থাকে, পুলিশ তাদের সহায়, তাই সব জেনেশুনেও লোকে চুপচাপ সব মেনে নিতে বাধ্য হয়।

    আসলে খাপের যেসব কর্তাব্যক্তি বা মাথা হয় তাদের প্রভাব নিজেদের খাপের মধ্যে প্রচুর, অনেকটা কিছু ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের মত। তাই খাপের নেতা যাকে সমর্থন দেবে সেই রাজনৈতিক নেতা বা দল সেই খাপের লোকেদের ভোট পাবে। সেকারণে রাজনৈতিক দলের পক্ষে খাপ পদ্ধতির বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠানো বিশেষ করে যে সব এলাকায় খাপ প্রথা আছে সেখানকার নেতাদের পক্ষে খুবই মুশকিল। বেচারা নবীন জিন্দল যে পার্লামেন্টে ইয়াং ব্রিগেডের একজন, বিদেশে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবনেতা, এম পি, তাকেও খাপনেতাদের সুরে সুর মিলিয়ে স্বগোত্র বিয়ে আইন করে বন্ধ করার দাবী করতে হয়, শুধু নিজের ভোটব্যাঙ্কের জন্য।

    খাপ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী চৌতালা ( চৌতালা হরিয়ানার একটি প্রভাবশালী খাপ) বা নবীন জিন্দলের মতো মাটির কাছের লোক ছাড়া এতদিন প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ছোটবড় নেতারাই একটা "ধরি মাছ না ছুঁই পানি" ধরণের অবস্থান নিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে মিডিয়া প্রচারের তাড়াতে অনার কিলিং নিয়ে এরা হাল্কা নিন্দে গোছের করেছে বটে তবে বেশীরভাগই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু মিডিয়ায় জিন্দলের স্বগোত্র বিয়ে বন্ধ করার খাপেদের দাবীকে খোলা সমর্থন দেওয়ার পরে সরকারপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে। নবীন নেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশের ছিছিক্কারে বিব্রত সরকার এখন ড্যামেজ কনট্রোল মোডে। এর জেরেই রাজ্যসভায় জোরালো বক্তব্য রেখেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অনার কিলিংয়ের বিপক্ষে। এ নিয়ে নতুন আইন আনার জন্য একটি জিওএম (গ্রুপ অফ মিনিস্টার) গঠন করা হয়েছে। সংসদের বর্ষাকালীন সভাতেই এই বিল আনার চেষ্টা করবে সরকার।

    নতুন আইনে এধরণের অপরাধ যা খাপ পঞ্চায়েতের নির্দেশে সংঘটিত হবে তার জন্য খাপ নেতারাও শাস্তি পাবে অপরাধীর সহায়ক হিসেবে। যদি খাপের সব সদস্যরা এতে জড়িত নাও থাকে তাহলেও। এভাবেই খাপ প্রথাকে নিরুৎসাহ করা হবে। এছাড়া যেখানে ছেলেমেয়েরা এভাবে পরিবারের বা খাপের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করবে কোর্টে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক একমাসের নোটিশ পিরিয়ড দরকার হবেনা। স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টের জোরে তারা তৎক্ষনাৎ বিয়ে করতে পারবে।

    যাকে হিন্দীতে বলে "দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে"।

    এদিকে কিছুদিন আগেই রোহতকের মেহমে সর্ব জাঠ সর্বখাপ মহাপঞ্চায়েতের একটি মহাসভা হয়ে গেল, জাঠেদের প্রায় শখানেক খাপের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে। এই সভায় তারা সরকারের কাছে বেশ কয়েক দফা নতুন দাবী রেখেছে। স্বগোত্র বিবাহ আইন করে ব্যান করার পুরনো দাবীর সাথে যোগ হয়েছে নতুন দাবী; খাপের অনার কিলিংয়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকার কোনো আইন আনতে পারবেনা। এছাড়া, হোমোসেক্সুয়ালিটী, সারোগেট মাদারহুড, এমব্রিও ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট ইত্যাদি সামাজিক ব্যাভিচার (খাপের ভাষায়) আইন করে বন্ধ করতে হবে! ছেলেমেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়সও কমিয়ে সতের/পনের বছর করতে হবে, যাতে বড় হয়ে অসামাজিক প্রেমটেম করার আগেই ধরে ধরে সবার বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায়!

    সরকারকে একটি কালচারাল মিনিস্ট্রী খুলে তার অধীনে স্কুলে স্কুলে ছেলেমেয়েদের চরিত্র গঠন (! )করতে হবে। পর্ণোগ্রাফিক অ্যাড, লিটারেচার (অবশ্যই এই ধরণের লেবেলের আওতায় কি বা কারা আসবে তাও মহামাণ্য খাপই ঠিক করবে আর কি!) এসবে জড়িত লোকজনকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আর সর্বোপরি, খাপের লোক আদালত (স্বেচ্ছাচারীতা)কে মান্যতা দিতে হবে। নাহলেই খাপেরা মহা আন্দোলন শুরু করবে, যার প্রারম্ভ হবে একুশে ডিসেম্বরে হরিয়ানা রাজ্যে চাক্কা জ্যাম করে!এই মহাসভায় হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতারাও যোগ দেন ও এইসব দাবীদাওয়ার পক্ষে নিজেদের সমর্থন জাহির করেন!

    খোদ রাজধানীর আশেপাশের এলাকাতে এইসব খাপেদের জোর সর্বাপেক্ষা বেশী, তাই অনায়াসে এরা সরকারকে নানা ব্ল্যাকমেলের ভয় দেখিয়ে যেতে পারে। তাই অন্তত কিছু দাবীদাওয়া অবিলম্বে না মানা হলে কমনওয়েলথের সময় গন্ডগোল পাকানোর হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে আদ্যিকালের "মগের মুলুক" কথাটা উঠে গিয়ে "খাপের মুলুক" চালু হলেও আশ্‌চর্য হওয়ার কিছুই থাকবেনা!

    কাজেই সরকারের পক্ষে খাপের বিরুদ্ধে আইন আনাটা এত সহজ হবেনা। যদিও চিদাম্বরম সংসদে আবার বড় গলা করে বলেছেন যে এই অধিবেশনেই অনার কিলিং বা এসম্বন্ধীয় অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধে আইন আসবে তবু তিনিও তার মন্তব্যে খাপের উল্লেখ সযতনে এড়িয়ে গেছেন। তাও ধরা যাক আইন হল সব হল, তাহলেই কি এ সমস্যার সমাধান হয়ে গেল?

    খাপ বাসিন্দাদের বক্তব্য যে তারা এদেশের বিচারব্যবস্থার ফেরে কোর্টে চক্কর খেয়ে খেয়ে নিরাশ হয়ে চটজলদি রায়ের জন্য খাপ পঞ্চায়েতের কাছে যায়। যে পরিবারের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে রদ করার বা তাদের শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ খাপ দেয়, পরিবারের লোক তা পালন না করলে অন্য সদস্যদের ওপরও নেমে আসে খাপের রোষ। তখন তাদের বাঁচাবার জন্য সরকারী যন্ত্র কোনো সাহায্যই করেনা। স্থানীয় কোর্ট বা পুলিশও খাপের রায় বা মীমাংসাকে মেনে নেয়, কারণ সেখানে যারা বসে আছে তারাও কোন না কোন খাপের লোক।

    বাবলি মনোজের কেসের মতই বেদপাল সোনিয়ার কেসে খাপের বিরুদ্ধে কারনাল কোর্টের রায় সাড়া জাগিয়েছিল। এই কেসে ২০০৯ এ পাঞ্জাব হরিয়ানা হাইকোর্টে হিউম্যান রাইটস ইনটারন্যাশনালের লইয়ারদের খাপের বিরুদ্ধে পি আই এল এর বয়ান থেকে বোঝা যায় পুলিশ প্রশাসন খাপের কাছে কতটা অসহায় । কৈঠাল জেলার মাতোর গ্রামের বেদপাল বিয়ে করে জিন্দ জেলার সিঙ্ঘওয়ালের সোনিয়াকে। এদের গোত্র ছিল এক, জানাজানি হলে এই গোত্রের খাপের মাথারা এক হয়ে এদের বিয়েকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। সোনিয়াকে জোর করে তার বাপের বাড়িতে আটকে রাখে তার পরিবারের লোকে। বেদপাল কোর্টে অ্যাপীল করলে, কোর্টের অর্ডারে একজন ওয়ারেন্ট অফিসার ও প্রায় জনা পনের পুলিশ কর্মী সাথে নিয়ে যায় সোনিয়াকে উদ্ধার করতে। গ্রামবাসী ও সোনিয়ার পরিবার বেদপালকে মেরে ফেলে, ওয়ারেন্ট অফিসারটিও গুরুতর আহত হয়। দেখেশুনে পুলিশ পালায় নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে। অতএব দেখা যাচ্ছে সমাজে খাপ শাসনের আধিপত্যে পরোক্ষ ভাবে হলেও এইসব এলাকায় সরকারের নানা বিভাগের দায়িত্বপালনে ঘাটতি বা উদাসীনতার একটা বড় হাত আছে।

    লক্ষ্যনীয় বিষয় হল খাপ রায় দিলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আসল অপরাধ সম্পাদন করে পরিবারের লোকজন অন্যান্য অনার কিলিংয়ের মতই। মনোজ বাবলি কেসে পাঁচজন অভিযুক্ত হল বাবলির পরিবারের লোক। অভিযোগ খাপে বা গোষ্ঠীর নেতাদের কাছে নিয়ে যায়ও মেয়েটী অথবা ছেলেটীর পরিবার। কোনো কোনো পরিবার খাপের চাপে পড়ে নিজেদের সন্তানদের শাস্তি দিলেও, অনেকেই কোন প্ররোচনা ছাড়াই শুধু নিজেদের বিশ্বাস থেকে এধরণের কাজ করে থাকে, দেশের খাপরহিত অঞ্চলের অনার কিলিংয়ের মত, খাপ এক্ষেত্রে বাহানা মাত্র। আসল সমস্যাটা হচ্ছে এখনো আমাদের ভারতীয়দের অনেকের মনে জাতপাত কুসংস্কারের আঁধার এতই গাঢ় যে শিক্ষার আলোও সে আঁধার দুর করতে পারছেনা। তাই খাপের অনেক শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত অধিবাসীরা যারা বর্তমানে উচ্চপদস্থ,বড় বড় সংস্থার মাথা বা রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী সদস্য, তারাও স্বগোত্রে বিবাহ অনুচিত মনে করে ও খাপ পঞ্চায়েতের প্রদত্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিকে সমর্থন করে থাকে। খাপের অন্তর্গত সাধারণ লোকেদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায় যদিও তারা এভাবে হত্যা করাটাকে সমর্থন করেনা, কিন্তু খাপের সন্মান, পরস্পরের ভাইচারা এসব সম্বন্ধে তাদের কোনো দ্বিমত নেই। অনেক খাপে তো আবার নিজেদের খাপ ছেড়ে মা ঠাকুমার দিকের খাপেও বিয়ে হয়না। এসবই নাকি জিনের বা বংশের শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য। জাঠ মজদুর থেকে শুরু করে গুর্জর ইঞ্জিনীয়রও খাপের নিয়ম কতটা বিজ্ঞানসম্মত, ডিএন এ টেস্ট ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে। খাপনেতাদের প্রচার ও এসব এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর তাদের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। অথচ এর বিপক্ষে,এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সাধারণের মাঝে সরকার বা অন্য সংস্থার সেরকম কোনো প্রচার গড়ে ওঠেনি। আমজনতা যাদের কথা শোনে সেসব নেতারাও এপ্রসঙ্গে প্রায় নীরব।

    তাই খাপের কেন্দ্রে যারা আছে, সেই ভুক্তভোগীরা,জাতনির্বিশেষে খাপের সাধারণ বাসিন্দারা, তারা যতদিন না সরব হবে, এই মধ্যযুগীয় প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, আজকের যুগে এসব ধ্যান ধারণার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নিজেদের কাছে প্রশ্ন তুলবে, ততদিন কোনো আইন আদালতই এধরণের সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয়না।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ৩০ আগস্ট ২০১০ | ১০২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন