নীলাঞ্জন হাজরা — আগের দিন তুমি শেষ করেছিলে বটসোয়ানার জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ হাতির পালের মধ্যে পড়ে যাওয়ার বর্ণনা দিতে দিতে, কীভাবে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা তোমায় রক্ষা করেছিল সেপ্রসঙ্গে চলে গিয়ে। এবার ঘটনাটা বলো।
জয়ন্ত মণ্ডল — হ্যাঁ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দু-পাশে আফ্রিকান হাতির পাল। ত্রিসীমানায় কেউ কোত্থাও নেই। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে সাইকেল ছোটাচ্ছি। এমন সময় বহু দূরে দেখলাম একটা আলো আমার দিকে আসছে। তোমার মনে আছে বোধহয়, একটা হাতিকে রাস্তায় দেখে আমি সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে উলটো দিকে ছুটছিলাম। মানে যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিকেই ফিরে যাচ্ছি। একটু পরেই বুঝতে পারলাম, একটা ট্রাক। কাছে এসে গেছে যখন দু-বার তিনবার ব্লিঙ্ক করল, আমি তখন রাস্তার একদম মাঝখান দিয়ে চলেছি ইচ্ছে করে। আমিও আমার টর্চটা দেখালাম। তো ট্রাকটা একেবারে আমার সামনে এসে থামল। বিশাল একটা ১৮ চাকার ট্রাক। খালি। আর আমি কিছু বলার আগেই ট্রাকের ড্রাইভার ভদ্রলোক আমাকে বলল, তোমার ব্যাপারটা কী, সুইসাইড করতে চাইছ নাকি? তা আমি বললাম, খুব বিপদে পড়েছি। সাইকেলে করে যাচ্ছিলাম। সামনে হাতির পাল আছে। তুমি প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করো, আমাকে ট্রাকে তুলে নাও। তাতে ও বলল, তুমি যাচ্ছ কোথায়? ওদিকেও তো হাতি। আমিই তো রাস্তায় আটকে গিয়েছিলাম। হাতির পাল। তা আমি আবার বললাম। বলে, টাকা লাগবে। বললাম, টাকা দেব। কত টাকা বলো? ২০ কোয়াচা চাইল। কোয়াচা হল জাম্বিয়ান টাকা। আমি বললাম, অত টাকা তো আমার নেই। তখন বলে, তাহলে তুমি সাইকেলে চড়েই যাও। আমি বললাম, না-না-না-না। প্লিজ, এমনি কোরো না। আমার কাছে সত্যিই অত টাকা নেই, থাকলে ঠিক দিয়ে দিতাম। সে কিছুতেই নেবে না। ট্রাকের এঞ্জিনও বন্ধ করেনি তখনও। বলল, ঠিক আছে, গুড-বাই। আমার সময় নষ্ট কোরো না। শেষে বাধ্য হয়েই বললাম, না-না, আমার কাছে যা শেষ সম্বল আছে তাই দিয়ে দেব। তুমি আমাকে তুলে নাও।
তা সেই শুনে সে বাইরে নেমে, তাড়াতাড়ি আমার সাইকেলটাকে দু-হাতে তুলে ট্রাকের পিছনে ছুড়ে দিল। সেটা দড়াম করে গিয়ে ভিতরে পড়ল, আর আমার মনে হল যেন আমারই হাড়গোড়গুলো ভেঙে গেল। সাইকেলটাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। একটা নামও দিয়েছিলাম—লিট্ল কুইন। ভীষণ ভালোবাসতাম। কোথাও কাদাজল থাকলে, কাঁধে তুলে সেই জায়গাটা সাইকেলটাকে পার করাতাম। একেবারে টিপটপ রাখতাম।
তা যাই হোক, তারপরে তো আমি ওর পাশে উঠে পড়লাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। কথা শুরু হল। প্রথমেই শুরু করল, তোমরা ভারতীয়রা এত কিপটে কেন বলো তো? আমি বললাম, তুমি জানলে কী করে যে আমি ইন্ডিয়ান? বলল, আমি হাড়ে হাড়ে চিনি ইন্ডিয়ানদের। আমি দেখেছি আমাদের দেশটা চালায় ভারতীয়রা। লুসাকায় যেখানে আমাদের দেশের মন্ত্রী-সান্ত্রিরা থাকে, প্রেসিডেন্ট কোন্ডা থাকে, তার আশেপাশে, সেই পাড়াতে সব ভারতীয়রা থাকে। তুমি আমাদের প্রেসিডেন্টকে জান? বললাম, জানি। কেনেথ কোন্ডা। বলল, তার বাড়ির পাশেই কয়েকজন ভারতীয় থাকে, তাদের মধ্যে একজন আবার কোন্ডার জ্যোতিষী—মিস্টার প্যাটেল। বললাম, হ্যাঁ-হ্যাঁ আমি দেখা করেছি মিস্টার প্যাটেলের সঙ্গে। তখন বলছে, তারা দেখবে, শুধু গাড়িই চড়ে না, রোল্স রয়েস চড়ে, মার্সিডিজ চড়ে, ভলভো চড়ে। তা আমি বললাম, আমি ভারতীয় ঠিকই, কিন্তু এখানের ভারতীয় নই। আই অ্যাম অ্যান ইন্ডিয়ান ফ্রম ইন্ডিয়া। ভদ্রলোক লুসাকার মানুষ। জাম্বিয়া থেকে বটসোয়ানায় যাচ্ছে, মাল বোঝাই করে ফিরে যাবে। বলল, সে আবার কী? আর তুমি বাইসাইকেল চড়ে এত দূরে যাচ্ছ, কেন? তোমার টাকা নেই?
তো ভারতীয়রা কীভাবে ১৫০-২০০ বছর আগে রেললাইন পাততে শ্রমিক হয়ে এখানে এসেছিল তাই নিয়ে আমি ওনাকে একটা ছোটোখাটো লেকচার দিয়েদিলাম। বললাম, কিন্তু আমি সেই পরম্পরার ভারতীয় নই। আমি অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়েছি। সাইকেলে চড়ে দুনিয়া ঘুরছি। তখন বলে, মাই গড! রিমার্কেবল! তারপর কিছুক্ষণ পরে বলল, বিয়ার খাবে? বললাম, কিন্তু আমার তো টাকা নেই! বলল, না-না-না-না। আমি তোমাকে খাওয়াচ্ছি। পিছনে দেখ, বিয়ার রাখা আছে। এই বড়ো ট্রাকগুলোয় ড্রাইভারের সিটের পিছনে একটা ক্যাবিনের মতো থাকে, বাংকে ঘুমানোর ব্যবস্থা থাকে। সেখানে বিয়ার ছিল। তো আমি একটা বিয়ার নিলাম। দেখি সেটার নাম সিম্বা! আর তাতে ৪০ শতাংশ অ্যালকোহল! সেই একটা বিয়ার খেয়েই, বুঝলে, আমি ঘুমে ঢুলতে শুরু করলাম। ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। বসে বসেই ঢুলতে লাগলাম।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, অন্ধকার। আর সামনে ছোটো ছোটো মণির মতো আলো জ্বলছে, অজস্র। কী ব্যাপার?
নী.হা. — হরিণের পাল?
জ.ম. — তারপর ও গাড়ির হেড-লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। দেখি, কয়েকশো জংলি কুকুর—ওয়াইল্ড ডগ্স! আমি বললাম, দাঁড়াও-দাঁড়াও-দাঁড়াও! তো উনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি ঠিক করলাম, ছবি তুলতেই হবে। ক্যামেরা তো পিছনে, সাইকেলের ব্যাগে। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে নামতে যাচ্ছি, ভদ্রলোক সিট থেকে একলাফ মেরে আমার কলারটা ধরে হিঁচড়ে আমাকে ভেতরে তুলে নিলেন। বললেন, ইফ ইউ গো ডাউন, ইউ আর ডেড মিট! তোমায় মরতেও দেবে না, জান না, জংলি কুকুররা শিকার মরতে দেয় না, মরার আগেই খেতে শুরু করে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে!
নী. হা. — ঠিক। এটা আমি জানি। আমার কাছে একটা বই আছে, Killers of the Wild, তাতে আছে ওয়াইল্ড ডগ্স নিজের শিকারকে দলে দলে আক্রমণ করে, আর মরার আগেই খুবলে খুবলে খেতে শুরু করে।
আফ্রিকায় উইল্ডাবিস্ট-কে শিকার করছে বুনো কুকুরের পাল
জ.ম. — তুমি বিশ্বাস করবে না, যে লোকটা ওই হাতির পালের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিল আমার সাইকেল তুলে দিতে, তার মুখে আমি কী ভয়ের ছায়া দেখেছিলাম। বর্ণনা করতে পারব না। আর সেই ভয়ার্ত মুখ দেখে, আমার হঠাৎ মনে হল, এই ভদ্রলোককে নির্ঘাৎ তিনিই পাঠিয়েছেন। তিনি মানে বুঝতে পারছ তো! আমি আর নামলাম না। কিন্তু মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মাই গড! যদি হাতিটাকে না দেখতে পেতাম। আমি তো সাইকেল চালিয়েই যেতাম। আর হয়তো এই বন্য কুকুরের পালের মধ্যে গিয়ে পড়তাম।
নী.হা. — অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলে।
জ.ম. — একদম। সেইখানেই আমার ওয়ার্ল্ড ট্যুর শেষ হয়ে যেত।
নী.হা. — জয়ন্তকাকু, তুমি আফ্রিকার ৪৯ টা দেশ যে ঘুরলে সেটা ক-দফায়?
জ.ম. — দ্যাখো, আমার প্রথম দফাটা ছিল ১৯৭৬-এর নভেম্বরের শেষ থেকে ১৯৭৮ সালের মার্চ। একটা অ্যাকসিডেন্টে হাঁটুতে চোট পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল ভারতে। অপারেশন করাতে হয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় ঢুকেছিলাম ইজরাল থেকে ইজিপ্টে, মানে উত্তর আফ্রিকা, ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সেবছরেরই মে-জুন পর্যন্ত। তারপর আফ্রিকা ছাড়ার কারণ, মস্কো অলিম্পিক্স কভার করতে চলে গিয়েছিলাম রাশিয়া। আর তৃতীয় দফায় গেলাম লিবিয়া থেকে অ্যালজেরিয়া, মরক্কো ইত্যাদি, ১৯৮১-র ডিসেম্বর থেকে ১৯৮২-র মার্চ।
নী.হা. — হাঁটুতে অপারেশন করা মানে তো ভালো রকমের চোট পেয়েছিলে, কী হয়েছিল?
জ.ম. — তানজ়ানিয়ায় একটা ট্রাক ধাক্কা মেরেছিল। খুব জোরে যে মেরেছিল তা নয়, মামুলি, কিন্তু আমি গড়িয়ে গিয়ে একটা খালে পড়ে গেলাম। তারপরে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওখানেই হাসপাতালে ভরতি করা হয়। ১৯৭৭ সালে। কিন্তু আমি দেশে ফিরি ১৯৭৮-এ। কারণ তারপরেও আমি অনেকদিন সাইক্লিং করেছিলাম। কিন্তু চোটটা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তারপর একজন ডাক্তার বললেন, তোমার হাঁটুতে অপারেশন করতে হবে। তারপর আমি মুম্বই ফিরি। আমার ভাগ্যই বলব, অপারেশনটা হল নেভি-র একটা হাসপাতালে মুম্বইতেই। তখন চিফ অফ নেভাল স্টাফ ছিলেন অ্যাডমিরাল জাল কারসেটজি। তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে তাঁদের দিল্লির বাড়িতে আমি আফ্রিকা ট্যুর নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম। তা উনি বললেন, তুমি আমার সেনাকর্মীদের জন্যও একটা লেকচার দাও। দিলাম, আইএনএস ইন্ডিয়ার অডিটোরিয়ামে। তারপর আমি ওনাকে অনুরোধ করি যে আমার হাঁটুতে অপারেশন করা দরকার, যদি সাহায্য পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে উনি ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। খুব ভালো অপারেশন করেছিলেন ডক্টর ফিলিপ কোশি।
নী.হা. — বেশ। আফ্রিকা প্রসঙ্গে ফিরি। এই যে এত বড়ো একটা মহাদেশ তুমি ঘুরলে, যেমনটা দুনিয়ার খুব কম মানুষই ঘুরেছে, তোমার চোখে সব থেকে অবাক-করা কী লেগেছিল?
জ.ম. — দুটো জিনিস—মেয়েদের চুলের স্টাইল। আর মহিলাদের পরিশ্রম করার ক্ষমতা। তুমি কখনও আফ্রিকান মেয়েদের চুলের স্টাইল লক্ষ করেছ? একেবারে অনন্য! আর দেখেছিলাম, আমাদের দেশের মতোই সেটা করে দেন বাড়িরই অন্য মহিলারা—গরম শিক দিয়ে চুল গরম করে, টেনে টেনে বেঁধে, অদ্ভুত সমস্ত স্টাইল! আর কী পরিশ্রমী! মনে আছে উগান্ডাতে এক রাতে আদিবাসীদের একটা গ্রামে ছিলাম। তো এক মহিলা ভোররাত্রিতে বাচ্চা প্রসব করলেন, আর বেলা এগারোটার মধ্যে দেখি মাঠে গিয়ে কাজ করছেন!
নী.হা. — তুমি এই যে সম্পূর্ণ অজানা, অপরিচিত দুনিয়ায় হঠাৎ করে এক-একটা গ্রামে হাজির হয়ে সেখানেই থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলতে, এটা হত কী করে… চেনা নেই জানা নেই…।
জ.ম. — দ্যাখো, তোমাকে আগেও বলেছি, আমি দেখেছি সারা দুনিয়াতেই, মানুষ সাধারণ ভাবে খুব হেল্পফুল, সাহায্য করে। ভাষা তো জানি না, হাত-পা নেড়ে বোঝাতাম, রাত্রে একটা শোবার জায়গা চাইছি, বা একটু খাবার পাওয়া গেলে ভালো হয়। তো মানুষ সাহায্য করেছে। কিছু কিছু জায়গায় হয়তো প্রথমে একটু অসুবিধা হয়েছে। একবার তো খুব মারধোরও খেয়েছিলাম। ক্যামেরা কাড়িয়ে নিয়েছিল…
(ক্রমশ। পরের কিস্তি পড়ুন ১৪ জানুয়ারি)
অপূর্ব