নীলাঞ্জন হাজরা — আগের দিন তুমি বলছিলে পথে পথে তোমার যেমন অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েছে, তেমনই আবার মার খেতে খেতেও কোনোক্রমে বেঁচেছ। বলছিলে একবার ক্যামেরাও কেড়ে নিয়েছিল। এটা কোথায়?
জয়ন্ত মণ্ডল — উগান্ডাতে, বুঝলে। কেনিয়া থেকে উগান্ডাতে ঢুকছি। প্রথমেই যে জায়গাটাতে পৌঁছলাম তার নাম ম্বালে, বুঝলে, Mbale। বিকেল বিকেল ঢুকেছি, একটা বাড়ি পড়ল, দেখি তার সামনে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকেই জিজ্ঞেস করছি, একটু থাকার জায়গা হতে পারে কি না। তখনও মনমোহন ছিল আমার সঙ্গে। উনি আমাদের ভিতরে আসতে বললেন, ওনার স্ত্রী চা নিয়ে এলেন। তো কথায় কথায় উনি বললেন, আমাদের এখানে একজন ভারতীয় শিক্ষক আছেন। বললাম, দেখা হলে খুব ভালো হয়। ফোন করা হল। মিনিট দশেকের মধ্যেই তিনি এলেন। সাইকেলটা দেখলেন—তাতে তো লেখা আছে, ওয়ার্ল্ড সাইকেল ট্যুরিস্ট, ক্যালকাটা, ইন্ডিয়া। দেখেই বললেন, আরি! বাঙালি! কমলদা। কমল রায়। তেরো বছরের ওপরে আছেন। উগান্ডারই নাগরিক হয়ে গেছেন। ওঁর স্ত্রীও ওখানে শিক্ষক। তাঁর বাড়িতেই উঠলাম। তো আমি মাঝে মাঝে একাই বেরিয়ে পড়তাম, আশপাশের সব গ্রামে-টামে যেতাম। তেমনই একদিন। একটা গ্রামে গেছি। দেখি খুব নাচ-গান হচ্ছে। একটা দল। রাস্তায়। অদ্ভুত সব আফ্রিকান বাজনা বাজাচ্ছে। আর সকলে নাচছে। আর জানো তো, আফ্রিকানদের ছন্দ-বোধ সাংঘাতিক। একটু যদি কোথাও বাজনা শোনে, কোনো দ্বিধা না করে নাচতে শুরু করে। আফ্রিকার সব দেশে এটা দেখেছি।
তো, আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছি। তারপর ছবি তুলতে আরম্ভ করেছি। দলটার একেবারে সামনে ছিল একটি এগারো-বারো বছরের মেয়ে। আমি ছবি তুলছি। হঠাৎ দলের মধ্যে থেকে একটি ছেলে সাংঘাতিক ক্রুদ্ধ মুখে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যামেরাটা ছিনিয়ে নিয়ে সপাটে আমাকে একটা থাপ্পড় মারল। তারপরেই অন্যরা এসে কিল-চড় মারতে শুরু করল। আর শুধু দেখছি আঙুলটা মেয়েটার দিকে দেখাচ্ছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। চুপ করে সহ্য করে যাচ্ছি। ইংরেজিতে দু-একটা কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিছুই বুঝছে না কেউ। ঠিক এই সময়, রাস্তা দিয়ে সাইকেল নিয়ে এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। স্যুট পরে, মাথায় টুপি। এটাও সেসময় আফ্রিকাতে দেখেছিলাম বেশ অবাক হয়ে। দিনের বেলা দেখেছি, মাঠে কাজ করছে, গাঁইতি নিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা, টিপ-টপ। কালো স্যুট, মাথায় টুপি, হাতে ছাতা নয়তো ছড়ি। যাবে কোথায়? বারে। বারে কী খাবে? শুধু বিয়ার! আফ্রিকানদের মদ্যপান মানে বিয়ার খাওয়া। যাই হোক, সে ভদ্রলোকটিকে তো আমি বললাম, প্লিজ হেল্প মি। তো উনি সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ালেন। কী হয়েছে? বললাম, আমি দুনিয়া ঘুরছি সাইকেলে। ইন্ডিয়া থেকে এসেছি। আমি কিচ্ছু বুঝিনি। যদি কিছু অন্যায় করে থাকি আমি খুবই দুঃখিত। আমি ক্ষমা চাইছি। উনি ওদের সঙ্গে কথা বললেন। তারপরে আমাকে বললেন, তুমি অন্যায় তো করেছ। এই যে উৎসবটা হচ্ছে, এটার পর এই মেয়েটিকে ‘সারকামসাইজ’ করা হবে! আমি তো অবাক। বললেন, হ্যাঁ। এটাই এখানে পরম্পরাগত রীতি। মেয়েদের বয়ঃসন্ধির সময় এটা করা হয়। তো, উনি আমার হয়ে সেই ছেলেগুলিকে অনেক বোঝানোর পর ব্যাপারটা মিটেছিল। ক্যামেরাও ফেরত পেয়েছিলাম।
উগান্ডার গ্রামে কোনো মহিলার ‘সারকামসিশন’-এর প্রস্তুতি
কিন্তু, জানো, এটাও আমার একটা বড়ো শিক্ষা হল। ফটোগ্রাফার মানেই ছবি তোলার অধিকার নয়। কীসের ছবি তুলছি, কী পরিস্থিতিতে সেটা বুঝতে হবে। মানুষের ভাবাবেগের সম্মান দিতে হবে। তখনও ফটোগ্রাফি আমার পেশা হয়নি। তার আগেই শিখেগেলাম। আমি এখন খুব জোরগলায় বলি, আমি পাপারাৎজো নই। আমি ফটো-জার্নালিস্ট। ফটো তোলা যাবে না যদি নিয়ম হয় কোথাও, তো ফটো তোলা যাবে না, ব্যাস।
নী.হা. — হ্যাঁ! আমি এই সমস্যাটার কথা জানি। তা, আর অন্য কোথাও তোমায় অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল?
মহিলাদের ‘সারকামসিশন’-এর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার
জ. ম. — প্রথমের দিকে, মাসাইদের একটা গ্রামে। তানজানিয়াতে একটা জায়গা আছে, বুঝলে, আরুশা। এই আরুশা থেকে যেতে হয় আফ্রিকার উচ্চতম পর্বত কিলিমাঞ্জারো, আর সেরেঙ্গিটি অভয়ারণ্য। তো সেই অঞ্চলে যখন যাচ্ছি, পথে একটা রাত মাসাইদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। প্রথমদিকে কিন্তু তারা মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ হাবভাব দেখায়নি। গ্রামে কোনো বহিরাগত এসেছে এটা তাদের মোটেই পছন্দ হয়নি। আসলে ব্যাপার কী জানো তো, আমি এটা দেখেও অবাক হয়েছিলাম, যে ওই দেশে ভারতীয় বংশোদ্ভূত যারা আছে তারা স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে একেবারেই মেশে না। আদিবাসীদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই।
এই প্রসঙ্গেই একটা অন্য ঘটনা তোমাকে একটু বলে নিই, তাহলে বুঝবে স্থানীয়দের সঙ্গে এই ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের দূরত্বটা কীরকম, এবং কেন। আমি তখন লেক ভিক্টোরিয়া-র তিরেমোয়াঞ্জা বলে একটা শহরে গেছি। তানজানিয়াতেই। তো মিস্টার সোম বলে এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে তাঁর নিজের কিছু অভিজ্ঞতা বলেছিলেন। তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্ট ছিলেন। তানজানিয়া সরকারের একটা পদে চাকরি করতে গিয়েছিলেন। তো প্রথম প্রথম যখন এসেছেন, একদিন বাজার করতে গেছেন, কিছু স্থানীয় লোক ওঁকে হুমকি দিতে থাকে যে তুমি চলে যাও এখান থেকে, কারণ তুমি এসেছ বলে স্থানীয়রা চাকরি পাচ্ছে না। সোম আমাকে বলেছিলেন, খানিক্ষণ এইভাবে বিরক্ত করার পরে আমি ওদের বুঝিয়ে বলি যে আমার যে কোয়ালিফিকেশন আছে সেটা তোমাদের নেই, তাই তোমরা কাজটা পাওনি। তারপরে মিস্টার সোম বললেন, কিন্তু পরে আমার মনে হল কেন স্থানীয়রা ভারতীয়দের সম্পর্কে এরকম বিরূপ? তো বুঝলে জয়, খুব শিগগিরি আমি একটা জিনিস বুঝলাম। দোষটা এই ভারতীয় বংশোদ্ভূতদেরই। কার্যত তারাই দেশের অর্থনীতিটা চালায়। আমি এমন ঘটনা শুনেছি যে ভারতীয় হিসেবে আমার লজ্জায় মাথাকাটা গেছে। এবং পরে বুঝেছি হ্যাঁ কথাটা মিথ্যে নাও হতে পারে, এরা এমন করতেই পারে। আমি মিস্টার সোমকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন কী এমন করেছে। উনি বললেন, আফ্রিকান একজন এলেন (ভারতীয় একটা দোকানে), কম্বল চাই। তো কম্বল দেখাল। এত দাম। দিয়েদিল। বেঁধে দিল কম্বলটা। বাড়িতে গিয়ে খুলে দেখে ওর মধ্যে চট দিয়ে দিয়েছে! তিনি আবার যখন ছুটে এলেন, (ভারতীয় বংশোদ্ভূত দোকানদার) পুলিশ ডেকে এনে বলছে, দেখ আমাকে ডিস্টার্ব করছে এই লোকটা!
নী. হা. — ইন্ডিয়ানরা এই কাণ্ড করে?
জ. ম. — এই কাণ্ড করেছে। মিস্টার সোম আমাকে একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন। নানাভাবে মানুষকে ঠকায়। এই ভারতীয়দের প্রায় সবাই ব্যবসায়ী, প্রকৃত শিল্পপতি খুবই কম।
নী. হা. — যাই হোক, আমরা মাসাইদের গ্রামের কথা শুনছিলাম…।
জ. ম. — হ্যাঁ। তো ওদের ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ। দেখলাম, সবাই ছ-ফুটেরবেশিলম্বা। আর ছিপছিপে। বুঝতে পারছ। আর আমি তো ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি! দেখলাম অধিকাংশই মেরুন রঙের পোশাক পরে আছে। আর করে কী, লুঙ্গির মতো একটা কাপড় বুক থেকে হাঁটুর একটু নীচ পর্যন্ত পরে। প্রত্যেকের হাতে বল্লম। এটা কিন্তু ১৯৮০র দশকের একেবারে গোড়ার কথা বলছি। এখন অনেক বদলে গেছে। আমি শুনেছি, একটা বয়সে এসে ছেলেদের প্রমাণ করতে হয় যে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। সেটা করা হয় একটা সিংহকে ওই বল্লম দিয়ে মেরে।
মাসাই যোদ্ধার সিংহ শিকার। ১৯৩২। ছবি এ এইচ ওয়ার্ডল অ্যান্ড কোং
একা নয় অবশ্য বড়ো দল থাকে। এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ওরা সিংহটাকে ঘিরে কোণঠাসা করে ফেলে, তারপর ছেড়ে দেয়, মারে না। আমি বহু চেষ্টা করেছিলাম এই ব্যাপারটা দেখার, কিন্তু সম্ভব হয়নি। যাই হোক, ওদের বাড়িগুলো সব মাটির তৈরি। ওড়িশার কোরাপুটে আমি যখন আদিবাসীদের সঙ্গে ছিলাম, ওরকম বাড়ি দেখেছি। বাড়িতে শুয়োর, ছাগল আর গোরু পোষে। আর চারদিকে এমন বেড়া দেওয়া যে সিংহ ঢুকতে পারবে না। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম। সেখানে একজনকে পাওয়া গেল যে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে। সে বলল, এখানে থাকা-টাকা যাবে না। তুমি বহিরাগত। আমি বললাম, আমিও তো মানুষ, তোমাদেরই মতো। শুধু চামড়ার রংটা আলাদা। তারপর দেখি একটা সভা মতো বসল। গ্রামের লোকেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলল। আমি চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরে, বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুমি থাকো। তো সেখানে একটা জিনিসই চোখে পড়েছিল, সকালবেলা গোরুর দুধ দুইল। তারপর একটা তির দিয়ে গোরুটার গলার কাছটা চিরে দিল। যে রক্তটা বার হল সেটা দুধের সঙ্গে মিশিয়ে তারপর খেল। আমাকেও দিল। তো আমি একটু খেলাম যাতে অসম্মান না হয়। কিন্তু বেশি খেতে পারলাম না। তারপরে সেখান থেকে সেরেঙ্গেটি চলে গিয়েছিলাম।
স্বাধীন জিম্বাব্যোয়ের প্রতীকী দীপ প্রোজ্জ্বলিত করছেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মুগাবে। ১৮ এপ্রিল, ১৯৮০
হঠাৎ মনে পড়ল, জানো, এই দফায় আমি আফ্রিকায় একটা খুব বড়ো ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলাম। জিম্বাবোয়ের স্বাধীনতা। ১৯৮০ সালের ১৭-১৮ এপ্রিল রাত্রে এক বিশাল উৎসবে ব্রিটিশ কলোনি রোডেশিয়া স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ জিম্বাবোয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন কানান বানানা, আর প্রথম প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মুগাবে। আর গেস্ট অফ অনারদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্স চার্ল্স, ইন্দিরা গান্ধি, পাকিস্তানের তখনকার মিলিটারি ডিকটেটর জিয়াউল হক। সেই সভা হয়েছিল স্যালিসবেরি শহরে। সেটাই পরে হয় রাজধানী হারারে। সেই সভা কভার করতে গিয়েছিলাম আমি। একটা মজার কথা খুব মনে আছে—জিয়াউল হক খুব চেষ্টা করছিলেন মিসেস গান্ধির সঙ্গে কথা বলতে, আর মিসেস গান্ধি তাকালেনই না একবারও!!
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন ২৮ জানুয়ারি)
অসাধারণ
চলুক ।
এই সিরিজটার জন্য অপেক্ষায় থাকি। নিয়মিত আসুক।
এটাও থেমে গেছে। ২৮ জানুয়ারি আসে নি, আজও আসে নি।
থামেনি। সামনের সপ্তাহে আসবে। আপডেট দেওয়া হয়নি।
অসাধারন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে। তখন গুগল ম্যাপ ছিলনা