নীলাঞ্জন হাজরা — জয়ন্তকাকু এই পর্ব দিয়ে আমরা তোমার বিশ্বভ্রমণের প্রথম অংশ শেষ করব। আফ্রিকা পর্ব। মিশর বাদ দিয়ে অবশ্য। সব শেষে তুমি বলো, আমি শুনেছিলাম তোমাকে একবার আফ্রিকার কোনো দেশের সেনা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সে তো সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা, কী হয়েছিল?
জয়ন্ত মণ্ডল — হ্যাঁ। সে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটেছিল। সেবার জ়াম্বিয়া থেকে জ়ায়ার সীমান্তে ঢুকেছি সাইকেল করে। সন্ধের দিক। খুব খিদে পেয়েছে। তো দেখি রাস্তার ধারে একটা বারের মতো, বুঝলে, সেখানে খাবার-দাবারও পাওয়া যায়। প্রত্যন্ত একটা জায়গা, সেখানে যে খাবারের একটা জায়গা পাওয়া গেল সেটাই খুব বড়ো ব্যাপার। কিন্তু একেবারেই রাস্টিক। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হত, পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তো যাই হোক, সেই বার-কাম-রেস্তোরাঁতেই দেখলাম কাসাভো পাওয়া যাচ্ছে। ওরা করে কী, কাসাভোটাকে সিদ্ধ করে। তারপর পিরিপিরি দিয়ে মাখে, সে ভীষণ ঝাল। ভূটানের রাস্তাতে রাস্তার দু-ধারে ছোট্টো ছোট্টো গুমটিতে দেখবে লঙ্কা বিক্রি করে। প্রচণ্ড ঝাল।
নী.হা. — আমি এটা আসামে দেখেছি। ওরা ভূত-জ্বলকিয়া বলে বোধহয়।
জ.ম.— হ্যাঁ। সেই রকম ঝাল। তো তাই খেলাম। দেখলাম মাংস ঝোলানো আছে, কিন্তু কে জানে কীসের মাংস, এই ভেবে আর খাইনি। তা দেখলাম অনেকেই ড্রিংক করছে, কেউ কেউ খাচ্ছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল। তুমি কোথা থেকে আসছ? সেই কথা হতে হতে একজনের সঙ্গে পরিচয় হল, সে বেশ ইংরেজি বলে। তাঁরা খুব অবাক হয়েছিল। কারণ সে সময় দেখেছি, স্থানীয় ভারতীয়রা কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে একদম মিশত না। এখন কী হয় জানি না, কিন্তু তখন মিশত না। জ়ায়েরেই নয় শুধু নয়, সর্বত্র দেখেছি—স্থানীয় ভারতীয়রা কখনও স্থানীয় আফ্রিকানদের সঙ্গে মিশত না। কিন্তু আমি বহু দেশে দেখেছি, তিন-চার প্রজন্ম ধরে যাঁরা আফ্রিকাতে রয়েছেন তাঁরাও মিশত না। অধিকাংশ সময়েই এই ভারতীয়দের বাড়িতে কাজের লোক হত কৃষ্ণাঙ্গরা, কিন্তু কাজ হয়ে গেলে, তুমি তোমার মতো, আমি আমার মতো নিজের নিজের রাস্তায় চলি। কিন্তু আমি এও দেখেছি, এই ভারতীয়রা স্থানীয় আফ্রিকান রাজনীতিবিদদের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক রাখত। কারণটা তো বুঝতেই পারছ।
নী.হা.— এটা কোন্ সাল?
জ.ম. — ১৯৭৭। কাজেই কোনো ভারতীয় হঠাৎ রাস্তার ধারের একটা বারে আমার মতো সময় কাটাচ্ছে এটা ভাবাই যেত না। পার্থক্য হল, আমি তো স্থানীয় ভারতীয় নই, আগন্তুক। আমার কাছে কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, খয়েরি চামড়া এ সবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সেসময়ের মধ্যেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে, আমরা সবাই মানুষ। আমাদের সংস্কৃতি আলাদা, খাদ্যাভ্যাস আলাদা, ধর্ম আলাদা—কিন্তু আমরা সবাই মানুষ। শিরায় একই রক্তে বইছে। তুমি এটাকে কেতাবি দর্শন বলতে পার, কিন্তু এটা আমার অভিজ্ঞতা। আমাকে দেখেই ওরা বুঝেছিল যে আমি আফ্রিকান নই। এমনকি আমাকে জিজ্ঞাসাও করল, আমি ‘মুইন্ডি’ নাকি।
নী.হা.— মুইন্ডি?
জ.ম.— হ্যাঁ। মুইন্ডি হল একটা সোয়াহিলি শব্দ, ভারতীয়দের হেয় অর্থে বোঝাতে মুইন্ডি বলা হয়। আমি এত জায়গায় ঘুরেছি কেউ আমাকে মুইন্ডি বলেনি। অন্যদের বলত। ওদের মধ্যে একটা রাগের ভাব এই কারণে ছিল যে ওরা মনে করত যে ওরা স্থানীয় মানুষ হলেও অর্থনীতির লাগাম মুইন্ডিদের হাতে। শ্বেতাঙ্গদেরও এরকম একটা হেয় করা নাম আছে— মুজ়ুঙ্গে। তো যাই হোক, সেই মুইন্ডি শুনে আমি খুব একচোট হাসলাম। আফ্রিকার মানুষরা, বুঝলে, আমি দেখেছি হাসতে খুব ভালোবাসে। দারুণ রসবোধ। হো-হো করে হাসবে না, কিন্তু সারাক্ষণ হাসবে। আমায় হাসতে দেখে সেই ভদ্রলোক আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সাইকেলে কী করছ? তোমার তো গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা। আমি বললাম না, আমি সাইকেলে করে দুনিয়া ঘুরছি। তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাইকেলে করে?’। বললাম হ্যাঁ। এরপর আমাকে বললেন, ‘তুমি কি এক বোতল খাবে?’ বললাম, ‘না, আমার কাছে পয়সা নেই।’ তখন তিনি বললেন, ‘আরে, খাও-খাও-খাও। আমি খাওয়াচ্ছি।’ বলে একটা বিয়ার দিল। ওদের ওখানে সবাই সিম্বা বিয়ার খায়। সিম্বা মানে সিংহ। এখানে তো বিয়ারে ৫ পারসেন্ট অ্যালকোহল, ওখানে প্রায় ৪০ পারসেন্ট!!
নী.হা. — আরিব্বাবা, সে তো প্রায় হুইস্কির মতো।
জ.ম. — হ্যাঁ। বিরাট বোতল। একটা খেয়েই ঘুম পেয়ে গেল। তা ভদ্রলোককে বললাম আমি লুমুম্বা যাব। উনি বললেন, ‘ও। আচ্ছা আমিও যাব, তোমায় ছেড়ে দেব।’ এদিকে ওঠেনই না। খেয়েই চলেছেন। খেয়েই চলেছেন। করতে করতে আটটা বেজে গেল। তখন বলল চলো। দেখি তাঁর গাড়িটা একটা পিক-আপ ভ্যান। তো আমি সাইকেলটা পিছনে তুলে দিলাম। তারপর হঠাৎ তিনি বললেন, ‘শোনো, আমি একটু আমার গ্রামে যাব, একটা কাজ আছে। সেটা সেরে আমি তারপর লুমুম্বা যাব। আমি বললাম, ঠিক আছে। এদিকে চারপাশে জঙ্গল, ঝোড়-ঝাড়, তার মধ্যে দিয়েই ঘড়-ঘড় করতে করতে গাড়ি চলছে, বালি আর পাথৱের। এর মধ্যে আমার আবার একটু ঢুল এসে গেল। পরে বুঝেছিলাম, সেটাই একটা মস্ত সমস্যা হয়েছিল। খানিকটা চলার পরে সে একটা জায়গায় গাড়িটা রেখে নিজের গ্রামে চলে গেল। খানিক্ষণ পরে সে ফিরে এসে বলে কী, ‘শোনো, আমি আজ তো যেতে পারব না, কাল যাব। চলো তোমাকে সেই বারটায় নামিয়ে দিয়ে আসি। আমি বললাম, ‘সে কী? ওখানে থাকব কোথায়?’ তো উনি বললেন, ‘ও কিছু সমস্যা না, বারটার বারান্দায় থেকে যাবে।’ এই বলে তিনি আমায় আবার সেই বারটার কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
তখন রাত যে খুব বেশি হয়েছে তা না। এই নটা-সাড়ে নটা। কিন্তু দেখি চারপাশ খাঁ খাঁ। কেউ কোথাও নেই। বারটা বন্ধ। ও মা, দেখি তার বারন্দাটায় এক জোড়া তরুণ-তরুণী রীতিমতো যৌন কাণ্ডকারখানা চালাচ্ছে। সেই দেখে আমার খুব হাসিও পেল। তো আমি একপাশে সরে গিয়ে, অন্যদিকে গিয়ে বসলাম। অন্ধকার। কোনো আলো নেই। অনেক্ষণ পরে একটা গাড়ি এল। বারটার কাছে এসে দাঁড়াল, আলো সোজা আমার মুখের ওপর। তারপর আলোটা বন্ধ হল। একজন লোক বেরিয়ে এল। এসে আমাকে ফ্রেঞ্চে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করল। কী বলে কিছুই বুঝলাম না। আমি ইংরেজিতে বললাম, ‘হেলো!’। তখন সে ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করল।
প্রথমেই জিজ্ঞেস করল আমি ওখানে কী করছি। বললাম। জানতে চাইল কোথায় যাব, বললাম—লুমুম্বা। তো সে বলল, ‘আমি তো লুমুম্বা থেকেই এলাম। জ়াম্বিয়া যাবো। এখন তো বর্ডার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই পাশেই আমার বাড়ি, সেখানে গাড়ি যাবে না। গাড়িটা এখানেই রেখে যাব। এবার দেখলাম সেটা একটা ফোক্সওয়াগন। তা বললাম, ‘তোমার বাড়িতে আমায় থাকতে দেবে এই রাতটা?’ সে বলল, ‘তুমি আসতে পারো, কিন্তু আমি যেখানে থাকব ওখানে তোমার থাকার জায়গা হবে না। তার চেয়ে বরং তুমি গাড়ির মধ্যেই থেকে যাও।’
আমি সাইকেল থেকে সব লাগেজ নামিয়ে, গাড়িতে তুলে, কোনো মতে সিট ফোল্ড করে পা গুঁটিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না। মাথায় প্রবল যন্ত্রণা শুরু হল। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সে ভীষণ কষ্ট। একবার শুই, আবার উঠে বসি। আর কেবলই মায়ের কথা মনে পড়ছে তখন। কত বার বলেছিল, এ সব করতে যাস না। কোথায় থাকবি, কী খাবি...। সেই সব কথা তখন যেন বেশি বেশি করে মনে পড়ছে।
যাই হোক, এক সময় আর থাকতে না পেরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখি অনেক রাত। সাড়ে-বারোটা বেজে গেছে। পেচ্ছাপ পেয়েছিল। সারলাম। একটু হাঁটাহাঁটি করতে থাকলাম। দেখি সেই ছেলে-মেয়ে দুটো নেই। একফালি চাঁদ উঠেছে। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। একশো গজের মতো গেছি, দেখি রাস্তার ওপরে এক বিশাল জমাট অন্ধকার—একটু একটু নড়ছে। হাতি। সর্বনাশ। কী করি? কোনো ক্রমে সাহস করে, একছুটে গাড়িটার মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর কেবলই মনে হচ্ছে, যদি এখানে মরি তা হলে বিষ্ণুপুরে কেউ জানতেও পারবে না যে কোথায় মরেছি। এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ক্লান্ত দেহটা ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই করিনি।
হঠাৎ খট-খট-খট-খট শব্দ। হুড়মুড় করে উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে। ছ-টা বাজে। সেই ভদ্রলোক এসে দরজায় খটখট করছে। বলল, ‘আমি এবার যাব। তুমি নেমে পড়ো।’ আমি বললাম রাতে হাতি আসার কথা। বললাম, একটা আলাদা হাতি ছিল। দলছুট। পাগলা হাতি হতে পারে। সেই শুনে সে হো-হো করে হেসে বলল, ‘পাগলা হাতি হলে না তুমি থাকতে, না আমার গাড়ি এই অবস্থায় থাকত!’ এই বলে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আমি লুমুম্বার দিকে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। জানি সামনে নিশ্চয়ই গ্রামটাম পাব। সব বাঁধাছাঁদা হয়ে যাওয়ার পরে খেয়াল হলো আমার গগ্ল্স আর হেলমেটটা নেই। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল, সেই যে লোকটির সঙ্গে আমার বারে দেখা হয়েছিল তার গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ওপরে ও-দুটো রেখেছিলাম। ওগুলো খুব দরকার। এখানে আশেপাশে কোথাও পাওয়াও যাবে না। তো ঠিক করলাম সেই গ্রামটায় যাব। বেশি দূর তো নয়। আট-দশ কিলোমিটার হবে। রওনা হয়ে গেলাম।
আর সেটাই আমার কাল হল। যখন যাচ্ছি রাস্তার অবস্থা থেকে মনে হল যে-কোনো মুহূর্তে টায়ার দুটোই পাংচার হয়ে যাবে। আর সেটা যদি হয়, তা হলে বিপদের শেষ নেই। চারপাশে জঙ্গল। এর মধ্যে দেখি, একপাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে বড়ো বড়ো ইগুয়ানার মতো স্যালামান্ডার। যেগুলোকে আমরা বলি গোসাপ। বিরাট বিরাট। তিন ফুট, চার ফুট। খানিক্ষণ পর দেখি আশেপাশে গাছ থেকেও পড়ছে। ভয়ে শিউরে উঠছি। ঘণ্টা দুয়েক চলার পরে বুঝলাম জঙ্গলে হারিয়ে গেছি, জ়ায়ারের জঙ্গলে।
এই ভিডিওটি জ়াম্বিয়া-র। জয়ন্ত মণ্ডল সম্ভবত এর কথাই বলছেন —
নী.হা.— কী কাণ্ড!
জ.ম.- হ্যাঁ। আৱ মনে রাখবে তখন জিপিএস ছিল না, কিছুই ছিল না। আমার সাইকেলের মিটারে তখন দেখছি আঠারো কিলোমিটার চলে এসেছি। পাগলের মতো বোঝার চেষ্টা করছি, কোন্ দিকে গেলে সেই বারটায় ফিরতে পারব। একবার এদিকে যাচ্ছি, একবার ওদিকে যাচ্ছি। আৱ মনে মনে প্রার্থনা করছি একজন লোকের যেন দেখা পাই। একটা জায়গায় এসে দেখি জঙ্গলটা একটু ফিকে হয়ে গেল। দেখি ছোট্টো একটা বসতির মতো। খুব ছোট্ট। একটা দুটো লোক তখন দাঁত মাজছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, এ কেমন গ্রাম? কোনো বাচ্চা নেই। বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে না। মেয়েরা সকালে দল বেঁধে জল আনছে না। হঠাৎ দেখি দু-তিনজন লোক ঝোপের ভিতর থেকে সোজা আমার দিকে বন্দুক তাক করে বেরিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। আমি তো তাড়াতাড়ি হাত দুটো ওপরে তুলে বললাম, আমি এখানে নতুন, পথ হারিয়ে ফেলেছি।
টানতে টানতে ওরা আমায় একটা আটচালা টাইপের ঘরে নিয়ে গেল। সাইকেলটা বাইরে রেখে আমি বোঝাতে চেষ্টা করছি কী ঘটেছে ঠিক। কিন্তু ওরা আমার সঙ্গে ক্রমাগত লিঙ্গালা ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে। এটা আমি একটা শব্দও বুঝি না। শেষে আমি বাংলায় কথা বলা শুরু করলাম। কারণ দেখলাম এক বর্ণ ইংরেজি বুঝছে না কেউ। যা বলছে আমি কেবল বলে যাচ্ছি, আমি ট্যুরিস্ট। লুমুম্বা যাব। পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাংলায় বলছি। পাগলের মতো হাত-পা নেড়েও বোঝানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ একজন লোক এসে হড়হড় হড়হড় করে কী সব বলে গেল। তারপর আর-একজন আমাকে কলার ধরে হিঁচড়ে একটা ছোটো ঘরে ঢুকিয়ে সাইকেলটা নিয়ে চলে গেল। মনে হল, আমি কোনো চোর কিংবা স্মাগলার।
ঘরের মধ্যে দেখি একটা ময়লা টেবিল। তার ওপরে একটা ওয়ারলেস সেট। সামনে দুটো চেয়ার। তার একটাতে সেনা পোশাক পরে একজন লোক সেই সেটটাতে কী সব বলছে। আমি চুপাচাপ বসে রইলাম আর একটা চেয়ারে। আধঘণ্টা, ৪০ মিনিট পরে একজন খুব লম্বা, সৌম্যদর্শন হাসিখুশি ভদ্রলোক এলেন। প্রপার আউটফিট পরা। আমাকে গ্রিট করলেন। আমিও পালটা গ্রিট করলাম। তারপরে সমস্ত কাগজপত্র তাঁকে দিলাম। পাসপোর্ট, প্রেস-ক্লিপিং বিভিন্ন দেশের। সব। সব দেখেটেখে তিনি পাসপোর্টটা নিয়ে চলে গেলেন। মিনিট দশ-পনেরো পরে ফিরলেন। পিছনে পিছনে আরও দু-জন লোক এল। তারা এসে আমার পিছনে দাঁড়াল।
এবার সেই ভদ্রলোক কী সব লিখলেন একটা কাগজে, তারপর সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ইঙ্গিত করলেন, ‘সই করো’। পড়তে গিয়ে দেখি, রোমান স্ক্রিপ্ট, কিন্তু ভাষাটা কিছুই বুঝছি না। কাজেই আমি বললাম আমি সই করব না। সেটা হল আমার দ্বিতীয় ভুল।
নী.হা. — ভুল কেন? না বুঝে কী করে সই করবে?
জ.ম.- সেই। ভদ্রলোক কেবলই কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছেন, আর আমি তাঁর দিকে সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে দুটো বিরাশি সিক্কার চড় কষালেন। মনে হল দাঁতের পাটিটা পড়ে গেছে। একই সঙ্গে চেয়ারটায় একটা এমন লাথি মারল যে আমি ছিটকে পড়লাম মেঝেতে। তারপর তিনি চিৎকার করে কী সব বলতেই, সেই লোক দুটো বুটের স্পাইক দিয়ে আমার হাতে, পায়ে হাঁটুতে ঘষে দিতে লাগল। আর আমি তারস্বরে চিৎকার করছি।
দেখা গেল সেই চিৎকারেই শাপে বর হল। কী হল, একটা জানালা ছিল, আমার চিৎকার শুনে তার পাশে আরও কিছু লোক জড়ো হয়ে গেল। তখন আমি ডুকরে ডুকরে কাঁদছি। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। আর আমি ভাবছি, কী অপরাধ করেছি আমি। আঙুলগুলো থেকে রক্ত বেরচ্ছে। আর আর্মির লোকেদের মনে হয় ট্রেনিংই হয় এমন, যে মুখে কোনো তাপউত্তাপ নেই। পাথরের মতো। শেষে সই করতে বাধ্য হলাম। যখন সই করছি, আমি কাঁদতে কাঁদতেই ইংরেজিতেই বললাম, ‘I don’t know what I am signing, but I hope it won’t get me into further trouble.’ হঠাৎ দেখি জানলার পাশ থেকে একজন বলছে, ‘Wait, I will read it for you.’
নী.হা. — আচ্ছা?!
জ.ম.— হ্যাঁ। তারপর তিনি এসে সেই অফিসার ভদ্রলোককে স্যালুট করে, কাগজটা নিয়ে যা লেখা আছে তার মানেটা আমায় পুরো বলে দিলেন।
নী.হা.— কী লেখা ছিল?
জ.ম. — আমি, অমুক চন্দ্র অমুক। এই আমার পাসপোর্ট নম্বর। আমায় জ়ায়ারের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ভিসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি একটা সেনা শিবিরে ঢুকে পড়েছি। এটা বেআইনি। এটা অপরাধ। তবে এটা আমি না জেনে করেছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি এই অপরাধ আর কখনও করব না।
সেইটা শুনে আমি ভাবলাম, ঠিকই তো লেখা আছে। আগেই বুঝেছিলাম এটা আর্মি ক্যাম্প। বিশ্বাস করো, সেই মুহূর্তে আমার সেই লোকটিকে মনে হল সাক্ষাৎ দেবদূত। সবাই আমার সামনে শত্রুর মতো দাঁড়িয়ে যখন তিনি এসেছেন বন্ধু হয়ে। আমার পরিত্রাতা হয়ে।
অত ব্যথার মধ্যেও তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। পরে জানলাম, তিনি আসলে জ়াম্বিয়ান। সীমান্ত শহরে থাকেন জ়ায়ারে। জ়ায়ারের সেনাতে চাকরি নিয়েছেন! তা, আমি তাঁকে বললাম, ‘দেখুন, আমি তো এখুনি আর সাইকেল চালাতে পারব বলে মনে হয় না। আমাকে একটু ওই বারটার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়?’ সবাই দেখলাম বারটাকে চেনে। তো, উনি সেই অফিসারের পারমিশন নিয়ে আমাকে সেখানে পৌঁছে দিলেন। তখন বেলা সাড়ে এগারোটা-বারোটা।
বুঝলে নীলাঞ্জন, আগের দিন যেসব খাবার কিছুতেই খেতে পারছিলাম না, সেগুলোই সঙ্গে সঙ্গে কিনে গোগ্রাসে খেতে থাকলাম।
এই আমার জীবনের গল্প!
আগেও বলেছি, আবার বলি, গুরুতে পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠতমও হতে পারে, লেখা।
সহমত। অসাধারণ।
আরো চাই
অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা । একজন মানুষ এইসব ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন, যাপন করেছেন এই জীবন ভাবলেই এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ জাাগে। এইসব অভিজ্ঞতা সারা পৃথিবীকে জানানোর মতো। কোনও একদিন হবে নিশ্চয়ই!
এটা ট্রুলি ট্রুলি অসম্ভব ভালো একটা লেখা। ওনার একটা বই বেরোবে পড়লাম। সেটা কি ঠিক? তাহলে জানাবেন।
জয়ন্ত মন্ডল এর সাথে খুব একটা মেলামেশা আমার ছিল না তবে চিনতাম না বা জানতাম না এমন নয়।প্রদ্যুত মন্ডল,অরুপ মন্ডলের সাথে আমার মেলামেশা টা খুব বেশি ছিল আর প্রশান্ত মন্ডল ( ওয়েট লিফটার ও হোমিও ডাক্তার) দেবেন্দ্র স্মৃতি ব্যায়ামাগারে লিফটিং প্যাকটিস করতেন তখন আমিও ওখানে ব্যায়াম করতে যেতাম।জয়ন্ত যে এমনি একটা স্বপ্ন পোষণ করত জানতাম না তবে প্রথম পরিভ্রমণটা শেষ করে আসায় ওর নাম অনেক ছড়িয়ে ছিল আমি তখন এক দুঃসপ্নের তরি বেয়ে চলেছিলাম,আমাকে আমার পায়ে দাঁড়াতে হবে। জীবনের সেই লক্ষে আমি কলিকাতা বাসী আর জয়ন্ত বিশ্ববাসী।
জয়ন্ত আমি সত্যিই আপ্লুত তোমার এই সফর সঙ্গতের সঙ্গী হতে পেরে।সঙ্গীত নয় ঠিকই তবে সঙ্গীতের মাধুর্য যেন তোমার ভ্রমণ কাহিনীতে জুড়ে রয়েছে উদারা,তারা,মুদারার মধ্যে আলাপ,রাগ এক নিঃস্বাসে সব পড়ে গেলাম।
ভালো থাকবে।আমি হাজরাপাড়ার ছেলে।মনে কি আছে?