১০. নরোয়রে দ্বিতীয় দিন - চল্লুম কেল্লায়
পরদিন সকালে উঠে বুঝি গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তার দিকে দোতলায় কমন প্যাসেজে এসে দাঁড়াই। রাস্তায় এখানে ওখানে মৃদু জল জমে আছে। এখন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় একটাও গরু, কুকুর দেখা যাচ্ছে না। কেবল কয়েকটা গাধা রাস্তার পাশে চোখ বুঁজে দাঁড়িয়ে। পিঠের লোম ভেজা। পেটের দিকটা শুকনো। করুণ, নিরীহ দেখতে লাগে। কেন যে শুধু শুধু শীতের বৃষ্টিতে ভিজছে কে জানে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, শীত করেনা ওদের? আজ মকরসংক্রান্তি। ঘন কুয়াশা, মেঘলা আকাশ, টিপটিপ বৃষ্টি দেখে মুড অফ হয়ে গেল। ঝকঝকে আলোয় পূরাতাত্বিক সৌধের ছবি ভালো আসে। কী আর করা যাবে। নীচে নেমে কালকের চায়ের ঠেলায় যাই। আসুন বাবুজী - বলে সে আদা ছিলতে থাকে। দুকাপ চা, এক প্যাকেট পার্লে-জি দিয়ে করি হালকা প্রাতরাশ। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে কুয়াশা একটু কমতে দশটা নাগাদ বেরোই।
গান্ধী চকে গান্ধী মুর্ত্তির পাশ দিয়ে বাঁদিকের তোরণ হয়ে কেল্লার দিকে চলি। কেল্লার দুটি মূল প্রবেশপথ। পশ্চিম দিকেরটা শহরের বিপরীতে - উরয়ায়া দরওয়াজা। আমি গেছিলাম শহরের দিকে পূব দিকের প্রধান গেটের পথে। পাথর বাঁধানো খাড়া পথ। শেষের দিকে কিছু সিঁড়ির পর কেল্লার পূব দিকের প্রথম তোরণ এলো - পিসনহারী (চাক্কি পিষাইওয়ালা) দরওয়াজা। এই অবধি বাইক চলে আসতে পারে। তারপর হাঁটতেই হবে। নরোয়র কেল্লা মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পূরাতত্ব বিভাগের অধীনে। সূচনা ফলকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অতীতে সকালে চাক্কি পেষার আওয়াজ হতে এই গেট খুলতো তাই এই নাম। পরে এই কেল্লা মোগল দখলে গেলে আওরঙ্গজেব দ্বারা ১৬৯২ সালে মোগল শৈলীতে পুনর্নির্মিত হয়ে তোরণটির নাম হয় আলমগীর গেট। তবে তারও আগে উইলিয়াম ফিঞ্জ (১৬১০) ও টেভর্নিয়র (১৬৪০) এর নোটে এই গেটের উল্লেখ আছে। এই কেল্লা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য আলেকজান্ডার কানিংহামের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া গেজেটিয়ারে (১৮৬৭) আছে। তাতেও এই গেটের উল্লেখ আছে।
দ্বিতীয় উত্তরমুখী তোরণটির নাম সৈয়দো কী দরওয়াজা। সৈয়দ দিলাবর খান এই তোরণটির অনেক মেরামতি করেন। তাই এই নাম। গেটের সামনে করিডোরে দুটি সমাধি নির্মিত। আরবি ও ফারসি ভাষায় দুটি শিলালিপি অনুযায়ী ওখানে শের শাহ সূরীর দুর্গপাল দিলাবর খানের (১৫৪৫) কবরও আছে। আর একটু এগিয়ে তৃতীয় দক্ষিণমুখী পীরন পৌর দরওয়াজা নির্মাণ করেন সৈয়দ পীরন দস্তগীর। যার উত্তর ও ডান দিকে শক্তিশালী নিরাপত্তা চৌকি রয়েছে। পূর্বমুখী চতুর্থ এবং শেষ দরজাটি হাওয়া পৌর দরওয়াজা। এর ডানদিকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত শিবের মন্দির অবস্থিত। এটির স্থাপত্য মধ্যযুগীয় রাজপুতানা শৈলীর। সারা বছর এই দরজা দিয়ে শীতল বাতাস বয় তাই এই নাম, যেমন জয়পুরে হাওয়া মহল। মারাঠাদের নরোয়র বিজয়ের আগে এর নাম ছিল গৌমুখী দরওয়াজা। ১৮০০ সালে দৌলতরাও সিন্ধিয়ার সুবেদার আম্বাজি ইঙ্গলে এটি পুনর্নির্মাণ করেন।
প্রায় পাঁচশো ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর আট কিমি পরিসীমার ২৫ থেকে ৩৫ ফুট উঁচু কেল্লা প্রাচীরে ছিল ৬০টি বুরুজ। আয়তনে এ কেল্লা গোয়ালিয়র কেল্লার পরে মধ্যপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম। কিন্তু প্রচারের অভাবে পর্যটকদের কাছে ব্রাত্য। তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। নির্জনে মনের আনন্দে ঘুরেছি। ২০১৯এর ফেব্রুয়ারিতে গোয়ালিয়র কেল্লায় গিয়ে মান সিং প্যালেসের সামনে কিলবিলে ভীড় দেখে ভালো লাগেনি।
প্রাচীন নরোয়র দুর্গ সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন নরোয়র মহাভারত কালীন নল রাজার রাজধানী ছিল। দুর্গটি সেই সময়কার। দুর্গের নীচের শহরটি দ্বাদশ শতক পর্যন্ত নালাপুর নামে পরিচিত ছিল। অনুমান খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে কচ্ছবাহ বা কছওয়াহা রাজবংশ এই কেল্লার নির্মাণ শুরু করেন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে পড়িহার, তোমর, গোলাম রাজবংশের সুলতান, লোধী রাজবংশ, মুঘল সম্রাটরা ছাড়াও নরোয়র দুর্গ বুন্দেলা শাসক চপতরায় এবং তার পুত্ররা - মহারাজা ছত্রশাল, মহারাজা বীরসিং দেও, নরোশঙ্কর, বিট্টল, মহাদাজি দৌলতরাও সিন্ধিয়া প্রমুখের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অর্থাৎ এ কেল্লা বহু শতাব্দী ধরে বহু হাত ঘোরা।
হাওয়া পৌর দরওয়াজা থেকে প্রথমে বাঁদিকে মানে দক্ষিন দিশায় গিয়ে কেল্লাকে চক্কর মেরে আসতে পরপর এলো অনেককিছু। মসজিদ, কোরিয়ো কী হাভেলি (তাঁতীদের বাসস্থান), কারাগার, মনসাদেবী মন্দির, চিল্লা হজরৎ দরগা, তাল কাটোরা, পসার দেবী মন্দির, আলহা উদল কী আখাড়া, সিদ্ধ বাবা স্থান, উরয়ায়া দরওয়াজা, আট কুঁয়া ন বাউড়ি, লক্ষ্মণ ঊর্মিলা মন্দির, ক্যাথলিক চ্যাপেল, সিকন্দার লোধি মসজিদ, মীনা বাজার, রাম জানকি মন্দির, সুনহেরি মহল, কাছেরি মহল, রানি দময়ন্তী মহল, ফুলওয়া মহল, রাওয়া পারেওয়া মহল, লাদাউ বাংলা, চক্কি মহল, ছিপ মহল হয়ে ব্যাক টু হাওয়া পৌর। এগুলির কথা পরপর লিখে গেলাম বটে তবে তাদের অবস্থান নিয়ে পাঠকের বিভ্রান্তি হতে পারে। তাই এক্সেল শীটে কেল্লার একটি ফ্রীহ্যান্ড লাইন স্কেচ করে তাতে ১২টি প্রধান জায়গা লেবেল করলাম। এবার বিবরণ পড়ে হয়তো আগ্ৰহী পাঠকের মনশ্চক্ষে কেল্লা পরিসরে জায়গাগুলির অবস্থান ধরা পড়বে।
তবে লাইন স্কেচের থেকেও পাখির চোখে বাস্তব ভূপ্রকৃতি দেখলে ধারণা আরো পরিস্কার হয়। তাই সেটাও রাখলাম নীচে। তাতেও কটি প্রধান জায়গা লেবেল করে দিলাম:
1. পিসানহারি গেট 2. বাকি তিনটি গেট 3. হজরৎ দরগা 4. তাল কাটোরা 5. পসার দেবী 6. পশ্চিম দ্বার উরয়ায়া গেট 7. ৮ কুঁয়া ৯ বাউড়ি, 8. সিকন্দর লোধীর মসজিদ, কাছেরি মহল সহ বাকিসব মহল এখানে কাছাকাছি আছে। নেট থেকে পাওয়া একটা ড্রোন শট - পূবের তিনটি গেট ও উত্তর দিশায় স্থাপত্যগুলি দৃশ্যমান
১১. মুশকিল আসান - লোকাল গাইড বিলু
হাওয়া পৌর গেটে বসেছিল পূরাতত্ব বিভাগের গার্ড বিলু। বছর তিরিশেক বয়স। শক্তপোক্ত চেহারা। কলকাতা থেকে এসেছি শুনে বললো, রোজ তো এখানে বসেই থাকি, চলুন আপনাকে প্রধান দ্রষ্টব্যগুলো দেখাই। আপনি একা ঘুরলে অনেক কিছু মিস করবেন। কেল্লাটা বেশ বড়। অনেক জায়গায় জঙ্গল হয়ে গেছে। রাস্তা হারিয়ে অযথা ঘুরপাক খেয়ে সময় নষ্ট হতে পারে। বিলুর সাথে গিয়ে সুবিধাই হোলো। এখান ওখান দিয়ে শর্টকাট মারলো। সূচনা ফলকে যা লেখা নেই তেমন কিছু জায়গাও দেখালো।
প্রথমে দক্ষিণ দিশায় গিয়ে মসজিদ, কোরিয়ো কী হাভেলি, কারাগার হয়ে মনসাদেবী মন্দির গেলাম। ওখানে এক সেবায়েত থাকেন, জল আলো আছে। আমি যেভাবে ঘুরি, চাইলে রাতে ওখানে থাকা যায় কিনা জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, চৌপাই তো নেই, আপনার মাটিতে শুতে অসুবিধা না হলে, থাকতেই পারেন। এমন সব জায়গায় থাকতে ভেতর থেকে যে টান অনুভব করি তার শিকড় রয়ে গেছে ২৪ থেকে ২৯ বছর বয়সকালে শৈলারোহণ পর্বে পুরুলিয়া, সিংভূমের কিছু অনবদ্য অভিজ্ঞতা। তাছাড়া এসব জায়গায় থাকলে ভোর এবং সন্ধ্যার আমেজ বা নিস্তব্ধ রাতের ছমছমে অনূভব নেওয়া যায়। তখন জোৎস্না থাকলে সোনায় সোহাগা।
১২. চিল্লা হজরৎ মদার সাহিব
তারপর বিলু নিয়ে গেল একটি সুন্দর জায়গায়। এটা সূচনা ফলকে উল্লেখ ছিল না। চিল্লা হজরৎ মদার সাহিব একটা দরগাহ ও মসজিদ। ধূবেলায় হজরৎ বলীউদ্দিন দরগাহতে কেয়ারটেকার চাচা মুবারক আলী সন্ধ্যায় অগরবাত্তি করে চলে যেতেন। এখানেও এক কেয়ারটেকার আছেন, তবে তিনি কোথাও যান না, এখানেই থাকেন - একদম একা! বলি, এতো বড় কেল্লার একান্তে, এমন নির্জনে রাতে একা থাকতে অস্বস্তি হয় না? সরল হেসে বলেন, একা কোথায় থাকি, এখানে যাঁরা মাটির তলায় শুয়ে আছেন তাঁরাই তো সঙ্গ দেন রাতে।
চিল্লা হজরৎ মদার সাহিবের চাচা
ওখানেও জল, আলো আছে। বলি, এমন নির্জনতায় এক দু দিন থাকতে বেশ লাগে। বলেন, রহে যাইয়ে না, আপ য্যায়সা এক অকেলা রাহগীর রহনে সে কোই দিক্কত নেহি। ম্যায় তো ইধারই রহতা হুঁ। বলি, এবার হবে না, নীচে লজে উঠেছি। তবে, কিছু মনে না করলে বলি, আমি তো আপনাদের সম্প্রদায়ের নই, জন্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণ, আমার কোনো আপত্তি নেই তবে আমি থাকলে আপনাদের সম্প্রদায়ের কারুর কোনো আপত্তি হবে না তো? চাচা বলেন, বাবুজী, হজরৎ কা দরওয়াজা সবকে লিয়ে খুলা হোতা হ্যায় ফির ভি নাসমঝ লোগ হরকৎ করতে ফিরতে হ্যায়। আপনে শুনা হোগা আজমীর শরীফ মে বচ্চন সাহাব মিন্নত মাঙ্গকে ধাগা বান্ধা থা। আরজু পুরা হোনে পর উন্হোনে চালিশ সাল বাদ যাকে মাজার মে চাদর চড়ায়া। কেউ কুছ বোলা? কিসিকো তকলিফ হুই? আপ ভি কভি দিল করে তো আ যাইয়েগা। অব তো ইন্তেকাল তক ইধরই রহনা হ্যায় মুঝে। রাত মে সন্নাটা কি এ্যাহসাস, সুবহ কা সুহানী নজারা, রুহ্ কি মরহম য্যাসা লাগে গা, দিল খুশ হো যায়েগা বাবুজী।
একটু আগে মনসাদেবী মন্দিরে রাত কাটানোর ইচ্ছার প্রেক্ষাপটে যে অনুভূতি কাজ করেছিল, তারই যেন প্রতিধ্বনি শুনলাম চাচার কথায়। জানি না আবার কখনো যাওয়া হবে কিনা নরোয়র তবে গেলে কেল্লায় চাচার আশ্বাসে, পীরবাবাবার ছত্রছায়ায় অন্ততঃ দুটি রাত কাটানোর ইচ্ছা মনে পুষে রাখলাম।
তাল কাটোরা
১৩. পসার দেবী
এরপর আর দক্ষিণ দিকে না গিয়ে পশ্চিমদিকে নিয়ে গেল বিলু। একটু এগোতে পড়লো তাল কাটোরা। জানুয়ারিতেও জল রয়েছে। অতীতে রাজা এখানে স্নান করে তালাওয়ের উত্তর দিকে পসার দেবী মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন। হিন্দিতে 'পসার' অর্থ শুয়ে থাকা। কিংবদন্তি অনুসারে মহাভারতকালীন নল রাজা ছোট ভাইয়ের কাছে জুয়ায় সর্বস্ব খুইয়ে পত্নী দময়ন্তীকে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে যখন চলে যেতে উদ্যত, কুলদেবী রাজসম্পত্তি রক্ষার্থে পথের সামনে শুয়ে পড়ে নলরাজের পথ আটকান। সেই থেকে কুলদেবী এখানে পসার দেবী নামে পূজিতা হন। অর্থাৎ দেবী এখানে মন্দিরে দণ্ডায়মান বা উপবেশিতা নন, তিনি শায়িতা। সারা ভারতে ছড়িয়ে আছে এমন নানা অদ্ভুত লোকবিশ্বাস যা আধুনিক মানুষের কাছে আজগুবি লাগতে পারে তবে স্থানীয় মানুষের কাছে সেসবের মান্যতা গভীর।
চৈত্র ও কার্তিক নবরাত্রির কদিনের মেলার সময় ছাড়া বাকি সময় কেউ থাকে না এখানে। ধর্মশালায় কয়েকটি ঘর আছে। চৈত্র নবরাত্রিতে মন্দির চত্বরে খোলা আকাশের নীচেই ভক্তরা রাত্রিবাস করেন। তখন উৎসব মূখর পরিবেশে তা ভালোই লাগে। আলো জলের ব্যবস্থা আছে। বর্তমান পূজারী রমেশজী বংশপরম্পরায় দেবীর পূজো করে আসছেন। তিনি আবার করেরা নগর পঞ্চায়েত প্রধান। রোজ সকালে নীচে থেকে এসে পূজো করে মন্দিরে তালা দিয়ে চলে যান। সেদিন মকরসংক্রান্তির ছুটি বলে একটু দেরিতে এসেছিলেন। তাই দেখা হয়ে কিছু কথা হোলো। নবনির্মাণ প্রকল্পে মন্দির চওড়া হবে, উচ্চ শিখর হবে।
১৪. চন্দন তালাইয়া আরো উত্তরে যেতে চোখে পড়লো একটা ট্রাপিজিয়ামের মতো বড় তালাও। তার উত্তর ও পশ্চিম দিকে গাঁথুনির অবশেষ রয়েছে। বিলু বলে এখানে একটা মহল তৈরির পরিকল্পনা ছিল, পরে বাতিল হয়ে যায়। এখানে কেল্লায় থাকা হাতি, ঘোড়া এসে জল খেতো। পাশে একটা চন্দন গাছ থাকায় এর নাম হয় চন্দন তালাইয়া। আকাশে মেঘ, বাতাসে কুয়াশার জন্য মরা আলোয় ছবি ভালো আসে নি। নেটে কেভিন স্ট্যান্ডেজ নামে জনৈক বিদেশী পর্যটকের ব্লগে, উজ্জ্বল আলোয় তোলা ছবিগুলো ভালো লেগেছে। কেল্লার কিছু স্থাপত্যের পরিচিতির জন্য কেভিনের কিছু ছবি এখানে রাখলাম। ওর ছবিতে K.S লিখে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। যে ছবিতে কিছু লেখা নেই সেগুলো আমার তোলা।
১৫. আলহা ও উদলের বীরত্ব
আরো উত্তরে যেতে এলো আলহা উদলের কুস্তির আখাড়া। দ্বাদশ শতাব্দীতে বুদেলখণ্ডের মাহোবা শহরের (বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত) এই দুই ভাই ছোট থেকে গুরু গোরখনাথের কাছে শাস্ত্রচর্চা এবং যুদ্ধকলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। আলহা মা শারদার (দেবী দুর্গার আর এক রূপ) পরম ভক্ত ছিলেন। লোকবিশ্বাসে তিনি দেবীর কাছে অমরত্বের বর পেয়েছিলেন। উদল ছিল বড় ভাই আলহার থেকে বারো বছরে ছোট। দু ভায়ে ছিল খুব মিল। বিপদে তারা একে অপরের জন্য জীবন বাজি রাখতেও পিছপা ছিল না। ক্রমে আলহা চান্দেল সেনাবাহিনীর সেনাপতি হন। কবি জগনিকের ‘আলহা খন্ড’ কবিতায় এই দুই ভাইয়ের ৫২টি যুদ্ধের বর্ণনা আছে।
আনুমানিক ১১৮২-৮৩ সালে দিল্লীশ্বর পৃথ্বীরাজ চৌহান বুন্দেলখণ্ড জয়ের স্বপ্ন নিয়ে চান্দেলারাজ পারমালের রাজধানী মাহোবা আক্রমণ করেন। বৈরাগড়ে প্রচণ্ড যুদ্ধে ছোটভাই উদল শহীদ হন। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে আলহা পৃথ্বীরাজ চৌহানের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে যুদ্ধক্ষেত্রে পৃথ্বীরাজের মুখোমুখি হন। প্রচণ্ড যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত করে হয়তো মেরেই ফেলতেন কিন্তু গুরু গোরখনাথের নির্দেশে আলহা পৃথ্বীরাজকে প্রাণভিক্ষা দেন। এই যুদ্ধের পর আলহা সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং মা শারদার ভক্তিতে মগ্ন হন। বুন্দেলখণ্ডে আলহা উদলের বীরগাথা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
একটু পার্শ্বচারণা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেই ভ্রমণেই পরে মৈহার গিয়ে ছিলাম দুদিন। রোপওয়েতে নয় - আধা উচ্চতা সিঁড়ি ধরে, বাকিটা ঘোরানো গাড়ি চলার পথে গেছিলাম পাহাড়ের মাথায় মা শারদা মন্দিরে। আমি ভক্ত নই, গেছি ভ্রামণিক হিসেবে। অদ্ভুত সুন্দর পথশোভা, দুরের পাহাড়, অরণ্য। একা যাই বলে আশপাশে নানা কিছু চোখে পড়ে। মৈহারে আপ্লুত ভক্তদের আচরণ আকর্ষণীয় লেগেছিল। সেখানেও পাহাড়ের নীচে একপাশে সুন্দর পরিবেশে গেছি আলহা উদলের প্রাচীন কুস্তির আখাড়ায়।
হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের এক প্রাণপুরুষ - মৈহার ঘরাণার জনক – বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেব। পূর্ববঙ্গের ব্রাহ্মণবেড়িয়ার বাড়ি থেকে পালিয়ে, অনেক ঘাটের জল খেয়ে, কলকাতা হয়ে অবশেষে বাবা থিতু হন মধ্যপ্রদেশের মৈহারে। বাবা বাঙালি মুসলমান হয়েও ছিলেন মা শারদার ভক্ত। রোজ সকালে ১০৬৩ সিঁড়ি চড়ে মন্দিরে যেতেন দেবীদর্শনে। বাবার জামাই পণ্ডিত রবিশঙ্কর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মৈহারে বাবার ঘরে মা কালী, শ্রী কৃষ্ণ, প্রভূ যীশু খ্রীষ্টের অনেক ছবি ছিল। বাবার সেই ঘর আজও সেভাবেই রক্ষিত আছে। বাইরে বদলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। শাস্ত্রীয় সংগীতসাধকরা বাবার নিবাস দেখতে যান তীর্থদর্শনের মানসিকতায়। আমিও গিয়ে দেখেছি - তবে তখন গেট বন্ধ ছিল বলে - বাইরে থেকে।
কেল্লায় আলহা উদলের কুস্তির আখাড়া ১৬. উরয়ায়া গেট - ৮ কুঁয়া ৯ বাউড়ি - লক্ষ্মণ ঊর্মিলা মন্দির আখাড়ার পিছনে, কেল্লার পশ্চিম প্রাচীর ঘেঁষে রয়েছে এক সিদ্ধবাবার স্থান। তবে নবরাত্রির সময় কিছুদিন ছাড়া বছরভর ওখানে কেউ থাকে না।
সিদ্ধ বাবার স্থান
এরপর আরো উত্তরে যেতে এলো কেল্লার পশ্চিম প্রবেশ তোরণ উরয়ায়া গেট। এখানে গেট অবধি গাড়ি চলে আসতে পারে। পূর্ব এবং পশ্চিমের এই মূল দুটি প্রবেশপথ ছাড়াও দক্ষিণে একটা বন্ধুর পায়ে চলা পাকদণ্ডী পথ আছে। উত্তর কোনেও অমন পথ একটা ছিল, জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে অব্যবহৃত হয়ে গেছে। উরয়ায়া গেটে থেকে দক্ষিণে তাকালে দুরে নীচে অনেকটা জায়গার ওপর প্রাচীন নেমিনাথ জৈন মন্দির চোখে পড়ে। একবার ভেবেছিলাম ওখানে থাকবো। কিন্তু দূরত্ব ও জনবাহনের অভাবে যাওয়া হয়নি।
গেটের উত্তরে এলো আট কুঁয়া ন বাউড়ি। বেশ বড় একটা নীচু বর্গাকার জায়গায় অনেকগুলি গোল কুঁয়ো এবং কয়েকটি চৌকো বাউড়ি দেখা গেল। এখান থেকে পাম্প করে কেল্লার মধ্যে কিছু জায়গায় জল যাচ্ছে পাইপলাইনে।
আট কুঁয়া ন বাউড়ি
তার কাছেই রয়েছে লক্ষ্মণ ঊর্মিলা মন্দির। সেখানে দুই বৃদ্ধ পূজারী থাকেন। পেন ড্রাইভের মাধ্যমে মাইকে ভজন চলছে। আরাধনাতেও টেকনোলজির অবদান। যেমন অনেক মন্দিরে এখন দেখা যায় মটোরাইজড্ ঢাক ও ঘন্টা বাদন। একটি ময়ূরীকে তাঁরা শিশু অবস্থায় উদ্ধার করেছিলেন। এখন সে পোষা মুরগির মতো তাদের রান্নাঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। গুরুতে ইন্দ্রাণীর 'ট্রফি' লেখার শুরুতে জন লেননের গানের একটি লাইন বেশ লেগেছিল - Tame birds sing of freedom, wild birds fly… নরোয়র কেল্লায় ময়ুরীটি মনে হোলো স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়েছে। দরজা তো খোলাই রয়েছে, চাইলেই উড়ে যেতে পারতো। তবে পাখি কেন, অনেক মানুষেরও মায়ার বাঁধন, নিশ্চিন্ততার আশ্বাস অনিশ্চিত স্বাধীনতার থেকে বেশী কাম্য মনে হয়। তাই স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়ে।
মায়া কেটে যেতে না পারা ময়ূরী লক্ষ্মণ ঊর্মিলা মন্দিরের পাশেই রয়েছে মকরধ্বজ হনুমান মন্দির। চ্যবনপ্রাশ, সঞ্জীবনী সালসার মতো মকরধ্বজ একটা কবিরাজি দাওয়াই বলে জানতাম। পূজারীজীকে শুধোই। তিনি একটি লাড্ডু প্রসাদ ও তদোধিক মিষ্টি গুড়ের চা পেশ করে বলেন, উনি হনুমানপুত্র। পুরাণ, রামায়ন, মহাভারতের কিছুই বিশেষ জানি না। তবু এটুকু জানতাম হনুমানজী ব্রহ্মচারী। সন্ধ্যায় লজে ফিরে গুগলদার সাথে আলাপচারিতায় যা জানলাম তা বেশ চমকপ্রদ।
১৭. মকরধ্বজের প্রেক্ষাপট এবং…
লেজের আগুনে সোনার লঙ্কা ছারখার করে গরমে ঘর্মাক্ত হনুমানজী সমূদ্রে স্নান করতে নামার সময় শরীর থেকে ঝরে পড়লো ঘাম। এক মহিলা মকর সেটি টপ করে গিলে ফেলে হয়ে পড়লেন গর্ভবতী। ঘর্ম থেকে গর্ভ সঞ্চার কীভাবে সম্ভব? না, সেসব কূট তর্কে গিয়ে লাভ নেই। গুণীজনকে শুধোলে বলবেন - সবই প্রতীকী। তো যাই হোক, পাতাল লোকের অধীশ্বর রাবণপুত্র অহিরাবণের সেনাদের হাতে ধরা পড়া গর্ভবতী মকরের পেট চিরে বেরোলো একটি শিশু। তিনিই মকরধ্বজ। পরবর্তীকালে প্রাপ্তবয়স্ক মকরধ্বজের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে অহিরাবণ তাকে পাতাললোকের প্রবেশপথের রক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
পরবর্তীতে রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করলে অহিরাবণ রাম ও লক্ষ্মণকে অপহরণ করে পাতাললোকে নিয়ে যায়। তাঁদের খুঁজতে এসে হনুমানজী পাতাললোকের দ্বারে দেখেন অর্ধেক বানর অর্ধেক সরীসৃপ মকরধ্বজ। তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে তিনি বলেন, “আমি হনুমান পুত্র মকরধ্বজ!” শুনে চমকে ওঠেন হনুমানজী। ধ্যান করে সত্য জানতে পারেন। কিন্তু দায়িত্ববোধে মকরধ্বজ পিতাকেও দ্বার ছাড়তে রাজি নয়। হনুমান তাকে পরাজিত করে বেঁধে রেখে রাম লক্ষ্মণকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ফেরার পথে রাম মকরধ্বজকে দেখতে পান। হনুমানজীর কাছে বিস্তারিত শুনে তাকে মুক্ত করে পাতাললোকের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন।
তবে মৎসগর্ভে মানবশিশুর জন্মের আখ্যান মহাভারতেও আছে। চেদি দেশে কোলাহল পর্বতের সাথে হইলো শুক্তিমতী নদীর সঙ্গম (পর্বতের সাথে নদীর ইয়ে!!) যথাকালে নদীগর্ভে উৎপন্ন হইলো একটি পুত্র ও একটি কন্যা। চেদিরাজ উপরিচর বসু নদীপুত্রকে করলেন সেনাপতি ও নদীকন্যাটিকে মহিষী। একদিন অরণ্যে মৃগয়াকালে রূপবতী মহিষী গিরিকাকে স্মরণ করে রাজা কামাবিষ্ট হলেন এবং রেতঃপাত হোলো। রাজা স্খলিত শুক্র একটি শ্যেনপক্ষীকে বললেন গিরিকাকে দিয়ে আসতে। শ্যেন ক্যুরিয়ার মারফৎ পত্নীর কাছে শুক্র প্রেরণ - এই ব্যাপারটি আমার ঠিক হজম হয়নি। ওটা তো রাজশয্যায় সরাসরি হতে পারতো। যাকগে, ওসব প্রতীকী ব্যাপার বোঝা আমার অসাধ্য।
তো হোলো কি, সেই শুক্রবাহক শ্যেনপক্ষীর ওপর শনির দৃষ্টি পড়লো আর এক শ্যেনের। মাঝ আকাশে দুই শ্যেনের ঝটাপটিতে বাহকশ্যেনের ঠৌঁট থেকে শুক্র খসে পড়লো গিয়ে মাঝনদীতে। সে আবার যে সে নদী নয়, সেই ঊর্বরা ঋতুমতী শুক্তিমতী। হয়তো সেই পতিত শুক্র হতেও আবার সে হয়ে পড়তো গর্ভবতী। তবে হোলো না।
কারণ অদ্রিকা নাম্নী এক অভিশপ্ত অপ্সরা ব্রহ্মশাপে মৎসী হয়ে তখন ঐ নদীতে বিচরণ করছিল। সে (মকরধ্বজ মাতা) মকরের মতোই সেই শুক্র নদীতে পড়তেই তৎক্ষণাৎ টপাস করে গিলে ফেললো। শুক্র গলাদ্ধকরণ করে কীভাবে গর্ভবতী হওয়া যায়? আবারও এসব কূট প্রশ্ন করে লাভ নেই। যথাকালে পূর্ণ গর্ভবতী অদ্রিকা ধরা পড়লো এক ধীবরের জালে। এবারও যমজ কেস। ধীবর মাছের পেট কেটে একটি পূত্র ও কন্যা পেয়ে রাজা উপরিচরের কাছে নিয়ে এলো। অপ্সরা শাপমুক্ত হয়ে ফুররর করে উড়ে গেল ইন্দ্রলোকে। রাজা ধীবরকে বললেন কন্যাটিকে তুমিই পালন করো। সেই হলো ধীবর পালিত কণ্যা মৎসগর্ভজাতিকা রূপবতী সত্যবতী। পুত্রটি পরে হয়েছিলেন ধার্মিক রাজা মৎস।
আর এক বিচিত্র সঙ্গম
১৯৯২ সালে রৌরকেলায় ছিলাম মাসখানেক। একদিন গেছিলাম ওখানে ব্রাহ্মণী ও কোয়েল নদীর সঙ্গমে। ব্রাহ্মণী নদীর সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক আখ্যান জড়িত। সেটা অনেক পরে জেনেছি। বস্তুত আখ্যান বর্ণিত ঘটনাটি না ঘটলে অষ্টাদশ পর্বের এক মহাকাব্যই রচনা হোতো না।
একদিন সেখানে নদী পার হতে এলেন এক মুনী। ঘাটে একটিই নৌকা। মাঝাইন এক রূপবতী যুবতী। মুনী বলেন, 'সুন্দরী, তুমি কি তরাতে পারো মোরে?' মেয়ে বলে, 'আসুন মুনীবর, আমি তো তরণী নিয়ে নদী তীরে বসেই আছি সেই তরে।' নৌকা যখন মাঝনদীতে ব্রহ্মচারী মুনীর চিত্ত উদ্বেল হয়ে ওঠে দাঁড় বাওয়া মাঝিয়ানের যৌবন সম্ভারের হিল্লোলে।
ঋষি পুত্রার্থে কামনা করেন তাকে। যুবতী বলে, 'ঋষিসেবার সুযোগ পাওয়া পরম সৌভাগ্য, কিন্তু হে মুনীবর, আমি তো কুমারী, আপনার সন্তান ধারণ করে কৌমার্য হারালে আমি সমাজে মুখ দেখাবো কী করে?' ঋষি বলেন, 'ভেবো না কল্যাণী, আমার বরে সন্তানের জন্ম দিয়েও তুমি কুমারীই থাকবে।' তবু মেয়ে দ্বিধান্বিতা, বলে, 'আমি মৎসগর্ভ জাতিকা, মৎস্যজীবীর গৃহে পালিতা, তাই গায়ে আমার মেছো গন্ধ। হে ঋষিকান্ত, মিলনকালে আমার সান্নিধ্যে আপনার বিবমিষার উদ্রেক হতে পারে।' ঋষি বলেন, 'রূপবতী, আমার বরে এখন আর তুমি মৎসগন্ধা নও, হয়ে গেলে পুষ্পগন্ধা। এক যোজন দূর থেকে লোকে তোমার সুরভি পাবে, লোকে তোমায় জানবে সুগন্ধবতী যোজনগন্ধা নামে। এবার খুশি তো?'
তাও তরণীবাহিকা তরুণী কুণ্ঠিতা হয়ে বলে, 'কিন্তু নদীতে আশপাশে আরো নৌকা রয়েছে যে, জেলেগুলো মাছধরা ছেড়ে এদিকেই দেখছে ড্যাবড্যাবিয়ে। নৌকায় ছইও নেই যে ঢুকবো গিয়ে তার আড়ালে। খোলা নদীতে, নৌকার উদোম পাটায় ইয়ে করার কথা ভেবেই যে আমার খুব ইয়ে করছে!' মুনী যোগবলে নিমেষে চারপাশে কুয়াশার আবরণ সৃষ্টি করে বলেন, 'এখন আর কেউ দেখতে পাবে না, আর লজ্জা নেই তো? হে মোহিনী কর্ণধারিণী, এবার দাঁড় রেখে এসো মোর কাছে। আমি যে তোমার যৌবনতরঙ্গে তলিয়ে যেতে বড়ই উতলা হয়ে পড়েছি।'
এই ঘটনার নিমিত্ত অথবা তাৎপর্য কী? রমণীর অপ্রতিরোধ্য রমণীয় আকর্ষণ? পুরুষ হিসেবে ঋষি হয়েও আত্মসংযমের অভাব? নাকি জীবজন্মের ধারা আবহমানকাল জায়মান রাখতে প্রকৃতির কৌশলে সৃষ্ট এমন এক প্রাকৃতিক লীলা যার প্রভাব অগ্ৰাহ্য করা ভোগী রাজা থেকে যোগী ঋষি - সবার পক্ষেই অসম্ভব? সর্বার্থেই স্খলন হয় পুরুষের, তবু মনুসংহিতায় বলা হোলো - নারী নরকের দ্বার স্বরূপ। চমৎকার! একেই হয়তো বলা যায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে উদ্ভূত ধর্মীয় ধাষ্টামো।
সেই কামাবিষ্ট মুনী হলেন তৎকালে তীর্থ পর্যটনে রত মহাঋষি পরাশর। মাঝিয়ান যুবতী রূপসী সত্যবতী যিনি পরবর্তীতে হবেন - মহাভারতীয় আখ্যানের দুই প্রাথমিক চরিত্র - ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর ঠাকুমা। ঋষি পরাশরের সাথে সেদিন নৌকায় মৎসকন্যা সত্যবতীর ইয়ে দিয়েই শুরু হোলো এক অকল্পনীয় ঠাকুরমার ঝুলি।
সত্যজিতের আগন্তুক সিনেমায়, ছোট্ট বাবলু ও তার বন্ধুদের গড়ের মাঠে বসে সূর্যগ্ৰহণ ও চন্দ্রগ্ৰহণ বোঝাচ্ছিলেন উৎপল দত্ত। বাবলুর মতে - 'হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে দাদু' সেখানে একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন - নিজেদের মধ্যে দূরত্বের আনুপাতিক হারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবীর আকার এমনই যে চাঁদ ও পৃথিবীর ছায়ায় সৃষ্টি হয় পূর্ণ সূর্যগ্ৰহণ এবং পূর্ণ চন্দ্র গ্ৰহণ। এটা এই ব্রহ্মাণ্ডের এক বিষ্ময়কর ম্যাজিক। ঠিক তেমনি, ঋষির বরে সদ্য গর্ভবর্তী হয়ে পত্রপাঠ নিকটস্থ দ্বীপে একটি ঋষিপুত্রের জন্ম দিয়েও সত্যবতী পুনরায় হয়ে গেলেন কুমারী। এও সেই ম্যাজিক! এমন ম্যাজিকের নমুনা মহাভারতে ভুরিভুরি।
পার্শ্বচারণার নেশায় চলে গেছিলাম বহু দুর। এবার ফেরা যাক। মকরধ্বজ মন্দির থেকে গেলাম কেল্লার উত্তর প্রান্তে। অতীতে রাজার গোলন্দাজ বাহিনীতে কিছু ফরাসী সৈন্য ছিল। তাদের জন্য ওখানে একটি ছোট চ্যাপেল ও সেমেটারি তৈরী হয়েছিল। কেল্লার প্রাচীরে উঠতে দুরে নীচে সিন্ধ নদীর ওপর উত্তর পশ্চিম দিশায় মোহিনী সাগর পিকআপ ড্যাম ও জলাশয় দেখা গেল। আরো দক্ষিণে এই সিন্ধ নদীর ওপরেই আছে প্রধান মোহিনী সাগর বা মাড়িখেড়া ড্যাম। সেই জলাশয়ের নাম অটল সাগর।
১৮ - বাকিসব মহল
বিলু এদিক ওদিক দিয়ে মীনা বাজার হয়ে নিয়ে এলো প্রাচীন রাম জানকি মন্দিরে। হালে রাধাকৃষ্ণর মূর্তি বসেছে। এলো সিকন্দর লোদীর সমাধি ও মসজিদ। কেল্লা দখল করে লোধীর আদেশে সৈন্যদল ছমাস ধরে নানা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেই সব দিয়ে সুলতানী স্থাপত্য বানায়। ছিপ মহলের পিলারে সেই কুকর্মের সাক্ষ্য রয়ে গেছে।
এলো সুনহেরী মহল। তার পাশে কাছেরি মহল। জনশ্রুতি এখানে নলরাজের গদ্দী বা সিংহাসন ছিল। তবে পূরাতত্ব বিভাগের ফলক অনুযায়ী এটি ষোড়শ শতকে কছওয়াহা রাজারা বানিয়েছিলেন। পরে গোয়ালিয়র রাজ মাধো রাও সিন্ধিয়ার (১৮৮৬ - ১৯২৫) নির্দেশে এটি ভালো করে মেরামত হয়। কাছেরি মহলের দক্ষিণে ভাট্টিতে কাঠ জ্বালিয়ে স্নানের জল গরম করার ব্যবস্থা দেখা গেল। এরপর এলো নলরাজের পত্নী দময়ন্তী মহল। তারপর ফুলওয়া মহল।
এর একটি প্রেক্ষাপট জানালো বিলু। জনশ্রুতি রাজা মকরন্দের কন্যা ফুলওয়াকে আলহা বা উদল, দুভায়ের একজন রাজার অনুমতি ছাড়াই জোরপূর্বক বিয়ে করে। তাই সেই ভাইকে এই কেল্লায় বন্দি করা হলে অন্য ভাই এসে লড়াই করে মুক্ত করে। তখন রাজা বাধ্য হয়ে তার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ দেন কন্যার। তাই ফুলওয়া মহলে বিয়ের মণ্ডপের চারটি পিলার আজও দাঁড়িয়ে।
চাক্কি মহলে আটা পেষাই হতো। তার পাশে লাদাউ মহল - রাজাকে যারা শষ্য লগান (কর) দিতে আসতো তারা শষ্যের বস্তা এখানে লাদ (থাক) করে রাখতো। সেগুলো পরে পাশে আনাজ ভাণ্ডারে তুলে রাখা হোতো। এর পূবে একটি শিব মন্দির রয়েছে। এর পরে এলো কেল্লা দর্শনের শেষ দ্রষ্টব্য - ছিপ মহল। ছিপ মানে চন্দনের টিপ। ওখানে উৎসবের চন্দন গোলা হোতো এবং সবাই তা কপালে পরতো।
দুটো নাগাদ ঈলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হোলো। ছাতা আনি নি। কোথাও পেতে খানিক গড়িয়ে নেওয়ার জন্য ন্যাপস্যাকে একটা প্লাস্টিক থাকে। সেটা বার করে দুজনে আগেপিছে মাথার ওপর ধরে হাঁটছিলাম। একটু পরে বিলু বলে, আমার লাগবে না। ছোট থেকে এখানে আমি ছাগল চরাতে আসতাম। কতদিন বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে এমনিই ভিজেছি। আমার অভ্যাস আছে। রোদ-জলে পোড় খাওয়া শরীর। সে পরে আছে একটা রেক্সিনের জ্যাকেট। তাই গা ভিজছে না বটে কিন্তু মাথায় কিছু নেই। বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। হাতের পাতায় মুছে নিচ্ছে মাঝে মাঝে। শক্তপোক্ত ভূমিপূত্র সে। ওর মতো হতে পারলে তো চিন্তাই ছিল না।
কিন্তু আমি একা ঘুরছি। বয়স হয়েছে। আটমাস পরে ষাটে পড়বো। আরো বহু জায়গায় যাওয়া বাকি। শীতের বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগলে বেড়ানোই মাটি হয়ে যাবে। তাই মাথায় গায়ে প্লাস্টিক জড়িয়ে ওর সাথে ঘুরি। মন পিছু হাঁটে পঁয়ত্রিশ বছর আগে মেঘহাতাবুরুর বৃষ্টিভেজা জনহীন রাস্তায়। সেদিনও এমন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে প্লাস্টিক জড়িয়ে হাঁটছিলাম কয়েকজন বন্ধু। হু-হু হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিল প্লাস্টিক। তবু হা হা হাসির বিরাম নেই। বয়সধর্ম। বহু পিছনে ফেলে এসেছি সে সব দিন।
বিলুর সাথে ঘুরতে ঘুরতে যা দেখেছিলাম চিটপ্যাডে শর্টে রানিং নোট নিয়েছিলাম। অনেক জায়গাতেই কিছু লেখা নেই, দিক নির্দেশও নেই। ও না থাকলে বাঁশবনে ডোম কানা হয়ে ঘুরে মরতাম। সন্ধ্যায় লজে এসে শর্টহ্যান্ড নোট থেকে একটু গুছিয়ে লিখে বুঝলাম ও আমায় গোটা তিরিশেক দ্রষ্টব্যস্থানে নিয়ে গেছিল। বিলু না থাকলে বেশ চকমা খেতাম। বিরাট এলাকা, কত কী রয়েছে, ভুলভুলাইয়া টাইপের ব্যাপার। ওর বদান্যতায় মোটামুটি দেখা হোলো। শেষ দ্রষ্টব্য ছিপ মহলে এসে ওকে বলেছিলাম, এবার তুমি গেটে গিয়ে বসতে পারো, এখান থেকে আমি ঠিক চলে যাবো। ওকে কিছু বখশিশ দিই। ও নমস্কার করে চলে যায়। কিছুক্ষণ বসে থাকি বৃষ্টিভেজা নির্জন কেল্লায়। পাঁচটা নাগাদ নামতে শুরু করি নীচে।
ভূমিপুত্র বিলু
যাদের নির্জন, প্রাচীন, ভগ্নপ্রায়, পর্যটকবিরল কেল্লার প্রতি আকর্ষণ আছে তাদের জন্য বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে থাকা নরোয়র কেল্লার কিছু ছবি রাখলাম। এগুলি কেভিনের স্যান্ডেজের তোলা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।