সবার আগে রাত্রিবাসের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। মন্দির চত্বরের আগে বাঁদিকে একটা শেড দেখলাম। গোবর নিকানো পরিস্কার মাটির মেঝে। বাঁদিকে দেওয়ালের পাশে মেঝের ওপর কয়ারের চাটাই বিছানো। আলো, প্লাগ পয়েন্ট রয়েছে। ডানদিকে পাথরের উনুনে আধজ্বলা কাঠ, ছাই। কেউ ছিল। রান্নাবান্না করেছিল। আশপাশে কাউকে দেখছিনা যে জিজ্ঞাসা করবো। তবে মনে হোলো গোপেশ্বরে গোপীনাথ মন্দিরের পিছনে সন্তকুটীরের মতো এটাও যাত্রীদের জন্যই হবে। ২০১২-১৫ সালে মহারাষ্ট্রে পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় স্থানীয় দলের সাথে গোটা তেরো হিল ফোর্ট ট্রেকে গেছি। কয়েক জায়গায় রাতে পাহাড়ের গুহায়, মন্দির চত্বরে থেকেছি। তখন এমন জায়গা পেলে বর্তে যেতাম।তখন ঐ শেড বেবাক খালি। ঘুপচি তিওয়ারী লজের থেকে ঢের ভালো। সাথে ম্যাট, স্লিপিং ব্যাগ থাকলে দিব্যি থাকা যায়। কিন্তু ম্যাট রেখে এসেছি গোপেশ্বরের মন্দিরে। গরমকালে গেছি বলে স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে যাইনি। পাতলা ফ্লিসের কম্বল আছে। ভেবেছি দুটো পাজামা, দুটো জামা, ফ্লিসের জ্যাকেটের ওপর উইন্ডচিটার ও তার ওপরে ফ্লিসের কম্বল দিয়ে ম্যানেজ হয়ে যাবে। ভাবি আর একটু দেখি।
মন্দিরের ডানদিকে সার দিয়ে কয়েকটি পাকা ঘর। টিনের ঢালু ছাদ। পিছন থেকে তিনটি ঘরের দরজাতেই তালা। সেবায়েতরা থাকেন হয়তো। হলুদ তীর চিহ্নিত সেই পূতঃ মহাবৃক্ষ। সবুজ তীর চিহ্নিত প্রথম ঘরটির নীল দরজায় তালা নেই। দরজা ঠেলে ঢুকি। একটি কাঠের চৌকির ওপর মোটা শতরঞ্জি পাতা। দেওয়ালের কোনে ছোট একটি টেবিল। পিছনের ছোট্ট জানলা খুলি। দুরে পঞ্চম কেদারের দূর্গমতম রূদ্রনাথের তুষারাবৃত পাহাড় একদম ক্যালেন্ডার। নীচে সবুজ জমি নেমে গেছে নীচে। হু হু ঠান্ডা হাওয়া।
সকাল থেকে ওপরে আসার সময় পথের হাবভাব দেখেই মনে হয়েছে সেদিন যাত্রী বিশেষ আসেনি। যারা এসেছিল তারাও নেবে গেছে। রাতে এখানে থাকার কেউ নেই। যখন মন্দিরের কাউকে দেখছিনা, অনুমতি নেওয়ারও বালাই নেই। দরজায় তালা নেই যখন এ ঘর বেওয়ারিশ। অতএব ঠিক করি এখানেই থাকবো। শতরঞ্জির ওপর সঙ্গে আনা প্লাস্টিক চাদর পাতি। হয়ে গেল এক রাতের বিছানা। ন্যাপস্যাক থেকে শুকনো খাবার, পাজামা, জামা, জ্যাকেট, কম্বল, হাওয়া বালিশ বার বিছানায় রাখি। কেবল জলের বোতল ও ছাতা নিয়ে বেরোই। দরজায় নিজের তালা লাগিয়ে সূচীত করে যাই - আপাতত এখানে কেউ আছে। চত্বরের কোনায় সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে দেখি বাথরুম, ইন্ডিয়ান টাইপ টয়লেট। কলে জলও আছে। আর কি চাই।
ভক্ত, পূজারীহীন ফাঁকা মন্দিরে ঢুকে সতী অনসূয়া দেবী মাতাজীর ছবি নিই। মান্যতাপ্রাপ্ত মন্দির অথচ তখন জনহীন! এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল ঐ ভ্রমণেই আর একবার - রূদ্রপ্রয়াগ থেকে কার্তিকস্বামীর পথে এক অখ্যাত স্থানে। আসতেও পারে সে কথা কখনো এই সিরিজে।
অনসূয়া দেবী সম্পর্কিত কিংবদন্তি সুবিদিত। তবু আমার মতো করে বলি। অত্রিমুনি তখন এই মন্দির থেকে দুই কিমি আগে একটি গুহায় তপস্যা করেছিলেন। ঋষিপত্নী অনসূয়া এখানে একটি কুঁড়েঘরে থাকেন। পতিব্রতা অনসূয়ার খ্যাতি ত্রিলোকে সুবিদিত। এর ফলে পার্বতী, লক্ষ্মী এবং সরস্বতীর মধ্যে অসূয়াবোধ তৈরী হয়। অনসূয়ার সতীপনার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তাঁরা তাদের স্বামীকে অনসূয়ার কাছে পাঠান। বিপজ্জনক প্রোপোজিশন। কারণ পতিরাও হড়কাতে পারেন।
ত্রিদেব তাঁদের পত্নীদের বোঝানোর চেষ্টা করন, একজন পতিব্রতা ঋষিপত্নীর সতীত্বের পরীক্ষা নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু রমণীর মন না জানতি দেবাঃ, ঈর্ষা তো আরো বিষম বস্তু। অগত্যা ত্রিদেব চললেন সতী অনসূয়ার সতীত্বের পরীক্ষা নিতে।
অনসূয়ার কুটীরে দুপুরে ত্রিদেব তিন ঋষির ছদ্মবেশে হাজির হয়ে বলেন, কিছু খেতে দাও, কিন্তু একটি শর্ত আছে - অন্ন পরিবেশন করতে হবে বস্ত্রহীন হয়ে। এমন উদ্ভট শর্তে বিচলিত হয়ে অনসূয়া চোখবুঁজে পতিকে স্মরণ করলেন। অত্রিমূনির যোগবলে সতী মনশ্চক্ষে দেখতে পেলেন তাঁর পরীক্ষা নিতে ছদ্মবেশে এসেছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। পতিই যোগবলে একটি ঘটির জল মন্ত্রপূতঃ করে সতীকে টেলিপ্যাথিতে পরামর্শ দিলেন কী করতে হবে।
সতী বলেন, আপনাদের শর্ত শিরোধার্য তবে সেক্ষেত্রে আপনাদের আমার সন্তানসম হয়ে অন্নগ্ৰহণ করতে হবে। এই বলে সতী তিনজনের ওপর দিলেন ছিটিয়ে সেই মন্ত্রপূতঃ বারি। ব্যস, পত্রপাঠ তিন ছদ্মবেশী ঋষি হয়ে গেলেন সতীর পূত্রসম কচি বালক। মায়ের কাছে শিশুর বা শিশুর কাছে মায়ের লজ্জা কীসের? অনসূয়া ঋষিশর্ত অনুযায়ী বস্ত্রত্যাগ করেই অন্ন পরিবেশন করলেন। বজায় থাকলো তাঁর সতীত্ব।
ওদিকে তিন পত্নী উদগ্ৰীব। ফিরছেন না কেন তাঁদের পতিরা? এতোক্ষণ লাগে পরীক্ষা নিতে? ডিভাইন ভিডিওকলে তাঁরা দেখলেন তিনটি পুঁচকে বালক নিকার পরে সতীকুটীরের আঙিনায় খেলছে। তাঁরা আঁতকে উঠে বলেন - এ কী অবস্থা তোমাদের? ত্রিদেব বলেন, কী বলবো বলো। তোমাদের জোরাজুরিতে সতীর পরীক্ষা নিতে এসে আমাদের কী হাল হয়েছে দ্যাখো। বারণ করেছিলাম, শুনলে না। সাধে কী বলে, স্ত্রী বুদ্ধির স্থান হাঁটুতে।
তিন দেবী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ঋষিপত্নীকে টেলিকলে অনুরোধ করেন - ঘাট হয়েছে, মাফ করে দাও। আমাদের পতিদের অরিজিনাল কন্ডিশনে ফেরত পাঠিয়ে দাও পিলিজ। স্বভাবে দ্বেষ, অসূয়া নেই বলেই তো সতীর নাম অনসূয়া। তিনি আবার জল ছিটিয়ে ত্রিদেবকে পূর্বাবস্থায় রূপান্তরিত করে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন কৈলাস, বৈকুণ্ঠ, ব্রহ্মলোকে। ঐ পৌরাণিক বিশ্বাসের নিদর্শন মন্দির দ্বারের বাইরে একটি পাথরে প্রতিফলিত।
রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে চললুম অত্রিমুনির তপোগুহার দিকে। ওখান থেকে প্রায় দুই কিমি। মন্দির থেকে আন্দাজ দেড় কিমি দুরে বাঁদিকে উপরের পথটা চলে গেছে পঞ্চকেদারের দূর্গমতম রূদ্রনাথ। নীচের পথটা গেছে অত্রিমুনির গুহার দিকে। শিশুপাল বলেছিল ওখানে পাহাড়ের নীচে এক গুহায় মধ্যপ্রদেশের এক ডাক্তার বিগত আট নয় বছর ধরে একাকী সাধনে রত। বর্তমানে দিগম্বর অবস্থায় আছেন কিন্তু মৌনী নন। চাইলে দেখা করতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছা হয়নি। একটি মানুষ পেশা, পরিবার ত্যাগ করে এতোদুরে, এতোদিন ধরে, নির্জনে একাকী সাধনে রত। তাঁর সাধনা যাই হোক, আমি আধ্যাত্ম্যিকতার বোধহীন এক শহুরে মানুষ, তাঁর সাথে দেখা করে কী করবো? তাঁকে তাঁর মতো থাকতে দেওয়াই উচিত। কাছে গিয়ে দেখলাম পাথরের ফাঁকে হলুদ প্লাস্টিক, দরজা লাগানো গুফার গায়ে রামশিলা লেখা। কয়েকটি সোলার প্যানেল রয়েছে বাইরে। তার মানে ব্যাটারিও আছে। অর্থাৎ উনি এক মডার্ন বাবা। তবু দেখা করতে ইচ্ছা করলো না।
লিখতে গিয়ে নেটে ১০/১৩এর একটি ব্লগে এই ছবিটি পেলাম। তাহলে তাঁর নাম অখিলেশ্বরানন্দ স্বামী। ব্লগে দেখলাম, উনি কারুর সাথে আলাপচারিতায় আগ্ৰহী নন, ছিলেন নিউরোলজিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু ইলেকট্রনিক্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আগ্ৰহ আছে। ঐসব বিষয়ে গুহাতে বইপত্র আছে। সেসব নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছবিতে ডেট দেখছি ১.১.২০০৮ - হয়তো ওটা ভুল। তবে মনে হয় ওখানে উনি ২০১৩ সালের আগে থেকেই আছেন। তখন কী AI নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছিল? এক ডাক্তার কোন সুদুর হিমালয়ের গুহায় নির্জনে একান্তে সাধনার সাথে ইলেকট্রনিক্স, AI নিয়ে পড়াশোনা করেন বোঝা দায়!
মনে পড়লো আমার প্রিয় লেখক নারায়ণ সান্যালের কুম্ভমেলায় নাগাসন্ন্যাসীদের মাতামাতি প্রসঙ্গে একটি লেখায় ওনার নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা :
“আমার সারা জীবনে প্রকৃত জ্ঞানতপস্বীর দেখা মাত্র একবারই পেয়েছি - বদরীকাশ্রমেরও উত্তরে। একটি গুহার ভিতর বসে ছিলেন সন্ন্যাসী। তিনি যে দিগম্বর সেটা বোঝা যাচ্ছিল না, তাঁর ‘সমং কায়শিরোগ্রীব' পদ্মাসনে চরণযুগলের স্থাপনের ভঙ্গিমায়। ভাস্করানন্দস্বামীর সেই পরিচিত ভঙ্গিমা! কুণ্ডু ট্র্যাভেলসের ম্যানেজার বিনয়বাবু সেবার আমাকে বলেছিলেন — সেই দিগম্বর সাধু নাকি সারা শীতকাল ঐ গুহাতেই সাধনা করেন ; যখন বরফে চারিদিক ঢেকে যায়, নির্জন বদ্রীনারায়ণতীর্থে জনমানব থাকে না, তখনো। সে জাতীয় সর্বত্যাগী নাগা সন্ন্যাসীকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় নেমে আসতে হয় না কুম্ভস্নান করতে। অন্তরের মানসগঙ্গায় তাঁদের নিত্য অমৃত - অবগাহন।” রামশিলা গুহার কাছাকাছি থেকে অত্রিমুনি প্রপাতটি দেখলাম। এর সাথে ছোটোখাটো আরো কয়েকটি জলধারা মিশে পরে অমৃতগঙ্গা হয়ে নীচে বয়ে চলেছে। ইচ্ছে ছিল অত্রিমুনির গুহায় যাবো। হোমওয়ার্ক করে জানি সে পথ সংকীর্ণ। এক জায়গায় প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হয়। তেড়ে বৃষ্টি এলো। পিছল পাথুরে পথ। আমার ভক্তিভাব প্রবল নয়। অত্রিমুনির সাধনগুহা না দেখলেও চলে।
সহ্যাদ্রীতে হিল ফোর্ট ট্রেকে এমন বেশ কিছু সংকীর্ণ পথে গেছি। গুহায় রাতে গেছি। এসব নতুন কিছু নয় আমার কাছে। তখন গেছি দলে। বিপজ্জনক অংশে দড়ি লাগানো হয়েছিল। এখন কোনো লোকজন নেই এখানে। একা, প্রবীণ বয়সে, এমন নির্জন জায়গায় অযথা ঝুঁকি না নিয়ে ফিরে চললুম। বেঁচে থাকলে বরং যেতে পারবো আরো কিছু একাকী ভ্রমণে। (উপরের ছবি দুটি নেট থেকে নেওয়া)।
বাঁদিকের পথে দেখলাম ফলক - রূদ্রনাথ ১২ কিমি। পরদিন ফেরার সময় শিশুপালের ধাবায় বসে একথা বলতে শিশু বলেছিল ওটা ভুল। ঐ পথে ও গেছে আগে। কম করে ১৪/১৫ কিমি হবে। কানাইয়াধার, হানসা বুগিয়াল, ধনপাল ময়দান, নাওলা পাস পেরিয়ে যেতে হয় রূদ্রনাথ। মন্ডল থেকে ২১/২২ কিমি হাঁটা পথ। ওটা রূদ্রনাথ যাওয়ার প্রচলিত পথ নয়। দূর্গম এবং নির্জন। মাঝে মেষপালকদের ছাউনি ছাড়া থাকার কোনো জায়গা নেই। ও পথে গাইড ও দলে ছাড়া যাওয়া উচিত নয়। তবে গেলে এ পথে না ফিরলেও চলে। রূদ্রনাথ থেকে ১৮ কিমি হেঁটে সগ্গর গাঁওতে নেমে এলে বাসপথে ৫ কিমি দুরে গোপেশ্বর চলে যাওয়া যায়। চোপতা - মন্ডল - গোপেশ্বরের পথেই সগ্গর। না হলে রূদ্রনাথ থেকে পনার বুগিয়াল, দুমক, বংশীনারায়ন হয়ে এক যাত্রায় পঞ্চকেদারের আর এক কেদার কল্পেশ্বরে নেমে যাওয়া যায়। দর্শন করে দেবগ্ৰাম হয়ে ঋষিকেশ যোশিমঠ সড়কে হেলাং চলে যাওয়া যায়। দেবগ্ৰাম হেলাং শেয়ার জীপ চলে। কল্পেশ্বর বা সগ্গর থেকেই বেশিরভাগ লোক রূদ্রনাথ যায়।
২০১৯এর উত্তরাখণ্ড ভ্রমণে পঞ্চকেদারের দুটি কেদারে গেছিলাম। ২০.৫ একাকী যোশিমঠ থেকে হেলাং এসে দিনে দিনে কল্পেশ্বর দেখে ফিরে গেছিলাম। ২৮.৫ পঞ্চকেদারের উচ্চতম তুঙ্গনাথ ও তার উপরে চন্দ্রশিলা গেছিলাম গুপ্তকাশীতে আলাপ উপরের ছবিতে পাঁচটি উত্তরপ্রদেশের তরুণের সাথে। মাঝে লাল টুপিতে আমি। খুব ভদ্র তারা। জলন্ধরে IT পড়ছে। হরিদ্বার থেকে ওদের ফেরার ট্রেন টিকিট তিনদিন পরে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। বলেছিলাম, চাইলে চলো আমার সাথে তুঙ্গনাথ, দেওরিয়া তাল ঘুরে আসি। ঘর থেকে একাকী বেরিয়ে পথে আলাপ পাঁচটি তরুণের সাথে সেই দু রাতের ছোট্ট দলীয়।ভ্রমণও বেশ লেগেছিল। উখিমঠে গ্ৰুপ ফটো তুলে ওরা চলে গেল হরিদ্বার। আবার আমি একা।
অনসূয়া মন্দিরের কাছে ফিরে এলাম। ময়দানের এক পাশে রয়েছে অত্রিমুনি ও অনসূয়া দেবীর পূত্র দত্তাত্রেয়র জন্মস্থানে ছোট একটা মন্দির। এখানেই হয় ডিসেম্বরে দত্তাত্রেয় জয়ন্তী মেলা।
দত্তা মন্দিরের পিছনে গীতা কুটীর। ঘরটি বন্ধ। বারান্দায় টিনের ছাত। তিনদিক খোলা। ৭১৩৪ ফুট উচ্চতায় স্লিপিং ব্যাগ না থাকলে মাঝরাতে ঠাণ্ডায় কাঁপতে হবে। গুলবাঘের ব্যাপারটাও আছে। তা না হলে দু চার জনের দলে এলে, স্লিপিং ব্যাগ থাকলে এখানেও এক পাশে আগুন জ্বেলে রাত কাটানো যায়।
তিওয়ারি লজের ম্যানেজার নারায়ণ সিং বিস্ত গেছেন মন্ডলে। লজে রয়েছে কুক কাম হেল্পার। নিকোনো রান্নার জায়গায় বসে তাকে বলি বানাও ম্যাগী মশালা, চা। ওটাই রেডিমেড পাওয়া যায় ওখানে। দাল-চাওল, রুটি সবজি খেতে চাইলে আগে বলতে হয়। লোকজন কম আসে বলে তৈরী থাকেনা। অর্ডার পেলে বানায়। পৌনে ঘন্টা লাগে। তখন সাড়ে চারটে বাজে। দেখলাম দোকানে বসে আছেন এক কমবয়সী দম্পতি। একটু আগে এসে পৌঁছেছেন এখানে মাতাজীর মান্নত মাঙ্গতে। তার মানে হয়তো বিয়ের কিছুদিন হয়ে গেছে, তাও সন্তান হয়নি। তারা চা খেয়ে গেল মন্দিরে। সন্তানের আকাঙ্খা তো মেয়েদেরই বেশী হয়। মহিলা স্নান করে পুজো দেবেন বললেন। স্বামী সাথে চলেছেন স্টেপনির মতো। পুজো দিয়ে নেবে যাবেন মন্ডলে। ওরা স্থানীয়। অল্প বয়স। সাথে মালপত্রও নেই। হয়তো ফেরার পথে এক ঘন্টায় নেমে যাবেন মন্ডলে।
আমি আয়েশ করে ডাবল ম্যাগী ও চা খাই। হয়ে গেল ফার্স্ট রাউন্ড ডিনার। রাতে ঘরে মুড়ি, ছোলাভাজা, বাদাম পাটালি দিয়ে করে নেবো সেকেন্ড রাউন্ড ডিনার। সন্ধ্যায় মন্দিরে গিয়ে একটু বসি। ভক্তজন কেউ নেই। একজন পূজারী এসে ক্যাসেটে হালকা ভলিউমে মাতৃ আরাধনার ভজন চালিয়ে, ধূপ, প্রদীপ জ্বালিয়ে একটু আরতি করে চলে যান। একটু পরে ঘরে যাই। আমি যে একটা খালি ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছিলাম, আসার পরে ঘরে আলো জ্বালালাম, কেউ কিছু জানতেও এলো না। ভেতরে কেউ আছে তার প্রমাণ হিসেবে আমি দরজার বাইরে কুন্ডির হুকে আমার তালা লাগিয়ে রাখি। নইলে আমাকেও কেউ তালা লাগিয়ে চলে যেতে পারে।
আজ সারাদিনের কিছু অভিজ্ঞতা, শিশুর থেকে জানা কিছু তথ্য চিটপ্যাডে লিখে রাখি। নটা নাগাদ সেকেন্ড রাউন্ড ড্রাই ডিনার করে শুয়ে পড়ি। সামনে পেছনে দরজা জানলা বন্ধ করে দিয়েছি। তাও পিছনের কাঠের জানলার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আলো জ্বললে ঘুমের অসুবিধা হয়। তবু দুশো ওয়াটের বাল্বটা জ্বালিয়ে রাখলাম। যেটুকু উত্তাপ দেয়। রাত বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ঠান্ডা। মে মাসেই এই অবস্থা। ডিসেম্বরে নিশ্চিত কাঁপিয়ে দেয় এখানে। বাড়িতে দুটো স্লিপিং ব্যাগ থাকতেও স্যাকে জায়গা বাঁচাতে পাতলা ফ্লিসের কম্বল আনার ভুলের খেসারত দিলাম। মে মাসেও বন্ধ ঘরে ডাবল পাজামা, ডাবল জামা, পাতলা ফ্লিসের জ্যাকেট, উইন্ড চিটারের ওপর পাতলা ফ্লিসের কম্বল গায়ে সারারাত ঠান্ডায় এপাশ ওপাশ করে গেলাম।
এই সেট-আপে ২৮.৫এ ১২ হাজার ফুটে তুঙ্গনাথেও কেঁপে মরতাম। ওখানে কালী কমলি ধরমশালায় একটা মাঝারি ঘরে ছজনে থাকায় শরীরের গরম একটা ফ্যাক্টর ছিল। কেয়ারটেকার কম্বল দিয়েছিল বলে বেঁচে গেছি। এই ভুল আবারও করেছি ২০২০ সালের শীতে মধ্যপ্রদেশে দু মাসের একাকী ভ্রমণে। সেবারেও ঐ পাতলা ফ্লিসের কম্বল নিয়ে গেছিলাম। জানুয়ারি ১০ তারিখ ঝাঁসির কাছে করেরা হনুমান মন্দিরের ঘরে ঠান্ডায় কেঁপেছি সারারাত। (এই সিরিজের ৯ পর্ব)। ২০২২ এর ডিসেম্বরে দুমাসের একাকী ভ্রমণে আর এই ভুল করিনি। স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে গেছিলাম। তাই তো কথায় বলে - ছাগল দিয়ে লাঙ্গল দেওয়া গেলে চাষা বলদ কিনতো না।
পুনশ্চঃ - পরদিন সকালে চলে আসার আগে মন্দিরে দানপাত্রে কিছু দক্ষিণা দিতে গেছিলাম। বেরোবার সময় দেখি মন্দিরের সামনে গ্ৰিল ঘেরা অংশের ডানদিকে একটা টেবিলের ওপর থাক দিয়ে রাখা অনেকগুলি পরিস্কার, মোটা সিন্থেটিক কম্বল। যাত্রীদের জন্যই রাখা। কাল সন্ধ্যায় এখানে বসে আরতি দেখেছিলাম। তখন চোখে পড়েনি। পড়লে একটা নিয়ে যেতাম। তাহলে সারারাত অযথা ঠাণ্ডায় কাঁপতে হোতো না। এসবকেই বলা যায়, দেখেছি, কিন্তু খেয়াল করিনি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।