আগের পর্বে বলেছিলাম তিনটি বিপজ্জনক অপরাধীর উদাহরণ দেবো যাদের আজীবন কারাগারে বন্ধ করে রাখাই বাঞ্ছনীয়:
১. চার্লস শোভরাজ - সুদর্শন, সপ্রতিভ, লেডিকিলার শোভরাজ বিকিনি কিলার নামেও পরিচিত। কেননা তাঁর বেশ কিছু শিকার মৃত্যুকালে ছিলেন বিকিনি পরিহিতা। তাঁর শিকারদের সুচতুরভাবে প্রতারণা করাই শুধু নয় জেল ও পুলিশের কর্মীদের চোখে ধূলো দিতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধ। তাই তার আর একটি নাম হয়ে গিয়েছিল Serpent. তার জীবনের ওপর সিনেমা, তথ্যচিত্র ছাড়াও ২০২১এ BBC/Netflix বানায় আট পর্বের ড্রামা সিরিজ - The Serpent. (আমি দেখিনি)
সিরিয়াল কিলার শোভরাজ ১২ জন মহিলাকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তবে সম্ভবত তিনি ৩০ জনকে হত্যা করেন। ভারতের জেলে ২০ ও নেপালের জেলে ১৯, জীবনের ৩৯ টা বছর জেলে কাটিয়ে শোভরাজ ৭৮ বছর বয়সে মুক্তি পান। কৃতকর্মের জন্য তার কোনো অনুতাপ হয়নি। বরং তাঁর অপরাধ জীবনের অভিজ্ঞতা বই, সিনেমা, টিভি সিরিয়ালের জন্য বিক্রি করে রয়্যালটি হিসেবে প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন। প্রভাব খাটিয়ে, ঘুষ দিয়ে তিনি ভারতের জেলেও ছিলেন আয়েশে। চার্লসের মতো অপরাধী কারাদন্ড মার্জনার যোগ্য নয়।
মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান - ২৫ বছর বয়সে তিনমাস ধরে পরিকল্পনা করে মার্ক ঠান্ডা মাথায় জন লেননকে হত্যা করে। সেদিন সে অনেকক্ষণ জনের বাড়ির নীচে আর্কেডে অপেক্ষা করেছিল। সে পিছন থেকে জনকে পাঁচবার গুলি করে। খুব কাছ থেকে গুলি করেছিল সে। তবু একটি ফসকে যায়। চারটি লক্ষ্যভেদ করে। জন হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মারা যায়। মার্ক গুলি চালিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। ফলে হাতেনাতে ধরা পড়ে। বিচারে আজীবন কারাবাসে দণ্ডিত হয়ে মার্ক জেলে আছে ১৯৮১ সাল থেকে। কুড়ি বছর পর মার্ক আইনানুগ প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেছিল। তার আবেদন বিশেষজ্ঞ মনোবিদ, পুলিশ কর্তাদের দ্বারা নাকচ হয়। তাদের ধারণা মার্কের impulsive nature, psychotic behavior, least regard for human life, personality disorder, manic depression, paranoid schizophrenia ইত্যকার নানাবিধ মানসিক জটিলতার কারণে ও সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। ফলে এযাবৎ ওর তেরোবার প্যারোলের আবেদন নাকচ হয়েছে। ৪৪ বছর জেলে কাটিয়ে মার্ক ২০২৫ সালের আগস্টে চতুর্দশতম প্যারোল আবেদনের শুনানির অপেক্ষায় আছে। তখন মার্কের বয়স হবে সত্তর।
হাদি মাতার - ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের জন্য ১৯৮৯ সালে ইরানের ধর্মগুরু আয়াতোল্লা খোমেনী সলমন রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারী করেন। সে বছরেই খোমেনী মারা যান কিন্তু জারি থাকে ফতোয়া। সাথে যোগ হয় রুশদির প্রাণনাশের পুরস্কার - তিন মিলিয়ন ডলার। সলমন ব্রিটিশ নাগরিক। তাই ব্রিটেন তাঁকে সরকারি নিরাপত্তা দেয়। প্রাণনাশের আশাংকায় রুশদি দশ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ব্রিটেনে গোপন জায়গায় সরকারি নিরাপত্তায় কাটান। তবুও তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট ইরাণী সন্ত্রাসীরা তাঁর ওপর ছবার ব্যর্থ হামলা চালায়। ১৯৯৮ সালে ব্রিটেন ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতায় ইরান রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের তুলে নেয়। তবে ফতোয়া ও পুরস্কার জারি থাকে। ২০০০ সাল থেকে রুশদি ভাবেন তাঁর প্রাণনাশের বিপদ হয়তো কেটে গেছে। তাই তিনি আমেরিকায় যাতায়াত শুরু করেন বিশেষ নিরাপত্তা ছাড়াই।
১২ই আগস্ট ২০২২ - ফতোয়া জারির ৩৩ বছর পর নিউ ইয়র্কের Chautauqua Institution এর অডিটোরিয়ামে রুশদি যে বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গেছেন - ভুক্তভোগী হিসেবে সেটি তার ভালোভাবে জানা - The importance of protecting writers whose lives are under threat. হঠাৎ দর্শকদের মধ্যে থেকে ২৪ বছরের হাদি মাতার ছুটে উঠে আসে স্টেজে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুশদিকে দশ, বারোবার ছুরিকাঘাত করে। ও হাতেনাতে ধরা পড়ে। রুশদি প্রাণে বেঁচে যান। তবে ওনার ডান চোখ নষ্ট হয়ে যায়। একটা হাতও আংশিক অকেজো হয়ে যায়।
পরে রুশদি সাংবাদিকদের বলেছেন - হাদি মাতারের সাথে তাঁর ঐ ২৭ সেকেন্ডের চকিত মোলাকাত ছিল প্রায়-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা - Near Death Experience. আর হাদি সাংবাদিকদের বলেছিল - রুশদি বেঁচে গেল? ভারি আশ্চর্য তো! রুশদিকে ১৮ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার সময় তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, আপনি ভাগ্যবান কারণ হাদি ঠিক জানতো না - ছুরি দিয়ে নিশ্চিতরূপে কীভাবে মানুষ মারা যায়।
তিন মাসের পরিকল্পনায় সেটা ভালো করে জানতো লেননের হত্যাকারী মার্ক। সে কাছ থেকে পাঁচটা গুলি ছুঁড়েছিল .38 Special হেভি ক্যালিবার রিভলবার থেকে। পয়েন্টেড বুলেট শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যেতে পারে তাই ও ভেবেচিন্তে ব্যবহার করেছিল Hollow point expanding বুলেট যা Soft Target মানে মানব শরীরে ঢুকেই ছেৎরে ফেটে যাবে - to cause maximum damage. তাই লেনন হাসপাতাল অবধি জীবন্ত পৌঁছোতে পারেন নি।
হাদি লেবাননের মুসলিম। সে ছশো পাতার স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের চার পাঁচ পাতার বেশী পড়েনি। কিন্তু শুনেছে রুশদি ঐ বইতে ইসলামের অবমাননা করেছেন। সে খোমেনীর ফতোয়ার কথাও জানতো। ওর হয়তো মনে হয়েছে তা পালন করার নৈতিক দায়িত্ব ওর ওপরেও বর্তায়। তাই সে রুশদির প্রাণ নিতে চেয়েছিল। হাদি ধরা পড়ার পর ওর মা ওর সাথে দেখা করেননি। ওর প্রাণভিক্ষাও করেননি। ওর ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে চাননা। মঞ্চে হাতে ছুরি নিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েও হাদি আদালতে বলেছে ও নিরপরাধ - he pleaded not guilty. দেখা যাবে আদালত কী ভাবে।
ফেরা যাক মুক্ত বন্দীশালায়
অনেকের ধারণা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ১৪ বা ২০ বছর। এই ধারণার কারণও আছে। অনেক সময় সরকার কিছু আজীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের ১৪ থেকে ২০ বছর মেয়াদ খাটার পর ছেড়ে দেন। কিন্তু সরকার চাইলে কাউকে আমৃত্যু কারাগারে বন্দী রাখতে পারে। তবে নতুন, হার্ডকোর অপরাধীদের জন্য কারাগারে স্থান সংকুলানের জন্য জেলারের সুপারিশে সাজার মেয়াদের এক তৃতীয়াংশ রেগুলার জেলে কাটানোর পর কিছু শান্ত, ভদ্র, নিরীহ স্বভাবের দণ্ডিতদের মুক্ত বন্দীশালায় এনে রাখা হয়। তাতে বন্দী পিছু সরকারের খরচও হয় অনেক কম।
তবে কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা মুক্ত বন্দীশালায় আসার সুযোগ পায় না। সেগুলি আর না লিখে উৎসুকদের জন্য রাজস্থান সরকারের Open Prison Policy থেকে রুল 3 অংশটাই রেখে দিলাম। তাতে দুটো কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার চোখে পড়লো। এক- ক্লজ 3d তে যেসব ধারায় দণ্ডিত অপরাধীরা মুক্ত বন্দীশালায় আসার জন্য বিবেচিত হবে না বলা আছে তাতে দফা 302 বা নরহত্যা নেই কিন্তু আছে দফা 303 - এই দফা লাগু হয় যদি কেউ সাজার মেয়াদ কাটার সময়ে জেলে বা প্যারোলে কদিনের মুক্তি পেয়ে তখন আবার কাউকে হত্যা করে। তখন শাস্তি ফাঁসি বা আমৃত্যু কারাবাস।
দুই- ক্লজ 3m - অবিবাহিত বন্দীরা বিবেচিত হবে না। অর্থাৎ মুক্ত বন্দীশালায় স্থানান্তরিত হতে গেলে তাদের রেগুলার জেলে আসার আগে বিবাববন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। জেল থেকে প্যারোলে কদিনের ছুটি পেয়ে বন্দীরা সহোদর/রা ভাই বোনের বিয়েতে যেতে পারে তবে নিজে বিয়ে করে কিনা জানা নেই। জেল খাটা পাত্রর সাথে কনের পিতামাতা বিয়ে দিতে বা পাত্রী নিজেই বিয়েতে রাজী হবে বলে মনে হয়না। তবে আইনত কোনো বাধা আছে বলে মনে হয় না। এই ক্লজটা আমার অদ্ভুত এবং অযৌক্তিক লাগলো।
নরহত্যার দায়ে দণ্ডিত বিবাহিত অপরাধীর একজন অভয় রাজ গুর্জর। ২০০৮ সালে ওর গাঁয়ে এক উৎসবের রাতে ও তরোয়ালের কোপে ওদের গাঁয়ের এক অত্যাচারী গুণ্ডা ও তার দুই সাগরেদের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছিল। কিন্তু ও পালায় নি। তরোয়াল হাতে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। গুণ্ডার দল সে রাতে বেশ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। অভয়ের উন্মত্ত তরোয়ালের সামনে দাঁড়াতেই পারে নি। কচুকাটা হয়ে যায়। অভয় বলে, গ্ৰামবাসীরা খুশিতে গ্ৰামে ১০০ কেজি লাড্ডু বেটেছিল।
থানেদার সে রাতে ওকে বলেছিল, কুছ মজবুরী কে বজহ সে বেবশ হমলোগ যো নেহি কর পায়া, তু নে কর দিখায়া অভয় - সাবাশ! আদালতে থানেদারের সদর্থক সাক্ষ্যে প্রতিপন্ন হয় অভয় যাদের উড়িয়ে দিয়েছে তারা কেউই নিরীহ সাধারণ গ্ৰামবাসী নয়। অত্যাচারী গুণ্ডা। অভয় ঐ কাজ করে ফেলেছে সহ্যের সীমায় পৌঁছে ক্ষণিকের উত্তেজনায়। তাই বিচারে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় অভয়ের।
অভয়ের কথা শুনে মনে পড়ে গোবিন্দ নিহালনির ‘অর্ধ সত্য’ সিনেমার শেষ দৃশ্য। সাসপেন্ডেড ইনস্পেক্টর অনন্ত ভেলাঙ্কার (ওম পুরী) সিভিল ড্রেসে বুলেট চালিয়ে থানায় আসে। তার সিনিয়র সফি ইনামদার ওর হাবভাব দেখে শঙ্কিত হয়ে বলে - কেয়া বাত হ্যায় ভেলু? ওম ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে - স্যার ম্যায় নে রামা শেট্টি কো মার দিয়া। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সমাজবিরোধী রামা শেট্টির জন্যই ওম পুলিশের উর্দী পরেও কিছু করতে না পেরে নিজেকে নপুংসক ভাবছিল অনেকদিন ধরে। রামাকে ক্ষণিকের উত্তেজনায় গলা টিপে মেরে ফেলা একটি স্ফূলিঙ্গে সেই জমা বারুদে লাগা বিস্ফোরণ। সে বারুদ জমা হয়েছিল নীতিবান ইন্সপেক্টর অনন্ত ভেলাঙ্কারের মনে - অনেকদিন ধরে - নানা পরিস্থিতিতে।
সদ্যজ্ঞাত প্রেক্ষিতে আমি ভালো করে আবার অভয়কে দেখি। ২০২৩ এ তখন ওর বয়স বললো ৪৮ - তাহলে ১৫ বছর আগে যখন ও তরোয়ালের ঘায়ে কচুকাটা করেছিল তিন গুণ্ডাকে - তখন ও তেত্রিশ। এখন শীর্ণকায় চেহারা, শান্ত মুখভাব দেখে অনুমান করা কঠিন একদা এই মানুষটি ক্ষিপ্ত হয়ে এক লপ্তে তিন গুণ্ডার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছল। গতকাল কেল্লায় ওকে দেখে ঘুণাক্ষরেও মনে হয়নি ও এক অতীতের ঘাতক! সাবেক পোষাকে সহজ সরল স্বাভাবিক এক দেহাতী মানুষ বলেই মনে হয়েছিল।
জিজ্ঞাসা করি, ঐ ঘটনার জন্য কী পরে আপনার কোনো অনুশোচনা হয়েছে?
- কখনোই নয়। পুণ্যকাম করলে অনুশোচনা কেন হবে বাবুজী?
- ঠিক আছে, অনুশোচনা না হোক, এই যে আপনার জীবনের পনেরোটা বছর জেলে কেটে গেল, তার জন্য কোনো আক্ষেপ হয়?
- তা হয় বৈ কি। তবে পুণ্য কামাতে গেলেও তো দক্ষিণা দিতে হয়, ভেবেছি এটাও তেমন। তবে ওপরওয়ালা আছেন। তাই আবেদন করতে এগারো বছর জেলে কাটানোর পর সরকার এখানে পাঠিয়েছে। এখানেও চার বছর হয়ে গেল। হালে রিহাইয়ের আবেদন করেছি। হয়তো মঞ্জুর হয়ে যেতে পারে।
- এখানে এসে কেমন লেগেছে?
- এখানে থাকলে জেলের মতো দমবন্ধ লাগে না। পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখা যায়। তাইতো আমাদের একমাত্র ছেলে নির্মল এগারো ক্লাসের পরীক্ষার পর চন্দ্রপুর থেকে কদিনের জন্য এসেছে আমার কাছে থাকতে।
- এখানে পরিবারের কেউ আপনার সাথে এসে থাকতেও পারে? তাহলে তো ভালোই বলতে হবে।
- হ্যাঁ পারে। একজনের সাথে আলাপ করাবো। নারায়ণ সিং তোমর। সে তার বৌকে নিয়ে আছে। এখানেই তাদের একটি মেয়েও হয়েছে। নাম রেখেছে নয়না।
- তোমর মানে তো রাজপুত বংশের?
- হ্যাঁ। ওর চেহারা দেখবেন। ওদের মেয়েকে দেখবেন। অপরাধ একটা করে ফেলেছে বটে কিন্তু কথা বললে বুঝবেন ওর তওরতড়িকা গাঁওয়ারদের মতো নয়।
- কিন্তু বৌ নিয়ে আছে মানে? বিয়ে কখন হোলো?
- বিয়ে ওর জেলে আসার আগেই হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের মাস চারেকের মধ্যেই খুনের দায়ে ধরা পড়ে নারায়ণ। তখনও ওদের ছেলেপুলে হয়নি। ওদের পরিবারের কারুর নেতাদের সাথে যোগাযোগ আছে। তাদের সুপারিশ, বৌ সন্তানহীনা এই সব কারণে সাত বছর রেগুলার জেল খেটে এই মুক্ত বন্দী শালায় ও এসেছে বছর চারেক আগে। তখনই ও বৌ কে নিয়ে আসে। নয়নার জন্ম এখানেই। ওর বয়স এখন বছর আড়াই।
- বিয়ের পরেই ও জেলে চলে এলো, ওর বৌ এতোদিন অপেক্ষা করেছিল ওর রিহাইয়ের জন্য?
- বয়সে অনেকটা ছোট ওর বৌ। নারায়ণের কাছেই শুনেছি বৌয়ের সাথে ওর ইসক ছিল বিয়ের আগে থেকে। আপনি তো দুনিয়াদারি দেখেছেন বাবুজী, বোঝেন নিশ্চয়ই সচ্চা প্যার মহব্বত থাকলে অনেকে অনেক কিছু সহ্য করতে পারে মানুষ। সাত বছর জুদাই ভী।
- যদি কিছু মনে না করেন, আপনারও কি বিয়ের আগে মহব্বত ছিল আপনার বৌয়ের সাথে? আপনি তো বেশ হ্যান্ডসাম।
সরল হেসে অভয় বলে, না, না বাবুজী, আমাদের বাড়ি থেকেই দেখেশুনে বিয়ে হয়েছিল। আমি যখন জেলে আসি, আমাদের ছেলে নির্মল তখন দু’বছরের ছোটু। কোথায় আর যাবে বৌ। তাই আমার ফেরার অপেক্ষায় আছে। কিছুদিন থাকে ওদের বাড়িতে, কখনো আমাদের বাড়িতে। সবাই খুব পছন্দ করে ওকে। এভাবেই ওদের দিন কাটছে।
অভয় আলাপ করায় নারায়ণের সাথে। লালচে ফরসা চেহারা বহদিন জেলের হাওয়া খেয়ে মলিন হয়ে গেছে। তবু বোঝা যায় আদতে কেমন ছিল। নীলাঞ্জনা নয়নাও মিষ্টি। এখানে ও বাবা মায়ের সাথে থাকলেও আর কোনো আত্মীয় পরিজন, নেই। সমবয়সী খেলার সাথী নেই। পার্কে গিয়ে খেলার সুযোগ নেই। পাথর বাঁধানো উঠোনে - পাশে এক চিলতে সবুজ। তাতে দু একটি ছোট গাছ। এটুকুই ওর প্রকৃতি পরিচয়। খেলনা নিয়ে নিজের মনে একা একা খেলে। ছোট সাইকেল চালায়। বন্দীশালায় ওর বাবার সহবন্দীরাই তার সঙ্গী। ওদের কাছেও শিশুটি মুক্ত বাতাসের মতো। এটা স্বাভাবিক বাড়ির পরিবেশ নয়। কিন্তু শিশুরা কী বোঝে তারা কোনো অস্বাভাবিক পরিবেশে আছে? কে জানে। তবে নয়না খুব গম্ভীর। প্রায় পৌনে ঘন্টা কাটিয়েছিলাম ওখানে। তার মধ্যে দুর থেকেও নয়নার মধ্যে শিশুসুলভ উচ্ছলতা দেখিনি। নয়নার জন্য মন খারাপ লেগেছিল আমার।
নারায়ণ একটা টুল এনে বলে, বাবুজী বসুন না একটু, চা খেয়ে যান। পর্দা ফেলা ঘরের দিকে তাকিয়ে মুক্ত বন্দীশালাবাসিনী ঘরণীকে চায়ের কথা বলে। একটু বাদে ওর বৌ থালায় করে তিনটে পরিস্কার ছোট গ্লাসে চা নিয়ে আসে। আমরা চা তুলে নিতে সে এক পরদেশী বুজুর্গ আঙ্কলকে হাত তুলে নমস্কার করে ঘরে চলে যায়। সে বেশ সুশ্রী। তাই ওদের মেয়েটি অমন ফুটফুটে হয়েছে। একদা সাত বছরের বিরহজ্বালা হয়তো প্রশমিত হয়েছে স্বামী কন্যাকে নিয়ে থেকে। হলেই বা একটা মোটে ঘর। তাই তার মুখে লজ্জা, বিষন্নতা, ম্রিয়মাণভাব চোখে পড়লো না। আর পাঁচটা গৃহস্থবধূর মতোই স্বাভাবিক লাগলো।
এই সব দেখেশুনে মনেই হচ্ছিল না আমি কোনো বন্দীশালায় এসেছি, হলেই বা তা মুক্ত। একাকী ভ্রমণপথে এমন কত যে সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়! দলের সাথে কলবল করে ঘুরলে এসব অধরা রয়ে যায়। সেদিন দলে থাকলে আমি গাড়ি বা অটোতে যেতাম। ভেতরের শর্টকাট রাস্তা দিয়ে দেড় কিমি হেঁটে যেতাম না, এসব চোখেও পড়তো না। পড়লেও দলে থাকলে অভয় আমায় ভেতরে ডাকতো না।
নারায়ণকে শুধোই, কেমন লাগে এখানে?
নারায়ণ বলে, আমি তো পরিবার নিয়ে থাকি। খারাপ লাগে না।
অভয় বলে, আমরা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে বাইরে যেতে পারি। তাই কাল নির্মলকে নিয়ে কেল্লায় বেড়াতে গেছিলাম। শুনেছি কেল্লাটা বিখ্যাত। তাই তো আপনি কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন ওটা দেখতে। অথচ চার বছর এখানে থেকেও আমার যাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় ফিরে আসতে হয়। ইনচার্জ মীনাজী রোজ সকাল বিকেল খাতায় হাজিরা নেন। এছাড়া জেলের মতো আর কোনো কড়াকড়ি নেই। এখানে থাকার এই নিয়ম সবাই মেনে চলে। বছরে দুবার প্যারোলে সাত দিনের জন্য বাড়ি যাওয়া যায়। এছাড়া বিশেষ কারণে, ধরুন বাড়িতে নিকটজনের শাদী বা দেহান্ত হলেও কদিনের ছুটি পাওয়া যায়।
- তখন যদি কেউ গিয়ে আর না ফেরে?
অভয় একটা মোক্ষম ডায়লগ ঝাড়ে। বাবুজী, তোতে কো পিঞ্জরে মে রখতে হ্যায়, কবুতর খুলা ছোড়া যাতা হ্যায়। আট দশ বছর রেগুলার জেলে কাটিয়ে যারা এখানে আসে তারা জানে এরপর পেতে পারে আইনত মুক্তি। তাদের জনমকুণ্ডলী আছে পুলিশের কাছে। পালিয়ে যাবে কোথায়? কতদিন? ধরা পড়বেই। তারপর আর মাফি নেই, আমৃত্যু জেলেই পচতে হবে। এসব কথা এখানে আসার আগে জেলার সাহেব পইপই করে বলে দিয়েছেন। জিসকো ভী থোরা সা অকল বচা হ্যায়, ও কভি এ্যায়সা হরকৎ করনা তো দুর, সোচে গা ভি নেহি।
অভয়ের কথার প্রমাণও পেলাম এই লেখা লিখতে গিয়ে, উপরে দেওয়া নিয়মের Rule 3 c তে।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।