লালকেল্লার ঐতিহাসিক বিচার প্রসঙ্গে
সেদিন বিকেলে বাঁকড়ে হনুমান মন্দির থেকে বেরিয়ে ইচ্ছা ছিল তিন কিমি দুরে শ তিনেক ফুট উচ্চ এক পাহাড়ের মাথায় নির্জন পরিবেশে 'বেটি মাইয়া' মন্দিরে যাবো। ওটা এক স্থানীয় লৌকিক দেবী মন্দির। তারপর পাহাড় থেকে নেমে যাবো দেড় কিমি দুরে হাতোদ গ্ৰামে 'আজাদ হিন্দ পার্কে'। সেখান থেকে ঝাঁসি-শিবপুরী হাইওয়ে ফিরতি পথ সাড়ে চার কিমি। মানে সব নিয়ে সাকূল্যে হাঁটতে হবে ন কিমি।
আমার প্ল্যান শুনে মুকেশ বারণ করলো। ওদিকে বাড়ি ঘর কম। তাই অনেকে রাত পাহারার জন্য কুকুর পোষে। কুকুর আবার ছোটে মিঞার প্রিয় খাদ্য। তাই ওদের লোভেই মাঝে মধ্যে পাশের মাধব উদ্যান থেকে চলে আসে লেপার্ড। শীতকালের বিকেল চারটে। একটু বাদেই দিনের আলো মরে আসবে। কী দরকার অযথা ঝুঁকি নেওয়ার। ওর উপদেশ মেনে সেদিন যাওয়া হয়নি আজাদ হিন্দ পার্ক। বাড়ি ফিরে তাই সমুদ্রবেলায় দাঁড়িয়ে একটু পা ভিজিয়ে ছিলাম। এ গাজন তারই পরিণাম।
২০০৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ৯২ বছর বয়সে মারা যান - নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সাথে বার্মা ফ্রন্টে লড়াই করা আজাদ হিন্দ বাহিনীর বীর সেনানী - কর্ণেল গুরবক্স সিং ধিঁলো। ৮ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় হাতোদ গ্ৰামের ঐ স্থানে তাঁর শেষকৃত্য হয়। তাই ঐ জায়গার নাম আজাদ হিন্দ মেমোরিয়াল পার্ক। সেটা আহামরি দর্শনীয় কিছু নয়। চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত চাষজমি, অরণ্য পাহাড়ের মাঝে গ্ৰামের মেঠো রাস্তার পাশে তারকাঁটার বেড়া দেওয়া একটা আড়াই বিঘার রুক্ষ জমি। ওখানেই মিশে গেছে কর্ণেল ধিঁলোর নশ্বর শরীরের ভষ্মাবশেষ। একটি ছোট্ট সাদামাটা স্মৃতিসৌধ হয়েছে।
চোদ্দ বছর পরেও প্রতি বছর ৬ই ফেব্রুয়ারি তাঁর তিরোধান দিবসে স্থানীয় ও শিবপুরীর হাজার দুয়েক মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও আমন্ত্রণপত্র পেয়ে তাঁর স্মরণোৎসবে আসেন। করেরার কাছে ITBP ক্যাম্পের সেনানীরাও আসেন। সিপাহী বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ায় ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশরাজ শিবপুরীতে ফাঁসি দেয় তাঁতিয়া টোপীকে। একটি দল প্রতি বছর শিবপুরীর মাধব বিলাস প্যালেসের সামনে তাঁতিয়া টোপী স্মারক থেকে তেরো কিমি হেঁটে আসে এখানে। শহর থেকে অনেক দুরে আর পর্যটক বিনোদনের উপকরণ না থাকায় অন্য সময় জায়গাটি থাকে জনহীন। হোক সাদামাটা, নির্জন, তবু সেদিন একবার দেখে আসতে চেয়েছিলাম আজাদ হিন্দ পার্ক - তীর্থ দর্শনের মানসিকতায়।
কিন্তু হাতোদের মতো এমন এক প্রত্যন্ত জায়গাতেই বা কেন হোলো ওনার শেষকৃত্য? কারণ ওখানেই এক সাদামাটা ফার্ম হাউসে উনি জীবনের শেষ ৫৪টি বছর অতিবাহিত করেন। প্রশ্ন জাগতে পারে ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর হাতোদ গ্ৰামেই বা থাকতে গেলেন কেন উনি? সে এক বিচিত্র আপতন। আর সেসব আখ্যান বর্ণনেই বাড়তে থাকে এহেন পল্লবগ্ৰাহীতার কলেবর।
তৎকালীন সামাজিক রীতি অনুযায়ী ১৯২৮ সালে বসন্ত কৌরের সাথে গুরবক্সজীর বিয়ে হয় মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে। উনিশ বছর বয়সে ১৯৩৩ সালে উনি যোগ দেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। ট্রেনিং নিতে চলে যান দেরাদুনের ইন্ডিয়ান মিলিটারি এ্যাকাডেমিতে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ট্রেনিং শেষ হওয়ার আগেই ১৯৪১ সালে তাঁকে চলে যেতে হয় ব্রিটিশ মালয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে। জাপানি আক্রমণে ব্রিটিশ ব্যাটালিয়নের সাথে সিঙ্গাপুরে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ সালে তিনিও যুদ্ধবন্দী হন। সেই বছরই আগস্টে সিঙ্গাপুরে INA তে যোগ দেন। একথা আগেই বলেছি।
সুভাষচন্দ্র ডাক দিয়েছিলেন "দিল্লী চলো"। বিজয়ী সেনাপ্রধান হিসেবে তাঁর দিল্লী যাওয়া হয়নি। বার্মায় মাউন্ট পোপার যুদ্ধক্ষেত্রে জেনারেল স্লিমের ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে এক মরণপণ যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁর তিন বিশ্বস্ত সেনানায়ক - গুরবক্স, সাহগল, শাহনওয়াজ - পরবর্তীতে লালকেল্লা বিচারের তিন অভিযুক্ত। ব্রিটিশ বাহিনীর ছিল ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি, কামান, উন্নত রাইফেল, প্রচুর গোলাবারুদ, অক্ষত সাপ্লাই লাইন ও আকাশ থেকে কার্পেট বম্বিং করার জন্য যুদ্ধবিমান। আজাদ হিন্দ বাহিনী হাতে সীমিত অস্ত্র ও পেটে খিদে নিয়েও অসীম উন্মাদনায় লড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু শুধু দেশপ্রেম দিয়ে লড়াই জেতা যায় না। তার জন্য চাই উপযুক্ত রসদ। তাই সেই অসম যুদ্ধ আর টানতে না পেরে, সহযোদ্ধাদের প্রাণক্ষয় এড়াতে ১৭ই মে ১৯৪৫এ তাঁরা আত্মসমর্পণ করেন। তবে তখন তাঁরা ভাবতেও পারেন নি যে পরাজিত সৈনিক হিসেবে দিল্লী গিয়েও প্রকারান্তরে তাঁরা নেতাজীর দীর্ঘলালিত স্বপ্ন পূরণ করতে চলেছেন। কারণ আগেই বলা হয়েছে লালকেল্লা বিচারকালীন ও তার পরবর্তী উত্তপ্ত ঘটনাপ্রবাহের ফলে সেই বিচারের কুড়ি মাসের মধ্যেই ব্রিটিশ রাজ ভারত ত্যাগ করতে একপ্রকার বাধ্য হয়।
৩রা জানুয়ারি ১৯৪৬ ফাঁসির দড়ি থেকে মুক্তি পেয়ে সামরিক চাকরি খুইয়ে গুরবক্সজী দিশেহারা হয়ে গেলেন। জীবনে তিনি একজনকেই নেতা হিসেবে মেনেছিলেন - সুভাষচন্দ্র। সেই নেতাজীই ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ এ তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনায় হয় সত্যই মৃত নয়তো সেই দুর্ঘটনার আড়ালে নিরুদ্দেশ। রণক্লান্ত, দিশাহীন সেনানায়ক চলে যান পাঞ্জাবে। কিছুদিন সেখানে পরিবারের সাথে থাকেন। জন্ম হয় এক কণ্যা ও দুই পুত্রের - অমৃতা, অমরজিৎ ও সরভজিৎ।
১৯৫২ সালে গুরবক্সজী ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন ইন্দোর। তাঁর ট্রাংকে লেখা ছিল G.S.Dhillon. তাই দেখে এক সহযাত্রী বলেন তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর এক কর্ণেল ধিঁলোর কথা কাগজে পড়েছেন। সেই সহযাত্রী আবেগতাড়িত হয়ে কর্ণেল ধিঁলো সম্পর্কে অনেক কথা বলে যান। অনেকক্ষণ চুপচাপ শুনে শেষে আর থাকতে না পেরে গুরবক্সজী বলেই ফেলেন, আমিই সেই কর্ণেল ধিঁলো। সহযাত্রী অভিভূত হয়ে ওনার পায়ে হেটমূন্ড হয়ে প্রণাম করে বলেন, কর্ণেলসাব, আমার জীবন আজ ধন্য হয়ে গেল, কিন্তু আপনি একা একা কোথায় যাচ্ছেন? বারবার জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখছেনই বা কী? গুরবক্সজীর বয়স তখন মোটে আটত্রিশ। তবু তিনি বলেন অনেক হোলো ছোটাছুটি, এবার তিনি চাইছেন নির্জন কোনো অরণ্যময় এলাকায় অল্প কিছু জমি কিনে সেখানেই কুঁড়েঘর বানিয়ে বাকি জীবনটা চাষবাস করে শান্তিতে কাটিয়ে দেবেন।
সেই সহযাত্রী বলেন, তাহলে আপনি আমার সাথে নামুন শিবপুরী। আপনাকে একটা জায়গা দেখাবো। যদি পছন্দ না হয় অন্য কোথাও চলে যাবেন। সেই অচেনা সহযাত্রীর দেখানো জায়গাই হাতোদ। ১৯৫২ সালে সে জায়গা ছিল প্রায় জনমানবহীন। চারপাশে শিবপুরীর বিখ্যাত অরণ্য। মাধব জাতীয় উদ্যান হতে তখনও সাত বছর বাকি। জায়গাটা ভালো লেগে গেল গুরবক্সজীর। সেই থেকে ওখানেই রয়ে গেলেন উনি। ওনার পুত্র সরভজিৎ ঐ ফার্ম হাউসেই রয়ে গেছেন। বাড়ি ফিরে ওনার সাথে আমার ফোনে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়েছে। অনুভব করলাম আজও উনি পিতৃগৌরবে আবেগতাড়িত। খুবই স্বাভাবিক।
চললুম জর্জ ক্যাসল
হনুমান মন্দির থেকে মোহনী মহারাজ আশ্রমের দিকে যেতে চোখে পড়লো সেই শ্বেতপাথরের মাইলফলক। ডানদিকে কাঁচা রাস্তায় একটু দুরে একটা গেট। সামনে পাথরের মোটা দেওয়াল। ফলে গাড়ি যেতে পারবে না। পাশে পায়ে চলাচলের ফোকর দিয়ে ভেতরে ঢুকি। একটা মোরাম পথ চলে গেছে জঙ্গলের ভেতর। ডানদিকে একটা জনমানবহীন গার্ডরুম। মনে হয় বহুদিন বন্ধ। ম্যাপ অনুযায়ী ওখান থেকে পৌনে কিমি হেঁটে আড়াইশো ফুট উঠলে পাহাড়ের মাথায় দেখা যাবে জর্জ ক্যাসল। কেউ কোথাও নেই। নির্জন বনপথে হাঁটতে বেশ লাগে।
অচিরেই পৌঁছে যাই বাঞ্ছিত জায়গায়। সকালে সুরয়ায়া থেকে বাসে আসার পথে সেই স্থানীয় সহযাত্রী এটা দেখিয়েই বলেছিলেন, রাজা কি কিলা। স্কটিশ ক্যাসলের আদলে তৈরী চার কোনে চারটি গোলাকার মিনারের মতো দ্বিতল কক্ষ, একটা বড় বর্গাকার একতলা কক্ষের সাথে সংযুক্ত। একতলার কক্ষটি ভোজন ও আলাপচারিতার জন্য। সামনে পিছনে ঢাকা বারান্দা। চাঁদনী রাতে একতলার ঐ বিরাট খোলা ছাদ থেকে চারপাশের জঙ্গল কেমন দেখতে লাগবে ভেবেই মনে ভালোলাগার রোমাঞ্চ জাগে।
শিবপুরীর অরণ্যে বাঘ শিকারে আসবেন বলে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাত্রিবাসের জন্য ঐ বাসস্থানটি ১৯১১ সালে নির্মাণ করান তৎকালীন গোয়ালিয়রের মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়া। তাই নাম জর্জ ক্যাসল। কিন্তু সেদিন ওখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল ব্রিটিশ সম্রাট ভারতে এতো জায়গা থাকতে শিবপুরীর মতো এক গন্ডগ্ৰামে রাত্রিবাসে রাজি হলেন কেন। ওখানকার হালকা, শুষ্ক, পর্ণমোচি অরণ্যের তুলনায় তো ঘন চিরহরিৎ অরণ্য তখন ভারতের নানা জায়গায় ছিল। কুমায়ুন বা গাড়োয়াল হিমালয়ের মনোরম ঠান্ডা পাহাড়ি এলাকা তো সৌন্দর্যের ভান্ডার। সেখানেও তখন সম্রাটের গুলি খেয়ে মরার জন্য বাঘ কম ছিল না। তাহলে? সে কথা বলতে গেলে হয়ে বেসুরো গলায় গাইতে হয় আর এক প্রস্থ শিবের গাজন। পূরাণ, দর্শন, ইতিহাস চর্চায় আমার বুৎপত্তি নেই। তবু কোনো প্রসঙ্গে অতীতের কিছু বিচিত্র, উল্লেখযোগ্য ঘটনা বা চরিত্রের বিবরণ, পশ্চাৎপট জানলে ভালো লাগে।
জর্জ ক্যাসল নামকরণের প্রেক্ষাপট
১৪৫০ সালে শুরু হয়ে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচশো বছর পর ১৯৯৭ সালে চীনকে হংকং হস্তান্তরের পর প্রিন্স চার্লস বলেছিলেন, অবশেষে অন্ত হোলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। একদা ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল পৃথিবীর ৬৪টি দেশ। তার মধ্যে ঘানা, সুদানের মতো অনুন্নত আফ্রিকান দেশ যেমন ছিল আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো বৃহৎ, অপেক্ষাকৃত উন্নত দেশও ছিল। একটি ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র - যার আয়তন তদানীন্তন নেটিভ স্টেট হায়দ্রাবাদের থেকেও কম - এতগুলি দেশকে এতদিন ধরে কীভাবে কব্জায় রেখেছিল তা বিষ্ময়কর। তাই বলা হোতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মধ্যগগনে (১৯০০-১৯২০) নানা প্রকারে (Dominion, Colony, Protectorate, Mandate, Territory) পৃথিবীর সিকিভাগ জমি ও জনসংখ্যার ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের। এই ৬৪টি দেশের মধ্যে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে ১৭৭৫-১৭৮৩ সালের সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা আদায় করে নেয় আমেরিকা। তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের পর খাইবার পাসের পশ্চিমে আর কখনো নাক না গলানোর অঙ্গীকার করে ১৯১৯ সালে ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমানা ধরে আফগানিস্তানকেও পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে রাজি হয় ব্রিটিশরাজ। বাকি দেশ তখনও ব্রিটিশ অধীনস্থ।
১৯৩১ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে Statute of Westminster পাশ হতে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদিরা পায় Dominion Status. এর ফলে দেশটি হবে স্বশাসিত তবে তার আনুগত্য বজায় থাকবে ব্রিটিশ সিংহাসনের প্রতি। অর্থাৎ দেশটি তখনও সার্বভৌম বা Sovereign নয়। এসব ছিল জটিল রাজনীতির সাথে চতুর বানিয়াবুদ্ধি মেশানো কুটিল মস্তিষ্ক উদ্ভাবিত ব্রিটিশ ললিপপ। ভারতের মতো অধিকৃত অঞ্চলগুলি (Colony) তখনও সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের আওতায়। জাতীয় কংগ্রেস ইংল্যান্ডের সিংহাসনে টিকি বাঁধা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন (Dominion Status) নাকি পূর্ণ স্বরাজ (Full Independence) কোনটা দাবি করবে তা অনেকদিন অবধি ঠিক করে উঠতে পারেনি। হয়তো মনে হয়েছিল বেশী দাবী করলে যদি বড়দা ক্রুদ্ধ হয়ে কিছুই না দেয় - দ্বিধা ছিল সেই কারণে। তখন অনেক সুবিধাভোগী ভারতবাসীও ছিল ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে।
ষোড়শ শতকে ইউরোপের দুই অভিযাত্রীক মানসিকতার উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেশ - স্পেন ও পর্তূগাল - পৃথিবীর নানা প্রান্তের - বিশেষত প্রাচ্যের - কে কতটা অংশ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গায়ের জোরে কব্জা করতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নামে। সে দৌড়ে যোগ দেয় ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, ব্রিটেন। শুরু হয় একের পর এক সমুদ্র অভিযান। ভারতে এসে পর্তুগিজ সাম্রাজ্যবাদ কোচি, বোম্বে, গোয়া, চট্টগ্রাম, দমন, দিউতে প্রতিষ্ঠা করে তাদের আধিপত্য। পন্ডিচেরী, কারিকাল, মাহে, ইয়ানাম (বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশে) ও চন্দননগর চলে যায় ফরাসী অধীনতায়। তামিলনাড়ু, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, শ্রীরামপুর ও মুর্শিদাবাদে বানিজ্য ঘাঁটি স্থাপনা করে নেদারল্যান্ডস বা ডাচেরা। তবে ডাচেদের মূখ্য আগ্ৰহ ছিল বাণিজ্যে, ক্ষমতা বিস্তারে নয়। ভারতের বাকি অংশ মোগল ও স্থানীয় রাজাদের অধীনে। অর্থাৎ ভারতে তখন আক্ষরিক অর্থে চলছে বারো ভূতের খেলা।
সেই লুটেপুটে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় সবার শেষে আসে ব্রিটেন। সম্রাট প্রথম জেমসের দূত হয়ে ১৬১২ সালে আগ্ৰায় আসেন স্যার টমাস রো। অধ্যাবসায়ী টমাস দীর্ঘদিন ধরে তৈলমর্দনে সুরাসক্ত মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে ভারতে উৎকৃষ্ট মানের সুরা তৈরির টোপ ফেলে জোগাড় করেন ভারতে ব্যবসা করার অনুমোদন। তার ভিত্তিতে ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষ দিনে ব্রিটেনে স্থাপিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাটে পা রাখে ১৬১৯ সালে। ব্যবসার সাথে বাড়তে থাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ১৬১৭ সালে জাহাঙ্গীর ব্রিটিশ বণিকদের বাংলায় বিনা আমদানি, রপ্তানি শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। তার একশো চল্লিশ বছর পর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জিতে কোম্পানি মোগল আধিপত্য উপেক্ষা করে বাংলা, বিহার থেকে রাজস্ব আদায় করতে শুরু করে। শুরু হয় ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে বাজিমাত করার প্রকল্প।
চালু হয় ভারতে কোম্পানি শাসন। নানা শোষণ ও অত্যাচারে ফলে পলাশীর যুদ্ধের ঠিক একশো বছর পরে ১৮৫৭ সালে জ্বলে ওঠে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন। অবশ্য তার একান্ন বছর আগে ভেলোরেও হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত সিপাহী বিদ্রোহ। তারা দখল করেছিল ভেলোর কেল্লা। ২৮০ জন ব্রিটিশ সৈনিককে হত্যা করেছিল। তবে সে বিদ্রোহের মেয়াদ ছিল মাত্র একদিন। কোম্পানি ফৌজ শক্ত হাতে দমন করেছিল সে বিদ্রোহ। সেই অর্থে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা সংগ্ৰাম বলা যেতে পারে। কোম্পানি ফৌজ সেক্ষেত্রেও তা কঠোরহস্তে দমন করে। নীল রক্তের তুলনায় বাদামি চামড়ার মানুষ হতাহত হয় প্রচুর। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত নেয় একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে দেশ শাসনের ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়। ১৮৫৮ সালে পাশ হয় Government of India Act. ভারতের শাসনভার কোম্পানির বোর্ড থেকে চলে যায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে। শুরু হয় ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশরাজ। ১৮৭৪ সালে ব্রিটেনে বন্ধ হয়ে যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
মারাঠা সাম্রাজ্যে ছত্রপতি প্রথম শাহু মহারাজের রাজত্বকালে (১৭০৭-৪৯) পেশোয়া প্রথম বাজীরাওয়ের অধীনে ছিলেন এক বিশ্বস্ত ও দক্ষ সর্দার - রানোজী রাও সিন্ধে। ১৭২৩এ মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি মালোয়ার (মধ্য ভারত) বিস্তৃত অঞ্চল মারাঠা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই যোগ্যতার স্বীকৃতিতে বাজীরাও তাকে মালোয়ায় শাসক নিযুক্ত করেন। ১৭৩১ সালে উজ্জয়িনীতে রাজধানী স্থাপন করে মারাঠা সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় রাণোজী পত্তন করেন সিন্ধে বা সিন্ধিয়া রাজ। অবস্থানগত গুরুত্ব ও দূর্ভেদ্য বিশাল কেল্লার সুরক্ষার জন্য রাজধানী না হওয়া সত্ত্বেও রাণোজীর কনিষ্ঠ পুত্র মাহাদজীর শাসনকাল (১৭৬২-৯৪) থেকেই সিন্ধিয়া রাজবংশ গোয়ালিয়র থেকে পরিচালিত হতে থাকে।
১৮১৮ সালে কোম্পানি ফৌজের সাথে তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের পর তৎকালীন মারাঠা সাম্রাজ্য কোম্পানির আনুগত্য মেনে নিতে রাজি হয়। চুক্তি অনুযায়ী রাজ্যগুলি থাকবে স্বশাসিত, তবে তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব কোম্পানির। তার জন্য তারা কোম্পানি নির্ধারিত কর দেবে। রাজ্যে থাকবে কোম্পানির এক ব্রিটিশ প্রতিনিধি (Resident). রাজকার্যে নাক না গলিয়ে সেই প্রতিনিধি কোম্পানিকে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাবে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজ্যশাসনে অবহেলা, অকর্মণ্যতা বা দূর্নীতির অভিযোগে Doctrine of Lapse প্রয়োগ করে দেশীয় রাজাকে সরিয়ে সেই রাজ্যের কর্তৃত্ব কোম্পানি পাকাপাকিভাবে নিজের অধীনে নিতে পারবে। 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ী' সিনেমায় এভাবেই অযোধ্যার প্রজাবৎসল নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সৈয়দ জাফরী ও সঞ্জীব কুমার যখন একান্তে শতরঞ্জ খেলায় মগ্ন তখন রেসিডেন্টের রিপোর্টের ভিত্তিতে দাবার আসল চাল দিচ্ছে কোম্পানি।
জর্জ ক্যাসলের নির্মাতা মাধো রাও ছিলেন সিন্ধিয়া রাজত্বের পঞ্চম মহারাজা। দশ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে তিনি মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর শাসনকালে (১৮৮৬-১৯২৫) ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কাছে তিনি এক দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বিবেচিত হন। চীনে বক্সার আন্দোলনে (বিহারের বক্সার যুদ্ধ নয়) ব্রিটিশকে সামরিক সাহায্য করার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯০১ সালে সম্রাট ঘোষিত হওয়ার পর সপ্তম এডোয়ার্ড তাঁকে পার্শ্বচর বা এডিকং (aide-de-camp) মনোনীত করেন। তাঁকে দেওয়া হয় চায়না মেডেল। ২-৮-১৯০২ তে ইংল্যান্ডে সম্রাটের রাজ্যাভিষেকে তিনি আমন্ত্রিত হন। সে বছর জুনের তিন তারিখে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক LLD (Doctor in Law) ডিগ্ৰি প্রদান করে।
স্বাধীনতার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ছিল ৫৮৪টি দেশীয় রাজ্য। তার মধ্যে ৫৬৫টি রাজ্য মনোনীত হয়েছিল স্যালুট স্টেট হিসেবে যাদের শাসকদের দুই থেকে একুশটি গান স্যালুট দিয়ে অভিবাদন করা হোতো। এর মধ্যে মাত্র আটটি রাজ্যের দশ জন মহারাজা একুশটি গান-স্যালুটের সম্মান পেয়েছিলেন। ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস বা গান স্যালুটের মতো ব্রিটিশ রাজতন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল আর এক ললিপপ - নানান গালভরা নামের উপাধি - যেমন নাইটহুড। এসব ছিল শাসিত দেশের স্থানীয় রাজা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য জাগিয়ে তুলে তা জিইয়ে রাখার ফন্দি। যথারীতি উপাধি পেয়ে ধন্য হওয়ার আশায় অনেক দেশীয় রাজাই তখন রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। তা যে আসলে আত্মসম্মান বিসর্জিত হীনমন্যতাবোধের প্রকাশ, সে কথা অনেকেই তখন বোঝেন নি বা বুঝেও রাজ্য শাসন ও সুবিধা ভোগের মোহে তা করে গেছেন।
মাধো রাও সিন্ধিয়া তাঁর আটত্রিশ বছরের শাসনকালে মেডেল ও উপাধি মিলিয়ে পেয়েছিলেন এগারোটি সম্মান যার তিনটি ছিল অতি বিশিষ্ট - GCSI (১৮৯৫), GCVO (১৯০২) এবং GBE (১৯১৭). এর মধ্যে GBE (Knight Grand Cross of the Order of the British Empire - বলেছিলাম না গালভরা সব নাম) ছিল এযাবৎ ব্রিটিশ রাজতন্ত্র উদ্ভাবিত পাঁচটি অসামরিক উপাধির (GBE, KBE, CBE, OBE, MBE) মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্রাট পঞ্চম জর্জের কাছ থেকে ১৯১৫ সালে যে নাইটহুড উপাধি পান তা ছিল KBE (Knight Commander of the order of the British Empire)। অবশ্য GBE উপাধির সূচনা হয় তার পরে, পঞ্চম জর্জের সময়েই তবে ১৯১৭ সালে, তাই রবীন্দ্রনাথকে যে KBE উপাধি দেওয়া হয় তখন সেটাই ছিল সর্বোচ্চ সম্মান। যদিও উপাধি প্রাপ্তির চার বছর বাদে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড ক্লেমসফোর্ডকে মার্জিত ভাষায় অথচ তীক্ষ্ম এক প্রতিবাদী পত্র লিখে ৩০-৫-১৯১৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যার্পণ করেন সেই নাইটহুড উপাধি।
নিজ গুণে, কর্মক্ষমতায়, আচরণে মাধো রাও ছিলেন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিশেষ অনুগ্ৰহ ভাজন। সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও তাঁর পত্নী কুইন মেরী তাঁর পুত্র জিভাজী রাওয়ের "স্পনসর" ছিলেন যদিও তার তাৎপর্য আমার বোধগম্য হয় নি। তাই সেই পুত্রের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল "জর্জ জিভাজী রাও সিন্ধিয়া"। ১৯১০ সালে সম্রাট হয়ে ২৫-৬-১৯১১ তে ইংল্যান্ডে রাজ্যাভিষেকের পর পঞ্চম জর্জ স্থির করেন ১২-১২-১৯১১তে দিল্লী দরবারে তিনি যোগ দেবেন।
দিল্লী দরবার
সাম্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে শাসিত দেশের রাজন্যদের মনে শাসক রাজতন্ত্রের গরিমা ও ক্ষমতার প্রতি সম্ভ্রম ও আনুগত্য বোধ জাগিয়ে তুলে নানা উপায়ে তা বজায় রাখা আবশ্যিক। ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার সাথে শাসিত দেশের কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষ তাদের শ্বেতাঙ্গ প্রভূদের ঠাটবাট দেখে উপলব্ধি করে এক ধরণের হীনমন্যতাবোধ। প্রভূর প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে অনুগতজনের চরিত্রে এসব উপাদানও প্রয়োজনীয়। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নানান জাঁকজমকের তেমন একটি নমুনা - দিল্লী দরবার। ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনে নতুন রাজা বা রাণীর রাজ্যাভিষেক হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সমস্ত দেশের রাজানুগত্যেরও নবীকরণ হোতো। জনবহুল ভারত ছিল ব্রিটিশ রাজমুকুটের মূল্যবান মণি। দিল্লী দরবার ছিল আমন্ত্রিত দেশীয় রাজাদের নতুন সম্রাট বা সম্রাজ্ঞীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অনুষ্ঠান। এটির আয়োজন হোতো দিল্লীর করোনেশন পার্কে। সন্ত নগরে দিল্লী জলবোর্ডের উত্তর পূর্বে প্রায় ১৩০ বিঘা জমির ওপর এই করোনেশন পার্ক এখন দিল্লীবাসীর অলস ভ্রমণের স্থান। কয়েকটি কারণে তৃতীয় দিল্লী দরবার ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম কারণ, ১৮৫৮ সালে ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনমুক্ত হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধীন হলেও রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতেরও সম্রাজ্ঞী হিসেবে বিবেচিত হন ১৮৭৬ সালে। ১-১-১৮৭৭এ ভাইসরয় লর্ড লিটন আয়োজন করেন প্রথম দিল্লী দরবার। কিন্তু তাতে কুইন ভিক্টোরিয়া আসেন নি। ১-১-১৯০৩এ দু সপ্তাহব্যাপী দ্বিতীয় দিল্লী দরবারের নিখুঁত আয়োজন করেন লর্ড কার্জন। কিন্তু তাতেও আসেন নি সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ড। একদিনে আটটি বাঘ মারায় পারদর্শী লর্ড হার্ডিঞ্জ ১২-১২-১৯১১এ দারুন জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজন করেন তৃতীয় দিল্লী দরবার। সেবারই প্রথম আসেন সপত্নী ইংলন্ডেশ্বর - পঞ্চম জর্জ ও কুইন মেরী।
দ্বিতীয় কারণ, তৃতীয় দিল্লী দরবার আয়োজনের বিপুল খরচ। তখনকার দিনে তা ছিল ন লক্ষ ব্রিটিশ পাউন্ড। ৩% চক্রবৃদ্ধি হারে মূদ্রাস্ফীতি ধরলে বর্তমানে তা হয়ে দাঁড়ায় প্রায় তিনশো কোটি টাকা! খরচের বহরের ধারণা পেতে আর একটা সমকালীন হিসেব দেখা যেতে পারে। ১৯০৫ সালে শুরু করে ১৯২১ সালে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সমাপ্ত করতে তখন খরচ হয়েছিল এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা - ঐ ৩% চক্রবৃদ্ধি হারে মূদ্রাস্ফীতি ধরলে বর্তমানে তা প্রায় ৩০ কোটি টাকা (তাতেও হবে কিনা সন্দেহ)। অর্থাৎ তখন কয়েকদিনের দরবার আয়োজনের খরচ হোলো দশটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির সমান। সে খরচ ইংল্যান্ড থেকে আসেনি, তা ছিল দেশীয় প্রজার রক্তচোষা পয়সা।
সম্প্রতি সর্দার স্ট্যাচু বানাতে খরচ হোলো তিন হাজার কোটি। ষষ্ঠ লোকসভা (২০১৪-১৯) পাঁচ বছরে ৩৩১ দিন সেশনে ছিল অর্থাৎ বছরে লোকসভায় গড়ে কাজ হয়েছে ৬৬ দিন। তবু স্থান সংকটে মন্ত্রী, সাংসদরা ঠিক মতো দেশের জন্য মন দিয়ে কাজ করতে পারছেন না বলে সংসদ ভবন ও সংযুক্ত পরিকাঠামোর নবীকরণ ও পূনর্নিমান বাবদ - শোনা যাচ্ছে - খরচ হবে মাত্র কুড়ি হাজার কোটি টাকা বা সাতটি সর্দার স্ট্যাচুর একটু কম। এসব দেখেশুনে মনে পড়ে ১৯৩০ সালে লেখা শেখ ওয়াজেদ আলীর ছোট গল্প 'ভারতবর্ষ'। এটা একসময় পাঠ্যপুস্তকে ছিল। সেই গল্পের একটি লাইন বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে তবু তার গুরুত্ব মনে হয় কোনোদিন কমবে না - "সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে"।
তৃতীয় কারণ, সেই দরবারে পঞ্চম জর্জ ঘোষণা করলেন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হবে।
চতুর্থ কারণ, সেই দরবারে পঞ্চম জর্জ ঘোষণা করলেন মোগল আমলের পুরোনো ঘিঞ্জি এলাকার বাইরে তৈরি হবে "নতুন দিল্লী" - অর্থাৎ অস্তমিত মোগল অস্তিত্বের ছবি মুছে ফেলে ঝকঝকে নতুন ব্রিটিশ রাজধানীর পত্তন হবে। তার কারিগর হবেন স্যার এডউইন লুটিয়েনস ও স্যার হারবার্ট বেকার। মূল নির্দেশ ছিল, যা তৈরী হবে তা যেন প্রতি ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও আধিপত্যকে সূচীত করে। কুড়ি বছর পরে ১৯৩১ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি তদনীন্তন ভাইসরয় লর্ড আরউইন নতুন রাজধানী উদ্বোধন করেন। ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসনে তখনও বিরাজ করছেন পঞ্চম জর্জ। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র তখনও কল্পনা করতে পারেনি মাত্র ষোলো বছর পর ঐ নতুন রাজধানী ত্যাগ করে চিরকালের মতো চলে যেতে হবে।
পঞ্চম কারণ - পঞ্চম জর্জের পর স্বল্প সময়ের জন্য (৩২৬ দিন) সম্রাট হন জ্যেষ্ঠপূত্র অষ্টম এডোয়ার্ড। তারপর ১১-১২-১৯৩৬এ সিংহাসনে বসেন তাঁর ভাই ষষ্ঠ জর্জ। তিনি সম্রাট ছিলেন আমৃত্যু ৬-২-১৯৫২ অবধি। ইংল্যান্ডে ১২-৫-১৯৩৭এ তাঁর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান হলেও ভারতে চতুর্থ দিল্লী দরবার করে তার প্রতিধ্বনি হয়নি। কারণ তখন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার অনুকূল ছিল না। অর্থাৎ এহেন দাম্ভিকতাপূর্ণ ব্রিটিশ জাঁকজমকের অন্তিম প্রদর্শন ছিল ১৯১১ সালের তৃতীয় দিল্লী দরবার।
১৯১১ সালের ডিসেম্বরে তৃতীয় দিল্লী দরবারে যোগ দিতে ভারতে এসে সম্রাট পঞ্চম জর্জ মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার ব্যক্তিগত আমন্ত্রনে শিবপুরীতে শিকারে এসে ঐ ক্যাসলে রাত্রিবাস করতে সম্মত হয়েছিলেন। তাই বানানো হয়েছিল ওটা। ৫৮৪ দেশীয় রাজার মধ্যে সম্রাটের কাছের মানুষ হতে পারার অলিখিত প্রতিযোগিতায় মাধো রাও ছিলেন অনেকটাই এগিয়ে। কারণ মাধো রাও শুধুই সুদুর চায়না যুদ্ধে ব্রিটিশকে সাহায্য করেননি, সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঝাঁসির রাণী লক্ষীবাঈ, তাঁতিয়া টোপী, নানা সাহেব প্রমূখরা কোম্পানির বিরুদ্ধে গেলেও তাঁর পিতা জয়াজী রাও সিন্ধিয়া ছিলেন কোম্পানির পক্ষে। অর্থাৎ এ আনুগত্য পুরোনো। জর্জ ক্যাসল নামকরণের সূত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমারও কিছু চিত্তাকর্ষক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা হোলো। তারই প্রতিফলন হয়েছে এখানে।
তিনটি হ্রদের বৃত্তান্ত
ক্যাসল চত্বর থেকে গাছপালার জন্য কাছেই পাহাড়ের পাদদেশে মাধব লেক ভালো দেখা যায় না। কিন্তু পশ্চিমে দু কিমি পাখি ওড়া দূরত্বে উত্তর দক্ষিণে তিন কিমি বিস্তৃত সখ্যাসাগর লেকের দৃশ্য অপূর্ব লাগলো। তখন বাজে পৌনে পাঁচটা। সূর্যাস্তের দেরী আছে। তবু মনে হোলো ওখান থেকে লেকের জলে সূর্যাস্তের শোভা দারুন লাগবে। শিবপুরী খরাপ্রবণ এলাকা। তাই ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে ঐ এলাকায় নির্মিত হয় পাথরের গাঁথুনির তিনটি বাঁধ। একটা জর্জ ক্যাসল থেকে পশ্চিমে দেড় কিমি পাখি ওড়া দূরত্বে অর্ধচন্দ্রাকার বাঁধ। ফলে সৃষ্টি হয় ১১কিমি পরিসীমার এক জলাধার - সখ্যাসাগর লেক - মহারাজা মাধো রাও সিন্ধিয়ার জননী সখ্যাবাই রাজে সিন্ধিয়ার সম্মানে।
অর্ধচন্দ্রাকার বাঁধের জন্য এর অন্য নাম চাঁদপাটা লেক। আকৃতিতে এই বাঁধটির সাথে ১৯৩৬ সালে আমেরিকার কলোরাডো নদীর ওপর নির্মিত হুভার ড্যামের সাদৃশ্য আছে। ওটা অবশ্য Concrete Gravity Arch Dam এবং উচ্চতায় অনেক বেশি (৭২৬ ফুট)। সে তুলনায় সখ্যাসাগর বাঁধের উচ্চতা মাত্র ৫০ফুট। তবে সখ্যাসাগর বাঁধের দৈর্ঘ্য (৬৫০০ফুট) হুভার ড্যামের (১২৪৪ফুট) পাঁচগুণের বেশী।
পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে নির্মিত হয় ১২০০ফুট লম্বা আর একটি সরল রেখার বাঁধ। ফলে সৃষ্টি হয় মাধব লেক - মাধো রাও সিন্ধিয়ার সম্মানে। জর্জ ক্যাসল থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে পাঁচ কিমি পাখি ওড়া দূরত্বে তৈরি হয় যাদব সাগর লেক। তিনটি বাঁধের মধ্যে এটিই তৈরি হয় সর্বপ্রথম - ১৯১৫ সালে। ওটা কার নামে জানতে পারি নি।
এই বাঁধ তিনটি তৈরি হয়েছিল পরিকল্পনা করে। শিবপুরীর নিকটে যাদব সাগরের ভৌগোলিক অবস্থান উচ্চতম স্থানে। সখ্যাসাগর তার থেকে প্রায় নব্বই ফুট নীচে। মাধব লেক সখ্যাসাগর থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট নীচে। যাদব সাগর ও সখ্যাসাগর সংযুক্ত আছে তিন কিমি দীর্ঘ কারবালা নালার মাধ্যমে। এই নালার মাঝামাঝি দক্ষিণ পারে হয়েছে মুক্তি ধাম বা আধুনিক শ্মশান। বর্ষায় উপরাঞ্চলের বৃষ্টির জল যাদব সাগরে জমে উপচে আসে সখ্যাসাগর লেকে।
সখ্যাসাগরের জল উপচে নামে মাধব লেকে। মাধব লেকের জল উপচে চলে যায় আরো চার কিমি পূবে ফুট পঞ্চাশেক নীচে ভাগোড়া তালাও তে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক Cascading Water Fall এর মতো এটি একটি মনূষ্য নির্মিত Cascading Lake Sysyem. তবে সখ্যাসাগর ও মাধব লেকে মাধব উদ্যানে হওয়া বৃষ্টির জলও সরাসরি এসে জমা হয়। জনশ্রুতি একদা শিবপুরীতে মনিয়ার বা মহিয়ার (করেরার মহুয়ার নদী নয়) নামে একটি নদী ছিল। এখন তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সীমিত বর্ষার জল যাতে জমি ধুয়ে নিম্ন এলাকায় না চলে যায় তাই এক শতাব্দীরও আগে তৎকালীন শাসকরা প্রকৃতির দান এভাবে কাজে লাগিয়ে জলসংরক্ষণের কথা ভেবেছিলেন। আজও মাধব লেকের পাশে পাম্পিং স্টেশন থেকে শিবপুরী শহরের জন্য জল যায়।
উৎকণ্ঠিত প্রহরী
লেক, জঙ্গল দেখতে দেখতে আমি ক্যাসলটাকে এক পাক মেরে পশ্চিম দিকে ছোট একটা পায়ে চলা পথ ধরে পাহাড়ের প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ওখানে একটা অনুচ্চ স্তম্ভের ওপর পাথরের ফলকে কিছু লেখা আছে। ইচ্ছা ছিল সেটা পড়ার। হঠাৎ হৈ হৈ করে একতলার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন খাঁকি পোষাকের এক প্রহরী। তাকে আমি দেখেছিলাম ঘরে বসে একমনে কাগজ পড়ছেন। আমার দিকে পিছন ফিরে ছিলেন বলে আমায় দেখতে পান নি। আমি এপাশে আসতে দেখতে পেয়েছেন। তিনি কাছে এসে বলেন, আরে বাবুজী আপনি ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন? বলি, এই একটু ঘুরেফিরে দেখছি আশপাশ। সে রীতিমতো বিষ্মিত হয়ে বলে, ঘুরেফিরে দেখছেন মানে? আপনাদের গাড়ি, দলের বাকি লোক কোথায়? এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। গাড়ি! দল!! মানে? আমি তো একাই এসেছি, হেঁটে। প্রহরীর চোখ প্রায় কপালে উঠে যায়। একা এসেছেন! হেঁটে!! কোথা দিয়ে? আমি ভেবেই পাচ্ছি না এতে এতো বিচলিত হওয়ার কী আছে। বলি, বাঁকড়ে হনুমান মন্দির দেখে আসার পথে ডানদিকে যে গেট দেখলাম সেখান দিয়ে ঢুকে মোরাম পথ দিয়ে হেঁটে এসেছি। কিন্তু আপনি এতো উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? হঠাৎ সে চুপ করে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তার খালি পা। হয়তো ঘরে জুতো খুলে বসেছিল, উত্তেজনায়, তাড়াহুড়োতে পরে আসতে ভুলে গেছে।
আমি জানি কথাবার্তা, হাবভাব বা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বদনের কল্যাণে আমায় সন্দেহজনক চরিত্র বলে মনে হওয়ার কথা নয়। তাই উনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না আমায় নিয়ে কী করা উচিত। একটু দম নিয়ে বলে, বাবুজী এই জাতীয় উদ্যানে মেন গেট থেকে টিকিট কেটে, খাতায় এন্ট্রি করে গাইড নিয়ে গাড়িতে করে জাঙ্গল সাফারিতে আসার নিয়ম। এভাবে একা পায়ে হেঁটে ঘোরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ দেখতে পেলে মোটা জরিমানা হয়ে যাবে। অফিসে নিয়ে গিয়ে পুছতাছও করতে পারে। আর এখানে আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাকে নিয়েও টানাটানি হবে। বলি, কিছু হয়ে গেলে মানে? প্রহরী বলেন, এই জঙ্গলে তেন্ডুয়া (লেপার্ড) আছে, কিছুদিন আগে হাতোদ গ্ৰামে একটা বাছুর নিয়ে গেছে। এমনিতে ওরা মানুষকে এড়িয়ে চলে, তবে ভয় পেয়ে আক্রমণ করে বসতেও পারে। বিকেল হয়ে আসছে, কেউ কোথাও নেই, আর এই সময় আপনি একা একা এলেন ঐ রাস্তা দিয়ে?
এবার ওনার বিচলিতবোধ করার কারণ বুঝতে পারি। সবিনয়ে বলি, দেখুন, এসব আমি জানতাম না। ঐ গেটে কেউ নেই, কোনো লিখিত নির্দেশও নেই। তাই অজান্তে ভুল হয়ে গেছে। ঠিক আছে, আমি এখুনি চলে যাচ্ছি। সে বলে, সাবধানে চারপাশ দেখে যাবেন। ক্যাসল মিউজিয়াম ছেড়ে আমার যাওয়ার উপায় নেই না হলে আমি যেতাম আপনার সাথে গেট অবধি। তার প্রাথমিক মৃদু উষ্মা তখন এক একাকী বয়স্ক পরদেশী পথিকের জন্য উৎকণ্ঠায় বদলে গেছে। কুড়িটা টাকা হাতে দিয়ে বলি, চা খাবেন। উনি বলেন, বাবুজী, তেন্ডুয়া দেখলে ঘাবড়ে না গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়বেন, চলে যাবে। আসার সময় ফুরফুরে মেজাজে এসেছিলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই জঙ্গলের অনভিজ্ঞতা, পড়ন্ত বিকেলের মরা আলো ও একাকীত্বের কারণে তখন সেই পথেই ফিরতে একটু গা ছমছম করছিল। সে যাত্রায় অবশ্য সেই প্রহরীকে নিয়ে টানাটানির মতো কিছু ঘটেনি। তাই আমি সেই বৃত্তান্ত লিখতে পেরেছি।
ব্যাক টু ভাদিয়াকুন্ড
হাইওয়েতে এসে শ তিনেক মিটার হেঁটে মাধব লেকের কাছে গিয়ে বাঁধ, স্পিলওয়ে, বাঁধের ওপর কয়েকটা ছত্রী এসব কাছ থেকে দেখলাম। এক কিমি দুরে সখ্যাসাগর বাঁধ। তারপর রাস্তায় ফিরে আসি। যতো একক বাইক আরোহী আসে হাত দেখাই। কেউ দাঁড়ায় না। হিচহাইক করতে গেলে অধৈর্য হলে চলে না। সবুরে মেওয়াও ফললো। যে বাইকে লিফ্ট পেলাম সে আমায় কারবালা চক অবধি ছেড়ে দিল। ফলে সাতশো মিটার হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পৌঁছে গেলাম আশ্রমে। তখন প্রায় ছটা। অন্ধকার হয়ে গেছে। আশ্রমে আলো জ্বলছে। ছোটোখাটো চেহারার গেরুয়া বসন ও জটাধারী রাধেশ্বর পুরী মহারাজ বারান্দায় লোহার কড়াইয়ে কাঠকুটো জ্বেলে একা বসে আছেন। আমি গিয়ে নমস্কার করে বলি, সকালে এখানে একটা স্যাক রেখে গেছি। কাল রাতে সুরয়ায়ার রামজানকী মন্দিরের ছিলাম। শর্মনভারতী এই আশ্রমের কথা বলতে এখানে এসেছি। আমি কি এখানে থাকতে পারি?
মহারাজ অমায়িক হেসে বলেন, বেশ তো থাকুন, কোনো অসুবিধা নেই। আশ্রম তো যাত্রীদের থাকার জন্যই। কে আমি, কোথা থেকে আসছি, কদিন থাকবো, কিছুই জানতে চাইলেন না। আধার কার্ড দেখতে চাইলেন না। আসুন আমার সাথে, বলে টানা বারান্দার পূর্ব প্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। আন্দাজ বারো বাই পনেরো ঘর। প্লাইটপ তিনটে লোহার চারপাই। তার ওপর কভার দেওয়া ফোম ম্যাট। দক্ষিণের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা বিশাল দুটো লোহার ট্রাঙ্ক। তার ওপরও ম্যাট পেতে দুজন শুয়ে পড়তে পারে। ঝকঝকে এলিডি আলো। সিলিং ফ্যান। গোটা দুয়েক প্লাগ পয়েন্ট। দেওয়ালে চারদিকে অনেক গজাল পোঁতা। মশারি টাঙ্গানোর কোনো অসুবিধা নেই। কাপড় ঝোলানোর তারও টাঙানো। মহারাজ বললেন, এখন কেউ নেই, যেখানে ইচ্ছে শুয়ে পড়ুন। দিনের বেলা দরজা খোলা রেখে বাইরে যাবেন না। অনেক বাঁদর আছে। ঘরে ঢুকে জিনিস নিয়ে চলে যেতে পারে। বাইরের তারে জামা কাপড় মেললে গিঁট দেবেন। না হলে তাও নিয়ে যেতে পারে। শৌচালয় পিছনে। কলে জল থাকে চব্বিশ ঘন্টা। রাতের খাবার আমি এখানেই দিয়ে যাবো আটটা নাগাদ। প্রয়োজনীয় সূচনাবলী দিয়ে চলে যান স্বল্পভাষী মহারাজ।
হোটেলের রুম বয়ও অনেক সময় সংক্ষেপে এতো নিপুণভাবে সব বলতে পারে না। মনে মনে শর্মনকে ধন্যবাদ দিই। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়র পিঠটাও চাপড়ে দিই। কারণ সকালে মহারাজকে না দেখেও মনে হয়েছিল এখানে ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বারান্দায় শোয়ার প্রয়োজনও হলো না। করেরা ও সুরয়ায়ার তুলনায় এখানকার ব্যবস্থা অনেক ভালো। বড় স্যাকটা ভাঁড়ারঘর থেকে নিয়ে আসার সময় উনি বলেন, চা করছি, খাবেন তো? খাবো না মানে? সেই পৌনে চারটেয় খেয়েছি ধনঞ্জয়ের, থুড়ি, মুকেশের চা। তারপর অতো হাঁটাহাঁটি হয়েছে, কপালে জুটেছে প্রহরীর ন্যায্য ধাতানি, সয়েছি অদেখা অথচ সম্ভাব্য তেন্ডুয়ার উপস্থিতির সাসপেন্স, সর্বোপরি শীতের সন্ধ্যা - এখন একটু চা হলে তো ভালোই হয়। আমি তো ভাবছিলাম লেক কাফেতে যাবো। মহারাজের কৃপায় তার দরকার হোলো না।
সন্ধ্যারতির কিছু আগে পাঁচজন স্থানীয় মানুষ এখানে রোজ আসেন। দুজন মধ্যবয়স্ক। তিনজন বয়স্ক। সবাই মিলে আগুনের ধারে গোল হয়ে বসে খানিক গল্পগাছা হয়। সন্তোষজী শক্তপোক্ত চেহারার মধ্যবয়সী মানুষ। মশলার চালু দোকান আছে ওনার। মহারাজকে জানতে চান কাল কী আনতে হবে। বুঝলাম সবার মিলিত দানেই ওনার চলে। আমায় নতুন দেখে আলাপ করলেন। আমি জর্জ ক্যাসলের অভিজ্ঞতা বলে জানতে চাইলাম, আচ্ছা সত্যিই কী ওখানে লেপার্ড আসার সম্ভাবনা আছে? উনিও প্রহরীর কথা সমর্থন করে বললেন এই জঙ্গলে বেশ কয়েকটা লেপার্ড আছে। হঠাৎ সামনাসামনি পড়ে গেলে কী হয় বলা যায় না। ওখানে একা হেঁটে না যাওয়াই উচিত। একটু বাদে মিনিট পনেরোর অনাড়ম্বর আরতি হয়। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে মন্ত্র উচ্চারণ করেন। সন্তোষজী ও ব্রজবিহারীজী কাঁসর ঘন্টা বাজান। আরতি শেষে সবাই একযোগে নিম্নোক্ত চারটি বাক্য দুবার করে বলেন:
ধর্ম কী জয় হো
অধর্ম কী নাশ হো
প্রাণীয়ো মে সদ্ভাবনা হো
বিশ্ব কা কল্যাণ হো
শেষে সবাই তিনবার বললেন হর হর মহাদেব। উচ্চারিত বা উচ্চকিত প্রার্থনা আমার আসেনা। আমি মৌন হয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছিলাম। তবে সবার সম্মিলিত নিবেদন ভালো লাগলো। সন্ধ্যারতির পর সবাই চলে যান। অন্ধকারে হাওয়ায় কাঁপা গাছের পাতা কুন্ডের জলে, পাথরের চত্বরে আলোছায়ার বিলি কাটে। রাতে বাঁদরের দাপাদাপিও বন্ধ। হাইওয়ে অনেক দুরে তাই গাড়ির আওয়াজ নেই। ওপরে ট্যূরিস্ট ভিলায় পর্যটকদের আনন্দোচ্ছ্বাস বিলাসবহুল ঘরের বন্ধ জানলা পেরিয়ে নীচে নামে না। মন্দির চত্বর নির্জনতায় ডুবে যায়। সেই নৈঃশব্দের সাথে মৃদু ছর ছর শব্দে সঙ্গত করে চলে ভাদিয়াকুন্ড ঝর্ণার শীতের শীর্ণ জলধারা।
হোমওয়ার্ক করে দেখেছি এখানে দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি দুরে দুরে ছড়ানো। অনেক হাঁটতে হবে। তাই আগেই ভেবেছি এখানে দুদিন থাকবো। বড় স্যাক থেকে জিনিসপত্র বার করে ট্রাঙ্কের ওপর গুছিয়ে রাখি। অন্য ট্রাঙ্কটার ডালা তুলে দেখি অনেক সিন্থেটিক কম্বল। কিছু নতুন। তখন ভোরের দিকে তাপমাত্রা ছিল ৬ ডিগ্ৰি। দুটো বড় কম্বল বার করে নিলাম। আরামে ঘুমানো যাবে। আমার সিঙ্গেল কম্বল দুটো ব্যাগেই রেখে দিলাম। আটটা নাগাদ মহারাজ আসেন থালা নিয়ে। তিনটে স্বাস্থ্যবান চাপাটি, একটু ভাত, ডাল, একটা সবজি, আচার ও শেষ পাতে ডেজার্ট হিসেবে এক ডেলা গুড়। মনে হয় মহারাজ গোছানো স্বভাবের।
তার প্রমাণও পাই পরদিন। একটা ইঞ্চি ছয়েক চওড়া ও ফুট তিনেক লম্বা খাপি ক্যাম্বিসের পট্টির চারপাশে ছুঁচ দিয়ে মোটা রঙিন সুতোর ইন্টারলক হাত সেলাই দিচ্ছিলেন উনি। বড়িষ্ঠ মহারাজ রঘুবীর পুরী, যিনি তখন হরিয়ানা গেছেন, তাঁর কোমরে ব্যাথা। তাই টান করে বাঁধার জন্য খালি সময়ে বসে বসে উনি একটা কোমরবন্ধনী বানাচ্ছেন ওনার জন্য। সেই সেলাই দেখে মানতেই হোলো ওনার অধ্যাবসায় ও নিপুণভাবে কাজ করার প্রবণতা।
বারান্দার নীচু পাঁচিলের পাশে এক বালতি জল, মগ ও মালসায় ছাই ও নারকেল ছোবড়া রাখা। সংসারত্যাগী মহারাজের নৈপুণ্যতা মুগ্ধ করে। থালা ধুয়ে পাঁচিলে উপুড় করে রেখে ঘরে আসি। আজ হাঁটা হয়েছে প্রায় আট কিমি। প্রাপ্তি হয়েছে মনোরম কিছু স্থানের সৌন্দর্য, কিছু সুন্দর মানুষের সান্নিধ্য। নিস্তব্ধ আশ্রমে মশারির মধ্যে ঢুকি। দেড় ইঞ্চি মোটা হাই ডেনসিটি ফোম ম্যাটের শয্যায় শুয়ে বেশ আরাম লাগে। শরীর ডুবে যাওয়া নরম শয্যায় অসুবিধা হয় আমার। আজকের দিনটা বেশ কাটলো ভাবতে ভাবতে চোখে নেমে আসে জমাট ঘুম।
(পরদিনের বৃত্তান্ত আসবে অন্তিম পর্বে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।