দিলাম ভুলের খেসারত
১১.০১.২০ - শনিবার করেরা বাগিচাওয়ালে হনুমান মন্দির থেকে বেরোলাম সকাল দশটা নাগাদ। আসার আগে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলাম রাজেন্দ্রগিরি মহারাজের সাথে। জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো অসুবিধা হয়নি তো? সম্মিলিত ভজননিনাদে নিদ্রাহীন রাতের কথা বলিনি। কারণ ওনারা এতে অভ্যস্থ। শুধু বলি, ঠান্ডায় একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছে। উনি বলেন, বললেই পারতেন, কত কম্বল ছিল স্টোরে। বলি, রাতে যখন কাঁপুনি টের পেলাম, তখন আপনারা শুয়ে পড়েছেন। তাছাড়া ভুল আমারই, এতো ঠান্ডা হবে ভাবিনি। উনি বলেন, তাতে কী হয়েছে, ডাকতে পারতেন, অযথা কষ্ট পেলেন।
বাস রাস্তায় যাওয়ার পথে দুবে বস্ত্রালয় থেকে দুশো টাকা দিয়ে কিনলাম একটা একানে খাপি সিন্থেটিক কম্বল। বাড়িতে দুটো স্লিপিং ব্যাগ ছিল। মাল কম রাখতে পাতলা একট ফ্লিসের কম্বল এনেছিলাম। ভুলের খেসারত দিতে হোলো। প্ল্যান-এ অনুযায়ী সুরয়ায়া গড়ি দেখে করেরা থেকে শিবপুরী অভিমুখে ৪৭কিমি দুরে রাতে ঘসারাই গ্ৰামে বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে থাকার কথা। কিন্তু গত রাতের অভিজ্ঞতার পর মনে হোলো আজ তো শনিবার! মঙ্গল, শনিবারে তো হনুমান মন্দিরে ভক্ত সমাগম বেশি হয়। আর ঐ হনুমান মন্দিরও খুব প্রসিদ্ধ। ওখানেও যদি আজ রাত্রিব্যাপী ভজন হয় তাহলে আজও কপালে আছে নিদ্রাহীন রাত। তাই ঠিক করি আজ রাতটা সুরয়ায়াতেই কোথাও থেকে যাবো।
এক ঝলকে মাড়িখেড়া
করেরা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি দাঁড়িয়ে আছে শিবপুরীর লোকাল বাস। পিছনের সীটে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। একটু বাদেই বাস ছেড়ে দিলো। করেরা থেকে সুরয়ায়া ঐ ২৭নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পশ্চিম দিশায় ৩৫কিমি। কুড়ি কিমি যেতে অমোলা গ্ৰামের কাছে পড়লো সিন্ধ নদীর ওপর ১৪০০মি লম্বা দীর্ঘ একটি ব্রীজ। দুপাশে স্থির নীলচে বিস্তীর্ণ জলরাশি। এখান থেকে পাখি ওড়া দুরত্বে বিশ কিমি উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধ নদীর ওপর ২০০৮ সালে নির্মিত হয়েছে অটল সাগর বাঁধ। তার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে মাড়িখেড়া জলাধার। তারই ব্যাক ওয়াটারের ওপর এই তৈরী হয়েছে বলে সেতুটা এতো লম্বা। বাঁধ নির্মাণের আগে সিন্ধ নদী এখানে হয়তো পাঁচ ছশো মিটার চওড়া ছিল। চলন্ত বাস থেকে ক্ষণিকের দেখায় জলাধারের দৃশ্য বেশ লাগলো।
প্রগত কথা
হাইওয়ের ওপর কন্ডাক্টর নামিয়ে দিল নিউ খালসা ধাবায়। ওখান থেকে গ্ৰামের রাস্তা ধরে উত্তর দিকে আটশো মিটার গেলে সমতল জমিতে সুরয়ায়া গড়ি। বারোটা বেজে গেছে। ভাবি হাঁটাহাঁটির আগে বডিতে দ্বিতীয় রাউন্ড মুড়ি, মটর, বাদামের জ্বালানি ভরে নি। ধাবার মালিক দীর্ঘদেহী, ছিপছিপে সর্দার প্রগত সিং কাছে এসে জানতে চান কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাবো। বুকে পিঠে স্যাক নিয়ে একাকী পরদেশী প্রায়বুড়োকে দেখলে ছোটখাটো জনপদের মানুষের কিঞ্চিৎ অবাক হয়। বড় শহরে যে যার ধান্দায় মগ্ন।
প্রাথমিক আলাপচারিতার পর খেয়াল হয় দুটো বোতলেই জল প্রায় শেষ। খরচ বাঁচাতে এখন আর জল কিনি না। জনগন যে জল খায় তাই বোতলে ভরে ক্লোরিন ট্যাবলেট দিয়ে খাই। সম্ভব হলে সরাসরি নলকূপ বা বোরওয়েল থেকে জল ভরি। আসলে জল যেভাবে হ্যান্ডলিং এবং স্টোর করা হয় তার থেকেই জলদূষণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। প্রগতজীকে বলতে উনি বললেন ঐ দেখুন রাস্তার ওপারে পেট্রল পাম্প। ওখানে বোর ওয়েল থেকে আমার কর্মচারী জল ভরে আনছে ধাবার জন্য। ওখান থেকে আপনিও জল ভরে নিতে পারেন। তেলের স্টক শেষ। তাই পাম্প বন্ধ। তবে চালু বোর ওয়েলের দৌলতে আমি তাজা জল পেয়ে গেলাম।
প্রগতজীর আদি নিবাস অমৃতসর জেলার ভিলোয়াল জনপদে। ওনার পিতা পঞ্চাশের দশকে এখানে আসেন। ৬৮ সালে দুমাস বয়সে মায়ের কোলে চেপে এসে এখানেই রয়ে গেছেন প্রগত। এখন বছরে একবার নাড়ির টানে যান দেশের বাড়ি। চাকরি বাকরির চেষ্টা না করে এখানেই ধাবা করেছেন। বহুদিনের সঞ্চয়ে প্রায় কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন ধাবা সংলগ্ন পাঁচ বিঘে জমি। মনযোগী শ্রোতা পেয়ে মন খুলে সেই সব কঠিন দিনের কথা বলে যান এক পরদেশীকে। ইচ্ছে ছিল ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে ধাবাটা পাকা করে দোতলায় রাত্রিবাসের জন্য ছিমছাম একটা হাইওয়ে মোটেল বানানোর কাজ শুরু করবেন। মাস ছয়েক পরে একবার ফোন করেছিলাম - বিমর্ষ গলায় বললেন, করোনার দাপটে প্ল্যান আপাতত বিশ বাঁও জলে। এখনো ধাবা খোলা রেখেছেন কিন্তু বিক্রি খুব কমে গেছে। কত মানুষের কত স্বপ্ন, পরিকল্পনা থাকে কিন্তু পরিস্থিতির চাপে ভেস্তে যায়।
ধাবার ছেলেটি খুব সুন্দর স্বাদের বড় চা দিয়ে গেল। দাম নিলো মাত্র দশ টাকা। আমি অবাক হয়ে বলি, এমন চা তো অন্ততঃ পনেরো টাকা হওয়া উচিত। প্রগতজী বলেন, বাবুজী, আমি গুরু গোবিন্দসিংজীর জপ করে এই ধাবা চালাই। এ কেবল ব্যবসা নয়, আমার কাছে মানব সেবা। কর্মচারী কম থাকলে আমি রান্না করি, জল ভরি, ঝাঁট দিই। ধাবার কোনো কাজে আমার ঝিঝক্ নেই। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার বাসনা নেই। তাই আমি এমন চা দশ টাকায় দিতে পারি। এতেও আমার লাভ থাকে। বেশি লোভ করতে নেই। এই যে আপনি সন্তষ্ট হলেন এর মূল্য টাকায় হয় না। রব নে রাখা, ওয়াহে গুরু কা কৃপা হুয়া, তো য্যাসে জমিন হুয়া, মেরা ইয়ে ইচ্ছা ভী কভি পুরা হোগা। চোখ বুঁজে একটু বিড়বিড় করেন প্রগত। হয়তো স্মরণ করে নেন ওনার ইষ্টদেব গুরু গোবিন্দ সিংকে।
জানতে চাই, প্রগতজী, আজ রাতটা কি আমি ধাবার চারপাইতে কাটাতে পারি? উনি অবাক হয়ে বলেন, এখন তো সবে সাড়ে বারোটা। গড়ি দেখে আরামসে তিনটের মধ্যে ফিরে এসে তো আপনি শিবপুরী চলে যেতে পারেন। ওখানে অনেক হোটেল, লজ পেয়ে যাবেন। এখানে থাকবেন কেন? তাও যদি আপনি থাকতে চান আমার কোনো অসুবিধা নেই। ঐ কোনে তিনপাশ ঘেরা জায়গায় শুয়ে পড়বেন। আমার দুজন লোকও থাকে রাতে, কোনো অসুবিধা নেই। আমি একটা কম্বলও দিয়ে দেবো। চারপাশে খোলা চাষজমি। এখানে রাতে কিন্তু ভালো ঠান্ডা হবে। বলি, হয়তো থাকার প্রয়োজন হবে না, তবু জেনে রাখলাম। বলি না এমন ভ্রমণে চেষ্টা করি বিকল্প প্ল্যান ছকে রাখতে। কখন কাজে আসে কে বলতে পারে। প্রগতকে ওর স্বপ্ন সাকার হওয়ার জন্য শুভকামনা জানাই। রাত্রিবাসের অনুমতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে চলতে থাকি গড়ির দিশায়।
গড়িতে গড়াতে লাল্লুর আপত্তি
কিছুটা যেতে রাস্তার বাঁদিকে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য তিরিশের এক যুবক আমায় দেখে হাসে। আমিও হেসে দাঁড়াই। সে আলাপ করে। নাম লাল্লু যাদব। গড়ির ASI গার্ড। কারণ সেই এক। পিঠে পেল্লায় স্যাক, বুকে বোঁচকা নিয়ে এক পরিণত বয়সের পরদেশীর এহেন বিরান স্থানে পুটপুট করে হেঁটে চলা। এখানে পর্যটক খুব কমই আসে। একটু ভেতরে, সমতলে বলে হাইওয়ে থেকে চোখেও পড়ে না। যারা আসে তারা সচরাচর আসে দলবদ্ধ হয়ে চারচাকায় ধুলো উড়িয়ে। ওখানে গিয়ে করে খানিক হৈচৈ, সেলফি সেশন। অতঃপর, ধুস, সেরকম কিছু নয়, বেকার এলাম গোছের মনোভাব নিয়ে অচিরেই প্রস্থান। লাল্লু বলে সাধারণ পর্যটকদের কাছে এই গড়ির তেমন আকর্ষণ নেই। এর কদর বোঝে সিরিয়াস দর্শক। এক বিদেশিনী পরপর তিনদিন এসেছিলেন। নিবিষ্ট হয়ে দেখছিলেন, নোট নিচ্ছিলেন, ছবি তুলছিলেন।
বলি লাল্লু ভাই, মাঝে প্রসাদ থাকলে তো আপনিও বিখ্যাত হয়ে যেতেন। মজাটা উপভোগ করে হাসে লাল্লু। আলাপচারিতার মধ্যে এসে দাঁড়ায় লাল্লুর বন্ধু অনিল শর্মা। অত্যন্ত মার্জিত ব্যবহার অনিলের। লাল্লু বলে গড়িতে তিন শিফটে দুজন করে ছজন গার্ড ডিউটি দেয়। ওর আজ নাইট ডিউটি, রাত দশটায়। উৎফুল্ল হয়ে তৎক্ষণাৎ প্ল্যান-বি ভাঁজতে যাই। বলি, লাল্লু ভাই, তাহলে কি আজ রাতটা আমি গড়ির এক কোনে, ঢাকা অলিন্দে আপনার ভরসায় থেকে যেতে পারি?
দু কানে হাত ঠেকায় লাল্লু। অসম্ভব। আকারে ছোট হলেও এই গড়ি পূরাতাত্বিক বিভাগের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সারা ভারতে নবম শতাব্দীর এমন শৈব মঠ খুব কমই টিকে আছে। প্রচুর অর্থব্যয়ে ASI এর পুনরুদ্ধার করে সংরক্ষণ করছে। সন্ধ্যা ছটায় গেটে তালা পড়ে যায়। ওখানে রাতে কেউ থাকলে জানাজানি হয়ে গেলে চাকরি তো যাবেই, জেলও হতে পারে। ওর বক্তব্য খুবই যুক্তিযুক্ত। আমার হতাশ মুখ দেখে লাল্লুও প্রগত সিংয়ের মতো একই কথা জানতে চায়, আমি এখানে থাকতেই বা চাই কেন? তার তো কোনো প্রয়োজন নেই।
বেড়াল দেখে লাল্লু করে মুশকিল আসান
এবার আমায় ঝোলা থেকে বেড়ালটা বার করতেই হয়। বলি, লাল্লু ভাই, সময়ের আড়াই বছর আগে কর্মজীবনে ইতি টেনে এখন আমার নেশা খুব কম খরচে একাকী ভ্রমণ। হোটেলের বদলে থাকি মন্দির, গুরুদ্বারা, আশ্রম বা ধর্মশালায়। গাড়ি, অটো রিজার্ভ না করে যাতায়াত করি বাস বা শেয়ার অটোয়। যথাসম্ভব হাঁটি। আমি বেরোই অনেকদিনের জন্য। তাই দিনপ্রতি তিন চারশো টাকার মধ্যে ঘোরার সংকল্প করেছি। এভাবে চারবার ঘোরাও হয়ে গেছে। এটা পঞ্চম বার। লাল্লুভাই, যখন চাকরি করেছি তখন মূদ্রার একটা দিক দেখেছি। এখন দেখতে চাইছি অপর দিক। এই খোঁজ বেশ লাগছে। আমি কি বোঝাতে পারলাম, কেন গড়িতে থাকতে চেয়েছিলাম?
লাল্লু, অনিল স্তব্ধ বিষ্ময়ে শুনছিল আমার কথা। হয়তো ওদের আমায় মনে হয়েছিল বিচিত্র কোনো নমুনা। ক্ষণিক পরে লাল্লু বলে, স্যার, এযাবৎ আমি আপনার মতো মানুষ দেখিনি, এমন সংকল্পও আগে শুনিনি। আপনি যদি আমায় বলেন দিনপ্রতি চারশো টাকায় এক সপ্তাহ ঘুরে আসতে, আমি পারবো না। আপনি কী করে পারছেন জানি না। এখন আপনি কোথা থেকে আসছেন?
বলি, গতকাল সকালে ঝাঁসি এসে রাতে ছিলাম করেরা বাগিচাওয়ালে হনুমান মন্দিরে। কিন্তু কিছু ভক্তের সারারাত সুন্দরকাণ্ড ভজনের জন্য ঘুমোতে পারিনি। আজ রাতটা ভেবেছিলাম ঘসারাইতে বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে থাকবো। কিন্তু শনিবার হনুমানজীর আরাধনার দিন। তাই ওখানেও যদি আজ সারারাত ভজন হয় তাহলে মুশকিলে পড়বো। গত তিন রাত ভালো ঘুম হয়নি। তাই ভেবেছিলাম আজ রাতটা গড়িতে শান্তিতে কাটিয়ে রবিবার ওখানে থাকবো। সুরয়ায়াতে রাত্রিবাসের পরিকল্পনা আমারও ছিল না।
লাল্লু বলে, তাহলে এক কাজ করুন স্যার। গড়ির উল্টো দিকে শখানেক মিটার পশ্চিমে আছে প্রাচীন জগন্নাথ রামজানকী মন্দির। সচিব বিজয়ভারতী মহারাজ। ওনার সাথে দেখা করে বলুন আজ রাতটা ওখানে থাকতে চান। বড় জায়গায়, জনবহুল মন্দিরের কথা আলাদা কিন্তু এমন ছোট, বিরান জায়গায় জনহীন মন্দিরে আজকাল অচেনা কাউকে রাতে থাকতে দিতে মহারাজরা ভরসা পান না। আমার রেফারেন্স দেবেন। আমি এই গ্ৰামের পুরোনো বাসিন্দা। উনি আমায় ভালো করে চেনেন। তবু যদি কোনো অসুবিধা হয়, আমার ফোন নম্বর রাখুন, ফোন করবেন, আমি গিয়ে কথা বলে ব্যবস্থা করে দেবো। তবে মন হয় তার প্রয়োজন হবে না। আমার নাম করলেই কাজ হবে।
বলি, কিন্তু ওটা তো রামজানকী মন্দির। যদি ওখানেও আজ শনিবার সারারাত ভজন হয়? লাল্লু বলে, না, না, সেসব হবে না। ওখানে থাকেন কেবল মহারাজ ও তাঁর এক সহকারী। সাতটায় আরতির পর আটটায় মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আর ওখানে বাইরের কেউ থাকে না। বলি, তাহলে তো ভালোই। দেখি মহারাজ থাকতে দেন কিনা। লাল্লুর দৌলতে হয়ে গেল পরিকল্পনা বহির্ভূত প্ল্যান-সি। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে যাই।
গতি হোলো আশ্রমে
মন্দির চত্বরের পরিবেশ মনোরম। গড়ি থেকে পশ্চিমে কিছুটা গিয়ে মাটির রাস্তার গায়েই সীমানা প্রাচীর দেওয়া বিঘা চারেক জমির ওপর আশ্রমের মতো একটা কিছু। সাজুগুজু নেই। কিছু প্রাচীন গাছ। চারপাশে চাষজমি। অখন্ড শান্তি। পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিপছিপে জটাধারী এক যুবক সন্ন্যাসী স্থানীয় একজনের সাথে কথা বলছিলেন। জানতে চাই, বিজয়ভারতী মহারাজ? উনি বলেন, ঐ ভেতরে বসে আছেন। ধন্যবাদ জানিয়ে এগোই।
প্রায় ৮০x৫০ ফুট সাইজের ২০ ফুট উঁচু টিনের শেড। তার মধ্যেই জগন্নাথ রামজানকী মন্দির। সামনে ১২ ফুট চওড়া টানা বারান্দা। পরিস্কার পাথরের মেঝে। দিনের বেলাতেও বেশ ঠান্ডা। মন্দিরের দরজার বাঁদিকে বড় কার্পেট পাতা। তার পাশে চৌকির ওপর বসে আছেন সচিব মহারাজ। কাছে গিয়ে নমস্কার করে, আত্মপরিচয় দিই। লাল্লু যাদবের রেফারেন্স দিয়ে সংক্ষেপে করেরায় রাজেন্দ্রগিরি মহারাজকে যা বলেছিলাম তারই পূনরাবৃত্তি করি। উনি ভাবলেশহীন মুখে শুনে বলেন, আধার কার্ড আছে? বার করে ওনার হাতে দিই। দেখে নিয়ে বলেন, ঠিক আছে বারান্দার ওপাশে থাকতে পারেন। মেঝেতে পাতার জন্য ম্যাট ও গায়ে দেওয়ার জন্য দুটো কম্বল পাবেন।
টানা বারান্দার পূবে বাইরের দিকে লোহার গ্ৰীলের ওপর সবুজ জালি নেট লাগানো, যেমন গ্ৰীণহাউসে লাগায়। ফলে ওদিক দিয়ে রাতে অল্প বাতাস ও ভালোই ঠান্ডা আসতে পারে। তবে দক্ষিণে ও পশ্চিমে দেওয়াল। ওপরে টিনের ছাউনি। উত্তর দিকটাও টানা বারান্দার মধ্যেই। মেঝেতে পাতার ম্যাট ও দুটো কম্বল পেলে, আমার কাছে যা আছে সব মিলিয়ে হয়তো গতরাতের মতো ঠান্ডায় কাঁপতে হবে না। বলি, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি কি এই বড় স্যাকটা এখানে রেখে গড়ি ঘুরে আসবো? মহারাজ স্বল্পবাক। কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।
যাওয়ার আগে অল্পবয়সী সন্ন্যাসীটির সাথে পরিচয় করি। নাম শর্মন ভারতী। পূর্বাশ্রমের নিবাস মোরেনা। বারো বছর বয়সে ঘর ছাড়ে। নানা ঘাটে জল খেয়ে এখানে এসেছে দশ বছর আগে। বয়স তেত্রিশ। শর্মন হাসিখুশী, আলাপী। সচিব মহারাজের বিপরীত স্বভাব। সেও জানায় এখানে বিশেষ কেউ আসে না। এখানে আশপাশে কোনো দোকানও নেই। চা খেতে হলেও আপনাকে হাইওয়ে যেতে হবে। রাতে আমাদের সাথেই খাবেন। শর্মনকে বেশ লাগে। বলি, তাহলে গড়িটা দেখে আসি? বলে, হ্যাঁ যান, ঘুরে আসুন।
সুরয়ায়া গড়ির তাৎপর্য
গড়ি মানে গড় বা কেল্লার ক্ষুদ্র সংস্করণ। সুরয়ায়া গড়ি ASI বা কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে। তাদের ভূমিকা প্রশংসার্হ। এখানে আছে একটি আবাসিক শৈবমঠ ও তিনটি মন্দির। ব্রাকেট, চৌকাঠ, ছাদ, স্তম্ভ, শিখর, মূর্তি, দেওয়ালের সুক্ষ চারুকলা এসবের কিছু খন্ডাংশ যা খননকালে এখানে পাওয়া গেছিল তা মঠ চৌহদ্দির মধ্যে মুক্তাঙ্গন সংগ্ৰহশালায় সাজিয়ে রাখা আছে। এখানে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপি পাওয়া গেছে তা সংরক্ষিত আছে গোয়ালিয়র মিউজিয়ামে। তার একটিতে ১২৮৫ খ্রীষ্টাব্দে নরোয়ারের রাজা গোপালদেবের উল্লেখ আছে। তবে এই মঠের নির্মাতা ও নির্মাণকাল নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি আছে। একমতে সহর্ষবর্ধনের গুরুদেব পুরন্দর শৈবধর্মের শিক্ষা ও প্রচারের জন্য খ্রীষ্টীয় নবম শতকে এই গড়ির নির্মাণ করেন। অন্যমতে উজ্জয়িনীর রাজা অবন্তীবর্মা এর নির্মাতা। শিলালেখ অনুযায়ী অতীতে এর নাম ছিল সরস্বতীপট্টন।
গড়ির আকার উত্তর দক্ষিণে ৫৫০ ফুট ও পূব পশ্চিমে ৪৯০ ফুট। গড়ির উত্তরমুখী একমাত্র প্রবেশদ্বারটি সরাসরি প্রাচীরের গায়ে নয়। বরং সেটি গড়ির পশ্চিম দুর্গপ্রাকারের মাঝামাঝি জায়গা থেকে বেরিয়ে থাকা ১০০x১০০ ফুট আকারের মজবুত ভাবে নির্মিত একটা আলাদা অংশে যাকে বলা যেতে পারে Entrance Enclave for visitors management. (ম্যাপে 3A চিহ্নিত)। অর্থাৎ অবাঞ্ছিত প্রবেশকারী একটি দরজা পেরিয়ে গড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না। তাকে আঁকা বাঁকা পথে তিনটি তোরণ পেরিয়ে পৌঁছতে হবে মঠ চত্বরে। গড়ির চারপাশে মোটা, মজবুত দুর্গপ্রাকার (ম্যাপে 3C)।
প্রাচীরের চার কোনে চারটি উঁচু বুরুজ। মাঝে প্রাচীরের সম উচ্চতার আরো চারটি বুরুজ। গড়ির মধ্যে মঠ চত্বরটি উত্তর দক্ষিণে ২১০ ফুট ও পূর্ব পশ্চিমে ১৬০ ফুট। চত্বরে রয়েছে একটি মঠ ও তিনটি মন্দির। মঠ চত্বরটি গড়ির মধ্যে হওয়া স্বত্ত্বেও আর এক দফা মোটা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা (ম্যাপে 3B)। তারও চার কোনে চারটি বুরুজ। গড়ির প্রাচীরের বাইরে পশ্চিম দিকে অতীতের সুরক্ষা পরিখার অবশেষ রয়েছে। অর্থাৎ মঠের সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল জোরদার। এখানে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগতে পারে - একটি ধর্মীয় মঠের এতো সুরক্ষার কী প্রয়োজন ছিল?
গবেষকদের অভিমত অশোকনগরের কাছে কদওয়াহাতে (অতীতে কদম্বগুহা) যে মত্তময়ুরপন্থী শৈবধর্মের উৎপত্তি হয়, কালে কালে তার নানান শাখা মধ্যভারতে তেরাহী (অতীতে তেরাম্ভী), মহুয়া, রানোদ ছাড়িয়ে গুজরাট, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এমনকি তামিলনাড়ুর অবধি ছড়িয়ে পড়ে। সুরয়ায়ার মঠও ছিল সেই মত্তময়ুরপন্থী শৈবধর্মের একটি শাখা। বিভিন্ন অভিলেখ থেকে জানা যায় এইসব শৈবমঠের মঠাধীশ বা আচার্যরা ধর্মাচরণ, শিল্প, সংস্কৃতির চর্চা ছাড়াও রাজ্যশাসনের ব্যাপারে রাজাদের রাজনীতি, কূটনৈতিক, প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেষ্টার ভূমিকাও পালন করেছেন। এমনকি যুদ্ধের সময় রণকৌশল বিষয়েও পরামর্শ দিতেন। তাই কালুচরী ও প্রতিহার রাজবংশের স্থানীয় রাজাদের কাছে তাঁদের ছিল প্রভূত মর্যাদা। পেয়েছেন অকুণ্ঠ আর্থিক আনুকূল্য। সামরিক বিষয়ে জড়িত থাকার ফলে নিরাপত্তার কারণে তাঁদের আবাসিক মঠ রাজার পৃষ্ঠপোষকতাতেই এহেন মজবুত দুর্গের অভ্যন্তরে গড়ে উঠেছিল। তবে দীর্ঘ ছ সাতশো বছরে তার অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত। সুরয়ায়া গড়ির মঠ সেই পরম্পরার এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। তাই পূরাতাত্বিকদের কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিক মতে সুরয়ায়া গড়ির মন্দিরের সুনিপুণ ভাস্কর্য দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সময়কালে কচ্ছপঘাত রাজবংশের শৈলীর অনুসারী। গোয়ালিয়রের কাছে অবস্থিত ছিল এই রাজবংশের কেন্দ্র। তাঁরা ছিলেন শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। তাঁরাই নির্মাণ করেন গোয়ালিয়র কেল্লার বিখ্যাত শাস-বহু বিষ্ণু মন্দির, মোরেনার কাছে গড়ি পদাবলী, চৌষট যোগিনী মন্দিরের আদলে মিতাবলীর একাত্তরশো মহাদেব মন্দির ইত্যাদি। চৌষট যোগিনী মন্দিরের আদলে তৈরী হয় ব্রিটিশ ভারতের সংসদ ভবন।
অতীতে সম্পূর্ণ মঠগৃহটি ছিল দ্বিতলবিশিষ্ট। এখন দ্বিতলের অধিকাংশ অংশ বিলুপ্ত। একতলায় মাঝখানে উন্মুক্ত সভা অঙ্গনের চারপাশে সার সার স্তম্ভের ওপর ভর করা ছাদবিশিষ্ট ঢাকা অলিন্দ। তারপর আবাসিকদের অধ্যয়ন ও আবাসকক্ষ। দরজার পাথরের ফ্রেমের পাশে লতাপাতার ও ওপরে অনেক জায়গায় গণেশের মুখ খোদিত। দেওয়ালে জিনিসপত্র রাখার জন্য আছে তাক, ঘোড়ার মুখওয়ালা পাথরের খোঁটা। বাইরের পেল্লায় মোটা দেওয়ালে আলো বাতাস আসার জন্য আছে বাতায়ন।
একতলার ছাদের একপাশে একটা চারদিক খোলা সর্বোতোভদ্র শৈলীর বর্গাকার গর্ভগৃহ। ওপরে চারপাশে বেরিয়ে থাকা কার্নিশ ও ত্রিস্তর শিখর। তবে সেখানে এখন পর্যটকদের যাওয়া নিষিদ্ধ। দেওয়াল তুলে রাস্তা বন্ধ। শিখরটি কেবল দুর থেকে দেখা যায়। মঠের মধ্যে একটি বর্গাকার কুয়ায় স্ফটিক স্বচ্ছ জল। এযাবৎ আমি অনেক প্রাচীন বাউলি দেখেছি কিন্তু এতো পরিস্কার জল কোথাও দেখিনি। তিন নম্বর মন্দিরের সামনে উন্মুক্ত চত্বরে রয়েছে মসৃন পাথরের গাঁথুনির একটি বড় আয়তাকার ধাপকুয়া। তাতেও টলটলে পরিস্কার জল। দেওয়ালে অনন্তশায়ী বিষ্ণুর ভাস্কর্য।
মঠ চত্বরে তিন মন্দির
এক নম্বর মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। এটি সর্বাধিক ঐশ্বর্যময়। এর অবস্থাও বাকি দুটি মন্দিরের থেকে ভালো। চারটি স্তম্ভের ওপর টিকে আছে উঁচু মন্ডপ। তারপর সংকীর্ণ অন্তরাল। অতঃপর গর্ভগৃহে চারধাপের বর্গাকার বেদীতে প্রোথিত ফুট তিনেক শিবলিঙ্গ। বেদীর উপরিভাগে লিঙ্গের আট ইঞ্চি অংশ অষ্টভূজাকার, বাকিটা গোলাকার। শিবলিঙ্গের উপরে ঢালা জল, দুধ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য গৌরিপট্ট বা যোনির প্রতীক এখানে অনুপস্থিত। মন্দিরের শিখর বিলুপ্ত। গর্ভগৃহের দরজার ললাটবিম্বে (lintel) গড়ুরাসীন বিষ্ণু। মন্ডপে ও দ্বারে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব (নটরাজ), গনেশ, বীরভদ্র, নবগ্ৰহ, সপ্তমাতৃকার ভাস্কর্য অতিশয় উৎকৃষ্ট মানের। উত্তরে বর্হিগাত্রে রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। মন্ডপের অভ্যন্তরে ছাদে পূর্ণপ্রস্ফূটিত পদ্মের অনুপম ভাস্কর্য আজও অটুট। মন্ডপের চারটি আয়তাকার স্তম্ভের চারপাশে শৈব সন্ন্যাসীর মূর্তি। ঐতিহাসিকদের মতে এটি যে একটি শৈবমঠ ছিল এবং মঠাধক্ষ্যদের যে মন্দির নির্মাণে সক্রিয় যোগদান ছিল এই শৈব-তপস্বীর মূর্তিগুলি তার অকাট্য প্রমাণ।
দু নম্বর মন্দিরটি আকারে এক নম্বরের থেকে ছোট। এটি এক নম্বর মন্দিরের বিপরীতে তাই পূবমুখী। এর অনুচ্চ মন্ডপটিও চারটি স্তম্ভে টিকে আছে। এখানেও সংকীর্ণ অন্তরাল। অতঃপর গর্ভগৃহ কিন্তু অভ্যন্তরে কোনো বিগ্ৰহ নেই। কেবল একটি চৌকোনা বেদী। এখানেও গর্ভগৃহের দরজার ললাটবিম্বে গড়ুরাসীন বিষ্ণু। বাঁ দিকে ব্রহ্মা ও তাঁর সঙ্গিনী ব্রাহ্মণী। ডান দিকে শিব-পার্বতী। এনাদের মাঝে নবগ্ৰহ ও সপ্তমাতৃকার ভাস্কর্য। গর্ভগৃহের দরজার নীচে দুপাশে গঙ্গা ও যমুনার মূর্তি। দুজনের পাশেই দন্ডায়মান একটি করে দ্বারপাল।
তিন নম্বর মন্দিরটি আকারে সবথেকে ছোটো। এটি আছে দ্বিতীয় মন্দিরের উত্তর দিকে সামান্য ব্যবধানে মঠের সীমা-প্রাচীরের উত্তর পশ্চিম কোন ঘেঁষে। এটি সম্পূর্ণ বিদ্ধস্ত হয়ে যায়। পরে পূরাতত্ব বিভাগ ধ্বসে পড়া পাথর সাজিয়ে এটির পূনর্নিমান করে। গর্ভগৃহ খালি। দ্বারের চৌকাঠ উধাও। মন্ডপ, অন্তরাল, শিখর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গর্ভগৃহের ছাদে চ্যাপ্টা পাথরের একটা স্ল্যাব পাতা আছে।
একটি অপ্রচলিত শিব মূর্তি
দু নম্বর মন্দিরের দক্ষিণ গাত্রে শিবের একটি অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত রূপ দেখলাম - অন্ধকান্তক মূর্তি। হিন্দু পুরাণে অন্ধকাসুর এক অনিষ্টকারী অসুর। তার নাকি ছিল এক হাজার মাথা, দু হাজার হাত ও পা। পার্বতীকে অপহরণের দূর্মতি হওয়ায় শিব তাকে বধ করেন। তাই ঘাড় বেঁকিয়ে সক্রোধে দু হাতে বাগিয়ে ধরা ত্রিশূলের এক মোক্ষম খোঁচায় অন্ধকাসুর বধকারী এই রুদ্ররূপী শিব - অন্ধকান্তকমূর্তি নামে পরিচিত।
হিন্দু পুরাণ মতে সৃষ্টি (ব্রহ্মা), স্থিতি (বিষ্ণু) ও লয় (মহেশ্বর) এই তিনেরই দেবতা আসলে অনাদি অনন্ত পরমেশ্বর শিবেরই তিনটি রূপ। তাই শিব গৃহী (সৃষ্টি), সমাহিত (প্রতিপালন) ও উগ্ৰ (সংহার) তিন রূপেই পূজিত হন। শিবের নানান উগ্ৰরূপের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় নটরাজ (তান্ডব নৃত্যে প্রলয় আনয়নকারী), গজান্তক (গজাসুর বধকারী), কঙ্কাল ভৈরব (ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক ছিন্নকারী), শরভেশমূর্তি (বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার বিনাশকারী), কালারিমূর্তি (ভক্ত মার্কন্ডেয় কে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে মৃত্যুর দেবতা যমকে পরাস্তকারী), কামান্তকমূর্তি (কামদেব মদনকে ভস্মকারী), অন্ধকান্তকমূর্তি (অন্ধকাসুর বধকারী) ইত্যাদি।
এর মধ্যে নটরাজ ছাড়া বাকি রূপের প্রতিমূর্তি আমি কোথাও দেখিনি। ভৈরব বা ভয়ানক রূপের নমুনা কিছু দেখেছি। যেমন কালিঞ্জর কেল্লায় মান্ডুক ভৈরব, উজ্জয়িনীর কালভৈরব। উখিমঠে অষ্টভৈরব মন্দিরে আবার দেখেছিলাম একই স্থানে আটটি ভৈরব রূপ। আমি ভারতের অনেক মন্দিরে গেছি। অন্ধকান্তকমূর্তিও চোখে পড়েছে কিন্তু এই বৃত্তান্ত জানা ছিল না। যাওয়ার আগে সুরয়ায়া সম্পর্কে কিঞ্চিৎ খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানতে পারি। ইলোরা গুহামন্দিরেও আছে অন্ধকান্তকমূর্তি। অসংখ্য ভাস্কর্যের ভীড়ে সে মূর্তি চোখে পড়লেও তার তাৎপর্য বুঝিনি। রাজস্থানে চিতোরগড় জেলায় বাডোলী মন্দিরেও আছে অন্ধকান্তকমূর্তি। সেখানে এখনও যাই নি।
ভাবালো আমায় গণেশজী
এক নম্বর মন্দিরের একটি ভাস্কর্য আমায় বেশ ভাবালো। হিন্দু মন্দির ভাস্কর্যে দেব ও দেবীর পাশাপাশি আভঙ্গ বা ত্রিভঙ্গ মূদ্রায় দন্ডায়মান শারীরিক ভঙ্গি বেশ প্রচলিত। দেবের একটি হাত দেবীকে পিছন থেকে বেষ্টন করে থাকে। দেবের বেষ্টিত হস্তের তালু থাকতেই পারে দেবীর কোমরে কিন্তু অবধারিত ভাবে তা থাকে দেবীর সুডৌল স্তনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এহেন ভঙ্গিতেও দুজনকেই লাগে নির্বিকার, দৃষ্টি একে অপরের মুখপানে নিবদ্ধ না হয়ে হতে পারে সম্মূখে বা দুদিকে প্রসারিত। অর্থাৎ এমন ভঙ্গিমা মানেই যে তা যৌনাবেশে (Eroticism) সিক্ত, তা হয়তো নয়।
ঐ মন্দিরের ললাটবিম্বে গড়ুরাসীন বিষ্ণুর বাম পাশে শিব ও পার্বতীর ও ডান পাশে ব্রহ্মা ও ব্রাহ্মণীর শরীর বিভঙ্গে ঠিক তেমন ভাবই পরিস্ফুটিত। ললাটবিম্বের ঠিক ওপরেই আর একটি প্যানেলের মধ্যভাগে নৃত্যরত নটরাজ। তাঁর বামদিকে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর ভঙ্গিতেও এই ভাব। বিষ্ণুর বাম হাত লক্ষ্মীকে জড়িয়ে, বাম তালু তাঁর বাম স্তনে রাখা কিন্তু লক্ষ্মী নির্বিকার ভঙ্গিতে দেখছেন আয়নায় মুখ।
কিন্তু নটরাজের ডানপাশে যুগল মূর্তি দেখে একটু খটকা লাগলো। সেখানে ত্রিভঙ্গমূরারী বিভঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন গণেশ। তাঁর বাঁদিকে এক সঙ্গিনী! তিনি কে তা জানিনা তবে তিনি এক মধ্যক্ষামা, গুরুনিতম্বিনী, পীনপয়োধরা যুবতী। তিনিও ত্রিভঙ্গ মূদ্রায় এলায়িত ভঙ্গিতে গনেশজীর শরীরে প্রায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। গনেশজীর বাম হাত তাকে বেষ্টন করে আছে। তাঁর অঙ্গুলিসমূহ সযত্নে ধারণ করে আছে তার পরিপুষ্ট স্তনভার। সঙ্গিনীর মুখভাব যেন চরম সুখাবেশে বিভোর। তিনি তাকিয়ে আছেন গনেশের দিকে। তাঁর শিথিল শুঁন্ড এলিয়ে পড়ে আছে নিজ বক্ষে। তিনিও যেন আবিষ্ট হয়ে সঙ্গিনীর মুখপানে চেয়ে আছেন। সেই দৃষ্টিবিনিময়ে - যৌনাবেশ না নির্লিপ্ততা - কী ভাব পরিস্ফুট তা গবেষকদের বিচার্য। তবে আমার মতো সাধারণের দৃষ্টিতে এমন শরীর বিভঙ্গ সহকারে যুগলের নিবিড় নৈকট্য - ঐ বিশেষ মনোবস্থারই ইংগিতবাহী।
মহাদেব বৃষপৃষ্ঠে আসীন হয়ে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বা ললিতাসনে উপবিষ্ট হয়ে বাম উরুতে পার্বতীকে বসিয়ে অঙ্গ বেষ্টন করে বাম হাতে ধরে আছেন তাঁর সুডৌল অমৃতভাণ্ড - এমন ভাস্কর্য অনেক দেখেছি - খাজুরাহো, হ্যালেবিড, বেলুরে তা অতি বাঙময়। অথবা পার্বতী স্বতঃপ্রণোদিতা হয়ে তাঁর লাবণ্যময় সম্পদভার শিবের কপাটবক্ষে ন্যস্ত করে কন্ঠলগ্না হয়ে তৃষিত ওষ্ঠে চেয়ে আছেন পতিমুখপানে, এমন ভাস্কর্যও দেখা যায়। এহেন শরীর বিভঙ্গে, মুখভাবে যৌনাবেশ (Eroticism) সুস্পষ্ট।
আর তা হবে নাই বা কেন? ব্রহ্মারূপী শিবই তো সৃষ্টির দেবতা। তাই পার্বতী হতেই পারেন সেই সৃষ্টিসূচনার স্ফুলিঙ্গ ও ফলাধার। তবে স্থিতির দেবতা বিষ্ণুকে সচরাচর দেখা যায় একাকী, শান্ত, আভঙ্গ মূদ্রায় দন্ডায়মান।লক্ষ্মী-নারায়ণ যুগল মূর্তিতে বিষ্ণুকেও লক্ষীকে জড়িয়ে তাঁর সুডৌল স্তনে তালু রেখে নির্লিপ্ত দন্ডায়মান ভঙ্গিতে দেখা যায়। যেমন দেখেছি এখানে - স্থিতির দেবতার স্থিতধী ভঙ্গিমা। বৈকুন্ঠধামে অনন্তনাগের শয্যায় আলস্যময় ভঙ্গিতে অর্ধশায়িত বিষ্ণুর পদপ্রান্তে বসে পদসেবা করতে দেখা যায় লক্ষ্মীকে। বিষ্ণুর সেই বিখ্যাত ভঙ্গিমা অনন্তশায়ী বিষ্ণু নামে সুপরিচিত। সেখানেও বিন্দুমাত্র আশ্লেষ প্রতিভাত হয় না। কিন্তু এই মন্দিরে যুবতী সঙ্গিনীর সাথে গনেশের এহেন মাখোমাখো ভঙ্গিমা আমার চোখে এর আগে কোথাও পড়ে নি।
হিন্দু সংস্কারে গণেশ সাত্ত্বিক ব্রহ্মচারী। তাই তাঁর আশপাশে নিবিড় নৈকট্যে কোনো যৌনতা উদ্রেককারী সঙ্গিনী থাকার কথা নয়। অন্য মতে তাঁর সৃজনীশক্তিই বুদ্ধি (intellect), সিদ্ধি (spiritual divinity) এবং রিদ্ধি (prosperity) নামক তিন সঙ্গিনীর মাধ্যমে প্রতীকী রূপে প্রতীয়মান। আবার যোগবলে অধীত গণেশের অষ্টগুণের সমাহার অষ্টসিদ্ধি হিসেবে বিবেচিত। সেটিও প্রতীকী রূপে অষ্ট সঙ্গিনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
তবে দুপাশে কিঞ্চিৎ দুরত্বে, মার্জিত ভঙ্গিতে দন্ডায়মান দুই সঙ্গিনীর (রিদ্ধি ও সিদ্ধি) মাঝে সিংহাসনে উপবিষ্ট রিদ্ধি-সিদ্ধি গনেশের প্রতিরূপই বেশি প্রচলিত। যেখানে তাদের গনেশের কোলে বসা অবস্থায় দেখা গেছে সেখানে মহাকায় গনেশের প্রেক্ষিতে তাদের দেখানো হয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে - যেন কণ্যাসম তারা - সেভাবেই যেন তাদেরকে গণেশ পিতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরে আছেন। তাঁরা যদি গনেশের সৃজনী শক্তির প্রতীকী প্রকাশ হন তাহলে তো তাঁরা গনেশের আত্মজা - সেখানে নৈকট্যেও যৌনাবেশ উদ্ভাসিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
এই প্রচলিত বিশ্বাসই রাজা রবি বর্মার রিদ্ধি-সিদ্ধি ও অষ্টসিদ্ধি গণেশ চিত্রণে প্রতিফলিত হয়েছে। সেই প্রচলিত ভাবের সাথে সুরয়ায়া গড়ির এক নম্বর মন্দিরে এক পূর্ণ যৌবনা সঙ্গিনীকে জড়িয়ে ধরা গনেশের এই ভঙ্গিমা তাই মেলানো গেল না। অভিনিবেশ সহকারে দেখলে ভারতের প্রাচীন মন্দির ভাস্কর্যে এহেন নানান বিচিত্র, সুন্দর, কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় চোখে পড়তে পারে। সুরয়ায়ার এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে এক অনন্য প্রাপ্তি হয়ে থাকবে।
গুটি গুটি ফিরে যাই আশ্রমে
মঠ প্রাঙ্গণের বাইরে এসে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা ভগ্নস্তুপে খানিক পায়চারি করি। সামান্য যে কয়েকজন দর্শক এসেছিল তারা সবাই চলে গেছে অনেক আগে। এখন এলাকাটা একদম নির্জন। খাড়া সিঁড়ি ধরে গড়ির প্রাচীরে চড়ে ওপর থেকে চারপাশে চেয়ে দেখি। প্রায় হাজার বছর আগে এই গড়ির পরিবেশ তখন আশ্রমিকদের উপস্থিতিতে কেমন প্রাণবন্ত ছিল তা এখন এই শীতের নির্জন বিকেলে মরা আলোয় অনুভব করা কঠিন। রামজানকী আশ্রম কাছেই তাই ফেরার তাড়া নেই। ফিরতেও ইচ্ছে করছে না।
গড়ির দুজন সিকিউরিটি গার্ডের সাথে মঠ চত্বরে অনেক গল্প হয়েছে। ওরা আসছে মেন গেট বন্ধ করতে। আমায় পাঁচিলের মাথায় চড়ে বসে থাকতে দেখে হেসে বলে, চলে আসুন স্যার, ছটায় গেট বন্ধ হবে। নেমে গেট পেরিয়ে হাঁটতে থাকি আশ্রমের দিকে। একপাল গরু মোষের দল গলায় বাঁধা ঘন্টায় টুংটাং আওয়াজ করে ঘরে ফিরছে। দু একটা বাছুর গোয়ালে ঢোকার আগে শৈশবের চাপল্যে দিনের শেষে খানিক লাফালাফি করে নিচ্ছে। বয়স্কদের চলার ছন্দে দীর্ঘ দোহনের, নিত্য জাবর কাটার ভাবলেশহীন শ্রান্তি। দাঁড়িয়ে যাই। এ দৃশ্য বহুবার দেখেও আশ মেটে না।
বিজয়ভারতী মহারাজ বাইরে পায়চারি করছিলেন। আমায় বলেন, আপনি মন্দিরের ভেতরেই শোবেন। বারান্দায় ঠান্ডা লাগবে। শর্মন বলে, চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি। উঁচু টিনের শেডের মধ্যে ছোট পাথরের মন্দির। তার চারপাশে অনেক জায়গা। জনা বিশেক লোক অনায়াসে সেখানে মাটিতে শুতে পারে। বড় বড় ড্রাম, লোহার ট্রাংকে জিনিসপত্র আছে। একটা ফ্রীজও রয়েছে দেখি। অনেক ওয়্যার পরানো দেড় ইঞ্চি মোটা ম্যাট, কম্বল এক পাশে পাট করে রাখা। শর্মন মন্দিরের পাশে দুটো ম্যাট পেতে দিল। খান তিনেক কম্বল দিয়ে বললো, রাতে ভালো ঠান্ডা পড়বে। স্যাক থেকে জিনিসপত্র বার করছি, শর্মন চলে গেল। একটু বাদে এলো এক গেলাস আদা দেওয়া চা নিয়ে। খুব দরকার ছিল। চায়ের গেলাস হাতে ওর সাথে পাশেই রান্নাঘরে যাই উনুনের পাশে বসে খোশগল্প করতে।
এক চিলতে চম্বলের স্বাদ
শীতালী সন্ধ্যায় চায়ে সুরুত সুরুত করে চুমুক দিতে দিতে বলি, আচ্ছা শর্মনভাই, তোমার জন্মস্থান তো মোরেনা। তার একটু দুরে ভিন্ড। ওসব জায়গা তো কিংম্বদন্তীর ভান্ডার। নির্জন, বিস্তীর্ন চম্বল ঘাঁটির গোলকধাঁধাময় কুখ্যাত বেহড়ে বাগী মান সিং, ফুলন দেবী, পান সিং, মোহর সিং, মালখান সিংরা তো ঘুরে বেড়াতো জীবন্ত রূপকথার চরিত্রের মতো। সিনেমাও হয়েছে এদের নিয়ে। সেই মোরেনার ছেলে হয়ে তুমি বাগী না হয়ে বিবাগী হয়ে গেলে?
চায়ের গেলাস হাতে দুলে দুলে খুব একচোট হাসে শর্মন। বলে হ্যাঁ, বাবুজী, ও এক জমানা থা যব ইয়ে কাহাবত হুয়া করতা থা কী চম্বল কা পানি যো পি লিয়া, বাগী হো যানা উসকা নসীবকা লকিড় বন গ্যায়া। কব, কিঁউ ঔর ক্যায়সে বনেগা ও তো স্রিফ মুদ্দত কী বাত হ্যায়। সে একটা সময় ছিল বটে। পুলিশ দল বেঁধেও বেহড়ে ঢুকতে ভয় পেতো। বেহদ উঁচু নীচু জমি। ঘোড়াও ঠিক মতো চলতে পারে না সেখানে। মাইলের পর মাইল চলো পয়দল। মন্দিরের জমি হাতিয়ে নেওয়া এক অত্যাচারী সরপঞ্চের জন্য মালখান সিং বাগী হয়ে যায়। সেই সরপঞ্চকে মারবার জন্য কুকুরের মতো তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল বলে গ্ৰাম ছেড়ে পালিয়ে পুলিশ পাহারায় বাস করতো সে।
তো একবার হয়েছে কী, মালখানের গিরোর (গ্যাংয়ের) কয়েকটি ছেলের কী দূর্মতি হোলো, সেই সরপঞ্চের এক মেয়েকে তারা জঙ্গলে ধরে এনে ছেড়ছাড় করেছিল। খবর পেয়ে মালখান ক্ষিপ্ত হয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দলের ছেলেগুলোকে বলে, মেয়েটির পা ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়ে তাকে পাহারা দিয়ে গ্ৰামে পৌঁছে দাও। তারপর ঘোষণা করে, ভবিষ্যতে দলের কেউ যদি কখোনো গ্ৰামের মেয়ে, বৌয়েদের সাথে এমন বত্তিমিজী করে তাহলে তার সাজা - মওত। বাগী মোহর সিংয়ের ক্ষেত্রেও একথা প্রচলিত ছিল।
খানিক চুপ করে যায় হাসিখুশি শর্মন। হয়তো অতীত বিলি কাটে মনে। একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে, তবে সেসব দিন আর নেই বাবুজী। মালখান সিং অর্জুন সিংয়ের কাছে, মোহর সিং জয়প্রকাশ নারায়নের কাছে আত্মসমর্পণ করে এখন ক্ষেতিবাড়ী নিয়ে থাকেন, লোকজনের উপকার করে বেড়ান। সবাই খুব মানে ওনাদের কারণ ওনারা নির্ভয় সিং গুজ্জরের মতো নীচ চরিত্রের ডাকাত ছিলেন না। ওনারা ছিলেন বাগী। শুনেছি ২০১৬তে নোটবন্দীর সময় মালখান সিংও সবার সাথে এটিএম লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলেছেন। কোনো বাড়তি সুবিধা নেন নি। তাই মালখান সিং, মোহর সিং, পান সিংয়ের মতো বাগীদের এখনও চম্বল ঘাটির মানুষ রবিনহুডের মতো সম্মান করে। একসময় ওনারা ছিলেন গরীব, অত্যাচারিতের শেষ ভরসা।
আবার খানিক চুপ করে থেকে শর্মন বলে, যদি কখনো ওদিকে যেতে চান তো আমায় বলবেন। বলি, কেন? ও বলে, বাবুজী আপনি হয়তো জানেন, সন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমে যেতে নেই। আমিও যাই না। কিন্তু বাড়ির লোকজন ও কিছু নিকট বন্ধুদের সাথে ফোনে যোগাযোগ আছে। যদি ওদিকে বেড়াতে যান তো কোনো বন্ধুকে বলবো, আপনাকে বেহড়ের কিছু এলাকা ঘুরিয়ে দেখাবে। সে এক অদ্ভুত জায়গা। যদিও এখন আর ডাকাতের উপদ্রব নেই তবু স্থানীয় সঙ্গী ছাড়া পরদেশী মানুষের ওখানে একা যাওয়া উচিত নয়। আর কিছু না হোক, পথ হারানোর ভয় আছে।
বলি, শর্মন, তুমি তো বারো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছো। আবার ওখানে গেলে কেন? ও বলে, বাবুজী, ঘর ছেড়েছি, জনমভূমিকে তো ত্যাগ করিনি। মাঝে কয়েকবার গেছি ওখানে। গেরুয়াধারীকে বাগীরা তো নয়ই, ছিঁচকে চোর ডাকাতও কিছু বলে না। অবশ্য তেমন কারুর সাথে আমার মোলাকাতও হয় নি। আমি এমনিই বেহড়ের এদিকে ওদিকে কিছু এলাকায় ঘুরেছি।
বলি, ১৯৯৮ সালের এক সকালে অফিসের কাজে গোয়ালিয়র থেকে রওনা হয়ে ঘুরপথে ভরতপুর, জয়পুর, আজমীর হয়ে প্রায় আটশো কিমি দুরে উদয়পুর পৌঁছেছিলাম কাকভোরে। সেবার হাইওয়ে ধরে গাড়িতে মোরেনা, ঢোলপুরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় দুপাশে উঁচু নীচু চম্বল ঘাঁটির উপস্থিতিতে দিনের বেলাতেও একটু ছমছমে লেগেছিল। তোমার কথা শুনে যেতেও ইচ্ছে করছে আবার শংকাও হচ্ছে - বুড়ো বয়েসে এসব এ্যাডভেঞ্চার করা কি ঠিক হবে?
চম্বল হবেখন, এখন সময় সন্ধ্যা আরতির
শর্মন বলে, ঠিক আছে, সে না হয় পরে ভেবে দেখবেন, এখন চলুন যাই মন্দিরে, সন্ধ্যা আরতির সময় হয়ে গেছে। আমাদের খোশগল্পের মধ্যেই এসে হাজির হয়েছিল দুটি বছর আট নয়ের ক্ষুদে - সতীশ ও প্রমোদ। শর্মন মন্দিরের মধ্যে পঞ্চপ্রদীপ দুলিয়ে, ঘন্টা নাড়িয়ে আরতি করছিল। সতীশ বাজাতে লাগল কাঁসর। প্রমোদ ওর ছোট্ট গাল দুটো কদবেলের মতো ফুলিয়ে সমানে বাজিয়ে গেল শাঁখ। প্রমোদ দু তিনবার শাঁখমুখেই গাল ফুলিয়ে পিছন ফিরে আমায় দেখল। খুব মিষ্টি লাগলো ভঙ্গিটা। বাহুল্যবর্জিত আরতি শেষ হয়ে গেল মিনিট দশেকে। জয়ভারতীজী ছিলেন না। বাইরে কোথাও গেছেন। সতীশ কাঁসর রাখে নির্দিষ্ট স্থানে। প্রমোদও শাঁখ ধুয়ে এনে রাখে। তারপর দুজনে অঞ্জলি পেতে মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
শর্মন ওদের হাতে ছোলাভাজা ও নকুলদানা দেয়। টিন খুলে দু মুঠো মুড়ি দুজনের পেটের কাছে সোয়েটারের কোঁচড়ে দেয়। আমি দুজনকে চকলেট দিই। ওরা গুটগুট করে চলে যায় অন্ধকার পথে। পাশেই কোথাও থাকে। শর্মন ওদের গমনপথের দিকে স্নেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, প্রসাদের লোভেই ওরা রোজ সন্ধ্যায় আরতির সময় আসে। আশ্রমের বয়স্ক মহারাজ রাশভারী, মিতবাক। মিশুকে শর্মনের কোনো সঙ্গী নেই। তাই হয়তো বালক দুটি এলে ওর ভালো লাগে। সংসারত্যাগী যুবক সন্ন্যাসীর এহেন বাৎসল্যবোধ দেখে অবাক লাগে। হয়তো নির্বান্ধব জীবনে সন্ন্যাসী হয়েও কখনো একাকীত্ববোধ ঘিরে ধরে ওকে। তাই আমায় পেয়ে নানা গল্প করছিল
ভালোই হোলো পেট পুজো
শর্মন বলে এবার চলুন আপনার সাথে গল্প করতে করতে রান্নাটা করে নি। আমরা আবার রান্নাঘরে এসে বসি। আটা মাখতে শুরু করে ও। বলি, আমি কিছু সাহায্য করতে পারি? ও বলে, না, না, আপনি মেহমান, আপনাকে কিছু করতে হবে না। সবজি করা আছে। গরম করে নিলেই হবে। কেবল আমাদের তিনজনের কয়েকটা রুটি করলেই হয়ে যাবে। হোটেল হলে অন্য কথা কিন্তু আশ্রমিক পরিবেশে হাত গুটিয়ে খেতে অস্বস্তি হয়। বলি, তাহলে চায়ের বাসনগুলো ধুয়ে ফেলি। ও বুঝতে পারে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। হেসে বলে, আচ্ছা, ধুয়ে ফেলুন তাহলে।
রান্নাঘরের কোনেই কলের নীচে ছোট্ট বাসন ধোয়ার জায়গা। গল্প করতে করতে গেলাস, সসপ্যান, ছাঁকনি ধুয়ে ফেলি। ওর আটা মাখাও শেষ। উনুনে ছাইচাপা আগুনে কাঠকুটো সাজিয়ে পাইপ দিয়ে কয়েকবার ফুঁ দিতে দাপিয়ে ওঠে আগুন। বেলন চাকিতে রুটি বেলার বালাই নেই। দুই তালুতে চাপড়ে, তাওয়ায় সেঁকে, আগুনে ফুলিয়ে তৈরি হয়ে গেল রুটি। চাষীর মতো শষ্য ফলানো সবার কম্মো নয় কিন্তু ওকে দেখে মনে হয় রান্না করতে জানা এক বিশেষ যোগ্যতা। আমি ওতে দড় নই। চা, ম্যাগী, খিচুড়ি, আলুভাজা, ওমলেট অবধি আমার দৌড়।
রুটি, সবজি, মুলোর স্যালাড, আচার সাজিয়ে শর্মন প্রথমে মহারাজকে দেয়। উনি ওনার ছোট্ট ঘরে দরজা বন্ধ করে আহার সারেন। মন্দিরের মাঝে ছোট ঘেরা জায়গায় বসে আমরা দুজনে খাই। দেশি ঘি মাখানো গরম রুটি, ধনেপাতা দিয়ে রাঁধা ঝোলঝোল আলুর তরকারি - ক্ষিদের মুখে লাগে অমৃত। খাওয়ার পর বাসনগুলো আমি মেজে দিই। ও বারণ করেছিল। আমি শুনিনি। রান্না যখন পারি না অন্ততঃ বাসন মেজে সেটা পুষিয়ে দিই।
হনুমানজীর ছত্রছায়ায় হ্যাট্রিক
বিগত তিনরাত ভালো ঘুম না হওয়ায় সেদিন নিস্তব্ধ রাতে জমাট ঘুম হোলো। সকালে শর্মন চা করে ডাকলো। জানতে চাইলো আজ কী প্রোগ্রাম। বলি, শিবপুরীতে থাকার ইচ্ছে নেই। ভাবছি ঘসারাইতে বাঁকড়ে হনুমান মন্দিরে থাকবো। শর্মন বলে, আপনি তো শান্ত জায়গা পছন্দ করেন, তাহলে আজ ভাদিয়াকুন্ডে হনুমানমন্দিরে গিয়ে থাকুন। ওখানেও এমন নিরিবিলি। কেউ বিশেষ যায় না। এখানে আসার আগে আমি ওখানে রঘুবীর পুরী মহারাজের আশ্রমে বছর খানেক ছিলাম। অনেকদিন আগের কথা তবু অসুবিধা হলে ফোন করবেন। আমি মহারাজকে অনুরোধ করলে হয়ে যাবে। শর্মনের পরামর্শের ওপর আস্থা রাখতে ভরসা হয়।
এবারে ভ্রমণের শুরুতে ক্রমান্বয়ে তিন রাত হনুমানজীর ছত্রছায়ায় রাত্রিবাসের হ্যাট্রিক হবে। আমার এমন ভ্রমণে কোথায়, কবে, কতোদিন থাকবো - সেই অনুযায়ী ট্রেন, গাড়ি, হোটেল বুক করে হয় না। এ হচ্ছে মুক্তকচ্ছ ভ্রমণ। তাই একটা আউটলাইন ঠিক করে বেরোই তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী গন্তব্য, রাত্রিবাসের স্থান এবং সময়কাল বদলায়। প্রতিবার গন্তব্যে পৌঁছে কোনো গতি না হওয়া অবধি থাকে মৃদু অস্বস্তিবোধ। ব্যবস্থা হলে পাই স্বস্তির আনন্দ। এমন ভ্রমণের এটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কখনো অসুবিধাও সইতে হতে পারে। তেমন সম্ভাবনা মনে রাখা এবং বাস্তবে হলে মেনে নেওয়ার মানসিকতা না থাকলে এভাবে বেরোনো উচিত নয়।
শর্মনের একটা ছবি তুলে, ওর হাতে দুশোটা টাকা দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সকালেও মহারাজ আশ্রমে নেই। হাইওয়েতে গিয়ে প্রগত সিংয়ের ধাবায় সুস্বাদু আলুর পরোটা, চা খাই। কাল রাতের নিটোল ঘুম, স্বাদু প্রাতরাশে তরতাজা লাগে মন। শরীর প্রস্তুত দুটো বোঁচকা নিয়ে হাঁটতে। চলো এবার ভাদিয়াকুন্ড।
চিত্রাবলী:করেরা - সুরয়ায়ার পথে মাড়িখেড়া বাঁধের ব্যাকওয়াটারের ওপর ১৪০০ মিটার সেতু (হলুদ তীর) 1- শিলচর পোরবন্দর ৩৫০৭ কিমি দীর্ঘ ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর 2- প্রগত সিংয়ের ধাবা 3- সুরয়ায়া গড়ি 4- রামজানকী মন্দির 3- গড়ি 3A- গড়ির প্রবেশপথ 3B- মঠের সুরক্ষা প্রাচীর 3C- গড়ির সুরক্ষা প্রাচীর 4- রামজানকী মন্দির গড়ির প্রধান প্রবেশ পথ গড়ির মধ্যে কিছু বিক্ষিপ্ত নির্মাণের অবশিষ্ট বাইরে থেকে মঠে প্রবেশপথ 1- ভিতর থেকে মঠের প্রবেশপথ 2- পাথরের স্ল্যাবের ছাদ 3- আবাসিক এলাকা আবাসিক এলাকা - মোটা দেওয়ালে বাতায়ন কুয়োতে এমন স্ফটিক স্বচ্ছ জল - আগে কখনো দেখিনি লেখায় বর্ণিত 1 নং মন্দির লেখায় বর্ণিত 2 ও 3 নং মন্দির 1 নং মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ এবং ললাটবিম্বের ওপর ভাস্কর্য উপরের ছবিতে সবুজ বক্সের মধ্যে অংশটির ব্লো-আপ - রোমান্টিক মুডে গনেশজী1নং মন্দিরে অন্তরাল অংশে ছাদে কারুকার্য - পূর্ণপ্রস্ফূটিত পদ্ম শিব কর্তৃক অন্ধকাসুর বধ রামজানকী মন্দিরের ঢাকা অলিন্দে বিজয়ভারতী মহারাজের আসন ও মন্দিরে প্রবেশপথ (হলুদ তীর) মন্দিরের (নীল তীর) পাশে মেঝেতে ডাবল ম্যাট পেতে শেডের মধ্যে দিব্য শোয়ার জায়গা পেলাম মন্দিরের পাশে আমার বডি ফেলার জায়গা। সামনে মহারাজের ঘর (লাল তীর) মন্দিরের মধ্যে আরতি করছে শর্মন - বাইরে দুই ক্ষুদে সেবক - শাঁখে প্রমোদ - কাঁসরে সতীশ সন্ধ্যা আরতির দুই নিত্য সেবক প্রমোদের ফাটা প্যান্টুল দিয়ে পোনু দৃশ্যমান - সতীশের প্যান্টুল সিলিপ করে নেমে যাচ্ছে - কিন্তু ভক্তিতে খাদ নেই চম্বল ত্যাগী মিশুকে বৈরাগী
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।