সেবার জাগ্রেব এলাম আমেরিকান বাণিজ্য বিভাগের ল্যাজ ধরে। সিটি ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে কাজ করার এই মহা সুবিধে ছিল। যেহেতু আমরা লন্ডনে অধিষ্ঠিত সেই সুবাদে ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রেডের ইউরোপিয়ান ট্রিপে আমন্ত্রিত হয়েছি। কখনও বা সিটি ব্যাঙ্কের পিতৃপরিচয়ের তকমা লাগিয়ে আমেরিকান ট্রেড গ্রুপের সঙ্গ দিয়েছি—কেবল কোটের লেপেলে পতাকার রঙ বদলিয়ে যায়! খরচা অবশ্যই সিটি ব্যাঙ্কের, জামাই আদরের একটা সীমা বেঁধে দেন সরকার!
আমেরিকান দলের সঙ্গে ভ্রমণ বেশ আরামের। বিমানবন্দরে পাসপোর্ট-ভিসা দেখানোর কোনো প্রশ্ন নেই, ট্যাক্সি খুঁজতে হয় না। প্লেন মাটিতে নামার আগেই একটি মিনি বাস (বালটিকের দেশগুলিতে – এস্টোনিয়া লাটভিয়া লিথুয়ানিয়া – সর্বত্র কালো মার্সিডিজ) সেখানে হাজির। প্লেন নামলে আমরা বসে থাকি—আম জনতা বেরিয়ে যায়, দূতাবাসের এক কর্তাব্যক্তি প্লেনে ওঠেন। তিনি পাসপোর্ট দেখতে চান না, কেবল নাম ডেকে তালিকা মিলিয়ে নেন। লন্ডন ছাড়ার পরে হাওয়া পথে কেউ অদৃশ্য হয়ে গেছেন কিনা সেটি নিরীক্ষণ করেন। পূর্বনির্ধারিত হোটেলের দোরগোড়ায় অভ্যর্থনা কমিটি ঘর বণ্টনের তালিকা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। মিনিবাস বা মার্সিডিজ সেখানে নামিয়ে দিলেই হাতে পাওয়া যায় ঘরের চাবি-কার্ড। রাতের ডেরা সুনিশ্চিত। সফরের পর্যটন সূচি স্থির করেন স্থানীয় মার্কিন দূতাবাসের বাণিজ্যিক বিভাগ—আপন কোটের বুক পকেটে আমেরিকান পতাকা সেঁটে সেখানে আমাদের হাজিরা দিতে হয়। বাকি সময়টা আমাদের ফ্রি টাইম। ইচ্ছেমত যে কোনো ব্যাঙ্ক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারি, সেটা স্থির করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। এঁরা সিআইএ-সুলভ কৌতূহলে জানতে চান না ঠিক কোথায়, কার সঙ্গে দেখা করছি (ইসরায়েলে সেটি চাওয়া হয়); অথবা কে জানে—আমাদের হাঁড়ির খবর এমনিতেই হয়তো রাখেন। তাই জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেন না। বিদেশি ব্যাঙ্ক থেকে যারা এসেছি তাদের সাক্ষাৎকারের একটি অতিরিক্ত পর্যায় থাকে—যেমন, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অধিকর্তা, অর্থ দপ্তরের প্রধান, ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক এবং বৃহৎ ব্যাঙ্কের উচ্চ পর্যায়ের লোক। বিদেশি ব্যাঙ্ক যদি ক্রোয়েশিয়াতে ব্যবসা করতে চায় তাহলে অর্থনৈতিক আধিকারিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা একান্ত আবশ্যিক। সেখানে দূতাবাসের প্রতিনিধিকে সচরাচর মুখ খুলতে দেখিনি; তাঁরা পরিচয় করিয়ে দেন এবং শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কোথায় কথা বলতে হয় আর কোথায় নীরবতা স্বর্ণময় – সেটি এই কূটনীতিকরা খুব ভালো বোঝেন। মিটিঙের আগে বা পরে তাঁরা আমাদের বলেন—আমাদের যে কোনো সাহায্য করতে তাঁরা প্রস্তুত। আপনারা এগিয়ে যান, আমরা আপনাদের অনেকটা পেছনে আছি!
মিটিঙে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি একত্র বসেন—পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও খেয়োখেয়ি সাময়িকভাবে শিকেয় তুলে। সিটি ব্যাঙ্কের ঝাণ্ডা ওড়ানোর সুযোগ কম। নিজের ব্যাঙ্কের বিষয়ে দু-লাইন এবং ক্রোয়েশিয়াতে কী মহান ব্রতে অবতীর্ণ হতে চাই—সেটি ব্যাখ্যান করে আমরা অপর পক্ষের প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকি। খেইটা ধরতে পারলেই শুরু করব—আপনাদের সেবার জন্য সিটি ব্যাঙ্ক সতত উন্মুখ, একটা চান্স দিয়েই দেখুন না সার! মনে যত ইচ্ছে থাকুক না কেন, এই আখড়ায় কিছুতেই বলা যাবে না চেজ বা ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকাকে বিজনেস দেবেন না। তারা আমেরিকান হতে পারে, তবে অতি অপদার্থ। এই কড়াকড়িটুকু থাকে বলে, প্রতিটি ব্যাঙ্ক বাজারের ফেরিওলার মত চিৎকার চেঁচামেচি করে আপন দ্রব্যগুণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার কোনো পথ পায় না।
সরকারি খাতে ভ্রমণের আরেক ফায়দা আছে – দূতাবাস আমাদের বাস, ইংরিজিভাষী গাইড সহ নিয়ম করে শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি প্রদক্ষিণ করাবেন। নিজের ব্যাঙ্কের কাজে যখন কোথাও গেছি সেটা ঠিক সম্ভব হত না।
ভেনিসের শক্তিশালী ডিউককে দাবার লড়াইয়ে হারিয়ে রাজা দ্রঝিস্লাভ স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাজ্যের সীমানাকে পোক্ত করেছিলেন। সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইতালিয়ানরা কখনও জলপথে, কখনও স্থলপথে উপদ্রব করে। অন্যদিকে তুরস্কের অটোমান শক্তি ক্রমশ দক্ষিণ থেকে উত্তরে ধেয়ে আসে। গ্রিস, আলবানিয়া, কসভো, বুলগারিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, রোমানিয়া অটোমান সুলতানদের পদানত হতে দেখে আতঙ্কিত ক্রোয়েশিয়া হাঙ্গেরির সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করে, তার কেতাবি নাম পারসোনাল ইউনিয়ন – ক্রোয়েশিয়া থাকবে তার এলাকার মধ্যে স্বাধীন কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করে খাজনা জমা দেবে হাঙ্গেরির রাজাকে। বিনিময়ে শত্রুর আক্রমণ থেকে ক্রোয়েশিয়াকে রক্ষা করবে হাঙ্গেরি, এই আজকের ন্যাটোর মতন প্রতিরক্ষা আউটসোর্স করে দেওয়া। মনে রাখা ভালো—হাঙ্গেরিয়ানদের পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্ট্রিয়ান সম্রাট ফ্রান্তস য়োসেফ তাদের সঙ্গেও ওই পারসোনাল ইউনিয়ন স্থাপন করেন – যা থেকে জন্ম নিয়েছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য (১৮৬৭)। কালক্রমে দেখা গেল, অস্ট্রিয়ানরাই ক্রোয়েশিয়াতে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। জার্মান কার্যত রাজভাষা হয়ে দাঁড়াল। হাবসবুর্গ রাজারা ক্রোয়েশিয়ার প্রায় সব শহর গ্রামগঞ্জের একটি জার্মান নাম দিয়েছিলেন। ইংরেজ আমাদের দেশে বারানসীকে বেনারেস, মুম্বাইকে বম্বে, কলকাতাকে ক্যালকাটা বলেছে, ঢাকা বা কানপুরকে দিয়েছে অদ্ভুত বানান। কিন্তু এ হেন নব নামাবলি সংখ্যায় কম। মাত্র শ-তিনেক বছরের শাসনে অস্ট্রিয়ানরা আজকের ইউক্রেন থেকে কৃষ্ণ সাগর অবধি বিশাল ভূখণ্ডে জার্মান নামের ছাপ মেরেছে - ইউক্রেনের লভিভকে বলেছে লেমবের্গ, রোমানিয়ার ব্রাসভকে ক্রোনস্টাড, পোল্যান্ডের ভ্রতস্লাভকে ব্রেসলাউ। আজ অবশ্য সে সব নাম বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে, তবু জাগ্রেবে এখনও কোনো রাস্তার জার্মান নাম চোখে পড়ে।
কিছু ব্যতিক্রম দেখেছি। যেমন আমার পরিচিত ভিয়েনার ব্যাংকার বন্ধু, এক সময়ের সহকর্মী, মারটিন চুরদা। বোর্ড মিটিং হচ্ছে ক্লাগেনফুরটের অফিসে - কী কথায় মারটিন বললে, “তুমি প্রেসবুরগ কবে যাচ্ছ?” সেটা স্লোভাকিয়ার রাজধানীর পুরোনো নাম, এখন তা ব্রাতিস্লাভা। কিন্তু মারটিন সে সব মানে না! তার কাছে স্লোভেনিয়ার রাজধানী লাইবাখ (লুবলিয়ানা) ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী আগরাম (জাগ্রেব)! আমরা হয়তো যেমন এখনও ডালহাউসি বা ক্যানিং স্ট্রিট বলে ফেলি।
জাগ্রেব আপনাদের ভ্রমণের বালতি তালিকায় পড়বে না। এলে অনন্য বুদাপেস্তের স্রষ্টা অস্ট্রিয়ানদের তৈরি শেষ বড়ো শহরটি দেখতেন। ১৮৮০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে জাগ্রেবের বাড়ি ঘর মাটিতে মিশে যায়। কথাটা শুনলে ক্রোয়েশিয়ানরা খুশি হন না, কিন্তু আজকের জাগ্রেব একান্তভাবেই অস্ট্রিয়ান স্থাপত্যের নমুনা। গ্রিড স্টাইলে রাস্তা আর আয়তাকারের বাড়ি, যার ভেতরে প্রকাণ্ড উঠোন আর বাগান। শহরের দুটি ভাগ – গরনি গ্রাদ বা উঁচা নগর এবং ডনই গ্রাদ বা নিচা নগর। গ্রাদ আর আমাদের গড় একই অর্থ বহন করে। অটোমানদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে শহরকে বাঁচাতে চারটি সুরক্ষিত দ্বার ছিল। তার একটি—প্রস্তর তোরণ—এখনো টিকে আছে। দেখলে অনুমান করতে অসুবিধে হয় না একদা এ শহর কীরূপ সুরক্ষিত ছিল। সন্ত মার্কের গিরজে এবং ক্যাথিড্রাল বেশ কয়েকবার আগুন ও ভূকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তী কালে দুর্গের দেয়াল থেকে কয়েক ধাপ নিচে যে লোকালয় তৈরি হল সেটাই আজকের নিচু শহর। এখান থেকে সামান্য হাঁটলেই সরু গলির বাজার, প্রধান স্টেশন, জাতীয় থিয়েটার, টিটোর স্মারক—একেবারে ছকে ফেলা।
ইউরোপের কোনো পুরোনো শহরে গেছেন শুনলেই দেশের গুণীজন সমাবেশে তুখোড় ভূপর্যটক আপনাকে প্রশ্ন করবেন, “আচ্ছা, ওই শহরে মূল গিরজের ডান পাশের রোমান আর্চটায় কনসটানটিনের সিলটা লক্ষ করেছেন?” সে কোন সীল, কেন, কোথায় আছে বা ছিল আপনি জানেন না, জানবার ইচ্ছে নেই আর জানলেও তিন মাইল হেঁটে সেটা দেখতে যাননি। যেই বললেন, ‘দেখি নি তো’ অমনি সেই গুণী নিতান্ত দুঃখী ভাব করে বলবেন, ‘আহা, জানলেন না কী যে হারালেন! সম্রাট যখন মৃত্যুশয্যায়...’ আপনি সে সম্রাটের রোগ ব্যারামের কথা জানতে চান না। ভাবেন—কেন মরতে বললাম ওই শহরে গিয়েছিলাম।
জাগ্রেবের মস্ত সুবিধে — এ শহরের যাবতীয় ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে সীমায়িত। বিশেষ পরিশ্রম না করেই উঁচু শহরের সেন্ট মার্ক চার্চ, ক্রোয়েশিয়ান পার্লামেন্ট, ক্যাথিড্রাল, প্রস্তর দুয়ার ইত্যাদি দেখে নিয়ে একবার যাবেন লত্রশচাক টাওয়ারে (কুলা লত্রশচাক )। ঠিক বেলা ১২টার সময় সেখানে তোপ (শব্দটি তুর্কী) দাগা হয়। পাঁচশ বছর ধরে এই উঁচু টাওয়ারে বসে প্রহরী লক্ষ রাখতেন—শহরের ত্রিসীমানায় কোনো সৈন্য সমাবেশ হয়েছে বা হচ্ছে কিনা। শত্রু বাহিনীর সন্ধান পাওয়া মাত্র কামান দেগে শহরবাসীকে সাবধান করা তার কাজ। বর্তমানে শত্রু আকাশ পথে হানা দিতে পারে। অটোমান নয়, সারবিয়ান বোমারু বিমান হানা দিয়েছে এই ক-বছর আগে। তখন সেই দুপুরবেলার বা বিকেলের গোলাবর্ষণ কোনো কাজে লাগেনি। ক্রোয়েশিয়ান সময় বারোটা বা কলকাতার ঠিক বিকেল সাড়ে চারটেয় জাগ্রেবে শত্রু হানা শুরু হবে বলে নয়, স্মৃতি এবং কামানটিকে চাঙ্গা রাখার জন্য রোজ একবার তোপ দাগা হয়। একজন ব্যক্তি মিনারে ওঠেন। একটি গোলা বর্ষণ করে বাড়ি ফিরে যান। এই তাঁর একমাত্র কাজ, একটি মাত্র সুখ। তোপ পড়লে ঘড়ির সময়টা মিলিয়ে নেবার রীতি চালু আছে। সে পালা সাঙ্গ হলে পাঁচ মিনিট হেঁটে নিচু শহরের ইয়েলাচিচ চত্বরে মালা কাভানা (ক্রোয়াট ভাষায় কাভা মানে কফি) নামক একটি অত্যুৎকৃষ্ট কফি হাউসে অলস আরামে বসে জানলার বাইরের ব্যস্ত পৃথিবীকে করুণার চোখে দেখবেন। তারপর নগর পরিক্রমা করতে পনেরো মিনিট।
হৃদয় খুঁড়ে
ইউরোপে পৌঁছেই তাবৎ ভ্রমণ পুস্তিকা তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে ডজন ডজন মিউজিয়াম প্রদক্ষিণ করেছি, সেটাই নিয়ম, টুরিস্টকে সেটা করতে হয় বলে। আজ এই সাড়ে চার দশক বাদে হয়তো মনে আছে ল্যুভরে ডেভিডের আবক্ষ মূর্তি, মোনালিসার ছবি, বার্লিনের পারগামন মিউজিয়ামে ব্যাবিলনের গেট, উফিজিতে ভেনাসের জন্ম, সিস্তিন চ্যাপেলের সিলিঙে আদমের সৃষ্টি। বেশিরভাগ ভুলে গেছি। আজকাল মিউজিয়াম এড়িয়ে চলি! জার্মান ভাষায় একটি বিশেষ শব্দ দিয়ে আমার মতন অসংস্কৃতিমনা মানুষকে চিহ্নিত করা হয় – কুলটুরবানাউসে (নিম্ন রুচি সম্পন্ন, ফিলিস্তিন)।
জাগ্রেবের এমন একটি মিউজিয়াম আছে যেখানে আপনি অবশ্য যাবেন—তার প্রধান কারণ এটি মোটে ঐতিহাসিক নয়! এখানে দু-হাজার বছরের পুরোনো কোনো বেড়ালের আবক্ষ মূর্তি আপনার আগমনের প্রতীক্ষায় হাঁ করে বসে নেই। উঁচু শহরে সন্ত মার্কের চত্বর থেকে বেরিয়ে বাঁ হাতে হাঁটলে দু-নম্বর চিরিলোমেতোদস্কা পথে পাবেন একটি অসাধারণ সংগ্রহশালা, যার তুল্য কিছু আমি অন্তত কোথাও দেখিনি। এর নাম মিউজিয়াম অফ ব্রোকেন রিলেশনশিপস: বাংলায় সম্ভবত বলতে পারি ভালবাসার ভগ্ন স্মৃতি।
জাগ্রেবের দুই শিল্পী, অলিঙ্কা ও দ্রাঝান একদিন অনুভব করলেন তাঁদের কণ্ঠে জড়ানো গভীর ভালবাসার মন্দার মালিকা ম্লান হয়ে এসেছে – এবার কি খেলা ভাঙার খেলা? ভালবাসার স্বর্গ হতে বিদায় নেওয়ার কাল আসন্ন হলে দ্রাঝান বলেন, “আচ্ছা, আমাদের এই চারটে বছরের প্রেমের, এক অন্তহীন খুশির দিনগুলির স্মৃতি কি হারিয়ে যাবে? তুমি আমি একসঙ্গে হয়তো কিছু কিনেছি, ছবি এঁকেছি তোমার। ভোলার পালা শুরু হলে এই ছবি, ওই পেয়ালা তারা কি চলে যাবে জঞ্জালের স্তূপে?” অলিঙ্কা বললেন, “কুঞ্জ ছায়ার স্বপ্ন মধুর মোহের স্মৃতি আমাদের মনেই থেকে যাবে, কিন্তু তোমার আঁকা ছবি আমার ফ্ল্যাটের দেওয়ালে সাজিয়ে রাখতে পারি! তোমার নতুন প্রেম যদি ইয়েলাচিচ চত্বরে আমাদের একসঙ্গে কেনা দাড়ি ওলা পুতুলটা দূর করে দিতে চায় তার একটা আস্তানার সন্ধান করা যেতে পারে”। এই ভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছে এক আশ্চর্য সংগ্রহ – ভালবাসার কাল শেষ। কিন্তু সেই দিনগুলির চিহ্ন থেকে যায়। পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি!
মনে পড়ে জতুগৃহ ছবির শেষ দৃশ্য—বিচ্ছেদের অনেক দিন বাদে মাধুরী (অরুন্ধতী দেবী) আর শতদলের (উত্তম কুমার) এক ট্রেন স্টেশনে হঠাৎ দেখা, ট্রেন বদল করবেন। একসঙ্গে বসে চা খেলেন। মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওষুধটা এখনও মনে করে খাও তো? দুজনের ট্রেন এলো, চলে গেলো দু-দিকে। রেস্তোরাঁর ছেলেটি কাপ ধুয়ে বেসিনের ওপরের আংটায় রাখতে গিয়ে পাশাপাশি রাখার জায়গা নেই দেখে দুটো কাপকে সাজালো খানিকটা দূরত্বে। জীবনে যে প্রেম নীরবে এসেছিল নীরবে তার সব কিছুই কি হারিয়েছি? কোন স্মৃতি বয়ে আজও ভেসে আসে উদাসী হাওয়া—কোনদিন একসঙ্গে বহুদূর হেঁটে উচ শহরের পিয়াত্রভস্কায় কেনা একটা অম্বরের মালা, একদিন বাখারাখে নদীর ধারে বসে একটা বিয়ার ম্যাটের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে কেউ লিখেছিল, ‘তোমার, তোমায় অনন্ত কাল ভালবেসে (দাইনে, দিখ ইমার উনড এভিগ লিবেনডে) আঙ্গেলিকা’
এই আভাস গুলি পড়বে মালায় গাঁথা, কালকে দিনের তরে
তোমার অলস দ্বিপ্রহরে
দুনিয়ার নানান দেশের মানুষজন পাঠিয়েছেন হারানো পুরাতন প্রেমের স্মারক, কিছু বেদনার কিছু মধুর। একটা চেয়ার, হাই হিল জুতো, টোস্টার, দোলনা, বুদ্ধ মূর্তি, বেল্ট, মেয়েদের পোশাকের বন্ধনী। একটি মেয়ে তার হারানো প্রেমের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছিল একটা গোটা আয়না জুড়ে। তারপর সেটিকে ভেঙেচুরে একটি কাঁচের বাকসোয় পুরে পাঠায় এই সংগ্রহ শালায়। নব প্রেমজালে পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেলেও তার স্মৃতি রয়ে যায় নানান পার্থিব আকৃতিতে। এই সংগ্রহ শালা তাদের স্থান দিয়েছে অনেক আদরে।
নব প্রেমজালে ঢাকা পড়ে যায় অতীতের আবেশ। স্মৃতি কি শুধুই বেদনার? রাইনের সেই সন্ধ্যে বুকের ভেতর থেকে রয়ে যাবে – তার সঙ্গে না হয় রইলো এক টুকরো কাগজ।
তবুও
ভালবাসার ভগ্ন স্মৃতির সংগ্রহশালা থেকে একটু মন খারাপ নিয়ে বেরিয়ে বাঁ দিকে হাঁটলে পাবেন প্রেমের এক নবীন প্রকাশ। উঁচু শহর থেকে নিচে নামার সেতুর রেলিঙে বাঁধা অজস্র তালা। কে বা কারা সেই তালাগুলির ভেতরে নিজেদের ভালবাসাকে আবদ্ধ করে চাবি দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তাদের দুজনের এখন স্বর্গ খেলনা গড়ার সময়, চাবি দূরে যাক। কোনো তালার ওপরে দুই প্রেমিক প্রেমিকার নাম স্বাক্ষরিত, কোনো তালায় ছবি আঁকা। নানান সাইজের, নানান রঙের তালা। প্রেমিক প্রেমিকা ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। তালা তার প্রতীক। সে বাঁধন থেকে তাঁরা মুক্তি চান না। চাবির কি প্রয়োজন? এই হাজার হাজার তালার পটভূমিকায় দেখবেন হ্যারমান বোলের তৈরি ক্যাথিড্রালের চুড়ো।
ঈশ্বরের আশীর্বাদ?
চাবি বন্ধ করে ভালবাসার সেতু নির্মাণের কপিরাইট জাগ্রেব দাবি করতে পারে না। প্যারিসের পঁ দা’রতে (শিল্পের সেতু) সেটি দীর্ঘদিনের রীতি। অজস্র বন্ধ তালার ভারে সেতুর রেলিং ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিছু তালা খুলে ফেলে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। কলকাতার একটা মিস্ত্রীকে ডাকলে তার অনেক উপকার হত – চাবি বানিয়ে সেগুলোকে খুলে নিয়ে বিনি পয়সায় কত তালার মালিক হয়ে যেত সে। আমস্টারডামের স্কিনি ব্রিজ বা মাগারে ব্রুঘে আরেকটি প্রেম সেতু। সেখানে তরুণ তরুণীরা দুনিয়াকে তাদের প্রেমের পয়গাম দিয়ে চাবিটি ফেলে দেয় ক্যানালের জলে। দশ হাজার বাই সাইকেল প্রতি বছর আমস্টারডামের খালের জলে বিসর্জিত হয় - এমনিতেই কলুষিত সে জলপথ; তার ওপরে চাবি ! বুদাপেস্টে বেশ গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রেমের বাঁধনের প্রতীক তালাগুলিকে শহরময় দেখা যায় — যেখানে দেখিবে সেতু সেখানেই বাঁধো তালা! প্রেমকে তালা বন্ধ করে রাখার ব্যারাম ক্রমশ ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে–সার্বিয়াতে নোভি সাদের কেল্লায় এবং স্লোভেনিয়াতে লুবলিয়ানার ব্রিজেও তাদের আবির্ভাব চোখে পড়েছে। এমনকি সারের ষ্টেইন্সে শহরে।
জাগ্রেব কোথাও আছে, থেকে যায়, তার রাজার দাবা খেলার ছক ছড়িয়ে, গলায় রুমাল বেঁধে, চক মেলানো বাড়ি আর বাগান নিয়ে। সরু রাস্তায় ট্রাম চলে টুং টুং শব্দ করে। পাথরের দুয়োর পেরিয়ে উঁচু শহর থেকে নিচু শহরের পথে মানুষের হাজার বছরের অবিরাম আসা যাওয়া।
কোনো গোপন গভীরে জেগে থাকে আরও দুই জাগ্রেব।
এক জাগ্রেব ভালবাসাকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আরেক জাগ্রেব প্রেমের ভেঙ্গে যাওয়া খেলাঘরের কণাটুকু রাখে সযত্নে সঞ্চয় করে।
তোমার মহা বিশ্বে প্রভু হারায় নাকো কিছু।