এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  ইতিহাস  শনিবারবেলা

  • পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি – ক্রোয়েশিয়া ৫

    হীরেন সিংহরায়
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১৬ জুলাই ২০২৩ | ১২১৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • অস্ট্রিয়ান নগর প্লানিং


    জাগ্রেব


    সেবার জাগ্রেব এলাম আমেরিকান বাণিজ্য বিভাগের ল্যাজ ধরে। সিটি ব্যাঙ্কের লন্ডন অফিসে কাজ করার এই মহা সুবিধে ছিল। যেহেতু আমরা লন্ডনে অধিষ্ঠিত সেই সুবাদে ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রেডের ইউরোপিয়ান ট্রিপে আমন্ত্রিত হয়েছি। কখনও বা সিটি ব্যাঙ্কের পিতৃপরিচয়ের তকমা লাগিয়ে আমেরিকান ট্রেড গ্রুপের সঙ্গ দিয়েছি—কেবল কোটের লেপেলে পতাকার রঙ বদলিয়ে যায়! খরচা অবশ্যই সিটি ব্যাঙ্কের, জামাই আদরের একটা সীমা বেঁধে দেন সরকার!

    আমেরিকান দলের সঙ্গে ভ্রমণ বেশ আরামের। বিমানবন্দরে পাসপোর্ট-ভিসা দেখানোর কোনো প্রশ্ন নেই, ট্যাক্সি খুঁজতে হয় না। প্লেন মাটিতে নামার আগেই একটি মিনি বাস (বালটিকের দেশগুলিতে – এস্টোনিয়া লাটভিয়া লিথুয়ানিয়া – সর্বত্র কালো মার্সিডিজ) সেখানে হাজির। প্লেন নামলে আমরা বসে থাকি—আম জনতা বেরিয়ে যায়, দূতাবাসের এক কর্তাব্যক্তি প্লেনে ওঠেন। তিনি পাসপোর্ট দেখতে চান না, কেবল নাম ডেকে তালিকা মিলিয়ে নেন। লন্ডন ছাড়ার পরে হাওয়া পথে কেউ অদৃশ্য হয়ে গেছেন কিনা সেটি নিরীক্ষণ করেন। পূর্বনির্ধারিত হোটেলের দোরগোড়ায় অভ্যর্থনা কমিটি ঘর বণ্টনের তালিকা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত। মিনিবাস বা মার্সিডিজ সেখানে নামিয়ে দিলেই হাতে পাওয়া যায় ঘরের চাবি-কার্ড। রাতের ডেরা সুনিশ্চিত। সফরের পর্যটন সূচি স্থির করেন স্থানীয় মার্কিন দূতাবাসের বাণিজ্যিক বিভাগ—আপন কোটের বুক পকেটে আমেরিকান পতাকা সেঁটে সেখানে আমাদের হাজিরা দিতে হয়। বাকি সময়টা আমাদের ফ্রি টাইম। ইচ্ছেমত যে কোনো ব্যাঙ্ক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারি, সেটা স্থির করার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। এঁরা সিআইএ-সুলভ কৌতূহলে জানতে চান না ঠিক কোথায়, কার সঙ্গে দেখা করছি (ইসরায়েলে সেটি চাওয়া হয়); অথবা কে জানে—আমাদের হাঁড়ির খবর এমনিতেই হয়তো রাখেন। তাই জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেন না। বিদেশি ব্যাঙ্ক থেকে যারা এসেছি তাদের সাক্ষাৎকারের একটি অতিরিক্ত পর্যায় থাকে—যেমন, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অধিকর্তা, অর্থ দপ্তরের প্রধান, ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রক এবং বৃহৎ ব্যাঙ্কের উচ্চ পর্যায়ের লোক। বিদেশি ব্যাঙ্ক যদি ক্রোয়েশিয়াতে ব্যবসা করতে চায় তাহলে অর্থনৈতিক আধিকারিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা একান্ত আবশ্যিক। সেখানে দূতাবাসের প্রতিনিধিকে সচরাচর মুখ খুলতে দেখিনি; তাঁরা পরিচয় করিয়ে দেন এবং শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। কোথায় কথা বলতে হয় আর কোথায় নীরবতা স্বর্ণময় – সেটি এই কূটনীতিকরা খুব ভালো বোঝেন। মিটিঙের আগে বা পরে তাঁরা আমাদের বলেন—আমাদের যে কোনো সাহায্য করতে তাঁরা প্রস্তুত। আপনারা এগিয়ে যান, আমরা আপনাদের অনেকটা পেছনে আছি!

    মিটিঙে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি একত্র বসেন—পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ও খেয়োখেয়ি সাময়িকভাবে শিকেয় তুলে। সিটি ব্যাঙ্কের ঝাণ্ডা ওড়ানোর সুযোগ কম। নিজের ব্যাঙ্কের বিষয়ে দু-লাইন এবং ক্রোয়েশিয়াতে কী মহান ব্রতে অবতীর্ণ হতে চাই—সেটি ব্যাখ্যান করে আমরা অপর পক্ষের প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকি। খেইটা ধরতে পারলেই শুরু করব—আপনাদের সেবার জন্য সিটি ব্যাঙ্ক সতত উন্মুখ, একটা চান্স দিয়েই দেখুন না সার! মনে যত ইচ্ছে থাকুক না কেন, এই আখড়ায় কিছুতেই বলা যাবে না চেজ বা ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকাকে বিজনেস দেবেন না। তারা আমেরিকান হতে পারে, তবে অতি অপদার্থ। এই কড়াকড়িটুকু থাকে বলে, প্রতিটি ব্যাঙ্ক বাজারের ফেরিওলার মত চিৎকার চেঁচামেচি করে আপন দ্রব্যগুণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার কোনো পথ পায় না।

    সরকারি খাতে ভ্রমণের আরেক ফায়দা আছে – দূতাবাস আমাদের বাস, ইংরিজিভাষী গাইড সহ নিয়ম করে শহরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি প্রদক্ষিণ করাবেন। নিজের ব্যাঙ্কের কাজে যখন কোথাও গেছি সেটা ঠিক সম্ভব হত না।

    ভেনিসের শক্তিশালী ডিউককে দাবার লড়াইয়ে হারিয়ে রাজা দ্রঝিস্লাভ স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাজ্যের সীমানাকে পোক্ত করেছিলেন। সুখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ইতালিয়ানরা কখনও জলপথে, কখনও স্থলপথে উপদ্রব করে। অন্যদিকে তুরস্কের অটোমান শক্তি ক্রমশ দক্ষিণ থেকে উত্তরে ধেয়ে আসে। গ্রিস, আলবানিয়া, কসভো, বুলগারিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, রোমানিয়া অটোমান সুলতানদের পদানত হতে দেখে আতঙ্কিত ক্রোয়েশিয়া হাঙ্গেরির সঙ্গে যে চুক্তি স্বাক্ষর করে, তার কেতাবি নাম পারসোনাল ইউনিয়ন – ক্রোয়েশিয়া থাকবে তার এলাকার মধ্যে স্বাধীন কিন্তু বশ্যতা স্বীকার করে খাজনা জমা দেবে হাঙ্গেরির রাজাকে। বিনিময়ে শত্রুর আক্রমণ থেকে ক্রোয়েশিয়াকে রক্ষা করবে হাঙ্গেরি, এই আজকের ন্যাটোর মতন প্রতিরক্ষা আউটসোর্স করে দেওয়া। মনে রাখা ভালো—হাঙ্গেরিয়ানদের পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্ট্রিয়ান সম্রাট ফ্রান্তস য়োসেফ তাদের সঙ্গেও ওই পারসোনাল ইউনিয়ন স্থাপন করেন – যা থেকে জন্ম নিয়েছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য (১৮৬৭)। কালক্রমে দেখা গেল, অস্ট্রিয়ানরাই ক্রোয়েশিয়াতে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। জার্মান কার্যত রাজভাষা হয়ে দাঁড়াল। হাবসবুর্গ রাজারা ক্রোয়েশিয়ার প্রায় সব শহর গ্রামগঞ্জের একটি জার্মান নাম দিয়েছিলেন। ইংরেজ আমাদের দেশে বারানসীকে বেনারেস, মুম্বাইকে বম্বে, কলকাতাকে ক্যালকাটা বলেছে, ঢাকা বা কানপুরকে দিয়েছে অদ্ভুত বানান। কিন্তু এ হেন নব নামাবলি সংখ্যায় কম। মাত্র শ-তিনেক বছরের শাসনে অস্ট্রিয়ানরা আজকের ইউক্রেন থেকে কৃষ্ণ সাগর অবধি বিশাল ভূখণ্ডে জার্মান নামের ছাপ মেরেছে - ইউক্রেনের লভিভকে বলেছে লেমবের্গ, রোমানিয়ার ব্রাসভকে ক্রোনস্টাড, পোল্যান্ডের ভ্রতস্লাভকে ব্রেসলাউ। আজ অবশ্য সে সব নাম বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে, তবু জাগ্রেবে এখনও কোনো রাস্তার জার্মান নাম চোখে পড়ে।



    Herren Gasse ভদ্রলোকের পথ


    কিছু ব্যতিক্রম দেখেছি। যেমন আমার পরিচিত ভিয়েনার ব্যাংকার বন্ধু, এক সময়ের সহকর্মী, মারটিন চুরদা। বোর্ড মিটিং হচ্ছে ক্লাগেনফুরটের অফিসে - কী কথায় মারটিন বললে, “তুমি প্রেসবুরগ কবে যাচ্ছ?” সেটা স্লোভাকিয়ার রাজধানীর পুরোনো নাম, এখন তা ব্রাতিস্লাভা। কিন্তু মারটিন সে সব মানে না! তার কাছে স্লোভেনিয়ার রাজধানী লাইবাখ (লুবলিয়ানা) ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী আগরাম (জাগ্রেব)! আমরা হয়তো যেমন এখনও ডালহাউসি বা ক্যানিং স্ট্রিট বলে ফেলি।

    জাগ্রেব আপনাদের ভ্রমণের বালতি তালিকায় পড়বে না। এলে অনন্য বুদাপেস্তের স্রষ্টা অস্ট্রিয়ানদের তৈরি শেষ বড়ো শহরটি দেখতেন। ১৮৮০ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে জাগ্রেবের বাড়ি ঘর মাটিতে মিশে যায়। কথাটা শুনলে ক্রোয়েশিয়ানরা খুশি হন না, কিন্তু আজকের জাগ্রেব একান্তভাবেই অস্ট্রিয়ান স্থাপত্যের নমুনা। গ্রিড স্টাইলে রাস্তা আর আয়তাকারের বাড়ি, যার ভেতরে প্রকাণ্ড উঠোন আর বাগান। শহরের দুটি ভাগ – গরনি গ্রাদ বা উঁচা নগর এবং ডনই গ্রাদ বা নিচা নগর। গ্রাদ আর আমাদের গড় একই অর্থ বহন করে। অটোমানদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে শহরকে বাঁচাতে চারটি সুরক্ষিত দ্বার ছিল। তার একটি—প্রস্তর তোরণ—এখনো টিকে আছে। দেখলে অনুমান করতে অসুবিধে হয় না একদা এ শহর কীরূপ সুরক্ষিত ছিল। সন্ত মার্কের গিরজে এবং ক্যাথিড্রাল বেশ কয়েকবার আগুন ও ভূকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরবর্তী কালে দুর্গের দেয়াল থেকে কয়েক ধাপ নিচে যে লোকালয় তৈরি হল সেটাই আজকের নিচু শহর। এখান থেকে সামান্য হাঁটলেই সরু গলির বাজার, প্রধান স্টেশন, জাতীয় থিয়েটার, টিটোর স্মারক—একেবারে ছকে ফেলা।

    ইউরোপের কোনো পুরোনো শহরে গেছেন শুনলেই দেশের গুণীজন সমাবেশে তুখোড় ভূপর্যটক আপনাকে প্রশ্ন করবেন, “আচ্ছা, ওই শহরে মূল গিরজের ডান পাশের রোমান আর্চটায় কনসটানটিনের সিলটা লক্ষ করেছেন?” সে কোন সীল, কেন, কোথায় আছে বা ছিল আপনি জানেন না, জানবার ইচ্ছে নেই আর জানলেও তিন মাইল হেঁটে সেটা দেখতে যাননি। যেই বললেন, ‘দেখি নি তো’ অমনি সেই গুণী নিতান্ত দুঃখী ভাব করে বলবেন, ‘আহা, জানলেন না কী যে হারালেন! সম্রাট যখন মৃত্যুশয্যায়...’ আপনি সে সম্রাটের রোগ ব্যারামের কথা জানতে চান না। ভাবেন—কেন মরতে বললাম ওই শহরে গিয়েছিলাম।



    লত্রশচাক টাওয়ার

    মালা কাভানা -এমনি করেই যায় যদি দিন


    জাগ্রেবের মস্ত সুবিধে — এ শহরের যাবতীয় ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য এক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে সীমায়িত। বিশেষ পরিশ্রম না করেই উঁচু শহরের সেন্ট মার্ক চার্চ, ক্রোয়েশিয়ান পার্লামেন্ট, ক্যাথিড্রাল, প্রস্তর দুয়ার ইত্যাদি দেখে নিয়ে একবার যাবেন লত্রশচাক টাওয়ারে (কুলা লত্রশচাক )। ঠিক বেলা ১২টার সময় সেখানে তোপ (শব্দটি তুর্কী) দাগা হয়। পাঁচশ বছর ধরে এই উঁচু টাওয়ারে বসে প্রহরী লক্ষ রাখতেন—শহরের ত্রিসীমানায় কোনো সৈন্য সমাবেশ হয়েছে বা হচ্ছে কিনা। শত্রু বাহিনীর সন্ধান পাওয়া মাত্র কামান দেগে শহরবাসীকে সাবধান করা তার কাজ। বর্তমানে শত্রু আকাশ পথে হানা দিতে পারে। অটোমান নয়, সারবিয়ান বোমারু বিমান হানা দিয়েছে এই ক-বছর আগে। তখন সেই দুপুরবেলার বা বিকেলের গোলাবর্ষণ কোনো কাজে লাগেনি। ক্রোয়েশিয়ান সময় বারোটা বা কলকাতার ঠিক বিকেল সাড়ে চারটেয় জাগ্রেবে শত্রু হানা শুরু হবে বলে নয়, স্মৃতি এবং কামানটিকে চাঙ্গা রাখার জন্য রোজ একবার তোপ দাগা হয়। একজন ব্যক্তি মিনারে ওঠেন। একটি গোলা বর্ষণ করে বাড়ি ফিরে যান। এই তাঁর একমাত্র কাজ, একটি মাত্র সুখ। তোপ পড়লে ঘড়ির সময়টা মিলিয়ে নেবার রীতি চালু আছে। সে পালা সাঙ্গ হলে পাঁচ মিনিট হেঁটে নিচু শহরের ইয়েলাচিচ চত্বরে মালা কাভানা (ক্রোয়াট ভাষায় কাভা মানে কফি) নামক একটি অত্যুৎকৃষ্ট কফি হাউসে অলস আরামে বসে জানলার বাইরের ব্যস্ত পৃথিবীকে করুণার চোখে দেখবেন। তারপর নগর পরিক্রমা করতে পনেরো মিনিট।

    হৃদয় খুঁড়ে

    ইউরোপে পৌঁছেই তাবৎ ভ্রমণ পুস্তিকা তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে ডজন ডজন মিউজিয়াম প্রদক্ষিণ করেছি, সেটাই নিয়ম, টুরিস্টকে সেটা করতে হয় বলে। আজ এই সাড়ে চার দশক বাদে হয়তো মনে আছে ল্যুভরে ডেভিডের আবক্ষ মূর্তি, মোনালিসার ছবি, বার্লিনের পারগামন মিউজিয়ামে ব্যাবিলনের গেট, উফিজিতে ভেনাসের জন্ম, সিস্তিন চ্যাপেলের সিলিঙে আদমের সৃষ্টি। বেশিরভাগ ভুলে গেছি। আজকাল মিউজিয়াম এড়িয়ে চলি! জার্মান ভাষায় একটি বিশেষ শব্দ দিয়ে আমার মতন অসংস্কৃতিমনা মানুষকে চিহ্নিত করা হয় – কুলটুরবানাউসে (নিম্ন রুচি সম্পন্ন, ফিলিস্তিন)।

    জাগ্রেবের এমন একটি মিউজিয়াম আছে যেখানে আপনি অবশ্য যাবেন—তার প্রধান কারণ এটি মোটে ঐতিহাসিক নয়! এখানে দু-হাজার বছরের পুরোনো কোনো বেড়ালের আবক্ষ মূর্তি আপনার আগমনের প্রতীক্ষায় হাঁ করে বসে নেই। উঁচু শহরে সন্ত মার্কের চত্বর থেকে বেরিয়ে বাঁ হাতে হাঁটলে দু-নম্বর চিরিলোমেতোদস্কা পথে পাবেন একটি অসাধারণ সংগ্রহশালা, যার তুল্য কিছু আমি অন্তত কোথাও দেখিনি। এর নাম মিউজিয়াম অফ ব্রোকেন রিলেশনশিপস: বাংলায় সম্ভবত বলতে পারি ভালবাসার ভগ্ন স্মৃতি।

    জাগ্রেবের দুই শিল্পী, অলিঙ্কা ও দ্রাঝান একদিন অনুভব করলেন তাঁদের কণ্ঠে জড়ানো গভীর ভালবাসার মন্দার মালিকা ম্লান হয়ে এসেছে – এবার কি খেলা ভাঙার খেলা? ভালবাসার স্বর্গ হতে বিদায় নেওয়ার কাল আসন্ন হলে দ্রাঝান বলেন, “আচ্ছা, আমাদের এই চারটে বছরের প্রেমের, এক অন্তহীন খুশির দিনগুলির স্মৃতি কি হারিয়ে যাবে? তুমি আমি একসঙ্গে হয়তো কিছু কিনেছি, ছবি এঁকেছি তোমার। ভোলার পালা শুরু হলে এই ছবি, ওই পেয়ালা তারা কি চলে যাবে জঞ্জালের স্তূপে?” অলিঙ্কা বললেন, “কুঞ্জ ছায়ার স্বপ্ন মধুর মোহের স্মৃতি আমাদের মনেই থেকে যাবে, কিন্তু তোমার আঁকা ছবি আমার ফ্ল্যাটের দেওয়ালে সাজিয়ে রাখতে পারি! তোমার নতুন প্রেম যদি ইয়েলাচিচ চত্বরে আমাদের একসঙ্গে কেনা দাড়ি ওলা পুতুলটা দূর করে দিতে চায় তার একটা আস্তানার সন্ধান করা যেতে পারে”। এই ভাবনা থেকে জন্ম নিয়েছে এক আশ্চর্য সংগ্রহ – ভালবাসার কাল শেষ। কিন্তু সেই দিনগুলির চিহ্ন থেকে যায়। পুরোনো ভাঙা দিনের ঢেলা, তাই দিয়ে ঘর গড়ি!

    মনে পড়ে জতুগৃহ ছবির শেষ দৃশ্য—বিচ্ছেদের অনেক দিন বাদে মাধুরী (অরুন্ধতী দেবী) আর শতদলের (উত্তম কুমার) এক ট্রেন স্টেশনে হঠাৎ দেখা, ট্রেন বদল করবেন। একসঙ্গে বসে চা খেলেন। মাধুরী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওষুধটা এখনও মনে করে খাও তো? দুজনের ট্রেন এলো, চলে গেলো দু-দিকে। রেস্তোরাঁর ছেলেটি কাপ ধুয়ে বেসিনের ওপরের আংটায় রাখতে গিয়ে পাশাপাশি রাখার জায়গা নেই দেখে দুটো কাপকে সাজালো খানিকটা দূরত্বে। জীবনে যে প্রেম নীরবে এসেছিল নীরবে তার সব কিছুই কি হারিয়েছি? কোন স্মৃতি বয়ে আজও ভেসে আসে উদাসী হাওয়া—কোনদিন একসঙ্গে বহুদূর হেঁটে উচ শহরের পিয়াত্রভস্কায় কেনা একটা অম্বরের মালা, একদিন বাখারাখে নদীর ধারে বসে একটা বিয়ার ম্যাটের ওপরে গোটা গোটা অক্ষরে কেউ লিখেছিল, ‘তোমার, তোমায় অনন্ত কাল ভালবেসে (দাইনে, দিখ ইমার উনড এভিগ লিবেনডে) আঙ্গেলিকা’

    এই আভাস গুলি পড়বে মালায় গাঁথা, কালকে দিনের তরে
    তোমার অলস দ্বিপ্রহরে

    দুনিয়ার নানান দেশের মানুষজন পাঠিয়েছেন হারানো পুরাতন প্রেমের স্মারক, কিছু বেদনার কিছু মধুর। একটা চেয়ার, হাই হিল জুতো, টোস্টার, দোলনা, বুদ্ধ মূর্তি, বেল্ট, মেয়েদের পোশাকের বন্ধনী। একটি মেয়ে তার হারানো প্রেমের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছিল একটা গোটা আয়না জুড়ে। তারপর সেটিকে ভেঙেচুরে একটি কাঁচের বাকসোয় পুরে পাঠায় এই সংগ্রহ শালায়। নব প্রেমজালে পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে গেলেও তার স্মৃতি রয়ে যায় নানান পার্থিব আকৃতিতে। এই সংগ্রহ শালা তাদের স্থান দিয়েছে অনেক আদরে।



    ভালবাসার ভগ্ন স্মৃতি সংগ্রহ


    নব প্রেমজালে ঢাকা পড়ে যায় অতীতের আবেশ। স্মৃতি কি শুধুই বেদনার? রাইনের সেই সন্ধ্যে বুকের ভেতর থেকে রয়ে যাবে – তার সঙ্গে না হয় রইলো এক টুকরো কাগজ।

    তবুও



    প্রেমের বাঁধনে


    ভালবাসার ভগ্ন স্মৃতির সংগ্রহশালা থেকে একটু মন খারাপ নিয়ে বেরিয়ে বাঁ দিকে হাঁটলে পাবেন প্রেমের এক নবীন প্রকাশ। উঁচু শহর থেকে নিচে নামার সেতুর রেলিঙে বাঁধা অজস্র তালা। কে বা কারা সেই তালাগুলির ভেতরে নিজেদের ভালবাসাকে আবদ্ধ করে চাবি দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তাদের দুজনের এখন স্বর্গ খেলনা গড়ার সময়, চাবি দূরে যাক। কোনো তালার ওপরে দুই প্রেমিক প্রেমিকার নাম স্বাক্ষরিত, কোনো তালায় ছবি আঁকা। নানান সাইজের, নানান রঙের তালা। প্রেমিক প্রেমিকা ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ। তালা তার প্রতীক। সে বাঁধন থেকে তাঁরা মুক্তি চান না। চাবির কি প্রয়োজন? এই হাজার হাজার তালার পটভূমিকায় দেখবেন হ্যারমান বোলের তৈরি ক্যাথিড্রালের চুড়ো।

    ঈশ্বরের আশীর্বাদ?

    চাবি বন্ধ করে ভালবাসার সেতু নির্মাণের কপিরাইট জাগ্রেব দাবি করতে পারে না। প্যারিসের পঁ দা’রতে (শিল্পের সেতু) সেটি দীর্ঘদিনের রীতি। অজস্র বন্ধ তালার ভারে সেতুর রেলিং ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। কিছু তালা খুলে ফেলে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। কলকাতার একটা মিস্ত্রীকে ডাকলে তার অনেক উপকার হত – চাবি বানিয়ে সেগুলোকে খুলে নিয়ে বিনি পয়সায় কত তালার মালিক হয়ে যেত সে। আমস্টারডামের স্কিনি ব্রিজ বা মাগারে ব্রুঘে আরেকটি প্রেম সেতু। সেখানে তরুণ তরুণীরা দুনিয়াকে তাদের প্রেমের পয়গাম দিয়ে চাবিটি ফেলে দেয় ক্যানালের জলে। দশ হাজার বাই সাইকেল প্রতি বছর আমস্টারডামের খালের জলে বিসর্জিত হয় - এমনিতেই কলুষিত সে জলপথ; তার ওপরে চাবি ! বুদাপেস্টে বেশ গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রেমের বাঁধনের প্রতীক তালাগুলিকে শহরময় দেখা যায় — যেখানে দেখিবে সেতু সেখানেই বাঁধো তালা! প্রেমকে তালা বন্ধ করে রাখার ব্যারাম ক্রমশ ছোঁয়াচে হয়ে উঠেছে–সার্বিয়াতে নোভি সাদের কেল্লায় এবং স্লোভেনিয়াতে লুবলিয়ানার ব্রিজেও তাদের আবির্ভাব চোখে পড়েছে। এমনকি সারের ষ্টেইন্সে শহরে।

    জাগ্রেব কোথাও আছে, থেকে যায়, তার রাজার দাবা খেলার ছক ছড়িয়ে, গলায় রুমাল বেঁধে, চক মেলানো বাড়ি আর বাগান নিয়ে। সরু রাস্তায় ট্রাম চলে টুং টুং শব্দ করে। পাথরের দুয়োর পেরিয়ে উঁচু শহর থেকে নিচু শহরের পথে মানুষের হাজার বছরের অবিরাম আসা যাওয়া।

    কোনো গোপন গভীরে জেগে থাকে আরও দুই জাগ্রেব।

    এক জাগ্রেব ভালবাসাকে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আরেক জাগ্রেব প্রেমের ভেঙ্গে যাওয়া খেলাঘরের কণাটুকু রাখে সযত্নে সঞ্চয় করে।

    তোমার মহা বিশ্বে প্রভু হারায় নাকো কিছু।


    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৬ জুলাই ২০২৩ | ১২১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৬ জুলাই ২০২৩ ১১:৪৭521302
  • ভাঙা প্রেমের জাদুঘরটার কথা আগে শুনেছিলাম, আপনার জবানিতে আরো মায়াময় হয়ে ধরা দিল। পূর্ব ইউরোপের প্রত্যেকটা জায়গা সত্যি যেন জীবন্ত ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে। খুব ভালো লাগছে ক্রোয়েশিয়া পর্ব।
  • Sumit Roy | ১৬ জুলাই ২০২৩ ১৩:৩৮521308
  • আপনার লেখা অনেক আগে একবার পড়েছিলাম। আজ সময় করে এসে অনেক দিন পর পড়ে খুব ভাল লাগল। যেভাবে বর্ণনা দিলেন তাও অনবদ্য। তবে ইতিহাসের ক্ষেত্রে কিছু জিনিস নিয়ে না বললে হয়তো এই পাঠকের হৃদয়ের খচখচানি দূর হবেনা, যদিও তা এত সুন্দর ভ্রমণকাহিনীর নিরিখে বেশ অপ্রাসংগিকই...

    ক্রোয়েশিয়ার রাজা দ্রুজস্লাভের দাবা ম্যাচের দ্বারা নিজের সীমানাকে পোক্ত করার ব্যাপারটি সত্যিকারের ইতিহাসের চেয়ে লোককাহিনীই হয়ে থাকবে। সত্যি বলতে, এটা নিয়ে ঐতিহাসিক এভিডেন্স পাওয়া যায়নি। গল্পটি অনুসারে, দশম শতাব্দীর শেষের দিকে, ক্রোয়েশিয়ার রাজা দ্রুজস্লাভ ভেনিসিয়ানদের সাথে যুদ্ধের সময় বন্দী হয়েছিলেন। ভেনিসের ডোজ দ্বিতীয় পিটার ওরসেওলো তাকে তার স্বাধীনতার জন্য দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ করেন। দ্রুজস্লাভ জিতলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে, তবে হারলে ভেনিস ক্রোয়েশিয়া লাভ করবে। দ্রুজস্লাভ জিতলেন ও ভেনিসের হাত থেকে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতাকে রক্ষা করলেন। গল্পটি ইন্টারেস্টিং কিন্তু এর সাপোর্টে হিস্টোরিক্যাল এভিডেন্স নেই। দাবা খেলে সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্যও নয়। বরং যেভাবে কোন রাজা নিজের অঞ্চলের স্বাধীনতা রক্ষা করেন, সেভাবেই তিনি করে থাকবেন। উল্লেখ্য, দ্রুজস্লাভের রাজত্ব ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল, কারণ মধ্যযুগীয় ক্রোয়েশিয়া রাজ্য তার শাসনের অধীনেই তার সর্বোচ্চ আঞ্চলিক সীমায় পৌঁছেছিল। তাই ভেনিসের ডোজ হয়তো দাবার বোর্ডে নয়, যুদ্ধের বোর্ডেই তার কাছে পরাজিত হয়, বা অন্তত শান্তিস্থাপন করে ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে সীমানা মেনে নিতে বাধ্য হয়।

    আর সব শেষে ভেনিসে কোন ডিউক ছিল না, বা ভেনিস ডাচি অফ মিলান, ডাচি অফ বার্গান্ডি প্রভৃতির মতো ডাচি ছিলোনা। ভেনিস ছিল একটি রিপাবলিক, যাকে রিপাবলিক অফ ভেনিস বলা হতো, আর এখানে শাসনকর্তা অভিজাতদের দ্বারা তার ইলেকশনে তার সারাজীবনের জন্য নির্বাচিত হতো, যাকে বলা হতো ডোজ, অন্যদিকে ডিউকরা পৈতৃক অথরিটি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়। আর ভেনিস ছিল স্বাধীন রিপাবলিক, ডাচিগুলো খুব কমই স্বাধীন থাকে।

    আর একটা জিনিস নিয়ে কিছু বলার আছে - "মনে রাখা ভালো—হাঙ্গেরিয়ানদের পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাঁধানোর উপদ্রব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অস্ট্রিয়ান সম্রাট ফ্রান্তস য়োসেফ তাদের সঙ্গেও ওই পারসোনাল ইউনিয়ন স্থাপন করেন – যা থেকে জন্ম নিয়েছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য (১৮৬৭)।" এই তাদের সঙ্গের বদলে হাঙ্গেরির সঙ্গে লিখলে ভালো হতো, অনেকে মনে করতে পারে ফ্রান্তস য়োসেফ হয়তো ক্রিয়েশিয়ার সাথেই পার্সোনাল ইউনিয়ন স্থাপন করল! তবে, আমার মতে, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির ব্যাপারটাকে ক্রোয়েশিয়া-হাঙ্গেরির সম্পর্কের মতো পার্সোনাল ইউনিয়ন টাইপ বললে হয়তো ক্রোয়েশিয়ানদেরকে অপমান করা হয়। কেননা ক্রোয়েশিয়ার পার্সোনাল ইউনিয়নের বেলায় ক্রোয়াটদের নিজস্ব রাজা ছিল, নিজস্ব মন্ত্রী ছিল, মানে অটোনোমি অনেক বেশি ছিল। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সামাজ্যের বেলায় কিন্তু হাঙ্গেরীয় ও অস্ট্রিয়ানদের রাজা ছিল একজনই, সাথে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা যেমন ফরেইন এফেয়ার্স, ডিফেন্স ও ফাইন্যান্স মিনিস্টারও ছিল একজনই। কাজেই হাঙ্গেরির অটোনোমি ছিল অনেক কম। তাই ক্রোয়েশিয়ার সেই অবস্থাকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সামাজ্যের হাঙ্গেরির অবস্থার সাথে তুলনা করা যায়না। আর হাঙ্গেরির অটোনোমি অনেক কম থাকাটাই ক্রোয়াটদের ওপর জার্মান ভাষার আধিপত্যেরও একটি কারণ ছিল।

    ১৮৬৭ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য গঠিত হলে জার্মান ভাষা হয়ে ওঠে ক্রোয়েশিয়ার কিছু অঞ্চল সহ গোটা সাম্রাজ্যের অনেক অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রশাসন এবং শিক্ষার জন্য লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। এই গোটা সাম্রাজ্যে বিভিন্ন এথনিক গোষ্ঠী ছিল, কিন্তু জার্মান ভাষা হয়ে ওঠে এদের সাধারণ ভাষা। এভাবে অ-জার্মান ভাষী অঞ্চলে জার্মান চাপিয়ে দেওয়াটাই পরে উত্তেজনার সৃষ্টি করে ও উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অবদান রাখে। ক্রোয়েশিয়ায় জার্মান ভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ক্রোয়েশিয়ান ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচারের জন্যও একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। আপনার বন্ধু মারটিন চুরদা যে প্রেসবুরগ, আগরাম এর মতো শব্দ ব্যবহার করছেন সেটা সেই জাতীয়তাবাদী চেতনারই অংশ হয়ে থাকতে পারে। তবে একটা বিষয় বলা দরকার। ক্রোয়েশিয়ার সব জায়গায় জার্মান ভাষার আধিপত্য ছিলনা। যেমন ক্রোয়েশিয়া-স্লাভোনিয়া অঞ্চলে ছিল হাঙ্গেরীয় ভাষার আধিপত্য।​​​​​​​
  • হীরেন সিংহরায় | ১৬ জুলাই ২০২৩ ১৬:৫৫521322
  • শ্রী সুমিত রায়

    দ্রুঝিস্লাভের দাবা জিতে রাজ্য রক্ষার গল্পটা হয়তো গল্পই – অকাট্য প্রমাণ নিয়ে তর্ক আছে সেটা নিয়ে, মানি । তর্ক থেকে যাবে।  কিন্তু ক্রোয়েশিয়া সেটাকে মেনে নিয়ে সর্বত্র দাবার ছক ছড়িয়ে রেখেছে ।  এটা নিয়ে কোন তর্ক নেই । আমি সেই কাহিনি বলেছি! পুরু আলেকসান্দারকে কি সত্যি বলেছিলেন তিনি রাজার কাছে রাজার মতন ব্যবহার চান ? গপ্পটা চালু আছে দু হাজার বছর যাবত !

    ভেনিস রিপাবলিক , কিন্তু  ডিউক ছিল , নির্বাচিত । ডুকাল পিরিয়ডে বিংশ ডিউক পিয়েতোর ওরসেওলো - ( ৯২৮-৯৮৭) পদে ছিলেন ৯৭৬- ৯৭৮ । ইউরোপের ইতিহাসে সকল ডিউক সমান শক্তিশালী ছিলেন না -এই ধরুন ডাচি অফ ওয়ারশ বা মিলান বা লুক্সেমবুরগ।

    অস্ট্রো- হাঙ্গেরিয়ান রাজত্ব ( ডুয়াল মনারকি ) পারসোনাল ইউনিয়নের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় , ক্রমশ অস্ট্রিয়ানরা বড়ো দাদার রোলটি নেয় । যেমন প্রতিরক্ষা , অর্থ ব্যবস্থা ভিয়েনার হাতে ছিল । বুদাপেস্তে হাঙ্গেরিয়ান ভাষা সভ্য সমাজে প্রায় অচল। এমনকি সৈন্য বাহিনীর অর্ডার দেওয়া হতো জার্মানে। ক্রোয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও অনেকটা একই রকম । আমার বাক্যটি যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে ভাবি নি । নিজস্ব মন্ত্রী হাঙ্গেরিরও ছিল , যেমন ক্রোয়েশিয়ার – কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা ছিল। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো দ্রুঝিস্লাভের পরেই ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড়ো হিরো ইয়েলাচিচ যিনি হাঙ্গেরিয়ানদের পেটানোর জন্য খ্যাত । হাঙ্গেরিয়ানরা এই অঞ্চলে কতোটা অপ্রিয় ছিল তার ব্যাখ্যা করার আড্ডা এটা নয় তবে একশো বছর বাদেও আমার নিতান্ত অফিসের কাজে তার প্রকাশ দেখেছি।  পরের পর্বে তার কথা বলব।

    ক্রোয়েশিয়ার সম্পত্তি দখল করার জন্য বহু বছর যাবত নানান রাজা উদব্যস্ত ছিলেন- এমনকি মুসোলিনি আনতে পাভেলিচের সঙ্গে একটি ডিল করে ক্রোয়েশিয়ার অনেক অংশ দখল করেন, সাময়িক ভাবে । আরেক উদাহরণ রিয়েকা ।

    ইউক্রেন থেকে রোমানিয়া স্লোভেনিয়া ক্রোয়েশিয়াতে জার্মান ভাষার ভূমিকার ইতিহাস নিয়ে একটা কাজ করছি- আপাতত বলা যাক ভাষাটা ঠিক “ চাপিয়ে “ দেওয়া হয়তো হয় নি ( প্রাশিয়ান রাজা স্কুলে পোলিশ পড়ানো বন্ধ করেন কিন্তু অস্ট্রিয়ানরা সেটি করেন নি অথচ এই নোভি সাদে আশি বছর আগেও হাঙ্গেরিয়ান চাপানো হয়েছিল। জার্মান রাজ ভাষা , শিখলে কাজ কর্ম জোটে এই যেমন আমাদের ইংরেজি না জানলে অন্ন জোটে না এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জার্মান ভাষা ভাষী বহু মানুষ আস্তানা গাড়েন , কিন্তু সেটা শহরে বেশি – প্রকৃষ্ট উদাহরণ স্লোভেনিয়া আমরা লাইবাখ ( লুবলিয়ানা ) মারবুরগ ( মারিবর ) জানি কিন্তু গ্রামের কদাচ জার্মান নাম দেখি । উত্তরে যদি এস্টোনিয়া দেখেন, ১৯২০ অবধি কাজের ভাষা জার্মান , রাজ ভাষা রাশিয়ান !  অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয় নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে আমার আগ্রহ অসম্ভব বেশি এ বিষয়ে। হাঙ্গেরিয়ান নয়, জার্মান ও ইতালিয়ান আজও চালু ক্রোয়েশিয়াতে ! আমার পরের পর্বে আবার আসবো – ডুবরোভনিক একটা দারুণ উদাহরণ ।

    মারটিন অস্ট্রিয়ান।  সে প্রেসবুরগ লাইবাখ বলে তার  অস্ট্রিয়ান জাতীয়তাবোধ থেকে – পিতামহের রাজত্ব ছিল সেটা ভোলা শক্ত ইংরেজকে তো এখনও কলকাতা বলতে শুনি নি !
     
  • Sumit Roy | ১৬ জুলাই ২০২৩ ১৭:৪১521327
  • স্পষ্টীকরণের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। পরের এপিসোড ও জার্মান ভাষা নিয়ে কাজটির জন্য অপেক্ষা করব। এর মধ্যে এই সিরিজের আগের লেখাগুলোও পড়ব। তবে সিরিজের পুরোনো এপিসোডগুলোতে কমেন্ট করে মাঝেমধ্যে বিরক্ত করতে পারি। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ... :)
  • হীরেন সিংহরায় | ১৭ জুলাই ২০২৩ ১৮:২১521363
  • শ্রী সুমিত রায়

    পড়বেন , অবশ্যই কমেন্ট করবেন নইলে মনে হবে দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলছি ।

    বিসমার্কের সাবধানবাণীর পড়ে প্রায় দেড়শ বছর কেটে গেলো, দুটো মহাযুদ্ধ হলো, ইউগোস্লাভিয়াতে গৃহ যুদ্ধ হলো কিন্তু বলকানের বিষয়ে বাকি ইউরোপ এখনও সচেতন নয় । ফুটবলে ক্রোয়েশিয়া,  টেনিসে সার্বিয়া – এই অবধি ।

    একদা খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত দেশ থেকে দরিদ্র জার্মান চাষি মজুর জীবিকার সন্ধানে পুবের দিকে গেছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে মুখের ভাষা।  রাশিয়ান জারিনা একাতেরিনা যে জার্মানদের তাঁর দেশে আমন্ত্রণ করেছিলেন তাদের আমরা জানি ভোলগা জার্মান নামে।  স্লাভিক দেশগুলিতে জার্মান ভাষা কেবল হাবসবুরগ সম্রাটরা চাপিয়ে দেন নি।  আজকের রোমানিয়ান রাষ্ট্রপতি ক্লাউস ইওহানেস বাড়িতে জার্মান বলেন- পাঁচ পুরুষে জার্মান তিনি।   দ্রাং নাখ অষ্টেন ( পুবের পানে ধাও ) এই স্লোগান হিটলারের সৃষ্টি নয় , গত শতাব্দীর গোড়া থেকেই চালু ছিল আর বিভিন্ন সময়ে ছিন্নমূল হয়েছেন তাঁরা ।  এটাই আমার আরেক বইয়ের বিষয়।  পাশাপাশি কাজ করছি-  তবে এই আলোচনা ভাগ করে নিতে খুব রাজি ।

    আমাদের বাড়িতে ইউক্রেনের মানুষজন এলে আমিও বলে ফেলি লেমবেরগ ( লভিভ ) ! 
     
  • তপতী মুখার্জি | 2a00:23c7:ea82:dc01:f4fa:d900:9737:***:*** | ২০ জুলাই ২০২৩ ১৪:৩১521464
  • পূর্ব ইওরোপের ডায়ারী পড়ে মুগ্ধ হলাম। লেখকের আরো লেখা পড়তে আগ্রহী ।
  • হীরেন সিংহরায় | ২০ জুলাই ২০২৩ ১৬:৪০521467
  • আপনাদের ভালো লাগাটাই আমার  পাথেয় । পূর্ব ইউরোপের গল্প বলতেই থাকি !
  • Debanjan Banerjee | ৩০ জুলাই ২০২৩ ০৮:২৫521899
  • হিরেনবাবু 
     
                 অনেক ধন্যবাদ আপনার "Work and Wanderlust: Memoirs of a Wandering Banker" বইটির উদ্ভোদনের সময়ে আমাকে আমন্ত্রনের জন্য | আপনার বইটি যথারীতি অসাধারণ হয়েছে | এই লেখাটি আপনার আরেকজন বাঙালী থেকে বিশ্বনাগরিক হয়ে ওঠবার দলিল | আপনি আপনার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে যেসব অসংখ্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন দেখেছেন যেমন হাতে লেখা চিরকুট ও রসিদ থেকে ইমেইল বা হোয়াটসআপ বা ইউরোপের সোভিয়েত যবনিকার পতনের মুহূর্তগুলো আমার মতে ইতিহাসের অমূল্য দলিল হয়ে থাকুক | আপনার লেখার শেষ অধ্যায়টি যেটি হচ্ছে "Roots" অসাধারণ | এই অধ্যায়টি থেকেই আপনার বিশ্বনাগরিক রূপটি ফুটে উঠলো | 
     
     
               শুভেচ্ছা নেবেন | কবে আবার আসবেন কোলকাতাতে ? আপনার লন্ডনের মোবাইল নম্বর কি ? অনেক কথা বলবার ইচ্ছে রইলো |
     
              পুনশ্চ : আমার আত্মীয় ও বন্ধু মহলে আপনার ইহুদি রসিকতা ও আমার আফ্রিকা বইদুটো বেশ কয়েকজনকে দিয়েছি | সবাই বলছে ভবিষ্যতে বাংলার ইতিহাস পাঠে এই দুটো বই অবশ্যপাঠ্য হবেই | আরো লিখুন |
  • হীরেন সিংহরায় | ৩০ জুলাই ২০২৩ ১১:৪০521906
  • অশেষ ধন্যবাদ ! পরবর্তী ইংরেজি বই ( মাই লাইফ এ্যাট সিটি) প্রস্তুতির পথে! ভালো থাকুন 
     
    লন্ডনের নম্বর এবং হোয়াটসএ্যাপ
     
    ০০৪৪ ৭৮৮৭ ৬২৬৭৩০
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন