নেমে গিয়ে হৃদয়ের অনেক গভীরে
বোহেমিয়ার গানের সুর আমাকে বিষণ্ণ করে
মনে জাগায় এক আকুল আকাঙ্ক্ষা
যদি চলে যাই দূরে অনেক দূরে
সেই মধুর সুর ফিরে আসে বারেবার
মনে করিয়ে দেয় আমি কার
রাইনার মারিয়া রিলকে*
মেদোনস্ত, বোহেমিয়া
পুরনো শহরের ফ্রাউয়েন কিরখে, রাজা আউগুস্তেসের স্বর্ণময় অশ্বারোহীর স্ট্যাচু ছাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাঁধানো পথ এলবে নদীর তীরে নেমে আসে। ওপারে শ্যামলা ধরিত্রী, দূরে কোন প্রাসাদ; ড্রেসডেনের ব্রুইল তেরাসের বন্দনায় গোয়েথে বলেছিলেন এই আমার ইউরোপের অলিন্দ। সেইখানে বসে আমার বন্ধু অরটউইনকে বলেছিলাম, চলো তোমার স্মৃতির অলিন্দে একবার উঁকি ঝুঁকি দিয়ে আসি, তোমার জন্মভূমি একদা বোহেমিয়া (বোয়মেন) আজকের চেক রিপাবলিকে! চেকোস্লোভাকিয়া নামক দেশের এগার শহরের সীমান্ত চৌকি থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে আসার পর সে দেশে হবে আমার প্রথম প্রবেশ।
অরটউইন বিস্মিত হয়ে বলে, মেদোনস্ত? পথ চিনবে কি করে?
জানালাম তার বাবার কাছ থেকে সেটা মোটামুটি জেনে নিয়েছি। এভিস গাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময়ে একটা কাজ চালানো ম্যাপ দেয় তাতে মেলনিক দেখাচ্ছে সেখান থেকে মেদোনস্ত খুঁজে নেওয়া শক্ত হবে না!
অচেনা অজানা পথের দুর্বার আকর্ষণে মাত্র বছর খানেক আগে বার্লিন থেকে এক সন্ধ্যের অন্ধকারে পশ্চিম পোল্যান্ডের নগণ্য গ্রাম ঝাকশেভোর প্রাসাদে হাজির হয়েছিলাম, সে কাহিনি অরটউইনের জানা ছিল। এই এলবে নদী পেরিয়ে চেকিয়া বা চেক রিপাবলিক ঢুকে পড়াটা সে তুলনায় সামান্য ব্যাপার।
ড্রেসডেনে এসেছি এক ব্যাংকিং কনফারেন্সে, অরটউইন খদ্দেরের খোঁজে। একটা বাড়তি দিন কাটিয়ে দেওয়ার অজুহাত অনায়াসে কর্তা ব্যক্তিদের কাছে পেশ করা যায়।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে তার অধীনে কাজে যোগ দেবার দিন (১ জুন ১৯৭৮) থেকে আমৃত্যু (১০ এপ্রিল ২০১৫) অরটউইন ছিল আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড (জার্মানে মজা করে বলতাম মাইন ফ্রয়েনড, ফিলসফ উনড ফুয়েরার)। অরটউইন একমাত্র সন্তান – তার পিতা মাতা রুডলফ ও এলিজাবেথ ক্রাইবিখ আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তাঁদের মৃত্যুর পর ক্রাইবিখ দম্পতির আজীবন সঞ্চিত পুস্তক, আর্ট এবং আসবাবপত্র আমাদের ফ্রান্সের বাড়িতে সযত্নে রক্ষা করে চলেছি। পরিবারের আদি বাড়ি বোহেমিয়ার মেদোনস্ত গ্রামে যার গল্প শুনেছি তার বাবা রুডলফ ক্রাইবিখের কাছে, ওবারউরসেলের বাড়ির বারান্দায় বসে।
সীমানা পেরিয়ে সেথায় যাওয়ার সুযোগ জুটলো এতদিনে! সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে অরটউইন ও আমি হেনরি ফোরডের প্রপৌত্রের কারখানায় বানানো একটি গাড়ি চড়ে যাত্রা শুরু করি এক দেশের পানে যার নাম চেকোস্লোভাকিয়া থেকে সদ্য চেকিয়া নামে পরিবর্তিত হয়েছে।
গাড়িতে বেশিদূর যাওয়ার আগে, একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে।
আমার কাছে বোহেমিয়া, চেকিয়া জড়িয়ে আছে একটি পরিবারের সঙ্গে। রাজনীতির বলি হয়ে কয়েকশ বছরের বাসভূমি হারানোর সে কাহিনি বইয়ে পড়ি নি, শুনেছি হের রুডলফ ক্রাইবিখের কাছে। তখন জানতাম না একদিন সেই দেশ সেই মাঠ সেই পথ দেখব নিজের চোখে, অনুমান করতে চাইব ছিন্নমূলের বেদনা। কাজটা সহজ নয়।
কয়েকশ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষ রাজস্থান থেকে সুদূর পূবে এই বাংলায় বাসা বেঁধেছিলেন। তাঁদের উত্তর পুরুষ আজও পুজোর সময়ে গ্রামের আটচালায় বসে নক্ষত্রের পানে চেয়ে তাদের স্মরণ করতে পারে। মোড়ল পুকুর, বেলে মাঠ, শাঁখের চক আমি তেমনই দেখেছি যেমন আমার বাবা দেখেছিলেন। র্যাডক্লিফের ছুরিতে যখন পূর্ব বাংলা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, আমাদের পরিবারের গায়ে পড়েনি তার কোন আঁচ। আমাদের সেই পুকুর মাঠ বাগান থেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অন্তত যতদিন না কেউ কাগজ চাইবেন বা বলবেন আপনারা তো বিদেশি।
বিগত কয়েকশ বছরে পোল্যান্ড নামক একটি পরাক্রমশালী দেশ তিনবার ইতিহাস ও ভূগোলের পাতা থেকে হারিয়ে গিয়ে পুনর্বার দেখা দেয় ১৯১৮ সালে। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়া নামের দেশ কখনো ছিল না : ছিল চারটা রাজ্য বা প্রদেশ। উত্তর পশ্চিমে বোহেমিয়া (বোয়মেন: রাজধানী প্রাগ) দক্ষিণে মোরাভিয়া (মেহরেন: রাজধানী ব্রনো) উত্তরে লুসাশিয়া (লাউসিতস, শ্লেজিয়েন: রাজধানী কটবুস) পূবে স্লোভাকিয়া, রাজধানী পজনি / প্রেসবুরগ। বোহেমিয়া, মোরাভিয়া প্রথমে পুণ্য রোমান সাম্রাজ্য পরে হাবসবুরগ শক্তির অধীনে উপরাজ্য, লুসাশিয়া অন্য কারো জমিদারি, স্লোভাকিয়া সে আমলে হাঙ্গেরির একটি ছোট প্রদেশ।
ত্রয়োদশ শতকে স্লাভিক রাজা অটোকার আমন্ত্রণ জানালেন জার্মান চাষি, মিস্ত্রি, হস্ত শিল্পী, ব্যবসায়ীদের – তাঁরা আসুন, খুঁটি গাড়ুন, দেশের উন্নয়ন হবে। ভিসা দিয়ে নয়, জমি জমা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রায় একই সময়ে টিউটোনিক নাইটরা উত্তর ইউরোপে পোপের আদেশে সারা বালটিক অঞ্চলে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে এসেছেন ব্রেমেন হামবুর্গের ব্যবসায়ীরা যারা বানাবেন আরও অনেক হানসা বন্দর। ঠিক তেমনই জার্মানরা এলেন মুখ্যত রাইনলানড থেকে পুত্র কন্যা পরিবার নিয়ে। ক্রমশ তাঁদের ডাক পড়েছে আরও পূবে, আজকের ট্রানসিলভানিয়া, রোমানিয়াতেও ( বর্তমান রোমানিয়ান রাষ্ট্রপতি ক্লাউস ইওহানিস বাড়িতে জার্মান বলেন )। সে কালে জার্মান ভাষী ইউরোপে অন্তত সতেরশো রাজা বা জমিদার; নিরন্তর আপসে লড়াই করে যাচ্ছেন তাঁরা। দেশের, জমিদারির উন্নয়নের জন্য পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা কেউ করেন না। অথচ ইউরোপে গুজব চালু ছিল জার্মানরা কাজের লোক, এঁরা যেখানে গেছেন সেখানেই চাষ ব্যবসা বাণিজ্য বেড়েছে। এঁরা কেউ রাজা হতে চান নি, বড়জোর সেনাপতি হয়েছেন। একদিন রাশিয়ান জারিনা একাতেরিনা ও পরে জার আলেকসান্দার তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, আজও পাঁচ লক্ষ জার্মান রাশিয়ার নাগরিক।
এঁদের কলোনাইজার বলতে আমার আপত্তি আছে। স্লাভ জাতির জমি জিরেত লুঠ করতে তাঁরা আসেন নি। নাৎসিরা দ্রাং নাখ ওস্টেন ( পুবের পানে ধাবিত হও) স্লোগানের পিতৃত্ব দাবি করতে পারেন না – কয়েকশ বছর ধরে ওস্ট জিডলুং বা পূবের পত্তনি কথাটা চালু ছিল -গো ইস্ট ! যখন এলিস আইল্যান্ডে ইউরোপীয় ইমিগ্রান্টের লাইন লেগে গেছে, তখনো বহু জার্মান হেঁটেছেন পূব দিকে। ক্রমশ আপন কর্মে সফল হয়েছেন, সম্পত্তি বাড়িয়েছেন। তাঁরা আমেরিকা অভিমুখী হলেন তিরিশ বছরের ধর্মযুদ্ধের পরে, ১৬৩০ সালে।
বোহেমিয়া থেকে বোহেমিয়ান শব্দটি এসেছে। জীবন সেখানে দিয়েছে খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে যা খুশি করার আনন্দ। পরের পাঁচশো বছর বোহেমিয়া রইল পুণ্য রোমান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে। এই রাজ্যের শ্রেষ্ঠী, জমিদার, সেনানায়ক, বিচারপতি রাজা - সকলেই মুখ্যত জার্মান ভাষাভাষী। বাড়ির কাজের লোক, ঘোড়া গাড়ির কোচোয়ান, বাড়ির মিস্ত্রি, চাষের মজুর অন্য ভাষায় কথা বলে। ধর্ম এক। ক্ষমতা, অর্থ শক্তি, জমির মালিকানা জার্মান ভাষী মানুষের হাতে।
যা কখনো পুণ্য বা রোমান ছিলো না সেই সাম্রাজ্যের শেষ ধারক ও বাহক ফ্রান্সিস ১৮০৬ সালে একটি চিঠি দিয়ে মহামান্য পোপকে জানালেন তিনি আর অত পুণ্য চান না, অস্ট্রিয়ার হাবসবুরগ সম্রাট সেজে বাকি দিনগুলি কাটাবেন। ইউরোপিয়ান ইতিহাসে একজন সম্রাটের পদত্যাগ পত্র লেখার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আছে কিনা জানিনা তবে তাঁর সাম্রাজ্যকে ডাউনসাইজ করার এই সুবুদ্ধিটুকু যে নাপোলেওঁর ক্রমাগত আক্রমণের ভীতি থেকে প্রণোদিত হয়েছিল সেটা মনে করা যেতে পারে। এবার অস্ট্রিয়ান শক্তি বোহেমিয়ার জানমালের মালিক হল।
ভারত আবিষ্কারের বাসনায় পালোস দে লা ফ্রন্তেরা বন্দরে কলম্বাসের জাহাজ ভাসানোর কয়েক দশক আগে জাখসেনের কোন গ্রাম থেকে জিগমুনড ক্রাইবিখ ঘোড়া এবং বলদের গাড়ি জুড়ে এলেন বোহেমিয়া; নৌকোতে যেখানে এলবে নদী পার হলেন তার নাম আউসিগ (চেক উশটি নাদ লাবেম)। কালে কালে আপন কর্ম বলে জমিদারি গড়লেন, উদ্যোগে সফল হলেন। তাঁদের অন্য কোন ‘দ্যাশ ‘ ছিল না, বড়দিনের ছুটিতে জাখসেনের গ্রামে বা শহরে মামা কাকা আত্মীয় পরিজনের জন্যে কলা মুলো জামা নিয়ে যেতেন না। প্রাগ তাঁদের সদর মহল্লা, পুণ্য রোমান সম্রাট কার্ল প্রতিষ্ঠা করেছেন কারলস উনিভারসিতেত (উনিভারজিতা কারলোভা) যেখানে পড়ানো হয় ল্যাটিন এবং জার্মানে।চেক ছাত্রের সংখ্যা দশ শতাংশ।
আজও অবাক হই দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং আর পাড়ায় পাড়ায় মারামারি কাটাকাটি অগ্নিকাণ্ড সত্ত্বেও কি করে এই জার্মান জাতি তাদের চোদ্দ কেন পঞ্চাশ পুরুষের নিখুঁত কুলুজি হাজির করতে পারে! এর ক্রেডিট অবশ্যই দিতে হয় গিরজে এবং পুরুতদের যাদের কুলুঙ্গিতে সেগুলো অক্ষত থেকেছে, আমাদের পুরী বা গয়ার পাণ্ডাদের লেজার বইয়ের মতন।
এবার আমাদের গাড়িতে
ড্রেসডেন থেকে বেরিয়েছি নীল বিস্ময় নামক ক্যানটিলিভার ব্রিজ পেরিয়ে – থাম শূন্য এই সেতু সে আমলে অষ্টম আশ্চর্য ( ১৮৯৩ ); বহু দূরের গ্রাম থেকে লোকজন আসতেন এটি দেখতে। উশটি নাদ লাবেমের পথ সিধে দক্ষিণ পানে মাত্র চল্লিশ মাইলের পথ, ঘন বনানী পেরিয়ে, গ্রাম শহর অনেকটা দূরে দূরে। মনে একটা বিচিত্র অনুভূতি – এই সেদিনের কাঁটা তারে ঘেরা এক কমিউনিস্ট দেশ থেকে যাচ্ছি আরেক কমিউনিস্ট দেশে, আমাদের দুজনের দুটো আলাদা পাসপোর্ট! এবার সত্যি তাহলে চেকিয়া? চেকোস্লোভাকিয়া যাওয়া হয় নি, তাতে কি? পূব দিকের যে এগার সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেটা ছিল বোহেমিয়া এবার সশরীরে বোহেমিয়া ঢুকলাম উত্তর দিক দিয়ে! প্রায় পনেরো বছর আগে যে পুলিশ চৌকি দেখেছিলাম এগারে, তার কাঠামো সেই রকমেরই রয়েছে কিন্তু তার ভেতরে মানুষ পরীক্ষার কাজ বোধহয় শেষ ! রক্ষীর চোখ মুখ মানুষের মতন। আমি বাহাদুরি করে দোবরি দেন বললে তিনি জবাবে গুটেন টাগ বললেন! কোন তাঁবুতে ঢুকে কাগজপত্র দেখাতে বা পাঁচটা প্রশ্নের জবাব দিতে হলো না।
উশটি নাদ লাবেম এক নদী বন্দর – ধূসর রঙের বাড়িঘর, বাজার দোকান বলতে কিছুই চোখে পড়ে না যদিও রাস্তার ধারে আমাদের কলকাতার হকারদের মতন কিছু লোক খাদ্য পানীয়ের স্টল খুলে ফেলেছে, তার ওপরে ইংরেজিতে লেখা নন স্টপ ! আমার দীর্ঘ ভ্রমণে সেন্ট পিটারসবুরগ থেকে স্কপয়ে অবধি সর্বত্র এই নন স্টপ লেখা দোকান দেখেছি। লন্ডনে সে আমলে টেসকো বা সেনসবেরি তখনো চব্বিশ ঘণ্টা দোকান খোলা রাখে না! অবশ্যই স্বীকার করি ওয়ারশ বা রিগায় গভীর রাত্তিরে রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে যাইনি ঐ নন স্টপের ঝাঁপ খোলা না বন্ধ !
রাস্তার একদিকে যাওয়া একদিকে আসা। মধ্যি খানে সাদা লাইন যেমন নেই তেমনই খানা খন্দও নেই। কি সবুজ এই মাঠ ঘাট, তাকে ঘিরে আছে নিবিড় বন বীথিকা। এই পথে একদিন হেঁটেছিল মানুষের সারি, চেনা মুখ চেনা সুখ ছেড়ে ভবিষ্যতের সন্ধানে। কয়েকশ বছর বাদে ফিরেছিল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে, অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে।
চোখে পড়ে নামের ফলক (ব্রাকেটে জার্মান নাম লিখেছি) – প্রভোদিন (মিকেনহাইন), ডেসত্রেবি (হাবস্টাইন) দুবা (দাউবা) দেস্তনা (দেশনা)। এই অসামান্য সুন্দর অঞ্চলটির নাম কোকোরিনস্কো, ক্রমশ খাড়াই। খানিকটা যেতেই রঙ উঠে যাওয়া বোর্ডে লেখা Medonosy, মেদোনস্তের চেক নাম।
ছোট গ্রাম। ক্রাইবিখ পরিবারের পৈত্রিক বাড়ির একটি পট ওবারউরসেলের বাড়িতে টাঙ্গানো দেখেছি – গ্রামের মধ্যে এই ছোটখাটো প্রাসাদ সুলভ বাড়িটি খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। অরটউইনের দু মাস বয়েসে তার পিতা মাতা দুটি সুটকেস হাতে পশ্চিমে পালাতে বাধ্য হন। এই বাড়ির প্রত্যক্ষ স্মৃতি তার নেই, তবে তার কাহিনি শুনে শুনে সে বড়ো হয়েছে, মনে একটা ছবি গাঁথা। বিগত চল্লিশ বছরে বার দুয়েক হয়তো সে এসেছে সঠিক জানে না।
পরবর্তী দৃশ্যের জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। তাদের বাড়ির কাছাকাছি গাড়ি পার্ক করে সম্ভবত গ্রামের একমাত্র কফির দোকানে পানীয়ের অর্ডার দিয়েছি জার্মানে – ইয়া বলে অদৃশ্য হলেন মানুষটি। সেখানে কোন গুটেন টাগ নয়, পেলাম একটা কঠিন দৃষ্টি। আশে পাশের বাড়ির জানলাগুলো বন্ধ হয়ে গেল। মনে হল তার সামান্য ফাঁকে কিছু কৌতূহলী চোখ আমাদের ওপর নজর রাখছে।
নজর রাখার কারণ বহুবিধ – জার্মান নাম্বার প্লেট ওলা ফোরড গাড়ি (সুপ্রাচীন স্কোদা, ওয়ারটবুরগ, ত্রাবান্ত ছাড়া অন্য গাড়ি রাস্তায় চলে না) ; ব্লনড চুল ওলা বিদেশি, নির্ঘাত জার্মান, সঙ্গে বাদামি চামড়ার একজন। এরা কারা? কেন এখানে? মেদোনস্ত কোন টুরিস্ট তালিকায় তো পড়ে না!
অনেক বছর আগে আমাদের গাঁয়ে ক্বচিৎ কোন গাড়ি ঢুকলে ছোট ছেলে মেয়েদের ভিড় জমায়েত হতো – সে কেবল নিছক কৌতূহল। আজ এখানে এই বোহেমিয়ার ছোট্ট গ্রামের মানুষের মনে কৌতূহল নয়, আছে এক অন্য এক ভাবনা অন্য সংশয়, ভীতি – এরা কি চায়? জমি বাড়ি ফেরত নেবে নাকি?
এই শীতল সম্বর্ধনার গভীরে নিহিত আছে যুদ্ধোত্তর চেকোস্লোভাক রাষ্ট্রপতি এদুয়ারদ বেনেশের বিখ্যাত ডিক্রি। তিনি র্যাডক্লিফ সায়েবের মতো ধর্মের ভিত্তিতে লাইন টেনে বলেন নি, এরা থাকুক এধারে অন্যেরা ওধারে। বেনেশ বললেন, চেকোস্লোভাকিয়া চেক এবং স্লোভাকদের দেশ, এখানে সংখ্যালঘু জাতির কোন স্থান নেই। যারা প্রমাণ পত্র সহ নিজেদের চেক বা স্লোভাক বলে নিজেদের পরিচয় পারবে না, তারা এতদিন নিতান্ত অন্যায় ভাবে বাস করেছে। এবার তারা ফিরে যাক আপন দেশে।
কোন দেশে?
কেন, পোলিশরা যাক পোল্যান্ডে, হাঙ্গেরিয়ানরা হাঙ্গেরিতে আর জার্মানরা জার্মানিতে!
সেই জার্মান যারা সাতশ বছর বোহেমিয়া মোরাভিয়াতে বসবাস করেছে? তাঁদের মুখের ভাষা জার্মান কিন্তু কোনদিন কোন জার্মান রাজা বা কাইজারকে খাজনা দেয় নি। কয়েকশ বছর হাবসবুরগ সম্রাটের, বিগত তিরিশ বছর চেকোস্লোভাকিয়ার নাগরিক। জার্মানিতে তাদের দূর সম্পর্কের কোন আত্মীয় নেই ! গুনতিতে তিরিশ লক্ষ, চেকোস্লোভাকিয়ার মোট বিশ শতাংশ।তারা যাবে কোথায়?
গন উইথ দি উইন্ডের শেষ দৃশ্যে রেট বাটলারের ভূমিকায় ক্লার্ক গেবলের মতো কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিনি বলেন, সেটা, প্রিয় বন্ধুগন, আমার সমস্যা নয়। এ দেশে তাঁদের থাকা চলবে না। তবে যাবার সময় তাঁরা যেন বাড়ির, গাড়ির চাবি নিকটস্থ পৌর সভা অফিসে, নিদেন পক্ষে স্থানীয় থানায় জমা করে যান। দুটো সুটকেসে যা ধরে তার বেশি কিছু সঙ্গে নিতে পারবেন না।
এই সেই এদুয়ারদ বেনেশ যিনি একদিন প্রাগ প্রাসাদের জানলা থেকে চার্লস ব্রিজের দিকে তাকিয়ে চেম্বারলেন দালাদিয়েকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন- মিউনিক চুক্তিতে হিটলারকে বোহেমিয়া মোরাভিয়া দান করেছিলেন বলে প্রাগে একটিও বোমা পড়ে নি।
তারপর পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে বহুবার। এখন ১৯৯৩।
চল্লিশ বছরের লৌহ আবরণ ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে, সীমান্তের কড়াকড়ি নেই। আজ যদি জার্মানরা এসে অমিতাভ বচ্চন স্টাইলে দাবি করে, আজ সে চালিস সাল পেহলে এ মেরি হাভেলি থি? এবারে কোন ট্যাঙ্ক বন্দুক নয়, একেবারে গণতান্ত্রিক কায়দায় সেই উদ্বাস্তু জার্মানরা ফিরে এসে বলে আমার জমি ফেরত দাও? রাইট টু রিটার্ন?
তাই জানলা বন্ধ হয়ে যায়? চোখের চাউনি হয় কঠোর?
ফিরেছি আবার কোকোরিনস্কো বনানী পার হয়ে। অরটউইনের বাবার কাছে শুনেছি এখানে অনেক চেক/জার্মান কবি শিল্পী এসেছেন, যেমন কারেল মাচা, ভিক্টর ডিক এবং ফ্রান্তস কাফকা ( কাফকা বাড়িতে ইদিশ বলেছেন, জার্মানে লিখেছেন, ইন্সিউরেন্স কোম্পানির অফিসে চেক ) – তাঁরা এই কোকোরিনস্কোর প্রান্তরে হেঁটেছেন একদিন, প্রাগের কফি হাউসে বিতর্ক করেছেন। দুজনেই মনে করেছেন ক্রমশ একটা ভাষার দেয়াল গড়ে উঠছে, তাঁরা দেখেছিলেন ভবিষ্যতের লিখন- ভাষার বিবাদে দেশভাগ।
পরে তো তাই হলো ! চেকোস্লোভাকিয়া নামক নতুন দেশ গড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়- এরা সকলেই একই ভাষায় কথা বলেন ! এই লজিক বেশিদূর টানলে জেনিভার জনগণ কি ফরাসি নাগরিক বনে যাবেন? ব্রাসেলসের অর্ধেক?
ফেরার পথে উশটি নাদ লাবেমে একটি নন স্টপ লেখা কাফেতে আমাদের শেষ স্টপ। সেখানে জুটল সম্যক আপ্যায়ন – অনুমান করতে অসুবিধে হল না যে তার কারণ আমাদের পকেটের ডয়েচ মার্ক ( ক্রেডিট কার্ড আসতে অনেক দেরি )। পার্ক করা ফোরড গাড়ি ঘিরে ভিড়।
ড্রেসডেনে ব্রিটিশ এয়ার আজও নামে না, হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে, ১৯৪৫ সালের ১৩/১৪ই ফেব্রুয়ারির রাতে বম্বার হ্যারিসের সেই অনাবশ্যক বিধ্বংসী বোমা বর্ষণের অপরাধবোধে।
লাইপজিগ বিমান বন্দরে আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেলো –অরটউইন যাবে ফ্রাঙ্কফুর্ট, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে আমি যাব লন্ডন।
স্মরণে
অরটউইন রুডলফ ক্রাইবিখ
জন্ম: ২৬শে এপ্রিল ১৯৪৫ মেদোনস্ত, দাউবা পরগনা, রাইখেনবেরগ জিলা ( অধুনা মেদোনস,
লিবেরেতস জিলা)
৭ মে ১৯৪৫: পূর্ব ফ্রান্সের রেমস শহরে একটি ইট গাথা স্কুলের ক্লাসরুমে জার্মানির বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ।
জুলাই ১৯৪৫: দুটি সুটকেস এবং শিশু পুত্রকে নিয়ে রুডলফ ও এলিজাবেথ ক্রাইবিখের পশ্চিম পানে যাত্রা শুরু। প্রায় অভুক্ত অবস্থায়, দু দিন হেঁটে বিশে জুলাই পুত্রকে রেখে গেলেন শ্মলন শহরের (এককালে পূর্ব জার্মানি) ফ্রাউ প্রেতসে নামের এক পরিচিতা মহিলার হেফাজতে।
তাদের দেখা হবে আরও দু মাস বাদে।
দাদু দিদিমার সঙ্গে অরটউইনের সাক্ষাৎ হবে চার বছর বাদে।
মৃত্যু: ১০ এপ্রিল ২০১৫ উজিঙ্গেন, হেসেন, জার্মানি
পু: মেদোনস্তে ক্রাইবিখ পরিবারের ভিটে বর্তমানে স্থানীয় পৌরসভা অফিস। কখনো ভাবিনি একদিন আমার প্রিয়তম বন্ধু ও তার পরিবারের কাহিনি লিখব একদিন। লেখা শুরু করার পরে আমাদের পরিচিতা স্লোভাক মহিলা হেনরিয়েতাকে অনুরোধ করেছিলাম তিনি যদি মেদোনস্ত গ্রামের সেই পৌরসভা থেকে ক্রাইবিখ পরিবারের সম্বন্ধে আরও কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। হেনরিয়েতা বললেন, সেই নামের পরিবার কখনো সেথায় বাস করতেন কিনা, কোথায় গেলেন, এ নিয়ে কোন আলোচনা করতে মেদোনস্ত গ্রামের পৌরপিতা নারাজ। অত্যন্ত অভদ্র ভাবে ফোন কেটে দিয়েছেন।
*রেনে কার্ল ইওহান ইওসেফ মারিয়া রিলকে, জন্ম প্রাগ, বোহেমিয়া, ডিসেম্বর ১৮৭৫
মূল জার্মান থেকে অনুবাদ - লেখক।