- গাড়ি পাওয়া যাবে?
- পাবেন। ক’দিনের জন্য?
- ছ’ দিন।
- কোথায় চালাবেন? জার্মানির সর্বত্র যেতে পারেন, তবে এখানেই গাড়ি ফেরত দেবেন।
- পোল্যান্ড যাওয়া যাবে?
এভিস নামক গাড়ি ভাড়া দেবার প্রতিষ্ঠানের মহিলা এবার সতর্ক হলেন।
- পোল্যান্ড যদি আপনার গন্তব্য হয়, ফোলকসভাগেন বা আউডি নয়, একমাত্র ফোর্ড গাড়ি পাবেন।
- কেন?
- গাড়ি চুরি হয় বলে।
- ফোর্ড খুব বাজে গাড়ি বুঝি? কেউ চুরি করে না?
মহিলাকে বিব্রত দেখাল।
- না, না। আমি তা বলছি না। তবে এটা আমাদের এভিস কোম্পানির সাম্প্রতিক নির্দেশ। আপনি ফোর্ডের যে গাড়িই বুক করুন না কেন, একটা ফ্রি আপগ্রেড দিয়ে দিচ্ছি। আপনি তো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে এলেন। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম আছে।
টেগেল বিমান বন্দর। নভেম্বর মাসে এক রবিবারের বিকেলে এসেছি বার্লিন। আমার গন্তব্যস্থল পশ্চিম পোল্যান্ডের একটি ছোট গ্রাম। তার অবস্থান – জার্মান সীমান্তের কাছাকাছি বড় পোলিশ শহর – এককালের রাজধানী, পজনান ছাড়িয়ে।
প্রথম আমেরিকান ব্যাঙ্ক হিসেবে সিটি ব্যাঙ্ক সদ্য শাখা খুলেছে ওয়ারশ-তে (আমাদের প্রথম এশিয় শাখা খোলা হয় কলকাতায়, ১৯০২ সালে)। সে দেশের কিছু ব্যাঙ্কের মানুষকে পশ্চিমি ব্যাঙ্কিং-এর কায়দাকানুন শেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাঙ্ক। এঁরা এতদিন অজ্ঞান-অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলেন। উচ্চমার্গের অর্থনৈতিক বাণিজ্য পদ্ধতি সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই। সেভিংস আর কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ছাড়া কিছুই জানেন না। এঁরা বুঝুন, উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও সুদের বিনিময়ে আমরা কত রকমের সেবা পরিবেশন করে থাকি। সেটার প্রচার আগেভাগে না করে রাখলে, আমাদের আগামী পরিষেবা বিক্রি হবে কী করে?
চার দিনের পাঠক্রম। এই ক’দিনে আমন্ত্রিত জনগণকে পশ্চিমি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কিং যতটা শেখানো সম্ভব। আসল উদ্দেশ্য – সিটি ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন করা। সবে সে’ দেশে দোকান খোলা হয়েছে। একটু ঢাক পেটানো দরকার। তাই একেবারে মুফতে এই শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনা – থাকা-খাওয়ার খরচা অবধি সিটি ব্যাঙ্কের। হোক না সে মাত্র চার দিনের জন্য! সে খরচা আখেরে উঠে আসবে। পোল্যান্ডে যখন আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াব, তখন এই সব মানুষেরা সিটি ব্যাঙ্ককে নিশ্চয় মনে রাখবেন, অর্থ এবং সহযোগিতার হাত – দুটোই বাড়িয়ে দেবেন। কৃতজ্ঞতা বলে তো একটা কথা আছে!
আমার লন্ডন অফিসের সহযোগী, এসেক্সের নিরন্তর ধূমপায়ী, শ্মশ্রুধারি ইয়ান ফিঞ্চ সদ্য-উন্মুক্ত পূর্ব ইউরোপের ব্যাঙ্কিং-জগতের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করার প্রচেষ্টায় রত। ইয়ান জানালে, তাকে পোল্যান্ডে এই সেমিনার আয়োজনের ভার দেওয়া হয়েছে। বিষয় – আমদানি-রপ্তানি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিদেশি মুদ্রা লেন-দেন। ইয়ান মহাউৎসাহে এই কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। তার কাছে এক প্রায় অচেনা দেশের গল্প শুনি উদাসীন ভাবে। বেল পাকিলে কাকের কী? আমার বাণিজ্য পশ্চিম ইউরোপে, আফ্রিকায়, এশিয়ায়।
ভগ্নদূতের মত এসে ইয়ান একদিন খবর দিলে – মুশকিল হয়েছে। আমন্ত্রিত বক্তাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি, ক্লাউদিও ফানতোনি – আমাদের সতত সিগার-মুখী সেই ইতালিয়ান ভদ্রলোক – জানিয়েছেন, পোল্যান্ডের এক অজ পাড়া-গাঁয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কের এবং তাঁর নিজের মূল্যবান সময়ের অপব্যয় করতে তিনি অনিচ্ছুক। অনভিজ্ঞ কিছু মানুষকে বৈদেশিক বাণিজ্য শেখানোর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি কাজ হল ব্যাঙ্কের জন্য অর্থ অর্জন করা (ইয়ানের মতে ‘নিজের জন্য বোনাস’)।
অতঃপর?
দাড়িতে হাত বুলিয়ে ইয়ান বললে, তুমি তো ব্যাঙ্কে এই ব্যবসার কাজ কর। যাবে পড়াতে, ক্লাউদিওর পরিবর্তে? নতুন দেশ দেখা হবে। শুনেছি, ওদের বিয়ার নাকি জার্মানির মত বা তার চেয়েও ভাল। গ্রামে বসে দারুণ আড্ডা দেওয়া যাবে। তবে মনে রেখো, এটা নভেম্বর মাস। এখন বেজায় ঠান্ডা!
বললাম, ‘যেতে আপত্তি নেই। তবে তোমাদের খেলার মাঠে আমার নাম বদলি খেলোয়াড়ের তালিকাতেও নেই। যদিও বৈদেশিক বাণিজ্য আমার জীবিকা, তবে ব্যবসা করা এক কথা, আর সে বিষয়ে ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়া আরেক জিনিস। দ্বিতীয়ত, সিটি ব্যাঙ্ক পোল্যান্ড-এর কর্তা, সিইও, অ্যালান হার্স্ট কি রাজি হবেন, আমার মতন একজন লোকের হাতে এই গুরুদায়িত্ব দিতে? আমাকে চেনেন না। তিনি তো চেয়েছিলেন ক্লাউদিওকে।’ ইয়ান বললে, ‘সে আমি ম্যানেজ করে দেব। অ্যালানকে উত্তমরূপে চিনি। দেখা হলেই আমার দু’ পাত্তর হয়। ইতিমধ্যে তুমি ট্রেড ফাইনান্সের বই জোগাড় করে ও পড়ে নিজের এলেম বাড়াও!’
পরদিন অ্যালান হার্স্টের ফোন এল ওয়ারশ থেকে।
সিটি ব্যাঙ্ক ওয়ারশ একটি ব্যাঙ্কিং সেমিনারের আয়োজন করেছে পশ্চিম পোল্যান্ডে। পূর্ব-নির্ধারিত প্রধান বক্তা, ক্লাউদিও ফানতোনি, এই সেমিনারে যেতে পারবে না। সেটি নিতান্ত দুঃখজনক। ইয়ান ফিঞ্চের কাছে তিনি জেনেছেন, আমি বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে কাজ করি। সিটি ব্যাঙ্ক যখন আমাকে এই পদে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তখন তিনি ধরে নিচ্ছেন, সে বিষয়টি আমি বুঝি এবং আমন্ত্রিত পোলিশ ব্যাঙ্কারদের বিশদভাবে শেখানোর মত এলেম আমার আছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে তিনি পোল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার উপস্থিতি দাবি করেন। ইয়ান ফিঞ্চ আমাকে স্থান-কাল বিষয়ে সম্যক অবহিত করবে। ইতিহাসের ক্লাসে হয়তো চারদিনে ফরাসি বিপ্লবের তাৎপর্য সম্যক বোঝানো সম্ভব নয়, কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্য তেমন কিছু শক্ত বিষয় বলে তিনি মনে করেন না। নইলে আমার মত লোক করে খাচ্ছে কী প্রকারে? বিশ্বের বাজারে সিটি ব্যাঙ্ক একটি বিরাট নাম, আশির বেশি দেশে আমাদের শাখা আছে। তবে পূর্ব ইউরোপ তথা পোল্যান্ডে আমাদের খেলা সবে শুরু। বিনামূল্যে এই প্রশিক্ষণ বিতরণ দ্বারা আমরা ব্যাঙ্কের নাম আলোকিত করব, এই আশা তিনি পোষণ করেন।
এই নাতিদীর্ঘ স্বগতোক্তি বা সলিলকির শেষে, তিনি বিদায় প্রার্থনা করে ফোন নামিয়ে রাখলেন। শুরুতে ‘সুপ্রভাত’ এবং শেষে ‘দেখা হবে’ এই শব্দ দু’টি ব্যবহার করার সুযোগ পাই।
সম্পূর্ণ ঘটনাচক্রে, একটি অখ্যাত গ্রামে ব্যাঙ্কিং শিক্ষাদানের সুযোগে, আমার যে শুধু পোল্যান্ড-সহ লৌহ-যবনিকার আড়ালে ঢাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হল, তা-ই নয়, অ্যালান হার্স্টের মত এক অসাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দেবার আগে তিনি আমেরিকার ডেমোক্রাট দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হোয়াটসঅ্যাপ এবং আইটি সেল নামক আধুনিক জনসংযোগের তুখোড় মাধ্যম ভোটারদের তখনও অজানা। পার্টির ইস্তাহার, ম্যানিফেস্টো এবং বক্তৃতার ড্রাফট লিখতেন লেখাপড়া জানা ভদ্র মানুষজন। গুজব শুনেছি, উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন নামক এক যুবকের নির্বাচনী ভাষণের খসড়া করেছেন অ্যালান। বত্রিশ বছর বয়েসে ক্লিনটন লিটল রক, আরকানসাসের (মতান্তরে আরকানস’) রাজ্যপালের অফিসে অধিষ্ঠিত হলে, আপন রাজনৈতিক কর্তব্য সমাপ্ত হয়েছে মনে করে অ্যালান সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দিয়েছিলেন। সিকি-শতাব্দী কর্ম করেন, মুখ্যত উন্নয়নশীল পূর্ব ইউরোপে। তাঁর সেই জমিদারিতে নিরঙ্কুশভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। অ্যালান কথা বলতেন উচ্চস্বরে। প্রচলিত সামাজিক বাকসংযম তিনি মানতেন না। তাঁর শব্দচয়নে কিছু রক্ষণশীল মানুষকে বিব্রত হতে দেখেছি।
সিটি ব্যাঙ্কের কাল পূর্ণ হলে’পর, তিনি মধ্য-পশ্চিম ইংল্যান্ডের কটসওয়ল্ড অঞ্চলে অক্সফোর্ডের কাছে অ্যাম্পনি ক্রুসিস গ্রামে (জনসংখ্যা ৬১০) বাসা বেঁধেছেন। সেখানে বসে পুরোনো দিনের চর্চা হয়।
এবারে একটা পাঠ্যপুস্তকের খোঁজে উঠে পড়ে লাগলাম। ‘আমাজন ডট কম’ নামক জনহিতকর প্রতিষ্ঠানটি তখনো জন্মগ্রহণ করেনি। ‘এ কুইক গাইড টু ইনটারন্যাশনাল ট্রেড’ বা ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং লেটারস অফ ক্রেডিট’ গোছের বইয়ের খোঁজ করে বেড়াচ্ছি। আমার একান্ত শুভানুধ্যায়ী উকিল বন্ধু জেফ উইন শেষটায় আমাকে ‘ডি সি গারডিনার’ নামে এক প্রকাশনার সন্ধান দিলেন। দু’খণ্ড কেতাবও ধার পাওয়া গেল তাঁর কাছ থেকে। বিবেক দংশনের কারণে, বিলম্বে হলেও, সে বই ফেরত দিয়েছি!
পাওয়ার-পয়েন্ট উপস্থাপনা তখন অজ্ঞাত। একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পাতার ওপরে মোটা কলমে কিছু বচন লিখে (আজ তার নাম বুলেট পয়েন্ট) সেটিকে স্থাপন করা হত প্রোজেক্টরের ভেতরে। এবার তার ওপরে চলত তাপস সেনের কায়দায় আলোকসম্পাত! দেওয়ালে প্রতিফলিত সেই বাণী পাঠ করে এবং আমাদের ব্যাখ্যা শুনে, সমবেত শিক্ষার্থী জ্ঞান অর্জন করতেন।
ছাত্রসুলভ উদ্যমে অ্যাসিটেটের এক সঙ্কলন বাক্স-প্যাঁটরায় বাঁধলাম।
পশ্চিম পোল্যান্ডের ঝাকশেভো গ্রামে এই শিক্ষা-বিতরণ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়েছে। গুগল নেই। সেই পুরোনো ম্যাপ ভরসা। অফিসের টেবিলে একটা ইউরোপীয় ম্যাপ পেতে আমার সহকারিণী এঞ্জেলাকে বললাম ‘হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাপো দেখি, এই ঝাকশেভো গ্রাম থেকে কোনটা কাছে পড়ে – বার্লিন না ওয়ারশ?’ এঞ্জেলা জিগ্যেস করলে, ‘দূরত্ব পরিমাপের আর কোনো বৈজ্ঞানিক উপায় কি তোমার জানা নেই?’ বললাম, ‘এই আমার শর্ট-কাট।’ এঞ্জেলা তার চম্পকাঙ্গুলি দিয়ে মেপে বললে – একেবারে সম-দূরত্ব! আজ বললে বিশ্বাস হবে না – ঝাকশেভো থেকে বার্লিনের তুলনায় ওয়ারশর দূরত্ব মাত্র ৭ কিমি কম! তফাত এই, যে বার্লিন থেকে অনেকটাই অটোবান বা মোটরওয়ে – গাড়ির গতিসীমা উঁচুতে রাখা যায়। ওয়ারশ থেকে দ্রুতগতির পথ তখনো নির্মিত হয়নি।
প্লেনে ওয়ারশ গিয়ে, সেখান থেকে ট্রেন বা সিটি ব্যাঙ্ক দ্বারা আয়োজিত যানবাহন সহযোগে ঝাকশেভো গ্রামে যাবার কথা একবারও মনে হয়নি। ইয়ানকে বলেছি, দেখা হবে সেই পাঠশালায়!
চলো বার্লিন। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে যাব ঝাকশেভো। পথঘাট জানা নেই। দেশ চিনি না। ভাষা জানি না। তাতে কী? বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ একদা হেলায় লঙ্কা জয় করেনি? এ তো সামান্য পোল্যান্ড।
পকেটে পাসপোর্ট, ক্রেডিট কার্ডের ওপর ভরসা নেই বলে ট্যাঁকে নগদ ব্রিটিশ পাউন্ড, জার্মান মার্ক আর বুকে বল নিয়ে প্লেনে বার্লিন এসেছি। এবার ব্যাগসহ এভিসের দেওয়া ম্যাপ পাশে রেখে, দুই থেকে আপগ্রেড করা চার দরোজার ফোর্ড গাড়িতে চড়ে বসলাম। টেগেল বিমানবন্দর ছাড়িয়ে আমার প্রাথমিক লক্ষ্য জার্মান অটোবান। এ আমার চেনা দেশ। দূরত্বের পরিমাপে বড়জোর এক ঘণ্টা লাগবে পোলিশ সীমান্ত পৌঁছতে। আমাদের অফিস থেকে বলে দিয়েছে, ব্রিটিশ পাসপোর্ট দেখালে পোল্যান্ড-প্রবেশের কোনো বাধা নেই। ভিসা লাগে না; আগন্তুককে ভয় দেখিয়ে, সাতটা অবান্তর প্রশ্ন করে, উদব্যস্ত করার পুরোনো পূর্ব ইউরোপীয় অভ্যাস তারা ত্যাগ করেছে বলে জানা গেছে। আমার পরিচয়পত্রে একটা ছাপ মেরে দেবে শুধু।
জার্মান পোলিশ সীমান্ত সুইতসকো (Świecko) পৌঁছনোর ঠিক আগে, বাঁ-হাতে আরেকটা ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর পড়ে। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন ডের ওডার। অধিকতর পরিচিত নগরী ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন ছিল আমার প্রথম জার্মান ঠিকানা। আমাদের দেশে দুই বহরমপুরের তফাত বোঝাতে গঞ্জাম জেলার নাম ব্যবহার করা হয়। জার্মানরা নদীর নাম দিয়ে দুই শহরের পার্থক্য নির্দেশ করে, ব্যাকরণ মেনে।
দৈর্ঘ্যে একশ’ কিলোমিটারের কম বলে ওডার (পোলিশে ওডরা) ছোট নদী, মহিলা, তাই ডি ওডার। মাইন দীর্ঘতর, নদ, অতএব পুরুষ, তাই ডের! যে ফ্রাঙ্কফুর্ট ওডার নদীর ধারে অবস্থিত, তা বোঝাতে ডি হয়ে যাবে ডের – আন ডের ওডার। অন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট মাইন নদের তীরবর্তী বলে সেটা হবে, আন ডেম বা সংক্ষেপে ফ্রাঙ্কফুর্ট আম মাইন!
জার্মান মোটে শক্ত ভাষা নয়, সংস্কৃতের নিকটাত্মীয়া। স্কুলের পণ্ডিতমশায়ের শেখানো কারক বিভক্তি মনে রাখুন!
জার্মান সীমান্ত পুলিশকে পাসপোর্ট দেখাচ্ছি। ডানদিকের জানলায় একটি তরুণের মুখ আবির্ভূত হল।
গাড়ির কাচ নামালাম।
- আপনি কি পজনান যাচ্ছেন?
ইংরেজ ছেলে। বললাম, পজনান ঠিক নয়, তার কাছাকাছি কোথাও যাব। সেই তরুণের হাতে পোল্যান্ডের পেল্লায় সাইজের এক ম্যাপ। দেখলাম আমার গন্তব্য গ্রামটির নাম না থাকলেও, তার কাছের শহর গ্নিজনোর উল্লেখ আছে।
পজনান হয়ে যেতে গেলে একটু ঘোরা পথ পড়বে। তবে একটা সঙ্গী জোটে। তাকে তুলে নিলাম। জার্মান সীমান্ত-প্রহরী স্মিত মুখে আমার এই সদ্ভাবনার সমর্থন করলেন,
‘ইনি কয়েক ঘণ্টা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন!’
স্বাভাবিক।
বার্লিন দেওয়ালের পতনের আগে অবধি, খুব কম যাত্রীবাহী গাড়ির পশ্চিম থেকে পুবে আসা-যাওয়া ছিল। ধনতান্ত্রিক পশ্চিম থেকে সাম্যবাদী পূর্ব ইউরোপে প্রবেশের সীমান্ত অঞ্চল তখন বাঘবন্দি খেলার এক বিশাল ছক। সেই মাঠ ঘিরে দশ মিটার উঁচু টাওয়ারে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন সশস্ত্র দর্শক। আমি এই খেলার আইনকানুন না মানলে, তারা দর্শক থেকে সরাসরি রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে – আমাকে হলুদ বা লাল কার্ড দেখানোর বদলে গুলি চালাবে। এই রেফারির ভিএআর বা ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির কোনো প্রয়োজন ছিল না। কাউকে জবাবদিহি করার দাসখত তারা লিখে দেয়নি।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মত সোজা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার সুবিধে পূর্ব ইউরোপে অলভ্য ছিল। নো ম্যানস ল্যান্ড পার হয়ে এই দু’ মিটার সোজা গেলেন। তারপর একটা বাধা – লোহার গেট, তার পেছনে কিছু ভারি যন্ত্রপাতি। সেখানে দু'জন পুলিশ। তাঁরা আপনার গাড়ির জানালা-দরোজা-বুট খুলে দেখবেন, কোনো বিদেশি – এক্ষেত্রে পশ্চিম জার্মানির – সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করবেন। মুক্তি পেলে সামনে আরেক কাঠের দরোজা। দু’জন নির্বাক সশস্ত্র প্রহরী – তাঁরা কিছু জানতে চাইবেন না। আপনার গাড়ি, আপনার চেহারা – ভালভাবে নিরীক্ষণ করবেন – পাসপোর্ট বা ভিসা চেক করা নয়, এঁদের উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। বিনা বাক্যব্যয়ে আপনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আপনাকে সন্ত্রস্ত করা এবং গাড়ির গতিকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা। এইভাবে ডাইনে-বাঁয়ে মুড়তে মুড়তে একসময় আপনি দিকশূন্য হয়ে যাবেন। সেই সময়, হঠাৎ, উর্দি-পরা আরেক প্রহরীর আবির্ভাব হবে। আপনার ভাষাটি তাঁরা কেউ বলেন না।
সুপ্রভাত বা কালরাত্রি, এমন কোনো সম্ভাষণের প্রত্যাশা বাহুল্য-মাত্র। এবার তিনি ইঙ্গিত দিয়ে আপনাকে যাত্রার অনুমতি দিলে, শুরু হবে বাঘবন্দি খেলার দ্বিতীয় পর্ব। আপনার পথ ডান-বাঁ, বাঁ-ডান করে সে দেশে ঢুকে পড়েছে বলে যখন আপনি আশা করছেন, ঠিক সেই সময় আরেকটি পরীক্ষাগার পাবেন। এবার প্রহরী নয়। পাবেন সরকারি ইউনিফর্ম পরা, কোটের লেপেলে চকচকে তারা লাগানো দু’জন অফিসার। তাঁরা বসে আছেন কাঠের কুঠুরিতে, সামনের ঝাঁপটি খোলা। যতক্ষণ না এঁরা সরকারিভাবে পাসপোর্টে আগমনী ছাপ দিয়ে দেশে প্রবেশের অধিকার দিচ্ছেন, ততক্ষণ আপনি একটি খেলার ছকের বোড়ে-মাত্র।
যাত্রাপথের ঈদৃশ জটিলতা সৃষ্টি করার কারণ আছে। আপনি কোনোমতেই দ্রুতবেগে গাড়ি চালিয়ে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ অথবা ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গোছের গান গেয়ে এ সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন না। সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। মনে রাখা দরকার, পশ্চিম থেকে পুবে আসার পদ্ধতি যতই জটিল মনে হোক না কেন, পুব থেকে পশ্চিমে আসার নিরীক্ষণ আরও ভয়ানক। গাড়ির তলায় শুয়ে, অস্ত্র হাতে খুঁচিয়ে দেখা হবে – সেখানে কেউ লুকিয়ে আছে কিনা, তেলের ট্যাঙ্কে শুধু তেল আছে – না সাপ-ব্যাঙ ভরা আছে – তার তালাশি নেবেন। গাড়ির কলকব্জা তারা প্রায় খুলে ফেললে, মনে হবে এটা আবার জোড়া দেওয়া যাবে তো? কোনো রকমের সন্দেহ জাগলে, টাওয়ারে দাঁড়ানো সশস্ত্র প্রহরী গুলি ছুঁড়তে দ্বিধা করবে না। কিন্তু সে ঝুঁকি নেওয়ার কী প্রয়োজন?
সারা পূর্ব ইউরোপ জুড়ে দেখেছি কাঁটাতারের বেড়া, খানাখন্দ, কুকুরের পাল, ওয়াচ টাওয়ার। শ্রমিক-কৃষকের স্বর্গরাজ্যকে আগলে রাখার জন্য মানুষের তৈরি মানুষের কারাগার।
ছেলেটির নাম বেঞ্জামিন। ডাকনাম বেন। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পি পি ই বা পলিটিক্স ফিলসফি ইকনমিকস পাঠ সমাপন করে, সদ্য-উন্মুক্ত পূর্ব ইউরোপকে চাক্ষুষ করার জন্য তার এই অভিযান। জাহাজের টিকিট কেটে পৌঁছেছে ক্যালে। সেখান থেকে ফকিরি যাত্রা শুরু। হাত অথবা বুড়ো আঙুল (এটার অর্থ ইউরোপে সম্পূর্ণ উল্টো) দেখিয়ে অনুনয়-বিনয় করে বিভিন্ন সহৃদয় ড্রাইভারের গাড়িতে উঠেছে – ক্যালে থেকে বেলজিয়ামের লয়ভেন, আখেনে জার্মান সীমান্ত তারপর কলোন হানোভার দিয়ে বার্লিন। নিচু ক্লাসে যা জার্মান শিখেছিল, সেটা খানিক কাজে লেগেছে। ন'শ' কিলমিটার পার হয়ে বার্লিন পৌছতে দু’দিন। মোটরওয়ে-সংলগ্ন রেস্তোরাঁগুলি চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। সেখানকার চেয়ারে বসে ঘুমিয়েছে। এক সদাশয় জার্মান ভদ্রলোক ফ্রাঙ্কফুর্ট আন ডের ওডার যাচ্ছিলেন। এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছেন।
নো ম্যান’স ল্যান্ডের ও’পাশে পোলিশ চৌকি। লাল সাদা পতাকা উড়ছে। ১৯৯২ সালের পোলিশ সীমান্তে প্রাচীন জুজু নেই। তবে পুরোনো বাঘবন্দি খেলার ছক তখনো সম্পূর্ণ সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। তার খরচা আছে। অদূর অতীতে আমার কমিউনিস্ট ইউরোপীয় সীমান্ত অতিক্রম করার রোমহর্ষক কাহিনী বর্ণনা সহকারে বেনকে এই সব জটিল কল-কবজার ব্যবহার-পদ্ধতি বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
এই ভ্রমণ-শেষে বেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে নিতে পারবে। ‘পোলিশ সীমান্ত যাহা ছিল, এখন যাহা হইয়াছে’ গোছের একটা থিসিস ঝাড়া থেকে তাকে আটকায় কে? কৃতজ্ঞতা-স্বীকারের তালিকায় এক দাড়িওলা ভারতীয়ের নাম থাকবে, এমন দুরাশা আমার নেই।
পোলিশ চৌকি খুব কৌতূহলী চোখে আমাদের দেখল। গাড়ির নম্বর-প্লেটের আদ্যক্ষর বি অর্থাৎ বার্লিন। জার্মানিতে সেই অক্ষর দেখে রেজিস্ট্রেশনের ঠিকানা অনুমান করা যায়। চালকের চেহারা ইউরোপীয় নয়, পাসপোর্ট ব্রিটিশ। বেনের ব্যাপারটা সহজ। তার দেশের নাম ও মুখের চেহারার সঙ্গে পাসপোর্টটা মিলে যায়। এবার পরিচিতি-পত্র হাতে নিয়ে ছবির সঙ্গে আমার সাদৃশ্য অনুধাবনের চেষ্টা করেন সেই অফিসার। বহু দেশের অভিবাসন নিরীক্ষক আমার জন্মস্থান পদুমা নামক জায়গাটির সঠিক অবস্থান জানবার গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইনিও ছাড়লেন না। এটি ঠিক কোথায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বীরভূমের এক নগণ্য গ্রামকে অন্তত এক মিনিটের জন্য কত দেশে যে চিনিয়েছি! তারপর জিজ্ঞাসাবাদ, জার্মান ভাষায়, পোলিশ উচ্চারণে। বুঝতে অসুবিধে হয় না।
- কোথায় যাবেন?
- ঝাকশেভো।
- কেন? কী করেন?
- ব্যাঙ্কে কাজ করি। একটা মিটিং আছে সেখানে।
পরিষ্কার ভ্রূকুটি। এমন আজগুবি যুক্তি তাঁরা হয়তো আগে শোনেননি। সেখানে পড়াতে যাচ্ছি শুনলে মূর্ছা যেতেন।
- ঝাকশেভো কোথায় জানেন?
- গ্নিজনোর কাছে।
- গ্নিজনো ঠিক কোথায় জানেন?
- পজনান পেরিয়ে বলে তো জানি। এই আপনাদের ই-৩০ দিয়ে যেতে হবে। ম্যাপ আছে।
- পোলিশ মুদ্রা?
- নেই। তবে জার্মান মার্ক আছে। পজনানে বদলে নেব।
বেন আমার পাশে বসে আছে। তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, সে কী করে, কোথায় যাচ্ছে – এমন সব প্রশ্ন কেউ করলেন না। এ ব্যাপারে আগেই একটা রিহার্সাল করে রাখা উচিত ছিল!
দুই প্রহরীর পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময়। কী বুঝলেন কে জানে? বাক্যব্যয় না করে পাসপোর্টে ছাপ মারলেন।
- গুটে রাইজে (শুভ যাত্রা)
বেন খুব উৎসাহিত বোধ করল: পূর্ব ইউরোপে ঢুকে পড়েছি! আমার পাসপোর্টে পড়ল প্রাক-কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপীয় দেশের প্রথম স্ট্যাম্প!
কোনো সীমানা পেরিয়ে জার্মান অটোবান যখন অন্যদেশে ঢুকে পড়ে, তাদের সামগ্রিক জার্মান নাম হয়ে যায় অয়রোপাস্ত্রাসে। অতএব জার্মান এ-১২ দেশান্তরী হয়ে ই-৩০ নাম ধারণ করে। পোল্যান্ডে এই পথের একটি পোশাকি নামও আছে – মুক্তি পথ বা আজাদি সড়ক। নিশ্চিত হালে দেওয়া। এই পথ দিয়ে ৫৩ বছর আগে জার্মান ট্যাংক অন্য একটা বার্তা নিয়ে পোল্যান্ড ঢুকেছিল। সেটা মুক্তির নয়। নাৎসি অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জার্মানদের জন্য জমিজায়গা দখল করে উপনিবেশ গড়া (বসবাসের জন্য জমি – লেবেনসরাউম, ‘মাইন কাম্ফ’ পুস্তক দ্রষ্টব্য)। তারও কয়েকশ’ বছর আগে টিউটোনিক নাইটরা এসেছিলেন প্রথমে ধর্ম-সংস্থাপনা, বাণিজ্য-বর্ধন ও রাজত্ব-স্থাপনের উদ্দেশ্যে। ১৯৪৫ সালের পরে এই পথেই বাড়ি-গাড়ি-জমি ফেলে রেখে, ঝোলা হাতে নিয়ে, ঠেলা গাড়িতে গোটা সংসার চাপিয়ে, নতুন-পুরোনো সব ঔপনিবেশিক জার্মান পদব্রজে ফিরলেন বাপ-পিতেমোর দেশে। মোট সংখ্যা – পঞ্চাশ লক্ষ।
পোলিশরা জার্মান বিদায় সুসম্পন্ন করলে ’পর রাশিয়ানরা জানালেন – মহান সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতেই পোল্যান্ডের মুক্তি নিহিত।
মুক্তি, ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? মুক্তি কোথায় আছে?!
পথের দু’পাশে চরছে গরু। রাখালদের খেলতে দেখা গেল না। পেরিয়ে যাচ্ছি গ্রামের পর গ্রাম। কোনো শহর বা কল-কারখানার ধোঁয়া দৃশ্যমান নয়। বেনকে বললাম, এইসব গ্রাম ও শহরের একটা জার্মান নাম ছিল, জানো তো? বেন খুব উৎসাহিত হয়ে বলল, ঠিক! এটা ছিল পশ্চিম প্রাশিয়া। আর পজনান তার সদর শহর। জার্মান নাম পোজেন আর আপনি যে জায়গাটা খুঁজছেন, সেই গ্নিজনোকে প্রাশিয়ানরা বলত গেনেসেন!
ছেলেটা পড়াশোনা করে এসেছে!
বললাম, বেন, এটাও মনে রেখো, পোল্যান্ড তিনবার ভাগ হয়েছে! শেষবারের মত প্রাশিয়া/রাশিয়া/অস্ট্রিয়া তাদের ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার পরে একশ’ তেইশ বছর পোল্যান্ড নামক দেশের অস্তিত্ব ছিল না! জানো তো পোলিশ জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম পঙক্তি?
“এখনো পোল্যান্ড একেবারে হারিয়ে যায়নি!”
এমন বেদনাময় পঙক্তি দিয়ে আর কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয়েছে কি?
বেন খুব নিচু স্বরে বললে, ‘পোল্যান্ডের পুনর্জন্ম হয়েছে। প্রাশিয়ার নাম তো ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে বিলুপ্ত।’
বাইরে নভেম্বরের সূর্য টুপ করে ডুবে গেল।
দিনটা ছিল বড় সুন্দর, সূর্য-করোজ্বল, বাতাসে কিঞ্চিৎ উষ্ণতার ছোঁয়া। নভেম্বরের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে নামে অন্ধকার। গোধূলিবেলা নিতান্ত সীমিত।
পোলিশ ভাষা ল্যাটিন হরফে লেখা হয়, গ্রামগঞ্জের নাম পড়ার অসুবিধে নেই। বেন তার ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। সাইনবোর্ড দেখে পজনানের পেছনে ধাওয়া করতে করতে সেখানে পৌঁছনো গেল। বেন বলেছে, তাকে শহরের মাঝামাঝি নামালেই হবে। বেন যার আশ্রয় নেবে, তিনি পজনান টাউন হলের পাশের রাস্তায় থাকেন। বেনের আগমনবার্তা জানানোর কোনো উপায় নেই – মোবাইল নামক জরুরি বস্তুটি তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে ঠিকানা জানা আছে তার। বিধি আজ রাতে বেনের নামে যে শয্যা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, সেটি সে ঠিক খুঁজে নেবে। গত দু’দিন হট্ট মন্দিরে না হোক, কাষ্ঠ কেদারায় শুয়েছে!
পজনানকে ঘিরে আছে ওয়ারতা নদী, যাকে আমরা জার্মানে ভারতা (এ নামের ব্যাটারি আপনারা চেনেন!) বলে জানি। প্রাশিয়ান রাজাদের আমলে এর নাম ছিল পজনান দুর্গ (ফেসটুং পোজেন)। অনেক লড়াই, ধ্বংস এবং পুনর্নির্মাণের পরে তার আজকের চেহারা পুরোপুরি জার্মানিক। সন্ধ্যেয় টাউন হলের বাতিগুলি তাকে দিয়েছে অপূর্ব শোভা। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেন বিদায় নেবে। আমিও ভদ্রতার খাতিরে গাড়ি থেকে নামলাম। তৎক্ষণাৎ হাড় জমে গেল। সে আমলে গাড়িতে বাইরের তাপমান জানানোর যন্ত্র থাকত না। শার্ট পরে গাড়ি চালিয়েছি এতক্ষণ। বাইরের শীতলতা শূন্যের ২ ডিগ্রি নিচে!
দু’জনে গল্প চালিয়েছিলাম। এবার একা। পথ খুঁজতে হবে গ্নিজনোর। আরও উত্তর-পূর্ব দিকে। পজনানের মত বড় না হলেও, একটা শহর বটে। তার নাম কোথাও লেখা দেখছি না। ম্যাপটা কি আর কাজে লাগবে? মোটরওয়ে নয়, দু’দিক দিয়ে গাড়ি যায়-আসে। যে কোনো জায়গায় গাড়ির কাচ নামিয়ে, ঠান্ডা সহ্য করে, পথচলতি লোকের কাছে হদিশ খুঁজি। গন্তব্যস্থানের নামটি বলতে পারি মাত্র। আমি আর কোনো পোলিশ শব্দ জানি না। তাঁদের কেউ ইংরেজি জানেন না। শুধু বলি – ঝাকশেভো? গ্নিজনো? সেই পথচারী হাত দেখিয়ে, আঙুল দিয়ে এবং অবোধ্য পোলিশ শব্দ ব্যবহার করে – এই পথভ্রষ্ট বিদেশিকে সঠিক নিশানায় প্রেরণ করার দুঃসাধ্য প্রয়াসে ব্রতী হয়।
পদাতিকের কমতি নেই সেই সন্ধ্যের পথে। এক অল্পবয়সি ছেলেকে পেলাম। ইংরেজি-জার্মান মিশিয়ে জানাল, সে ঝাকশেভোর নাম শুনেছে। গ্নিজনোর পথ প্রশস্ত, কিন্তু সেদিক দিয়ে গেলে দূর পড়বে। অন্য পথ ধরা সমীচীন। ঝাকশেভো এত ছোট গ্রাম, যে আপাতত সেটার নিশানা কোনো সাইনবোর্ডে মিলবে না। আমি যেন জলতভ (জার্মানে ফ্লোটোভ) নামের একটি মাঝারি জনপদের নাম দেখে চালাই। জলতভের পরেই ঝাকশেভোর দিশা পাওয়া যাবে। তার নির্দেশমত গাড়ি চালালাম। পথ নির্জন নয়, কিন্তু অন্ধকার। রাস্তার ওপরে বাজার-দোকানের যে বিচ্ছুরিত আলো দেখতে আমরা অভ্যস্ত, সে আমলের পোলিশ গ্রামের পথে তা ছিল না – কোনো দোকান, পেট্রোল স্টেশন বা সুপার মার্কেট – কিছুই নেই। দূরে কোথাও আছে সমবায়িকার র্যাশন দোকান। রাস্তার ধারে স্ট্রিট ল্যাম্প নেই। দু’ কিলোমিটার যাই, গ্রামের বাড়ির আলো দেখলেই গাড়ি থামাই, আবার জিজ্ঞেস করি। তাঁদের হাতের ইঙ্গিত দেখে আর মুখের ভাষা শুনে তিনটি পোলিশ শব্দ শিখে ফেললাম প্রাভো – ডাইনে, লেভো – বাঁয়ে আর প্রসতো – সোজা।
এক সময় মনে হল, সব রকম নিশানা প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। মোবাইল ফোন বা গ্রামের রাস্তার টেলিফোন বুথ – কোনোটাই নেই। নেই কোনো পোলিশ মুদ্রা। সেই যে হেলায় পোল্যান্ড জয় করব বলে পণ করেছিলাম, তার মাশুল দিচ্ছি! সন্ধে থেকে রাত। নানান মানুষের নানান নির্দেশ শুনতে শুনতে এক সময় জলতভ গ্রামে উপনীত হলাম। আবার সেই কাচ নামানো। ঠান্ডা হাওয়ার ঝটকা। এবারে শুনলাম একটি মধুর শব্দ – ঝাকশেভো? তাম! ঐ তো! এই রাস্তার শেষে, প্রাভো, ডাইনে!
এক সন্ধেয় চারটে পোলিশ শব্দ শেখা হয়ে গেল।
অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে উপনীত হলাম অচেনা অজানা অন্ধকার একটি গ্রামের একমাত্র আলোকিত প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে।
ঝাকশেভো।