এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  ইতিহাস  শনিবারবেলা

  • পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি – ক্রোয়েশিয়া ৩

    হীরেন সিংহরায়
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১৮ জুন ২০২৩ | ১৪৮৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • আদালতে এডু


    বাহুবলীর প্রবঞ্চনা – দুই



    ক্রোয়েশিয়ার শিক্ষা

    রিয়েচকা বাঙ্কা

    সিটি ছেড়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে এসেছি। শহর এক, ঠিকানা অন্য। এশিয়া আফ্রিকা আরব সাগর এলাকার উন্নয়নশীল দেশগুলিতে চুটিয়ে বাণিজ্য করছি কিন্তু পূর্ব ইউরোপীয় ব্যাবসায়ে আমার নতুন ব্যাঙ্ক তেমন আগ্রহী নয়। অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য যে দেশে কখনো ইউনিয়ন জ্যাক ওড়েনি সেখানে দোকান খোলায় আমাদের গভীর অনীহা। যোগাযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে।

    একদিন আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগের গর্ডন ফোন করে বললে, সে দেখা করতে চায় আমার চার তলার অফিসে। গর্ডন গ্লাসগোর ছেলে। না হেসে কোনো কথা বলতে পারে না। একবার তার স্কটিশ উচ্চারণের সঙ্গে সড়গড় হয়ে গেলে দারুণ আড্ডা দেওয়া যায়। অবাক লাগল। দিনের মধ্যে তার ডেস্ক ছেড়ে আমার কাছে আসতে চায় কেন? তার প্রাণ মন সাধন হল ওই ট্রেডিং ডেস্ক। সেখানেই পয়সা বানায়, পয়সা লোটায়। লাভ লোকসান যাই হোক বিকেল পাঁচটার পরে পানশালায় তার আবির্ভাব অবশ্যই নির্ধারিত -আমাদের দেখা সাক্ষাৎ সেখানেই হত।

    স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার জলপাইগুড়ি অফিসে আমাদের কোষাধ্যক্ষ সজনীবাবু বাজারের খবর রাখতেন। সে আমলে বার ছিল না- ব্যাঙ্কের সামনে আমগাছের তলায় মোহনদার চায়ের দোকান ছিল, পুলিস মোড়ে পানের দোকান ছিল। ব্যাঙ্কে টাকা তুলতে বা জমা দিতে এসে মানুষজন ক্যাশ বিভাগের লোকেদের সঙ্গে গল্প গুজব করতেন ফলত। সেই বিভাগকে অনায়াসে স্থানীয় তথ্য এবং গুজব সম্প্রসারণ কেন্দ্র নামে অভিহিত করা যায়। তাবৎ ইনফরমাল ইনফরমেশন ছেঁকে সজনীবাবু তথ্যের স্বর্ণ আহরণ করেছেন। অনেক পরে যেটাকে গোল্ডম্যান বা সিটি ব্যাঙ্কের তাবড় অফিসাররা মার্কেট ইনটেল বা মার্কেট রিড বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন সেটার সঙ্গে সজনী বাবু আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মেনে নিচ্ছি সজনীবাবুর বাজারি খবর জলপাইগুড়ি শিলিগুড়ির মধ্যে সীমায়িত থাকত—কিন্তু মূল ব্যাপারটা একই। এক ব্যাঙ্কের ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রেডারের সঙ্গে আরেক ব্যাঙ্কের ট্রেডারের যে ফোন সংলাপ হয় তার ভেতরে অনেক প্রকারের মাণিক্য লুক্কায়িত থাকে। কর্পোরেট অফিসের বড় সায়েবদের সঙ্গে ফর্মাল, সৌজন্যমূলক আলাপ আলোচনা করে এবং বার্ষিক বা ষাণ্মাসিক হিসেবের খাতা খুঁটিয়ে দেখে আমরা কর্পোরেটকে যাচাই করি। সে কর্পোরেট দাঁড়িয়ে থাকে ব্যাল্যান্স শিটের ওপারে, আমাদের অ্যানালিসটরা অবধি তার চরণ পায় না। ট্রেডারের কোন আইন কানুন নেই—নাফাই একমাত্র প্রোটোকল।

    আজকাল ফোন রেকর্ডিং শুরু হওয়ার ফলে এই ব্যক্তি স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়েছে। তবে সন্ধ্যা রজনীতে পানশালার বার্তা রেকর্ড হয় না।

    গর্ডন অফিসে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল, “একটা কথা আছে। সিটি ব্যাঙ্কের সময় পূর্ব ইউরোপে ব্যাবসা করেছ জানি। ক্রোয়েশিয়ার রিজেকা (বেশির ভাগ ইউরোপীয় ভাষায় জে অক্ষরের উচ্চারণ ওআই কিন্তু অ্যাংলো স্যাক্সন উচ্চারণে রিয়েকা রিজেকা হয়ে যায়) বাঙ্কার নাম শুনেছ? জার্মান ব্যাঙ্কের সঙ্গে তোমার খুব ওঠা বসা জানি। বায়ার্ন এল বি তে চেনা আছে?” আমি বললাম, “আমাকে এ সব কথা জিগ্যেস করে নিজেকে লজ্জিত কোরো না। রিয়েচকা বাঙ্কা ভালো চিনি না। তবে বায়ার্ন এল বি চিনি। অনেক দিন। কী ঘটনা কী রটনা? ঝেড়ে কাশো (স্পিট ইট আউট)”।

    রিয়েচকা বাঙ্কায় বিদেশি মুদ্রা কেনা বেচার এক ব্যাবসায়ী আছে, তার নাম এডুয়ার্ড নোডিলো, এডু নামে পরিচিত। সে সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড লন্ডনের সঙ্গে প্রচুর ব্যাবসা করছে।



    এডুয়ার্ড নোদিলো - ফরেন এক্সচেনজ ডিলার রিয়েচকা বাংকা - টিভি টক শো


    এতে তো আমাদের খুশি হওয়ার কথা?

    গর্ডন বললে, “দুটো কথা – প্রথমত এই এডু নামক ব্যক্তিটি যে সব বিদেশি মুদ্রার কারবার করছে আর যে পরিমাণে করছে তাতে ধন্দ জাগে। মনে হচ্ছে ডলারে সে এমন একটি অবস্থিতি (পজিশন) নিয়েছে যে সেটাকে ঢাকার (কভার) জন্য অন্যান্য বিদেশী মুদ্রায় একটা খেলার জাল ছড়িয়েছে – যাকে আমরা বলি ক্রস কারেন্সি সোয়াপ। আমরা রিয়েকা বাঙ্কাকে যতটুকু চিনি তাতে প্রশ্ন জাগে তারা এই সব উদ্ভট মুদ্রার বাজারে ঢুকছে কেন? এক ক্রোয়েশিয়ান ব্যাঙ্কের কোন বাণিজ্যিক প্রয়োজন তাতে?”

    কথাটা পুরোপুরি মেনে নেওয়া শক্ত। এককালে ব্যাঙ্ক তার খদ্দেরের প্রয়োজন অনুযায়ী বিদেশি মুদ্রা কিনতো বা বেচত, তার দর ছিল নির্ধারিত (ফিক্সড রেট আমি যখন স্কুলে পড়ি এক ডলারের দাম ছ টাকায় বাঁধা ছিল)। আপনি ডলার চান, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি কিনবেন বলে অথবা আপনার ক্রেতা তার মূল্য ডলারে চোকাবে – সেই মতন ব্যাঙ্ক ডলারের কেনাবেচা করতো। ১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট আমেরিকান সরকার এক আউন্স সোনার বদলে ৩৫ ডলার দেওয়ার দায় থেকে নিজেদের মুক্তি ঘোষণা করলে বিদেশি মুদ্রার নির্ধারিত দরের সমাপ্তি ঘটে। বিভিন্ন মুদ্রার পারস্পরিক দর স্থির হল বাজারের সরবরাহ ও যোগান অনুযায়ী - শুরু হলো ট্রেডিং। তাই রিয়েচকা বাঙ্কা কেন সুইডিশ ক্রোনার বা সৌদি রিয়াল কিনছে বা সুইস ফ্রা বেচছে তা নিয়ে কার কী মাথাব্যথা? আমাদের ব্যাঙ্কের অবশ্য কোনো ঝুঁকি নেই। কারবার সুরক্ষিত।

    গর্ডন থামে না – হঠাৎ স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের সঙ্গে ব্যাবসা বাড়াচ্ছে কেন? আমরা তাদের নিয়মিত ব্যাংকার নই। তার মানে কি অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক মুদ্রা কেনাবেচার যে সীমা (লিমিট) রিয়েচকা বাঙ্কাকে বেঁধে দিয়েছে, সেটি অতিক্রান্ত? গরডনের সন্দেহ এই এডু নামক লোকটি তার নিজের ব্যাঙ্কের অনুমোদিত লিমিটের বাইরেও কেনাবেচা করছে। এটা তার ব্যাঙ্কের ওপরওলাদের অথবা মালিক বায়ার্ন এল বি কে হয়তো জানানো উচিত। গর্ডন সেটা পারে না, কারণ সে বিদেশি মুদ্রার ট্রেডার মাত্র—তার দুটো পয়সা হচ্ছে। বাজারে তাকে করে কম্মে খেতে হবে। অপর পক্ষ আইন মেনে কাজ করেছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব সে ব্যাঙ্কের লোকেদের। ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা তাদের নিশ্চয় আছে। এখানে বেমক্কা প্রতিবাদ করে নিজের ব্যাবসা ও আখেরের ক্ষতি গর্ডন কেন করবে। আমরা কি বিদেশি মুদ্রা বাজারের চৌকিদার নাকি?

    গর্ডনকে আমি খুব পছন্দ করি। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত সেন্ট অ্যানড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক (এখানে পাঠকালে ব্রিটেনের রাজকুমার উইলিয়াম কুমারী কেট মিডলটনের প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়েছিলেন)। লাভ লোকসানের বাইরের জীবন নিয়েও ভাবে। আমাদের আরও কিছু মিল আছে – আমি সপ্তাহান্তে ছেলে মেয়েকে দেখতে পাই গোলডার্স গ্রিনেই, গর্ডন গ্লাসগো উড়ে যায় শুক্রবার বিকেলে, সোমবার ভোরে ফিরে আসে।

    শেয়ার বাজারে অথবা বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার ব্যাবসায়ে যারা গোলমাল পাকিয়েছেন, তাঁরা সবাই বড়লোক হবার জন্য করেননি। নিক লীসন নামের এক ইংরেজ যুবক জাপানি স্টক এক্সচেঞ্জে ফাটকা খেলেছিলেন তিনি অন্যদের চেয়ে বাজার ভালো বোঝেন এই অহংকারে – পাশার দান উলটে গেলে লন্ডনের তিনশো বছরের পুরনো বেয়ারিং ব্রাদারস ডকে উঠল। এই ধরুন বিদেশি মুদ্রা ব্যাবসায়ে এক কারবারি মনে করলেন এক মাসের মধ্যে ডলারের বিনিময় মূল্য কমে যাবে। তিনি দশ লক্ষ ডলার অগ্রিম অন্য ব্যাপারীকে বেচলেন। তাঁর হাতে কিন্তু সেই পরিমাণ ডলার নেই। দশ লক্ষ ডলার দেবার এক মাস সময় আছে এবং তিনি আশা করছেন ডলারের দাম কমবে – অর্থাৎ শর্ট সেলিং এর সুযোগ। তাই আজ থেকে দু-তিন সপ্তাহ বাদে বাজার থেকে স্বল্প মূল্যে দশ লক্ষ ডলার কিনে তিরিশ দিনের মধ্যে সেটি প্রাপককে দেবেন। লাভ শুভ। শুভ লাভ। শেয়ার বাজারের ব্যাপারী এই একই খেলা খেলেন – সম্প্রতি হিন্ডেনবুর্গ যা করলেন। এক্ষেত্রে আপনি, সুধী ব্যক্তি, বেমক্কা প্রশ্ন করতেই পারেন – যদি ডলারের বিনিময় মূল্য না কমে তাহলে তো অশুভ ক্ষতি। সে শঙ্কা যুক্তিযুক্ত।

    জুয়োর নেশা কঠিন। শুনলে পেত্যয় হবে না ১৯৯৪ সালে আমরা ওয়ারশ, পোল্যান্ডে এক ট্রেডারকে শর্ট সেল করতে দেখি – তার কোনো ভেতরের খবর আছে ডলারের দাম অচিরে কমবে।

    যে কোনো ব্যাঙ্ক তার ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রেডারের কারবারি সীমা বেঁধে দেয়—কাঁচা, নভিস ট্রেডারকে দেওয়া হয় দৈনিক বা ইনট্রা ডে লিমিট; ধরুন সকাল দশটা নাগাদ সে চেজকে দশ মিলিয়ন ডলার বেচল। বাড়ি ফেরার আগে তাকে অন্তত দশ মিলিয়ন ডলার কিনে তার খাতা মিলিয়ে যেতে হবে (স্কোয়ারিং দি পজিশন)। দিনের মধ্যে সে যদি আর কোনো কেনাবেচা না করে থাকে, তাহলে তার লাভ বা লোকসান হবে ঐ দশ মিলিয়ন ডলারের কেনা ও বেচা দামের পার্থক্য। যত সে অভিজ্ঞ বা কাজে দঢ় হবে, ব্যাঙ্ক তাকে আরও বেশি সময়ের জন্য ঝুঁকি নেওয়ার অনুমতি দেবে, যেমন একদিনের লিমিট – ওভারনাইট। আজ উধার কল বরাবর। প্রশ্ন করতেই পারেন সে রাতে ঘুমোয় কী করে – তার কেনা দামের সঙ্গে বেচার দামের বিস্তর ফারাক হতে পারে! তাহলে পোক্ত ট্রেডারের কথা ভাবুন যিনি সাতদিন বা এক মাস অবধি অবধি তাঁর খাতাটি খোলা রাখেন (রানিং অ্যান ওপেন পজিশন)। বিভিন্ন মুদ্রায় ব্যাপারীদের প্রাত্যহিক অবস্থান (ডেলি পজিশন) নিরীক্ষণ করার জন্য আধিকারিক নিযুক্ত থাকেন। কোনো ট্রেডার কোনো মুদ্রায় অতিরিক্ত ঝুঁকি নিচ্ছেন কি না—সেটির সম্যক পর্যবেক্ষণ করা তাঁর কাজ। তবে এই পাহারাদারির কাজে ব্যত্যয় হয়েছে, হচ্ছে, হবে। মানুষের ভ্রান্তির জন্য মেশিন নয়, মানুষই দায়ী!



    উল্লাসের আগে

    উল্লাস - অক্টোবর ফেসট মিউনিক


    সিটি ব্যাঙ্কে আমার এক শুভানুধ্যায়ী ডেনিস আইখেনব্যারগার বলেছিলেন—যখন কোনো বিষয় জানতে কাউকে ফোন করবে, মোদ্দা কথাটা প্রথমেই বোলো না। আবহাওয়া, আগের দিনের ফুটবল ইত্যাদি বাজে কথা বলার পর হঠাৎ যেন মনে পড়ল—এমনিভাবে তোমার আসল প্রশ্নটি করবে। মেঘের আড়ালে মেঘনাদ! গুরু বাক্যি স্মরণ করে মিউনিকে আমার খুব চেনা মানুষ, অনেক অক্টোবর ফেসটে বিয়ার পানের সঙ্গী, এবারহারড এবারলেকে ফোন করলাম। এক বছর আগে রিয়েচকা বাঙ্কার আন্তর্জাতিক ঋণে অংশ না নেয়ায় সে একটু ক্ষুণ্ণ হয়ে ছিল। তবে আমি তো এখন অন্য ব্যাঙ্কে। সে অপরাধ স্খালন হয়ে গেছে। এ কথা সে কথা – বায়ার্ন মিউনিকের চ্যাম্পিয়ন না হবার জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে জানালাম আমাদের গপ-শপ কমে যাওয়ার কারণ সিটি ব্যাঙ্কের তুলনায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক পূর্ব ইউরোপে তেমন ব্যাবসা বানিজ্য করে না। তবু বায়ার্ন এল বির মালিকানাধীন রিয়েচকা বাঙ্কার সঙ্গে আমাদের বিদেশি মুদ্রার ব্যপারীরা প্রচুর বাণিজ্য করছে। আমার মনে হয় একটু বেশি মাত্রায় করছে। সে ব্যাবসা আমার আওতায় পড়ে না তবে তুমি জানলে হয়তো খুশি হবে!

    সঠিক প্রতিক্রিয়া হল। এবারহার্ড ঘোড়েল ছেলে।

    “ডলার / ইউরো না ডলার বনাম অন্যান্য মুদ্রা?”

    জানালাম দ্বিতীয় অনুমানটি সত্য। এবারহার্ড সোজা জিগ্যেস করলে, “আমার মুদ্রার ব্যাপারী তোমার লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারে কি?”

    সেটাই আমার উদ্দেশ্য। যোগাযোগ করানো!

    কেবলমাত্র সত্যান্বেষী গর্ডনের এলেমের দরুন এই বিরাট জুয়ো খেলাটি ধরা পড়ল এমন দাবি সে কেন আমাদের ব্যাঙ্কও করেনি। আমরা ছাড়া অন্যান্য কিছু ব্যাঙ্কের ট্রেডার এমন সন্দেহ পোষণ এবং ব্যক্ত করেছিলেন। আমাদের মত তাঁদেরও ধারণা ছিল রিয়েচকা বাঙ্কার জার্মান মালিক যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করছেন। কেউ কেউ ব্যাঙ্কের স্থানীয় কর্ম কর্তাদের কাছে নাকি সন্দেহ ব্যক্ত করেন – উত্তরে তাঁদের বলা হয় আল ইজ ওয়েল।



    বায়ারিশে লানদেসবাংক ব্রিয়েনার স্ত্রাসে মিউনিক


    দাল মে কুছ কালা হ্যায় যারা বলেন তাঁদের আমরা সামগ্রিকভাবে বংশীবাদক—হুইসলব্লোয়ার—আখ্যা দিয়ে থাকি, যুগে যুগে তাঁদের দেখা পাওয়া গেছে। খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁদের কথা মানুষ শুনেছে। তবে এক্ষেত্রে বাজারি কানাকানির ভিত্তিতে মিউনিকের টনক নড়ে। তাঁদের তাড়ায় অতি দ্রুত রিয়েচকা বাঙ্কার তদন্তকারি অফিসাররা খাতাপত্র দেখে আবিষ্কার করলেন সব্বোনাশ, এডুয়ার্ড নদিলো বিগত চার বছর (১৯৯৮ থেকে) ডলারের দামের ভবিষ্যৎ নিয়ে ফাটকা খেলেছেন। অনেক লোকসান লুকিয়ে রেখেছিলেন বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রার ব্যাবসায়ের আবরণে—তাঁর বসেরা টের পাননি। বয়েস ৫০। মুখে সব সময় প্রজ্বলিত সিগারেট। বাক্যালাপে পটু। থাকতেন একটি দু-কামরার ছোট ফ্ল্যাটে, ঝরঝরে টয়োটা গাড়ি চালাতেন। বেতন আটশো ডলারের মত। স্থানীয় রেডিওতে টক শো করতেন, বিভিন্ন মুদ্রার ওঠা নামার ব্যাপারে সাপ্তাহিক ভবিষ্যৎবাণী (ফোরকাস্ট) দিয়ে পত্রিকায় কলাম লিখতেন। এডুর ট্রেডিং জনিত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় এগার কোটি ডলার। রিয়েচকা বাঙ্কার মূলধনের চেয়ে বেশি। সদ্য উন্মুক্ত পূর্ব ইউরোপের বাজারে বৃহত্তম ট্রেডিং লস।

    এমতাবস্থায় সকলের দৃষ্টি পড়ল রিয়েচকা বাঙ্কার দুই তৃতীয়াংশের মালিক, বাভারিয়ান সরকারের আপন ব্যাঙ্ক, বায়ার্ন এল বির প্রতি। আপাতকাল সঙ্কেত দেখা দিলে নতুন মালিকের রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়ার কথা। ক্রোয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ বললেন, তদন্ত হলো। এবারে আপনারা হাল ধরুন, কমিউনিস্ট অর্থ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সবে যারা খোলা বাজারে কারবার করতে নেমেছেন তাদের ভুল ভ্রান্তি হতেই পারে—সহি রাস্তা দেখান। মিউনিক থেকে আরও উচ্চ পদের মানুষজন এলেন পর্যবেক্ষণে। গুচ্ছের মিটিং করে ক্রোয়েশিয়ান সরকারকে জানালেন ঢের হয়েছে। রিয়েচকা বাঙ্কা তাঁরা আর চালাতে চান না – সরকারকে ফেরত দেবেন। ক্রোয়েশিয়ান সরকার অত্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে দাম জানতে চাইলে বায়ার্ন এল বি সরকারকে বলেন, ‘আমরা আশি মিলিয়ন ডলারে কিনেছিলাম, আপাতত এক ইউরো পেলেই বেচে দিই’। নামমাত্র বলে যে শব্দটি এতদিন শুনে এসেছি, তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করলাম। একটি ইউরো ক্রোয়েশিয়ান সরকারের হাতে তুলে দিয়ে যাক যা গেছে তা যাক বলে জার্মান ম্যানেজারবর্গ রিয়েকা ছেড়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন। তাঁদের এ ক্ষতির ভাগ বদান্য বাভারিয়ান সরকার এবং ততোধিক বশংবদ করদাতা বহন করবেন – পালাবার পথ নাই তাদের।



    লোগো বাভারিয়ান লানদেসবাংক


    কথা না শুনলে আমার বাবা রেগে গিয়ে বীরভূমের ভাষায় বলতেন, “বুঝে কর গা যেঁইয়ে”। মিউনিকের জ্ঞানী ব্যাঙ্কাররা প্রায় সেই রকম কিছু হয়তো বললেন ক্রোয়েশিয়ান সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে।

    মিউনিকের ক্রেডিট কর্তাকে জিগ্যেস করেছিলাম সিটি ব্যাঙ্ক রিয়েচকা বাঙ্কাকে ঋণ দিতে রাজি হলে বায়ার্ন এল বি কি জামিন দেবেন? তার উত্তরে শুনেছিলাম জামিন দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বাভারিয়ান সরকারের ব্যাঙ্ক বায়ার্ন এল বি। আর রিয়েচকা তো তাদেরই ব্যাঙ্ক – অর্থাৎ ঘুরে ফিরে রিয়েচকা বাঙ্কার পেছনে রয়েছে বাভারিয়ান সরকারের অন্তর্নিহিত সুরক্ষা (ইমপ্লিসিট সাপোর্ট)। আপনাদের কিসের চিন্তা?

    সিটি ব্যাঙ্কের আর্ট গ্র্যান্ডি বলেছিলেন, ঐ অন্তর্নিহিত সুরক্ষার গোপন কথাটি গোপনে না রেখে প্রকাশ্যে কবুল করুন! হু গট ইউ!

    সর্বনাশে সমুৎপন্নে অরধং ত্যাজতি পণ্ডিতঃ! এক্ষেত্রে সর্বস্ব, মতান্তরে আশি মিলিয়ন ডলার, তার সঙ্গে আরও কিছু ত্যাগ করে পশ্চিমি খোলা বাজারের নায়করা মিউনিকে পলায়ন করলেন। সাল ২০০২ – জার্মানির ষোলটি লান্দেসবাঙ্ক চলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশ্য সমর্থনে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আজ্ঞা পালন করে ক্রোয়েশিয়া তার তাবৎ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করেছে।

    পশ্চিমি বাহুবলীর প্রবঞ্চনা দেখে ক্রোয়েশিয়ার খোলা বাজারি অর্থনীতির শিক্ষা হয়তো সম্পূর্ণ হল।

    পরিশিষ্ট

    এক
    পরের বছর, ২০০৩ সালে অস্ট্রিয়ার এরস্তে উনড স্টাইয়ারমেরকিশে বাঙ্ক রিয়েচকা বাঙ্কের ৫৫% অংশ কিনে নেয় – দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যাবসায়ে ক্রোয়েশিয়ান সরকারের অংশ নেমে হল ৫.২%। সকল শর্ত মিটিয়ে আঠাশ নম্বর সদস্য হিসেবে ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় ২০১৩ সালে।

    দুই
    তখন পশ্চিমের খোলা বাজারে

    ক্রেদি লিওনে
    ১৮৬৩ সালে অঁরি জেরমাঁ দ্বারা লিওঁ শহরে প্রতিষ্ঠিত ক্রেদি লিওনে ব্যাঙ্ক অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ফ্রান্সের দক্ষিণ পূর্বের অভ্যারনিয়া-রোন- আলপ অঞ্চলে তাদের শাখা প্রশাখা বিস্তার করে। ব্যাঙ্কের প্রথম তিনটি বিদেশি শাখা খোলা হয় মিশরের কাইরো এবং পোর্ট সায়েদে ( ১৮৬৯ সালে ফরাসি ব্যবস্থাপনায় নির্মিত সুয়েজ খাল উদ্বোধন হওয়ার অব্যবহিত পরে ) এবং সেন্ট পিটারসবুরগে। প্যারিস নামক শহরে শাখা খোলা হয় অনেক পরে। ১৯০০ সাল নাগাদ ব্যাল্যান্স শিটের আকার অনুযায়ী ক্রেদি লিওনে দুনিয়ার পয়লা নম্বর ব্যাঙ্কের জায়গা দখল করে।।

    আপনারা অনেকে প্লাটুন বা র‍্যামবোর মত ফাটাফাটি হলিউডি ছবি দেখেছেন। ছবির শেষে টাইটেল প্রায় অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে - দ্বিতীয় ক্যামেরাম্যান, সিলভেস্তার স্ট্যালোনের মেকাপ ম্যান, ক্যান্টিন ম্যানেজার ইত্যাদির নাম জানার ব্যাপারে আপনার কোন আগ্রহ না থাকাই স্বভাবিক। তবে নিতান্ত কৌতূহলবশত দেখলে একটা বিচিত্র বস্তু আবিষ্কার করতেন – এই সব ছবির ফাইনান্সিং করেছে ক্রেদি লিওনে, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ফরাসি ব্যাঙ্ক।

    সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রথম ছবি শেষ করতে পারছেন না টাকার টানাটানিতে; সে খবর পেয়ে ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়ের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার হাল ধরলেন। পথের পাঁচালী ছবি প্রযোজনা করে সরকার পরবর্তী বহু প্রজন্মের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ফিল্ম তৈরির এই ব্যয় কোন মন্ত্রকের খাতে বরাদ্দ হতে পারে তা জিজ্ঞেস করা হলে ডক্টর রায় নাকি অবলীলাক্রমে বলেছিলেন, ‘ বইয়ের নাম যখন পথের পাঁচালী ওটা পি ডব্লিউ ডি কে ধরিয়ে দাও –ওরা তো পথ ঘাট বানায়! যতদূর জানি ওদের তহবিলে কিছু রেস্ত পড়ে আছে’। ’

    সেটা ব্যতিক্রম – পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও লাইনে আর কখনো যান নি।

    আমার সময়ে দেশে ষ্টেট ব্যাঙ্ক ইন্ডিয়া অথবা পরে লন্ডনে সিটি ব্যাঙ্ককে চলচ্চিত্র ব্যাবসায়ে অর্থ নিবেশ করতে দেখিনি। হলিউডে ক্রেদি লিওনের অফিসারকূল ছবির স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত দেখতেন বলে শোনা গেছে। ফরাসী ভাষার ছবি হলেও না হয় কথা ছিল ; এমনকি প্যারিসের কফি হাউসের বিজ্ঞজন সংস্কৃতির সম্প্রচারের খাতিরে সেটাকে মেনে নিতে পারতেন। কিন্তু র‍্যামবোর মতন রগরগে সনসনিখেশ ছবি বক্স অফিসে পয়সা কামালেও ফ্রান্সের নাম উজ্জ্বল করে নি – পরবর্তী অনেক ছবি চলে নি। চললেও লাভের গুড় কোন পিঁপড়েয় খেয়েছে তার হিসেব মেলে নি। বছরের পর বছর নানাবিধ ব্যাবসায়ে অসফল হয়ে, নতুন নতুন পন্থায় অজস্র অর্থ অপচয় করে এবং হলিউডের ফিল্ম প্রযোজনা জনিত বিপুল ক্ষতিতে জর্জরিত হয়ে ক্রেদি লিওনে একদিন সরকারের পদপ্রান্তে মাথাটি রাখে। ফরাসি সরকার তাদের অভয় এবং চারশ কোটি ডলার দিয়ে কোলে তুলে নেন। এই প্রকার ফরাসি বালখিল্যতায় নিতান্ত বিরক্ত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরকারি মালিকানা নামক ল্যাঠাটি চোকাতে আদেশ দেন। ২০০২ সালে বেসরকারিকরন হয় – ফরাসি প্রশাসন হাতে রাখল ১৬% শেয়ার। তার ক বছর আগে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাঙ্কের প্রধান অফিস পুড়ে গিয়ে ৭০% নথিপত্র ভস্মীভূত হয়।

    কাকতালীয়?

    ব্যাঙ্ক অস্ট্রিয়া / ক্রেডিট আনসটালট ভিয়েনা
    অস্ট্রিয়ান সরকারের মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণ প্রয়াস চলে বহুদিন ধরে। এক সময় ( ১৯৯৫) সুইজারল্যান্ডের ক্রেডি সুইস কিনতে চায় ক্রেডিট আনসটালট – দু-পক্ষের আলাপ আলোচনা বেশ এগিয়েছে এমন সময় পুরো ব্যাপারটা বানচাল হয়ে গেল। অস্ট্রিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর, মারিয়া শাউমায়ার ঘোষণা করলেন তিনি চান ক্রেডিট আনসটালটের শীর্ষে অস্ট্রিয়ান পতাকা উড়ুক। এই প্রখর জাতীয়তাবাদের ঠেলায় সুইস ব্যাঙ্ক ল্যাজ গুটিয়ে জুরিখ প্রস্থান করে -ফল যথা পূর্বম তথা পরম। ভিয়েনা ইলেক্ট্রিসিটিকে এ ব্যাঙ্ক বেচে দেওয়ার প্রস্তাবও উঠেছিল – কেউ মনে করিয়ে দিলেন বললেন সেটাও যে সরকারি সংস্থা! অস্ট্রিয়ান সরকার এবারে আরেক উদ্ভাবনী চিন্তার পরাকাষ্ঠা দেখালেন –দুটি সরকারি মালিকানার ব্যাঙ্ক মিলে মিশে এক হল। মানে দুটো সরকারি ব্যাঙ্কের জায়গায় একটা বিশাল সরকারি প্রতিষ্ঠান- ক্রেডিট আনস্টালট – বাঙ্ক অস্ট্রিয়া – বি এ সি এ! কয়েক দশকের ব্যর্থ প্রয়াসের শেষে ২০০৫ সালে ইতালিয়ান ব্যাঙ্ক ইউনিক্রেডিট বি এ -সি এ কিনে নিয়ে সরকারের বিড়ম্বনা মেটায়। এই অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কের শিখর দেশে এখন ইতালিয়ান পতাকা ওড়ে।

    জার্মানি
    ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন খোলা বাজারের ঝাণ্ডা ওড়াচ্ছে আর ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের জন্য পূর্ব ইউরোপীয় সরকারদের নিয়মিত চেতাবনি দিচ্ছে। জার্মান সরকাররূপি সুপারম্যানকে চার দশক যাবত বলা হয়েছে তাবৎ ষ্টেট ব্যাঙ্কের (লান্দেসবাঙ্ক) সরকারি গ্যারান্টি বা কবচটি ছিনিয়ে নিতে। নানা প্রকারের গড়িমসি করে শেষ অবধি ২০০৫ সালে বার্লিন প্রশাসন লান্দেসবাঙ্ক গুলিকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর হুকুম দেওয়া মাত্র একাধিক লান্দেসবাঙ্ক হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়তে আরম্ভ করে – ষোলটি ব্যাঙ্ক কমে আজ ছটিতে দাঁড়িয়েছে।


    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৮ জুন ২০২৩ | ১৪৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১৮ জুন ২০২৩ ২০:১৪520481
  • এই সজনীবাবুর কথা আপনার 'আমার জার্মানি' বইয়ের প্রথমেই আছে। এখানে দেখেই মনে হল আরে এঁর কথা পড়েছি ত, চিনি এঁকে। wink
     
    অতি লোভে তাঁতি নষ্ট প্রবাদটা বোধহয় ব্যাঙ্ক ডোবার ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে প্রযোজ্য। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৮ জুন ২০২৩ ২০:৫১520482
  • ধন্যবাদ জানাই আমার জারমানি পড়ার জন্য । চার দশকের বিদেশি ব্যাংকিং দেখেও অভিভূত হতে পারলাম না! জলপাইগুডির কর সায়েব , শ্যামবাজারের এস পি সেন কলকাতা মূল শাখার প্রয়াত সুপ্রিয় গুপ্ত - এদের শিক্ষা মাথায় রেখেছি! তাই ভাংগিয়ে চালিয়েছি ! 
  • শিবাংশু | ১৯ জুন ২০২৩ ১৪:২০520529
  • স্যার,
    একই গুরুর চেলা হবার জন্য আপনার লেখায় লাইনের মধ্যে লেখা লাইনগুলি পড়তে পারি। এদেশে ১০০ ভাগ সরকারি জামিনকেও ঝুঁকি বিচার করার সময় মস্তো মার্জিন দিয়ে রাখা হয়। স্টেট ব্যাংক যা শিখিয়েছে, তা শুধু পেশাগত জীবনেই নয়, প্রাত্যহিক জীবনেও আমাকে ঋদ্ধ করে।  

    এই ব্যাংকটি আমাকে অবাক করে। একদিনে, এক সঙ্গে, ধরা যাক তিনশো জন ছেলেমেয়ে চাকরিতে ঢুকলেন। তাঁরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্ধেক ইংরেজি জানা, কোনও দিন টাই না পরা, সাদামাটা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর  ছেলেপুলে। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ একদিন চেয়ারম্যান হবেন, কেউ এম ডি। চাকরির ম্যারাথন দৌড়ে সামিল হয়ে এমন প্রশিক্ষণ হয়ে যায় যে তাঁরা ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে চূড়ান্ত দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলাদের থেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ যুদ্ধ দিয়ে যান। ইন্দিরা গান্ধি নয়, তলওয়ার সাহেব তাদের বাতিঘর। 

    সিনেমায় টাকা ঢালার একটা গপ্পো মনে পড়ে গেলো। পাটনায় এক ব্রাঞ্চ ম্যানেজার  নিজেকে 'কলাকার' মানে শিল্পী বলতেন। আবার ব্যাংকের পার্ল্যান্সে মহোত্তম 'কলাকার' বলা হয় 'মাল্য' বা 'নীরব' নামের জনতাদের। তো সে মহাত্মা একটি ভোজপুরি ফিল্মে লুকিয়ে নায়িকার কাকা টাইপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন আর একের পর এক চেক ওভারড্র্যাফ্ট করে টাকা দিতেন। কুলোকে বলে পর্দার বাইরে নায়িকার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিলো বেশ গভীর। হাজার পঞ্চাশেক টাকা তছরুপ করার পর লোকে আভাস পায়। আমি তখন জোন্যাল অফিসে। বস আমাকে  বলেন 'গোপনে' (ডিসক্রিট এনকোয়ারি) করতে। কারণ লোকটি আবার ইউনিয়নের নেতা। কোথায় কোন রাজনৈতিক সাঁট রয়েছে, জানা নেই। সেই অ্যাকাউন্টটা প্রসঙ্গে খোঁজ করতে ম্যানেজার তুষ্ণীম্ভাব দেখিয়ে বলেন 'ডে-সাব, আপ ভি কলাকার, ম্যাঁয় ভি কলাকার'। ব্যাংক-কা ইয়ে সব কিরানি লোঁগ কলা কে বারে ক্যা সমঝেগা? 

    তার পর কী হৈল জানে শ্যামলাল। সে আরেক সনসনি-খেজ 'পটকথা'।  
     
    লিখে যান স্যার, 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৯ জুন ২০২৩ ২২:৫২520540
  • আপনি সার সত্যটি বললেন।
     
    " তাঁরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের অর্ধেক ইংরেজি জানা, কোনও দিন টাই না পরা, সাদামাটা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর  ছেলেপুলে। তাদের মধ্যে থেকেই কেউ একদিন চেয়ারম্যান হবেন, কেউ এম ডি। চাকরির ম্যারাথন দৌড়ে সামিল হয়ে এমন প্রশিক্ষণ হয়ে যায় যে তাঁরা ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে চূড়ান্ত দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলাদের থেকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ যুদ্ধ দিয়ে যান। ইন্দিরা গান্ধি নয়, তলওয়ার সাহেব তাদের বাতিঘর। "।
     
    আমার আলমা মাটার সম্বন্ধে এর চেয়ে বডো কথা বলার নেই। বরানগরের পাতি বাংলা স্কুল থেকে এসেছিলাম , বন্ধ জুতো পরেছি প্রথম এস বি আই ইন্টারভিউতে। আমার মতন আরো অনেকে।স্কুলের নাম ইংরেজি উচচারন কোন কিছুই প্রতিবন্ধ ছিলো না। আমার এক বান্ধবীর বাবা বার্কলেজ ব্যাংক রেডিং এ কাজ করতেন । আমাকে জিজ্ঞেস করেন কতদূর অবধি উঠতে পারো ( ১৯৭৮)- বলেছিলাম সীমাবদ্ধ নই। তিনি বললেন বার্কলেজ ব্যাংক্ কতদূর উঠতে পারবেন তার পথে অনেক গনডী আছে। 
    মাত্র ন বছরে এ ব্যাংক শুধু কাজ শেখায় নি- মেরুদন্ড গড়ে দিয়েছিল। 
     
    জানি আমার কথা বৃদ্ধের গাল গল্প শোনাবে । কিন্তু সেটাও লিখে যাবার সময় এসেছে। 
  • Amit | 163.116.***.*** | ২০ জুন ২০২৩ ০৭:৪৩520544
  • আচ্ছা যেকোনো ব্যাঙ্ক যখন এরকম মুভি হোক বা নতুন টেকনোলজি বা প্রজেক্ট এ ইনভেস্ট করে - মানে যেগুলোর রিস্ক অনেক বেশি বা আননোউন- তখন সেগুলোর রিস্ক এসেসমেন্ট কিভাবে করে ? 
     
    মানে একটা অয়েল বা গ্যাস রিফাইনারি বা স্টিল বা গাড়ি র প্লান্ট প্রজেক্ট এ ইনভেস্ট করা তো অনেক রেফারেন্স পেতে পারেন। সেগুলোর মার্কেট ডিমান্ড , লং টার্ম সেলস এগ্রিমেন্ট , এগুলো তো অনেকটাই জানা বা অন্য প্রজেক্ট থেকে রেফারেন্স পেতে পারেন। ওয়েল এস্টাব্লিশড ডাটা আছে প্রচুর। একটা রিফাইনারি ভালো চললে পাশেরটা ১০০-% নাহোক অন্তত তার ৭০-৭৫-% মতো ভালো তো চলতেই পারে - সেম মার্কেট , সিমিলার ডিমান্ড সিমিলার কাস্টমার এসব ফ্যাক্টর্স যদি একদম চেঞ্জ নাহয়। ফেল হতেও পারে হয়তো -কিন্তু ভালো চলে যাওয়ার প্রোবাবিলিটি বেশি এসব এ ।   
     
    কিন্তু সিনেমায় তো এটা হয়না। একটা ছবি হিট হলে পরেরটা ও হবে এমন ভরসা স্পিলবার্গ ও দিতে পারে না। বা একদম নতুন কোনো বিজনেস যেটার মার্কেট ই জানা নেই বা ডাটা নেই। সেক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলো এগুলো শেয়ার হোল্ডার দের বা বোর্ড মেম্বার্স দের কাছে জাস্টিফাই করে কিভাবে ? বা ইনভেস্টমেন্ট সিকিউর করার জন্যে কি কি করে ? আলাদা কিছু ইন্সুরেন্স নেয় ? 
     
    এগুলো তো ভাবতাম ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট রা করে। জেনেই করে যে টাকা ডুবতেও পারে- উঠতেও পারে। রিস্ক নিজের। 
  • হীরেন সিংহরায় | ২০ জুন ২০২৩ ২০:২২520563
  • অমিত
     
    ঠিক। speculative ব্যবসার কোন ট্র্যাক রেকর্ড হয় না। এর comparable পাওয়া শক্ত । কোন নিবেশ ফুল প্রুফ নয় কিন্তু যথাযথ বিচার বিবেচনা করা দরকার - ফরাসি ব্যাংকের অফিসার ছবির চিত্র নাট্য পডে কি বিচার করেছেন তাঁরাই জানেন অথবা শিবাংশুর কলাকার ম্যানেজার। বোর্ড অবধি যায় না - আর এ্যাংলো স্যাকসন বোর্ড প্রথার ওপরে বিশ্বাস চলে গেছে আমার। গল্প নয় নিজের ব্যাংকের কান্ড দেখে। ইনসিউরার ব্যাংকারের অধিক বুদ্ধি রাখে- তারা ফিল্ম প্রোডাকশন ইনসিউর করবে না । 
     
    চার দশকে দেখা নমুনা অনেক শেখারও অনেক। একটা সিরিজ শুরু করব শিগগির। 
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ২৪ জুন ২০২৩ ০৮:১৯520674
  • ''সে আমলে বার ছিল না- ব্যাঙ্কের সামনে আমগাছের তলায় মোহনদার চায়ের দোকান ছিল, পুলিস মোড়ে পানের দোকান ছিল।''- এ জন্যই হীরেনদা আপনার লেখা এত ভাল লাগে। সজনীবাবুর মাধ্যমে কর্পোরেট ব্যাংকিংয়ের গল্প পাড়া! ব্যাংকিং ইন্সুরেন্স অর্থনীতির মন্ত্রগুলো আমাদের সাধারণ জীবনেই ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, আপনার লেখাগুলো একটা সম্যক ধারণা পড়িয়ে দেয়া পাঠককে। 
    মাথা নত করছি। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন