সারায়েভো: অন্য দিনের ভোরে
নদীর নাম বসনা–দেশের নাম বসনিয়া। সাড়ে পাঁচশো বছর আগে সেই নদীর দেশে অটোমানরা যে রাজধানী নির্মাণ করলেন তার নাম সরাই বসনা–বসনা দুর্গ অথবা প্রাসাদ। সরাই শব্দ ফারসি, যাকে আমরাও চিনি (যেমন এককালের মুঘলসরাই, আজকের বেগুসরাই)। সরাই শব্দটি এক সময়ে লোকমুখে সরাই-ইয়েভ থেকে সারায়েভো হয়ে গেছে; অধিবাসীরা সারাইলিয়ে।
গভর্নর ঈসা বেগ ঈশাকোভিচ বানালেন তুর্কি স্টাইলে আচ্ছাদিত বাজার, আজকের মলের পূর্বসূরী–পাবলিক বাথ, সেতু, মাদ্রাসা, উপাসনার জন্য মসজিদ (তুর্কি – মেসজিদ)। পাশাপাশি গড়ে উঠলো ক্যাথলিক গিরজে, অর্থোডক্স গির্জে এবং তার সামনে সিনাগগ! পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ স্পেনের রানি ইসাবেলা যখন নিনিয়া পিন্তা ও সান্তা মারিয়া জাহাজ সাজিয়ে দিয়ে কলম্বাসকে তাঁর ভারত আবিষ্কার অভিযানের সবুজ ঝান্ডা দেখিয়েছেন, ঠিক সেই সময় রাজা ফার্দিনান্দের সঙ্গে মিলে দুর্বার বেগে চালাচ্ছেন স্প্যানিশ ইনকুইজিশন – স্পেনের ইহুদিদের বলা হলো: হয় ধর্ম, নয় দেশ ছাড়ো। পশ্চিম ইউরোপ তাদের ‘আসুন বসুন একটু জিরিয়ে নিন’ বলে বসার ঘরের দরোজা খুলে দিলো না–যে ইহুদি ইতিমধ্যে সেখানে পৌঁছেছে তাদেরই রেখেছে একঘরে করে, সেখানে চলেছে ইহুদি বিতাড়ন, ঘেটো প্রকল্প এবং ইহুদি সংহারের পালা। অটোমান সুলতানরা আপন সাম্রাজ্যের দ্বার খুলে দিলেন ইহুদির জন্য–ক্রমশ পূর্ণ নাগরিকতা (প্রসঙ্গত, পূর্ব বিদেশমন্ত্রী বর্তমানে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বসনিয়া হারজেগোভিনার স্থায়ী প্রতিনিধি স্বেন আলকালাই সেফারদিক ইহুদি)। ইস্তানবুলের পরে সারায়েভো হয়ে উঠলো অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী–জনসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। বেলগ্রেডে পনেরো হাজার, জাগ্রেবে দশ হাজারের বাস তখন, লন্ডনে লাখ দেড়েক। ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ সারায়েভোর এক চতুর্থাংশ নাগরিক ইহুদি, চল্লিশ শতাংশ মুসলিম বসনিয়াক বাকিরা সার্ব – শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। যেমনটা চলল আরও কয়েকশো বছর।
বিগত তিনশো বছরে শিল্পে, সংস্কৃতিতে এই শহরের প্রগতি অভাবনীয়–এই ১৯৯২ সালর সার্ব আক্রমণের সময় নষ্ট হয়ে যায় সারায়েভো লাইব্রেরির লক্ষ লক্ষ বই, সাত হাজার হাতে লেখা পুঁথি।
আজ যদি সারায়েভোর অত্যন্ত আধুনিক ট্রামে চড়েন, মনে রাখবেন–সেখানে ইউরোপের প্রথম (১৮৯৫) এবং বিশ্বের দ্বিতীয় ইলেকট্রিক ট্রাম চলেছে, সান ফ্রান্সিসকোর পরেই। ভিয়েনায় তা দেখা দেবে কয়েক বছর বাদে। সারায়েভোর রাস্তা বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়েছে যখন খোদ ভিয়েনায় রাস্তায় গ্যাসের বাতি টিমটিম করে জ্বলে। আমার রোমানিয়ান পত্নীকে মনে করিয়ে দিই–ইউরোপের যে শহরের রাস্তায় প্রথম বিজলি বাতি জ্বলেছিল, সেটি রোমানিয়ান তিমিসোয়ারা (জার্মানে তেমেসবুর্গ, হাঙ্গেরিয়ানে তেমেসভার)। নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলি–মাটির নিচে প্রথম ট্রেন চলেছে লন্ডনে (১৮৬৩), কিন্তু তাকে টানতো স্টিম ইঞ্জিন – হাবসবুর্গ সম্রাটরা পৃথিবীর দ্বিতীয় ভূগর্ভ রেল স্থাপনা করেন–ভিয়েনায় নয়, বুদাপেস্তে এবং সেটি আবার প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রেন। সুইজারল্যান্ড যখন সবেমাত্র ট্রেন লাইন পাতার নাট বোল্টু ঠুকছে, অটোমানদের তৈরি লাইনে বানিয়া লুকা থেকে প্রিয়েদর – প্রায় একশো কিলোমিটার – ট্রেন চলেছে বসনিয়াতে।
মস্কোর (১৯৮০) পরে ১৯৮৪ সালে সারায়েভোতে শীতকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। প্রাক্তন কমিউনিস্ট দেশগুলির আর কোথাও কোনো অলিম্পিকের আসর বসেনি।
সারায়েভো: অবরোধ
৬ এপ্রিল ১৯৯২ - ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬
মস্তার থেকে সারায়েভোর পথটি অতীব মনোরম। বাঁ-পাশে নীল বর্ণা নেরেতভা বয়ে যায়। এই গ্রীষ্মেও তার জল কমেনি। খানিক চলার পরে সে ক্রমশ বিস্তারিত, বিশাল হ্রদে পরিণত, কোথাও বা জল বিদ্যুতের যোগান দিচ্ছে। কী অসম্ভব গাঢ় নীল জল! প্রথম শহর ইয়াবলানিতচা শহরের সাইনবোর্ড দেখে হাসান সালিহামিজিচের কথা মনে হল। সম্ভবত বসনিয়া হারজেগোভিনার সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার, দশ বছর বায়ার্ন মিউনিকের পরে ইয়ুভেন্তুস দলের উজ্জ্বল তারকা – বর্তমানে বায়ার্ন মিউনিকের ডিরেক্টর – তিনি এই ইয়াবলানিতচার মানুষ। প্রসন্ন ধরিত্রী। নদীতে, হ্রদে ক্যাম্পিঙের আখড়া, রোইং-বোটিং-সাঁতারের ধুম পড়ে গেছে এই জুলাই মাসে, গরমের ছুটির দিনে। রেস্তোরাঁর বাইরে কাঠের বেঞ্চে ছাতার নিচে বসে খানাপিনা চলছে। এই তো, সুদিন এই রকমই দিন।
জলে ঝাঁপাচ্ছে যে শিশুর দল, তাদের কেউ প্রশ্ন করে তার পরিচয় কী? সে বসনিয়াক না সার্ব না ক্রোয়াট? জিজ্ঞাসে কোনজন? পথের দু-পাশ সবুজে ভরে আছে। আকাশ কী উজ্জ্বল!
বিশ বছর আগে এই রাস্তায় দেখা গেছে ট্যাঙ্কের সারি, জ্বলন্ত বাড়ির আড়ালে আড়ালে স্নাইপারের ছায়া, কখনো আকাশে সারবিয়ান বোমারু বিমান, কোনো বাড়ির উঠোনে বসে সেই বিমানের দিকে বন্দুক তাক করছে এক যুবক। সারি সারি দেহকে একই সঙ্গে গোর দেওয়া হচ্ছে, কোথাও ক্যাথলিক কোথাও অর্থোডক্স ক্রসের নিচে। দু-হাত দূরে মুসলিম মাজার। এই সেদিন।
১৩৮৯ সালে কসভোর যুদ্ধবিজয়ী অটোমান সুলতানরা ক্রমে ক্রমে সার্বিয়া-ক্রোয়েশিয়া-বসনিয়া-স্লোভেনিয়া দখল ও শাসন করেছেন প্রায় পাঁচশো, অস্ট্রিয়ান হাবসবুর্গ বংশ পরের পঞ্চাশ বছর–এই দীর্ঘকালে বসনিয়ার সার্ব, ক্রোয়াট, বসনিয়াক বাস করেছেন একই পাড়ায়। গড়ে ওঠেনি কোনো ঘেটো। তাদের গায়ের রঙ, মুখের ভাষা, পরনের পোশাক, স্কুলের ঠিকানা, সিলেবাস, খাওয়ার কায়দা (একটি বিশেষ খাদ্য বাদে), খেলার মাঠ খাওয়ার সময় একই সুতোয় বাঁধা। হাসান সালিহামিজিচেরা যখন মাঠে ফুটবল নিয়ে ছুটেছেন, সেটি ছিনিয়ে নিতে পেরিসিচ বা ইয়ানকোভিচ কালাশনিকভ হাতে তাঁকে ধাওয়া করেননি। তাহলে বিবাদ কবে শুরু হল–কোথায়, কেন? বিদেশি রাজাদের শাসনে সকলে বেশ মানিয়ে গুছিয়ে থেকেছেন, ধর্ম জাতি নিয়ে কোনোদিন দাঙ্গা বিবাদ হয়নি। কোথায় ছিল জাতিভিত্তিক রাজ্য গঠনের উন্মাদনা, জাতিগত শুদ্ধিকরণের উল্লাস?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে রাজা আলেকসান্ডারের পতাকার তলায় কিংডম অফ ক্রোয়াট, স্লোভেন, সার্ব সৃষ্ট হল – দক্ষিণ স্লাভ জাতির প্রথম স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সত্বর তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শোনা গেল। ক্রোয়েশিয়ার নেতা আনতে পাভেলিচ বললেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় – আগে ছিলাম অস্ট্রিয়ান হাবসবুরগ গুষ্টির প্রজা এখন কি বনে যাবো বেলগ্রেডের সারবিয়ান রাজার প্রজা? ইয়ুগোস্লাভিয়া নামক সংযুক্ত রাষ্ট্র একটা ধাপ্পা – আসলে সেটা সার্বিয়ার মৌরুসিপাট্টা’। প্রথমে ইতালি ও পরে নাৎসি জার্মানির সহায়তায় পাভেলিচ স্বাধীন ক্রোয়েশিয়ান রাষ্ট্র পত্তন করলেন। এবার শুরু হল লম্বা ছুরির রাত যেখানে তাঁর শত্রু সারবিয়ান – বলকানের ইতিহাসে প্রথম গৃহযুদ্ধ। নাৎসিদের ক্রূরতাকে হার মানানো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বেসামরিক মানুষের হত্যাকাণ্ডে পাভলিচ এবং তাঁর দল উসতাসে ইউরোপে হিটলার ও স্তালিনের পরে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। কিন্তু দারুণ সেই দুঃসময়েও দেখা গেছে বসনিয়াক, ক্রোয়াট তাদের সার্ব প্রতিবেশীর প্রাণ বাঁচিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইওসেপ ব্রজ টিটো মিত্রশক্তি থেকে কোনো সাহায্য চাননি – কেবলমাত্র তাঁর সার্ব বসনিয়াক স্লোভেন কিছু ক্রোয়াটদের নিয়ে তৈরি পার্টিজান বাহিনির বলে জার্মানদের খ্যাদালেন, ক্রোয়েশিয়ার নাৎসি সমব্যথী সরকারকেও শায়েস্তা করলেন। ইওসিপ ব্রজ টিটোর মা স্লোভেন, বাবা ক্রোয়াট। তিনি জন্মেছিলেন যে গ্রামে, সেই চুমরোভেতস থেকে ক্রোয়েশিয়ার জাগ্রেব ষাট কিলোমিটার, স্লোভেনিয়ার লুবলিয়ানা একশো। স্ত্রী য়োভাঙ্কা সার্ব। তাঁর আর যত দোষ থাকুক না কেন (সেগুলি অগুনতি) ব্যক্তিগত জীবনে তিনি স্লাভিক সংহতির মূর্ত প্রতীক। তাই তিনি বিভিন্ন জাতির মানুষকে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বলে খানিক হেসে, গলা জড়িয়ে কেঁদে, শ্রমিক কৃষকের স্বর্গরাজ্যের শপথ নিয়ে, কখনও বন্দুকের ভয় দেখিয়ে প্রায় চার দশক ইয়ুগোস্লাভিয়াকে (আক্ষরিক অর্থে দক্ষিনের স্লাভ জাতি) এক ঝান্ডার নিচে রাখতে পেরেছিলেন। কাস্তে হাতুড়ি ছাপের তলায় সার্ব স্লোভেন ক্রোয়াট বসনিয়াক মনটিনেগ্রিন ম্যাসিদোনিয়ান সমবেত হলেন, কসভো এবং ভয়ভদিনা বাদে প্রত্যেক প্রদেশের রইল আপন সংবিধান, পার্লামেন্ট,আইন, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার অধিকার। কেউ কারো প্রভু নয়, সকলে এক বিরাট সাম্যবাদী পরিবারের অংশ।
ইয়ে ভাইচারা অমর রহে।
টিটো কাস্তে হাতুড়িকে মানলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নকে নয়। ওয়ারশ চুক্তিতে সই করলেন না – হাবসবুর্গের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন হতে চাননি। শোনা যায় স্তালিন ছ-বার মৃত্যুদূত বা আততায়ী পাঠিয়েছিলেন–সকলেই অসফল। টিটো স্তালিনকে লেখেন, আপনি ছ-জনকে পাঠিয়েছিলেন–আমি একটা লোককে পাঠালে আপনি বাঁচতেন না!
১৯৫৬-র হাঙ্গেরিয়ান অভ্যুথানে, ১৯৬৮তে প্রাগের স্বতঃস্ফূর্ত সোভিয়েত-বিরোধী প্রতিবাদের দিনে টিটো কোন ট্যাঙ্ক পাঠাননি। ইয়ুগোস্লাভিয়া কমিউনিস্ট দেশ তবে তার লৌহ যবনিকা আধেক ঢাকা–সিটি ব্যাঙ্ক সরাসরি ব্যবসা করেছে সে দেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে–এনারগোপ্রোইয়েকট ও আগ্রোকমেরচ। পশ্চিম ইউরোপের মানুষদের অগ্রিম ভিসা নিতে হয় না, সীমান্তে ছাপ মেলে।
টিটোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা বদলাতে শুরু করল। তাঁর উত্তরাধিকারী মিলোশেভিচ যে ইয়ুগোস্লাভিয়াকে সঙ্ঘবদ্ধ করার ডাক দিলেন, সেটি প্রকৃত প্রস্তাবে সারবিয়ান প্রভুত্বের শঙ্খনাদ। সেদিন বোঝা গেলো পঞ্চাশ বছর আগে ক্রোয়েশিয়ার আনতে পাভেলিচ ঠিকই বলেছিলেন – রাজ্য হবে স্বতন্ত্র, জাতিভিত্তিক–বেলগ্রেড বা সার্বিয়ার দাস নয়। মন চল নিজ নিকেতনে।
বার্লিন দেওয়ালের পতনের পরে কাস্তে হাতুড়ি পতাকা বর্জিত প্রথম মুক্ত নির্বাচনে (১৯৯০) জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল–স্লোভেনিয়া থেকে ম্যাসিদোনিয়া অবধি পাঁচটি রাজ্য আওয়াজ তুলেছে জাতিভিত্তিক স্বতন্ত্র দেশ চাই। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম সার্বিয়ানদের প্রভুত্ব থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম।
স্লোভেনিয়ার জনসংখ্যার দেড় শতাংশ সারবিয়ান, ক্রোয়েশিয়াতে তিন শতাংশ। বসনিয়া একমাত্র রাজ্য যেখানে প্রায় অর্ধেক বসনিয়াক মুসলিম, বাকি ক্রোয়াট এবং সার্ব যারা কয়েকশো বছর একত্র বাস করেছেন। এখন এই দেশ স্বাধীন হবে কিসের ভিত্তিতে? ধর্মের ভিত্তিতে বাঁটোয়ারার প্রস্তাবে ভারত দু-ভাগ হয়েছিল, জাতীয়তার ভিত্তিতে বসনিয়ার কি তিন ভাগ হবে?
বসনিয়ার সমস্যার শুরু।
১৯৯০ সালের দেশব্যাপী নির্বাচনের ঠিক আগে ব্রিটিশ সাংবাদিক মিশা(মাইকেল) গ্লেনি বসনিয়া ঘুরেছেন একটি ঝরঝরে ট্রাবান্ত গাড়িতে। তাঁর লেখা থেকে –
“গণতান্ত্রিক মুসলিম পার্টির সবুজ পতাকা উড়ছে এক গ্রামে। তাঁরা একা বসনিয়া শাসন করতে চান বলে জানাচ্ছেন। পাশের গ্রামে ইয়াভোনিচারের (ক্রোয়েশিয়া গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন) পতাকা উড়ছে। দু-পা এগোলে দেখি দেওয়াল ভরে গেছে সারবিয়ান গণতান্ত্রিক পার্টির ব্যানারে (এস ডি এস)। কোনো গ্রামের এক দেওয়াল সবুজ, পাশের দেওয়াল লাল কোথাও বা লাল নীল সাদা (সার্বিয়ার জাতীয় রঙ)। কিছু গ্রামে পাশাপাশি বাড়ির দেওয়ালে তিনটে রঙের সমাহার – এক বাড়িতে সবুজ, পরেরটায় লাল নীল সাদা তার পরে লাল! তিনটি সম্প্রদায় নিয়ে কোনো জাতীয় দল গড়ে ওঠেনি, তাঁদের মধ্যে কোনো সমঝোতাও নয়। সংসদীয় গণতন্ত্র বসনিয়ার ভাগ্যে নেই”।*
সাতের দশকে কলকাতার যে কোনো পাড়ার রাজনৈতিক অবস্থান জানা যেত দেওয়াল লিখন থেকে – কোনো দেওয়ালে ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস’ বা ‘বিপ্লব কোন ভোজসভা নয়’, আবার কোথাও একটি ছবির তলায় লেখা ‘এশিয়ার মুক্তি সূর্য’। বুঝে নিন।
১৯৯২ সালের পয়লা মার্চ বসনিয়া হারজেগোভিনার গণভোট। বসনিয়ার সার্ব জনতা এটিকে বয়কট করেন – তাঁরা চান সার্বিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে। এর আগেই তাঁরা বসনিয়ার পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এ নির্বাচন তাঁরা বয়কট করেন তাঁদের কাছে এটি অর্থহীন। তাঁরা চান সার্বিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে। রাস্তায় রাস্তায় সার্ব প্যারামিলিটারি তৈরি করেছে অজস্র ব্যারিকেড যাকে অতিক্রম করে ক্রোয়াট ও বসনিয়াক জনতা ভোট দিতে গেলেন। ৯৯.৭% বসনিয়াক ও ক্রোয়াট মতদাতা বসনিয়ার স্বাধীনতা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে চাইলেন – এক নতুন দিন।
বাতাসে বারুদের গন্ধ।
পয়লা মার্চ পুরনো শহরের কেন্দ্র সেই বাসারসিয়াতে একটি সারবিয়ান বিয়ের শোভাযাত্রায় অনেক লাল-নীল-সাদা সারবিয়ান পতাকা উড়তে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তার ওপরে গুলি চালায় একজন বসনিয়াক স্নাইপার। পরের দিন ২ মার্চ সার্ব মিলিশিয়া ঘিরে ফেলে পার্লামেন্ট ভবন – থানার সার্ব পুলিস গুলি চালায় সেই থানারই বসনিয়াক কনস্টেবলের ওপরে।
ছয় এপ্রিল ১৯৯২ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নতুন বসনিয়াকে স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সার্ব প্রতিরোধ গড়ে উঠল। সারায়েভোর চারপাশের পাহাড়ে বন্দুক কামান নিয়ে সার্ব সৈন্য মোতায়েন – এদের সঙ্গে আছে বেলগ্রেডের অঙ্গুলিহেলনে চালিত ইয়ুগোস্লাভ জাতীয় সৈন্য বাহিনি।
সারায়েভোর অবরোধ শুরু – চলবে ১৪২৫ দিন।
বিজলি, গ্যাস, জলের লাইন কাটা পড়েছে বহুবার। প্রাণধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী আসতো ইউ এনের বিমানে – তেরো হাজার ফ্লাইট নেমেছে সারায়েভো বিমান বন্দরে। একমাত্র বার্লিন এয়ার লিফট (১৯৪৮) দেখেছে এর চেয়ে বেশি উড়ো জাহাজের ওঠানামা। সার্ব সৈন্য ঘিরে রাখে এয়ারপোর্ট – সেখানে আসা যাওয়ার পথ ছিল একটি টানেল – আজকের বুতমির গ্রামের টানেল মিউজিয়ামে দেখেছি সে ইতিহাস। চার বছরে প্রায় ১৪০০০ মানুষ প্রাণ হারান, হাজারের বেশি শিশু। শহরের সেই ধংসস্তূপে একজন চেলো বাদকের ছবিটি সাড়া জাগিয়েছিল। জাতিসংঘ তার শক্তি নিয়ে লড়াই করে মুখ্যত আকাশ থেকে – ন্যাটোর বম্বিং শুরু হয় ১৯৯৪ সালে।
আমেরিকার ডেটনে (১৯৯৫) যুদ্ধ-ক্লান্ত সার্ব ক্রোয়াট বসনিয়াকরা মিলে যে শান্তি-চুক্তিতে সই করলেন সে অনুযায়ী দেশটার নাম হল বসনিয়া এবং হারজেগোভিনা সেখানে আবার বসনিয়ান ক্রোয়াট ও বসনিয়াক মুসলিমদের আলাদা সমিতি। এর ভেতরে রইল একটি স্বশাসিত এলাকা – রেপুবলিকা স্রাপ্সকা, সারবিয়ান রিপাবলিক। কোনো পুলিস পাহারা বা সীমান্ত রক্ষী নেই কোথাও – যেমন কোনো বেড়া নেই আয়ারল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের মাঝে। গাড়ি থামিয়ে পথের ধারে পাহাড়ের কিনারায় যেখানে থেমেছি, দেখি চতুর্দিকে সিরিলিক অক্ষরে নাম লেখা। নিতান্ত বোকার মতো প্রশ্ন করতে জানলাম আমরা রেপুবলিকা স্রাপ্সকায় আছি–মেনুটি অবশ্য দু-রকম হরফেই লেখা।
তিনভাগে ভাগ হয়ে গেল–দেশ: বসনিয়ান ক্রোয়াট(ক্যাথলিক), বসনিয়াক মুসলিম এবং সার্বিয়ান (রেপুবলিকা স্রাপ্সকা)।
সার্বিয়ানরা কয়েকশো বছর পাশাপাশি বাস করেছেন বসনিয়াকদের সঙ্গে এই সারাজেভো শহরে – গৃহযুদ্ধের পরে অনেক পাড়ার হাত বদল হল। অনেক সার্ব শহর ছেড়ে চলে গেলেন নতুন রেপুবলিকা স্রাপ্সকায়, কিছু বাসা বাঁধলেন পূর্ব সারায়েভোতে, বসনিয়াকদের থেকে দূরে।
ভারতভাগের রিপ্লে।
সারায়েভো: নতুন দিন
ল্যাটিন ব্রিজ, গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে কিন্তু আগামীকাল একটা অন্য দিন।**
আমি এক প্রাণবন্ত উজ্জ্বল সারায়েভোকে দেখেছি। পথে পথে মেলা বসেছে, গান বাজনা প্যান্টমাইম শহর বাজার গমগম করছে। অজস্র তরুণ মুখে দেখেছি ভবিষ্যতের স্বপ্ন।
সারায়েভো শহরের মাঝখানে একটি পথ আছে শুধু পদাতিকদের জন্য। তার নাম ফারহাদিয়া। এখানে দেখবেন রাস্তার ওপর আড়াআড়ি লাইন টানা: তার একদিকে লেখা পূর্ব অন্য দিকে পশ্চিম। সারা ইউরোপে এর সমতুল্য কোনো নিশানা নেই: আক্ষরিক অর্থে এখানে পূর্ব ও পশ্চিমের সাক্ষাৎকার! পুবদিকে গাজি হুসরেভ বেগ মসজিদ ও মিউজিয়াম, বাসারসিয়া মসজিদ (যেখানে আমার গল্প শুরু হয়েছিল) – মিনি ইস্তানবুল! সেখানে আছে একটি সম্পূর্ণ ঢাকা বাজার (বেজিস্তান) ইস্তানবুলের গ্রানড বাজারের ছোটো সংস্করণ। আমার মতে অটোমান সুলতানদের গ্রান্ড বাজার পৃথিবীর প্রথম শপিং মল–এর কপিরাইট তাঁদের দিতেই হয়। সেখানে কী যে পাবেন না! ক্রেডিট কার্ড যতক্ষণ আছে! চমৎকার পাথরে বাঁধানো পথ: সেখানে আবার সিনাগগ: ইহুদি ইতিহাসের মিউজিয়াম দেখবেন (তুর্কি সুলতানরা কোনো বৈষম্য করেননি)। ফারহাদিয়া মসজিদের উলটোদিকে দেখবেন মিউজিয়াম অফ ক্রাইম এগেনসট হিউম্যানিটি। স্রেবেনিতসার গণহত্যার ইতিহাস আপনাদের শোনা – তার ছবি দেখবেন। এ মিউজিয়াম দেখতে গেলে অবশ্য কঠিন স্নায়ুর প্রয়োজন যেমন জেরুসালেমের হলোকষ্ট স্মৃতি মিউজিয়াম, ইয়াদ ভাশেম – সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ধাতস্থ হতে সময় লাগে।
এবার পশ্চিমে পাবেন থিওটোক্সের এক অসামান্য বিশাল অর্থোডক্স ক্যাথেড্রাল, স্যাক্রেড হার্ট ক্যাথলিক গির্জা। ফারহাদিয়া পথের ওপর তাদের মুখোমুখি দেখা। কিন্তু পূর্ব মিশে আছে পশ্চিমে যেমন পশ্চিম মিশে গেছে পূর্বে। সারায়েভো আমাকে অভিভূত করে – পথে পথে আমি এক আশ্চর্য ছবি খুঁজে পেয়েছি: এই শহরের ছশ বছরের ইতিহাসে কেবলি দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবের কাহিনি। চেহারা দেখে কারো ধর্ম বা জাতি চেনার কোনো উপায় নেই: সকলেই স্লাভিক বংশোভূত। কারো রক্তে মিশেছে তুর্কি কারো হুন। স্লাভিক ভাষার ওপর পড়েছে অজস্র তুর্কি ও ফারসি শব্দের ছায়া – তোপ (কামান), কপু (গেট), দুশমান (শত্রু), পামুক (তুলো)। পূর্ব দিকের রাস্তার নাম তুর্কি কিন্তু পশ্চিমের নামেও তুর্কি প্রভাব আছে।
সারায়েভোর স্লোগান:
বিংশ শতাব্দীর শুরু ও শেষ এখানেই।
যে রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল ২৮শে জুন ১৯১৪, তা শেষ হল চার বছরের যুদ্ধে, ১৯৯৬ সালে। সারায়েভোর টানেলের দেওয়ালে লেখা আছে “দি প্লেস দ্যাট এনডেড দি টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি”। শেষ যুদ্ধের ক্ষত অনেক গভীরে – দেশ ভাগ, পাড়া ভাগ। সারায়েভোর সমাজের চেহারা বদলে গেলো – সার্বিয়ান নাগরিকের সংখ্যা বিশ থেকে দুই শতাংশে নেমে এসেছে। জাতীয় শুদ্ধি যজ্ঞের (এথনিক ক্লিনসিং) পরে সারবিয়ান পাড়া এখন পুরো দস্তুর বসনিয়াক। শহর সম্পূর্ণ মেরামত হয়েছে – ১৯৪৫ সালের বিধ্বস্ত বার্লিনকে আজ চেনা যায় না। তেমনি ১৯৯৬ সালের সারায়েভো আজ নতুন সাজে গড়ে উঠেছে।
২০১৪ সালে – সেই দিনের শতবার্ষিকী বছরের অনুষ্ঠানে আবার দেখা গেলো বিভক্ত সংসার। ২৮শে জুনের মূল অনুষ্ঠানে ফার্দিনান্দ ও সোফির শেষ দিনটির স্মৃতিতে সারায়েভো টাউন হলে ভিয়েনা ফিলহারমনিক বাজিয়েছে হাইডেন, ব্রামস, শুবারট এবং রাভেলের বোলেরো। সেই সঙ্গীতের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে মিলিয়াকা নদীর দু-পারে, ল্যাটিন ব্রিজ ছাড়িয়ে। আমন্ত্রিত দেশগুলির মধ্যে সার্বিয়া এবং স্থানীয় সার্বিয়ান নাগরিক এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে।
ঠিক সেই দিনেই বসনিয়ার আরেকটি সেতুর ওপরে আরেক বাজনার আসর বসেছে। দ্রিনা নদীর তীরে আরেক অটোমান সেতুর পাশে রেপুবলিকা স্রাপস্কার ভিসেগ্রাদ শহরে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপের মুরাল উদ্বোধন – সারবিয়ান স্টেট অর্কেস্ট্রা বাজিয়েছে ভিভালদি-র সামার কঞ্চেরটো। সারবিয়ানরা মনে করেন গাভ্রিলো তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি (১৯৯২ সালে সারায়েভোতে তাঁর স্ট্যাচু ভেঙে ফেলা হয় সারবিয়ান বোমাবর্ষণের প্রতিবাদে)। সারবিয়ানদের কাছে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ এক মুক্তিযোদ্ধা –বহু শতাব্দীর বিদেশি শাসনের অবসান ঘটিয়ে বলকানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।
কোন দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন উনিশ বছরের গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ? বৃহত্তর সার্বিয়া না এক অখণ্ড ইয়ুগোস্লাভিয়া?
ইয়ুগোস্লাভিয়া নামের কোনো দেশ কখনও ছিল না ইতিহাসে, ভূগোলে। দীর্ঘকাল এই অঞ্চলের রাজা ছিলেন অটোমান সুলতান – তাঁরা যে বাউন্ডারি লাইন টেনেছিলেন, তার ভেতরে অনেকগুলো জাতি পাশাপাশি বাস করেছে – তাঁদের জুড়ে দিলেই ইয়ুগোস্লাভিয়া? ভারতে ইংরেজ যেমন করেছে? ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ আফ্রিকাতে?
বসনিয়া হারজেগোভিনা একদিন সেতু পার হবে।
পুনশ্চ:
পাঠক, পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি শুরু করেছি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প শোনানোর জন্য। ইতিহাসের টোল খুলে বসার কথা ছিল না। কিন্তু বলকান এক আশ্চর্য অনুভূতি – তার প্লাবনকে মুক্তি দিতে গেলে ব্যাবসা-বাণিজ্যের গল্প কোথায় তলিয়ে যায়। দীর্ঘ ইউরোপ প্রবাসে যুদ্ধের প্রেক্ষিতে কয়েকটি রঙ্গমঞ্চ আমাকে ভীষণ ভাবে আপ্লুত করেছে, যেমন নরমান্দি - নীল আটলান্টিকের ফ্রেমে বাঁধানো সারি সারি সাদা ক্রস, মাগেন দাভিদ – শত্রু-মিত্র পাশাপাশি সমাহিত; যেমন ভেরদাঁ, আদিগন্ত সবুজ প্রকৃতির পটভূমিকায় ইউরোপের বৃহত্তম মৃত্যুভূমি; যেমন দাখাউ- নাৎসি জার্মানির প্রথম দিন থেকে শেষদিন অবধি প্রজ্বলিত মৃত্যু বহ্নি ; যেমন বার্লিন – একটা দেশের ভাঙা গড়ার দলিল – মর্মবিদারী ইতিহাস, খানিক দূরের দৃশ্যপটে।
বসনিয়ায় অগ্নিশিখা যখন লেলিহান, সারায়েভো যখন অবরুদ্ধ, সে সময়ে বাকি ইউরোপের মতন আমার জীবন চলেছে আপন বৃত্তে – লর্ডসে টেস্ট ম্যাচ, বার্সেলোনায় অলিম্পিক, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়াতে খুঁজছি নতুন ব্যবসা – কৌন রোতা হ্যায় কিসি আউরকে খাতির এয় দোস্ত? যেমন একদিন ফুটপাথের ভিখিরির দিকে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি ঠিক তেমনিভাবেই?
শুনিনি কি-
“দূরে কাছে কেবলি নগর, ঘর ভাঙ্গে
গ্রাম পতনের শব্দ হয়;
মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,
দেয়ালে তাদের ছায়া তবু
ক্ষতি,মৃত্যু,ভয়
বিহবলতা ব’লে মনে হয়।
এসব শূন্যতা ছাড়া কোনোদিকে আজ
কিছু নেই সময়ের তীরে।”
- পৃথিবীলোক,
জীবনানন্দ দাশ
*Misha Glenny: Fall of Yugoslavia
** After all, tomorrow is another day –Scarlett O’Hara, Final sentence of Gone with the Wind by Margaret Mitchell