ঝাকশেভো থেকে বিদেয় নেবার সময় আমাদের সমবেত করে অ্যালান বললেন, ‘নিজের আপিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে এই নিরালায় বসে ক’দিন শুধু আড্ডা দিলেন আর পান করলেন। এবার কিছু ধান্দা ধরুন, যাতে ব্যাঙ্কের দু’পয়সা হয়।’
কর্তার ইচ্ছায় সব সময় সকল কর্ম হয় না।
যে কাজ করলে সিটি ব্যাঙ্কে আমার মাসের মাইনে মেলে, ঝাকশেভোতে পাঠাভ্যাস তার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তৎকালীন প্রভু ইভান করুণাপরবশ হয়ে বলেছিলেন, ‘অ্যালান বলছে যখন, যাও। ব্যাঙ্কেরই তো কাজ।’ এখন ইভানের কাছে ওয়ারশ যাবার আবদার করলে, তিনি নির্ঘাত বলবেন, তোমার মাইনে আর বোনাস কে দেয় ? অ্যালান না আমি?
ভবিতব্য অন্যরূপ। আমার কর্মজীবনের পালাবদল হল।
এতদিন কর্পোরেটের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম। শেল, ভোলভো, ইউনিলিভার, হাইনেকেন, কার্নো মেটাল বক্স ইত্যাদি কোম্পানি ছিলেন আমার নির্দেশক। তাঁরা যখন কোনো অজানা অচেনা অখ্যাত দেশে মাল রপ্তানি করেছেন, সিটি ব্যাঙ্কের সাধ্যমত আমরা তাঁদের বাণিজ্যের ঝুঁকি সংরক্ষণ করবার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছি। কাজ ছিল তাঁদের দেখভাল করা, জুন-জুলাই মাসে লর্ডস টেস্ট, উইম্বলডনে আপ্যায়ন। মাঝেমধ্যে ভাল জায়গায় খাওয়ানো।
প্রিয় হোক না হোক, প্রভু আমার।
বছরে দু’বার বড়কর্তার সামনে বাজেট মিটিং – কেন এই সব বাণিজ্য থেকে আশানুরূপ আয় হয়নি তার কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। বাজেটের বেশি আয় হলে তিনি জানতে চাননি, আমার কোন প্রতিভার বলে সেটি সম্ভব হল।
আমার দীর্ঘ ইউরোপে প্রবাসে পশ্চিমি ব্যাঙ্কিং-এর চরম দুর্দিন দেখি ১৯৮৮- ১৯৯২। সিটি ব্যাঙ্কের অবস্থা সুবিধের নয়। রেটিং নেমে গেছে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। নরওয়ে থেকে জার্মানি, রবার্ট ম্যাক্সওয়েল থেকে রেফকো সহ আরও অনেক নাটের গুরু নানা ব্যাঙ্কের টাকা ডুবিয়েছেন। সোমবার ১৯শে অক্টোবর, তেইশটি উন্নত দেশের শেয়ার বাজার বিশ শতাংশ মূল্য হারায়। তারপর থেকেই শেয়ারে সংক্রান্তি। সিধে দক্ষিণপানে তার যাত্রা। সেই সময়, নিজের নাক কেটে অনেক ব্যাঙ্ক আমাদের যাত্রাভঙ্গ করাতেও বদ্ধপরিকর। বাড়ি-ঘর বন্ধকের ব্যবসা খারাপ – সম্পত্তির দাম ধারের চেয়ে কম। বাড়ি বেচে অনাদায়ী টাকা শোধ হবে না। চাকরির বাজার শোচনীয় – এক শুক্রবার সকালে তৎকালীন মরগান গ্রেনফেলের অফিসে ঊর্ধ্বগামী এস্কেলেটর বন্ধ করে দেওয়া হয় – একের পর এক নাম ডেকে লোক ছাঁটাই হচ্ছে – তাদের সবার গতি নিম্নমুখী!
দেড় বছরের মত সিটি ব্যাঙ্কে নিলম্বিত বার্ষিক বেতন-বৃদ্ধি বন্ধ। চাকরি আছে তাই বাপের ভাগ্যি। বোনাস নেমে এল শূন্যের কাছাকাছি। যা মেলে, তা দিয়ে বড়জোর বন্ধু পরিজনকে ম্যাকডোনালডস-এ আমন্ত্রণ করা যায়। নানাভাবে ব্যয়সঙ্কোচের পন্থা খোঁজা হল – আমরা যেন কাগজের দু’পিঠে ফোটোকপি করি, তাতে অর্থ সাশ্রয় হয়। খদ্দের দেখা করতে এলে চায়ের সঙ্গে বিস্কিট দেওয়া বারণ। গোটা পশ্চিমি দুনিয়া তখন হন্যে হয়ে নতুন বাজার খুঁজছে – অন্ন দাও বলে।
দশ মাসের ভেতরে আমাদের অল্প দেখা, কম জানা দুনিয়াতে তিনটে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটল ।
১৯৮৯, ৪ জুন: তিয়ানানমেন স্কোয়ারে (স্বর্গীয় শান্তি চত্বর) একদিন গণতন্ত্র ও মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা চেয়ে যে প্রতিবাদী মানুষেরা গোলাপ ফুল হাতে দাঁড়িয়েছিলেন ট্যাঙ্কের মুখোমুখি, তাঁদের ও সেই স্বপ্নের মৃত্যু হল চিনা লাল ফৌজের বন্দুকের গুলিতে।
১৯৮৯, ৯ নভেম্বর: আঠাশ বছরের পুরোনো বার্লিন দেওয়াল এবং পঞ্চাশ বছরের পুরোনো পূর্ব ইউরোপীয় সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ল ।
১৯৯০, ১১ ফেব্রুয়ারি: কালো ও সাদা মানুষের সমান অধিকার চাওয়ার অপরাধে ছাব্বিশ বছর কারাবাসের পরে মুক্ত একজন মানুষ গ্রীষ্মের সেই উজ্জ্বল দিনে এসে দাঁড়ালেন কেপ টাউনের পৌরসভার বারান্দায়। কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, সারা আফ্রিকা যখন সাদা বনাম কালোর এক আসন্ন গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় কাল গুনছে, নেলসন ম্যানডেলা বললেন, দু’শ’ বছরের শাসক ও শোষক প্রভুদের ভাষা, আফ্রিকানস-এ - ওয়াট ইজ ফেরবাই ইজ ফেরবাই (যা বিগত তা বিগত)। সারা আফ্রিকা বিচ্ছুরিত হল এক উজ্জ্বল আলোকে।
পারস্পরিক আপাত-সম্পর্কবিহীন এই তিনটি ঘটনার তাৎপর্য বুঝে আপন বিজনেস প্ল্যান বানাতে ব্যাঙ্কেরা যখন ব্যস্ত, তার দেড় বছরের মধ্যে আরও কিছু দেখা গেল:
২৪শে জুলাই, ১৯৯১: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম সম্মানে বিভূষিত এক অর্থনীতিক দাঁড়ালেন ভারতীয় পার্লামেন্টে। অর্থমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বললেন, আজকে একটি ভাবনার সময় এসেছে। ভারতীয় অর্থনীতির চার দশকের শৃঙ্খল খুলে দিলেন। বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারে সেদিন দু’সপ্তাহের মত তেল আমদানি করার সামর্থ্য ছিল।
২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৯১: লিথুয়ানিয়া থেকে কাজাখস্তান, আরমেনিয়া থেকে সাইবেরিয়া অবধি বিস্তৃত তিন কোটি আশি লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জোড়া পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্ত্যেষ্টি ঘোষিত হল। মাতা রাশিয়ার আঁচলের ছায়া ত্যাগ করে চোদ্দটি ভাই বেরাদর আপন আপন ঝান্ডা তুললেন।
ঠিক যখন নতুন বাজারের সন্ধানে পশ্চিমের তাবৎ ব্যাঙ্ক হন্যে হয়ে ফিরেছে, কোন দৈববলে উন্মুক্ত হল শাকের ক্ষেত?
কাকতালীয়?
১৯৮৯ সালে চিনের মাথা পিছু আয় (৩১১ ডলার) ছিল ভারতের সমান, কিছু আফ্রিকান দেশের চেয়েও কম – ছোট গাম্বিয়ার আয় সাতশ’ ডলার। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে স্বর্গীয় শান্তি চত্বরে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল, সেটির মোড় ফেরানোর প্রয়োজন বুঝেছিলেন দেশের নেতৃত্ব। যারা গণতন্ত্রের দাবিতে পথে নেমেছিলেন, তাঁরা শুনলেন ধনতন্ত্রের আহ্বান। ব্যক্তিস্বাধীনতা নয়, মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা নয় – পেলেন এক বাজারি অর্থনীতি। চিন রূপান্তরিত হল পৃথিবীর কর্মশালায়। আজ চিনের মাথা পিছু আয় ১০ হাজার ডলার, ভারতের পাঁচগুণ। সিটি ব্যাঙ্ক কালক্ষেপ না করে ঢুকে পড়ল সে দেশে ।
১৯৮৯ সাল অবধি সিটি ব্যাঙ্কের একটি মাত্র শাখা ছিল পূর্ব ইউরোপে, বুদাপেস্টে, একটা ধুনি জ্বালিয়ে রাখার মত। পরের কয়েক বছরে আমাদের অফিস দেখা দিল ওয়ারশ, প্রাগ, বুখারেস্ট, মস্কো, আলমাতি, ব্রাতিস্লাভা, সোফিয়া, কিয়েভে। তিনটি বালটিক দেশের দায়িত্ব দেওয়া হল ওয়ারশকে; ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া সহ পুরোনো ইয়ুগোস্লাভিয়ার ভার নিল বুদাপেস্ট। এককালে আমেরিকা দেখেছিল ওয়েস্টওয়ার্ড হো – এবার ইস্টওয়ার্ড হো!
প্রসঙ্গত, ষাট বছর আগে একজন অস্ট্রিয়ান ‘পুবের পানে ধাও (দ্রাং নাখ অস্টেন)’ কথাটি বলে অসম্ভব অপ্রিয় হয়েছিলেন।
১৯৯০ সালে আফ্রিকার উত্তরে কাইরো, মধ্যে কিনশাসা, পূবে নাইরোবি এবং দক্ষিণে জোহানেসবুরগ ছাড়া সিটি ব্যাঙ্কের কোনো শাখা ছিল না। অতি দ্রুত আমাদের আবির্ভাব হল উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, জাম্বিয়া, সেনেগাল সহ ১৭টি দেশে ।
১৯৯১ সালের জুলাই মাসের পরে ভারতে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং-এর দ্বার উন্মোচিত হল। আমরা গোষ্ঠীঋণের ব্যবসা শুরু করি। টেলকোকে (আজকের টাটা মোটর) নিয়ে আমরা প্রথম নামলাম বিশ্বের বাজারে।
ব্যাঙ্কের সর্বময় কর্তা জন রিড বললেন, “আমাদের হেড অফিস নিউ ইয়র্কে, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। আমেরিকায় ব্যাঙ্কের শাখা বন্ধ করতে আমি ভ্রুক্ষেপ করি না, কিন্তু সারা বিশ্বে শাখা খুলতে আমরা আগ্রহী (টোকিও বক্তৃতা, ১ এপ্রিল ১৯৯৫ – নিজে শুনেছি)”। পরের বছর ইউক্রেনে খোলা হল আমাদের শততম শাখা।
খুব শিগগির ‘এ- ফোর’ কাগজের দু’পিঠে ফোটোকপি করার ফরমান বাতিল হল। খদ্দেররা দেখা করতে এলে চায়ের সঙ্গে টা পেলেন আবার।
পূর্ব ইউরোপ সহ আফ্রিকা, আরব সাগর অঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ার সকল উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন প্রভূত অর্থ। তিরিশের বেশি দেশের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং পরিচালনার দায়িত্ব নিল সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডনের যে বিভাগ, সেখানে একদিন ডাক পড়ল আমার। এর সঠিক কারণ কোথায় নিহিত ছিল জানি না – ঝাকশেভোতে অনুষ্ঠিত নাটকের মূল গায়েন অ্যালানের পরোক্ষ প্ররোচনা, বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে আমার ঝুঁকি-সম্পর্কিত পরিচিতি, নতুন নতুন দেশে সিটি ব্যাঙ্কের দ্রুত বাণিজ্য বিস্তার অভিলাষ অথবা তৎকালীন উন্নয়নশীল দেশগুলির মুখ্য আধিকারিক শওকত আজিজ তথা তস্য সুযোগ্য উত্তরসূরি আলমানের সরাসরি নির্দেশ – বা অন্যকিছু?
আমার জীবনটা ঘটনা নামক চক্র দ্বারা পরিচালিত।
এতদিন বিক্রেতার বা রপ্তানিকারকের অর্থ উদ্ধারের ঝুঁকি সমাধানের চেষ্টা করেছি আমরা। সিটি ব্যাঙ্কের খাতায় এবং মুরোদে না কুলোলে খানিক বেচেছি অন্যান্য ব্যাঙ্কের কাছে। মোদ্দা কথা, কর্পোরেট খদ্দের যেন খুশহাল, সন্তুষ্ট থাকেন। এবার খেলা অন্য প্রকারের। উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন অর্থের আর সেই অর্থের ভাঁড়ারের চাবিটি আছে পশ্চিমি ব্যাঙ্কের দেরাজে। এবার আমার মক্কেল মূলত তিরিশটি দেশ আর সেখানকার ব্যাঙ্ক এবং বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। যেমন, চেক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, হাঙ্গেরিয়ান ব্যাঙ্ক, স্লোভাক টেলিকম, ঘানা কোকোবোর্ড, পোলিশ তেল কোম্পানি প্লতস্ক, ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ে, রাশিয়ান গ্যাস কোম্পানি, পাকিস্তান স্টেট অয়েল, শ্রীলঙ্কা টেলিকম, ইন্ডিয়ান অয়েল, হিন্দালকো।
মনে আছে, ভিয়েনার ক্রেডিট আনস্টালট ব্যাঙ্ক ফেরাইনের নিকলস পালফি বলেছিলেন, এমন সব দেশের ও ঋণ গ্রহীতার নাম আপনারা হাজির করেন, যাঁদের সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান শূন্য। আমার ব্যাঙ্কের ছেলেমেয়েদের জাতীয় গ্রন্থাগারে পাঠাতে হয় তা জানতে (গুগল আসতে দশ বছর দেরি আছে)।
এবার ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চে অবতরণ ।
পূর্ব ইউরোপে প্রথম অংক প্রথম দৃশ্য – স্থান ওয়ারশ (পোলিশে ভারশাভা, জার্মানে ভারশাউ, ইদিশে ভারশে)।
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের ভ্রাম্যমাণ ফিরিওলা। যে যেখানে ডাকে, সেখানেই ঝুলি নিয়ে হাজিরা দিই। না ডাকলেও। তবে ওয়ারশতে বিশেষ খাতির অ্যালানের সৌজন্যে।
আমাদের কাহিনি গতে বাঁধা। তার খানিকটা কল্প কথা। নাটকের প্রথম সারির শ্রোতা এইসব উন্নয়নশীল দেশে সিটি ব্যাঙ্কের অফিসার - যাঁরা স্থানীয় কর্পোরেট এবং ব্যাঙ্কের পরিচর্যা করে থাকেন। এঁরাই তাঁদের খদ্দেরের দরোজা আমাদের জন্যে খুলে দিতে পারেন। তারপর তাঁদের ভাগ্য আর আমাদের হাতযশ। অতএব প্রথম কাজ বিশ্বাস উৎপাদন করা – আমরা কাউবয় নই। আমরা দেশের ও দশের (পড়ুন সিটি ব্যাঙ্কের লাভ এবং আপনার বোনাস বৃদ্ধির বাসনায়) মঙ্গলার্থে আন্তর্জাতিক লগ্নিকারকদের ভাণ্ডার থেকে আপনার মক্কেলের জন্য ঋণ সংগ্রহ করব। ধরুন, আপনার খদ্দেরের প্রয়োজন হাজার ডলার, সিটি ব্যাঙ্ক ১০০ ডলার ধার দিতে রাজি। আপনি খদ্দেরকে বলতে পারেন, আমরা একশ’ দিলাম, বাকিটা চেয়েচিন্তে যোগাড় করুন। কিন্তু আমাদের পরামর্শ এই, যে তাঁকে বলুন অন্যত্র যাবেন কেন, হাজারই পাবেন, সবটা সিটি ব্যাঙ্কের কাছে নয়। কীভাবে, কোথা থেকে বাকিটা আসবে, তা নিয়ে তিনি যেন কোনো মাথাব্যথা না করেন। আমরা আনব বাজার থেকে। আপনার নাম বাড়বে খদ্দেরের কাছে (আমার নিজেরও যে দু’পয়সা হবে সেটা সহজেই অনুমেয়, বলা বাহুল্য)।
এর পোশাকি নাম সিনডিকেশন। গোষ্ঠী ঋণ। মানে ঋণগ্রহীতা একজন, ঋণদাতা দশ জন – ঋণের শর্ত সবার এক। লেনেওয়ালা এক, দেনেওয়ালা দশ। টেবিলের একপাশে গ্রহীতা, অপর দিকে ঋণদাতাদের গুষ্ঠি। সুদের হার এবং পারিশ্রমিক সকলের অংশ অনুযায়ী ভাগ-বাটওয়ারা করা হয়। তবে আমাদের নিজেদের খদ্দের বলে এই সামগ্রিক ঋণ যোগাড়ের যে অঙ্গীকার তাঁর কাছে করেছিলাম, তার সাম্মানিক স্বরূপ মক্কেলের কাছ থেকে একটা বাড়তি ফি আদায় করেছি। সেটি সিটি ব্যাঙ্কের অন্দর-কি-বাত। গোপন কথাটি রবে গোপনে। অন্যেরা সেই ফি’র পরিমাণ অনুমান করে ঈর্ষান্বিত হন। তবে এটাও বোঝেন, সিটি ব্যাঙ্ক হাতের-পায়ের-মাথার কসরত না করলে এই ডিল হাওয়ায় উড়ে তাঁদের টেবিলে উপস্থিত হত না।
বহু দেশে ঐ একই ভাষণ, একই রেকর্ড চালিয়েছি। আমার শিক্ষায় গণ্ডাদুয়েক সহকর্মী সেই চিত্রনাট্য ও সংলাপ পাঠ করেছে। তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন ব্যাঙ্কের উচ্চপদে বসে এই দোহা গেয়ে সংসার প্রতিপালন করে।
পুত্র এবং শিষ্যের কাছেই মানুষ পরাজয় ইচ্ছা করে – এমন একটা আপ্তবাক্য আছে বলে জানি।
তিরিশ বছর আগে দু’দিনের পরিচয়ে হলুদ, ধূলি-ধূসরিত ওয়ারশ দেখেছি। রাস্তায় রাশিয়ান লাদা কিছু ট্রাবান্ত গাড়ি। তাদের কেশে যাওয়া ধোঁয়াতে উৎকট গন্ধ – সেগুলো টু-স্ট্রোক এঞ্জিনের মোটর। যুদ্ধে আশি শতাংশ ওয়ারশ বিচূর্ণ হয়। সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ কিছু হয়েছে, তবে দেওয়ালে অনেকদিন চুনকাম হয়নি।
সেনাটোরস্কা ১৬ নম্বরে আমাদের অফিস। জাতীয় থিয়েটারের প্রায় উলটো দিকে। সে বাড়িও পঞ্চাশ বছর রঙ-চুন দেখেনি। রাস্তা থেকে একটা গেট দিয়ে যেন কারো উঠোন পেরিয়ে দোতলায় অফিসে ঢোকা। ঝাকশেভো থেকে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে। সেই যে বেয়াতা, সন্ধেবেলা একাকী ভারতীয়কে প্রাসাদে প্রবেশ করতে দেখে সন্দিহান হয়েছিলেন, তিনি অ্যালানের খাস সেক্রেটারি। বেয়াতা মিটিং রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন। কর্পোরেট ব্যাঙ্ক আর ব্যাঙ্কিং সম্পর্ক বিভাগ নিয়ে কুল্লে পনেরোজন এলেন আমার বাণী শুনতে ।
পোল্যান্ডে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং নতুন। আমার শ্রোতারা মন দিয়ে শুনলেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না। নীরবতা স্বর্ণময়? এমন সময় দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটখাট চেহারার একজন মানুষ একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘আমাদের সঙ্গে ভাগ করে খদ্দেরকে ঋণ দেওয়ার জন্য রাজি এমন সব ব্যাঙ্ক বা তহবিলকে আপনারা একত্র করেন। কিন্তু আমার এক খদ্দের আছে, যার প্রয়োজন টাকা নয়। তারা জাহাজ বানায়। তার জন্য টাকা পায় অগ্রিম। বিনিময়ে ক্রেতাকে একটা জামিন দিতে হয় – যদি সে জাহাজ ডেলিভারি করতে না পারে, সেই জামিন বাজেয়াপ্ত হবে। একটা জাহাজ বানাতে সেই জামিনের পরিমাণ এক কোটি ষাট লক্ষ ডলার। সিটি ব্যাঙ্ক থেকে সেটা আমরা একা করতে পারি না। আপনাদের আন্তর্জাতিক ঋণের বাজারে এমন কোনো তহবিলকে ধরতে পারেন, যারা এখানে ঝুঁকির ভাগ নেবে?’
তার নাম ইয়াচেক।
কখনো কখনো একটা মুহূর্ত আসে। একটা নতুন ভাবনা। মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া। ইয়াচেকের প্রশ্ন আমার কাছে ছিল সেইরকম মুহূর্ত। ঋণের ভাগীদার জোগাড় করেছি অন্য দেশে – তারা দেনাদারকে অর্থ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে। কিন্তু একটা জামিনকে, গ্যারান্টিকে কি ভাগ করে দেওয়া যায় নিবেশকদের কাছে? শেষ পর্যন্ত ঝুঁকিটি একই। তবে এক্ষেত্রে নিবেশককে পয়লা দিনে টাকা দিতে হচ্ছে না। এটা একটা সম্ভাব্য দায়। যদি জাহাজনির্মাতা সময়মত ও প্রতিশ্রুতিমত জাহাজটি ক্রেতার হাতে তুলে দিতে না পারে, তাহলেই নিবেশককে ঐ টাকা ধরে দিতে হবে অর্থাৎ নিবেশক ঝুঁকি নিচ্ছেন জাহাজনির্মাতার কর্মক্ষমতার ওপরে। সশক্ত সমর্থ ক্রেতা প্রস্তুত আছে। জাহাজ পেলেই টাকা দেবে। নির্মাতা কি সময়মত জাহাজের ডেলিভারি দিতে পারবে ?
অর্থ নয়, সম্ভাব্য ঝুঁকির ভাগ কখনো বণ্টন করিনি। তাতে কী? দেখা যাক, ঝুলে পড়ি – চাকরি ছাড়া আমার আর কিছু হারানোর নেই।
ইয়াচেককে বললাম, হ্যাঁ করা যাবে।
জাহাজ নির্মাতার নাম স্টচনিয়া গদিনিয়া বা গদিনিয়া শিপইয়ার্ড।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পুরনো প্রাশিয়া আধখানা হল। একশ’ তেইশ বছর বাদে ম্যাপে দেখা গেল পোল্যান্ড নামক একটি দেশকে। সে পোল্যান্ডের সমুদ্রতট সীমিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাস্ত জার্মানির (লিগ অফ নেশনসের তত্ত্বাবধানে) অধিকারে রইল ডানজিগ মুক্ত বন্দর, তার সঙ্গে দু’হাজার বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ড। সেটা পুরোটাই সমুদ্র জুড়ে ।
তার সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্য ১৯২২ সালে নব গঠিত পোলিশ সরকার গদিনিয়া বন্দরের স্থাপনা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রাশিয়ার বাকি আধখানাও বিলুপ্ত। তার সঙ্গে ডানজিগ, আজকের গদানসক - এল পোল্যান্ডের অধীনে। ফলত পোল্যান্ড পেল দু’টি বন্দর, দু’টি শিপইয়ার্ড। গদিনিয়া বানাত ছোটমাপের উপকূলবাহী (কোস্টাল) জাহাজ। এ ব্যাপারে তাদের দক্ষতা অপরিসীম। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দিকটা মোটেই সুবিধের নয়। কমিউনিস্ট সরকারের নির্দেশ – জাহাজ বানানো তোমাদের কাজ। মন দাও সেদিকে। জাহাজ বেচে লাভ হল, না লোকসান হল - সেটা তোমাদের ভাবনার বিষয় নয়। তোমরা সরকারি কর্মচারী। বেতন তো বাঁধা।
কর্মন্যে বাধিকারস্তে মা বোনাসে কদাচন।
এই বৃত্তান্ত কোনোদিন কারো কোনো কাজে লাগতে পারে – এইরূপ নিতান্ত অন্যায় আশা করে এবং পাঠক, আপনার অপার ধৈর্য প্রার্থনা সহকারে, ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করি।
মনে করুন, আমাদের কোম্পানি বাড়ি বানায়। এক অর্থবান ব্যক্তি জমিজায়গা এবং কর্পোরেশনের মঞ্জুর করা প্ল্যান আমাদের হাতে সমর্পণ করে, সেই মোতাবেক একটি বাড়ি তৈরির আদেশ দিলেন। দামের বিশ শতাংশ অগ্রিম তিনি দেবেন। একটি নির্ধারিত দিনে তিনি পেতে চান সেই নবনির্মিত বাড়ির চাবি। আমরা বললাম, “ভাববেন না মল্লিক মশায়, সামনের পুজোর আগেই এ বাড়ির চাবি আপনার হাতে তুলে দেব।” তিনি বিচক্ষণ লোক। টাকা দিলেন বটে, কিন্তু এতটা আস্থা রাখাও সমীচীন মনে করেন না। ‘প্রাসাদে পাঠাভ্যাস’ পর্বে দেখেছি, হরিদাস পালকে কেউ বিশ্বাস করে না। পাবলিক চায় একটা শক্তসমর্থ, দড় গ্যারান্টি (এক্ষেত্রে অ্যাডভান্স পেমেন্ট গ্যারান্টি)।
মল্লিক মশায় বললেন, “দেখুন, কিছু টাকা আগাম তো দিলাম। কিন্তু আপনি যদি কোনো কারণবশত সময়মত এ কাজটি সম্পন্ন করতে না পারেন, তার হ্যাপা আমি সামলাতে চাই না। আপনি বরং আপনার ব্যাঙ্ক থেকে সেই আগাম টাকা বাবদ আমার নামে একটা গ্যারান্টি বা অঙ্গীকারপত্র লিখিয়ে দিন। তাতে বলা থাকবে, ঠিক দিনে আপনি বাড়ির চাবি না দিতে পারলে আপনার ব্যাঙ্ক আমার অগ্রিম প্রদত্ত টাকাটি আমাকে ফেরত দেবে।”
তার মানে এই, যে আমরা অগ্রিম কিছু টাকা পেলাম। কিন্তু সমমূল্যের জামিন চেয়ে মাছের তেলে কয়েকটি মাছ ভাজার রাস্তাটি মল্লিক মশায় বন্ধ করে দিলেন। তাঁকে আশ্বস্ত করতে যে জামিন লাগবে, সেটার সংস্থান হতে পারে আমার ব্যাঙ্কের দাক্ষিণ্যে।
আমাদের শিরে দু’টি সংক্রান্তি – মল্লিকমশায়কে তাঁর অগ্রিম টাকার জন্য জামিন দেওয়া এবং বাড়ি বানানোর বাকি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে উধার নেওয়া।
ব্যাঙ্ক যদি আমাদের কর্মক্ষমতা ও যথাসময়ে সিমেন্ট, লোহা, মজুর জোগাড় করার এলেমের ওপর আস্থা রাখে, তাহলে সেই পরিমাণ অর্থের ঝুঁকি নিয়ে কিঞ্চিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাঁরা সেই অঙ্গীকারপত্র বা গ্যারান্টি দেবেন এবং বাকি টাকা ধার দেবেন। ব্যাঙ্ককে দেওয়ার মত আর কোনো সুরক্ষাও আমাদের হাতে নেই। অট্টালিকা তৈরি হয়নি, যে সেটি বন্ধক দিতে পারি। ফাঁকা মাঠ, গোরু-ছাগল চরে। সন্ধেবেলা গাঁজার আড্ডা বসে। এ ঝুঁকি নিতে ব্যাঙ্ক যদি নারাজ থাকে? তাহলে আমার একমাত্র উপায় – প্রাপ্ত অগ্রিম অর্থ সেই ব্যাঙ্কে জমা রেখে তার বিনিময়ে একটি গ্যারান্টি জোগাড় করে ক্রেতাকে দেয়া। এতে ক্রেতা তুষ্ট। কিন্তু আমি সেই অট্টালিকা বানাব কী দিয়ে? বাকি টাকা কোথায় পাই? আমার গ্যাঁটের পয়সায় তো কুলোবে না!
স্টচনিয়া গদিনিয়ার ঘটনাটি ঠিক তাই। এক্ষেত্রে বাড়ি নয়, জাহাজ। ক্রেতা জার্মান। জাহাজের দামের বিশ শতাংশ সে অগ্রিম দেবে মার্কে। সে চায়, মার্ক বা ডলারের গ্যারান্টি। জাহাজ নির্মাতা পোলিশ। তার মুদ্রা জলোটি। বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের বাজারে সেটি এক নিতান্ত দুর্বল মেষ শাবক। সে মুদ্রা কোনো জার্মান জ্ঞানত গ্রহণ করবে না। বিক্রেতার একমাত্র উপায় প্রাপ্ত জার্মান মার্ক ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে গ্যারান্টি নেয়া। ফলে তাঁর হাতে টাকা নয়, রইল পেন্সিল। এবারে ব্যাঙ্কের কাছে পুরো টাকা ধার নিয়ে ড্রাই ডকে জাহাজ বানানো। পোলিশ মুদ্রার সুদের হার সে সময় শতকরা ৪০%।
কিসের ভিত্তিতে কোনো ব্যাঙ্ক এই কোম্পানির হয়ে গ্যারান্টি দিতে পারে? জাহাজ এঁরা বানিয়েছেন অনেক। সে কাজে লাভ হয়েছে না লোকসান – তার খবর রাখেন না। এখন শোনেন, বাৎসরিক হিসেবনিকেশের খাতায় নাকি প্রভূত লাল কালি! সিটি ব্যাঙ্ক কি এই পুরো শিপইয়ার্ডটি বন্ধক নিয়ে ধার দিতে পারে? নিয়ে হবেটা কী? খদ্দের টাকা দিতে না পারলে আমরা এটা কাকে বেচব?
আনন্দমঠের মত তখন উত্তর হইল, আস্থা!
আমাদের নমস্য ক্রেডিট গুরু আর্ট গ্র্যান্ডি বললেন, জাহাজ এরা অতীতে বানিয়েছে। ঐতিহাসিক প্রমাণ প্রভূত। টাকা পেলে আবার বানাবে – সে বিশ্বাস আমাদের আছে। যে টাকা তারা অগ্রিম পাবে, তার জামিন আমরা দেব। সেই টাকা নিয়ে এরা জাহাজ বানানো শুরু করুক। যে জাহাজ তখনও তৈরি হয়নি, সেটি নেব বন্ধক! মনে কর, একপাশে রাখা আছে আমাদের ধার দেওয়া জলোটির স্তূপ। সেই অর্থ দিয়ে এরা জাহাজ তৈরি করবে। যেমন যেমন জাহাজ গড়ে উঠবে, সেই স্তূপাকৃত জলোটির পরিমাণ কমবে, বাড়বে আমাদের সুরক্ষা। একদিন অর্থ বিলীন, কিন্তু তখন মাথা উঁচু করেছে এক জাহাজের মাস্তুল। কাজ সম্পূর্ণ হলে, পুরো জাহাজটা আমাদের কাছে বন্ধক রইল, কিন্তু আমাদের ঝুঁকির পরিমাণ ৮০%। এদের প্রয়োজন ১ কোটি ষাট লক্ষ ডলার। সিটি ব্যাঙ্ক তিরিশ লক্ষের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এবারে বাছা বাজারে যাও, অন্যান্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বল। তারা কি আমাদের পাশে থেকে একই চুক্তি ও কড়ারে বাকি এক কোটি তিরিশ লক্ষ ডলারের ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নিতে পারেন?
বাজার? কোথায় বাজার?
পশ্চিমের কাছে পূর্ব ইউরোপ অচেনা এলাকা। এক দেউলে জাহাজ কোম্পানির ঝুঁকি নেবে কোন মর্কট? জাহাজ এরা বানাতে পারে। সেটা কাগজে-কলমে দ্রষ্টব্য। তবে সাফল্যের সঙ্গে উপকূলগামী জাহাজ বানিয়ে বছরের পর বছর লোকসান করে চলেছে। পশ্চিমি কায়দায় বাৎসরিক হিসেব শুরু করা থেকে দেখা গেছে তাদের ভাঁড়ে মা ভবানী।
১৯৯৩ সাল অবধি সারা পূর্ব ইউরোপে বাণিজ্যিকভাবে (পারস্পরিক সরকারি ঋণ বাদে) কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী ঋণের কারবার হয়নি। পশ্চিমি ব্যাঙ্কের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কাউকে ফোন করে কোনোরকম অভিমত জানব, যাকে বলে মার্কেট রিড, তারও উপায় নেই। এক্ষেত্রে একমাত্র অভিমত আমাদের নিজেদের। সেইটেই অন্য ব্যাঙ্কের মাথায় ঢোকানো – সিটি ব্যাঙ্ক এদের জানে, বিশ্বাস করে – এরা জাহাজ বানাতে ও সময়মত অর্পণ করতে পারে। সিটি ব্যাঙ্ক মনে করে, এক বছরের এই ঝুঁকির মুল্য ২%। এই বার্তা গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে দেওয়াটা আমাদের ব্রত! কাজটা কঠিন ছিল। তবে সে এক আশ্চর্য উন্মাদনার দিন – মনে হয়েছে আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। আমার দলের জার্মান মেয়ে কিরসটেন, চেক/আমেরিকান উইল রোকা, হাঙ্গেরির লাসলো, সদা-সর্বদার সঙ্গী ইংরেজ মেয়ে অ্যাঞ্জেলা, ইস্তানবুলের আহমেত –সবাইকে বলেছি, মনে রেখো – একদিন বালটিক সাগরের ধারে দাঁড়িয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানসন্ততিকে বলতে পারবে – এইসব জাহাজ আমাদের অর্থ সহায়তায় তৈরি হয়েছে!
আমি কৃতজ্ঞ সিটি ব্যাঙ্কের সেই সব মানুষের কাছে, যারা আমাদের বিশ্বাস করে শুধু এগিয়ে যেতে নয়, একটি স্বপ্ন দেখার অধিকার দিয়েছিলেন। গত শতাব্দীর শেষ দশকে আমরা সারা পূর্ব ইউরোপ জুড়ে কাজ করেছি, কিন্তু আমাদের সিঁড়ি ভাঙা সবে শুরু। এখানে আছাড় খেলে এ পথে কতটা এগোনো যেত, তাতে সন্দেহ আছে।
লন্ডন-প্যারিস নয়। প্রথম ব্যাঙ্ক মিটিং স্থির করলাম ভিয়েনাতে। কেন ভিয়েনা? হয়তো অনুভূতি, যাকে আমেরিকানরা গাট ফিল বলে। খানিকটা ইতিহাস – অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য পোল্যান্ড চিনত। আরেকটা কারণ, আমার ভিয়েনিজ ব্যাঙ্কিং বন্ধুবর্গ। ফ্রাঙ্কফুর্ট-লন্ডনের চেয়ে হাম ভি কুছ কম নহি, এ গর্ব তাঁরা করেন। বারবার তাঁরা দাবি করেছেন, ভিয়েনা ও অস্ট্রিয়া হল পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে কাছের লোক। ভূগোলের হিসেবে কথাটা খুব সত্যি! কোনো সন্ধ্যায় ভিয়েনার শোয়েখাট বিমানবন্দরে প্লেন নামার সময় বাঁদিকের জানালার বাইরে আপনি প্রথমেই যে আলোকিত নগরীটি দেখেন, সেটি ভিয়েনা নয়। স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভা বা প্রেসবুরগ! শোয়েখাট থেকে ভিয়েনা যাবার অটোবানের ওপরে প্রাগ/ব্রাতিস্লাভা/লুবলিয়ানা/বুদাপেস্ট/জাগ্রেব শহরের নিশানা দেখতে পাবেন!
দূরত্ব? বুদাপেস্ট আড়াই, প্রাগ সাড়ে তিন, ব্রাতিস্লাভা ঘণ্টাখানেক।
অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য মূর্ত হয়ে ওঠে আমার কাছে।
ঝাকশেভোর পরে ঠিক এক বছর কেটে গেছে। আরেকটা নভেম্বর। তবে ভিয়েনার শীত পোল্যান্ডের শরতকালের সন্ধে। সোমবারে আমার ছোট কর্মীবাহিনী নিয়ে ভিয়েনার গ্র্যান্ড হোটেলে উঠেছি। বিকেল নাগাদ স্টচনিয়া গদিনিয়ার সিইও এবং তাঁর সাগরেদ ক্রিস্তফের এসে পৌঁছানোর কথা। আসেননি। তাঁরা ফোন করে জানালেন, ব্যাপার গুরুতর। ওয়ারশ বিমানবন্দরের কর্মীরা অকস্মাৎ ধর্মঘট করেছেন। অগত্যা তাঁরা ট্রেনে ভিয়েনা আসছেন। হিসেবমত ট্রেন পৌঁছুবে কাল সকাল ছ’টায়। আমাদের ব্যাঙ্ক মিটিং বা পথসভা দশটার সময় নির্ধারিত। আমন্ত্রিত ছয়টি ব্যাঙ্কের ১০ জন আসবেন। আমাদের প্রস্তুতি পুরোদমে চলল। সব স্লাইড রেডি। কিন্তু আমরা তো মূল নাটকের পার্শ্ব অভিনেতা। নায়ক আন্দ্রে, সহ নায়ক ক্রিস্তফ আসছেন রাতের ট্রেনে! সময়মত এসে পৌঁছালে বাঁচি।
পরদিন সকালে চা পান করে রিসেপশানে উৎকণ্ঠ হয়ে বসে আছি। সাতটার সময় ঝোড়ো কাকের চেহারা নিয়ে আন্দ্রে ও ক্রিস্তফের প্রবেশ। সারারাত্তির প্রায় জেগে কাটিয়েছেন। দু’বার পাসপোর্ট চেকিং। একবার চেকোস্লোভাক, আরেকবার অস্ট্রিয়ান সীমান্তে পুলিশ ঘুম থেকে তুলে পাসপোর্ট দেখেছে। আমি বললাম, একটু কিছু মুখে দিয়ে শুয়ে পড়ুন। স্নান করে ন’টার সময় আসুন। আমরা কথা বলব তখন।
মোটামুটি ভদ্রস্থ চেহারায় দু’জনে দেখা দিলেন প্রাতরাশের ঘরে। প্রথমেই আন্দ্রে বললেন, আমি পোল্যান্ডে আপনার মতন জনা দুই ব্যাঙ্কার দেখেছি বটে। তার বাইরে বিদেশি কোনো ব্যাঙ্কারের সঙ্গে আমার এই প্রথম সাক্ষাত হবে। আর বলছেন একসঙ্গে জনাদশেক আসবেন! এঁদের সামনে আমি কী বলব? আমাদের কোম্পানির আর্থিক হাল আপনারা জানেন। তার কী ব্যাখ্যা দেব? আর তাঁরা এর কী-ই বা অর্থ করবেন?
এর পরে যে বাক্য বিনিময় হল, সেটি আমার স্মৃতিতে অমলিন। অকস্মাৎ কোন ভূত মাথার ওপরে সওয়ার হয়েছিল জানি না।
আন্দ্রে, আপনি সিইও। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই কাজ শুরু করেন গিদনিয়াতে। নিজের হাতে কাজ করেছেন কখনো, না কেবল লোক চরিয়েছেন?
আন্দ্রে আহত হলেন। সেটাই আমার অভিপ্রায়।
“হীরেন, আপনি কি ভাবেন সিইও হয়ে এখানে কাজ শুরু করি? আমি নিজের হাতে জাহাজ বানিয়েছি। জাহাজের খোল থেকে ক্যাপ্টেনের স্টিয়ারিং হুইল অবধি। লোক চরিয়ে মাতব্বরি করিনি। বিশ বছর বাদে এরা আমাকে এই অফিস দিয়েছে। আমার মন পড়ে থাকে হাতুড়ি শালায়। আপনি জানেন না – আমার বাবা সারাজীবন এখানে হাতুড়ি পিটিয়েছেন। তার মধ্যে পাঁচ বছর জার্মানদের অধীনে জাহাজ তৈরি না হলেও, জার্মান যুদ্ধ জাহাজ সারানোর কাজ করেছেন – পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে। একদিনও কাজ বন্ধ করেননি। আমার গর্ব আমি এখানে কর্তা হয়েছি। বাবা দেখে গেছেন।
এ প্রশ্ন কেন?”
আমি বললাম, “আন্দ্রে, আমাদের কাজ একটা প্রকল্প বা ধরুন একটা স্বপ্ন বেচা। আমরা এই ধরনের পথসভা বা ব্যাঙ্কারদের মিটিং-এ ঋণগ্রহীতার বিগত তিন বছরের হিসেবনিকেশ দেখাই। আগামী দিনের পরিকল্পনা – পাঁচ বছরের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরি। লগ্নিকারীদের মনোযোগ ও অর্থ আকর্ষণ করি। এখানে সে রকম কোনো গল্প নেই। আজ যে সব ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে, তাদের কারো কোনো শাখা নেই পোল্যান্ডে। এঁরা কেউ আপনার শিপ ইয়ার্ড দেখেননি। স্টচনিয়া গদিনিয়ার বিগত পাঁচটা বাৎসরিক হিসেবনিকেশ কাউকে কোনো আশ্বাস দেবে না। আপনাদের অর্ডার বুকে ক’টা জাহাজ আছে আপনি দেখাতে পারেন, কিন্তু সেগুলো কীভাবে বানাবেন, তার কোনো গ্রহণযোগ্য গল্প নেই।
এই সকালে, দশ জন অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কারের সামনে আপনার, আমাদের একটাই গল্প। আপনাদের হাতে অর্ডার আছে। আপনার বাবা জাহাজ বানানোর কাজ করেছেন সারাজীবন। আপনি জাহাজ বানিয়েছেন, আবার বানাবেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ আপনাদেরই হাতে।”
প্রথমে আমাদের উদ্বোধনী ভাষণ। আজ এক ঐতিহাসিক দিন। সদ্য উন্মোচিত পূর্ব ইউরোপের এক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ঋণের বাজারে আত্মপ্রকাশ করছে – এই প্রথম। বাজারি অর্থনীতির সঙ্গে নতুন পোল্যান্ডের পরিচয় আজ এখানে, এই ভিয়েনাতে।
এরপর আন্দ্রের অভিভাষণ। ইংরেজি তেমন সবল নয়। তবে আবেগ তাঁকে দ্রুত আচ্ছন্ন করল। তিনি বলে চললেন, আমার বাবা জাহাজ বানানোর কাজ করেছেন। আমিও করেছি। গদিনিয়ার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এককালে আমরা জার্মান বন্দর ডানজিগের (গদানসক না বলে জার্মান নাম ব্যবহার করলেন) সঙ্গে পাল্লা দিয়েছি। মাঝের চল্লিশ বছর আমাদের ব্যবসাপদ্ধতি ঠিক আমাদের হাতে ছিল না। কিন্তু জাহাজ বানানোর ব্যাপারে পোল্যান্ডের ঐতিহাসিক সাফল্য আছে। আমাদের দক্ষতা আজও অসামান্য। সেটির সম্মান করেন জার্মান ও ফরাসি ক্রেতারা। তাই আমাদের অর্ডার-বুক ভর্তি। আপনাদের সাহায্য পেলে আমরা সেইসব জাহাজ যথাসময়ে জলে ভাসাব।
আমি দলের ছেলেমেয়েদের বলতাম, আমাদের কাজ উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিশ্বের বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। গল্প বলি। ভবিষ্যতের ছবি আঁকি। কিন্তু সততার সঙ্গে আপোষ করে নয় – কঠোরভাবে তথ্যনিষ্ঠ হতে হবে, হাতে পাওয়া তথ্য ভাগ করে নিতে হবে। যদি গল্প জোরালো না হয়, আবেগের আশ্রয় নাও। বন যাও সপনো কে সওদাগর, ড্রিম মার্চেন্টস! আন্দ্রেকে আমি এমন কোনো জ্ঞান দিইনি। আমার অধিকারে ছিল না। তবে তিনি যে ভাষণটি দিলেন, তা কেতাবি নয়, অন্তরের কথা। এরপরে বেচারি ক্রিস্তফ গদিনিয়ার করুণ অর্থনৈতিক অবস্থার বিশদ বর্ণনা দিলেন। নির্মম সেই সংখ্যা - তার মধ্যে কোনো আবেগ পাঞ্চ করা শক্ত! সবশেষে আমরা বোঝালাম ব্যাঙ্কগুলি কীভাবে এই অঙ্গীকার বা গ্যারান্টির ভাগাভাগি করে নিতে পারে – টেকনিকাল ডিটেল।
আগে-পরে মিলিয়ে উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থসংগ্রহের প্রয়াসে বাইশ বছরে অনেক পথসভা করেছি। সবসময় মনে হয়েছে, এ যেন আমার নিজের মেয়ের বিয়ে। পরিকল্পনা, উদ্যোগ, আশানুরূপ অভ্যাগত এল কিনা, সমাবেশে তাদের দেখাশোনা করা, দাঁড়িয়ে থেকে শেষ অভ্যাগতকে বিদায় দেওয়া পর্যন্ত রীতিমত নার্ভাস লাগত। এঞ্জেলা, লিন, নাতালিয়া – বিভিন্ন সময়ে কতবার বলেছে, তুমি চুপ করে বোসো! আমরা আছি!
ভিয়েনার এই দিনটায় আমার অনুভূতি একেবারে অন্য রকম। সমাগত ব্যাঙ্কগুলিকে যথারীতি আপ্যায়ন করে তাদের সঙ্গে নানান গল্পগাছা করে বিদায় নিলাম। একবারও কাউকে জিগ্যেস করিনি তারা কী ভাবছে। তাদের আর কোনো প্রশ্ন আছে কিনা। এই মহান যজ্ঞে অংশ নেবে কিনা। যে কোনো ব্যাঙ্ক মিটিং-এর পরে যে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন আয়োজকরা করে থাকে।
সন্ধের প্লেনে লন্ডন ফিরব আমরা। ভিয়েনা শহরের মাঝে বৃহৎ স্টাড পার্কের পুবদিকের গেটে ঢুকতেই একটা অসাধারণ স্ট্যাচু আছে। য়োহান স্ট্রাউস বেহালা বাজাচ্ছেন – ড্যানিউবের দশটি জলপরী মুগ্ধ হয়ে তা শুনছে। কতবার সে পথে যাওয়া আসা করেছি। কখনো মন দিয়ে লক্ষ্য করিনি। গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্ট যাবার পথে ম্যারিওট হোটেলের উলটোদিকে ট্রাফিক লাইটে ট্যাক্সি আটকে ছিল। অনেকক্ষণ সেই আলোকিত স্ট্যাচুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষ কেতাবে ইতিহাস পড়ে। আমরা নিজেই কি আজ একটা ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়ছি? মনে একটা গভীর প্রশান্তি। স্ট্রাউস ভর করেছিলেন। রাতে বাড়ি ফিরে গেশিখটে আউস ডেম ভিনারভালড (ভিয়েনা অরণ্যের কাহিনি) ভালতস শুনলাম দু’বার। চোখ বন্ধ করে।
ইতিহাসের সঙ্গে বাণিজ্যের যোগ সবসময় খুঁজেছি। ভালোয়-মন্দয় মিলিয়ে পোল্যান্ড তো জার্মানির প্রতিবেশী। অতএব এরপরের মিটিং ফ্রাঙ্কফুর্টে করা সাব্যস্ত হল। সেই শহর – কলকাতার পরেই যাকে আমি সবচেয়ে বেশি চিনি – দেড় দশক আগে এখানে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার অফিসে আমার প্রবাসী কর্মজীবন শুরু। আমরা আমন্ত্রণ জানলাম কুড়িটি ব্যাঙ্ককে। জনা বারো আসবেন বললেন। ভিয়েনার পরে আন্দ্রের মনোবল দ্বিগুণ হয়েছে। আমাদেরও। শহরের মাঝখানে আমার প্রথম কর্মস্থল স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কোনাকুনি ফ্রাঙ্কফুরটারহোফ হোটেলে আমাদের পথসভা অনুষ্ঠিত হবে। মাথায় কী দুর্বুদ্ধি চাপল – পোলিশদের জানালাম হিটলার এই হোটেলে উঠতেন, এখন আমরা! তাঁরা শুনে খুব খুশি হলেন বলে মনে হল না। আমাদের অভ্যাগতদের মধ্যে একজনের পরিচিতি দেখে একটু অবাক হলাম – টরবেন নামক এক ডেনিশ ভদ্রলোক এসেছেন ওয়েস্ট ডয়েচে লান্দেসবাঙ্ক কোপেনহাগেন ব্রাঞ্চ থেকে। আমরা নিমন্ত্রণ করেছিলাম ওয়েস্ট ডয়েচে লান্দেসবাঙ্ক ডুসেলডরফকে! সেখান থেকে কেউ আসেননি। সে ব্যাঙ্কে আমার সহযোগী পেত্রা শ্মিতসের প্রতি মনে মনে রুষ্ট হলাম।
টরবেন জানালেন, ডুসেলডরফ হেড অফিস তাঁকে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিত্ব করতে বলেছে। গদিনিয়া বন্দর ডেনমার্কের কাছাকাছি পড়ে বলে বোধহয়! বিরতির সময় কফির কাপ হাতে ছোট্ট পরিধির একটা গোলাকার টেবিলের চারপাশে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছে। টরবেন বললেন, আপনারা পোল্যান্ড থেকে নতুন বাণিজ্য নিয়ে আসছেন। জানেন কি, পশ্চিম ইউরোপের ব্যাঙ্কাররা আজকাল ম্যাপে খোঁজার চেষ্টা করেন, এ জায়গাটা কোথায়। তবে অন্তত দুটো দেশ ম্যাপে পোল্যান্ড খুঁজতে বেরোয় না – জার্মানি আর অস্ট্রিয়া!
তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া হয় আমন্ত্রিত ব্যাঙ্কগুলিকে, এই সামগ্রিক ঋণে তাদের যোগদানের ব্যাপারে মতামত জানানোর জন্য। আমাদের প্রয়োজন এক কোটি তিরিশ লক্ষ ডলার। এবার অপেক্ষা। যারা না বলেন, তাঁদের উত্তর আসে দ্রুত। অন্যান্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে শুরু হয় প্রশ্নোত্তরের আসর। নানা ব্যাঙ্কের ক্রেডিট দফতরের আরও কিছু প্রশ্ন থাকে। সেগুলো সামলাতে হয়। প্রশ্ন করাটা ভালো লক্ষণ। তার মানে আশা আছে! আমাদের সময় নষ্ট করছেন না। পথসভায় আপ্যায়িত হয়েই কেটে পড়েননি। তিন সপ্তাহ কেটে গেল। অন্তত আটটা ব্যাঙ্ক তখনো তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রতিশ্রুতি এল অস্ট্রিয়ান রাইফআইজেন ব্যাঙ্ক থেকে – ৪০ লক্ষ ডলারের। খুব স্মরণীয়। আমাদের পূর্ব ইউরোপের প্রথম পদক্ষেপে প্রথম সাহায্যের হাত বাড়ালেন সে ব্যাঙ্কের মারটিন চুরদা। অনেক বছর বাদে আমরা একসঙ্গে এক অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কে কাজ করেছি – মারটিন সিইও, আমি ডিরেক্টর। অতি দ্রুত আমাদের অভীষ্ট লাভ হল। দু’টি অস্ট্রিয়ান, তিনটি জার্মান (তার মধ্যে সেই ওয়েস্ট ডয়েচে লান্দেসবাঙ্ক, কোপেনহাগেন!) এবং আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে, হল্যান্ডের একটি ব্যাঙ্ক - তাঁরা কোনো পথসভায় আসেননি – কেবল আমাদের পাঠানো কাগজপত্র পড়েই! ঋণ গ্রহীতাকে চাক্ষুষ করার বাসনায় কোনো ব্যাঙ্ক গদিনিয়া যাননি।
পরবর্তী কালে প্রাক্তন কমিউনিস্ট ইউরোপে আমরা অনেক বৃহৎ কারবার বা ডিল করেছি। কিন্তু পোল্যান্ডের একটি প্রায় দেউলিয়া জাহাজ তৈরির কোম্পানির জন্য এক কোটি তিরিশ লক্ষ ডলার জোগাড় করাটা আমাদের কাছে সবচাইতে স্মরণীয় সাফল্য।
বাজারে যখন নামি, লন্ডন-প্যারিসের অনেক চেনা ব্যাঙ্কার আমাদের এই অভিযানকে নিছক মূর্খতা আখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা এসব দেশের কোনো ব্যাঙ্কের কাছে যাইনি। আমন্ত্রিত ব্যাঙ্কগুলির অনুমোদনের বিলম্ব দেখে আমার তখনকার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এঞ্জেলা খুব চিন্তায় পড়লে আমি বলতাম, নেলসন ম্যান্ডেলার কথা মনে রেখো – যতক্ষণ না কাজটা সম্পূর্ণ হচ্ছে, সেটাকে অসম্ভব মনে হয়।
ঋণপত্রের সইসাবুদ সাধারণত লন্ডনের কোনো হোটেলে হওয়ার কথা। পূর্ব ইউরোপে আমাদের প্রথম আবির্ভাবকে স্মরণীয় করে রাখার বাসনায় আমরা সেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করি গদিনিয়া শিপইয়ার্ডে।
ঋণপত্র অসম্ভব জটিল আকার ধারণ করেছিল। জার্মান কোম্পানি জাহাজ কেনার অঙ্গীকার দিয়েছে। অতএব তার জামিনটি হবে জার্মান আইন অনুযায়ী। সেটির খসড়া সম্পূর্ণ করতে যেতে হয়েছিল হানোভারে। গদিনিয়াতে যে জাহাজ তৈরি হবে, তার বন্ধক নিতে পারি পোলিশ আইনবলে। সামগ্রিক ঋণটি হবে ইংল্যান্ডের আইন মোতাবেক! পাঁচ না হোক, তিন আইনের খেলা! সব ব্যাঙ্ককে গদিনিয়া শিপ ইয়ার্ডে আমন্ত্রণ জানানো হল। জার্মানরা এলেন – এই সুযোগে ডানজিগ দেখা হবে! চারটি ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি এলেন। অন্যেরা তাদের মোক্তারনামা পাঠালেন। ইউরোপীয় আইন অনুযায়ী, ঋণপত্রের প্রতি পাতায় ছোট সই (ইনিশিয়াল) এবং শেষে পুরো সই করতে হয়। অনুষ্ঠান শুরু হবার তিন ঘণ্টা আগে, ঘুম থেকে উঠেই আমি ছোট এবং পুরো সই করা শুরু করি – সেই চারটি ব্যাঙ্ক আর সিটি মিলিয়ে প্রায় হাজার পাতায়।
গদিনিয়ার দু’নম্বর ড্রাই ডকে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে লান্দেসব্যাঙ্ক রাইনল্যান্ড ফালতসের হাইনতস ফিরমেনিখ বিস্ময়ের সুরে বলেছিল – এই জাহাজটা আমাদের টাকায় তৈরি? আমি বলেছিলাম, এতে তোমাদের ১৭% অংশ আছে!
রাজধানী থেকে বন্দরঘাটা! এবার শুরু হল আমার পূর্ব ইউরোপের সরকারি বানিজ্যযাত্রা। ঝাকশেভোতে ছিলাম নিতান্তই অনুপ্রবেশকারি!
অয়মারম্ভ।