সাভা নদী কেবল ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়ার সীমান্ত নির্দেশ করে না। তার দুই তীরে দুটো ধর্ম, দুটো আলাদা হরফ। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া পশ্চিম ইউরোপের ঘরের মানুষ – ক্যাথলিক, ল্যাটিন হরফে লেখে। ক্রোয়েশিয়া ভেনিসের ডিউককে দু-হাত, অটোমান সুলতানকে সাত হাত দূরে সরিয়ে রেখেছিল। স্লোভেনিয়া প্রায় সাতশ’ বছর ব্যাভেরিয়ান অস্ট্রিয়ান ক্যাথলিক রাজাদের অনুগত থেকেছে—রাষ্ট্র বিপ্লবের সন্ধান তেমন মেলেনি। সার্বিয়া, বসনিয়া, মাসিদোনিয়া, মন্টিনিগ্রো পাঁচশ’ বছর অটোমান সুলতানকে খাজনা দিয়েছে। জোর করে অল্পবয়সী ছেলেদের ধর্মান্তরিত করে সৈন্যবাহিনীতে পাঠানো হয়েছে (ইয়ানুসারি) কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সামগ্রিক চাপ ছিল না। মাঝে মাঝেই স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে সে রাজার বিরুদ্ধে।
তাহলে এই নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষজন দু-দু-বার এক পতাকার তলায় সমবেত হলেন কেন? ১৯১৮ সালে এক রাজার আহ্বানে, ১৯৪৫ সালে এক সাম্যবাদী নেতার কাস্তে হাতুড়ি তারার ছত্রছায়ায়?
১৯৪১-৪৫ সালে চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট ক্রোয়াট উস্তাশে নৃশংসতায় নাৎসি জার্মানিকে হার মানিয়ে সার্ব, ইহুদি বধ যজ্ঞে নেমেছিল। টিটোর পার্টিজান বাহিনী পালটা মার দিয়ে ইয়ুগোস্লাভিয়াকে নাৎসি মুক্ত করলেন, সে দলে শুধু সার্ব এবং স্লোভেন নয়, ক্রোয়াট, মন্টিনেগ্রিনও ছিলেন। তাঁরা লড়লেন বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শেষ হলে সকলে ভাই ভাই হয়ে গেলেন? আপাতত? যেমনটি ফ্রান্সে হয়েছিল—দেশ মুক্ত হলেই লড়াকু রেজিসতঁস ও নাৎসিদের সহযোগী ভিশি ফ্রান্সের রেজিম এক অটুট ফ্রতারনিতের সকল্পে আবদ্ধ হয়েছিলেন? চার বছরের আপোষে খুনোখুনি ভুলে গিয়ে?
অথবা সকলে একত্র হলেন এক দক্ষিণ স্লাভের দেশের নামে (ইয়ুগো = দক্ষিণ, স্লাভিয়া = স্লাভের আবাস)? ইওসেপ ব্রজ টিটোর মা স্লোভেন, বাবা ক্রোয়াট, এক বউ সার্ব – একই অঙ্গে গোটা ইয়ুগোস্লাভিয়া যেন অখণ্ড অমিয় শ্রী টিটো? তাই কি তিনি সকলকে নিয়ে একটা দেশকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন?
আমার ধারণা টিটো সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে পরবর্তীকালের ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের নীল নকশাটি এঁকেছিলেন। ছ-টি রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান, পতাকা, জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার (যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্টিকেল ৫০ – যার দরুন ব্রেক্সিট সম্ভব হল!) কিন্তু সকলেই এক খোলা বাজারের সদস্য! মুদ্রা এক—দিনার। মানুষ, মূলধন, সকল বস্তু এবং সেবার অবাধ গতায়াত যা সাধারণ বাজারের মূলমন্ত্র। ১৯৯১ অবধি কোনো রিপাবলিকের নির্দিষ্ট সীমান্ত ছিল না। দেশটা ভাগাভাগি হবার পরে কোন রিপাবলিকের সীমানার খুঁটি কোনখানে পড়বে তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্ক চলে। এই গত মাসে গাড়ি চালাচ্ছিলাম জার্মানি থেকে ফ্রান্সের পথে, কখন বেলজিয়ামে ঢুকে পড়েছি জানি না—ইয়ুগোস্লাভিয়া ছিল তাই, একটি অর্থনৈতিক সমবায় সমিতি। আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেমন জার্মানি বড়ো ভাই, হল্যান্ড, ফ্রান্স মেজো-সেজো ভাই। তারা মাল বেচে, অন্যেরা কেনে! পর্তুগাল গ্রিস সেই পরিবারের হতদরিদ্র পরিজন মাত্র। তাদের জার্মান গাড়ি কেনা ছাড়া গতি নেই – যাতে তারা কিনতে পারে, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আরও ধার দেয় গ্রিসকে! সামনের বহু জন্মে তাদের ধার শোধ হওয়ার নয় (কথাটা গ্রিক মানুষের কাছে শোনা)।
পাহাড়ে ঘেরা দেশ স্লোভেনিয়ার জনসংখ্যা মেরে কেটে বিশ লাখ। আয়তনে সুইজারল্যান্ডের অর্ধেক, পশ্চিম বাংলার এক চতুর্থাংশ। তার সমুদ্র তট মাত্র ৪৭ কিলোমিটার—মানে এই ধরুন চাঁদপাল ঘাট থেকে ডায়মন্ড হারবার। কিন্তু স্লোভেনিয়া ইয়ুগোস্লাভিয়ার জার্মানি—অস্ট্রিয়ার দোরগোড়ায় অবস্থান তার। সবচেয়ে উন্নত রাজ্য। সেথায় বেকারত্ব প্রায় নেই, অথচ বসনিয়াতে বিশ শতাংশ বেকারি। স্লোভেনিয়ার জাতীয় আয় কসভোর দশগুণ (আজকের হিসেবে স্লোভেনিয়ার জাতীয় আয় ভারতের ২%; মাথাপিছু আয় ভারতের একুশ গুণ—তিরিশ হাজার ডলার)। ইয়ুগোস্লাভ অর্থনীতির দ্বিতীয় এঞ্জিন প্রতিবেশী ক্রোয়েশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেমন ফ্রান্স। জার্মানি ইউরোপের বুকে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জনসংখ্যার শতাংশের হিসেবে সবচেয়ে বেশি মারা যান ডাচ নাগরিক—কিন্তু সে সব ভুলে গিয়ে ডাচ-জার্মান-ফরাসি এই খোলা বাজারে সকলেই ভাই বেরাদর—মহা সম্মিলনী সভার মূল মন্ত্র অর্থনৈতিক। লগ যা গলে।
১৯৪৫ সালের পরে ইয়ুগোস্লাভিয়ার জন্ম লগ্নে হয়তো সেই অর্থনৈতিক লজিক ছিল মুখ্য। আদতে সার্ব বনাম ক্রোয়াট লড়াইটা শুরু হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতে। অটোমান রাজত্বের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে সার্বিয়া এক বৃহত্তর সার্বিয়ার স্বপ্ন দেখে—গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ অস্ট্রিয়ান রাজকুমারকে হত্যা করেন বসনিয়ার মুক্তির জন্য নয়, সার্বিয়ার সীমানা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু টিটোর নতুন ইয়ুগোস্লাভিয়াতে সার্ব বনাম ক্রোয়াট লড়াই মুলতুবি রইল, বিধ্বংসী যুদ্ধের পরে দেশ গড়ার দাবিতে।
স্লোভেনিয়া আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু অর্থনীতিক পাওয়ার হাউস, সে তার মাল বেচল মন্টিনিগ্রো মাসিদোনিয়ায়—বিনা শুল্কে—কিনল কিছু খাদ্যশস্য মাত্র। সহজ ভিসা পদ্ধতির সুযোগে নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠল ক্রোয়েশিয়ার ট্যুরিজম—জাতীয় আয়ের প্রায় বিশ শতাংশ। তার এক অংশ বেলগ্রেডে গেল টিটোর রাজ্যপাট সামলানোর জন্য আর এক বিশাল অংশ গেল গরিব কসভার, মাসিদনিয়ানকে খাওয়াতে পরাতে। প্রতিবাদ করে কোনো লাভ ছিল না। ভাষা, ধর্ম অন্য হতে পারে, কিন্তু আহা, সে তো তোমারই ভাই!
আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাতায় মোটা ইউরো জমা দেয় জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, কিন্তু খানেওয়ালে ডজন – আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, রোমানিয়া, বুলগারিয়া, ইত্যাদি ভাইয়েরা। ডাবলিন থেকে গলওয়ে যাওয়ার পথে দেখেছি – বারোটি সোনালি তারা মার্কা অজস্র নীল বোর্ডের ছড়াছড়ি—পথের এই অংশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বদান্যতায় নির্মিত হইল! এই যেমন কলকাতার বাসস্টপে দেখি—সেটি কোন বিধায়কের দানে তৈরি! রোমানিয়ায় বুখারেস্ট-ব্রাসভের পথের ধারে একই প্রকার বোর্ড আছে, তবে সে রাস্তা চাউচেস্কুর আমলের। ব্রাসেলসের দানের টাকা অন্য কারো পকেটে ঢুকেছে।
একটা তফাৎ অবশ্য থেকে গেল – ফুটবলের মাঠে হল্যান্ড বনাম জার্মানির সাক্ষাৎ চিরাচরিত শোধ তোলার লড়াই, সেটা কখনও থামেনি। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ফ্রান্স বনাম জার্মানির খেলায় প্রায় উন্মুক্ত গোলের দিকে ধাবমান ফরওয়ার্ড বাতিসতঁর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জার্মান গোলকিপার টোনি শুমাখার তাঁর দাঁত উড়িয়ে এবং পাঁজর ভেঙে দিলে ফরাসি রেডিও টিভি খবরের কাগজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিলিং ফিল্ড ভেরদাঁকে স্মরণ করে। খেলার মাঠে সেই পাল্টা মার দেওয়ার সুযোগটা ইয়ুগোস্লাভিয়ার ছিল না—বিশ্বকাপ অথবা ইউরোপিয়ান ফুটবলে ক্রোয়েশিয়া বনাম সার্বিয়ার দেখা হওয়ার রাস্তাটা টিটো বন্ধ করে দিয়ে যান। এক দেশ এক দল। ইয়ুগোস্লাভিয়া আটবার ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার অধিকার অর্জন করে। ১৯৯২ সালে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেশে গৃহযুদ্ধ ঘটানোর অভিযোগে খেলতে দেওয়া হয় না। ডেনমার্ক সেই শূন্যস্থানটি নিয়ে সব ভবিষ্যতবাণীকে বিফল প্রমাণিত করে জার্মানিকে হারিয়ে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হয়!
ছোটো দেশ স্লোভেনিয়া বিশাল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ছাতার তলায় আপন ধান্দা করে দিব্যি দিন কাটিয়েছে। ১৯১৮ সালে সেই সাম্রাজ্যের পতন হলে সারবিয়ান রাজা আলেকসান্দারের ডাকে তারা যোগ দিল স্লোভেন-ক্রোয়াট-সার্বদের এক মিলিত রাজ্যে। ব্যবস্থা ভালোই, জার্মান শিখতে হবে না, নতুন রাজ ভাষাটা মোটামুটি এমনিতেই বোধগম্য। তাছাড়া এরা স্বজাতি, স্লাভ! ১৯২৯ সালে দেশের নাম হল ইয়ুগোস্লাভিয়া। স্লোভেনিয়া তার প্রতিরক্ষা, বিদেশ দফতর ইত্যাদি ঝুট ঝামেলা বেলগ্রেডের হাতে আউটসোর্স করে মন দিল আপন উন্নতিতে, যেমন আজকের লুক্সেমবুর্গ – তাদের কুল্লে তিনশো সেপাই আছে, সামন্ত নেই।
দ্বিতীয় যুদ্ধে স্লোভেনিয়া কিছু কনিষ্ঠ বল নিয়ে মার্শাল টিটোর পাশে দাঁড়ায়। তিনি বিজয়ী হলেন।
রজনী পোহালে দেখা গেল টিটোর ইয়ুগোস্লাভিয়া কমিউনিস্ট কিন্তু পুরোপুরি সোভিয়েত স্টাইলের কমান্ড ইকনমি নয়। মস্কো ক্রেমলিনের মতন সকল সিদ্ধান্ত বেলগ্রেড হতে নয়, স্থানীয় শ্রমিক সঙ্ঘের দ্বারা নির্ধারিত হবে। তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য—সেখানে কোনো ছাড় নেই, গোয়েন্দা পুলিশ আছে—কিন্তু হাটে মাঠে ঘোরেন, হাল হকিকত জানেন। বিদেশ যাওয়ার, বিদেশিদের আসার বা অর্থ নিবেশ করার বাধা নেই। এককালে হাবসবুর্গ ও রাজা আলেকসান্দারকে সেলাম করেছে স্লোভেনিয়া, এবার না হয় টিটো এবং কাস্তে হাতুড়িকে সেলাম করবে—আউটসোর্সিং-এর কাজ বহাল রেখে।
ইয়ুগোস্লাভিয়ার প্রথম বিশ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাক লাগানো—কেবল পূর্ব ইউরোপ নয়, সারা ইউরোপের শীর্ষে। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা স্লোভেনিয়া: সে আমলে শহরভিত্তিক মাথাপিছু আয়-গণনা চালু ছিল—লুবলিয়ানার নাগরিক বেলগ্রেডের দ্বিগুণ কামায়!
অর্থনীতিতে আমার প্রণম্য গুরু হাইমান মিন্সকি বলেছেন, সুদিনেই ভবিষ্যৎ দুর্দিনের বীজ রোপিত হয়ে থাকে,** উজ্জ্বল দিনগুলিতেই আমরা ভুলভ্রান্তি করে থাকি। তাঁর বাণীর মূল্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ইয়ুগোস্লাভিয়া কোনো ব্যতিক্রম নয়। সেখানে ক্রমশ দেখা দিল নানান তাত্ত্বিক পরিবর্তন (এডভারদ কারডেলির সংশ্লিষ্ট পরিশ্রম থিওরি—বেজায় শক্ত) এবং তার সাথে এল অপ্রত্যাশিতভাবে তেলের দামে বৃদ্ধি – কারো কারো মনে থাকতে পারে—১৯৭৩ সালে কলকাতায় এক লিটার পেট্রোলের দাম ১.৭৩ পয়সা থেকে বেড়ে বোধ হয় পাঁচ টাকা হয়েছিল রাতারাতি। সেই প্রথম অয়েল শক – হল্যান্ডে তেলের অভাবে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। তারপর যা হয়—মিসম্যানেজমেন্ট, ইনফ্লেশন, আই এম এফের কাছে ধার, দিনারের বিনিময় মূল্যে হাজার গুণ লোকসান—এককালের জার্মানির মতন দেখা গেল দু-বিলিয়ন দিনারের নোট। সময় খারাপ। টিটো চোখ বুজলেন। এরপরে ঘটনার ঘনঘটা। এবার এক নয়, ছয় রিপাবলিক ও দুই স্বয়ংশাসিত প্রদেশ (কসভো, ভয়ভোদিনা) পালা করে রাষ্ট্রপতি হবে। তালেগোলে সারবিয়ান রাষ্ট্রপতি মিলোসেভিচ পেশী-আস্ফালন করে দুটি স্বয়ংশাসিত প্রদেশের শাসনভার নিজের হাতেই নিয়ে নিলেন – জব হম হ্যায় তো ক্যা গম হ্যায়।
প্রথম মহাযুদ্ধে অস্ট্রিয়ান প্রজা ক্রোয়াটরা লড়েছিল বিদেশি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে। সার্বরা সেদিন বলেছিল, এ মহা অন্যায়। আমরা সবাই আসলে সার্ব। ক্রোয়াটরা ক্যাথলিক সার্ব, বসনিয়াক হল মুসলিম সার্ব—মানে যারাই ইয়ুগোস্লাভিয়ায় বাস করে তারা সবাই অরিজিনালি সার্ব! অতএব সকল সার্ব এক হও!
সার্ব রাষ্ট্র গড়ো।
সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের বিরোধের যে তুষের আগুন এতদিন ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল, সেটি শিগগির লেলিহান আকার ধারণ করবে।
বার্লিন দেওয়াল ভেঙেছে, জ্যোতির্ময় না আসুন—নতুন নিশান এসেছে । ১৯৯০ সালের ইলেকশানে সব কটি রিপাবলিক তুলল কাস্তে-হাতুড়ি বিবর্জিত পতাকা। কমিউনিজমের সকাল সন্ধেবেলার সেই মধুর খেলার সমাপ্তি। স্লোভেনিয়ার মানুষকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনারা কি ইয়ুগোস্লাভিয়ার অংশ হতে চান, না স্বাধীনতা চান? ৯৬% স্লোভেনিয়ান স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলেন।
২৬শে জুন ১৯৯১ স্লোভেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তার দেখাদেখি একই দিনে ক্রোয়েশিয়া জানাল সেই একই সিদ্ধান্ত। স্লোভেনিয়ার ভেতরে মোতায়েন ইয়ুগোস্লাভ সৈন্যবাহিনী (সেখানে সার্ব-ক্রোয়াট-মন্টিনেগ্রিন এক হেঁসেলে খায়) জানে না এবার তাদের কাজ কী হবে – সার্বিয়া ফিরে যাওয়া অথবা স্লোভেনিয়ান স্বাধীনতার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেওয়া। দশ দিনের মধ্যে রণাঙ্গন নিশ্চুপ – সার্বিয়ান প্রধান মিলোসেভিচ ইতিমধ্যে অন্য ডিল করেছেন। হোক স্লোভেনিয়া স্বাধীন, যা গেছে তা যাক—দাবার বোর্ডে সে একটা বোড়ে মাত্র। বিশ হাজার সার্ব সেখানে বাস করেন কিনা সন্দেহ। তাঁর আসল লড়াই এবং লক্ষ্য—ক্রোয়েশিয়ায় বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক সার্ব নাগরিকদের জুড়ে নিয়ে এক মহান সার্বিয়া গড়ে তোলা। সাত দশক আগে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ সেই আশায় অস্ট্রিয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারিকে গুলি করেন সারায়েভোর মিলিয়াকা নদীর ল্যাটিন ব্রিজের ধারে।
ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের তিন প্রতিনিধি* ইয়ুগোস্লাভ বিচ্ছিন্নতাবাদের সমাধা করতে জাগ্রেবে এসে স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতার অধিকার মেনে নিলেন – তাঁরা বললেন, এতেই যদি ঝগড়া বিবাদ বন্ধ হয়, তবে তাই সই। ক্রোয়েশিয়ার একটি অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ ব্রিওনিতে জুলাই মাসের সাত তারিখে সকলে মিলে যে কাগজে সই করলেন তার মোদ্দা কথা ছিল – স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া মেনে নিক। ছ-ভাইয়ের সংসারে একটি ভাই না হয় আলাদা ঘরকন্না করুক, মুখ দেখাদেখি তো আর বন্ধ হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এই তিন গুণী প্রস্তাব দিলেন ইয়ুগোস্লাভিয়াতে সাধারণ বাজারের স্টাইলে এক ইউরোপীয় মুভমেন্ট গড়ে তোলা হোক—যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলছে। সেখানে কেউ আর ঝামেলা পাকাবে না – সকলে এক সূত্রে মন বেঁধে ‘সব কা সাথ সবকা বিকাশ’-এর মোচ্ছবে লেগে যাবে।
বিসমার্ক দূরের কথা, এঁরা কেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকু পড়ে আসেননি। আপাত স্বাধীনতার লম্বা দড়ি ছেড়ে দিয়ে টিটো তো ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন – রাজনীতি নয়, অর্থনীতি। লগে রহো ক্রোয়াট আউর সার্ব ভাই। চল্লিশ বছর যাবত হয়তো সেই কারণে শান্তি বজায় ছিল। এবারের বিবাদ অর্থনীতির নয়, জাতীয়তাবাদের। স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া না হয় মেনে নিল; কিন্তু আসল সমস্যা সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের পারস্পরিক শোধ তোলার বাসনা।
অব হম ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে।
স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা এল স্বল্প মূল্যে। কিন্তু ইয়ুগোস্লাভিয়ার ঘর ভাঙার সেটিই সূচনা – ঘনিয়ে আসে দেশব্যাপী অনিশ্চয়তা। এবার কার ঘর ছাড়ার পালা? কে তুলে নেবে লোটাকম্বল?
ব্রাসেলসের তিন মহাত্মা সেদিন বোঝেননি—ব্রিওনি দ্বীপের আপাত সহজ সমাধানে নিহিত ছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধের বীজ।
ছ-মাসের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এক বছর বাদে স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতাকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে আমেরিকা।
রাষ্ট্রসংঘে নিজস্ব আসন। স্লোভেনিয়া এবার একটি স্বতন্ত্র দেশ। নীড় ছোটো ক্ষতি নেই। স্মল ইজ বিউটিফুল।
পুঃ
* জিয়ানি দে মিচেলিস (ইতালি), শাক দে পু (লুক্সেমবুর্গ), হান্স ফ্যান ডেন ব্রুক (নেদারল্যান্ডস)। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর বলিষ্ঠ স্বরে এদের সমর্থন করে বলেন, এই পথেই ইয়ুগোস্লাভ বিচ্ছিন্নতাবাদী সঙ্কটের সমাধান হবে।
** "Stabilty leads to instability. The more stable things become the more unstable they will become when the crisis hits." – Hyman Minski (1919-1996)
*** দেশভাগের সময় স্লোভেনিয়ার জি ডি পি ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার; আজ ৬২ বিলিয়ন, মাথা পিছু আয় তিরিশ হাজার ডলার।