আগাথা ক্রিস্টির মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস (অ্যান্ড দেয়ার ওয়্যার নান—যা থেকে হিন্দি ছবি গুমনাম—এর পরেই সবচেয়ে জনপ্রিয় রহস্য উপন্যাস) যাঁরা পড়েছেন, অবিলম্বে এই দৃশ্যটি চিনতে পারবেন। প্রথম চলচ্চিত্র ভার্শনটি (১৯৭৪) দেখেছিলাম—তাতে মেগাস্টার কাস্ট: আলবার্ট ফিনি (যাঁকে আগাথা ক্রিস্টি এরকিউল পোয়ারোর চরিত্রে একেবারে পছন্দ করেননি), শন কোনারি, জন গিয়েলগুড, ইনগ্রিড বেরগমান, ভেনেসা রেডগ্রেভ, জ্যাকেলিন বিসে এবং আরও অনেকে। পরে জেনেছি গার দে লেস্ত, প্যারিস থেকে বাইশশো কিলোমিটার দূরের ইস্তানবুলগামী ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ইউরোপের পয়লা দূরপাল্লার ট্রেন। সময় লাগত তিন দিন। সেকালে খুব কম ট্রেন তার আপন দেশের গণ্ডির বাইরে গিয়ে স্টিমের ধোঁয়া ছেড়েছে।
আজকে যারা পবনপুত্রের মতো হাওয়ায় ওড়াউড়ি করতে অভ্যস্ত, তাঁরা শুনলে হয়তো অবাক হবেন—এই ১৯৭২ সালে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়াতে আমার সহকর্মী কীর্তি চক্রবর্তী বোম্বের ট্রেনিং সেন্টার থেকে দু-বার ট্রেন বদলে ৩০১১ কিলোমিটার দূরের ডিব্রুগড় (স্লাভিকে ডিব্রুগ্রাদ!) শহরে যায় প্রথম ব্রাঞ্চে যোগ দিতে। সবসমেত ৭২ ঘণ্টা কীর্তি পথেই কাটায়।
ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের প্রথম রুট ছিল প্যারিস–ভিয়েনা–বুদাপেস্ট–বুখারেস্ট–ভারনা–ব্ল্যাক সি ফেরি–কনস্টানটিনোপল। অটোমান সরকার বুলগারিয়ার সঙ্গে রেললাইন সংযোগ সম্পূর্ণ করার পরে নতুন যাত্রাপথ হল কনস্টানটিনোপল–সোফিয়া–বেলগ্রেড–বুখারেস্ট–বুদাপেস্ট–ভিয়েনা–প্যারিস। কালক্রমে খানিকটা দক্ষিণ ঘেঁষে জার্মানিকে এড়িয়ে দ্বিতীয় রুট নির্ধারিত হল প্যারিস–মিলান–ভেনিস–জাগ্রেব–বেলগ্রেড–সোফিয়া–ইস্তানবুল (ততদিনে কনস্টানটিনোপলের নাম বদলে গেছে)। বর্তমানে সিম্পলন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস এই পথে আসা-যাওয়া করে থাকে—তার ভাড়া: এই, তিন হাজার পাউন্ড।
মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছবি দেখার পরে আগাথা ক্রিস্টির সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হল একেবারে অপ্রত্যাশিত জায়গায়।
পেরা পালাস
তুরস্ক দেশের একটি ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক ঋণপত্র সই হবে ইস্তানবুলে। সিটি ব্যাংক তার প্রধান আয়োজক। বহু বছর যাবৎ লক্ষ্য করেছি—অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় তুরস্কের লোন সাইনিং সেরিমনি সবচেয়ে জমকালো। ঋণগ্রহীতা ব্যাঙ্কেরা একে অপরের সঙ্গে পাল্লা দিতে থাকে – কে কত আকর্ষণীয় স্থানে, কত রমরমা সহকারে তার আয়োজন করতে পারে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি দেশ বিদেশ থেকে আসবেন। তাদের সামনে তুরস্কের একটা উজ্জ্বল ছবি তুলে ধরা চাই। দুরুস্ত সভাস্থল, সর্বদা ইউরোপিয়ান তুরস্কে – কখনো বসফোরাসের (বোয়াজিচি) ওপরে চিরান পালাস বা ফোর সিজনস হোটেল, অরতাকয়, এসমা সুলতান। এলাহি খাওয়া দাওয়া, প্রভূত ভাষণ এবং সমাগত ব্যাঙ্কারদের জন্য একটি গিফট! বছরে অন্তত ছ-টা এমনি সমারোহে পাওয়া সাম্মানিক দানের স্মৃতিতে আমাদের বসার ঘর প্রায় ভরে আছে।
এবারে ভাকিফ ব্যাঙ্কের ঋণপত্র সই হবে একেবারে অন্য জায়গায়, বসফোরাসের জলরাশি থেকে দূরের এক হোটেলে। তার নাম পেরা পালাস (প্যালেস)। গোল্ডেন হর্ন থেকে গালাতা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁ দিক বরাবর গেলে এই হোটেল (তুর্কিতে ওতেলি)। দক্ষিণা এতই বেশি, যে আমাদের রাত্রিবাসের খরচা সিটিব্যাঙ্ক দেবে না। কোনো একটা মোচ্ছবে বা সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অবশ্য কোনো অসুবিধে ছিল না—শুধু ট্যাক্সি ভাড়া লাগে।
এটি একটি নিও ক্লাসিকাল ধাঁচের বাড়ি। ১৮৯২ সালে তৈরি—অটোমান সুলতানদের প্রাসাদ ছাড়া এই প্রথম কোনো বেসরকারি বাড়িতে বিদ্যুৎ-সংযোগ হয়; প্রথম বৈদ্যুতিক লিফট, যা আজো সচল। প্রাথমিক উদ্দেশ্য: ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাত্রীদের আসা-যাওয়ার পথে রাত্রিবাস। অনুমানে অসুবিধে নেই—সে আমলে সে ট্রেনের যা ভাড়া ছিল, তাতে আজ দশবার হাওয়াই জাহাজে প্যারিস-ইস্তানবুল যাতায়াত সম্ভব।
১৯২৬ থেকে আগাথা ক্রিস্টি নিয়মিত ইস্তানবুল আসেন। সব সময়ে থেকেছেন পেরা পালাস হোটেলে। ৪১১ নম্বর ঘরটি ছিল তাঁর খুব প্রিয়। হোটেল কর্তৃপক্ষ তখন সে ঘরটি খালি থাকলেও অন্য কাউকে দিতেন না। একবার, ১৯২৯ সালের শীতকালে প্রচণ্ড তুষারপাতের কারণে ইস্তানবুলের অদূরে চেজারকয় শহরের কাছে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছ-দিন আটকে থাকে। তখন আগাথা ক্রিস্টি পেরা পালাসে ছিলেন। ক্রোয়েশিয়ার স্লাভন্সকা ব্রোদে ট্রেন থেমে যাওয়াটা সেই ঘটনার ওপরেই আধারিত। দুয়ে দুয়ে চার। তাই জনরব ওঠে—আগাথা ক্রিস্টি তাঁর ঘরেই মার্ডার অন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস লেখেন। পেরা পালাসের ৪১১ নম্বর ঘর এখন মিউজিয়াম—অন্য কেউ সেখানে রাত্রিবাস করতে পারেন না, এমনকি রাষ্ট্রপতি এরদোইয়ান-ও। ভাকিফব্যাঙ্কের লোন সই হবার পরে হোটেল ম্যানেজার খুব গর্বের সঙ্গে আমাদের সেই ঘরটি দেখালেন, ছবি তুললেন। সিনেমা দেখেছি বটে, কিন্তু বইটা কখনো পড়িনি। আশা করেছিলাম এক কপি ফিরি-তে দেবেন! দিলেন না।
ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের তিনদিনের যাত্রা শুরু হত সন্ধেবেলা ইস্তানবুল থেকে। এই পেরা পালাস হোটেলে সান্ধ্যভোজন শেষে যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হত তিন কিলোমিটার দূরে, গোল্ডেন হর্নের পাশে সিরকেচি স্টেশনে। সেখানে গিয়ে তাঁরা ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে আরোহণ করতঃ আরামদায়ক শয্যায় শায়িত হতেন। নিদ্রাভঙ্গ এবং প্রাতরাশ বুলগারিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে। বেলগ্রেড অবধি অটোমান সাম্রাজ্য, তারপরে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজত্ব। বেলগ্রেড জংশন পেরিয়ে ট্রেন যেত প্রথমে খাড়া উত্তরে, পরে পশ্চিম পানে—বুখারেস্টের দিকে; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বেলগ্রেডে বাঁয়ে মুড়ে সিধে পশ্চিম পানে—এ পথে বেলগ্রেডের পরেই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন জাগ্রেব, ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী। মোটরগাড়ি বা সস্তায় বিমান সফরের আগের যুগে ট্রেন ছিল অর্থবান মানুষের দূরান্তর যাত্রার একমাত্র বাহন। আজকে শুনলে অবাক হতে হয়—ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে কুল্লে ৪৬ জনের বসবার ও শোবার ব্যবস্থা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মাঝে লৌহ-যবনিকা নামে। ট্রেন আসত ফ্রান্স–জার্মানি–অস্ট্রিয়া হয়ে জাগ্রেব—সেখান থেকে লাইন আলাদা। বেলগ্রেড দিয়ে সোফিয়া অথবা বুদাপেস্ট, বুখারেস্ট। বিশ্বযুদ্ধের পরে ইতালি এবং অস্ট্রিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপে প্রবেশের পরে প্রথম যাত্রাভঙ্গ জাগ্রেবে—জেমস বন্ড/শন কোনারির দ্বিতীয় ছবি, ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ-এ সীমান্তের তত্ত্ব তল্লাশি দেখানো হয় জাগ্রেব স্টেশনে।
ক্রোয়েশিয়ার কিসসায় ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ও পেরা পালাস নিয়ে এই আমড়াগাছি কেন? এহ বাহ্য।
ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ে
ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে আমার বাণিজ্যিক পরিচয় রেলপথের কল্যাণে। ১৯৯১ সালের জুন মাসে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে – ইয়ুগোস্লাভ সার্বিয়া কোনোমতেই যুগোস্লাভিয়াকে খণ্ডিত হতে দেবে না। বন্ধু ও প্রতিবেশিকে রক্তাক্ত করেও তারা বজায় রাখতে চায় ইওসিপ টিটোর যুগোস্লাভিয়া। একান্ত অসম এ লড়াই চলে তিন বছর। ক্রোয়েশিয়ার কোনো সামরিক বাহিনী ছিল না—একমাত্র ভরসা পুলিশ কনস্টেবল বা কনিষ্ঠ বল! শোনা গেছে অনেক ক্রোয়াট জার্মানি থেকে সপ্তাহান্তে লড়াইতে ভাগ নিয়ে আবার সোমবারে কাজে ফিরে গেছেন। ক্ষয়ক্ষতি প্রভূত। জাতীয় আয়ের এক চতুর্থাংশ বিনষ্ট – প্রায় চল্লিশ বিলিয়নের মতন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে রেলপথ।
ইংল্যান্ডের ডার্লিংটন থেকে স্টকটন অবধি প্রথম রেল চলার ৩৫ বছরের ভেতরে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজারা ক্রোয়েশিয়াতে ট্রেন লাইন পাতার কাজ শুরু করেন। কালে সেটি একটি যাতায়াতের অত্যন্ত জরুরি ধমনীরূপে অভিজ্ঞাত হল। ভিয়েনা থেকে গোটা বলকানে শাসন ও ট্যাক্স আদায়ের জন্যে এই যোগাযোগ অত্যন্ত জরুরি। টিটোর ইয়ুগোস্লাভিয়াতে ক্রোয়েশিয়ান রেল ছিল একটি বিভাগ—এই যেমন ধরুন আমাদের পূর্ব রেল। স্বাধীনতা ঘোষণার দিনে—জুন ১৯৯১—যে ক-টি ওয়াগন এবং ট্রেনের বগি ক্রোয়েশিয়ার সীমানার ভেতরে ছিল, তাই হয়ে গেল তাদের মোট রেল পরিবহন সামগ্রী (দেশে থাকতে দেখেছি, ট্রেনের দেওয়ালে লেখা থাকত—এটি আপনার জাতীয় সম্পত্তি; পাখা খুলে নিয়ে কেউ লিখে গেছে—আমার সম্পত্তির ভাগ বুঝিয়া লইলাম)। রেল মন্ত্রকের সূচনা হল। সেগুলো নিয়ে তারপরে তৈরি হল একটি রেল কোম্পানি – ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ে।
আজকের ক্রোয়েশিয়াকে অনেকে চেনেন, জানেন। স্প্লিট, জাদার সবার ইউরোপ ভ্রমণ তালিকার অন্তর্গত। দুবরোভনিকের মত রূপকথার শহরে আপনি যখন হেঁটে বেড়ান, একবার মনে করার চেষ্টা করবেন—তাদের আপন ভাই ও প্রতিবেশিরা তার বিনষ্টি সাধনের বিপুল প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিল এই মাত্র আঠাশ বছর আগে। শহরের মধ্যমণি স্ত্রাদুন (পাথরে বাঁধানো পথ—আমার বাড়ির মেঝের চেয়েও ঝকঝকে!) সারবিয়ান, মন্টিনেগ্রিন বোমার আঘাতে জর্জরিত হয়েছিল। আজ তার কোনো চিহ্ন নেই। আকারে ভারতের ২%, কিন্তু একটি দীর্ঘ সমুদ্র তটরেখার অধিকারী (পৃথিবীর ২১তম) এ দেশ। জুরিখ থেকে পূর্ব আফ্রিকা যাবার পথে উজ্জ্বল দিনে আকাশ থেকে সারা ডালমেশিয়ান উপকূল দেখেছি। নীল আদ্রিয়াটিকের ওপরে অসংখ্য দ্বীপ। ক্রোয়েশিয়াকে আরও সবাই চেনেন ফুটবলের কারণে—স্বাধীনতার পাঁচ বছরের ভেতরে ক্রোয়েশিয়ান টিম (মুখ চলতি নাম ভেতরেনি) ইউরো ১৯৯৬-এ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে। ১৯৯৪ সাল থেকে একবার বাদে প্রতিটি বিশ্বকাপ খেলেছে। ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে তৃতীয় স্থান (কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানিকে ৩-০ গোলে হারায়। সে সময় ক্রোয়েশিয়ার জনসংখ্যা চল্লিশ লক্ষ আর জার্মানির সমস্ত শ্রেণির রেজিস্টার্ড ফুটবল খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৩৫ লক্ষ!)। ২০১৮ বিশ্বকাপে তারা রানার্স আপ। ২০২২ সালের সেমিফাইনালিস্ট।
গৃহযুদ্ধ চলল তিন বছর। অনেক পারস্পরিক খুন-খারাবির পরে ১৯৯৫ সালে সারবিয়ান সৈন্য বাহিনি ফিরল আপন দেশে। যুগোস্লাভিয়া বলতে বাকি রইল শুধু সার্বিয়া আর মন্টিনেগরো (কালো পাহাড়)। রেলপথ সংস্কার খুব জরুরি—জাতীয় আয়ের চার ভাগের একভাগ আসে ট্যুরিজম থেকে। কিন্তু রেল মেরামতের টাকা নেই—ধার দেবে কে?
পুবের বন্ধ দুয়ার ভেঙে পড়তেই সিটিব্যাঙ্ক প্রায় জ্যোতির্ময়ের বেশে হাজির হয়েছে প্রাক-কমিউনিস্ট দেশগুলিতে। ওয়ারশ, প্রাগ, বুদাপেস্ট, মস্কো, ব্রাতিস্লাভায় আমাদের নীল পতাকা উড়ছে। বলকানে তখন গৃহযুদ্ধ—সেখানে দোকান খুলে বসাটা আমরা সমীচীন মনে করিনি। লন্ডন থেকে ব্যাঙ্কিঙ্গের পসরা ঝুলিতে নিয়ে ফিরি করতে যেত আমাদের লোকজন। তাদের একজন রজার – সে যোগাযোগ রাখত সম্ভাব্য ঋণ গ্রহীতাদের সঙ্গে। জুতসই খদ্দের পেলে আমাদের কাজ শুরু। এই ভাবেই বাজার থেকে ডলার তোলার আলোচনা শুরু হয় ক্রোয়েশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে। একাকী গায়কের নহে তো এ গান, সঙ্গে জুটল জার্মানির ড্রেসনার ব্যাঙ্ক। তারা তখনও পুবে দোকান খোলেনি। লাইফবয় যেখানে, স্বাস্থ্যও সেখানে – অতএব ডলার যোগানের ফিল্ডে নামল সিটি ও ড্রেসনার ব্যাঙ্ক। যেখানে জনতার প্রয়োজন সেখানেই সিটি ব্যাঙ্ক! গালগপ্পো নয়—যাবতীয় অর্থনৈতিক পত্রিকায়, এমনকি সকল খবরের ভাণ্ডারী গুগল খুঁজলে এই কর্মকাণ্ডের হদিশ পাবেন।
আজকের ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে হলে বলা আবশ্যক, বলকানের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম পশ্চিম ইউরোপের দৈনন্দিন জীবনে ছায়াপাত করেনি। ওই প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়াতে কে কাকে পেটাচ্ছে তা জানার আগ্রহ খুব কম মানুষের ছিল; তার প্রধান এবং নিতান্ত স্বার্থপর কারণ—আমাদের তেল, গ্যাস বা গমের সরবরাহে ভাঁটা পড়েনি। সারায়েভোতে চার বছরের যে অবরোধ চলেছিল (গত পাঁচশো বছরের ইউরোপীয় ইতিহাসে দীর্ঘতম) সে বিষয়ে আমাদের জ্ঞান তখন প্রায় শূন্য। তবে একটা কথা খুব চালু হল তখন – এথনিক ক্লিনসিং (জাতিগত পরিশোধন)। যে যার আপন পাড়ায়, মতান্তরে আপন দেশে, থাকুক। বেপাড়ায় এলেই মারধর। এর প্রকাশ খানিকটা মেলবোর্নের টেনিস খেলার মাঠে নিয়মিত দেখবেন—সার্ব ও ক্রোয়াট অস্ট্রেলিয়ানরা আপন দেশের খেলোয়াড়ের সমর্থনে প্রায় হাথাপাই করে থাকেন। দুবাইতে জর্জ বোরসালিয়ান আমাকে বলেছিল, বলকানের যুদ্ধ হল শোধ তোলার লড়াই (সেটলিং দি স্কোর)। উত্তর কলকাতায় যাকে আমরা বলতাম “খার”—সেটা না মেটা অবধি লড়াই চলবে। হলও তাই। স্লোভেনিয়া মাসিদোনিয়া ক্রোয়েশিয়া, এমনকি মন্টিনেগরো আলাদা হল। গোলমালটা থেকে গেছে বসনিয়া-হার্জেগোভিনাতে।
এই বিভাজিত, বিধ্বস্ত দেশে রেলওয়ের সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের জন্য বাজার থেকে ডলার তোলা কঠিন কাজ – ভাঙা চোরা রেল লাইন, ওয়াগনের সংখ্যা সীমিত। ব্যাল্যান্স শিটের প্রসঙ্গ অচল। কোনো ব্যাঙ্কের কাছে ঋণের আমন্ত্রণপত্র পাঠালে প্রথম মন্তব্য শুনতে হত, “ক্রোয়েশিয়া? মানে যেখানে মারামারি কাটাকাটি হচ্ছে?”
সাতিশয় বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, “স্যার, সেটা তো এই শেষ হল বলে। এখন তারা স্বাধীন দেশ”।
শোনে কে?
অ্যাঞ্জেলা রোজ আমার সকল দুষ্কর্মের সাথী – তাকে বলেছি বিষণ্ণ হইয়ো না। দিস ইজ আওয়ার স্টোরি টেলিং টাইম! ছাড়ো ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের গল্প – “জানেন এই লোন ক্রোয়েশিয়ার রেললাইনের জন্য, সেই যে ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, সেটা যেত এবং যাবে ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে দিয়ে। আচ্ছা, ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ দেখেননি? জাগ্রেব স্টেশনে জেমস বন্ড?” তারপরে ছাড়ো দুবরোভনিকের গল্প, “আপনারা তো চেনেন, নিশ্চয় বেড়াতে গেছেন?”। বিশেষ করে জার্মান ও অস্ট্রিয়ান ব্যাঙ্কারদের কাছে এটা খুব লাগসই অ্যাপ্রোচ! পাঠকের স্মিত বিদ্রূপ মাখানো হাসির মুখোমুখি হতে হবে জেনেও বলি—সুধী, ব্যাবসার সময় অনেক সময় অবান্তর গল্পের ঝাঁপি জরুরি। এমনকি জার্মান লোন বেচতে রাইনের গপ্প জুড়ে দিয়েছি। কোনটা যে কখন লেগে যায়!
কিছু ইউরোপীয় ব্যাঙ্ক (আমেরিকান এবং জাপানি ব্যাঙ্কেরা পাড়া মাড়ালেন না) আস্থা ও অর্থ প্রদর্শন করাতে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হল। ড্রেসনার ব্যাঙ্ক আর আমাদের ব্যাঙ্কে উল্লাস। আই এফ আর এবং ইউরোউইক পত্রিকা আমাদের এই সফলতাকে সম্বর্ধনা জানালেন।
যেহেতু খোদ সরকার এখানে দেনাদার, তাঁরা আমাদের সসম্মানে আহ্বান জানালেন টাকার থলি হাতে নিয়ে জাগ্রেবে পদধূলি দিতে। রীতিমত আড়ম্বরের সঙ্গে সরকারি ভবনে সই-সাবুদের সমারোহ। ইউরোপীয় ব্যাঙ্কের প্রধান প্রতিনিধিরা হাজির। সরকার থেকে অনেক কেষ্টবিষ্টু দেখা দিলেন—নতুন ক্রোয়েশিয়াতে প্রথম আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ঋণ। সেখানে একজন বিশিষ্ট মানুষের অনুপস্থিতি চোখে পড়ল। তিনি অর্থমন্ত্রী বোঝো পিরকো। জানা গেল—তিনি ব্রাসেলস গেছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাতকার করতে। ফেরার কথা ছিল গতকাল, তবে আজ দুপুর নাগাদ আসবেন। দলিল দস্তাবেজে সই-সাবুদের পরে মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন জাগ্রেবের কেন্দ্রস্থলে—বান ইওসিপ ইয়েলাচিচ চত্বরের পাশেই। বহু ভাষাবিদ ইয়েলাচিচ উনবিংশ শতাব্দীর ক্রোয়েশিয়ান হিরো। তিনি অস্ট্রিয়ান সম্রাটের দ্বারা সম্মানিত এবং হাঙ্গেরিয়ানদের দ্বারা ঘৃণিত। হাঙ্গেরিকে পিটিয়ে ইয়েলাচিচ আজকের ক্রোয়েশিয়ার সীমানা শক্ত করেন এবং ভূমিদাস প্রথা নির্মূল করেন। চত্বরটি পাথরে বাঁধানো। বহু দিন বহু পথচারী চলে চলে তাকে মসৃণ করেছেন।
আমরা ভোজনের জন্য আসন গ্রহণ করার আগেই মন্ত্রীবর এলেন। জাগ্রেবে অর্থনীতি পড়েছেন। নতুন ক্রোয়েশিয়াতে তরুণের জয়। মন্ত্রীর বয়েস ৩৮। কমিউনিস্ট আমলের দাগবিহীন মানুষজন সামনে আসছেন তখন! আবার টোস্ট করা হল। ক্রোয়েশিয়ার প্রথম বাণিজ্যিক ঋণ-সংগ্রহের সম্মানে এবং দেশের দ্রুত উন্নয়নের শুভ কামনা জানিয়ে (আজ ক্রোয়েশিয়া পৃথিবীর ৪৬তম ধনী দেশ)। প্রধান অতিথির ভাষণ এবার। সাধারণত এই প্রকার অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার বা মন্ত্রীরা ক্লান্তিকর বক্তৃতা দিয়ে অভ্যাগতদের ঘুম পাড়ান, সোনামুখ করে সেটি শুনতে হয়। মান্য বোজো পিরকো একটি ব্যতিক্রম স্থাপন করলেন। এটি এত স্মরণীয়, যে পাঠকের ধৈর্যের ওপর খানিকটা কর বসিয়ে তা নিবেদন করতে চাই।
প্রথামত, তিনি ঋণদাতা ব্যাঙ্কগুলিকে ধন্যবাদ জানালেন। সকালবেলা ঋণ সই করার সময়ে উপস্থিত থাকতে পারেননি বলে দুঃখপ্রকাশ করলেন। ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মহামন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতকার ছিল—সেখানে তিনি গিয়েছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে ক্রোয়েশিয়ার যোগদানের প্রারম্ভিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করার জন্য। আগের দিন ফেরার কথা, কিন্তু মিটিং ক্রমশ বিলম্বিত হতে থাকে। তিনি মাত্র এই সকালের বিমানে ফিরেছেন। সমাগত পশ্চিমী ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে তিনি তাঁর এই আলোচনার সারমর্ম ভাগ করে নিতে চান।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিভূ মিস্টার ইউঙ্কারস বারবার মন্ত্রীবর পিরকোকে বলেছেন, যে ক্রোয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ হবে দেশের ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণ করা। কম্যুনিস্ট আমলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল সরকারি মালিকানায়—অতএব একান্ত অদক্ষ ও অকর্মণ্য। পশ্চিমী ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাফল্যের উৎস হল বেসরকারি মালিকানা। শেয়ারের মালিকদের লাভের সন্ধানে সেগুলি দক্ষ হাতে চালিত হয়। নিকম্মাদের কোনো স্থান নেই সেখানে। পিরকো তাঁকে আশ্বাস দিলেন—এ ব্যাপারটি তিনি আগ্রহের সঙ্গে খুঁটিয়ে দেখবেন। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই মহান প্রবক্তা অধৈর্য হয়ে বলেন—শুধু মুখের কথা নয়, ক্রোয়েশিয়ার লক্ষ্য হওয়া উচিত অতি দ্রুত এই বেসরকারিকরণের কাজটি সম্পন্ন করা। এইরূপ চাপে খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে ক্রোয়েশিয়ান অর্থমন্ত্রী পিরকো বললেন, দেশে ফিরে গিয়ে তিনি সাধ্যমত দ্রুতবেগে ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণের কাজে হাত দেবেন, কিন্তু তাঁর একটি জিজ্ঞাস্য আছে।
ইউঙ্কারস এবার প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে জানতে চেয়েছেন সেটা কী। মান্যবর পিরকো তখন বললেন, “আমি যতদূর জানি, ফ্রান্সের বৃহৎ ব্যাঙ্কগুলি সরকারি মালিকানায় আছে ১৯৪৫ সাল থেকে। শুধু তাই নয়, বছরের পর বছর ধরে বিশেষ করে ক্রেদি লিওনে ব্যাঙ্কের ক্ষতির পরিমাণ প্রভূত – তারা হলিউডে ফিল্ম প্রযোজনা এবং বিশাল লোকসান করেছে। সেই ব্যাঙ্ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ফরাসী সরকার পাওনা খাজানা থেকে বদান্যতার সঙ্গে যে অর্থসাহায্য করছেন, তার পরিমাণ ক্রোয়েশিয়ার জাতীয় আয়ের প্রায় অর্ধেক (দশ বিলিয়ন ডলার)। এই সঙ্গে এটাও বোধহয় উল্লেখ করতে পারি, যে, বিগত তিরিশ বছর যাবত অস্ট্রিয়ান সরকার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের দুটি বৃহৎ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান – ব্যাঙ্ক অস্ট্রিয়া এবং ক্রেডিট আনসটাল্টকে বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করতে। সেটা আজো সম্ভব হয়নি। যদি মাননীয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এদের কয়েক যুগ দিয়ে থাকেন, আশা করি ক্রোয়েশিয়াকে একটা দুটো বছর সময় দেবেন!
বার্লিন দেয়ালের সঙ্গে সঙ্গে প্রাক কমিউনিস্ট অর্থ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আমরা, পশ্চিমের ব্যাঙ্কেরা, সতত তাদের বলেছি—তোমাদের ব্যাংকিং সংবিধানের পাতায় পাতায় যে লেখা, সে ভুল। সবই ভুল অথবা গুল। তোমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতারা তোমাদের ভ্রান্ত করেছে। আমরা এসেছি নতুন পথের বার্তা নিয়ে। মামেকং শরণং ব্রজঃ। অন্য পন্থা নেই। আমরা বাজারি অর্থনীতিকে গুলে খেয়ে যে জ্ঞান আহরণ করেছি, সেটি তোমাদের দেবো। সেই পথেই তোমাদের মুক্তি।
জাগ্রেবের এই দিনটি, মান্যবর পিরকোর এই ছোট ভাষণটি মনে গেঁথে আছে। আমাদের পশ্চিমা আত্মম্ভরিতার উচ্চ মিনার থেকে নামিয়ে তিনি একটি আছাড় দিলেন! যে তিনটি ব্যাঙ্কের নাম তিনি করলেন, তার দুটির প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন সেই মধ্যাহ্ন ভোজনের আসরে। ভাষণ শেষে একটু নীরবতা। তারপর আমরা সমবেত ব্যাংকাররা সোচ্চারে করতালি দিয়ে মান্য পিরকোকে সম্বর্ধিত করি। হুতোম কেন বলছিলেন—আপনার মুখ আপনি দেখ—তা বুঝলাম। বাজারি অর্থনীতির পশ্চিমী জ্ঞান অভ্রান্ত নয়। তার নমুনা অজস্র।
মাত্র বারো বছর বাদে সিটি ব্যাঙ্ক সহ বেসরকারি মালিকানাধীন অনেক বিশ্ববিখ্যাত পশ্চিমী ব্যাঙ্ক দেউলে হয়ে তাদের সরকারের কাছে অর্থভিক্ষা করে আপন প্রাণ বাঁচাবে – জার্মানির ষোলটি লান্দেসবাঙ্কের মধ্যে দশটি এবং ড্রেসনার নামক ব্যাঙ্কটির নামো-নিশান মিলিয়ে যাবে।
এ তো বড়ো রঙ্গ, জাদু, এ তো বড়ো রঙ্গ
চার রঙ্গ দেখাতে পারো যাবো তোমার সঙ্গ!!
পরিশিষ্ট:
ক্রোয়েশিয়া: সেই বছর (১৯৯৫), ব্যাঙ্ক বেসরকারিকণের কাজ শুরু এবং অতিদ্রুত সম্পন্ন হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে বোঝো পিরকা সরকার থেকে বিদায় নিয়ে প্রিভরেদনা বাঙ্কা জাগ্রেবের কর্ণধার। প্রায় ৯০% ক্রোয়েশিয়ান ব্যাঙ্কের মালিকানা ইতালিয়ান এবং অস্ট্রিয়ানদের হাতে। গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ক্রোয়েশিয়ান সরকারের আছে ৫.৩% শেয়ার। ২০১৩ সাল থেকে ক্রোয়েশিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্য দেশ ভাগের সময় মাথাপিছু আয় ছিল চার হাজার ডলার, এখন আঠারো হাজার।
ফ্রান্স: বছর বছর অনাদায়ী ঋণে জর্জরিত ব্যাঙ্কগুলিকে ভর্তুকি দিয়ে ক্লান্ত সরকার বেসরকারিকরণ দ্বারা শেষ অবধি ছুটকারা পেলেন ২০০০ সাল নাগাদ। মোট ৫৫ বছর চারটি ব্যাঙ্ক সরকারি মালিকানায় ছিল।
অস্ট্রিয়া: ক্রেডিট আনস্টাল্ট সরকারের হাতে ছিল প্রায় সত্তর বছর, বাঙ্ক অস্ট্রিয়া দু-দশক। ব্যাঙ্ক চালানো অর্থ দফতরের কাজ নয়—এমন আওয়াজ উঠলে ৪৫% সিটি অফ ভিয়েনাকে বেচে দেওয়া হয়। খবর কাগজ পিছু ছাড়ে না—সিটি অফ ভিয়েনা কোনো বেসরকারি সংস্থা নয়! তার ওপরে আরেক খেলা – বাঙ্ক অস্ট্রিয়ার রঙ লাল, পৃষ্ঠপোষক ট্রেড ইউনিয়ন ও বাম ঘেঁষা রাজনৈতিক দল; ক্রেডিট আনস্টালটের রঙ নীল! লাল-নীলকে মিশিয়ে বিএ–সিএ নামের এক কিম্ভুত প্রতিষ্ঠান তৈরি হয় ২০০০ সাল নাগাদ। শেষ অবধি ইতালিয়ান ইউনিক্রেডিট ব্যাঙ্কের অধিগ্রহণ করে অস্ট্রিয়ান সরকারের মুখরক্ষা করলেন।