টেনিস পটীয়সী সেরেনা উইলিয়ামস উইমবলডনের অল ইংল্যান্ড টেনিস টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছেন; একজন রিপোর্টার জিজ্ঞেস করেলেন, পরের রাউন্ডে কার সঙ্গে খেলবেন জানেন কি ? উত্তরে সেরেনা বলেন,জানি না,ওই কোন ওভা হবে।
অনুমানটা আংশিক সত্য।
বার্লিন ওয়ালের পতন এবং ইউরোপের পূর্ব দিগন্তের লৌহ যবনিকা উন্মোচিত হবার পরে গত তিরিশ বছরে মহিলা টেনিসে পোল্যান্ড থেকে সার্বিয়া,চেক থেকে রাশিয়া কাজাখস্তানের খেলোয়াড়রা সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট করেছেন ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মৌরুসি পাট্টা। কম্যুনিস্ট আমলে আমরা পেয়েছি চেকোস্লোভাকিয়ার ইয়ারোস্লাভ দ্রবনি, ইয়ান কোদেশ, সোভিয়েত ইউনিয়নের আলেকস মেত্রেভেলি (জর্জিয়ান),রোমানিয়ার ইওন সিরিয়াক, ইলি নাস্তাসে কিন্তু মেয়েদের বিশেষ দেখা যায় নি। আজকে পাশা একেবারে উলটে গেছে; পুরুষদের অনেক পেছনে ফেলে অজস্র উজ্জ্বল মহিলা তারকা আলো করে রেখেছেন দুনিয়ার টেনিসের কোর্ট।
রাশিয়ান, চেক, স্লোভাক, বুলগারিয়ান মেয়েদের নাম শেষ হয় ওভা অথবা এভা দিয়ে; বিয়ের আগে পিতার পদবি এবং বিয়ের পরে স্বামীর পদবির সঙ্গে সম্পর্ক সূচিত করে সেটি যুক্ত হয়। রাশিয়ান মারিয়া শারাপোভা,আনা কুর্নিকোভা,স্লোভাক দানিয়েলা হানটুকোভা,চেক পেত্রা কিতোভা বুলগারিয়ান কাতারিনা মালেভার নাম সকলের জানা। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে; কখনো এ যোগ করেও একই উদ্দেশ্য সাধিত হয় যেমন পুতিনের স্ত্রী পুতিনা, কিন্তু পুতিনের দুই কন্যার বিবাহিতা নাম যথাক্রমে কাতারিনা তিখোনোভা এবং মারিয়া ভরন্তসোভা। রাশিয়ান টেনিস প্লেয়ার দিনারা সাফিনার দাদার নাম মুরাত সাফিন,তিনিও ছিলেন টেনিস স্টার। চেকে যেমন নাভ্রাতিলোভের ( আন্তন নাভ্রাতিলোভ নামের এক চেক ব্যাঙ্কারকে চিনতাম, প্রাগের চেসকোস্লভেন্সকি অবখদনি বাঙ্কায়) মেয়ে নাভ্রাতিলোভা,এবার তিনি যদি স্টেপানকে বিয়ে করেন তার বিবাহিতা নাম হবে স্টেপানোভা। তেমনি নোভোতনির মেয়ে নোভোতনা; ইয়ানা নোভোতনা ১৯৯৮ সালে উইম্বলডনে বিজয়ী হন। টেনিসে আরেক সফল দেশ বেলারুশেও ‘এ রুল’ চালু,যেমন আরিনা সাবালেঙ্কা,তাঁর পিতা আইস হকি প্লেয়ার সেরগে সাবালেনকো।
পোলিশ মেয়েরা সাম্প্রতিক কালে টেনিসে অসাধারণ ফলাফল দেখিয়েছেন কিন্তু তাঁরা ওভার দলে পড়েন না। সাধারণত তাঁদের নামের শেষে আ-কার যোগ হয় যেমন আনিইয়েস্কা রাদভান্সকা ( সিটি ব্যাঙ্কে আমাদের উকিল স্টেফান স্কালস্কির সঙ্গে বিয়ের পরে তার এককালের জার্মান বান্ধবীর নাম ক্লদিয়া হর্ন থেকে হলো ক্লদিয়া স্কালস্কা) অথবা স্ট্যানিস্লাভস্কির স্ত্রী স্ট্যানিস্লাভস্কা। লন্ডনের গ্রিনডলেজ ব্যাঙ্কে অনেকদিন আগের পরিচিত পাভেল পোলানসকি ঠাট্টা করে বলতেন আমরা সবাই স্কি ক্লাবের মেম্বার! পোল্যান্ডে বহু নাম শেষ হয় ভিচ (wicz) দিয়ে,এই লেজুড় পিতৃ পরিচয় স্থাপনা করে, সেটি পুত্র কন্যা বিশেষে বদলায় না। বলকানে বিশেষ করে সার্বিয়া,ক্রোয়েশিয়াতে ভিচের (vic) অথবা ইচের (ic) ছড়াছড়ি – যেমন আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেভা মারিচ, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইভো আন্দ্রিচ (“ দ্রিনার ওপরে সেতু”) নোভাক জোকোভিচ;ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার লুকা মদরিচ ( রিয়াল মাদ্রিদ )।
রোমানিয়াতে ভিচ বা ইচের তুল্য হলো স্কু যেমন চাউসেসকু কিন্তু বুলগারিয়া বাদে গোটা বলকানের কোথাও মেয়েদের পদবির সঙ্গে কোন অক্ষর যুক্ত হয় না – রোমানিয়ান স্টার সিমোনা হালেপের বাবা স্টেরে হালেপ, সারবিয়ান স্টার আনা ইভানোভিচ জার্মান ফুটবলার শোয়াইনস্টাইগারকে বিয়ে করেছেন কিন্তু তিনি কোন ইভানকোভিচকে বিয়ে করলে হতেন আনা ইভানকোভিচ। সার্বিয়ার সর্বকালের সেরা মহিলা টেনিস খেলোয়াড় মনিকা শেলেশ আদতে হাঙ্গেরিয়ান। নোভি সাদে গিয়ে দেখেছি যে দুই মহিলাকে নিয়ে সে শহর সবিশেষ গর্বিত তাঁরা মিলেভা মারিচ ও মনিকা শেলেশ। হাঙ্গেরিয়ান ভাষাটাই গোটা ইউরোপ থেকে আলাদা - মেয়েদের নামেও সেখানে কোন এভা ওভা অথবা আ-কার ই-কারের বালাই নেই।
পিতার পরিচয়ে সন্তানের পরিচয় একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। তবে প্রত্যেক প্রজন্মে সেটি বদলে যায় না (ব্যতিক্রম শুধু ইহুদিদের ক্ষেত্রে;সেটা চালু ছিল অষ্টাদশ শতক অবধি এবং বর্তমান আইসল্যান্ডে )। আমাদের দেশে কোনো কালে এক মাধবের পুত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল মাধবানি সেটাই থেকে গেছে, মাধবানির পুত্র/ কন্যাও মাধবানি। কৃষ্ণের পুত্র কৃশনানি।
অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানাই, নাম মাহাত্ম্য নিয়ে আজ এই বৃহৎ গৌরচন্দ্রিকার করার কারণ আমাদের দেশের একজন মহিলা!
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী!
পুরনো ব্রাতিস্লাভা প্রথম ঘুরেছি আমাদের অফিসের ইভেতার সঙ্গে। সদ্য উন্মুক্ত ম্যাকডোনালডের সোনালি আর্চের উলটো দিকে আমাকে একটা বাড়ির কোনায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল ‘দেওয়ালে কি লেখা আছে মন দিয়ে পড়ো। তুমি পুরোটার মানে বুঝবে না, এটা স্লোভাক ভাষা। কিন্তু দুটো নাম চিনতে পারবে। এঁরা তোমার দেশের লোক ছিলেন’।
১৯৩৮ সালে নেহরু কৃষ্ণ মেনন ও কন্যা ইন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে ইউরোপে গিয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা দাবিতে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে তাঁদের সভায় পাঁচ হাজার লোক জমায়েত হন। স্পেনের গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকান পক্ষের প্রতি ভারতের সমর্থন জানাতে সে দেশেও যান। ইউরোপের অবস্থা,বিশেষ করে চেকোস্লোভাকিয়ার পরিস্থিতি তখন অগ্নিগর্ভ- হিটলার নিত্যদিন শাসাচ্ছেন সে দেশের অর্ধেক তাঁর প্রাপ্য নইলে তিনি সেনা পাঠিয়ে জবর দখল করবেন। প্রাগের বিপন্ন সরকার খুঁজছেন আন্তর্জাতিক সচেতনতা,সহায়তা। ব্রাতিস্লাভায় এই মিটিঙের পাঁচ সপ্তাহ বাদে ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৮ ব্রিটেনের প্রধান মন্ত্রী চেম্বারলেন ও ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী এদুয়ারদ দালাদিয়ে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার পশ্চিম ও পূর্বের অংশ (বেশির ভাগ জার্মান অধ্যুষিত সুদেতেনলানড) হিটলারকে উপঢৌকন দিয়ে বললেন,‘এবার ঝুট ঝামেলা বাড়াবেন না, শান্তি বজায় রাখুন’। যাদের দেশের ভাগ বাঁটোয়ারা হচ্ছে যে সভায় সেই চেকোস্লোভাকিয়ার কোন প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এই সুযোগে পোল্যান্ড খুবলে নেয় উত্তরের কিছু জমি এবং হাঙ্গেরি দখল করে আজকের স্লোভাকিয়ার অংশ বিশেষ (মিউনিকের এই মহান সন্তুষ্টিকরন বা অ্যাপিজমেনট অনুষ্ঠানের আলোচনায় আমরা পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির জমি ডাকাতির কথাটা কখনো শুনতে পাই না)।
ছ মাস বাদে জার্মান সৈন্য চেকোস্লোভাকিয়ার সম্পূর্ণ দখল নেয়।
বাকিটা ইতিহাস।
প্রায় ষাট বছর আগের এই ফলকে বানান অন্য রকম হলেও জওহরলাল নেহরুকে চিনলাম। ইংরেজি বাদে প্রায় কোনো ইউরোপীয় ভাষায় ‘জ’ ধ্বনির সমার্থক কোন অক্ষর নেই। স্লোভাকে ডি জেড দিয়ে সেই ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়েছে (জার্মান ভাষায় এই একই ধাঁচে লেখা হয়) কিন্তু নেহরুর পরে যিনি উল্লেখিত,তাঁকে আমরা চিনি অন্য নামে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নাম পরিবর্তন করে তাঁকে গান্ধিওভা বানানো হয়েছে। তাঁরও ছাড় নেই, তাঁকেও পরিচিত হতে হবে স্লোভাক কায়দায়,স্বামীর নামের সাথে ‘ওভা’ যুক্ত হয়ে। বিশ বছর বাদে,১৯৫৮ সালের কার্লোভি ভারি (জার্মান কারলসবাদ,চার্লসের স্নানাগার!) ফিলম ফেস্টিভালে মাদার ইন্ডিয়া ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন নারগিসোভা! এখানে একটু শর্টকাট নেওয়া হয়েছিল,সঠিক আইন মানলে পুরস্কার ফলকে লেখা হতো নারগিস রাশিদোভা (তাঁর বাবার নাম আবদুল রাশিদ) সুনীল দত্তের সঙ্গে ততদিনে বিয়েটা হলে তিনি হতেন নারগিস দত্তভা (প্রসঙ্গত এক মেক্সিকান অভিনেত্রীকে বাদ দিলে কার্লোভি ভারি ফেস্টিভালে নন কমিউনিস্ট দেশের কেউ পাত্তা পেতেন না – নারগিস সেই ট্র্যাডিশন ভাঙ্গেন,এর পরে ১৯৭২ সালে রঞ্জিত মল্লিক ইন্টারভিউ ছবির জন্য বেষ্ট অ্যাকটর এ্যাওয়ার্ড পান)। স্লোভাকিয়াতে ফিল্মের পোষ্টারে,খবর কাগজে,টেলিভিশনে শ্যারন স্টোন হন শারনে স্টোনোভা, মেরিলিন মনরো হয়ে যান মেরিলিন মনরোভা।
ছেলেদের নামের ওপরেও কঠোর অস্ত্রোপচার হতে দেখেছি পূর্ব ইউরোপের আরেক দেশে, লিথুয়ানিয়াতে। সেটা অন্য গল্প।
পুরনো শহর ( স্টারে মেসতো ) ধাপে ধাপে নেমে গেছে দানিউবের ঘাটে। সেখান থেকে ছবিটি অতীব মনোরম। বাঁধানো চত্বরে হাঁটলে মনে হবে টাইম মেশিনে চড়ে আপনি কয়েকশ বছর পিছিয়ে গেছেন। জীর্ণ পুরাতনের প্রতি শ্রমিক কৃষকের সরকারের অসীম অনীহা দেখেছি একাধিক দেশে। কি ভাগ্যে প্রাগ, ভিলনিউস, টালিন, বুদাপেস্ট বেঁচে গেছে। বুখারেস্টকে স্মৃতির ভার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার সঙ্কল্প যিনি নিয়েছিলেন সেই নিকোলা চাউসেস্কুর অকালে নিধন না হলে তিনি সে কাজটি নিশ্চয় সম্পূর্ণ করতেন। স্তারে মেসতোর চারটে পাড়া ছিল যার মধ্যে দুটি – ভিদ্রিতসা এবং সুকারমানডেল সোভিয়েত আমলে ভেঙ্গে ফেলা হয়। যাকে সোভিয়েতরা ভেঙ্গে উঠতে পারেন নি অসম্ভব যত্নের সঙ্গে তার সংস্কার করা হয়েছে,সেটি আজ দুনিয়ার মানুষ দেখতে আসেন। দানিউবের অন্য পাড়ে অবশ্য সোভিয়েত স্থপতি কলা কৌশলীরা আরেক ব্রাতিস্লাভা সৃষ্টি করে গেছেন যাকে ব্রুটালিস্ট আর্ট বলা হয় সেখানে যাবার টুরিস্ট বাস দেখি নি।
জানি ব্রাতিস্লাভা আপনাদের ভ্রমণ তালিকায় স্থান পাবে না, আপনারা যাবেন প্রাগে। ভ্লাতাভা (মলদাউ) নদীর ওপরে চার্লস ব্রিজের (কার্লস ব্রুইকে) ডজন খানেক পাথুরে মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে সাতটা সেতু দেখবেন,প্রাগ দুর্গকে পেছনে রেখে ছবি তোলাবেন, আরেক প্রস্তর তোরণ পেরিয়ে চলে যাবেন বিশাল ওয়েনসেসলাস স্কোয়ারে। ব্রাতিস্লাভার সপক্ষে বলি, ভিয়েনা থেকে স্পিড বোট বা ট্রেন ধরে একদিনের জন্যে আসুন ব্রাতিস্লাভা,মাত্তর এক ঘণ্টা লাগে। একটি ওয়ার্নিং – স্টেশন এলাকাটি মোটে আকর্ষণীয় নয়, সোভিয়েত আমলের শিল্প। জানি,জার্মান স্থাপত্যকর্মে ভরা প্রাগ এক অসাধারণ সুন্দর শহর কিন্তু ব্রাতিস্লাভায় পাবেন সারা ইউরোপের হাতের,ছেনির কাজ! রোমানরা ব্রাতিস্লাভা দুর্গের ভিত গড়েছেন দু হাজার বছর আগে, শেষ করেছেন হাঙ্গেরিয়ানরা। পাহাড়ের ওপরে সেই কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়ালে পরিষ্কার দিনে অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি দুই দেশের সীমানা দেখা যায়, ইউরোপের একমাত্র দৃষ্টান্ত। তিনশ বছর ছিল হাঙ্গেরিয়ান রাজধানী,মারিয়া থেরেসার আমল থেকে অস্ট্রিয়ান ও হাঙ্গেরিয়ান স্থাপত্য কলার সংমিশ্রণ। রাজা ফারদিনান্দের স্ত্রী,স্পেনের রাজকন্যা মারিয়ানা দিয়ে গেছেন তাঁর দেশের কিছু স্মৃতি, তেমনি পাবেন ফরাসি, জার্মান ও অনিবার্যভাবেই ইতালিয়ান ছোঁয়া। ব্রাতিস্লাভার ইহুদি ইতিহাস দীর্ঘদিনের, স্লোভাকিয়ার একমাত্র সিনাগগ দেখা যাবে এখানে, জামোচকা স্ট্রিটে পুরনো বাড়ি ঘর। ওয়ারশ, ফ্রাঙ্কফুর্টের মতন ফেক স্টুডিও সেট নয়।। পাহাড়ের ওপরে আছে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেভিন দুর্গ,স্লোভেনিয়ানরা সেই নামটির অরিজিনালিটি দাবি করেন! নাৎসি জার্মানির কবল থেকে এ শহরকে উদ্ধার করতে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় সাত হাজার সোভিয়েত সৈনিক, তাঁদের নাম লেখা সমাধিস্তম্ভ আরেক পাহাড়ের ওপরে।
ভেন্তুরসকা স্ট্রিটে পালফি প্যালেস – দুশ বছর আগে সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসার জেনারেল লেওপোলড পালফি এটির নির্মাণ করেন। কিংবদন্তি মোতাবেক ১৭৬২ সালে ছ বছরের বালক ভলফগাঙ আমাদেউস মোৎসার্ট এখানে পিয়ানো বাজিয়েছিলেন। পরে পালফি বংশধরেরা ভিয়েনায় আস্তানা গাড়েন। তাদের এক অনেক উত্তর উত্তর পুরুষ,ক্রেডিট আনসটালট ব্যাঙ্কের নিকলশ পালফি আমার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সঙ্গী (বৈঠকি আড্ডায় পঞ্চম পর্ব পশ্য)। আমি জিজ্ঞেস করলে নিকলশ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন পালফি প্যালেসে মোৎসার্টের পিয়ানো বাজানোর গল্পটি তিনি বাল্যকাল থেকে শুনে এসেছেন। হয়তো পালফি পরিবারের প্রতি প্রজন্মের শিশুদের শুনতে হয়েছে - কিছুই শিখলে না! জানো মোৎসার্ট ছ বছর বয়েসে পিয়ানো বাজিয়েছেন, এই আমাদের পূর্ব পুরুষের বৈঠকখানায়। আর তোমরা? ফুটবল নয় ভিডিও গেম নিয়ে পড়ে আছো!
তখন ফোন ক্যামেরা ছিল না,কোন ছবি কেউ এঁকে রাখেন নি, কোন সাক্ষ্য প্রমাণ নেই! বরং পালফি নামটার জন্যই নিকলশ মরমে মরে থাকেন। সে প্যালেস নেই, তিজোরি কবে শূন্য। ব্যাঙ্কে কলম পিষে বা কীবোর্ড পিটে খেতে হয়!
আমাদের দেশে আজকাল ইনভেডার কথাটা খুব চালু, সেদিন টেলিভিশনে দেখলাম যোগী আদিত্যনাথ বলছেন ভারতের প্রকৃত পরিচয় তাজমহলে নয়, সনাতন অট্টালিকা ও মন্দিরে। ব্রাতিস্লাভা আজ পরম যত্নে রক্ষা ও পরিচর্যা করে তাদের ইনভেডারদের স্থাপত্য,শিল্পকলা। চলতি কথা আছে একশ দেশের হাতের বা পায়ের চিহ্ন ভরে রেখেছে ব্রাতিস্লাভাকে। দেভিন বা ব্রাতিস্লাভা দুর্গ থেকে আদিগন্ত দেখা যায়,ঐ উজ্জ্বল দিন ডাকে স্বপ্ন রঙ্গিন, দূরে প্রশস্ত প্রসন্ন দানিউব বয়ে যায়। আহা কি চমৎকার এই বেঁচে থাকা।
পুরনো শহরের অলিতে গলিতে পাবেন পাব- বড়ো,মাঝারি এবং ছোট। বাইরের সাইনবোর্ড দেখে এমনি কোথাও ঢুকে পড়লে মনে হবে যেন বিনা এত্তেলায় কারো বসবার ঘরে প্রবেশ করেছেন, এমনই অন্তরঙ্গ। ভাষায় আটকাবে না, হলিউড, টেলিভিশন, ইউরোভিশনের দৌলতে ইংরেজি ভাষা আজ যথেষ্ট প্রচলিত যা আমার প্রথম যাত্রায় দেখি নি। স্লোভাক বিয়ার অতি উচ্চ মানের। কোন বিয়ার ? ক্লসটরনি(মঠ মন্দিরের) না স্টারোস্লোভিইয়েনসকি(প্রাচীন স্লোভাক) পিভোভার ? নামের জটিলতায় যাওয়া অর্থহীন,যে কোন সোনালি পানীয় হাতে তুলে নিন (ডুঙ্কেল বা ডার্ক বিয়ার বিশেষ দেখি নি, সেটা আইরিশ বেলজিয়ান ও জার্মানির কলোনের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া ভালো)। নাম যাই হোক না তার স্বাদ অনবদ্য। পান করলেই মনে হয় সমস্ত ব্রিটিশ বিয়ারকে অতি সত্বর নর্দমায় ঢেলে দেওয়া উচিত। বুঝেছি কেন এ দেশে মাথা পিছু বার্ষিক বিয়ার পানের পরিমাণ জার্মানি ও চেকের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দেয়।
বহুকাল আগে নিউ ইয়র্কের বার্নস অ্যান্ড নোবেলের বইয়ের দোকানে চা কফি মেলে সেটা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম; চায়ের দোকানে বইটা অনুষঙ্গ না বইয়ের দোকানে চা? ব্রাতিস্লাভার কোনো পাবে পা দিয়ে মনে হয়েছে এটা হয়তো স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি। ডজন দুয়েক টেবিল, তাকে ঘিরে নিতান্ত অসংলগ্ন ভাবে দু চারটে করে চেয়ার। টেবিলে ছড়ানো আছে বই;অনেক ভাষায়, কোনো বইয়ের পাতা খোলা,পাশে পেন্সিল। কেউ যেন পড়তে পড়তে উঠে গেছেন,একটু বাদে ফিরবেন। সেখানে বসে যেমন খুশি বই তুলে নিয়ে যতক্ষণ খুশি পড়ার কোন বাধা নেই। কেউ এসে জিজ্ঞেস করবে না আপনি আর কিছু নেবেন কিনা। আপন তৃষ্ণা কখন কিসের জন্য জাগে সেটা যথাস্থানে জানানোটা আপনার কাজ,অযথা আপনাকে বিরক্ত করে সে তথ্য জানতে তাঁরা অনিচ্ছুক।
মারেকের অপেক্ষায় বসে ছিলাম, এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বইয়ের দিকে চোখ চলে গেল – ইংরেজিতে লেখা, The Jews of Czechoslovakia,১৯৬০ নাগাদ প্রকাশিত মোটা বাঁধানো বই, আকর গ্রন্থ -উনিশ শতকের ইহুদি সমাজ, চেক সাহিত্য (কাফকা জার্মানে লেখেন কিন্তু মিলেনা ইয়েসেনসকাকে আন্তরিক চিঠি লিখেছেন চেক ভাষায়) অর্থনীতি,সংগীত, চিত্রকলা নিয়ে একটি পাঁচশ পাতার রিসার্চ পেপার, পাতায় পাতায় সুন্দর হাতে লেখা নোট! প্রামাণ্য রেফারেন্স বই, কেবল লাইব্রেরিতে প্রাপ্য। আমাকে তাতে মগ্ন দেখে আধ লিটারের বিয়ার মাগ টেবিলে দিতে এসে বার কিপার বললেন,রাখবেন বইটা? আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, না মানে, এই পাতা ওলটাচ্ছিলাম আর কি। তিনি হেসে বললেন, নিয়ে যান, এটা আপনাকে উপহার দিলাম!
*ভ্লাদিমির ক্লেমেন্তিস তখন চেকোস্লোভাকিয়ার বিদেশ মন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধের পরে কমিউনিস্ট প্রশাসনে আবার বিদেশ দফতর সামলান কিন্তু স্টালিনেরর রোষানলে পড়েন। তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী দাগিয়ে দিয়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
ক্রমশ...