নৃপেনবাবু বিনোদিনী দেবী উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন দীর্ঘদিন। এই মফস্বল শহরে তাঁর ছাত্র সংখ্যা ঈর্ষণীয়। টোটো চালক থেকে ব্যাঙ্গালুরু শহরের পাঁচলাখি সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বিশাল বঁটিতে ঝপাঝপ ছ-সাত কিলোর কাতলা মাছ কেটে কাটাপোনা বিক্রেতা থেকে – জার্মান প্রবাসী তুলনামূলক সাহিত্যের নামকরা অধ্যাপক।
তাঁর পুত্র দীপেনও কম যান না। আমেরিকার একটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং জল ছাড়াই যে কোন জমিতে উচ্চ ফলনশীল ধানের উৎপাদনযোগ্য সংকর বীজ সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। সফল হলে পৃথিবীর চেহারাটাই পালটে যাবে। সাহারা, কালাহারি এমনকি আমাদের ঘরের থর মরুভূমিতেও দিগন্ত বিস্তৃত চোখ জুড়োনো সবুজ ধানক্ষেত দেখা যাবে। গবেষণা এখনও সফল হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ – কাল কিংবা পরশু...।
প্রতি বছর শীতকালে দীপেন সপরিবারে বাড়ি আসেন। এবারে আসতে পারেননি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সেমিনারে ইউরোপ যেতে হয়েছে। তাই দীপেনের স্ত্রী নমিতা এসেছেন তাঁর একমাত্র পুত্র নমপেনকে নিয়ে। এখানে তাঁরা মাস খানেক থাকবেন। মাসখানেক পর দীপেন এলে, আরও দিন সাতেক থেকে এক সঙ্গে উড়ে যাবেন আমেরিকায়।
নিজের পুত্র হলে কী হবে, নৃপেনবাবু দীপেনকে একদমই গ্রাহ্য করেন না। পত্নীর সামনে তিনি পুত্রকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু পুত্র-প্রসঙ্গ এলেই, তিনি মনে মনে “হতভাগা, গাধা একটা” বলে বেশ শান্তি পান। তাঁর যুক্তি সেই ধান চাষই যখন করবি, তখন অতদূরে না গিয়ে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান কিংবা বড়জোর তাঞ্জাভুর যেতে পারতিস?
আরো একটা কারণ আছে। তাঁর নাতিটির নাম নমপেন। প্রথম বার শুনে তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর পুত্র কম্বোডিয়াতে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য দেখে বা শুনে, ওখানকার রাজধানীর নামে পুত্রের নাম নমপেন রেখেছে। ঘন্টা – মোটেই তা নয়। তাঁর বউমার নাম নমিতার – নম, আর দীপেনের পেন – দুইয়ে মিলে নমপেন। তাঁর নাতির নাম।
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি আরও জেনেছেন, কম্বোডিয়া দেশটার নাম তাঁর পুত্র শুনেছে – কিন্তু সেটা ঠিক কোন দিকে সে জানে না। একটু ভেবেচিন্তে বলেছিল, ইউরোপের কোন দেশ মনে হয় – লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, আর্মেনিয়া, কম্বোডিয়া...। নৃপেনবাবু কিছু বলেননি। মনে মনে দীপেনের ভূগোলের মাস্টারমশাই ভূদেববাবুর কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, “হতভাগা, দীপেনটাকে ভূগোলে পাসমার্ক দিয়েছিলি কী করে”? প্রসঙ্গতঃ ভূদেববাবুও তাঁর ছাত্র ছিলেন।
কথায় আছে টাকার থেকে সুদ মিষ্টি। নৃপেনবাবুর ক্ষেত্রেও কথাটি সমান প্রযোজ্য। নিজের পুত্রটিকে তিনি গাধা মনে করলেও, পৌত্র নমপেনকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। এবং বিশ্বাস করেন, বছর চোদ্দর এই প্রতিভাধর নাতিটিই তাঁর নামের পূর্ণ মর্যাদা রাখবে, এমনকি বংশের নাম উজ্জ্বল করবে।
বাড়ি আসার পরের দিনই তাঁর বউমা একটি আবদার করলেন, বললেন, “বাবা, নমু মোটামুটি বাংলা বলতে পারে। ওখানে তো বাংলা শেখার সুযোগ খুব কম, তাই পড়তে বা লিখতে জানে না। এই এক মাসে যদি নমুকে বাংলা অক্ষর পরিচয় আর লেখাটা একটু শিখিয়ে দেন...তাহলে আমি ফিরে গিয়ে বাংলা বইটই পড়ানো চালু করে দেব”।
বৌমার কথায় নৃপেনবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, বললেন, “মোক্ষম বলেছ বউমা। মাতৃভাষা হল মায়ের দুধের মতো। সে কী আর কৌটোর দুধ কিংবা প্লাস্টিক-প্যাকেটের দুধ দিয়ে পূরণ হয় মা? মাতৃভাষা না জানলে কোন বিদ্যা বা জ্ঞানই পূর্ণ হতে পারে না...”।
নৃপেনবাবুর স্ত্রী বললেন, “এই শুরু হল লেকচার... ক্লাসের ঘন্টা না পড়া পর্যন্ত থামবে না। পাগলকে কোনদিন, “সাঁকো নাড়া দিও না”, বলতে আছে, বৌমা?”
নমিতা মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না। শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যে এই নিরন্তর খুনসুটির ব্যাপারটা নমিতা বেশ উপভোগ করেন।
দাদু ও নাতির যৌথ উদ্যোগে শুরু হল বাংলা-শিক্ষা অভিযান। বাংলা পড়া ও লেখা দ্রুত গতিতেই চলতে লাগল। অবশ্য একথাও মানতে হবে নমপেন বা নমু এতটুকু চঞ্চল, অমনোযোগী বা অধৈর্য হল না – সমান উৎসাহে দাদুর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে গেল।
ঠিক কুড়ি দিন পর। রবিবারের সকাল। নৃপেনবাবুর স্ত্রী ব্রেকফাস্টের টেবিলে বললেন, “শুনছো, আমি আর বৌমা একটু শপিং করতে যাবো টাউন মলে। আজ রবিবার – সন্ধের দিকে খুব ভিড় হয় – আমরা এবেলাতেই যাবো – এই এগারোটা-সাড়ে এগারোটা নাগাদ, ফিরতে ফিরতে দেড়টা দুটো হয়ে যাবে। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করো না - তুমি আর নমু খেয়ে নিও। নীলিমাকে বলে যাচ্ছি – ও খাবার বেড়ে দেবে। কেমন?”
কথাটা শুনেই নৃপেনবাবুর মাথায় একটা আইডিয়া এল। এতদিন তিনি নমুকে পড়িয়েছেন, লিখিয়েছেন বাঁধা-ধরা ছোটদের বই থেকে। সেসব নমুর ভালই আয়ত্ত হয়ে গেছে। সে সব পড়ে সত্যি সত্যি নমু কতটা শিখেছে এবং বুঝেছে তার একটা পরীক্ষা নিলে কেমন হয়?
ছাত্রদের উপহার দেওয়া অনেক ডাইরি তাঁর ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমের বুকসেলফের ড্রয়ারে রাখা থাকে। ব্রেকফাস্টের পর তিনি নতুন একটা ডাইরি আর একটা পেনসিল বের করে নমুকে বললেন, “দাদুভাই, আজকে একটা নতুন খেলা খেলব”।
নমু বেশ মজা পেয়ে বলল, “বাঃ কী খেলা দাদু”?
“খেলাও বটে আবার লেখাপড়াও বটে”।
“খেলা আর লেখাপড়া একসঙ্গে?” নমু বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল।
“হুঁ। খেলাটার নাম ধরো ডাইরি-ডাইরি খেলা। মানে এখন থেকে দুপুরের খাওয়ার সময় পর্যন্ত তুমি যা যা দেখবে, যা যা কথা বলবে, যা যা করবে এবং শুনবে, সব লিখে রাখবে তোমার ডাইরির পাতায়। বুঝতে পারলে?”
“ধরো এই তুমি আমাকে যা বললে, সে কথাও লিখবো? তারপর দিম্মা, মা, নীলিমা মাসি, আজ বাগানে মালিমামা এসেছে, যে যা বলবে, করবে, তারপর আমি যা যা করব, সব লিখবো?”
“গুড। ঠিক বুঝেছ। বাগানে গেলে গাছের নাম, ফুলের নাম, পাখির নাম, যা জানো সে সবও লিখবে...”।
“এখনই শুরু করি?”
“করো। কিন্তু এখন কাউকে দেখাবে না, এমনকি আমাকেও না। আমাকে দেখাবে সেই দুপুরে খাওয়ার আগে। ঠিক আছে?”
বিশাল ঘাড় নেড়ে নমু বলল, ঠিক আছে।
“ডাইঋ ডাইঋ খেলা
দাদুর থেকে ডাইঋ আর পেন্সিল নিলাম। এই ডাইঋতে আমি এখন থেকে যা কিছু দেখব, শুনব - সব ৯খে রাখবো। ঘর থেকে বেঋয়েই দেখি সিঁড়ির মাথায় বেড়ালটা বসে আছে। আমাকে দেখেই পড়িমঋ করে দৌড়ে পালাল। কি মুশকিল, এখনও পর্যন্ত বেড়ালটা আমার পঋচিত হতে পারল না? আমাকে দেখলেই ভয় পায় কেন? কই অন্য কাউকে তো ভয় পায় না। কই দিদিমা কিংবা নী৯মামাসিকে তো ভয় পায় না? দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দাদু বলেছিল, তোমার দিদিমা আর নী৯মা ওকে পঋপাটি করে খেতে দেয় যে – মাছ, দুধের বাটি – তাই বেড়ালটা ওদের পায়ে পায়ে ঘোরে।
নিচে বাগানে গেলাম। মা৯মামাকে দেখতে পেলাম না। পিছনদিকে গিয়ে দেখি মা৯মামা মাটিতে বসে কাজ করছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “মা৯মামা কী করছো গো?”
আমাকে দেখে হেসে বলল, “এই মাটিটা একটু খুঁড়ে দিচ্ছি। গাছের গোড়া খুঁড়ে দিলে শেকড়ে হাওয়া পায়, গাছ খুব বাড়ে। আমাদের গায়ে ঝিঋঝিঋ হাওয়া লাগলে যেমন ভাঋ আরাম হয়, গাছেদেরও হয় জানো তো?”
“এটা কী গাছ গো মামা?”
“পেঁয়াজ গাছ, সবে গজাচ্ছে। আরও দিন সাতেক গেলে পুষ্ট হয়ে পেঁয়াজক৯ হবে”।
“আর ওই চারাগু৯?”
“ওগুলো গাজর – এধারে টোম্যাটো। টোম্যাটোকে অনেকে বি৯তি বেগুন বলে জানো তো! ওই দিকে লংকা। আর ওই যে ওদিকের কটা বেগুন গাছ। আর এই যে এইখানে আছে ফুলকপি আর বাঁধাকপি। ফুলকপির সবে ফুল এসেছে – দিন পনের পরে এত্তোবড়ো ফুল হবে – সে ফুলকপি দিয়ে তরকাঋ রাঁধলে যা স্বাদ হবে না – সব কিছু ভু৯য়ে দেবে”।
“আর ওদিকের লম্বা লম্বা পাতাওয়ালা গাছগুলো কি?”
“ওগুলো? ওগুলো কলাগাছ – কাঁঠা৯ কলা। সবে মোচা এসেছে, কলা হতে অনেক দেঋ”।
“মোচা থেকে কলা?”
“হ্যাঁগো মোচার বড়ো বড়ো পাপড়ির তলায় সাজানো আছে – সাঋসাঋ ক৯র গুচ্ছ। ওগুলোই বেড়ে বেড়ে হয়ে যাবে কলার কাঁদি”।
ভেতর থেকে মা ডাকলেন, “নমু, কোথায় গে৯? আমরা এবার বেরোব”।
আমি মা৯মামাকে বললাম, “মা ডাকছেন। আসি”। দৌড়ে দোতলায় গিয়ে দেখি মা আর দিদিমা বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি। দিদিমা রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নী৯মামাসিকে বলছেন, “নী৯মা,
মেসোমশাইকে সাড়ে বারোটা থেকে তাগাদা দিবি চান করতে যাবার জন্যে। আর যদি চা চায় একবার দিবি – ৯কার চা। চিনি ছাড়া। একটু পরে নমুসোনার জন্যে একটা ডিমের পোচ দিবি, সামান্য নুন-গোলমঋচ দিয়ে। মেসোমশাইকে দিবি না”।
মা বললেন, “একদিন একটা ডিম খেলে কী হবে মা? বাবা ডিম খেতে ভালোবাসেন”।
দিদিমা বললেন, “না বৌমা তুমি জানো না, ডিম খেলেই ওঁনার ক৯ক পেনটা বেড়ে ওঠে। ওঁনার ৯ভারে ডিম একদমই সহ্য হয় না। আর শোন দেড়টার মধ্যে খেতে দিয়ে দিবি। মেসোমশাইকে ভাত কম দিয়ে তরকাঋ বেশি দিবি। কেমন? ডাক্তার বলেছে বেশি বেশি তরকাঋ খেতে। নমুসোনা, ঠিক সময় মতো স্নান সেরে দাদুর সঙ্গে খেয়ে নেবে, কেমন? দাদু যেন বেশি দুষ্টুমি না করে, লক্ষ্য রাখবে”।
মা বললেন, “তোর হাতে ওটা কি, নমু?”
আমি বললাম, “ডাইঋ, দাদু বলেছেন ডাইঋ ৯খতে”।
মা বললেন, “৯খছিস? কই কী ৯খ৯ দেখি?”
আমি বললাম, “এখন দেখানো যাবে না, দাদু মানা করেছেন। বলেছেন কেউ যেন দেখতে না পায়। দাদু দুপুরে খাবার আগে দেখবেন”।
দিদিমা বললেন, “ছাড়ো বৌমা, বেঋয়ে পড়ি। তোমার বাবার যত্তো ছিটিয়া৯ কারবার, সারাজীবন মাষ্টাঋ করে মাথার মধ্যে ছিটমহল বানিয়ে ফেলেছেন। নী৯মা আমার বেরোচ্ছি...” গলা তুলে নৃপেনবাবুকে চেঁচিয়ে বললেন, “শুনছো, আমরা বেরোচ্ছি”। তারপর নমুর গাল টিপে বললেন, “তুমি তো লক্ষ্মী ছেলে, দাদুর দিকে একটু নজরদাঋ করো, কেমন? দাদু যেন দুষ্টুমি না করতে পারে। আমরা বেরোলে দরজাটা বন্ধ করে ওপরেই থেকো”।
মা-দিদিমা বেঋয়ে যেতে আমি আবার বাগানে গেলাম। মা৯মামা দেখলাম ফুলের বাগানে কাজ করছেন। কী সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে – এতো বড়ো বড়ো – তেমনি সুন্দর রঙ। মা৯মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কী ফুল মামা?”
“ডা৯য়া। রোদ্দুর পড়ে ফুলগুলো যেন খিলখি৯য়ে হাসছে, তাই না, ছোটবাবু? আর ওই দিকে দেখ চন্দ্রমল৯কা। কতরকমের রঙ, দেখছো? ওই দিকের গুলো সূর্যমুখী আর এই যে এগুলো ক্যালেনডুলা। তারপাশেই দেখ এই যে এগু৯ গাঁদাফুল। রকমাঋ রঙের ফুল শীতকালেই হয়। গরমকালের ফুলে তেমন রঙ হয় না, অধিকাংশই সাদা – বে৯, শিউ৯, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, টগর, মালতী, কামিনী। একটু একটু রঙ থাকে কাঁঠা৯ চাঁপায়, মাধবীলতায়। অবিশ্যি গরমের অধিকাংশ ফুলেই ভাঋ মিষ্টি গন্ধ হয় – শীতকালের ফুলে আবার তেমন গন্ধ হয় না”।
মা৯মামার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে বললাম – “এই বড়ো গাছগুলো কী গাছ, মামা”।
“ওই গাছটা আম গাছ, আম্রপা৯ – ছোট ছোট আম পাকলে মিছঋর মতো মিষ্টি। এটা জামরুল। আর ওইটা হল ৯চু। গরমকালে ৯চু পেকে লাল টুকটুকে হয়ে ওঠে – ওঃ - সবুজপাতার মধ্যে
থোকাথোকা পাকা লাল ৯চুগুলো হাওয়ায় যখন দোলে - সে ভাঋ চমৎকার দেখতে লাগে। গরমকালে একবার চলে এসো না, ছোটবাবু। দাদুর বাগানের আম্রপা৯ আর ৯চু খেলে, আমেঋকা ফিরতে তোমার ইচ্ছেই হবে না...”।
মা৯মামার কাজ হয়ে গেল। বাগানের নানান যন্ত্রপাতি ধুয়ে মুছে পঋপাটি করে গুছিয়ে রাখলেন, গ্যারেজের এক কোনে। বললেন, “এখন তবে আসি, ছোটবাবু। আমি আবার বেষ্পতিবার আসবো, তুমি থাকবে তো?”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ থাকব, বাবা আসবেন মাসের শেষ দিকে – তারপর আমাদের আমেঋকা ফিরতে হবে...”। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল – এমন সুন্দর দেশ আমাদের – এসব ছেড়ে আমরা কেন আমেঋকায় থাকি – সেটা তো আমাদের দেশ নয়...। মা৯মামা চলে গেলেন, আমি দরজা বন্ধ করে দোতলার সিঁড়িতে পা দিতেই নী৯মামাসির ডাক শুনলাম – “নমুবাবা, ওপরে এসো...”। বুঝলাম আমার পোচ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
সিঁড়ির মাথায় নী৯মামাসির সঙ্গে দেখা হল, তাঁর এক হাতে ডিমের পোচ আর অন্য হাতে ৯কার চা। বললেন, “দাদুর ঘরে চলো। ওখানে বসে দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে খাবে”।
দাদুর ঘরে ঢুকে দেখি দাদু খাটে মশাঋর ভেতরে ঢুকে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। আমি অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদু তুমি দিনের বেলা মশাঋর মধ্যে ঢুকে বসে আছো কেন?”
দাদু মশাঋর থেকে বেড়িয়ে এসে সোফায় বসতে বসতে বললেন, “এস, বসো, দাদুভাই। দিন হোক বা রাত, মশাদের আমি মোটেই বিশ্বাস কঋ না। কখন যে হুল ফোটাবে...ঠিক তোমার দিদিমার মতো”।
টেবিলে চায়ের কাপ রেখে নী৯মামাসি দাদুর কথায় মুখ টিপে হেসে বললেন, “মেসোমশাই, আপনার চা। চা খেয়েই আপনি কিন্তু চান করে নেবেন। গিজার চালু করে দিয়েছি”। তারপর আমার হাতে প্লেট আর চামচ ধঋয়ে দিয়ে বললেন, “তুমিও পোচ খেয়েই চান করতে যাবে। তোমাদের বাথরুমেও গিজার চালু করে দিয়েছি”।
নী৯মামাসি চলে যেতে দাদু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তোমার পোচে নুন-গোলমঋচ দিয়েছে তো, দাদুভাই? গোলমঋচের গুঁড়ো ছাড়া পোচের স্বাদ জমে না। আমারও পোচ খুব প্রিয় খুব খেতাম – কিন্তু তোমার দিদিমা ডাক্তারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে...আমার ডিম খাওয়াটাই নাকচ করে দিয়েছে। কী ঝকমাঋ বলো তো, দাদুভাই!”
দাদুর সামনে বসে তাঋয়ে তাঋয়ে পোচ খেতে খুব খারাপই লাগছিল। কিন্তু দাদুর বয়স হয়েছে – ডিম-টিম না খাওয়াই ভালো।
চা করে শেষ করে দাদু বললেন, “কই কী ৯খলে, কেমন ৯খলে দেখি। এই পরীক্ষায় তুমি পাশ করলে, আমারও পাশ করা হবে। বুঝবো আমি এতদিনেও মাষ্টাঋ করা ভু৯নি”।
আমি ডাইঋ লেখা এখানেই শেষ করলাম। লেখাপড়া করতেও যে এমন মজা হয় – এর আগে বুঝতেই পাঋনি”।
- - -
নমু পোচ শেষ করে ডাইরিটা দাদুর হাতে দিয়ে বলল, “তুমি দেখ দাদু, আমি ততক্ষণ স্নানটা সেরে আসি”।
নৃপেনবাবু ডাইরি খুলতে খুলতে বললেন, “বেশ বেশ। সেই ভালো। আমি তোমার লেখাটা পড়ে ফেলি”।
ডাইরি পড়তে পড়তে নৃপেনবাবু বেশ কয়েকবার জিভে বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “দোষ তো দাদুভাইয়ের নয় – আমার। আমি পুরোপুরি ফেল করে গেলাম। দাদুভাইকে বলাই হয়নি – বাংলা ভাষায় ৯ বর্ণের কোন ব্যবহারই আর নেই। এও বলা হয়নি – ঋ বিশেষ কিছু তৎসম – অর্থাৎ সংস্কৃত - যেমন ঋতু, ঋষি, ঋত, ঋজু, ঋত্বিক, এই রকম সীমিত কিছু শব্দ ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার হয় না। এটা যদি বলে দিতাম দাদুভাইয়ের লেখায় তো কোন খুঁত ছিল না! একশো তো একশ। কিন্তু আমি? ছিঃ – ফেল হয়তো করিনি। কিন্তু বত্রিশের বেশি – অর্থাৎ বড়ো জোর টায়েটায়ে পাশ করেছি বলা চলে।
কিন্তু ওর দিদিমা এসব কী বলেছে আমার সম্পর্কে? – তাও বৌমা, নীলিমা, নাতির সামনে? আমি ছিটিয়াল? মাষ্টারি করে করে আমার মাথায় ছিট-মহল গজিয়েছে? তার ওপর আমি দুষ্টুমি করলে, আমাকে সামলাবে আমাদের নাতি? ছি ছি। ছেচল্লিশ বছর একসঙ্গে ঘর করে, নিজের স্বামী সম্পর্কে এই রকম মন্তব্য? মহিলার মাথার ঠিক আছে তো?
তার পরেই ভাবলেন, কিন্তু তিনিই বা কম কিসে? নাতির সামনে দিদিমাকে মশার সঙ্গে তুলনা করলেন? ওর দিদিমা তাঁকে মশার মতো হুল ফোটান? ছি ছি। তিনিও তো বজ্জাতিতে তাঁর স্ত্রীর থেকে এক চুলও কম যান না!
ডাইরিটা হাতে নিয়ে নৃপেনবাবু অনেকক্ষণ বসে রইলেন। জানালা দিয়ে দূর আকাশে একটা চিলকে ভেসে বেড়াতে দেখলেন বহুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে সিদ্ধান্ত করলেন, দীর্ঘ দাম্পত্যের এটাই মজা। পরষ্পরের পিছনে লাগাতেই সম্পর্কটা সুন্দর টিকে থাকে – একদম গলাগ৯ – পঋপাটি সম্পর্ক।
----০০০০----
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।