১
[বিছানায় টানটান শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছিল পৈলান, পৈলান মণ্ডল। ঘাড়ের নিচে ভাঁজ করা হাত। বেশ হাল্কাপুল্কা মেজাজ। এখন সবে ভোর। আরেকটু বেলা হলেই লোকজন আসা শুরু হবে। সঠিক কতদিন তা ঠিক মনে নেই, তবে অনেকদিন কেটে গেল বিছানায় শুয়ে। আজকে একটু বেরোবে ভাবছে। নিঃশব্দে দরজা খুলে ঢুকল কেউ, বলল,]
হুহুঃ সুপ্রভাত, প্রভু। ঘুম ভেঙে গেছে? তাহলে একটু চা দিয়ে যাই, প্রভু’?
পৈলানঃ সুপ্পোভাত? এখানে গুডমন্নিং বলার রেওয়াজ নেই নাকি হে? তার ওপর আবার পোভু? এমন তো শুনি নাই কভু? হা হা হা হা। বলি যাত্রা-পালা হচ্ছে নাকি বলো তো, পৌরাণিক পালার রিহার্সল করছো? আমি বাপু, ওসব একদম পছন্দ করি না। আমি খাঁটি বাঙালি, বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। আমি গুডমন্নিং, স্যার, এই সব শুনতেই অভ্যস্ত। ওই সব আলফাল বকে আমার মেজাজ খিচড়ে দিও না, বুঝলে?
হুহুঃ হ্যাঁ স্যার। আর ভুল হবে না। আজ্ঞে, এখানে নতুন নতুন তো, সড়গড় হতে একটু সময় লাগবে বৈকি। তবে স্যার, ওই যে বলছিলাম, চা দেবো, না কফি দেবো, স্যার?
পৈলানঃ চাই দাও। সকাল সকাল কফিটা তেমন জমে না। আমার চাটা কেমন হয় জানো তো? হাল্কা লিকার, চিনি ছাড়া-দুটো ট্যাবলেট।
হুহুঃ স্যার একটা কথা জিগ্যেস করি? আপনি লিকার চা কী ভালোবেসে খান? নাকি নাচার হয়ে খান?
পৈলানঃ চিনি ছাড়া লিকার চা শখ করে, কে খায় চাঁদ? সাড়ে চারশোর ওপর সুগার, তার ওপর বুকজ্বলা অম্বল। বাধ্য হয়ে খাই। তিন চামচ চিনি, ঘন দুধের সর জমে ওঠা চা। তবে না চা খেয়ে আরাম, চা খেয়ে মজা!
হুহুঃ সে আর বলতে, স্যার? এখানে স্যার নো সুগার, নো অম্বল। এক কাপ নিয়ে আসছি খেয়ে দেখুন, স্যার। এখানকার সুগারে সুগার হয় না। এখানকার চায়ে চাইলেও অম্বল হয় না।
পৈলানঃ গ্রান্টিক দিচ্ছ? তবে হলেই বা আমার কী হবে? তোমারই ভোগান্তি হবে। ডাক্তারবাবুকে বলে তোমার চাকরিটা খাবো। তেমন তেমন হলে জেলেও ভরে দেব। বিনা বিচারে সতের বছর। আমাকে বিভভান্ত করার চেষ্টা, আমাকে হত্তা করা চক্কান্ত।
হুহুঃ [হেসে] না স্যার। গ্যারান্টি। একবার তো ট্রাই করে দেখুন। [দরজার দিকে ফিরতে যায়]
পৈলানঃ ওহে, শোনো হে, শোনো। হন হন করে চললে, বলি নামটা কী তোমার? কী বলে ডাকব?
হুহুঃ হে হে, স্যার। আমার নাম? আমার নাম শুনে হাসবেন, স্যার।
পৈলানঃ সে না হয় হাসলামই, নামটা কী শুনিই না।
হুহুঃ হুহু, স্যার। হুহু গন্ধর্ব।
পৈলানঃ [ভুরু কুঁচকে] বেশ বেআক্কেলে নামটা তো, হে! বাঙালি যে নও, সে তো বুঝতেই পারছি। ইউপি না বিহার, নাকি তেলেগু? তা এখানে জুটলে কোত্থেকে?
হুহুঃ এইখানেই আমাদের বাস, স্যার। বহুদিনের।
পৈলানঃ তবে যে একটু আগে বললে, এখানে নতুন নতুন, সড়গড় হতে সময় লাগবে। যত্তো সব ফালতু কথা। তোমার রকম সকম আমার একটুও ভাল ঠেকছে না, হে। তোমার ওপর আমার নজর থাকবে, এই বলে দিলাম। যাও যাও, চাটা নিয়ে এসো, তারপর তোমার হচ্ছে...তোমার গন্ধটাও ধরবো।
হুহুঃ হে হে, গন্ধ নয় স্যার, গন্ধর্ব। [হুহু হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে]
[পৈলান বিছানা থেকে নেমে এল। নিজেকে খুব হাল্কা মনে হল তার, যেন কোন ভার নেই, কিছুটা নেচেও নিল আপন মনে, ফাঁকা ঘরে]
পৈলানঃ বাইরে কি কুয়াশা হয়েছে, নাকি মেঘ করেচে? সুজ্যি ওঠার নাম নেই। সেই থেকে মনে হচ্ছে যেন ভোর। মেঘে মেঘে বেলা কত হল কে জানে? এ ঘরে, ব্যাটারা একটা ঘড়িও দেয়নি। ওই গনধরবো নাকি, ব্যাটাকে বলতে হবে একটা ঘড়ি দিতে। আরেকটা আরেকটা কি যেন, হ্যাঁ মনে পড়েছে, ফোন, ইন্টারকম। না, না ইন্টারকম নয় কলিংবেল হলেই ভালো। বেলটা হাতের কাছে রেখে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। বারবার উঠে ফোন ডায়াল করতে হবে না।
[হুহু হাতে ট্রের ওপর চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল]
অ্যাই। শোনো হে, তোমার কথাই ভাবছিলাম। ঘরে একটা ঘড়ি রাখোনি কেন বলতো? এটাও কী আমাকে বলে দিতে হবে? তোমার ম্যানেজার কে আছে? ডেকে দিও তো। আর ওই সঙ্গে একটা কলিং বেলও যেন ব্যবস্থা করে। আশ্চর্য। এতটুকু দায়িত্বজ্ঞান যদি থাকে!
হুহুঃ আজ্ঞে স্যার এই যে আপনার চা, একটু চুমুক দিয়ে দেখুন তো। মনোমত হল কিনা?
[চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সুড়ুৎ শব্দে লম্বা চুমুক দিয়ে]
পৈলানঃ আঃ। বেড়ে হয়েছে চাটা। মাইরি। মনে হচ্ছে সেই ইয়ং বয়সে যেমন খেতাম আর কি। যেমন মিঠে, তেমনি কড়া লিকারে ঘন দুধ। না তোমাকে যতটা অকম্মা মনে হচ্ছিল, ততটা নও। কিন্তু সেই সুগার আর অম্বলের ব্যাপারটা কিন্তু আমি ভুলছি না, মনে রেখো।
হুহুঃ ওসব, একদম ভুলে যাবেন স্যার। কোনদিন যে ছিল এমন মনেও হবে না।
পৈলানঃ বাইরে কি, কুয়াশা করে আছে? নাকি মেঘলা? সেই থেকে সুজ্যি দেখা যাচ্ছে না কেন?
হুহুঃ আজ্ঞে স্যার, এখানে সবসময় এরকমই – ভোরের আলোর মতো। রোদ্দুরের ধাঁধানো আলোও হয় না, আবার অমবস্যার মিশমিশে অন্ধকারও হয় না।
পৈলানঃ সব চাইনিজ এলইডি মাল- বুজে গেছি, আমাকে আর বোকা বুঝিও না হে, তোমার চালবাজির কথায় আমি ভুলছি না। ম্যানেজারকে বলে এক্ষুনি একটা ঘড়ি, ওই সঙ্গে ক্যালেন্ডার আমার চাই। আজকে কত তারিখ আর এখন কটা বাজছে, বলো দেখি।
হুহুঃ আজ্ঞে, এখানে ঘড়ি পাওয়া যায় না, স্যার। ক্যালেণ্ডারও না। এখানে কেউ সময়ও মাপে না, কারো মেয়াদও ফুরোয় না, স্যার। এখানে আসতেই যা কষ্ট, তারপরেই ব্যস - হয়ে গেল।
পৈলানঃ কিসের কী হয়ে গেল? কী সব আবোলতাবোল বকছো বলো তো?
হুহুঃ মানে স্যার, ব্যাপারটা চট করে বুঝে ওঠা ভারি শক্ত। আসলে সবাই অনাদি আর অনন্ত হয়ে গেল।
পৈলানঃ [খুব রেগে। আঙুল তুলে] অ্যাই শালা, অনাদি, অনন্তর নাম তুলে আমাকে ভয় দেখাস না। ওদের সব খবর আমি জানতাম বলেই, ওদের দুটোরই আমি খবর নিয়ে নিয়েছি। [একটু থেমে] অ, তাই বল, এইবার বুঝেছি, তোরা সব শালা কোন দলের লোক। আমাকে একদম ঘাঁটাস না। সেই থেকে আমাকে তাপ্পি মারছিস? শালা, তোরা আমায় কিডন্যাপ করে এনেছিস, না?
[চাটা শেষ করে, হুহুর হাতে খালি কাপটা ধরিয়ে দিল]
হুহুঃ ব্রেকফাস্টে কী খাবেন, স্যার? মাংসের হালকা ঝোল আর মাংসেরপুর দেওয়া পাঁউরুটি টোস্ট, দিই?
পৈলানঃ সোজা কথায় উত্তর দিবি না, না? তুই খুব হারামি, জানিস তো? সাত হারামির এক হারামি বললেও কম বলা হয়। তোর নামটাও বললি গানধরবো! শালা তুই পাক্কা টেররিস্ট। শুরুর থেকেই তুই আমাকে থ্রেট করছিস, বন্দুক ধরবি? ভেবেছিস আমি গেঁড়ে ভোঁৎনা? ভয় দেখালেই সিঁটিয়ে কাদা? এখন আবার মাংসের ইস্টু, সেন্ডউইচ টুচ খাইয়ে আমার মন ভুলোতে চাচ্ছিস? আমার পছন্দ-অপছন্দ সবই তোদের খবরে আছে, কেমন?
হুহুঃ আপনি খুব বিচলিত হয়ে উঠছেন, স্যার। সবার সব খবরই, আমাদের রাখতে হয়, সেটাই আমাদের কাজ স্যার। যে যেমন কাজ করে, সে তেমনই ফল পায়, এ নিয়ম স্যার, আমাদেরও, আপনাদেরও। বিচলিত হবেন না স্যার। খাবারের সঙ্গে এবার কফি এনে দিই স্যার? আরাম করে খান।
পৈলানঃ [ভুরু কুঁচকে] অ্যাই, বিচলিত আবার কী রে? তোকে আগেই বললাম না, বাংলায় বল।
হুহুঃ হে হে। বিচলিতর বাংলা টেনসান, স্যার।
পৈলানঃ টেনসান? অ তাই বল। অ্যাঁ কী বললি, টেনসান? শালা তুই আমাকে টেনসান শেখাচ্ছিস? আমার মোবাইলটা কোথায়? আমার মোবাইলটা কোথায়? ওটা আমাকে একবার দে, তারপর তোদের কেমন টেনসনে দৌড় করাই দেখ। আমার ছেলেরা একবার খবর পেলে না? তোদের হাঁড়ির হাল করে ছাড়বে জেনে রেখে দে।
হুহুঃ আপনার খাবারটা আমি নিয়ে আসি, স্যার। আরাম করে খান। খেতে খেতে না হয় আপনার কথার উত্তর দেওয়া যাবে। [হুহু বেরিয়ে গেল]
পৈলানঃ [চিন্তিত মুখে, পায়চারি করতে করতে] ছিলাম তো শালা কলকাতার সেরা নার্সিং হোমে। কতদিন ছিলাম, সে তো মনেও নেই ছাতা। কখন ঘুমোতাম, কখন জাগতাম কে জানে। মাঝে মাঝে চোখ মেলে দেখতাম মাথার ওপর সিলিংয়ে লুকোনো মিটমিটে আলো। বিছানায় শুয়ে আছি বুঝতে পারতাম। আড়ষ্ট ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার ক্ষমতাও ছিল না। তবে সারা গায়ে, নাকে, মুখে গুচ্ছের নল লাগানো ছিল দেখতাম। ডানপাশের দেওয়ালে একটা টিভির মতো নীল পর্দার বাস্কো, বাস্কো নয়, বাস্কো নয়, কি যেন বলে, হ্যাঁ মনে পড়েছে মনিটর। মনিটর। স্কুলে ন বছর পড়েছিলাম, সব কেলাসে আমিই মনিটর হতাম। মনিটর মানেই মাতব্বরি। মাতব্বরি ব্যাপারটা আমার জন্ম থেকেই। সেই ভাঙিয়েই তো এত ক্ষমতা আর দাপট। আমার নাম শুনলে, পোয়াতি মেয়েদের গবভোপাত হয়ে যায়। মায়ের কোলে ঘুমকাতুরে খোকারা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বিরোধী দলের নেতাদের ধুতি হলুদ হয়ে কেচ্ছা কেলেংকারি হয়। কিন্তু এ ব্যাটারা কারা? কোন দলের? আমাকে তুলে এনেছে বুঝতে পারছি। কিন্তু কী চায় কি আমার থেকে! দু-চার পেটি হলে, তেমন পবলেম নেই। কিন্তু না হলে? এ জায়গাটা কোথায়? এখান থেকে বেরোনোর উপায় কী? তবে হ্যাঁ, একবার বেরোতে পারলে, শালাদের গুষ্টির ষষ্টিপুজো যদি না করে ছাড়ি তো আমার নাম পৈলেন নয়।
[ট্রে হাতে হুহু ঢুকল। প্লেটে স্যাণ্ডউইচটোস্ট, বোওলে মাংসের স্টু আর কাপে গরম কফি]
হুহুঃ একদম গরম গরম খেয়ে নিন, স্যার।
পৈলানঃ হুঁ। তেমন খিদে মনে হচ্ছিল না, কিন্তু গন্ধটা হেবি ছেড়েছে, তাতেই কেমন যেন খিদেটা চনমনে হয়ে উঠেছে। তোদের পেটের মধ্যে কী মতলবটা আছে বুঝতে পারছি না, তবে ভয় পেয়ে আমি পেটে না খেয়ে দুব্বল হবো, এমন আহাম্মক আমায় ভাবিস না।
[স্যাণ্ডউইচে কামড় দিয়ে, এক চামচ সুপ নিল]
বাঃ। রান্নাবান্না তো ভালই তোদের ক্যান্টিনে। তা তোদের মতলবটা কী খুলে বলবি? আমাকে এখানে এনে বন্দী রেখে তোদের লাভটা কী হবে? এই এত দামি ঘর, এই রকম খাওয়া দাওয়া...তোদের বস কে আছে? তাকে বল না, এসব ভাঁট খরচ আর সময় নষ্ট না করে, সামনে এসে ঝেড়ে কাশতে!
হুহুঃ আপনাকে বন্দী রাখা হয়েছে, কে বলল, স্যার? আপনি তো বন্দী নন।
পৈলানঃ বন্দী নই? এই ঘরের বাইরে, যেখানে খুশি আমি যেতে পারি? কী ফালতো বলছিস মাইরি।
হুহুঃ হ্যাঁ স্যার। যেখানে খুশি আপনি যেতে পারেন। কোন বাধা নেই। তবে এই লোকে পনের দিনের মেয়াদ, তার পরে অন্য লোক।
পৈলানঃ অ তোর ওই সময় ডিউটি চেঞ্জ হয়ে যাবে বুঝি? অন্য লোক আসবে? তবে পনের দিন তো অনেক দিন রে? তার আগেই আমি চলে যাবো। আচ্ছা, আমি যদি বন্দী না হই, তাহলে আমার মোবাইলটা দিচ্ছিস না কেন?
হুহুঃ এখানে ওটার কাজ কী, স্যার? টালির টুকরো। এখানে নেট ওয়ার্ক নেই, মোবাইল থাকা না থাকা সমান।
পৈলানঃ এ জায়গাটা কলকাতা থেকে অনেক দূরে?
হুহুঃ তা স্যার, বেশ খানিকটা দূরেই।
পৈলানঃ [মুখ ভেংচে] বেশ খানিকটা দূরে। হতভাগা, আমাকে বন্দী করেই যদি না রাখবি, তাহলে কলকাতা ছেড়ে এখানে নিয়ে এলি কী করতে?
হুহুঃ আজ্ঞে মুক্তি পেলে এখানেই আসতে হয় প্রথমে, তারপর অন্য লোকে। হে হে, আপনি এতদিন যে ফাঁদে বন্দী ছিলেন, তারপরে আপনাকে আবার বন্দী কে করবে?
পৈলানঃ আমি বন্দী ছিলাম? হারামজাদা, এমন দেব না কানের গোড়ায়। আমাকে বন্দী করতে পারে এমন কারো ক্ষমতা ছিল বাংলায়?
হুহুঃ হে হে ছিলেন বৈকি, স্যার। সে এমনই বন্দী, বুঝতেও পারেননি। এই এখন যেমন বুঝতে পারছেন না, যে আপনি মুক্ত। আর আপনি স্যার এখন বাংলাতেও আর নেই।
পৈলানঃ (চমকে) বাংলাতেও নেই মানে? আমি তাহলে এখন কোথায়? বিহার, ইউপি না দিল্লিতে? কী ভজকট বকছিস মাইরি!
হুহুঃ ওসব নয়, ওসব নয়, হে হে এ একেবারে অন্যলোকের জায়গা। তবে এ লোকে সবাইকেই একবার আসত হয়।
পৈলানঃ হতভাগা জেনে রাখ, অন্যলোকের এলাকাতে আমি একলা যাই না। আমার সঙ্গে সাঙ্গপাঙ্গ থাকে, তাদের হাতে মটরদানা থাকে। বলা নেই কওয়া নেই, অন্য লোকের এলাকায় এনেছিস কেন বে, আঁটকুড়ির ব্যাটা?
হুহুঃ আপনি স্যার, সেই থেকে অনেক আকথা কুকথা বলছেন, সেটা না বললেই ভালো, স্যার। আমি আপনার নাড়ি নক্ষত্র, হাঁড়ির খবর সব জানি, কিন্তু আপনি আমার কিছুই জানেন না। কার মধ্যে কী লুকিয়ে আছে কে জানে, স্যার? আর কী কথায় কখন কী ঘটে যায়, কে বলতে পারে? এখানে আবার সব কথার এবং কাজের হিসেবও রাখা হয়, সেটাই মুশকিল।
পৈলানঃ (সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে স্যুপ খেতে খেতে) ব্যাটাকে অ্যাত হড়কাচ্ছি, তাও হেব্বি ক্যাজুয়াল রয়েছে কিন্তু। উলটে মাঝে মাঝে, আমাকেই দেখছি কচি করে হড়কে দিচ্ছে। হারামীটার পেছনে বেশ লম্বা হাত আছে বোঝা যাচ্ছে। হয়তো সিবিআই, ইডি। বুঝেছি, এ শালা নিগ্ঘাৎ কেন্দের চক্কান্ত। যাই হোক মাথা গরম করে লাভ হবে না মনে হচ্ছে। ব্যাটাকে অন্য ভাবে ম্যানেজ করা যায় কিন দেখি।
(স্যুপ স্যাণ্ডউইচ শেষ, এবার কফির কাপে চুমুক দিয়ে)
তা বাপু, তোমার ওপর যতোই রাগটাগ করি না কেন, একটা কথা মানতেই হবে। রান্নার হাতটা খাসা। কিসের মাংস ঠিক বুঝলাম না, তবে খুব তার হয়েছে রান্নায়! কোথাকার ঠাকুর হে? আর মাংসটাই বা কিসের?
হুহুঃ ঠাকুর বলে এখানে কেউ নেই, রান্নাটান্নাও করতে হয় না, স্যার। যে যেমন কর্ম করে, তার মনোমত ঠিকঠাক জিনিষ এখানে তৈরি হয়েই থাকে।
পৈলানঃ এতো বেশ বেড়ে জায়গা মাইরি। এর পর যেন বলে বসো না, যে এর জন্যে কোন খরচাও হয় না!
হুহুঃ হে হে, স্যার ঠিকই ধরেছেন, সত্যিই কোন খরচা নেই। সারা জীবনের লুঠপাট করে জমানো পয়সায় ছ্যাদলা ধরে। তারপর সাত ভুতে কামড়াকামড়ি করে সে পয়সার ষষ্ঠীপুজো করে।
পৈলানঃ তা ঠিক, তবু মন তো মানে না। পোথম পোথম তোমার ওপর একটু বিরক্ত হয়েছিলাম ঠিকই, এখন দেখছি তোমার মধ্যে অনেক গুণ আছে হে। আর পৈলেন মণ্ডল গুণের কদর জানে। ঐ যে অনন্ত, ব্যাটার অনেক গুণ ছিল, খালপাড়ের বস্তি থেকে একদিন ভোরবেলা ফেরার সময় ওকে দেখেছিলাম। আর দেখেই বুঝেছিলাম ওর ভেতরে মাল আছে। তুলে এনে সঙ্গে রাখলাম কদিন। ঝট করে তৈরি হয়ে গেল, জান?
হুহুঃ হে হে, সে আপনার হাত যশ।
পৈলানঃ সেই অনন্ত, আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে, দু বছরে রাজার ব্যাটা কেরাসিনওয়ালা বানিয়ে দিলাম! আর সে কিনা এলো আমার পেছনে কাটি করতে? এমন বিশ্বেসঘাতক! দিলেম শালাকে টপকে।
হুহুঃ জানি, স্যার।
পৈলানঃ আর ওই অনাদি? আমার বিরোধী দলে ছিল, ওখানে ব্যাটাকে ল্যাজেগোবরে অবস্থা করে ছেড়েছিল। যে কোনদিন লাশ হয়ে ভুরভুরি কাটত পোড়ো সেপটিক ট্যাংকে। একদিন মাঝ রাত্রে ধড়াস করে পায়ে এসে পড়ল, পলুদা বাঁচাও। আমার চোখের কোলটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে উঠল।
হুহুঃ হে হে, সে আর বলতে? আপনার দয়ার শরীর।
পৈলানঃ আরে তা নয়, তা নয়। পেটে জল পড়লে আমার মনটা কেমন যেন মাখো মাখো হয়ে যায়। সেই অনাদি অনন্তর সঙ্গে ভিড়ে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবার ছক কষছিল। দিলাম শালার ঘন্টা বাজিয়ে।
হুহুঃ হে হে, আপনিই তো শেষ বিচারের মালিক। এই তুলছেন, এই খালাস করছেন।
পৈলানঃ ছেঁদো গ্যাস দিয়ে লাভ নেই, গন্ধ। কাজের কথাটা শোন। এখানে কত পাও? বলি ফিউচারের কথা কিছু ভেবেছ? সারা জীবন এভাবেই কাটাবে? নাকি দু পয়সা কামিয়ে, একটু রোখঠোক রোয়াবি দেখিয়ে রাজার হালে থাকবে?
হুহুঃ আজ্ঞে, সে আর বলতে? আর উণিশ বিশ হলেই খালে লাশ - একেবারে খাল্লাস।
পৈলানঃ আরে তা কেন? সবাই কী আর ওদের মতো নাকি? ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।
হুহুঃ সে কথা একশবার, আমাদের ভাবনা তো আপনি ভেবেই রেখেছেন। আপনার নিজের দলেরই আটত্রিশজন এখন মাটির তলায় কংকাল হয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আর ষোলজনের বানিয়ে তোলা মামলায় যাবজ্জীবন চলছে।
পৈলানঃ (ভুরু কুঁচকে) বেশ ছোকরা হে, তুমি! আমার থেকেও তোমার দেখি সব হিসেব একেবারে মুখস্থ!
হুহুঃ আজ্ঞে তা তো হবেই! আপনার হরেক লীলা, সব কী আর আপনার মনে রাখা ঠিক হয়? এরপর আছে বিরোধী দলের একশ আটত্রিশ জন, আর নিরীহ আম জনগণ গোটা চল্লিশেক তো হবেই!
পৈলানঃ (কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে) সব কী আর মনে আছে? কাজের মধ্যে অমন দু চারটে হয়েই যায়। আর ওসব না করলে লোকে মান্যিগণ্যিই বা করবে কেন? আর পাব্লিকের মনে ভয়ভক্তিই বা আসবে কোত্থেকে, হে? ওটাই তো আমাদের পোফেসন, ওটাই তো আমাদের ইউএসপি। ওটুকু না থাকলে, পলিটিক্যাল ন্যাতারা আমাদের দিয়ে ঘরও মোছাবে না, হে।
হুহুঃ আর পলিটিক্যাল হাতটা যদি মাথায় না থাকে, ক্ষমতার ল্যাজ নাড়া থাকবে কোথাও?
পৈলানঃ তুমি বেশ চালাকচতুরও আছো, য়্যাঁ? ভেজা বেড়ালটা সেজে থাকো, দেখে বোঝাই যায় না। এখনই কিছু বলতে হবে না। ভালো করে চিন্তা ভাবনা করে দেখ। এখান থেকে সটকে নিয়ে একবারটি আমায় কলকাতায় নিয়ে চলো, তারপর তোমার লাইফ কেমন বানিয়ে দিই দেখবে! হে হে, এটুকু না বোঝার মতো বোকা তুমি তো নও হে!
হুহুঃ আজ্ঞে, ভাবনা চিন্তার বাকি আর কী রাখলেন বলুন দেখি?
পৈলানঃ বলো কী হে, ভাবনা চিন্তা করেই ফেলেছ? বা বেশ বেশ। তা বেরোবার আগে লাঞ্চের ব্যবস্থা কিছু করেছ নাকি? দুপুরে ওই মাংসের কষা আর খান কতক পরোটা বানাবে নাকি? যাওয়ার আগে এ পাড়ার খাবারটা জমিয়ে খেয়েই যাই। আচ্ছা, ওই মাংসটা কিসের বলো তো হে, অমন স্বাদ এর আগে কোনদিন পাই নি।
হুহুঃ আজ্ঞে ওটা নরমাংস, স্যার।
পৈলানঃ অ তাই বলো! অ্যাঁ। নরমাংস? আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ তোর পেটে পেটে এই ছিল, গন্ধ?
হুহুঃ কিছু অন্যায় করে ফেললাম নাকি, স্যার? একটা মানুষখেকো বাঘ, কিংবা একটা হাঙর সারা জীবনেও অতো মানুষ খেতে পারে না স্যার, এই ক বছরে আপনি যা খেয়েছেন।
পৈলানঃ হ্যাক থুঃ থুঃ। ছিঃ ছিঃ। কোন শালা বলে আমি নরমাংস খেয়েছি? লাশ ফেললেই তার মাংস খাওয়া হয়ে যায়? আমার মতো একজন সমাজসেবীকে তুই নরমাংস খাওয়ালি?
হুহুঃ এ হে হে, আপনি এত ছ্যাছ্যা থুথু করছেন কেন স্যার, মানুষ কি এতই অখাদ্য স্যার? বাঘ ভাল্লুক স্যার কখনো কখনো মানুষ মারে পেটের জ্বালায়, আপনি মারেন, স্যার ক্ষমতা আর টাকার জ্বালায়। তা স্যার একটু খেয়ে দেখতে দোষ কী?
পৈলানঃ তোকে আমি ফাঁসিতে চড়াবো। তোকে আমি... আমি...ওয়াক ওয়াক...ওরে বাবা আমার কেমন গা গুলোচ্ছে...ইস...ইস...ছ্যাঃ ছ্যাঃ...ওয়াক ওয়াক...
[আলো নিভে যায়, কিছুক্ষণ পৈলানের ‘ওয়াক ওয়াক, থু থু’ আর হুহুর ‘ঘাবড়াবেন না স্যার, সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম অমন হতে পারে স্যার’ শোনা যেতে থাকে ...তারপর হুহুর কণ্ঠের বদলে একটী মেয়ের কণ্ঠ শোনা যায়, ‘স্যার, স্যার একটু শান্ত হোন স্যার, ও স্যার, স্যার...। আলো জ্বলে উঠলে দেখা যায়, হস্পিট্যালের বেডে পৈলেন শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে, তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে একটি নার্স, নাম পিংকি। পৈলানের সারা গায়ে নাকে মুখে নানান টিউব, সে সব খুলে সে উঠে পড়তে চাইছে।]
পিংকিঃ বীণাদি, শিখাদি একবার আসবে গো, পেশেন্ট হঠাৎ কেমন করছে দেখে যাও। সামলাতে পারছি না। ও বীণাদি, ও শিখাদি।
[আরো দুই নার্স বীণা আর শিখা দৌড়ে ঢুকল কেবিনে]
বীণাঃ ও মা, এ আবার কী হল রে? কোমার পেশেন্ট এমন কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে এই প্রথম দেখছি। শিখা তুই স্যারকে বরং একবার ফোন কর। আমি আর পিংকি ততক্ষণ দেখছি একে শান্ত করা যায় কি না।
[শিখা মোবাইলে ডায়াল করতে থাকে]
শিখাঃ যাচ্চলে, নেট ওয়ার্ক সীমার বাইরে বলছে।
বীণাঃ যাচ্ছেতাই নেট ওয়ার্ক। আবার কর।
শিখাঃ দাঁড়া দাঁড়া রিং হচ্ছে...রিং হচ্ছে...রিং হচ্ছে...যাঃ স্যার তুললেন না।
বীণাঃ ছেড়ে দে, এখন আর তাড়া নেই। পেশেন্ট ঠাণ্ডা মেরে গেছে...
পিংকিঃ ভেন্টিলেশান খুলে দিই?
বীণাঃ পাগল হয়েছিস? পুজোয় বোনাস নিবি না, মুখপুড়ি? ভেণ্টিলেশন চলুক...
[তিনজন বেডের দুপাশে দাঁড়িয়ে পৈলানের দিকে তাকিয়ে রইল। পর্দা নেমে এল]
..০০..
["পরবাস" ওয়েব পত্রিকায় কয়েক বছর আগে প্রকাশিত]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।