ওফ তোরা একটু থামবি? সেই কাল বিকেল থেকে শুরু করেছিস। গ্যাঙোর-গ্যাঙ আর মকমক করে, কান ঝালাপালা করে দিলি একেবারে!’
‘হে হে। তোরাই বা এত অল্পে অধৈর্য হয়ে উঠিস কেন, বল দেখি? সারা বছরই তো চুপটি মেরে থাকি, এই বর্ষার দু-তিনটে মাস আমাদের গলা খোলে। আনন্দে একটু গান গাই। তাও গাইতে দিবি না, হতভাগা?’
‘তা ঠিক। কিন্তু তাই বলে এ ক’মাসে সারা বছরের গানই গেয়ে ফেলতে হবে, সেটাই বা কেমন কথা? আচ্ছা, তোরা বছরের অন্য সময়টা করিস কী? তোদের দেখাই পাওয়া যায় না!’
‘স্রেফ ঘুমিয়ে কাটাই ব্রাদার, স্রেফ ঘুমিয়ে। পুকুর-খাল-বিল-জলার ধারে ভেজা মাটির একটু নীচে, গর্তের মধ্যে লাগাতার ঘুম। এই তো, বর্ষা ধরে এলে, আগে মা দুগ্গা আসবেন, তারপর মা কালী আসবেন। বাতাসে একটু শিরশির ভাব এল কী এল না, বাস। আমাদের আর দেখা পাবি না। বেশ ক’মাস পর যেই হাওয়ায় একটু গরমের ছোঁয়া লাগল, চড়ক পুজোর বাদ্যি বেজে উঠল ড্যাং ড্যাডাং ড্যাং, কাল বোশেখির ঝড়ে তালগাছের মাথাগুলো নিংড়ে, দু-এক পশলা বৃষ্টি শুরু হলেই, আমাদেরও গ্যাঙোর-গ্যাঙ শুরু।’‘বুঝলাম। কিন্তু তালগাছের মাথা নিংড়ে বৃষ্টি হয়, এ খবরটা তোকে কে দিল?’
‘বোঝো। তুই বেশ মুখ্যু তো! বৃষ্টি কোথা থেকে হয় কোনদিন দেখেছিস? অনেক উঁচু থেকে। আর সব থেকে উঁচুগাছ কোনটা? তালগাছ। তাহলে তালগাছের মাথা থেকে বৃষ্টি আসবে না তো কী তোর মাথা থেকে নেমে আসবে, হাঁদা গঙ্গারাম?’
‘তাহলে যে শুনেছিলাম, মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। সেটা কি তবে মিথ্যে?’
‘মেঘ? মেঘ আবার কী? অ বুঝেছি, সেই কুঁচবরণ কন্যা তার মেঘবরণ চুল? আচ্ছা খ্যাপা তুই যা হোক। তুই বুঝি জানতিস, কন্যার মেঘের মতো চুল থেকে বৃষ্টি হয়? হা হা হা হা। এসব গুজবে তোরা কান দিস কেন’?
‘আমরা উড়ে বেড়াই। অনেক দূর দূর জায়গায় ঘুরে বেড়াই। বৃষ্টি কিন্তু পড়ে তালগাছের থেকেও অনেক উঁচু থেকে, আকাশে থাকা মেঘের থেকে’।
‘আহাম্মকের মতো কথা বলিস কেন? বলি আকাশে মেঘ থাকবে কী করে শুনি? গাছের যেমন থাকে, মাটি থেকে তেমন কোন কাণ্ড আছে? নাকি আকাশে হুক লাগিয়ে ঝুলে থাকে? অথবা তোদের মতো ডানা আছে? যে উড়ে উড়ে বেড়াবে? আমাকে বোকা পেয়েছিস? যা বোঝাবি, তাই বুঝে যাবো?’
‘হে হে হে হে। ছ-সাতমাস তো থাকিস মাটির গর্তে অন্ধকারে ঘুমিয়ে। তুই সব জেনে গেছিস? আর আমরা কিছুই জানি না’!
‘কে বলেছে ছসাত মাস টানা ঘুমোই? হ্যাঁ অনেকটাই ঘুমোই, কিছুটা ঝিমোই, আর কত কী যে চিন্তা করি! চিন্তা করলেই সব কিছুর হদিস মিলে যায়, তা জানিস? তোদের তো আছে দুটো লিকলিকে ঠ্যাং আর দুটো ডানা। তোরা ভাবিস, খানিকটা উড়ে এলেই সব জানা হয়ে যায়? ছ্যাঃ ভাবতে হয় রে, ভাবতে হয়’।
‘তা বটে’।
‘এই যে এত্তো বড়ো পুকুরটা। তার পাড়ে এত রকমের গাছপালা, ঝোপঝাড়, লতাপাতা। গাছে গাছে পাখি, পুকুরে মাছ, মাটির পোকামাকড়, কেঁচো। এর বাইরে আর কী থাকবে হে, আর কী থাকতে পারে?’
‘এটা আবার একটা পুকুর নাকি? ডোবাও নয়। খাল বলা চলে। বর্ষা বলে, একটু জল জমেছে, বর্ষার একমাস পরেই জল শুকিয়ে কাদা, তাতে মাগুর আর পাঁকাল থাকে। আহা সে সব বড়ো ভালো খেতে। তারপর গরমকালে মাটি শুকিয়ে ফেটে চৌচির। ঢোলকলমির ঝোপে ভরে ওঠে, তার ডালে হেলে সাপ জড়িয়ে থাকে’।
‘ওই সাপগুলোর কথা আর বলিস না। খুব বজ্জাত হয়। আমাদের দেখলেই সিমসিম করে এগিয়ে আসে, আর খপ করে ধরে খেয়ে ফেলে, এত বদমাস’।
‘বারে, তোরা যে খাস? ফড়িং ধরে, পোকামাকড় ধরে’?
‘তার মানে? ফড়িং খাওয়া আর আমাদের ধরে খাওয়া এক হল? আমাদের একটা সম্মান নেই? আমাদের মতো উঁচু জাতের প্রাণীকে খেয়ে ফেলা মোটেই উচিৎ নয়। আমরা চিন্তাশীল। আমরা গান গাই। আমাদের কত নাম আছে জানিস’।
‘তোরা তো ব্যাং, তোদের আবার নাম কী?’
‘ওই তো রে, মুখ্যু। ডানা নাড়িয়ে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানোর খুব বড়াই করলি একটু আগে। অথচ এই জগতের কিছুই জানলি না। শোন, আমাদের ব্যাং বলে। কেন বলে জানিস? এই ব্রহ্মাণ্ড তৈরির সময় মহাকাশে একটা বিগ ব্যাং হয়েছিল। সেই বিগব্যাং থেকেই আমাদের উৎপত্তি। তাছাড়া আমাদের ভেক বলে। মণ্ডূক বলে, দাদুরি বলে, দর্দূর বলে। হিন্দিতে মেডক বলে। জানিস?’
‘বাবা, তোদের এত নাম?’
‘আমাদের ছানাদেরও আলাদা নাম আছে, ব্যাঙাচি। তোদের এমন আছে? তোদের বাচ্চাদের বলে কাগের ছা, বগের ছা। কিংবা সাপের বাচ্চা, বেড়ালছানা, কুকুরছানা। কিন্তু আমাদের মতো আলাদা নাম কোনদিন শুনেছিস? শুনিসনি আর শুনবিও না! আমাদের মতো একমাত্র মানুষেরই অনেক রকম নাম হয়। সায়েব হয়, নিগার হয়। হিন্দু হয়, মুসলমান হয়। বামুন হয়, বাগদি হয়। বড়োলোক হয়, ছোটলোক হয়। বাঙালি হয়, বিহারি, তামিল, তেলেগু হয়। বিজেপি হয়, টিএমসি, আপ, বসপা হয়। সে অনেক অনেক নাম’।
‘হে হে কী যে বলিস, তার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝি না। মানুষ আর তোরা সমান হলি?’
‘সমান নয়, সমান নয়, সমান কখন বললাম? মানুষ কখনো ব্যাঙের মতো হতে পারবে? ভুলেও সে কথা ভাবিস না। আমরা এক জায়গাতেই থাকি, তিনচারমাস ভরপেট খাই, সাত-আট মাস ঘুমোই, নানা চিন্তা ভাবনা করি! আর মানুষ? এই এদেশ যাচ্ছে, ওই বিদেশ যাচ্ছে। শুনেছি চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গলে যাচ্ছে! কিন্তু ভাবনা চিন্তার বেলায় লবডংকা! আচ্ছা, ব্যাং কোনদিন ব্যাং খাচ্ছে দেখেছিস? বা শুনেছিস?’
‘না, তা শুনিও নি, দেখিও নি। কিন্তু তাতে কী? সে তো আমরাও আমাদের খাই না’।
‘তোদের কথা ছাড়। তোদের কথা আসছে কোত্থেকে? সে কথা নয়। কথাটা হচ্ছে, মানুষ কিন্তু মানুষকে খায়’।
‘যাঃ। এরকম কোনদিন শুনিনি। দেখিওনি। এটা আবার একটা বাজে কথা বলছিস’।
‘ঠিক কথা। আমিও কোনদিন মানুষ মানুষকে খাচ্ছে, নিজের চোখে দেখিনি। কিন্তু মানুষ বিস্তর মানুষকে মেরে ফেলছে, সেটা তো দেখেছি! এই খালেই তো দেখেছি। রাস্তার ধারের এই খালের জলে, ঝোপে ঝাড়ে কম মড়া মানুষ দেখেছি? বল না। সেই মরা মানুষকে আবার একদল জ্যান্ত মানুষ এসে তুলে নিয়ে যায়, সেও দেখেছি’।
‘হুঁ, সে তো আমিও দেখেছি’।
‘তোর ওই দেখাই সার, তারপরে ভাবনা চিন্তা করেছিস কী? করিসনি। একদল মানুষ যে মড়াটাকে তুলে নিয়ে যায়, কী করে নিয়ে গিয়ে? তুই বলতে চাস খায় না? আমি চিন্তা করে দেখেছি, খায়। নিশ্চয়ই খায়। তা নাহলে আর কী করে?’
‘হুঁ। এবার থেকে তোর মতো ভাবনা চিন্তা করবো ভাবছি’।
‘হে হে। এবার তোর মোটা মাথায় ঢুকেছে, কথাগুলো। ভাব, ভাব। ভাবনা ছাড়া মাথার আর কাজ কি?’
‘ভাবনা ছাড়া, মাথার আর কোন কাজ নেই বলছিস? এই যেমন ধর এখন আমার পেট বলছে, খিদে পেয়েছে। মাথা বলছে, সামনেই তো খাবার, খেয়ে ফেল!’
‘সামনেই খাবার, খেয়ে ফেল, মানে? অ্যাই, অ্যাই আর এগোবি না! খুব খারাপ হয়ে যাবে, খুব খা...’।
‘বাঃ রে, বিগব্যাং! অনেকটা মাংস আর খেতেও বেশ। পেটটা ভরে গেল। বিকেল অব্দি আরামসে চলে যাবে। ওফ, সেই থেকে বকবক করে মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছিল!’
সাদা দুই ডানা মেলে বকটা মাঠের দিকে উড়ে গেল।
..০০..
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।