কুশীলব
(মঞ্চে প্রবেশের ক্রম অনুসারে)
প্রাণপণবাবু কমলা – প্রাণপণবাবুর স্ত্রী প্রতাপ – প্রাণপণবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট
মাছওয়ালা মানসভূষণ খুশি – প্রাণপণবাবুর কন্যা আনন্দ – প্রাণপণবাবুর পুত্র।
প্রথম অঙ্ক
দৃশ্য ১
[প্রাণপণবাবুর বসার ঘর। দুটো দরজা। বাঁদিকের দরজা বাইরে যাওয়ার, ডানদিকের দরজা বাড়ির ভেতরে যাওয়ার। মাঝখানে সোফায় বসে প্রাণপণবাবু খবরের কাগজ পড়ছেন। সামনের দেওয়ালে বড়ো ঘড়ি, সময় সকাল নটা। খবরের কাগজের থেকে চোখ তুলে বার বার ঘড়ি দেখছেন।]
প্রাণপণঃ হ্যাঁগো শুনছো, আরেক কাপ চা দেবে নাকি? হতভাগা ছোঁড়াটা আর আসবে বলে মনে হয় না।
[একটু পরে প্রাণপণবাবুর স্ত্রী, কমলা প্লেটে চায়ের কাপ আর বিস্কুট নিয়ে ঢুকলেন।]
কমলাঃ সকাল সকাল কাকে আবার গাল দিতে বসলে?
[চায়ের প্লেটটা হাতে নিয়ে]
প্রাণপণঃ আরে, ওই প্রতাপের কথা বলছি। জরুরি কাজ বলে বাড়ি গেল, বারবার করে বললে, শনিবার সন্ধেয় সিওর ফিরবো, স্যার। এখন দেখ, ব্যাটার টিকির দেখা নেই।
কমলাঃ হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে। তা তোমার কী প্রতাপ ছাড়া দিন চলবে না? সব কাজ বন্ধ?
প্রাণপণঃ প্রাণপণ সমাদ্দার ওসব প্রতাপ–ট্রোতাপ কারো তোয়াক্কা করে না, বুঝেছ?
কমলাঃ সে তো বিয়ের পর থেকেই বুঝছি।
প্রাণপণঃ দুঁদে উকিল হিসেবে আজ এই তল্লাটে আমার যে নাম-ডাক, প্রভাব-প্রতিপত্তি সে আমি নিজের পরিশ্রম, অধ্যবসায়..
কমলাঃ (ঠাট্টার গলায়) আহা, গলাটা শুকিয়ে এলো গো, শুধু চায়ে হবে, একটু জল এনে দিই?
প্রাণপণঃ বাজে কথা ছাড়ো...ইয়ে আরো কী যেন বলেছিল সেই ছেলেটা...হ্যাঁ মনে পড়েছে...সাধনা, একাগ্রতা...এটসেটরা এটসেটরা দিয়ে অর্জন করেছি।
কমলাঃ কে আবার তোমার সম্বন্ধে এসব আবোল তাবোল বকতে গেল, শুনি?
প্রাণপণঃ আবোল তাবোল? বললেই হল? আরে, তোমরাও তো ছিলে সেই ফাংসানে। মনে নেই? মদনতলা বিন্দুবাসিনী দেবী বুনিয়াদি উচ্চ বিদ্যালয়ে আমাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিল?
কমলাঃ ওঃ সেই সম্বর্ধনা?
প্রাণপণঃ হুঁ হুঁ...বেড়ে বলেছিল ছেলেটা। মনে হয় ক্লাস টুয়েলভে পড়ত..।
কমলাঃ কোথাকার কোন ডেঁপো, ফাজিল ছেলে কী উস্তুম-ফুস্তুম বললে, আর তুমি একেবারে গলে গেলে?
প্রাণপণঃ ডেঁপো ছেলে? ফাজিল ছেলে? কিছুই না জেনে, ফট করে একটা ছেলের সম্বন্ধে এমন বলতে তোমার মুখে আটকালো না?
কমলাঃ অত জানি না বাপু, আর আমার জেনে কাজও নেই। যা জানি তাতেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি।
প্রাণপণঃ পরের ছেলের সম্বন্ধে এমন আলটপকা মন্তব্য – আইপিসির...
কমলাঃ শোনো, আজ তাহলে ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ করছি।
প্রাণপণঃ কেন? কেন? এমন দুর্গতি কেন?
কমলাঃ ওই কটা ছাড়া, ঘরে সব কিছুই বাড়ন্ত। তা ভালই হবে, আমারও হাড় জুড়োবে। রোজই হেঁসেল ঠেলে ঠেলে হাড়ে আমার দুব্বো গজিয়ে উঠল!
প্রাণপণঃ তার মানে? ফাঁকি মারবে?
কমলাঃ তা কেন? বসে বসে তোমার আইপিসিমার গল্প আর আইনের ধারাপাত শুনব।
প্রাণপণঃ মাই ঘড, আইপিসি মানে ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড, পিসি নয়...(হঠাৎ যেন খেয়াল করে)...তুমি কী ঠাট্টা করলে?
কমলাঃ ঠাট্টা? আমি করলাম? কখন? না তো! পিসি মানে পিসিমা, এই তো জেনে এসেছি আজন্ম।
প্রাণপণঃ বুঝেছি, তুমি ঠাট্টা করছো।
কমলাঃ সেই ভালো, তুমি বসে বসে ভাবো, এটা ঠাট্টা নাকি বিদ্রূপ! প্রতাপ না এলে তো আর বাজার হবে না!
প্রাণপণঃ আজ রোববারের দিনে, প্রতাপ নেই বলে খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে?
কমলাঃ কেন? পিসিমা খাওয়াবে না?
প্রাণপণঃ (নিজের মনে) প্রতাপটা বেশ কাজের ছেলে, সেটা তো মানবে? ও আমার পিছনে থাকলে সুবিধে হয় খুব।
কমলাঃ তোমার পেছনে লেজ তো রয়েছে, আবার প্রতাপকেও চাই?
প্রাণপণঃ (স্ত্রীর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে) ছোঁড়াটা কচি আর টাটকা আনাজ চেনে। তাজা মাছের কদর জানে। চাঙ্গা চিকেনের চোখ চেনে। দরদস্তুর করে, সুলুকসন্ধান জেনে, ফিকে রঙ গাঢ় রঙ সব দিক বিচার করে, বাজারটা বেশ ভালই করে।
কমলাঃ (মুখ টিপে হাসি) খুঁকখুঁক।
প্রাণপণঃ হতভাগাটা এল নাঃ। (হঠাৎ চেগে উঠে) তাই বলে উপোস করে থাকবো নাকি? প্রতাপের জন্যে আমার কাজ আটকে যাবে? কী ভাবো কী আমাকে?
কমলাঃ যাক বাবা, তাও ভালো যে, শেষমেষ তোমার প্রতাপ বেরিয়েছে!
প্রাণপণঃ কই? কোথায়? প্রতাপ এসেছে?
কমলাঃ না রে বাবা, বলছি, তোমার নিজের প্রতাপ প্রকাশ পেয়েছে – ঘটে একটু বুদ্ধি যদি থাকে।
প্রাণপণঃ কী? আমার ঘটে বুদ্ধি নেই? কী পেয়েছো কী তুমি আমাকে? আমার পার্সটা আর থলিগুলো দাও আমি নিজেই বাজার করে নিয়ে আসবো।
কমলাঃ তাই যাও। শুনলাম ভালো ইলিশ উঠছে বাজারে। দেখো তো পাও কী না। সেদিন কী ছাই ইলিশ এনেছিলে, মনে হল সেদ্ধ পেঁপে খাচ্ছি।
প্রাণপণঃ ক্কীঃ! নশো টাকা দরের ইলিশ তোমার পেঁপে সেদ্ধ মনে হচ্ছে? খাস কোলাঘাটের ইলিশ ছিল!
কমলাঃ কোলাঘাটের ইলিশ না ছাই! অখাদ্য। কোলাঘাটের কোলাব্যাঙও ওর থেকে টেস্টি হয়।
প্রাণপণঃ অ তোমার বুঝি বাপের বাড়িতে কোলাঘাটের ব্যাঙ খাওয়ার অভ্যেস ছিল?
কমলাঃ অ্যাই, সকাল সকাল আমার বাপের বাড়ি তুলবে না?
প্রাণপণঃ আচ্ছা, বেশ সকাল সকাল না তুলে, একটু বেলায় তুলবো, কিংবা বিকেলে। কিন্তু কোলাব্যাঙ তুমি কোথায় খেলে সেটা তো বললে না!
কমলাঃ কোলাব্যাঙ আর খাই কী করে? কোলাব্যাঙের সঙ্গে ঘর করলে কী আর খাওয়া যায়?
প্রাণপণঃ কী? আমি কোলাব্যাঙ? সকাল সকাল তুমি আমাকে যা নয় তা বলবে?
কমলাঃ আচ্ছা, বাবা বেশ, সকাল সকাল বলবো না, একটু বেলায় কিংবা বিকেলে বলবো। [প্রস্থান]
প্রাণপণঃ [খুব রেগে] আমার কথা নিয়ে আমাকেই খোঁচা দেওয়া? আমিও ছেড়ে দেব না, মনে রেখো। কী ভেবেছো কি তুমি? আমি সব মেনে নিই বলে, যা খুশি তাই বলে যাবে? আমি এর একটা বিহিত করে তবেই ছাড়বো।
[তিনটে থলি আর পার্স হাতে স্ত্রীর প্রবেশ, প্রাণপণবাবুর হাতে থলি আর পার্স দিয়ে]
কমলাঃ ফেরার সময় ধনে পাতা আর লংকা আনতে ভুলো না।
প্রাণপণঃ [রাগটা এখনো কমেনি] ভুলবো না, আমি কিছুই ভুলি না। যা যা বললে সব আমি শোধ তুলবো।
কমলাঃ [নির্বিকার গলায়] গন্ধরাজ লেবু পেলে কটা নিও তো, ছেলে মেয়ে খুব পছন্দ করে।
প্রাণপণঃ [ব্যাগ হাতে দরজার দিকে যেতে যেতে] আমার কোন কিছুই যে তোমার পছন্দ নয় সে কী আর আমি বুঝি না? যেদিন চোখ বুজবো সেদিন টের পাবে।
কমলাঃ আচ্ছা সে দেখা যাবে! কিন্তু যে যা দিল চোখ বুজে থলেতে ভরে নিও না, কী দিচ্ছে দেখে নিও। বোকা পেয়ে তোমার মাথায় সবাই হাত বুলোয়।
প্রাণপণঃ [রেগে] আমি বোকা? আমার মাথায় লোকে হাত বুলোয়?
কমলাঃ বলি, বাজার না হলে রান্না হবে? বেলা চারটেয় ভাত দিলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না, এই বলে দিলাম।
প্রাণপণঃ ঠিক আছে এখন বেরোচ্ছি, ফিরে এসে প্রত্যেকটা কথার জবাব আমি দেব। [প্রস্থান]
কমলাঃ দিও। আমি কান পেতে শুনবো। কিছু বলবো না। [সদর দরজা বন্ধ করলেন। ]
দৃশ্য ২
[প্রাণপণবাবুর স্ত্রী মঞ্চ পার হয়ে উল্টোদিকে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলেন, দরজায় বেল বাজল, থমকে দাঁড়ালেন।]
কমলাঃ ওঃ আবার! নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুলেছে! চশমা নয়তো মোবাইল। একটা কাজ যদি ঠিকঠাক করতে পারে। [দরজা খুলতে খুলতে] কী হল কি আবার, ফিরে এলে কেন? আমি কী সারা সকাল দরজা বন্ধ আর খোলা...ও মা তুমি? [প্রতাপের প্রবেশ]
প্রতাপঃ হ্যাঁ কাকিমা, কাকু কী বাজারে বেরিয়ে গেছেন?
কমলাঃ হ্যাঁ এই মাত্র বেরোলেন। তুমি এখন এলে? কাকু তোমাকে খুব খুঁজছিল। গালাগালও দিচ্ছিল।
প্রতাপঃ অ্যাঁ, গালাগাল?
কমলাঃ হ্যাঁ।
প্রতাপঃ জানতাম, এরকম কিছু একটা হবে। চাকরিটা আমার গেল, কাকিমা।
কমলাঃ কেন? চাকরি যাবে কেন?
প্রতাপঃ ওই যে বললেন গালাগাল, তার মানে স্যার রেগে আছেন আমার ওপর...
কমলাঃ তা তো আছেন।
প্রতাপঃ কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কোন দোষ নেই...
কমলাঃ তার আমি কী জানি, বাপু। তুমি গতকাল ফিরবে বলে ছুটি নিলে, ফিরছো আজকে এখন!
প্রতাপঃ না কাকিমা, আমি কালই এসেছি...কিন্তু...
কমলাঃ সেকি? কালকে এসেছো? তাহলে ছিলে কোথায়, সারারাত?
প্রতাপঃ আজ্ঞে সে কথাই তো বলছি। ছিলাম ভূষিদার বাড়ি।
কমলাঃ ভূষি? ভূষির বাড়ি কেন? সে তোমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেছিল?
প্রতাপঃ হ্যাঁ। কাল তখন আমি ট্রেনে, ভূষিদা ফোন করলেন। বললেন, আমি স্টেশনে টিকেট কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করছি, নেমেই আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
কমলাঃ কেন?
প্রতাপঃ তা কিছু বললেন না। ফোনটা কেটে দিলেন।
কমলাঃ তারপর?
প্রতাপঃ স্টেশনে নামলাম, দেখলাম ভূষিদা দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন, খুব জরুরি ব্যাপার। ওঁনাদের বাড়ি যেতে হবে।
কমলাঃ কেন?
প্রতাপঃ তা কিছু বললেন না। ফোনটা কেটে দিলেন। ইয়ে না, মানে...আমাকে ওঁনার বাইকের পেছনে বসিয়ে নিলেন।
কমলাঃ আর তুমিও বসে পড়লে? তারপর?
প্রতাপঃ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে, ভূষিদার বাবার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।
কমলাঃ তাই? তারপর?
প্রতাপঃ খুব খাওয়ালেন। লুচি আলুর দম, রসগোল্লা। মাসিমা বললেন, সেই কোন সকালে বেরিয়েছো, মুখটা শুকিয়ে গেছে।
কমলাঃ আচ্ছা? আমরা বুঝি তোমাকে খেতে দিই না?
প্রতাপঃ ইসসস্, ছি ছি, সে কথা বলিনি। ওই বলছিলাম আর কি। লুচিগুলো মোটেই ভাল নয়, কাঁচা তেলের গন্ধ।
কমলাঃ তাই? আর আলুর দম?
প্রতাপঃ ছ্যা, ছ্যা নুনে পোড়া, মুখে তোলা যাচ্ছিল না।
কমলাঃ আর রসগোল্লা?
প্রতাপঃ এক বিন্দু রস নেই কাকিমা, খেয়ে মনে হল তুলোর গোলা খাচ্ছি। আপনার মতো যত্ন কেউ করে না, কাকিমা।
কমলাঃ আচ্ছা? দেখা হলে ভূষির মাকে আমি আচ্ছা করে দুকথা শুনিয়ে দেবো, দেখো।
প্রতাপঃ অ্যাঁ!
কমলাঃ হ্যাঁ, আমাদের আদরের প্রতাপের সঙ্গে এমন ব্যাভার?
প্রতাপঃ না, না, সেকী? আপনি আবার এসবের মধ্যে জড়াবেন কেন? ভূষিদা কী ভাববেন!
কমলাঃ তা কিসের জন্যে ডেকেছিল সেটা তো বললে না!
প্রতাপঃ মেসোমশাইয়ের অনেক মাছের ভেড়ি আছে, জানেন তো? সেই ভেড়ি নিয়ে কিছু আইনি জটিলতা...
কমলাঃ তোমার সঙ্গে আইনি পরামর্শ?
প্রতাপঃ আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই বলছিলেন।
কমলাঃ বলো কী? তুমি এখন আইনি পরামর্শও দিতে শুরু করে দিয়েছো?
প্রতাপঃ হ্যাঁ...(হঠাৎ খেয়াল হতে) না না কাকিমা, আমি আইনের কী বুঝি? আমি কোন পরামর্শ দেব?
কমলাঃ উঁহুঃ...ব্যাপারটা তোমার কাকুকে জানাতে হবে, তোমাকে উনি এত বিশ্বাস করেন, আর তুমি কী না তাঁর মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিচ্ছো?
প্রতাপঃ কাকিমা এ আপনি কী বলছেন, আমি কাকুর মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নিচ্ছি?!
কমলাঃ এই শহরে সবাই জানে তোমার কাকু নাম করা উকিল, তুমি তার অ্যাসিস্টান্ট।
প্রতাপঃ সে তো বটেই!
কমলাঃ কাজেই অনেকেই এবার তোমার থেকে আইনি পরামর্শ নেবে! কারণ কেউ ডাকলেই তুমি বাইকের পেছনে চেপে পড়বে, আর আলুর দম দিয়ে লুচি খেতে খেতে আইনি পরামর্শ দেবে!
প্রতাপঃ (খুব ভয় পেয়ে ) কাকিমা, আমি যদি জানতাম তাহলে আমি যেতামই না, বিশ্বাস করুন। আমি বাংলার এমএ। আইনের আমি কী জানি? আমার বাপ ঠাকুর্দারা কেউ আইনের ছায়া মাড়াননি।
কমলাঃ ঠিক আছে, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম। কিন্তু কিসের পরামর্শ নিলেন?
প্রতাপঃ তাও ঠিক জানি না, আমাকে ওপরের একটা ঘরে বসিয়ে রেখে ভূষিদার বাবা বললেন, দাঁড়াও দলিলটা নিয়ে এসে দেখাই। কোথায় যে রাখলাম দলিলটা।
কমলাঃ তারপর?
প্রতাপঃ ভূষিদাও বললেন, আপনি কিন্তু যাবেন না, ভেড়িটা নিয়ে বাবা ভীষণ অখুশি আছেন। প্লিজ কিছু একটা উপায় বের করে দিন। বাবা খুশি পেলে আমরা সবাই খুব আনন্দ পাবো!
কমলাঃ অখুশি...খুশি...আনন্দ...এই সব বলল ভূষি? তারপর?
প্রতাপঃ বসেই রইলাম, বসেই রইলাম, আটটা বাজল, নটা বাজল। আমি মাসিমাকে বললাম, আমি আজ আসছি মাসিমা, কাল আবার না হয় আসবো!
কমলাঃ শুনে মাসিমা– যিনি কাঁচা লুচি খাইয়েছিলেন, কী বললেন?
প্রতাপঃ ঠিক কাঁচা নয় কাকিমা, তবে মানে ওই আর কী...
কমলাঃ লুচি এখন থাক, ভূষির মা কী বললেন?
প্রতাপঃ মাসিমা বললেন, “অমন কাজও করো না, বাবা প্রতাপ। ভূষির বাবাকে দেখছো তো কী রকম মন খারাপ করে রয়েছেন? ওঁনাকে খুশি করা এখন তোমার হাতে। তাহলেই আমরা সবাই খুশি এবং আনন্দ পাবো”।
কমলাঃ (আনন্দে) প্রতিমাদিদি...এমন বললেন? (আনন্দ সামলে কিছুটা গম্ভীর হয়ে) ইয়ে...মানে, ভূষির মা এমন বললেন? উনিই তোমাকে শুকনো তুলোর গোলা গিলিয়েছিলেন না?
প্রতাপঃ (কাঁদোকাঁদো) না না কাকিমা তুলোর গোলা নয়, রসগোল্লাই...তবে ওই একটু ইয়ে আর কি!
কমলাঃ সে আমি পরে বুঝে নেব, কিন্তু ভূষির মা যেমনি বললেন, তুমিও অমনি মেনে নিলে?
প্রতাপঃ (অকারণ জোরের সঙ্গে) মোটেই না, আমি তীব্র প্রতিবাদ করলাম, বললাম, এরপর গেলে স্যার খুব রেগে যাবেন, আমাকে ফিরতেই হবে।
কমলাঃ আচ্ছা? তারপর কী হল?
প্রতাপঃ ভূষিদা এসে বললেন, “বাবা ভেড়ির দলিলটা পাগলের মতো খুঁজছেন, নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন, আজকের রাতটা আপনি এখানেই থেকে যান প্রতাপবাবু, কোন অসুবিধে হবে না। কাল ভোরে আমি আপনাকে বাইকে করে পৌঁছে দেবো”।
কমলাঃ ইস্, আবার সেই কাঁচা লুচি আর নুনে পোড়া আলুর দমের লোভে রাত্রে থেকে গেলে?
প্রতাপঃ না কাকিমা, রাত্রে পাঁঠার মাংস আর পরোটা...সঙ্গে রাবড়ি...
কমলাঃ পরোটা কাঁচা না পাকা? মাংস নুনে পোড়া নাকি ঝামা?
প্রতাপঃ না মানে ইয়ে খারাপ নয়... ওই আর কি...,ভালোই।
কমলাঃ বাঃ বেশ, তারপর? সারা রাত্রেও ভেড়ির দলিল তো পাওয়া গেল না...
প্রতাপঃ ঠিক তাই, আপনি কী করে জানলেন?
কমলাঃ দলিল কোনদিন ছিলই না তো ভূষির বাবা পাবেন কোত্থেকে? সে যাক আজ ভোরে ফিরলে না কেন?
প্রতাপঃ ভোর বেলা কোথায়? কেউ ডেকে দেয়নি, আমার ঘুম ভাঙল যখন তখন সাড়ে সাতটা! মুখ হাত ধুয়ে ভূষিদাকে ডাকলাম।
কমলাঃ ভুষিও তোমার মতো ঘুমোচ্ছিল?
প্রতাপঃ আজ্ঞে না, ওঁনারা বাইরের বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন আর চা খাচ্ছিলেন।
কমলাঃ ওঁনারা মানে? ভূষির মা, বাবাও?
প্রতাপঃ আজ্ঞে হ্যাঁ।
কমলাঃ চিন্তা করো প্রতাপ, তুমি কী রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন। তুমি ঘুমোচ্ছো বলে, ওঁনারা সংকোচ করে তোমার ঘুম ভাঙাননি! আর তুমি বেলা আটটা অব্দি ভোঁসভোঁসিয়ে দিব্বি ঘুমোলে?
প্রতাপঃ কাকিমা, আটটা নয় সাড়ে সাতটা।
কমলাঃ তারপর? ভূষির বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি বাইকে এলে মিনিট পনের লাগে। তুমি দশটা বাজিয়ে ঢুকলে কেন?
প্রতাপঃ চা-টা খেয়ে আমাকে নিয়ে ভূষিদা বাইক নিয়ে বের হলেন। এদিকে না এসে উলটো দিকে বাইক চালিয়ে দিলেন।
কমলাঃ কোথায়? কেন?
প্রতাপঃ জিগ্যেস করলাম। ভূষিদা বললেন “মিনিট পনের লাগবে, আপনাকে সেই ভেড়িটা একবার দেখিয়েই ফিরে আসবো”।
কমলাঃ কোন ভেড়িটা, যার কোন দলিল নেই। কিন্তু সারা রাত ওরা খুঁজে বেড়িয়েছে!
প্রতাপঃ আজ্ঞে হ্যাঁ।
কমলাঃ তা তুমি নেমে ফিরে এলে না, কেন?
প্রতাপঃ আজ্ঞে, ভূষিদা যা স্পিডে চালাচ্ছিলেন, নামতে গেলে, আমার কোনদিনই আর ফেরা হত না।
কমলাঃ আহারে, বালাই ষাট। তারপর?
প্রতাপঃ শহর ছেড়ে ভূষিদা প্রায় আধঘন্টা মেঠো পথে বাইক চালিয়ে একটা ভেড়ির ধারে গিয়ে থামলেন। সেখানে ছোট্ট একটা খোড়ো চালায় আমরা বসলাম। ভেড়ির লোকজন এসে ভূষিদার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগল। কত পোনা ছাড়া হয়েছে, কত মীন ছাড়া হবে। কোন মাছ। কত মাছ। কী রকম মাছ। মাছের খাবার...মাছের বাড়, মাছের হাড়...ওফ্ টু মাচ।
কমলাঃ হয়েছে হয়েছে, পুরো ব্যাপারটাই ফিশি, তারপর?
প্রতাপঃ ঠিক বলেছেন, কাকিমা। পুরো ব্যাপারটাই আমার মনে হল সাজানো ষড়যন্ত্র। স্যার আমার ওপর রেগে গিয়ে আমাকে বরখাস্ত করবেন, আর তখনই সে চাকরিটা...
কমলাঃ ভূষি এসে হাতাবে...ঠিক ধরেছে তুমি... হা হাহাহাহাহা...
প্রতাপঃ (কমলার হাসিতে খুব অপ্রস্তুত) আমি এখন তাহলে আসি কাকিমা?
কমলাঃ কোথায় যাবে?
প্রতাপঃ বাজারে যাই, স্যারের একটু হেল্প হবে।
কমলাঃ খবর্দার, বাজারের দিকে পা বাড়িয়েছো কী তোমার ঠ্যাং ভেঙে ফেলে রাখবো। সোজা নিজের ঘরে যাও, চুপ করে শুয়ে থাক। আমি না ডাকা পর্যন্ত ঘরের বের হয়েছো কী তোমার চাকরি নট...এই বলে দিলাম।
প্রতাপঃ (অবাক) ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকবো?
কমলাঃ তুমি তো বাংলার এমএ। এই কথাটা বুঝতেও চলন্তিকা লাগবে নাকি?
প্রতাপঃ না মানে...ইয়ে... তাই যাই...বলছেন যখন...(ধীর পায়ে ভেতরের দিকে প্রস্থান)
কমলাঃ (প্রতাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর) ভূষির মতো এমন করিতকর্মা ছেলে আমি আর দুটো পাবো না...(ভীষণ আনন্দে)...জয় মা জয় মা...মুখে তুলে চেও মা...। [প্রতাপের আবার প্রবেশ] কী হল? ফিরে এলে যে?
প্রতাপঃ কাকিমা, মানে বলছিলাম কি, এখনো বাজারে গিয়ে যদি স্যারকে ধরতে পারি...
কমলাঃ তাতে কী হবে?
প্রতাপঃ তাহলে আমরা চাকরিটা হয়তো টিকে যাবে...
কমলাঃ (রেগে) আর তুমি যদি এখনই নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম না নাও, তোমার চাকরি কী করে টেকে আমি দেখবো! [প্রতাপের দৌড়ে ভেতরে প্রস্থান] হা হাহাহা, বোকা ছেলে...
[ভেতরে প্রস্থান]
[পর্দা নেমে এল।]
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[পর্দার বাইরেই, মঞ্চের সামনে এক প্রান্তে মাছওলা একটু উঁচুতে বসে, সামনের ঝাঁকায় ইলিশের স্তূপ (কার্ডবোর্ডের মাছ -রাংতায় মোড়া চকচকে)। পাশে দাঁড়িপাল্লা। তার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণপণবাবু।]
প্রাণপণঃ ইলিশগুলো তো ভালোই মনে হচ্ছে! গায়ে এলইডি আলোর মতো রূপোলি ঝলক। দেখে যা মনে হচ্ছে ওজন সাড়ে আটশো, নশোর বেশি বই কম নয়। [প্রকাশ্যে] ইলিশ কত করে যাচ্ছে, হে?
মাছওয়ালাঃ সকালে পনেরশ ছিল, এখন চোদ্দোশোয় দেব কাকু...
প্রাণপণঃ যা দর বলছে, খুব একটা বেশি কী? ভালো জিনিষের জন্যে প্রাণপণ পেছপা হয় না। আর ও কটা টাকা প্রাণপণের ঘন্টা খানেকের রোজগার। কথাটা তা নয়, আসলে এসময় প্রতাপটা থাকলে, একটু শলাপরামর্শ করা যেত...। [প্রকাশ্যে] দামটা বড় বেশি বলছো হে। মাছও তেমন সরেশ নয়।
মাছওয়ালাঃ আজ ভোরের জালে-পড়া মাছ স্যার। খাস কোলাঘাটের। মাছ একেবারে গ্রান্টি, স্যার। মদনতলায় এই মাছ কেনার লোক কজন আছে স্যার? আপনাদের মতো কজন, হাতে গোনা। ষোলোশয় কিনেচি, পনেরশয় বেচছিলাম, আপনার জন্যে আরো একশ লেস।
প্রাণপণঃ হ্যাঃ, বললেই হল, তুমি লসে মাছ বেচছো? [মানসের প্রবেশ, প্রাণপণবাবুর পাশে দাঁড়াল]
মানসঃ স্যার, ইলিশ নিচ্ছেন নাকি? [প্রাণপণ ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ানো ছোকরার দিকে তাকালেন, ছোকরা মৃদুহেসে, মাথা ঝাঁকাল] কোয়ালিটি মন্দ নয়। কোলাঘাটের টাটকা ফসল। তবে দরটা একটু বেশিই। যদি নেবেন বলে মনস্থির করে ফেলেন, তা হলে আমি একটু দরদাম করে দেখতে পারি।
প্রাণপণঃ আপনি আমাকে চেনেন নাকি?
মানসঃ বিলক্ষণ। মদনতলায় আপনাকে চেনে না, এমন কাকপক্ষীও এ তল্লাটে আছে বলে আমার মনে হয় না। আর আমার মতো সামান্য এক ফচকে ছোঁড়াকে আপনার মতো মানুষের আপনি-টাপনি বলাটাও কী উচিত হচ্ছে, স্যার?
প্রাণপণঃ কী করা হয়? নাম কী? তোমাকে তো চিনতে পারলাম না।
মানসঃ হেঁহেঁ। আমাকে না চেনাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে সে সব পরে হবে, স্যার। ইলিশ যদি পছন্দ হয়ে থাকে, চটপট তুলে নিন, স্যার। আজকাল মদনতলায় হাবিজাবি কাঁচা পয়সাওয়ালা লোকের আনাগোনা খুব বেড়েছে। আঙুল ফুলে কলাগাছ সে সব বারফট্টাই বাবুরা, আপনার মতো গণ্যিমান্যি লোকের সম্মান বুঝবে না। শেয়াল কি আর বাঘ-সিংহের বনেদিয়ানা বুঝবে, স্যার?’
প্রাণপণঃ মাছটা খারাপ নয়, নেওয়া চলতে পারে বলছো?
মানসঃ নিশ্চিন্তে নিতে পারেন, স্যর। তাহলে কথা বলি? [চারটে বড়ো বড়ো মাছ পাল্লায় তুলে দিয়ে, মাছওয়ালাকে] কত হয় দেখো তো হে।
প্রাণপণঃ আরে রে, করো কী হে! অত মাছ কে খাবে?
মানসঃ সামান্য একটু বেশি হবে, তা হোক। আপনার মতো ছোট্ট সুখী পরিবারে দুটো হলে টানাটানি হয়। তিনটে হলে ঠিক হয়, কিন্তু ওদিকে আবার তিনে শত্রু – মা-ঠাকুমার মুখে শুনেছি। কাজেই চারটে ঠিক হবে, স্যার। ভাজা, সরষে ঝাল, ভাপা, কালোজিরে ফোড়নের ঝোল। মাছের তেলটা দিয়ে গরমভাত মেখে...আঃ। আপনারা মাছের টক খান নাকি, স্যার? পুরোন তেঁতুল দিয়ে ইলিশের মুড়োর টকমিষ্টি অম্বল খেয়ে দেখবেন, স্যার। কুলকুচি করলেও মুখের স্বাদ যায় না, বেশ কিছুদিন লেগে থাকে।
প্রাণপণঃ সে ঠিক আছে, তাই বলে এত? না, না, দুটো নামাও।
মানসঃ ওইটি বলবেন না, স্যার! এই ইলিশ কি আপনি সারা বছর পাবেন? এ কি একঘেয়ে কাটাপোনা? সারা বছর একই দাম, একই স্বাদ? অনেকে জোড়া-জোড়া ইলিশে তেল-সিঁদুর লাগায়, নাকে নথ পরায়। বলে ইলিশ ঘরের লক্ষ্মী। [মাছওয়ালাকে] কত হল হে?
মাছওয়ালাঃ তিন কিলো সাড়ে তিনশো।
মানসঃ অ্যাঃ, আবার সাড়ে তিনশো! ওই তিন কিলোই ধরো। ছানি-কুচোনো না করে, বড় বড় পিস করবে, ভাই। মুড়োয় শাঁস রাখবে না। সুপুরি আর পৈতে ফেলে, তেলটেলগুলো ভাল করে পরিষ্কার করে দেবে। [প্রাণপণবাবুকে] একটু চা বলবো, স্যার? একটু তো সময় লাগবেই।
প্রাণপণঃ কিন্তু এ তো অনেক টাকা! আমি অত আনিনি তো!
মানসঃ দুশ্চিন্তা করছেন কেন স্যার? যা এনেছেন, তাতে আরামে হয়ে যাবে।
প্রাণপণঃ [খ্যাঁক করে উঠলেন] তার মানে? আমি কত এনেছি, তুমি কী করে জানলে হে? তোমাকে ভালো মনে করেছিলাম, তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব ছোকরা! শুধু মাছ কিনলেই হবে, বাকি আর বাজার নেই?
মানসঃ স্যার, স্যার স্যার, প্লিজ, প্লিজ উত্তেজিত হবেন না, স্যার। আপনার মতো মানুষের উত্তেজনা মানায় না।
প্রাণপণঃ এমন বেয়াক্কেলে কথা বললে, উত্তেজিত হবো না?
মানসঃ একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন স্যার। বাজারের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই পাঁচ নিয়ে এসেছেন, আনেননি?
প্রাণপণঃ তা...ইয়ে হয়তো...হয়ে যাবে...।
মানসঃ তা ছাড়াও মানিব্যাগ ঘাঁটলে পাঁচ-সাতশ কী আর হবে না?
প্রাণপণঃ তা...মানে... কিন্তু...
মানসঃ মাছের জন্যে তিন দিলে দুই থাকবে। দুই দিয়ে আপনার বাকি বাজার হবে না, স্যার?
প্রাণপণঃ দুই দিয়ে বাকি বাজার?
মানসঃ মানছি, মাগ্যির বাজারে জিনিষপত্রের দাম বেড়েছে ঠিকই! কিন্তু এতটাও কী বেড়েছে স্যার?
(মাছওয়ালাকে) তেলগুলো পরিষ্কার করে আলাদা প্লাস্টিকে দেবে। ওগুলো দিয়ে পুঁইচচ্চড়ি যা হবে না, স্যার! ওই চা এসে গেছে স্যার, চিনি ছাড়া, লিকার চা।
প্রাণপণঃ এসবের দরকার ছিল না।
মানসঃ রোববারের বাজারটা এনজয় করুন স্যার, অযথা উত্তেজনায় শরীরকে বিপদে ফেলবেন না!
প্রাণপণঃ [চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে] সাড়ে চারের মাছ, তিনে রাজি হয়ে যাবে? কী বলছো হে? তুমি কী এখানকার দাদা, না তোলাবাজ?
মানসঃ না না স্যার, আমি সামান্য...
প্রাণপণঃ এ তল্লাটের সব দাদাদের আমি চিনি, কিন্তু তোমাকে তো নতুন চিনছি হে!
মানসঃ আমাকে তেমন কেউ চেনে না, স্যার।
প্রাণপণঃ উঁহুঁ। আমার কাছে কতটাকা আছে, চিনি ছাড়া চা খাই, এত খবরও রয়েছে তোমার কাছে। তোমার মতলব মোটেই সুবিধের ঠেকছে না।
মানসঃ মতলব? ছি ছি আপনি একটু খুশি হলে আমিও খুশি হবো, স্যার, সেইটুকুই যা মতলব।
প্রাণপণঃ ও সব কথায় ভুলছি না, আমিও কিন্তু খুব সুবিধের লোক নই, এ কথাটা মনে রেখো।
মানসঃ হে হে, বদ মতলব নিয়ে কোন লোক আপনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবে, এ আশা ঘুণাক্ষরেও করি না, স্যার। একবার দেখে নেবেন, পিসগুলো ছোট হচ্ছে না তো, স্যার? এর থেকে বড়ো করলে, মাছের ভেতরে তেল-নুন-মশলা ঢুকবে না। পানসে কাঁচা লাগবে। আবার ছোট করলেও খেয়ে ঠিক তৃপ্তি হয় না - তেলে পড়লেই যেন তেজপাতা - তখন কাঁটা বাছার খাটনিই সার হয়, স্যার!
প্রাণপণঃ [চা শেষ করে, ভাঁড়টা পচা আনাজের ডাব্বায় ছুঁড়ে ফেলে] সত্যিই, ছোঁড়া ইলিশ খাওয়ার তরিবত জানে। কিন্তু ওর মতলবটা কী, সেটা তো বুঝতে পারছি না! তবে মদনতলায় আমার হাত থেকে পার পেয়ে ব্যাটা যাবে কোথায়? বলি, আমি যে মদনতলায় একজন কেউকেটা সেটা তো আর মিথ্যে নয়। আর সেই দাপটেই যে এমন অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে, সেটাও তো সত্যি, নাকি? এরপর...মানে ইয়ে...আমার নামে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় বললেও নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি হবে না! [পার্স থেকে তিন হাজার টাকা গুনে বের করলেন] [মানসকে বললেন] দরদাম যা করার তুমিই করো হে, আমি আর ওসবের মধ্যে নেই।
মানসঃ [প্লাস্টিকের প্যাকেটে কাটা ইলিশ নিয়ে, প্রাণপণবাবুর মাছের ছোট থলিতে ভরতে ভরতে] ছি, ছি। এ আবার একটা কথা হল? আপনার সঙ্গে আবার দরদস্তুর কী? আপনি নিজে হাতেই টাকাটা দিন স্যার। আপনার মতো ব্যক্তির হাতে ঈপ্সিত জিনিষ তুলে দিতে পেরে, ও কী কম আনন্দ পাচ্ছে স্যার?
[প্রাণপণবাবু মাছওয়ালা ছোকরার হাতে টাকা দিয়ে একটু হাসলেন। ছোকরা টাকা কটা গুনলোও না বরং করজোড়ে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে এমন হাসল, কানদুটোও এঁটো করে ফেলল হতভাগা!]
প্রাণপণঃ এখন তো শীতের সময় নয়, তা তোমার এই ঈপ্শীত ব্যপারটা কি হে?
মানসঃ ঈপ্সিতের কথায় শীত মনে পড়ে গেল, স্যার? শীত নয় স্যার, অন্য কিছু। ঈপ্সিত মানে...যাকগে যাক, ছাড়ুন না স্যার। মুখ ফস্কে এক আধটা কথা অমন বেরিয়ে যায়। সব কথা কী স্যার অমন ধরতে আছে? তখন আমার নাম জিগ্যেস করছিলেন, আমার নাম মানসভূষণ দাস।
প্রাণপণঃ মানস? আচ্ছা?
মানসঃ লোকে ভালোবেসে ভুষি বলে। খুব খারাপ কিছু বলে না।
প্রাণপণঃ কিছু করা হয়, নাকি এমনি ফোপরদালালি করে বেড়ানো হয়?
মানসঃ ওই রকমই স্যার। কিছুদিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলাম। তারপরে আবার ম্যানেজমেন্ট...
প্রাণপণঃ বলো কী হে?
মানসঃ কোন মতে টেনেটুনে এই সবে শেষ করলাম, স্যার।
প্রাণপণঃ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, তার পর আবার ম্যানেজমেন্ট?
মানসঃ কপালটাও ভালো স্যার, পাশ করলাম, কী না করলাম, একটা চাকরিও পেয়ে গেলাম!
প্রাণপণঃ তোমায় দেখে তো বোঝার জো নেই?
মানসঃ সবই আপনার আশীর্বাদ, স্যার।
প্রাণপণঃ বাব্বাঃ। চাকরিতে জয়েন করোনি?
মানসঃ এখন কদিন ছুটি, ফাইন্যাল রেজাল্টটা বেরোলেই, নতুন চাকরিতে জয়েন। বিদেশ বিভুঁই কোথায় চলে যাবো স্যার, কবে আবার ফেরা হবে তাও জানি না। তাই বাড়ি এসে আপনাদের মতো সজ্জনের সেবা করে একটু আনন্দ পাওয়া, স্যার। মা কালীর দিব্বি স্যার, এ ছাড়া আর কোন বদ মতলব নেই।
প্রাণপণঃ ঠিক আছে, ঠিক আছে। কদিন রয়েছো তো? সময় করে একবার এসো না আমাদের বাড়ির দিকে। ভালো করে আলাপ করা যাবে।
মানসঃ আমাদের মতো উটকো ফোপরদালাল... না কী যেন বললেন স্যার...
প্রাণপণঃ আরেঃ ছোঃ, ওসব কথা মনে রাখতে হয় বুঝি?
মানসঃ ইয়ে বলছিলাম, অচেনা অজানা লোককে হুট করে বাড়ি নিয়ে যাবেন...কাকিমা রাগ করবেন হয়তো!
প্রাণপণঃ আরেঃ তখন অচেনা ছিলে, এখন তো আর নও।
মানসঃ পরে একদিন আসবো, স্যার। সব অরিজিন্যাল আর জেরক্স নিয়ে!
প্রাণপণঃ কিসের অরিজিন্যাল, কিসের জেরক্স?
মানসঃ আজ্ঞে আধার কার্ড, প্যান, ভোটার আইডি, ড্রাইভিং লাইসেন্স। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি, ম্যানেজমেন্টে...
প্রাণপণঃ ধুর পাগল, ও নিয়ে আমি কী করবো? আমি কী ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলবো নাকি, লোন দেব?
মানসঃ না মানে চেক করা ভালো, স্যার। দিন কাল ভালো নয় স্যার, সত্যি বললাম, না মিথ্যে, কে জানে?
প্রাণপণঃ সে যা জানার আমি জেনে নিয়েছি, মানস। তুমি আসছো। না এলে কিন্তু খুব রেগে যাবো।
মানসঃ এত করে বলছেন, নিশ্চয়ই যাবো স্যার।
প্রাণপণঃ গুড। কিন্তু যাবে কী করে?
মানসঃ কেন স্যার? হেঁটে। সাইকেলে কিংবা বাইকে?
প্রাণপণঃ আরে না, না। বলি আমার বাড়ি চিনবে কী করে?
মানসঃ ওহোঃ ওই নিয়ে আপনি ভাববেন না স্যার। মদনতলায় আপনার বাড়ি কাউকে চেনাতে হয় স্যার? আপনার বাড়ি চেনে না, এমন কেউ আছে এই শহরে?
প্রাণপণঃ (গদ্গদ স্বরে) হে হে হে হে, বেশ নামজাদা হয়ে গেছি, বলতে চাও?
মানসঃ আজ্ঞে আপনি এ শহরের বটগাছ। আপনার আশ্রয়েই আমাদের...
প্রাণপণঃ বড্ডো বাড়িয়ে ফেলছো, বাবা মানস।
মানসঃ আচ্ছা স্যার বাড়ি গিয়ে সব কথা হবে। এখন আপনি অন্য বাজার করবেন তো, স্যার? আপনি করুন, আমি কাছাকাছিই থাকবো। কোন সাহায্য দরকার হলেই, চলে আসবো, শুধু একটু হাঁক দেবেন।
প্রাণপণঃ আচ্ছা আচ্ছা সে হবে ‘খন।
[দুজনে মঞ্চের দুদিকে বেরিয়ে গেল। আলো নিভে যেতে অদৃশ্য হল মাছওয়ালা, তার ঝাঁকার মাছ সমেত।]
দ্বিতীয় দৃশ্য
[আলো জ্বলতেই, পর্দার বাইরে মঞ্চের সামনেটা যেন লম্বা রাস্তা। ডানদিক থেকে প্রাণপণের প্রবেশ, দুহাত ভরা তিনটে থলি। দুটো বড়ো, একটা ছোট–মাছের। রিকশ বা রিকশওয়ালাদের দেখা যাবে না, রিকশ চলার শব্দ আর রিকশওয়ালাদের কথা শোনা যাবে। ]
প্রাণপণঃ [দর্শকদের দিকে হাত তুলে] রিকশ, অ্যাই রিকশ।
[রিকশর হর্ন দিয়ে ঝনঝনিয়ে চলে যাওয়ার আওয়াজ, যেতে যেতে রিকশওয়ালা বলল]
এখন যেতে পারবুনি, বাবু। সকাল থিকে কিছু খাই নাই, খিদে পেয়েছে।
[একটু পরে, আবার একই ভাবে] রিকশ, অ্যাই রিকশ।
[রিকশ হর্ন দিয়ে দাঁড়াল] কোতায় যাবেন বাবু?
প্রাণপণঃ মুহুরিপাড়া।
ওদিকে এখন যাবনি, ফিরতি ভাড়া পাবোনি, খালি আসতে হবে। [রিকশার চলে যাওয়ার আওয়াজ]
প্রাণপণঃ যাচ্চলে, ব্যাটাদের হল কী? অ্যাই রিকশ, মুহুরি পাড়া যাবে?
[হর্ন দিয়ে রিকশা দাঁড়াল] তিরিশটাকা লাগবে বাবু।
প্রাণপণঃ তি-রি-শ টাকা? কেন বলতো? অন্য সময়তো পনের নেয় সবাই।
অত জানিনি বাবু, ওই টাকাই নাগবে। [বলতে বলতে রিকশার চলে যাওয়ার আওয়াজ]
প্রাণপণঃ [জনান্তিকে] ভালো বিপদ হল তো দেখি। ব্যাটাদের দল বেঁধে হলটা কী? সেই থেকে হেঁকে চলেছি, একটাও রিকশ যাচ্ছে না! এতগুলো ব্যাগ নিয়ে এখন যাই কী করে? অন্যদিন হতভাগারা ঘাড়ের কাছে এসে প্যাঁকপ্যাঁক করে কানের পোকা বের করে দেয়। আর আজ দেখ! [মানসের প্রবেশ, প্রাণপণের পিছনে দাঁড়াল।]
মানসঃ স্যার রিকশা খুঁজছেন না তো?
প্রাণপণঃ বাঃ। খুজছিই তো! তা নাহলে যাবো কী করে?
মানসঃ মানুষ বিপদে পড়লে, কিংবা অসহায় অবস্থায় পড়লে, ওদের দেখা মিলবে না, স্যার।
প্রাণপণঃ তাই তো দেখছি, হে!
মানসঃ কত আর দূর? আমাকে দুটো ব্যাগ দিন, আপনার বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসি।
প্রাণপণঃ আরে ছি ছি, তাই আবার হয় নাকি?
মানসঃ আপনার এই সামান্য সেবাটুকু করার সুযোগ দেবেন না, স্যার?
প্রাণপণঃ আমার...সেবা...তার মানে?
[প্রায় জোর করেই ভারি থলিদুটো প্রাণপণবাবুর হাত থেকে নিয়ে নিল মানস]
মানসঃ আপনি ওই আমিষ থলিটা নিজের কাছেই রাখুন স্যার। খুব ভারি মনে হচ্ছে না তো?
প্রাণপণঃ আরে না না, তুমি বারবার কিন্তু খুব বিড়ম্বনায় ফেলছো, মানস।
মানসঃ এটুকু সেবার বদলে যে অনেক আনন্দ পাবো স্যার। খুশিও।
[ভুষি দু হাতে থলি নিয়ে হাঁটা দিল মঞ্চের অন্যদিকে। প্রাণপণবাবুও অগত্যা মাছের থলিটা নিয়ে ভুষির সঙ্গ নিলেন। এই হাঁটাটা কিছুটা আলঙ্কারিক হাঁটা, যার মধ্যে কথাবার্তা চলবে, কথাবার্তা শেষ হতে হতে দুজনেই মঞ্চের বাইরে চলে যাবে।]
প্রাণপণঃ ইঞ্জিনিয়ারিং কোথায় পড়েছ, ভুষি?
মানসঃ আজ্ঞে সে তেমন বলার মতো কিছু নয়, কানপুর আইআইটি।
প্রাণপণঃ বলো কী হে? তেমন কিছু নয়? আর চাকরি কোথায় পেয়েছ, বললে?
মানসঃ আজ্ঞে বলিনি তো। এবার বলব। সাক্সবি এণ্ড টাক্সবি লিমিটেড।
প্রাণপণঃ বাঃ। তুমি তো সাংঘাতিক ছেলে হে? এমন গুণের ছেলে হয়েও তুমি লোকের বাজারের থলি বয়ে বেড়াচ্ছো? তা দেবে থোবে কেমন?
মানসঃ ছি ছি স্যার, কেউ কিছু দেবে থোবে বলে আমি বাজারের থলি বইছি, এ আপনার ভ্রান্ত ধারণা। আর আমিও যার তার থলি কেন বইব, স্যার? আপনার মতো লোকের থলি বওয়ার মধ্যেও একটা বেশ বড়সড় ইয়ে আছে, স্যার।
প্রাণপণঃ আরে রাম রাম, আমি সেকথা বলিনি। বলছিলাম যেখানে জয়েন করছো, তারা মাইনে-পত্তর কেমন দেবে থোবে ?
মানসঃ [লাজুক হেসে] শুনেছি ছেলেদের মাইনে, আর মেয়েদের বয়েস – জিগ্যেস করতে নেই! কথাটা কী সত্যি, স্যার?
প্রাণপণঃ হো হো হো হো । [মানসের কাঁধে হাত রেখে] তোমাকে প্রথমে চিনতে পারিনি, তবে এখন দেখছি, তুমি বেশ ইন্টারেস্টিং।
মানসঃ আপনাকে আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই চিনি স্যার। আপনার হয়তো মনে নেই, আমাদের স্কুলে আপনাকে একবার সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই ফাংসানে স্যার আমি একটা লেকচার দিয়েছিলাম, লিখেওছিলাম আমিই!
প্রাণপণঃ মনে নেই আবার? বেশ মনে আছে। তুমিই সেই ছেলে? চিনতে পারিনি হে, অনেক বড়ো হয়ে গেছ!
মানসঃ আজ্ঞে আপনাদের মতো মানুষের কত শত চেনাজানা, আমাকে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
প্রাণপণঃ আরে না না, মোটেও তা নয়। আসলে তুমি আমার সম্বন্ধে যা যা বলেছিলে সে সব কথা ভোলা যায়?
মানসঃ কী আর এমন বলেছিলাম, স্যার? আপনার সম্বন্ধে বলতে শুরু করলে ভাষা হারিয়ে যায়।
প্রাণপণঃ য্যাঃ। না না। এ তুমি বড্ডো বাড়িয়ে বলছো।
মানসঃ না স্যার। এখনও সেদিনের কথা মনে পড়লে খুব দুঃখ হয়।
প্রাণপণঃ কেন, কেন? দুঃখ হয় কেন?
মানসঃ কিছুই বলতে পারিনি। ক্লাস টুয়েলভের ছেলে...তখন কী বুঝতাম, কীই বা জানতাম!
প্রাণপণঃ না, না, খারাপ বলোনি তো?
মানসঃ কিছুই তো বলতে পারিনি, স্যার, তার খারাপ-ভালো তো পরের কথা।
প্রাণপণঃ কী জানি? আর কী বলার ছিল।
মানসঃ আমি জানি, স্যার। আজকে হলে আরো সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারতাম।
প্রাণপণঃ চলো বাড়ি চলে এসেছি, বাঁদিকে ঘুরেই সেকেণ্ড বাড়িটা।
মানসঃ আপনার বাড়ি চিনি স্যার, সবুজ রঙের দরজা, পেতলের নেম প্লেট – পিপি সমাদ্দার, অ্যাডভোকেট।
প্রাণপণঃ ভেরি গুড, এত পরিশ্রম করলে যখন, একটু বসে চা-টা খেয়ে যাও।
মানসঃ না না স্যার, ওসবে কী দরকার? বাড়ির লোককে ব্যতিব্যস্ত করা। আজ থাক, আরেকদিন বরং...
প্রাণপণঃ দ্যাখো হে ছোকরা। বাড়ির লোক ব্যতিব্যস্ত হবে কিনা, সেটা আমি বুঝবো। বেশি ফাজলামি করো না, একটু বসে, চা না খেয়ে তোমার আজ পরিত্রাণ নেই, এ কথাটা জেনে রাখো।
মানসঃ আজ্ঞে এত করে যখন বলছেন, তখন কী আর করা? কিন্তু পরে আমাকে কোন দোষ দেবেন না কিন্তু!
প্রাণপণঃ [মঞ্চের শেষ প্রান্তে এসে, কলিংবেল টিপে দরজার বাইরের অপেক্ষা করতে করতে] দোষের কথা আসছে কোথা থেকে?
মানসঃ না স্যার, মানে ইয়ে বলছিলাম, আমি আসাতে বাড়ীর সবাই খুশি নাও হতে পারে তো?
প্রাণপণঃ কেন? কেন? খুশি হবে না কেন? বাই দ্য ওয়ে, আমার কন্যার নামও খুশি, আর ছেলের নাম আনন্দ।
মানসঃ জানি, স্যার। খুশি আমাদের স্কুলেই পড়তো, দু ক্লাস নিচে। খুব ভালো মেয়ে, কিন্তু জানি না কেন, আমাকে দেখলে মোটেই খুশি হয় না কোনদিন।
প্রাণপণঃ বাবা, তুমি তো দেখছি, আমার ঠিকুজি কুলুজি সব জেনে বসে আছো? তা খুশি তোমার ওপর অখুশি হবার কারণ কী জানতে পারি?
মানসঃ আমিও জানি না, স্যার। জানতে চাইওনি কোনদিন। মেয়েদের মনের খবর কে রাখে, আমিতো রাখি না, স্যার? মেয়েদের মনের দরজা...
[আবার বেল দিতেই, ভেতর থেকে ‘আসছি’ শোনা গেল।]
[আলো নিভে গেল।]
তৃতীয় অঙ্ক
[পর্দা সরতেই, প্রাণপণবাবুর একই বসার ঘর। ঘড়িতে সময় দশটা পঁচিশ। বাঁদিকে সদর দরজা। মঞ্চের ডানদিক থেকে একটি মেয়ে, “আসছি আসছি” বলতে বলতে বাঁদিকে দৌড়ে গেল। মেয়ের নাম খুশি। সে দরজা খুলতেই প্রাণপণবাবু আগে, পিছনে মানসভূষণ ঢুকল।]
প্রাণপণঃ দরজা খুলতে এত দেরি করিস কেন, মা? ভারি ভারি থলে নিয়ে ছেলেটা দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই থেকে।
খুশিঃ বা রে, আমি কী করে জানবো? আমি ভেবেছি, প্রতাপদা আজ নেই, তুমি রিকশ নিয়ে আসবে! ভুষিদা যে আজকাল মুটেগিরি করছে, জানতাম না তো?
[মানস ঘরে ঢুকে এসে ঘরের কোনায় থলি দুটো রাখল। প্রাণপণবাবু মেয়ের হাতে আমিষের থলি দিতে দিতে]
প্রাণপণঃ কাকে কী বলছিস, খুশি? মানসের মতো হীরের টুকরো ছেলে এ তল্লাটে আমি দেখিনি। তোর মা আবার কোথায় গেল? এটা রান্নাঘরে সাবধানে রেখে আয়, তারপর মাকে ডাক।
[খুশি ভেতরে চলে যাওয়ার পর]
মানসঃ দেখলেন তো, স্যার? বলেছিলাম না খুশি আমাকে দেখলে খুশি হবে না!
প্রাণপণঃ কী দেখে বুঝলে, খুশি তোমাকে দেখে অখুশি হয়েছে?
মানসঃ ওই যে বলল না, স্যার আমি মুটেগিরি করছি, আমাকে ও মুটে মনে করে।
প্রাণপণঃ তুমি তো মোটেই মুটে নও। বললে কী হয়েছে?
মানসঃ না স্যার, ওই মুটে কথাটা এখন আমায় খুঁটে খুঁটে খাবে। আমি এখন আসি স্যার?
প্রাণপণঃ আসবে মানে? কোথায় যাবে?
মানসঃ না, স্যার কিছু একটা বাড়াবাড়ি হবার আগেই আমি বরং চলে যাই।
প্রাণপণঃ তুমি তো ব্রিলিয়ান্ট বয়। এত ভিতু কেন বলো তো! আমার মতো...
মানসঃ আপনার মতোই তো হতে চাই, স্যার কিন্তু আমাকে দিয়ে সে হবার নয়।
প্রাণপণঃ আলবাৎ হবে, সোফায় আরাম করে বসো। মেয়েদের সব কথায় কান দিলে চলে?
কমলাঃ কার আবার কানে ফুসমন্ত্র দিচ্ছ? [ভেতর থেকে প্রাণপণবাবুর স্ত্রীর গলা পাওয়া গেল, ভেতরে দরজা দিয়ে মঞ্চে ঢুকতে ঢুকতে] সারাদিন তো লোককে কুমন্ত্রণা দিয়ে মামলা বাগাচ্ছো? এখন ঘরেও শুরু করেছ? [সোফায় বসা ভুষিকে দেখে] অ ভুষি? কখন এলে? কেমন আছো, বাবা?
[ভুষিসোফা থেকে উঠে প্রাণপণবাবুর স্ত্রীকে এবং তারপর প্রাণপণবাবুকেও প্রণাম করল]
মানসঃ ভালো আছি, কাকিমা। আপনি ভালো আছেন তো?
কমলাঃ বসো বাবা, বসো। বাবা, মা ভালো আছেন? মিতুলের তো সামনেই ফাইন্যাল পরীক্ষা। তোমার মতো রেজাল্ট হবে তো?
মানসঃ সবাই ভালো আছে কাকিমা। মিতুলটা মহা ফাঁকিবাজ, তবে মা তো দিনরাত পেছনে লেগে রয়েছেন, দেখা যাক কী হয়?
কমলাঃ না, না। চিন্তা করো না। মিতুল, খুব ভালো মেয়ে, ভালোই হবে। তুমি বসো একটু চা-টা করে আনি।
[কমলাদেবী ভেতরের দিকে যাচ্ছিলেন]
প্রাণপণঃ তুমি ওকে চেনো? [কমলাদেবী প্রাণপণবাবুর কথায় ঘুরে দাঁড়ালেন]
কমলাঃ চিনবো না? খুশির সঙ্গে এতদিন একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে!
প্রাণপণঃ কোনদিন বলোনি তো?
কমলাঃ অপেক্ষা করছিলাম। কোনদিন চুরিচামারি করলেই তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতাম।
প্রাণপণঃ তার মানে? চুরিচামারির সঙ্গে আলাপের কী সম্পর্ক?
কমলাঃ তোমার সঙ্গে কোন ভদ্রলোকের আলাপ আছে? সবাই তো চোর চোট্টা, ঠগ, জোচ্চোর।
প্রাণপণঃ [রেগে গুম হয়ে] তাই বুঝি? তা ওই মিতুল মেয়েটি কে?
মানসঃ আমার বোন, স্যার। অনেকটাই ছোট, এবার ক্লাসটুয়েল্ভ এর ফাইন্যাল দেবে।
প্রাণপণঃ আচ্ছা?
কমলাঃ যাই তোমার জন্যে চা করে আনি... [কমলাদেবী ভেতরের দিকে যাচ্ছিলেন]
প্রাণপণঃ শুনছো। মানসের জন্যে, আজ খুব সস্তায় প্রচুর ইলিশ পেয়েছি। চট করে কিছু ভেজে ফেল দেখি, রোববারের সকালটা জমে যাবে একেবারে! [কমলা থমকে দাঁড়িয়ে,]
কমলাঃ মানসটা আবার কে?
মানসঃ কাকিমা ওটাই আমার নাম, মানসভূষণ।
কমলাঃ তাই নাকি? আমরা তো চিরকাল ভূষি বলেই জানি!। বসো বাবা, কখানা ভেজে এনে দিই। [কমলার প্রস্থান]
প্রাণপণঃ তুমি তো সাংঘাতিক ছেলে হে? আমি ছাড়া, আমার বাড়ির সবাই তোমায় চেনে জানে, অ্যাঁ?
মানসঃ ওই...ইয়ে মানে...কাকিমা আমাকে একটু প্রশ্রয় দেন। স্নেহ করেন।
প্রাণপণঃ রাস্তায় আসতে এ কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানাওনি তো? তার ওপর আবার বলছিলে তুমি এলে বাড়ির লোকেরা অখুশি হবে!
মানসঃ আসলে আমি একটু ভিতু টাইপের তো, আপনার মতো সাহসী হলে...
প্রাণপণঃ হা হাহাহা, এ কথাটা মন্দ বলোনি কিন্তু। তবে একটা কথা চুপিচুপি বলি।
মানসঃ কী স্যার?
প্রাণপণঃ আমি এ সময় মাছ ভাজার কথা বললে, তোমার কাকিমা আমাকে দু কথা শুনিয়ে দিত, তুমি এসেছ বলে, এক কথায় চলে গেল মাছ ভাজতে! অবাক করলে হে?
মানসঃ আজ্ঞে তা নয়, কাকিমাতো ভালো মানুষ, মায়ের মতো। উনি তো খুশি হবেনই। কিন্তু খুশি আমায় দু চোখে দেখতে পারে না!
প্রাণপণঃ কেন বলো তো?
মানসঃ কী জানি কেন? আমার খুব ইচ্ছে হয়, আপনার সঙ্গে বসে নানান লোকের নানান গল্প শুনি।
প্রাণপণঃ একশ বার আসবে।
মানসঃ ইচ্ছে হয়, কাকিমার সঙ্গে বসে একটু কথাবার্তা বলি। কিন্তু খুশি মোটেই অ্যালাউ করে না।
প্রাণপণঃ খুশি অ্যালাউ করার কে? তুমি আসবে।
মানসঃ না ইয়ে, খুশি বলে আপনি নাকি খুব কড়া, গম্ভীর, আর রাশভারি মানুষ। আজে বাজে লোকের সংস্রব রাখেন না। আমি যেন এ বাড়িতে কখনো পা না রাখি।
প্রাণপণঃ ছি ছি, খুশি এমন বলেছে? কিন্তু খুশি তো আমার তেমন মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমি খুশিকে ডেকে বলে দেব। আসবে না কেন? একশবার আসবে!
মানসঃ না না এ বিষয়ে কোন কথা বললে, খুশি খুশি মনে মেনে নাও নিতে পারে। আসলে আমার বাবা হচ্ছেন মেছো বিভূতি, মাছের আড়তদার... ।
প্রাণপণঃ তাতে কী? জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো...ছোটবেলায় পড়োনি?
মানসঃ পড়েছি স্যার। ভাঃসঃও করেছি ।
প্রাণপণঃ ভাঃসঃ মানে?
মানসঃ ভাবসম্প্রসারণ। কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে। পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি। অনেক লিখেছি স্যার, কিন্তু কিছুই হয়নি।
প্রাণপণঃ ভাবসম্প্রসারণ লিখে কী আবার হবে?
মানসঃ নম্বর স্যার। বারো নম্বরে পাঁচের বেশি কোনদিন জোটেনি।
প্রাণপণঃ হা হাহাহা তুমি তো তাও পাঁচ পেতে আমার জুটতো তিন কি চার! হা হাহাহা।
মানসঃ জীবনটা তো ভাবসম্প্রসারণ নয়, স্যার। ভদ্র শিক্ষিত সমাজে, আমার বাবাকে তেমন কেউ পাত্তাটাত্তা দেয় না, একটু অবজ্ঞার চোখেই দেখে। খুশি সেই জন্যেই হয়তো আমার ওপর অখুশি।
প্রাণপণঃ তুমি বিভূতিভূষণের ছেলে? আগে বলবে তো?
মানসঃ আজ্ঞে হ্যাঁ নাম ওটাই, কিন্তু সকলে মেছো বিভূতি বলে। বিবাহ, উপনয়ন, নিয়মভঙ্গ, অন্নপ্রাশন কিংবা যে কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে আমরা সুলভ মূল্যে উৎকৃষ্ট মৎস্য সরবরাহ করিয়া থাকি। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
প্রাণপণঃ হা হাহাহা পরীক্ষা অনেকদিন হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাবের যে কোন বড় অনুষ্ঠানে, পিকনিকে বিভূতির থেকেই তো আমরা মাছ-টাছ কিনি, ও আর তোমায় বলতে হবে না।
মানসঃ তাই? জানেন, আমার বাবার ইচ্ছে, খুশির বিয়েতে আপনাদের মাছের সাপ্লাই দেওয়ার।
প্রাণপণঃ সে তো বটেই। তবে খুশির এখনই বিয়ের চিন্তা তো করছি না, মানস।
মানসঃ না করাই উচিৎ, কী আর এমন বয়েস? বাচ্চা মেয়ে। তবে মনোমত পাত্র যদি পেয়ে যান, দেরি করেই বা লাভ কী?
প্রাণপণঃ তা ঠিক। এমএ করে একটা চাকরিও যখন পেয়ে গেছে, তখন অকারণ দেরি করারও কোন মানে হয় না। তা তোমার জানাশোনার মধ্যে এমন কোন ছেলেটেলে রয়েছে নাকি?
মানসঃ আছে বৈকি, স্যার। অনেক আছে। খুশির মতো মেয়েকে ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে, ছেলেদের বাপ-মায়েরা লাইন লাগিয়ে দেবে!
প্রাণপণঃ বলো কী হে? হা হাহাহা, আমার মেয়ের জন্যে স্বয়ংবর সভা বসাতে হবে নাকি?
মানসঃ স্বয়ংবরে খুব রিস্ক আছে স্যার, আজকাল তাই কেউ আর ওই পথ মাড়ায় না।
প্রাণপণঃ কিসের রিস্ক?
মানসঃ ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যায়!
প্রাণপণঃ কিসের ভুল বোঝাবুঝি?
মানসঃ দ্রৌপদী আর অর্জুনের কেসটা মনে নেই, স্যার? স্বয়ংবর সভা থেকে দ্রৌপদীকে নিয়ে অর্জুন ঘরে এলেন, আর কুন্তী বললেন, যা পেয়েছ, পাঁচ ভাই ভাগ করে নাও!
প্রাণপণঃ য্যাঃ যত্তো আজগুবি কথা। ওসব আবার আজকাল হয় নাকি? আজকাল কোন্ বাড়িতে পাঁচ ভাই আছে?
মানসঃ তা নেই। কিন্তু তাও ভালো করে না জেনেশুনে হুট করে অচেনা অজানা ছেলের হাতে, হাত-পা বেঁধে খুশির মতো মেয়েকে তুলে দেওয়াটা কী উচিৎ হবে, স্যার?
প্রাণপণঃ একদমই না।
মানসঃ বিশেষ করে আপনি যেখানে ওকে এত যত্নে আদরে, মনের মতো করে মানুষ করেছেন। খুশি কী আপনার বুকের পাঁজরের থেকে কম কিছু, স্যার?
প্রাণপণঃ একদম মনের কথা বলেছো, মানস। খুশি অখুশি হলে, আমার গোটা জীবনটাই ভূষি হয়ে যাবে।
মানসঃ একদম ঠিক বলেছেন, স্যার। খুশিকে জেনেশুনে কোন ভূষি ছেলের হাতে তুলে না দেওয়াটাই মঙ্গল।
[ভূষির পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল, ফোনটা বের করে দেখল তার বাবার ফোন।] এক মিনিট, একটা ফোন এসেছে, চট করে কথাটা সেরে নিই, স্যার? হ্যালো, বলো।
[মঞ্চের আলো কমে এলো। ফোকাস শুধু মানসের ওপর। বাইরে থেকে মেছো বিভূতির ভারি গলা পাওয়া গেল]
বিভূতিঃ কী রে? শুনলাম তুই হাফ দামে মাছ বিলি করে বেড়াচ্ছিস?
মানসঃ হাফ দাম কোথায়? যা দাম নিয়েছি, তোমার লস তো হয় নি, বাবা!
বিভূতিঃ হতভাগা, লাভ না হওয়াটাও একধরনের লস, সেটা জানিস? ব্যবসাটা আর কবে শিখবি? তা এই বিশেষ ডিসকাউন্টটা কাকে দিলি, শুনি?
মানসঃ খুশির বাবা, প্রাণপণস্যারকে।
বিভূতিঃ ছি ছিছি, আমার ছেলে হয়ে তুই এমন চশমখোর ব্যবসা শিখেছিস? হতচ্ছাড়া ছেলে, তাহলে দাম নিলি কেন?
মানসঃ বা রে, উনি দাম না দিয়ে জিনিষ নেবার মানুষ? কী যে বলো তুমি?
বিভূতিঃ তুই কী এখন ওঁদের বাড়িতেই?
মানসঃ হুঁ।
বিভূতিঃ বা বা বা, প্রাণপণবাবুকে রাজি করা। প্রাণপণ চেষ্টা কর।
মানসঃ সেই চেষ্টাই করছি বাবা।
বিভূতিঃ আমার খুশি যদি এনে দিতে পারিস...
মানসঃ কী হবে তাতে?
বিভূতিঃ আরে বোকা হাঁদা, ঘরে মালক্ষ্মী এসে বসলে আর চিন্তা কী?
মানসঃ তোমার চিন্তা দূর হলে, আমার কী?
বিভূতিঃ হতভাগা ছেলে, তা তো বলবিই। বুড়ো বাবা নিশ্চিন্ত হলে, তোর মনে হয় খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
মানসঃ ঠিকাছে ঠিকাছে, রাখছি।
[ফোনটা অফ করে প্যান্টের পকেটে রাখতেই, মঞ্চ আবার আলো হয়ে উঠল]
প্রাণপণঃ [হাসি হাসি মুখে] কার ফোন, বাবার? কম দাম নিয়েছ শুনে, খুব বকাবকি করলেন নিশ্চয়ই?
মানসঃ না, স্যার। উলটে যাচ্ছেতাই গালাগালি করলেন, আপনার থেকে দাম নিয়েছি বলে!
প্রাণপণঃ কেন? কোন খুশিতে দাম নেবে না, শুনি?
মানসঃ তা জানি না স্যার, তবে ওঁনার ওই একটাই কথা, খুশি।
[দুটো প্লেটে ইলিশমাছের চারটে দাগা ভেজে প্রাণপণবাবুর স্ত্রী ঘরে এলেন।]
মানসঃ এঃ কাকিমা, এযে গাদা মাছ ভেজে নিয়ে এলেন।
কমলাঃ গাদা আবার কোথায়? দুটো করে ভেজে আনলাম, শুরু করো, আরো আনছি।
মানসঃ আমাকে আর দেবেন না কাকিমা। স্যারকে দিন। আপনি নিন, খুশিকে, আনন্দকে দিন। তাতেই আমাদের খুশি, তাতেই আমাদের আনন্দ।
[কমলার প্রস্থান। বিনা বাক্যব্যয়ে প্রাণপণবাবু গরম মাছভাজার টুকরো ভেঙে মুখে নিয়ে পুরলেন]
প্রাণপণঃ বাঃ, যেমন টেস্ট তেমনি সুবাস। কোলাঘাট ছাড়া এমন মাছ হয় না, মানস। খাও খাও, বসে আছো কেন? ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যে!
[বড়ো একটা থালায়, অনেকগুলো মাছভাজা নিয়ে কাকিমা ঘরে এলেন। খুশি আর আনন্দও ঢুকল তাঁর পিছনে। প্রাণপণবাবুর প্লেটে আরো দুটো মাছভাজা দিয়ে]
কমলাঃ কই? তুমি তো এখনো শুরুই করলে না, ভূষি?
মানসঃ আজ্ঞে কাকিমা, আপনারা সকলে খেয়ে যদি খুশি হন, আনন্দ পান, তার থেকে আমার আর কিসে খুশি? কিসে আনন্দ? তবে কিনা ময়রা কোনোদিন নিজের বানানো দই, মিষ্টি খায় না। রান্নার ঠাকুর ভালো ভালো রান্না করে, কিন্তু নিজে খায় পান্তাভাত আর পেঁয়াজ। আমাদেরও তাই, মাছে খুব একটা রুচি আসে না। [প্রাণপণবাবু মুখের থেকে কাঁটা বের করতে করতে]
প্রাণপণঃ কী যে বলো! ওভাবে ভাবো কেন? তোমার বাবা মাছের ব্যবসা করেন, তাতে কি? তোমার সঙ্গে কথা বার্তা বলে বুঝতে পারছি, মাছের ব্যবসাও বেশ ব্যবসা। খাসা ব্যবসা।
মানসঃ এতটাই ভরসা দিচ্ছেন যখন, মুখ ফুটে তখন একটা কথা বলে ফেলি, স্যার?
খুশিঃ আমি ততক্ষণ চা করে আনি। [ভূষির এই কথা শুনেই খুশি দৌড়ে ভেতরে চলে গেল চা করতে]।
প্রাণপণঃ বলে ফেল, হে বলে ফেল। এখন খুব ভালো মুডে আছি।
মানসঃ আজ্ঞে ইয়ে বলছিলাম কী, স্যার আপনাদের এই খুশি যদি আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম, আমার বাবা-মাও খুব খুশি হতেন। বাবা তো খুশিতে পাগল, বলেন খুশির মতো একটি মেয়ে যদি আমার মেয়ে হয়ে, আমাকে বাবা বলত, তার থেকে খুশি তিনি আর কিছুতে হবেন না।
[প্রাণপণবাবু একটু অবাক হয়ে স্ত্রী মুখের দিকে তাকিয়ে, ]
প্রাণপণঃ তুমি কোন খুশি, কিসের খুশির কথা বলছো বলো তো? আমার তো সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। তুমি কী আমাদের খুশির কথা বলছো? সে খামোখা তোমার বাবাকে বাবা বলবে কেন? আর তাতে বিভূতিবাবুরই বা খুশি হওয়ার কী আছে? যা খুশি বকে চলেছ!
মানসঃ আজ্ঞে তা বটে, খুশির খুশির দিকটাও তো ভাবার আছে! সে যদি খুশি হয়েই আপনার সঙ্গে আমার বাবাকেও বাবা বলে, তাতে আপনি কী খুশি হবেন না, স্যার। খুশি যদি তাঁর, মানে ওই বিভূতিবাবুর পুত্রবধূ হয়, তাহলে তিনি খুশির মতো মেয়ে পেয়ে খুশিও হবেন।
প্রাণপণঃ বিভূতিবাবুর পুত্রবধূ? [জীবনে এত অবাক আর কখনো হননি প্রাণপণবাবু, মাছভাজা খাওয়া থামিয়ে তিনি ভূষি এবং স্ত্রীর মুখের দিকে বার বার দেখতে লাগলেন। প্রাণপণবাবুর স্ত্রী নির্বিকার মনে মাছভাজা খাচ্ছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে তিনি...] ছোঁড়া কী বলছে, শুনতে পেয়েছো?
কমলাঃ কালা তো আর নই, শুনতে পাবো না কেন? মাছটা কিন্তু দারুণ টেস্টি, ভুষি!
প্রাণপণঃ কিছু বলছো না যে?
কমলাঃ কী আবার বলবো? ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, দারুণ চাকরি। দেখতে শুনতেও খাসা। বিয়ের পরেও আমার মেয়েটা এই শহরেই চোখের সামনে থাকবে। সেই কবে থেকে ওদের পুরো বংশটাকে চিনি। আমার খুশি মাছ খেতে ভালোবাসে, সে অভাব ওদের বাড়িতে কোনদিন থাকবে বলে মনে হয় না। এমন ছেলে পাবে কোথায়? তোমার তো আইনের ব্যবসা, কাজ কারবার যতো চোর জোচ্চোর আর বদমাশদের সঙ্গে। তোমার ওপর আমার ভরসা হয় না বাপু। তার থেকে ভূষিতেই আমি খুশি।
[ভিজে বেড়ালের মতো ভূষি এখন মাথা নিচু করে মাছের টুকরো মুখে পুরল, তার মুখে আর কথা নেই। আর এই সময় খুশি বড়ো একটা ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে প্রথম কাপটা রাখল প্রাণপণবাবুর সামনে। তারপর মাকে, তারপর ভূষিকে। ভূষিকে চা দেওয়ার সময়, দুজনের চোখাচোখিটা প্রাণপণবাবুর চোখ এড়াল না। তিনি আগুনের মতো রেগে উঠলেন]
প্রাণপণঃ এটা কন্সপিরেসি, ষড়যন্ত্র।
কমলাঃ আই পিসি ১৮৬০ সেকসন ১২০এ।
প্রাণপণঃ তার মানে?
কমলাঃ সেকসনটা বলে দিলাম, তোমার কেস খাড়া করতে সুবিধে হবে। জুনিয়রদের মাথায় আর কাঁঠাল ভাঙতে হবে না। আরো আছে, ট্রেসপাসিং – সেকসন ৪৪১; আরো আছে ৪১৫, ৪১৭, ৪২০ চিটিংবাজি। তোমার মতো সরল সাধাসিধে আইনজীবিকে সস্তায় ইলিশমাছ খাইয়ে কুপ্রস্তাব দেওয়া। আরও বলবো? তোমার প্রতাপকে গতকাল রাত থেকে ভূষি নিজের বাড়িতে আটকে রেখেছিল। না, না, কোন অত্যাচার করেনি, মারেওনি, ধরেওনি। লুচি, পরোটা মাংস, রসগোল্লা খেয়েদেয়ে-ঘুমিয়ে, দিব্বি ছিল। কিন্তু তাতেও অ্যাবডাকশনের কেস হয়। সেকসন ৩৬২।
[স্ত্রীর কথায় প্রাণপণবাবু হতাশ হলেন খুব, গম্ভীরভাবে মেয়েকে জিগ্যেস করলেন]
প্রাণপণঃ তোর থেকে আমি এমনটা আশা করিনি, মা! তোরা সব্বাই মিলে আমাকে এমন বোকা বানালি?
[মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, খুশি মেঝেয় পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতেঘষতে নিচু গলায় বলল]
খুশিঃ আমিও আশা করিনি বাবা। আমি ভেবেছিলাম, ভূষিদাকে তুমি সামনে দাঁড়াতেই দেবে না। সেই ভূষিদাকে তুমি কিনা নিজে ঘরে ডেকে আনলে! তাতেও হল না, তার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ হয়ে উঠলে! আর এদিকে আমি গোহারা হেরে গেলাম।
প্রাণপণঃ সে আবার কী? আমার প্রশংসার সঙ্গে তোর গোহারার কী সম্পর্ক?
খুশিঃ আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, তোমাকে কনভিন্স করে, যদি ভূষিদা তোমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি আসতে পারে, তবেই আমি... [খুশি হঠাৎ থেমে গিয়ে মাথা নিচু করেই রইল, তার চোখে এখন জল। প্রাণপণবাবু আবার মেয়ের চোখের জল একবারেই সহ্য করতে পারেন না, তাঁর রাগ রাগ ভাবটা থিতিয়ে গেল, স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন]
প্রাণপণঃ “তবেই আমি...” কী? বল মা, বল, আমার কাছে আর লুকোস না।
খুশিঃ সে আমি তোমায় বলতে পারবো না, বাবা। [খুশি দৌড়ে চলে গেল ঘর ছেড়ে। প্রাণপণবাবু হতভম্ব হয়ে, বসে রইলেন কিছুক্ষণ, নিজের স্ত্রী আর ভূষির দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন]
প্রাণপণঃ কী এমন কথা, যা মেয়ে সবাইকে বলতে পারে, কিন্তু বাবাকে বলতে পারে না?
[মুখঝামটা দিয়ে প্রাণপণবাবুর স্ত্রী বলে উঠলেন]
কমলাঃ কোন বুদ্ধি নিয়ে তুমি অ্যাদ্দিন ওকালতি চালাচ্ছো বুঝি না, বাপু। বাপের কাছে নিজের বিয়ের কথা কোনো মেয়েকে কোনদিন বলতে শুনেছ? উকিলদের ঘটে কী একটু সাধারণ বুদ্ধিও থাকতে নেই?
[প্রাণপণবাবু কিছু বললেন না, গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করতে লাগলেন, ভূষির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সে তখনো ভাজা মাছ খেয়ে চলেছে। দেখেই তাঁর পিত্তি জ্বলে গেল, বললেন]
প্রাণপণঃ অ্যাই যে ছোকরা, ওপর ওপর তোমাকে দেখে বেশ ভালো ছেলেই ভেবেছিলাম।
মানসঃ আজ্ঞে স্যার, ভেতরে ভেতরেও আমি খুব খারাপ বা ফ্যালনা নই। সে কথা কাকিমা, খুশি, এমনকি এই আনন্দও জানে। আপনার সঙ্গে আজকেই প্রথম আলাপ কি না, তাই আপনার একটু ভ্রম হচ্ছে।
প্রাণপণঃ ভ্রম হচ্ছে? আমার ভ্রম হচ্ছে? হুঁহুঁহুঁহুঁ, তুমি একটি ভিজে বেড়াল! তোমার ভাব দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতেও জানো না!
মানসঃ আজ্ঞে, মাছ আর বেড়ালে খাদ্য খাদক সম্পর্ক।
প্রাণপণঃ আসলে তুমি একটি গভীর জলের মাছ!
মানসঃ আজ্ঞে হ্যাঁ। এ কথাটা আমার বাবাও বলেন, যে কোন জিনিষের গভীরে না গেলে সেটাকে সঠিক জানা যায় না। জলে ডুব না দিলে কী আর সাঁতার শেখা যায়, স্যার?
প্রাণপণঃ হুঁ। আমার আদরের মেয়েটাকে তোমরা সকলে মিলে, সেই জলে ফেলে দেওয়ার মতলব করেছ?
মানসঃ মতলব বলছেন, স্যার? আমরা দুজনে – খুশি আর আমি – সেই কবে থেকে অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছি, স্যার। এখন আপনার অনুমতি পেলেই, আমরা ভেসে উঠবো।
[ভূষির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে]
প্রাণপণঃ ভেসে উঠবে? ওঠাচ্ছি তোমাকে ভেসে, দাঁড়াও! বিয়ে করে কোনো ছেলে ভেসে ওঠে না হে, বরং অতলে তলিয়ে যায়। আমাকে আর কাকিমাকে দেখেও তোমার চৈতন্য হল না? তোমাকে আমি ডুবিয়েই ছাড়বো। এমন ডোবাবো না! শুনছো, খুশিকে বলো তো অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে ভালো দেখে কিছু সন্দেশ আনতে। আর শোনো হে ছোকরা, তোমার বাপ - মেছোবিভূতি আজ সন্ধেয় বাড়িতে থাকবে? নাকি তিনি আবার কোথাও মাছ ধরতে যাবেন? ভাবছি আজ সন্ধেয় তোমার কাকিমাকে নিয়ে, তোমার বাবা-মার সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করেই আসবো।
মানসঃ আজ্ঞে স্যার, এমন টাটকা সরেশ মাছ, নিজে থেকে ধরা দিতে আসছেন খবর পেলে, তিনি আর অন্য কোত্থাও মাছ ধরতে যাবেন না।
[খুশি একটা বড়ো প্লেটে অনেকগুলি সন্দেশ সাজিয়ে নিয়ে ঘরে এল। প্রাণপণবাবু খুব অবাক হলেন]
প্রাণপণঃ এত তাড়াতাড়ি কোত্থেকে সন্দেশ আনলি?
[সন্দেশের থালা হাতে খুশি যখন প্রাণপণবাবুর সামনে দাঁড়াল, তার মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়ের খুশিমাখা লাজুক হাসিটা তাঁর চোখ এড়াল না। তিনি একটা সন্দেশ হাতে তুলে নিতে তাঁর স্ত্রী বললেন]
কমলাঃ আমি আগেই আনিয়ে রেখেছিলাম, তোমার যে শেষমেষ সুবুদ্ধির উদয় হবে সে আমার জানাই ছিল।
প্রাণপণঃ আচ্ছা? তোমার সঙ্গে যে জীবন কাটাচ্ছি, তাতে দুর্বুদ্ধি হবে না তো কী হবে? আমার সুবুদ্ধি যদি এসে থাকে, সে আমার ওই মেয়ের জন্যে, আর ওই... ওই... ওই... ভূষিটার জন্যে। ছোঁড়াটা একটু ডেঁপো টাইপ, কিন্তু বেশ ভালো। হা হাহাহা।
[প্রাণপণবাবুর স্ত্রী কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না, তিনিও হাসতে লাগলেন। ভূষি খুশির দিকে তাকিয়ে দুবার ভুরু নাচাতে, খুশি লজ্জা পেয়ে ভাইয়ের পাশে সোফায় বসল, মুখ নিচু করে। ভূষি মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে লিখল, ‘খেপি, আমার সঙ্গে আর কোনদিন চ্যালেঞ্জ নিবি না, কেমন?’ খুশির পাশে রাখা মোবাইলে আওয়াজ হল ‘টুং’। আনন্দ দিদির মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পড়ে বলল]
আনন্দঃ অ্যাই দিদি খেপি কে রে? ভুষিদা লিখেছে, খেপি আমার সঙ্গে আর কোনদিন চ্যালেঞ্জ নিবি না, কেমন?
[খুশি দৌড়ে ঘর ছেড়ে ভেতরে চলে গেল। ভূষি লাজুক মুখে আনন্দকে জড়িয়ে ধরল। প্রাণপণবাবু আর স্ত্রী হাসতে লাগলেন খুব]
[পর্দা নেমে এল।]
..০০..
[কোন নাট্যদল নাটকটি মঞ্চস্থ করলে কোন আপত্তি নেই। কোন সাম্মানিক নয়, শুধু সংবাদটুকু পেলেই যথেষ্ট খুশি হব, আনন্দ পাবো - লেখক।]
[এটি গল্পের আকারে "দেশ" পত্রিকায় বেরিয়েছিল - এখন নাটক হয়ে এখানে প্রকাশিত হল]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।