সাইবেরিয়ার সন্ধানে
-সিটি ব্যাঙ্ক নানান দেশের জন্য বাজার থেকে টাকা তুলছে জানি। আমাদের দে’উ কোম্পানিকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন। আমরা কাজাখস্তানে মোটর গাড়ির কারখানা খোলার উদ্যোগ করছি।
-কাজাখস্তানে? কেন? পুরো রাশিয়া ছেড়ে পাহাড় পর্বতের দেশে, যেখানে অতি সামান্য লোকের বাস? কারণ?
-একটা কারণ – অনেক কোরিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষ সেথায় বাস করে!
-জাপানে আছে জানি, সেটা ঔপনিবেশিকদের কল্যাণে। কিন্তু কাজাখে কোরিয়ান বসতি আছে তা জানতাম না!
-আরও একটা বিষয়ে আপনাকে অবহিত করি। সাইবেরিয়ার নাম শুনলে কি মনে হয় বলুন তো? বেজায় ঠান্ডা সারা বছর। সেটা একটা পেনাল কলোনি। ধরে বেঁধে না নিয়ে গেলে কেউ সেখানে যেতে চায় না, তাই তো?
-ঠিক! যতদূর জানি যদিও এটা বিশাল অঞ্চল কিন্তু স্বেচ্ছায় কেউ যায় না।
-শুনলে আরও অবাক হবেন, লাখ খানেক কোরিয়ান মানুষ সম্পূর্ণ নিজেদের ইচ্ছেয় তল্পিতল্পা বেঁধে ভাগ্য পরিবর্তনের বাসনায় হাজার কিলোমিটার হেঁটে সাইবেরিয়ায় হাজির হয়েছিল সোয়াশো বছর আগে। যদিও তখন আমেরিকার দুয়োর খুলে গেছে, কিন্তু এই হত দরিদ্র, ক্ষুধার্ত কোরিয়ান চাষি ও মেছুরেদের সে জাহাজের টিকিট কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই পদব্রজে সাইবেরিয়া! তবে সেখান থেকেও তাদের উৎখাত হতে হয়েছে।
দে’উ নামক কোম্পানির লন্ডন অধ্যক্ষ মিস্টার লি-র সঙ্গে কথা হচ্ছিল কভেনট গার্ডেনসের (যেথায় মাই ফেয়ার লেডি এলাইজা ডুলিটল ফুল বেচেছেন একদা) মেডেন লেনের রুলস নামক রেস্তোরাঁয় বসে। ১৭৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁটি কেবল সুপ্রাচীন বলে নয়, বুনো মুরগি থেকে উড়ো পাখি ইত্যাদি প্রভূত আরাধ্য ভোজ্য বস্তু টেবিলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশেষ খ্যাত। বিদেশি, বিশেষ করে কোরিয়ান এবং জাপানি অতিথিদের এখানে আকছার নিয়ে গেছি - তাঁরা এই ধরনের "ইংলিশ ট্র্যাডিশনের" সঙ্গে পরিচিত হতে ভালোবাসেন। সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডনে একদা জাপানি, কোরিয়ান, জার্মান ইত্যাদি দেশের বাণিজ্যিক (ট্রেডিং) কোম্পানিগুলিকে চিনেছি কর্পোরেট বা আমেরিকানরা যাকে বলেন রিলেশানশিপ ব্যাঙ্কিঙের সুবাদে। পরে সেই সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙের সুযোগ আসে - যেখানে আমরা আপন ভাঁড়ারের টাকা কেবল নয়, দুনিয়ার আরও অনেক ব্যাঙ্কের কুলুঙ্গি হাতড়ে ধন আহরণ করি। অধুনা লুপ্ত ডং আ, হিও সুং, সাঙ্গইওং, সুণকিওং ইত্যাদি নানান কোরিয়ান লন্ডন অফিসের পদাধিকারীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেমন মিস্টার লি। তাঁর অনেক কথা মনে পড়ে। মিস্টার লি শরৎকালের কোরিয়ান বর্ণনা দিয়েছিলেন দু-লাইনে – “আকাশ অনেক উঁচুতে / পশুরা হৃষ্টপুষ্ট”। নানান কোরিয়ান খাদ্য বস্তুর সঙ্গে তিনি পরিচয় করান তার মধ্যে অন্তত একটির প্রতি আমার নিষ্ঠা আজো অটুট – কিম চি (গ্যাঁজানো সবজি)।
পটভূমিকা জেনে নেওয়া আবশ্যক।
১৯৫০-১৯৫৩ সালের কোরিয়ান লড়াইয়ের শেষে ৩৮ নম্বর সমান্তরাল রেখা (থার্টি এইটথ প্যারালাল) অনুযায়ী উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজক সীমান্ত টানা হয়। দক্ষিণ কোরিয়া তখন কৃষি নির্ভর অত্যন্ত দরিদ্র এক দেশ - তার জাতীয় আয় দু বিলিয়ন ডলার। একনায়ক রাষ্ট্রপ্রধান পার্ক চুং হি বললেন আমাদের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হবে আগে, সাম্য স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদি ব্যাপার আপাতত মুলতুবি থাকুক। এখন আমরা গড়ি খামার। ভারতবর্ষের কাছ থেকে উন্নয়নের তরিকা জানার জন্যে ডেলিগেশান পাঠান - জাপান বাদে ভারত এশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে মোটর গাড়ি বানানো হয়, হোক না সে হিন্দ মোটরের অ্যামবাসাডর, চার চাকার গাড়ি তো। দেশের উন্নয়নের পথে কোন পন্থাই নিন্দনীয় নয় যদি তার মূল লক্ষ্য হয় বিকাশ - অতএব দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু ধনী পরিবারের সঙ্গে সরকারি আঁতাত হল। সরকার এঁদের অর্থ, অনুমতি, সকল সুবিধা দেবেন। তাঁরা দেশ গড়ুন, কোনো প্রশ্ন করা হবে না। সামগ্রিকভাবে এই পরিবারগুলিকে বলা হয় জেবল (আমির পরিবার/ ধনী গোষ্ঠী) যার মালিক ও পরিচালক হবেন সেই গোষ্ঠীর মানুষ। আমাদের টাটা বিড়লা আম্বানি আদানির মতন। সরকারি ব্যাঙ্কের খাজানা খুলে দেওয়া হল। অনাদায়ী ঋণের ব্যপারে কোনো প্রশ্ন করা হবে না - লাগে টাকা দেবে পার্ক চুং হি।
রবীন্দ্রনাথের শ্যামার পংক্তি ধার করে বলা যায় – ন্যায় অন্যায় জানি নে, জানি নে, জানি নে। তবে জানি গৃহযুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত এক দরিদ্র কৃষি প্রধান দেশ দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ বছরের মধ্যে এঁরাই বানিয়েছিলেন এশিয়ান টাইগার। তাদের কয়েকটিকে আপনারা ভারতে দেখেন – সামসুং, হুন্দাই, এল জি (আদি নাম লাকি গোল্ডস্টার, ১৯৯৫ সালে নামটি সংক্ষেপিত হয়)। দুর্নীতি, স্বজন পোষণ ও পুকুর চুরির কারণে হারিয়ে গেছে অনেক নাম - তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দে’উ, যার মালিক দশ বিলিয়ন ডলার হাপিশ ও কোম্পানিকে দেউলে করে (১৯৯৭) প্রথমে দেশত্যাগী হন, বর্তমানে জেলখানায় বন্দি।
কোরিয়ার সঙ্গে কাজাখের মেল বন্ধন ব্যাপারটা একেবারে অজানা ছিল। ব্যাঙ্কে কাজ করার এই মহা সুবিধে। নিখরচায়, অল্প আয়াসে জ্ঞান বাড়ে, তার সঙ্গে আবার বেতনটা মেলে ফাউ!
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্বে দেশের দুঃসহ দারিদ্র্য থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে কোরিয়ান চাষিরা অন্য কোথাও যেতে চাইছিলেন। যাবেন কোথা? একদিকে সমুদ্র, উত্তরে বিশাল চিন দেশ। কিন্তু মিং রাজারা অবাঞ্ছিত হাঘরে বিদেশিদের দূরে রাখার জন্য তাঁদের সীমান্ত সিল করে রেখেছেন, ট্রাম্প সাহেবের মেক্সিকান আটকানোর দেওয়াল তোলার মত। তবে চিনের প্রাচীর আরও শক্ত পাথরে তৈরি। রাস্তা খুলে গেল ১৮৬০ সালে, যখন চিন তাদের পুবের প্রত্যন্ত এলাকা পিমরস্কি ক্রাই রাশিয়ান জারের হাতে তুলে দেয় - সেখানে আর চীনা নিষেধাজ্ঞা খাটে না। সে খবর জানা মাত্র হতদরিদ্র কোরিয়ান চাষি তাদের বাক্স-প্যাঁটরা-ছাগল-গরু সমেত হাঁটতে শুরু করেন পুবের পানে। যেখানে গিয়ে তাঁরা থামলেন, সেখানকার বড়ো শহরের নাম ভ্লাদিভস্তক (পুবের প্রভু), জনসংখ্যা চার হাজার! আজও সেখানে কোরিয়াস্কায়া (পথ) আছে! ঠিক এই সময়ে ইংরেজের উৎপাতের কারণে আফ্রিকানাররা বলদের গাড়িতে চড়ে কেপ থেকে ট্রান্সভাল যাত্রা (গ্রেট ট্রেক / ঘ্রটে ত্রেক) করছেন, পথ দুর্গম, সম্পূর্ণ অজানা, দূরত্ব প্রায় সমান।
এমনি করেই খাচ্ছিল কোরিয়ান চাষি মাছ ধরে আর বীজ বুনে।
নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বিঘ্নিত হল সত্তর বছর বাদে। নাট্যমঞ্চে আবির্ভূত হলেন ইস্পাত মানব, স্তালিন।
সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তকরণের ঘটনাটি আমাদের ভাষাকে একটি উপমা উপহার দিয়েছে - তুঘলকি কাণ্ড। ইধর কা মাল উধর অনেকেই করে থাকেন। মানুষ, মালপত্র সমেত ইধর কা শহর উধর করে দিয়ে ইতিহাসে যে অতুলনীয় স্থানটি সুলতান তুঘলক অধিকার করেছেন তার একমাত্র তুলনা স্তালিন। মানুষ, ব্যবসা, কারখানা, গোরু, ছাগল, ক্ষেপণাস্ত্র - যে কোনো মানব গোষ্ঠী বা বস্তু সমগ্রকে এক সপ্তাহের নোটিসে হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজটা তিনি একটা সিগারেট ধরানোর মতন সহজ করে ফেলেছিলেন। সেটি কখনো সাধিত হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের, কখনো বা আভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার নামে।
১৯৩৭ সালে স্তালিন সীমান্ত শুদ্ধির ডিক্রি জারি করলেন। কোরিয়া তখন জাপানি উপনিবেশ। বহু কোরিয়ান বাস করে জাপানে। তাঁদের সঙ্গে সাইবেরিয়ান কোরিয়ানদের কি সম্পর্ক বোঝা মুশকিল। কোথাও কোনো গুপ্তচর হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের সার্বিক সংহারের প্ল্যান ফাঁদছে। অতএব সকল কোরিয়ানকে পিমরস্কি ক্রাই থেকে অনেক দূরে পশ্চিমে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। শুরু হল ঝাড়ে বংশে কোরিয়ান নির্বাসন, এবার সরকারি খরচায়, ইকনমি ক্লাসে - গরু ভেড়ার ট্রেন বা ক্যাটল কার সহযোগে তাঁদের পাঠানো হল পশ্চিম দিকে, যেমন কাজাখস্তান, তুরকিস্তান, কিছু আরও দূরে - সাইবেরিয়ান শীত থেকে মুক্তি জুটলেও এই যাত্রায় মারা গেলেন অনেক। ১৯৪৫ সালের মধ্যে কোরিয়ান ভাষায় লেখা পড়া দূরে থাক, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পড়ানো বেআইনি হল।
স্তালিনের সামগ্রিক জনযাত্রানাট্য আগে ও পরে দেখা গেছে - ১৯৩০-৩৭ সালে দশ লক্ষ যৌথ খামার প্রকল্পের বিরোধী কুলাককে উচ্ছেদ করে পশ্চিম থেকে পুবে পাঠানো হয়। পাঁচ লক্ষ ভোলগা জার্মানকে ১৯৪১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোলগা নদীর তীর থেকে সাইবেরিয়ার তুষার নদীর তীরে পৌঁছে দেওয়া হয় সেই একই প্রকারের রেল ওয়াগনে (পথে পঞ্চাশ হাজার মারা যান)। সেটি দেশের নিরাপত্তা কায়েম রাখার আন্তরিক সদিচ্ছায় - দু-মাস আগে নাৎসি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নে হানা দিয়েছে। এখন যদি ভোলগা জার্মানরা আপন জাতভাইদের সঙ্গে হৃদ্যতা করে সে লড়াইয়ে তাঁদের পক্ষ নেন!
রুলস রেস্তোরাঁর লাঞ্চ থেকে এক অর্থায়নের পরিকল্পনা জন্ম নেয়; সেখানে আমাদের সেওল শাখা মূল চরিত্রে অবতীর্ণ হল। সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডনের ভাগ্যে জোটে কাঠবেড়ালির সীমিত ভূমিকা। তাতে কী? এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি ডিল। সিটি ব্যাঙ্ক ছেড়ে এসেছি অনেক দিন। দে’উ নিক্ষিপ্ত হয়েছে কর্পোরেট আস্তাকুঁড়ে কিন্তু কোরিয়ান ব্যবসা কাজাখস্তানে ক্রমবর্ধমান। সামসুং ইলেকট্রনিক, শিনহান, পসকো, হুন্দাই গাড়ি থেকে শুরু করে প্রায় সকল বৃহৎ কোরিয়ান কোম্পানি আজ কাজাখস্তানে ছয় বিলিয়নের বেশি ডলার লগ্নি করেছে।
পঞ্চাশ বছর বাদে সাইবেরিয়া থেকে নির্বাসিত সেই কোরিও-সারামের অনেকে আজ কাজাখস্তানে সুখে ঘরকন্না করেন, স্বচ্ছন্দ রাশিয়ান ও কাজাখ বলেন। ভাষার ওপরে সোভিয়েত কুলুপ লাগানো ছিল দীর্ঘদিন, ফলে তরুণ প্রজন্মের কোরিয়ান হয়তো দুর্বল। ১৯৯১ সালের স্বাধীনতার পরে কোরিয়ান ভাষা শেখা বা চর্চার ওপরে কাজাখ সরকার কোনো বাধানিষেধ আরোপ করেননি বরং প্রোৎসাহিত করেছেন দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের একান্ত সহযোগিতায়।
কাজাখস্তানের কোরিও-সারাম আজ বাড়িতে এবং অফিসে বসেদের একই ভাষায় বাক্যালাপ করেন!
সরল রেখায় সুরক্ষিত শহর
আমাদের স্কুলের বইতে এ শহরের নাম ছিল আলমাআতা। স্বাধীনতার পরে নামটি বদলে হল আলমাতি। কোথাও খুঁটি গাড়তে অনিচ্ছুক ভ্রাম্যমাণ কাজাখ জনতা একদিন বাক্স-বিছানা সংরক্ষণের স্থায়ী জায়গা খুঁজে নিল। মহান অক্টোবর বিপ্লবের পরে বহু রাশিয়ান ততদিনে ঢুকে পড়েছে বিশেষ অনুমতি না নিয়েই। ১৯২৮ সালে লেভ ডাভিডোভিচ ব্রণসটাইন এই শহরে নির্বাসনে প্রেরিত হন, যাকে আমরা লেওন ট্রটস্কি নামে চিনি। আলমাআতার পরে তিনি সোভিয়েত সীমানা হতে চিরতরে নির্বাসিত হলেন। ১৯৩৬ সালে কাজাখ জনগণ মহান সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি অনুযায়ী যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে হত্যালীলা শুরু হল তার নজির সোভিয়েত আমলে অসংখ্য। তাবৎ কাজাখ বুদ্ধিজীবী, লেখক ও শিল্পী একই সঙ্গে পরমগতি প্রাপ্ত হলেন। সরকারি মতে এঁরা সোভিয়েত-কাজাখ মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করছিলেন, তাই দেশের স্বার্থে এঁদের নির্মূল উচ্ছেদ করাটাই যথার্থ পদক্ষেপ। যেমন লিথুয়ানিয়া লাটভিয়া এষ্টোনিয়াতে বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল সোভিয়েত মতে যুক্তিযুক্ত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্পবাণিজ্য ইউরোপীয় রাশিয়া থেকে আপাত নিরাপদ এশিয়ান আলমাআতায় নিয়ে আসেন। ভোলগা জার্মানদের পাঠানো হল পশ্চিম থেকে পূর্বে। কোরিয়ানদের পুব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে। জনতা এবং জীবনকে সর্বদা সচল রাখার প্রকৃষ্ট পদ্ধতি।
আজকের আলমাতি এক সোভিয়েত সৃষ্টি। মূল শহরে সব রাস্তা চলে সরল রেখায়, নিউ ইয়র্কের অ্যাভেন্যু আর স্ট্রিটের মতন ওই কাটাকুটি খেলা। গ্রিড সিস্টেম। চলে যান নাক বরাবর বলে যে কথা আমাদের দেশে চালু আছে সেটি এখানে ষোলো আনা প্রযোজ্য। শহরের কেন্দ্র ছাড়িয়ে বাইরে অভিক্ষেপ করলেও প্রায় তাই। আঁকাবাঁকা কোনো পথ সুদূরে যায় না। যদিও বা ইতিহাসে এমন কোনো বেয়াড়া পথ থেকে থাকে, স্তালিনের বুলডোজার সে সমস্যা মিটিয়ে দিয়েছে।
কাজবেক স্ট্রিট তেমনি একটা রাস্তা, যেমনটি দেখবেন আলমাতি শহর জুড়ে। প্রতিটি রাজপথের দু-পাশে বৃক্ষের সৈন্য বাহিনী শহরকে সবুজে মুড়ে রেখেছে। কাজবেক চলে যায় দূর - অতিদূর এক সরল রেখায়। কোথায় যে শেষ হয়, কে জানে! দিগন্তে কক তোবে পর্বতের রেখা। এই পথে পড়ে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি অর্থোডক্স গিরজে জেনকোভ ক্যাথেড্রাল - বিশ্বের অন্যতম উঁচু কাঠের বাড়ি, যেখানে একটি পেরেক অবধি ঠোকা হয়নি, দুটো ভূমিকম্প সামলে একশো বছর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পার্কের অন্য দিকে পানফিলোভ স্মৃতিসৌধ। কথিত আছে জেনারাল ইভান ভাসিলিয়েভিচ পানফিলভ ১৮ নভেম্বর ১৯৪১ সালে ৩১৬ নম্বর রাইফেল ডিভিশনের ২৭ জন সৈন্য নিয়ে মস্কো শহরের কাছে প্রায় হাতাহাতি যুদ্ধে আঠাশটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে জার্মানদের অগ্রগতি রুখে দেন। কেউ বেঁচে ফিরে আসেননি। সেই আঠাশ জন বীরের সম্মানে এই সৌধ। তাঁর শৌর্যগাথা নিয়ে ছবি হয়েছে - ‘পানফিলভের ২৮জন মানুষ'। শালোপা এবং দ্রুঝিনিন পরিচালিত এই ছবি মুক্তি পায় সেই যুদ্ধের ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে।
একটি সম্পূর্ণ অনাবশ্যক ফুটনোট এই, যে, রাশিয়ানরা নিজেরাই খোঁজখবর করে এমন কোনো বীরত্বের রেকর্ড খুঁজে পাননি। স্টেট সিক্রেটকে অবজ্ঞা করে সর্বসমক্ষে জানানো হয়েছে, যে, কথিত আঠাশ জন পরমগতি প্রাপ্ত বীরবৃন্দের অনেকেই পরিণত বয়েস অবধি বেঁচে ছিলেন। এইরূপ সংশোধনবাদি ইতিহাসকে উপেক্ষা করে সেই বীরবৃন্দ প্রস্তরীভূত হয়ে পানফিলোভা পার্কে দাঁড়িয়ে আছেন। থাকবেন।
গল্প অনুযায়ী পানফিলভ এবং তাঁর সাথীরা নাৎসি জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন সোভিয়েত মাতৃভূমি রক্ষার্থে।
এই পার্কে আরেকটি স্মৃতি সৌধ আছে। সেটি সম্মান জানায় সকল কাজাখ সৈন্যদের যারা প্রায় দশ বছর ব্যাপী আফঘানিস্তান দখলের যুদ্ধে (১৯৭৯-১৯৮৯) প্রাণ হারিয়েছেন। এই বিফল যুদ্ধের অনেক স্মারক আছে আজকের রাশিয়াতে- যেমন ইয়েকাতেরিনবুরগের কালো টিউলিপ। যে পরিবহন হাওয়াই জাহাজে (এ এন ১২) তাঁদের দেহ সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরিয়ে আনা হয় তার মুখ চলতি নাম ছিল কালো টিউলিপ।
পানফিলভ পার্ক থেকে বেরুলেই কাজবেক স্ট্রিট। সিটি ব্যাঙ্কের অফিসে পুরনো পরিচয়ের খাতিরে ঢুঁ মারা গেলো। সামনে ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার বিশাল বাড়ি।
কক তোবে (নীল পাহাড়) আলমাতির অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থল। আলমাতি গেছেন আর কক তোবে চড়েননি শুনলে লোকে ছ্যা ছ্যা করবে। প্রায় দেড় হাজার ফিট উঁচুতে গাড়ি অথবা কেবল কারে পৌঁছুতে পারেন। আবহাওয়া ভালো থাকলে বহুদূর অবধি দেখা যায়! চার পাশে বনানী, হ্রদ, হেঁটে বেড়াবার অফুরন্ত অবকাশ, সপ্তাহান্তে বিপুল জনসমাবেশ। স্কিইং সেন্টার। পার্কে মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি অভিযান স্টাইলের স্ট্যাচু, ২০০৭ সালে স্থাপিত।
অনুষ্ঠানের হোতা, বিটিএ ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ সর্বদা সদলবলে সেখানে নিয়ে গেছেন, সেটা আমার একক যাত্রার কালে দেখে ফেলেছি বলে এড়ানো যায়নি। তাঁরা মনঃক্ষুণ্ণ হবেন।
আলমাতি আমার দেখা সবচেয়ে নিরাপদ রাজধানী শহর। মনে আছে এক সন্ধেয় আমাদের সরকারি গাড়ির অপেক্ষা করছি ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সামনে। দেখি রাস্তার অপর পারে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা চলন্ত গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছেন। রাস্তা অতীব প্রশস্ত। গোটা শহরেই। তাদের পাশে বোধ হয় আরও এক পরিবার দাঁড়িয়ে। বাবা মা একটি ছেলে। ভিলনিউস ব্যাঙ্কের আরতুরোস ছিল আমার সঙ্গে। আজ সন্ধ্যেয় আমাদের হোতা বি টি এ ব্যাঙ্কের নানান মনোরঞ্জক অনুষ্ঠান আছে। ফিরতে দেরি করা যায় না!
আরতুরোসকে বললাম, ‘এখানে কি ট্যাক্সি মেলে না? এঁরা কেন গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছেন?’
তার এ শহরে আসা যাওয়া আছে। আরতুরোস বললে ‘তোমার কী মনে হয়? এঁদের কতক্ষণ লাগবে একটা গাড়ি ধরতে?’ আমি বললাম, ‘এই ভর সন্ধেবেলা, ব্যস্ত ট্রাফিক। কে থামবে! তাছাড়া নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকে যায় না কী?’
আরতুরোস বললে, ‘দেখতে থাক। পাঁচ মিনিটের বেশি যদি লাগে, হোটেলে ফিরে গিয়ে আমার পয়সায় বিয়ার খাওয়াব। কৌতূহল বেড়ে গেল। বিয়ারের জন্য নয়। সপরিবারে পরায়া গাড়িতে কারো লিফট পাওয়া অসম্ভব মনে হচ্ছিল। তিরিশ বছর আগে জার্মানিতে হাত দেখিয়ে লিফট জোগাড় করার ভীষণ চল ছিল। নিজে করেছি। তবে সেটা অটোবানে। শহরে নয় -সেখানে সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা আছে, আমেরিকার মতন নয়। কথ্য জার্মানে বলা হয়, বুড়ো আঙ্গুল (প্যার দাউমেন) দেখিয়ে সফর করা। নিরাপত্তা পরিস্থিতির অনিশ্চয়তার কারণে হয়তো জার্মানিতে এই যানযাত্রার পদ্ধতি প্রায় বিলীন এখন।
দু-মিনিটের ভেতর একটা গাড়ি থামল। তার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে আরেকটা। সেই দম্পতি এবং অন্য পরিবার উঠে গেলেন। ওঠার আগে হয়তো কিঞ্চিত বাক্যালাপ হয়েছে। কে কোন দিকে যাবে আর সে গাড়ি দুটির চালকই বা কোনদিকে যাবে সে আলোচনা একান্ত স্বাভাবিক।। তখন প্রায় রাত আটটা বাজে। মনে পড়ে যায় মেট্রো সিনেমার সামনে থেকে একটু বেশি রাতে ট্যাক্সি করে পাইকপাড়া ফেরার ব্যর্থ প্রয়াস। হলুদ ট্যাক্সি শুধু ‘ভওয়ানিপুর জায়েগা'।
এটা কি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাকি দেখা যায় শুধু এই বড় রাস্তার ওপরে? আরতুরোস বললে সে প্রথমবার দেখে অবাক হয়েছিল। তার আপন দেশে এটা অকল্পনীয়। আলমাতিতে চালু প্রথা। নিরাপত্তার কোনো ব্যত্যয় হবে না। আপনি যে কোনো সময়ে শহরের যে কোনো পথে যে কোনো গাড়িকে হাত দেখাতে পারেন। সে থামবে, গাড়িতে জায়গা না থাকলে দুঃখপ্রকাশ করবে। আপনার গন্তব্যস্থল যদি তার যাত্রা পথের সঙ্গে না মেলে, সে খানিকটা এগিয়ে দেবার প্রস্তাব দেবে। অথবা আপনি পরের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করবেন। দারা-পুত্র-পরিবার সকলের জন্য এই ভ্রমণ ব্যবস্থা উন্মুক্ত। এখানে কোন মূল্য ধরে দেওয়ার প্রথা আছে কিনা সেটা আরতুরোসের অজ্ঞাত – আমারও জানা হয়নি। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মানুষের প্রতি এবম্বিধ স্নেহ ও করুণা সহকারে গাড়ির দরোজা খুলে দেওয়াটা কি আমরা লন্ডন নিউ ইয়র্ক ফ্রাঙ্কফুর্ট কেপ টাউন মুম্বাই এমনকি টোকিওতে দেখতে পাব?
আরতুরোস মৃদু স্বরে বললে, ওসব দেশ তো দেখিনি। তবে আমার শহর ভিলনিউসে কেউ থামবে না জানি।
পু: বন্ধুবর্গের কাছে খবর নিয়ে জেনেছি, এই প্রকার মানবিকতার অভিব্যক্তি বর্তমানের আলমাতিতে বিরল।