হেলসিঙ্কির এসপ্লানাদিতে বসে পিরকোকে কথা দিয়েছিলাম –দেখা হোক আগামী গ্রীষ্মে, অনেক উত্তরে। সুমেরু বৃত্ত ছাড়িয়ে, যেখানে শুধু শান্ত নীরবতা খেলা করে হ্রদের ঢেউয়ে। দিন নেই রাত নেই, সূর্যদেব করুণা বর্ষণ করেন অকৃপণ।
সুযোগ এসে উপস্থিত হল একান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে।
নিয়মিত নরডিকে চক্কর কাটি। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ সিটি ব্যাঙ্কের বাঞ্ছিত হাওয়াই রথ।।কিন্তু আমার পছন্দের বাহন তিনটি দেশের মিলিত বিমান প্রয়াস, এস এ এস (স্ক্যানডিনেভিয়ান এয়ারলাইন্স সিস্টেম)। লন্ডন হতে অসলো, স্টকহলম যাওয়া যায় ব্রিটিশ বিমানে কিন্তু আমার কাজ সেখানে শেষ হয় না। অসলো থেকে বেরগেন, স্টাভাঙ্গার বা ত্রন্দহেম অথবা স্টকহলম থেকে গোয়েটেবর্গ যেতে হলে এস এ এস ভরসা।
বিদ্যা বিষয়ে বলা হয় যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। পৃথিবীর যাবতীয় বিমান সংস্থা সেই রূপ এক প্রকল্প প্রস্তুত করেছেন তার নাম ফ্রিকুয়েনট ট্রাভেলার (নিয়মিত ভ্রমণকারী) প্ল্যান – আপনি সেই এয়ারলাইনে যত বেশি ভ্রমণ করবেন আপনার খাতায় তত জমা হবে এয়ার মাইল সেটি আপনার। এয়ার মাইল দেয় সম্পূর্ণ মুফতে সেই কোম্পানির হাওয়াই জাহাজে যত্র তত্র সফর করার স্বাধীনতা। নিরন্তর নরডিক আসা যাওয়ার ফলে আমার ভাঁড়ারে বেশ কিছু ধন সঞ্চিত হয়েছে। এই সম্পদের আয়ু সীমিত (সব এয়ারলাইনের নয়- ব্রিটিশ এয়ার বা লুফতহানসার এয়ারমাইল অমর)। একদিন এস এ এসের চিঠি পেলাম- আমার স্তূপীকৃত এয়ারমাইলের একটা অংশ সামনের জুলাই মাসের মধ্যে খরচা না করলে তামাদি হয়ে যাবে। ব্যাঙ্কের কাজে এ ধন অর্জন করেছি কিন্তু সে ধন ব্যবহার করে ব্যাঙ্কের কাজ করার সদিচ্ছা আমার নেই। জানতে চাইলাম আমার জমানো এয়ারমাইল দিয়ে কতদূর যাওয়া যায়। টেলিফোনের অপর প্রান্তের মহিলা বললেন এই ধরুন ইকনমি ক্লাসে লন্ডন হতে কাইরো, তেল আভিভ, মস্কো, ইস্তানবুল অথবা। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম স্ক্যানডিনেভিয়াতে কতদূর যেতে পারি? তিনি একটু অবাক হলেন। তারপর হয়তো অঙ্ক কষে জানালেন 'নরওয়ের কিরকেনেস আমাদের শেষ সীমা। রুটিং হবে লন্ডন -অসলো – ত্রমসো- কিরকেনেস। ত্রমসোতে কয়েক ঘণ্টা, সব মিলিয়ে বারো। যাবেন?'
একটু সময় চেয়ে নিলাম। কাল ফোন করব।
একদিন সুমেরু বৃত্ত অতিক্রম করে সার্টিফিকেট পাবার অভিলাষে ট্রেনে বাসে চড়ে ফিনল্যান্ডের রোভানিয়েমি গেছি -ষ্টেট ব্যাঙ্কের কাজ ফুরুলে দেশে গিয়ে গল্প করব বলে। সে কতকাল আগের কথা। এবার যাবো সেই বৃত্তের চারশ কিলো মিটার উত্তরে- কিরকেনেস, নরওয়ের পূর্ব সীমান্ত। লন্ডন থেকে আড়াই হাজার কিলো মিটারের উড়ান দূরত্ব। পিরকোকে বললাম দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে কিরকেনেস এসো। তিনটে দেশ এসে এই এক বিন্দুতে মেলে। তিনটে দেশের ঘড়িতে তিন রকম সময়। নরওয়েতে অন্তহীন দিন দেখব, ফিনিশ হ্রদে স্নান এবং সীমানা পেরিয়ে রাশিয়া যাবো।
যদিও সে আমার নানান অবিমৃশ্যকারিতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত ছিল, এটি অনেক উচ্চ মাত্রার।
পিরকো হোলাপ্পা ফিনিশ। ফিনল্যান্ডে বাণিজ্য যাত্রার সূত্রে পরিচয়, তা থেকে ঘনিষ্ঠতা। থাকতো হেলসিঙ্কির নিকটবর্তী ভানতায় (গ্রামের বাড়ি পুওলাঙ্কা)। সেখান থেকে কিরকেনেস এগারশ কিলো মিটার খাড়া উত্তরে, প্রায় কলকাতা-দিল্লি। উড়ে যেতে গেলে দুবার বিমান বদল করতে হয়, খরচ অনেক। ট্রেনে কেমিয়ারভি (সান্টা ক্লসের ঠিকানা রূপে পরিচিত) তারপর বাস যোগে এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়, সেটা প্রায় বাইশ ঘণ্টার ধাক্কা। স্ক্যানডিনাভিয়া এবং ফিনল্যান্ডের প্রকাণ্ড আয়তন ও বিস্তার পশ্চিম ইউরোপে খুব কম মানুষের বোধগম্য হয়। অসলো হতে কিরকেনেস হাওয়াই দূরত্ব কলকাতা -মুম্বাইয়ের সমান, দক্ষিণে ক্রিস্টিয়ানসান থেকে কিরকেনেসের দূরত্ব সিমলা থেকে চেন্নাই সমতুল। ফিনল্যান্ডের কেমিতে ট্রেন বদল করে সুইডেনের হারপারানডা থেকে মালমো গেছি স্থলপথে, ট্রেনে – সে দূরত্ব প্যারিস-রোমের দেড় গুণ। একই দেশে!
আমার এই চমকপ্রদ প্ল্যানিঙের কোন সমালোচনা না করে পিরকো মৃদু কণ্ঠে বলল মনে রেখো রাশিয়ান ভিসা লাগবে! আমি বললাম ঠিক। সেটার ব্যবস্থা তোমাকে আমাকে করতে হবে আলাদা! তাহলে ওই কথাই রইল। দেখা হবে কিরকেনেস বিমান বন্দরে! আর্কটিকা বলে একটা হোটেলের খবর পেয়েছি। তাদের একটা টেলেক্স পাঠিও যাচ্ছি বলে। বুক করো না। আর শোনো এক সপ্তাহের জন্যে একটা গাড়ি ভাড়া করে রেখো।
ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। পথে ত্রমসোতে থামা। এই সেই শহর যেখানে কিছু মানুষ চব্বিশ ঘণ্টার মাপে সময়ের হিসেব রাখার প্রয়াসকে বিসর্জন দিতে চান- সেতুর রেলিঙে বেঁধে গেছেন হাতের ঘড়ি। কিরকেনেস পৌঁছুতে সরকারি হিসেবে সন্ধ্যে, আকাশে ঠা ঠা রোদ্দুর। ছোট্ট হাওয়াই আড্ডার বাইরে পিরকো দাঁড়িয়েছিলো। আমার হাতে চাবি তুলে দিয়ে বললো আভিস কোম্পানির গাড়ি পেয়েছি, একটা শর্তে।
- সেটা কি?
- এই নরওয়েজিয়ান নাম্বার প্লেটের গাড়ি ফিনল্যান্ডে চালানো যাবে। রাশিয়ায় নয়। সেখানে যদি গাড়ি চুরি বা ভাঙ্গচুর হয়, ইন্সিউরেন্স এক পয়সা দেবে না।
গত বছর বার্লিনে গাড়ি ভাড়ার নেওয়ার সময় আভিস কোম্পানি বলেছিল একমাত্র ফোরড বাহন নিয়ে পোল্যান্ড যেতে পারি - অন্য কোম্পানির নয়, চুরি হয় বলে। এখানে দেখি যে কোনো গাড়ি নিয়েই রাশিয়া যাওয়া হারগিজ মানা।
- আচ্ছা সে না হয় কাল ভাবা যাবে। এখন কোথায়?
- মিলিস ওভারনাটিং, সেখানে রাত্রিবাস। তোমাদের দেশের ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের নরওয়েজিয়ান নাম! যিনি চালান তাঁর নাম মিলি!
দু হাজার অধিবাসী নিয়ে কিরকেনেস (সঠিক নরওয়েজিয়ান উচ্চারণ শিরকেনেস – শিরক মানে গিরজে, শিরকেনেস- গিরজের অন্তরীপ) তখন একটি গ্রাম।এই শতাব্দীতে শহরের সম্মান পেয়েছে। বিমান বন্দর থাকলেই কৌলীন্য বাড়ে না – নরওয়ের হাটে মাঠে প্লেন নামে, কারণ চিলির মতন লম্বা এই দেশে যাতায়াতের সেটাই একমাত্র উপায়। যেমন হাওয়াই জাহাজ ছাড়া আগরতলা থেকে কলকাতা আসা শক্ত।
জুলাই মাসের ঝলমলে দিন- সন্ধ্যে বা রাত সেখানে নামে না, যেমন একুশে নভেম্বর থেকে দু মাস সূর্যের মুখ দেখা যায় না। ভারাঙ্গার ফিওরডে ক্রুজ কোম্পানির জাহাজ নোঙ্গর ফেলেছে। গানে গিটারে পথ বাঙময়। পরদা টেনে কৃত্রিম অন্ধকারে ঘুমনো গেল এক সময়ে।
ঘরের ভেতরে হাতি (এলিফ্যানট ইন দি রুম) – এই রূপক অভিব্যক্তি আজকাল খুব শোনা যায়, তার মানে আমাদের সামনে একটা বিশাল সমস্যা, যার বিষয়ে আলোচনা মুলতুবি রয়েছে। ব্রেকফাস্টের সময়ে সেই হাতিটি বেরিয়ে পড়লো। পিরকো বললে 'আভিস যে মানা করেছে রাশিয়া যেতে? তাহলে কি হবে? আমরা কি যাবো? উচিত হবে?’
একটি অতিরিক্ত আশঙ্কা আছে। গাড়ি পিরকোর নামে নেওয়া। আমাদের এই রাশিয়ান অভিযানে গাড়ি চুরি বা ভাঙচুর হলে পুরো খরচা তার ঘাড়ে পড়বে। নৈতিক এবং আর্থিক সহায়তা দিতে অবশ্য আমি যে পিছপা হব না সে বিষয়ে তার মনে কোন সংশয় থাকার কথা নয়।
মিলি কখনো কোনো ভারতীয় দেখেন নি, সঙ্গে আবার ফিনিশ মহিলা! ব্রেকফাস্টের টেবিলে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে বসে গেলেন, ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ। জানাতে হল শুধু এক রাত্রির থাকা, আপাতত রাশিয়া যাবো, ফিরে এসে দু দিন নরওয়ে তারপর ফিনিশ লাপল্যান্ড। অবাক হলেন একটু। বললেন 'আপনারা খুব ঘোরেন! কিরকেনেসে গরম কালে অনেকে আসেন মাঝ রাতের সূর্য দেখতে, ভারাঙ্গার ফিওরডে নিয়মিত ক্রুজ শিপের ভেঁপু বাজে! আবার শীতকালে তাপমান শূন্যের তিরিশ ডিগ্রি নিচে চলে যায়, প্রতি বছর নতুন করে তৈরি হয় স্নো হোটেল। সে সময় এলে দেখবেন অরোরা বরেয়ালিস, উত্তরের আলোয় আকাশে জাদুর খেলা'। কিরকেনেস ছোটো গ্রাম, কিন্তু যুদ্ধের ইতিহাস দীর্ঘ। পুরো চার বছর নাৎসি অধিকারে ছিল নরওয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা ইউরোপের মধ্যে প্রতি ইঞ্চি বা সেন্টি মিটার মাপে সবচেয়ে বেশি বোমা পড়েছে এই গ্রামে – এলভে নদীর ওপারে দাঁড়ানো সোভিয়েত লাল ফৌজের সঙ্গে নাৎসি জার্মানির শেষ লড়াই।
সোভিয়েত বাহিনি তাদের তাড়ায় অক্টোবর ১৯৪৪। সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর যোদ্ধাদের স্মরণে নরওয়েজিয়ানরা স্থাপনা করেছে এক স্ট্যাচু, তার একদিকে নরওয়ের অন্যদিকে রাশিয়ার পতাকা ওড়ে। হয়তো পশ্চিম ইউরোপে একমাত্র সোভিয়েত স্মারক (বার্লিনের বেদি বা ভিয়েনার রাশিয়ান ফোয়ারাকে নাগরিকরা কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে বানান নি সেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়ন বানিয়েছিল)। মিলির কথার সুরে বোঝা যায় রাশিয়ার সঙ্গে এঁদের একটি ভাব ভালবাসার পুরনো সম্পর্ক আছে যা আমি অন্যত্র দেখি নি। যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড একদা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে সুপরিচিত ছিল, দেড় বছর আগে সেটি খণ্ড খণ্ড হয়ে পনেরোটি আলাদা দেশে পরিণত হয়েছে। সীমান্তের ওপারের দেশটির নাম এখন রাশিয়া। কিরকেনেস তথা সর ভারাঙ্গার কমিউনের মানুষদের সে দেশে যাতায়াতের সুবিধে বেড়েছে, যদিও ভিসা মকুব হয় নি। জানালাম লন্ডনে ভিসা পেতে শুধু ছবি সহ দরখাস্ত নয়, রাশিয়ান এমবাসিতে রীতিমত ইনটারভিউ দিতে হয়েছে (একমাত্র আইভরি কোস্ট ভিসার জন্য সাক্ষাৎকার সহ আঙ্গুলের নিশানি দিতে হয় তাদের লন্ডন দূতাবাসে)। হেলসিঙ্কিতেও তার ব্যত্যয় হয় নি।তিনি ধরে নিয়েছেন এই গাড়ি নিয়েই রাশিয়া যাচ্ছি।
মিলির কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। রাস্তায় সাইনবোর্ড – এই পথে রাশিয়ান সীমান্ত। একবার সেদিকে তাকিয়ে বললাম, - তোমার কাছে পেতসামোর গল্প শুনেছি। চলো এবার তোমাদের হারানো দেশ গ্রাম চোখে দেখবে আর সেই সঙ্গে পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের শেষ বন্দর - মুরমানসক! দেখো আমরা এ গাড়ি ঠিক ফিরিয়ে আনবো!
পিরকো বললে, চলো, যা হবার হোক। সিসু কথাটা শুনেছ কখনো? আমি তাতেই বিশ্বাসী!
সিসু একটি ফিনিশ শব্দ। সেটা বিশেষ্য না বিশেষণ জানি না। তবে এর সঠিক অনুবাদ সম্পর্কে বিতর্ক আছে। সিসু একটা প্রত্যয়, যার অর্থ সকল সঙ্কট, বাধার মুখোমুখি হয়ে তার মোকাবিলা করা, ফলের কথা চিন্তা না করে সঙ্কল্পের দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে চলা। এদিকে ওদিকে পিছন ফিরে তাকানো নয়। সিসুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেবার প্রচেষ্টায় অনেক ফিনিশ গুণী ব্যক্তি কেতাব লিখে ডক্টরেট পেয়েছেন।
পরিচিত জনের কাছে সুমেরু বৃত্ত ছাড়িয়ে রাশিয়ান অরণ্যের অনিশ্চয়তায় আমাদের এই যাত্রার গল্প করেছি। আজ অবধি ফিনিশ নরওয়েজিয়ান রাশিয়ান এমন কাউকে আমি পাই নি যিনি এ পথে গেছেন অথবা এই অঞ্চল সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত ধারনা আছে। আমার বাহাদুরির গল্প শুনে মস্কো, সোচিতে আমার আপাদ মস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে অন্তত দু জন রাশিয়ান বলেছেন, কি করে গেলেন? একা? কেনই বা গেলেন? সুস্থ দেহে ফিরেছেন সেটা আপনার ভাগ্য!
পুব দিকে রাশিয়ান স্থল সীমান্ত এলভেনেস, মাত্র আট কিলোমিটার। ৫৩ নম্বর বাস যায় সে অবধি। উত্তরে জল পেরুলে আরেক রাশিয়ান চৌকি। সামনেই পড়লো সেই গিরজে যার নামে রাস্তার নাম এবং পরে শহরের নাম। এই গিরজে যেন একটি অন্তরীপ। সেখানে নেমে পেন্নাম ঠোকার ইচ্ছে হল না।
তাহলে এবার রাশিয়া?
অনেক দিনের গল্প শোনা সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার যাওয়া হল না। তাতে আর কি। যারাই সে দেশে গেছেন রাশিয়ার চিঠি লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিনপঞ্জি দেখেছি বলে মনে পড়ে না!
অকারণে টমাস মানের ভেনিসে মৃত্যু (টোড ইন ভেনেডিগ) উপন্যাস মনে পড়ল। তিনি লিখেছিলেন ট্রেনে করে ভেনিসে আসাটা খিড়কি দুয়োর দিয়ে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করার মতন। ভেনিসে আসতে হয় একমাত্র সমুদ্র পথে। আর আমরা রাশিয়া যাচ্ছি বনপথে!
কিরকেনেস ছাড়ার পরে বাঁ হাতে পরের পর তিনটে হ্রদ। মিনিট পনেরোর মধ্যে এলভনেস গ্রাম পেরিয়ে পাইন বনের মধ্যে একটা কাষ্ঠ কুটির চোখে পড়লো। নরওয়ের পতাকা উড়ছে। বিশালাকৃতি দাড়ি ওলা এক ব্লনড নরওয়েজিয়ান প্রহরী তার জানলায় বসে আছেন। সামনে পেছনে কোন গাড়ি নেই। হাত বাড়িয়ে পাসপোর্ট দুটো এগিয়ে দিলাম। খুব মন দিয়ে পাসপোর্ট গুলো এবং আমাদের দুজনের মুখ ভালো করে দেখে নিয়ে তিনি ইংরেজিতে জানতে চাইলেন রাশিয়ার কোথায় যাবো।
গন্তব্য মুরমানসক শুনে জানতে চাইলেন কখনও সেখানে গেছি কিনা আর রাশিয়ান বলি কিনা। দুটো প্রশ্নের উত্তর "না" শুনে একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, গুড লাক! নরওয়ের নাম্বার প্লেট ওলা গাড়িটা আমাদের নয় কিন্তু গাড়ির কাগজ দেখতে চাইলেন না। যাক রক্ষে – আভিস কোম্পানিকে ফোন করলে তারা ট্রাক পাঠিয়ে গাড়ি ফেরত নিতো!
এবার নো ম্যানস ল্যান্ড। প্রায় ১০০ মিটার দূরে আরেকটা চৌকি। সেখানে একটা মাঝারি সাইজের কাঠের বাড়ি, রাশিয়ান পতাকা উড়ছে। একজন প্রহরী কাঠের গেট খুলে দিয়ে আমাদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করে ইঙ্গিতে ঢুকতে বলল। পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ করে তাকে একটা তালা লাগাতে দেখলাম। এখানে কি আরও কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে? হাত তুলে এগিয়ে যাবার আদেশ দিলো। সেই কাঠের বাড়িটি ডান পাশে রেখে গাড়ি চালালাম।
পিরকো উৎসাহিত হয়ে বলল রাশিয়া ঢুকে পড়েছি। আমি বললাম আমার মনে হয় না এটা রাশিয়ান সীমান্ত। সে বললে কেন রাশিয়ান পতাকা উড়ছে যে? আমি বললাম পাসপোর্টে ছাপ মারল না কেন?
খানিকটা নিচুতে নেমে তারপর আবার উঠে একটা রাস্তা চলে গেছে এক্কেবারে সোজা। সেটির শেষে একটা প্রকাণ্ড কারখানার মত শেড দেখা গেলো। রাস্তার দু পাশে এক ধরনের ঝোপ। কোথাও কোন মানুষের বসতি নেই। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তখন পেয়ে বসেছে আমাদের। আমি বললাম ওটা কি কোনো কারখানা? এমন বিজন বনে?
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একটি বিশাল কাঠের বাড়ির সামনে থামার নির্দেশ পেলাম। বোঝা গেলো এটি মানুষ পরীক্ষা করার কারখানা। তার চত্বরে কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ইউনিফরম ধারি পুলিশ ইঙ্গিতে আদেশ করল গাড়ি ছেড়ে অফিসে ঢুকতে। পাঁচ ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে যাব, আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হল বহু ভাষায় লিখিত একটি সাবধান বাণীর প্রতি। রাশিয়ান নরওয়েজিয়ান সহ সকল নরডিক, ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসি ভাষায় লেখা আছে: এই সীমান্ত চৌকিতে কোন প্রকার ঘুষ দান করা অথবা ঘুষ দান করার প্রচেষ্টা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। ছবি তুলতে গেলে রক্ষী বাধা দিলো। আমি পিরকোকে বললাম তার মানে এখানে টাকা দেয়া নেয়ার ব্যবসা চলে। সে চিন্তিত হয়ে বললে আমার কাছে তো রুবল নেই। আমি বললাম চিন্তা করো না। ওরা সানন্দে আমার ক্রোনার, পাউনড, তোমার ফিনিশ মার্কা নেবে।
বিশাল অফিস ঘর। একদিকে টানা লম্বা কাউনটার। তার পিছনে গম্ভীর মুখে সারি সারি ইউনিফরমধারি অভিবাসন পরীক্ষক। ডজন খানেক জীর্ণ সোফা। সেখানে কাকের মত হা পিত্যেশ করে বসে আছেন ট্রাক ড্রাইভাররা। চেয়ার নেই কোথাও। কেহ স্বতন্ত্র বসিও না! চায় পানির কোন বন্দোবস্ত নেই। জানলা দিয়ে যতদূর দেখা যায় কেবল ঘন পাইন বন।
ডাক পড়ল আধ ঘণ্টার মধ্যে। পরীক্ষকের কপালে ভ্রুকুটি। স্বাভাবিক। পিরকোর ফিনিশ পাসপোর্ট। আমার জন্ম ভারতে। হাতে ব্রিটিশ পাসপোর্ট। গাড়ি নরওয়েজিয়ান। কোন ভাষা সমীচীন হবে না বুঝে ইংরেজিতে বাক্যালাপ করলাম। উত্তর পেলাম পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে, প্রচলিত রাশিয়ান স্বভাব দোষ সহ –হ্যাভের উচ্চারণ হ্যেভ! আই হ্যেভ!
এখানে আমড়াগাছি করার কোন সুযোগ নেই। আজ অবধি সেই ভাইভা ভোসি মনে আছে। সরাসরি প্রশ্ন। তার তেমনি উত্তর প্রার্থনীয়।
- কোথা থেকে আসছেন?
- কিরকেনেস।
- তার আগে?
- আমি লন্ডন আর ইনি হেলসিঙ্কি থেকে।
- রাশিয়ার কোথায় যাবেন?
- মুরমানসক।
- কেন?
- বেড়াতে।
- কেন?
- পৃথিবীর উত্তরতম বন্দর দেখব বলে।
- মুরমানসক পৃথিবীর উত্তরতম বন্দর নয়।
- মানে ওই রকম শুনেছি।
- কত দিনের জন্য?
- দু তিন দিন, সাত দিনের ভিসা আছে।
- গাড়ি কি আপনার?
- না, আভিস কোম্পানির।
- সেখানে কাজ করেন?
- না, তারা গাড়ি ভাড়া দেয়।
- কি করেন?
- ব্যাঙ্কে কাজ করি, ইনি ফিনিশ সরকারে
- কত টাকা সঙ্গে আছে?
- কিছু ক্যাশ আর ক্রেডিট কার্ড আছে।
- মুরমানসকে ক্রেডিট কার্ড চলে না। ক্যাশ কত আছে?
আমার সদ্য বদলি করা নরওয়েজিয়ান ক্রোনার, ব্রিটিশ পাউনড, পিরকোর ফিনিশ মার্কা সব তাঁর কাউনটারে রাখলাম। বাজারে বিক্রি হতে পারে এমন কোন গয়না পিরকোর গলায় বা কানে থাকলে সেগুলো বন্ধক দিতেও আমাদের দ্বিধা হতো না।
- ডলার?
- সেটার ব্যবহার তো আমাদের কারো দেশে নেই, তাই রাখি না।
- অসুবিধে হতে পারে। কোথায় উঠবেন? হোটেল বুকিং আছে?
- আর্কটিকা হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।বুকিং নেই। মানে যাওয়ার অনুমতি যদি কোন কারণে না মেলে তাই-
পিরকো তৎক্ষণাৎ তার হাত ব্যাগ থেকে একটা জীর্ণ টেলেক্সের কপি বের করে টেবিলে রাখলো, নিঃশব্দে। দিন সাতেক আগে মুরমানসকের আর্কটিকা হোটেলে খোঁজ খবর করেছিল। তারা জানায় ঘরের কোন অভাব হবে না। প্রমাণের যে প্রয়োজন হবে সেটা অবশ্য আমরা ভাবি নি। তবে কি ভাগ্যে মনে করে এনেছে। তিনি সেটি উলটে পালটে দেখে নিঃশব্দে ফেরত দিলেন।
পিরকো ধরে নিয়েছে এবার তার পালা। মনে মনে প্রশ্নোত্তরের আসরে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে! চিন্তা হলো।অন্যায় ভাবে ফিনিশ জমি হাপিশ করার জন্য সে আবার এই রাশিয়ান আধিকারিককে দায়ী সাব্যস্ত করে ভালো মন্দ দু কথা না শুনিয়ে দেয়!
ঘটনাটা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝে ওঠার আগেই তিনি দুই পাসপোর্টে দুটি ঠাপ্পা মেরে ফেরত দিলেন।
একটি মাত্র রাশিয়ান শব্দ আমাদের দু জনের জানা ছিল: স্পাসিবা (ধন্যবাদ)। সেটা বলেই বাজির দানের মত পাসপোর্টের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অর্থ সামগ্রী কাউনটার থেকে তুলে নিয়ে পকেটস্থ করে অতি দ্রুত বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। একটু ভয় করছিল - হঠাৎ যদি পেছন থেকে ডেকে বলেন, দাঁড়ান। আমার আরও দুটো প্রশ্ন ছিল!
একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা বয়ে বেড়াচ্ছি চোদ্দ বছর ধরে। জার্মান সীমান্তে চেব গ্রামের চেকোস্লোভাক চৌকি ভিসা থাকা সত্ত্বেও সে দেশে ঢুকতে দেয় নি!
পিছনের জীর্ণ সোফা গুলিতে ক্লান্ত ট্রাক ড্রাইভাররা বসে আছেন। তাঁদের কাল অন্তহীন।
গাড়িতে উঠে দুজনে ঘোষণা করলাম: এবার রাশিয়া!