কলোন থেকে চেকোস্লোভাকিয়ার ভিসা পাওয়া গেছে। যাব কারলোভি ভারি (জার্মান কারলসবাদ) হয়ে প্রাগ। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য জার্মান চেক সীমান্ত – চৌকির জার্মান নাম ইয়েগার, চেক ভাষায় চেব। দূরত্ব প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার। কাল সন্ধের ঝোঁকে এসে পৌঁছেছিলাম। চেক সীমান্তরক্ষীরা আমাদের পাসপোর্টগুলো উলটে-পালটে দেখে নিয়ে বললেন, আজ হবে না। কাল আসুন।
ব্যাপারটা বোঝা গেল না। অগত্যা নিকটস্থ জার্মান গ্রাম ভালডসাসেনে রাত্রিবাস। আমরা ক’জন ফ্রাঙ্কফুর্টের বাঙালি – আশিসদা, শ্রাবণী বৌদি, আলো বৌদি ও তাঁদের দুই শিশুপুত্র। পরের দিন সকালে আবার আবির্ভূত হয়েছি নীল-সাদা-লাল পতাকার নীচে চেক ছাউনিতে, পঞ্চাশ বছর আগের জার্মান সূদেতেনল্যান্ডে। বাইরে সশস্ত্র প্রহরী লম্বা কাঠের বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে। সকালবেলাতেই বেয়নেট পালিশ করে এসেছে।
ছাউনির ভেতরে সেই একই দৃশ্য। উঁচু কাঠের টেবিল, কিছু কাগজপত্র, দুটো স্ট্যাম্প। টেবিলের অন্যদিকে দু’জন ভীষণ চিন্তিত মুখে বসে আছেন। তাঁদের সামনে আমাদের অশোক স্তম্ভ-শোভিত নীল পাসপোর্ট রেখে গুটেন মরগেন বললাম। তার উত্তর পেলাম না। ওদের ভাষায় দোবরি দেন (শুভ দিন) বলে একটা সম্ভাষণ আছে বলে তো জানি। বাঙলায় সুপ্রভাত বলব কিনা ভাবছি, এমন সময় পিছনের পর্দা ফাঁক করে সামরিক কায়দার টুপি পরা পুরোদস্তুর ইউনিফর্মধারী একজন বয়স্ক লোক প্রবেশ করলেন। অন্য দু’জন তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তাঁকে সেলাম জানালেন – তাঁদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমাদের দিকে চেয়ে এই গেরেমেভারি মানুষটি ভালো জার্মানে বললেন, “আপনারা কাল এসেছিলেন, জানি। আমাদের কলোনের কনসুলেট অফিস আপনাদের এ দেশে প্রবেশ করার ভিসা দিয়েছে – সেটা ঠিক। তবে এখন সেই ভিসা প্রযোজ্য হবে না। আমরা প্রাগে খবরাখবর করেছি। তাঁরা জানিয়েছেন আপনাদের চেকোস্লোভাকিয়াতে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না”।
আমি এবার সরাসরি প্রশ্ন করলাম: কারণটা জানতে পারি কি?
সরকারি অফিসার: নাইন।
আশিসদা আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, “আপনি ক্ষেপে আছেন জানি, কিন্তু বাংলাতেও খিস্তি করবেন না। জেলে পুরে দিতে পারে”। আশিসদা এবার অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে আমাদের পাসপোর্টগুলি পুনরাধিকার করে চেক ছাউনি থেকে বেরুলেন। আমরা তাঁর পিছনে। নির্বাকভাবে গাড়িতে চড়ে নো ম্যানস ল্যান্ড পার হয়ে জার্মান চৌকি। সেটির পোশাকি নাম – ব্যাভেরিয়ান সীমান্ত পুলিশ চৌকি (বায়ারিশে গ্রেন্তস পোলিতসাই) – জার্মান নয়! ব্যাভেরিয়ানরা সবচেয়ে শেষে সংযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিলেন ১৮৭১ সালে। আজো নিজেদের স্বতন্ত্র দেশ মনে করেন, বাকি জার্মানদের প্রাশিয়ান বলে বিবেচনা ও অবজ্ঞা করে থাকেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়টা ছাড়া।
আগের দিনের সেই জার্মান প্রহরী তখনো সেখানে থিতু।
- কী হল? আজো ঢুকতে দিল না?
কাঁচুমাচু করে জানাতে হল – তাঁর অনুমান সত্য। কিঞ্চিত ভয় হল। এখন জার্মানরা যদি সন্দিগ্ধ হয়ে আমাদের ছানবিন শুরু করে? যদি ভাবে, চেক পুলিশ আমাদের কোনো গুপ্ত তথ্য জেনে শঙ্কিত হয়ে ঢুকতে দিচ্ছে না? জার্মানরা আবার আমাদের ফেরত নেবে তো? আমার সবে দেড় বছর কেটেছে – স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার করুণায় সাময়িক ভিসায় এদেশে আছি।
তিনি আমাদের পাসপোর্ট দেখার কোনো চেষ্টা করলেন না। অঙ্গুলি হেলনে জার্মানি ঢুকতে বললেন। এবারে আশিসদা বললেন, আসুন, এবারে বাংলা কেন, জার্মানেও খিস্তি করা যাক। চেকটা জানি না – এই যা!
আশিসদা বললেন, বেরিয়ে যখন পড়েছি, ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরব না সিনহারায়। গাড়ির মুখ ঘোরালেন।
তাহলে এখন কোথায়?
“আরে চলুন বার্লিন যাই। সেখানে যাওয়ার আমাদের বিলকুল হক আছে। মানসটা বার্লিনে থাকে। প্রায় যেতে বলে। গিয়ে হাজির হই। চমকে দেওয়া যাবে”।
সালটা ১৯৭৯। বার্লিন দেয়াল ভাঙতে পুরো দশ বছর বাকি।
কালকের যাত্রা শুরু হয়েছিল কলোন থেকে সোজা পূবের দিশায়। এবার চেকোস্লোভাকিয়াকে ডান পাশে রেখে উত্তর-পূর্ব পানে যাওয়া, হিরশবের্গ সীমান্ত অবধি। সেখানে আমরা জার্মান প্রজাতন্ত্র বা পশ্চিম জার্মানি ছেড়ে ঢুকব জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে। এই অঞ্চলটা সেই পুরোনো সাক্সা-কোবুরগ-গথা যেখানকার রাজকুমার আলবার্টের সঙ্গে মহারাণী ভিক্টোরিয়া বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে জার্মানে বাক্যালাপ করতেন। ব্রিটিশ রাজবংশের ধমনীতে জার্মান রক্ত প্রবহমান আজ তিনশ’ বছর।
এক ঘণ্টাও লাগল না। জুন মাসের ঝলমলে রোদ। ধরিত্রী সবুজ। প্রাগ না যেতে পারার দুঃখ প্রায় ভুলে গেছি, কিন্তু ভিসা থাকা সত্ত্বেও কেন সে দেশে ঢুকতে দিল না – সে প্রশ্নটা মনের ভেতরে খোঁচা দিচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানি দু’ভাগ হয়েছে। নিতান্ত মূর্খের মতন প্রশ্ন করি, কোন চুক্তির বলে এই বিভাজনের কাজটি সম্পন্ন হয়? গণভোটে? এলবে নদীর তীরে রাশিয়ান এবং আমেরিকান সৈন্যগণ হাত মিলিয়ে কী কথা বললেন? কোন ভাষায়? কেন আমেরিকান পদক্ষেপ থেমে গেল নদীর ধারে? তার স্ক্রিপ্ট কার লেখা? প্যাটন তো থামতে চাননি? উত্তর মেলে না।
ইউরোপের অনেক দেশের সীমানা স্থলপথে অতিক্রম করেছি। গাড়িতে, ট্রেনে, এমনকি পদব্রজে। কিন্তু কোনো বিভাজিত দেশের সীমানা কখনো পার হইনি। আয়ারল্যান্ডেও নয়। ভারত-পাকিস্তান বা ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত আমার অচেনা। সেদিন হিরশবের্গের রাস্তায় দেখলাম এক বিভক্ত দেশ। তাদের ভাষা, ধর্ম, আহার, আচরণ এক। দেশ-শাসনের নীতি আলাদা। ন’টি রাজ্য নিয়ে তৈরি জার্মান প্রজাতন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র (যাদের আমরা পশ্চিম জার্মানি বলি, যদিও সে নামে কোনো দেশ কখনো ছিল না) থেকে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (বা পূর্ব জার্মানি) পার হয়ে যাব পশ্চিম বার্লিন। সেটা একটি দ্বীপের মত – আইনত জার্মান প্রজাতন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র। মাঝখানে পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট গণতন্ত্র। তারা পশ্চিমকে অধিকার দিয়েছে সে দেশের পথ, রেল, নদী ব্যবহার করে পশ্চিম বার্লিন নামক দ্বীপে পৌঁছুনোর। সে শহর তিন মিত্র শক্তির অধীনে। সেখানকার টেমপেলহফ বিমানবন্দরে নামবার অধিকার আছে ব্রিটিশ এয়ার, এয়ার ফ্রান্স আর প্যান অ্যামের। লুফতহানসার নয়।
মাত্র কয়েকমাস আগে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের দাক্ষিণ্যে যখন প্রথমবার বার্লিন যাই, রাস্তায় নোটিস লেখা দেখেছি – এখন আপনি ফরাসি বিভাগ (সেক্টর) ছেড়ে আমেরিকান বিভাগে প্রবেশ করছেন। তার মানে এই নয়, যে, ফরাসি বিভাগে আপনি তাদের ভাষা বলেন বা সস্তার সিগারেট কেনেন। আপনাকে পাসপোর্ট দেখাতে হয় না। শহরের মুদ্রা এক – পশ্চিম জার্মান মার্ক। দরদামে কোনো ব্যত্যয় নেই। শুল্কের ছাড় নেই। খুব একটা নজর না করলে, কখন কোন মিত্রশক্তি-শাসিত অঞ্চলে আছেন – তা বোঝা যায় না।
সোভিয়েত বিভাগে প্রবেশ করা যেত পাসপোর্ট দেখিয়ে, তবে খুব কড়াকড়ি ছিল না। পূর্ব বার্লিনের মানুষ পশ্চিমে আসতেন কাজ করতে। মাইনে পেতেন ডয়েচ মার্কে, খরচা করতেন পুবের মার্কে। দিনের শেষে ফিরে যেতেন আপন আস্তানায়, যেমন আজ স্প্যানিশ কর্মীবাহিনী দিনের বেলা ব্রিটিশ জিব্রাল্টারে কাজের পরে বিকেলে স্পেনে ফিরে যান। দিনের ঠিক একই সময়ে মরক্কোর কর্মীবাহিনী স্প্যানিশ সেউটা হতে আপন দেশে ফেরেন – একই ইকোনমিকস। জিব্রালটার এবং সেউটাতে কাজের মজুরি স্পেন এবং মরক্কোর চেয়ে বেশি।
শ্রমিক কৃষকের স্বর্গরাজ্য গণতান্ত্রিক জার্মানি এবং অবক্ষয়ী ধনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী জার্মানির মাঝে যে বিশাল তাত্ত্বিক ব্যবধান ছিল, সেটি মূর্ত হল ইট-কাঠ-পাথরের একটি দেওয়াল রূপে। দিনটা বারোই আগস্ট, ১৯৬১। ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেট থেকে পটসডামার প্লাতস বরাবর উঠল একটি দেওয়াল, ক্রমশ সেটি ঘিরে ফেলল বার্লিনের পশ্চিম অঞ্চলকে। অবাধে আসা-যাওয়া বন্ধ। ফরাসি, ব্রিটিশ, আমেরিকান সেক্টরে কোনো বাধাবন্ধ নেই, কিন্তু সোভিয়েত সেক্টরে ঢুকতে-বেরুতে গেলে পাসপোর্ট-ভিসা আবশ্যক। তিন মিত্রশক্তি-শাসিত বার্লিনের চারপাশে পূর্ব জার্মানির কাঁধে কাঁধ দিয়ে সেখানে সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের সামরিক বাহিনী মোতায়েন।
এখানে আমার একটি ব্যক্তিগত নিবেদন আছে। দেশে থাকতে লাল ঝাণ্ডা তুলে পথে নামিনি, কিন্তু দোতলার বারান্দা থেকে মনে মনে তাদের সমর্থন জানিয়েছি। এই পথেই মানুষের মুক্তি হবে। বিরোধী মতামতকে নিতান্ত দুস্প্রচার মনে করেছি, ইউরোপে আসার পরেও। ১৯৭৭ সালে প্রথমবার পূর্ব বার্লিন দেখে সে ধারণা বদলাতে আরম্ভ করে। শ্রমজীবীদের স্বর্গের দুয়োরে তালাচাবি কেন?
হিরশবের্গের প্রজাতন্ত্রী জার্মানির প্রহরী বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন। একটি গোলাকৃতি ছাপে অলঙ্কৃত হল আমাদের সকলের ভারতীয় পাসপোর্ট। এবার নো ম্যানস ল্যান্ড পেরিয়ে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে প্রবেশভিক্ষা। (এর বিস্তৃত বর্ণনা আমি পোল্যান্ড পর্বে দিয়েছি)। যে প্রহরীরা আমাদের ঘিরে ফেললেন, তাঁদের মুখ ভাবলেশহীন। সুপ্রভাতের জবাব নীরবতা। গাড়ির তন্ন তন্ন তালাশি। তেলের ট্যাঙ্কের ওপরে কোনো অজানা রশ্মির বিচ্ছুরণ – কেউ সেখানে লুকিয়ে আছে কিনা জানার জন্য। ড্যাশবোর্ডের সব কাগজ, আমাদের মালপত্র খুলে দেখা হল। এবারে একধারে একটি আলাদা, ঘেরা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুটো লম্বা লাঠিতে লাগানো আয়না দিয়ে গাড়ির তলায় কিছু লুকোনো আছে কিনা – তার তদন্ত। পুরো ব্যাপারটাতে কতক্ষণ লেগেছিল মনে নেই, তবে মনে হয়েছিল অনন্তকাল। সবাই নিশ্চুপ।
আমরা কি অপরাধী? এমনটা গোয়েন্দা সিনেমাতে দেখেছি। যন্ত্রের মত মানুষেরা এসে মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। কোনো কথা নেই। পাখিরা ডাকে না সেখানে। আকাশ স্তব্ধ হয়ে থাকে। দুঃস্বপ্নের মত।
ষোল বছর বয়েসে সন্ধেবেলা বিনা বাতিতে বাইসাইকেল চালিয়ে বরানগরের স্কুল থেকে পাইকপাড়া ফেরার পথে চিড়িয়া মোড়ে পুলিশ আমাকে ধরে। অতি স্নেহের সঙ্গে, “এ ববুয়া, বতিয়া বিনা সাইকিল চলাতে হো?” – এই বলে সাইকেলটি বাজেয়াপ্ত করে থানায় জমা করে। সেটি যে থানার জিম্মায় রইল, সেই মর্মে স্বাক্ষরিত একটি চিরকুট হাতে নিয়ে দমদম রোড ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরি। পরের দিন শিয়ালদা কোর্টে দশ টাকা জরিমানা দিয়ে সাইকেল ফেরত পেয়েছি। সে পুলিশকে দেখে ভয় হয়নি। এখানে হল। কোনো অপরাধ না করেও।
চিড়িয়া মোড় থানার পুলিশের মুখটা মানুষের বলে মনে হয়েছিল।
এদের দেশে স্থায়ী অথবা সাময়িক বসবাসের কোনো দুরভিসন্ধি আমাদের নেই। তৎকালীন চ্যান্সেলর হেলমুট শ্মিডের জিম্মায় দিব্যি আছি। হিরশবের্গ থেকে বার্লিন অবধি যে রাস্তাটি সিধে ৩০০ কিলোমিটার চলে গেছে, সেটি শুধু ব্যবহার করতে চাই।
এ পথে আমি যে যাব একবার, বারবার নয়।
এক সময় সে অনুমতি পাওয়া গেল। সকালবেলায় চেকরা তাদের দেশে ঢুকতে দেয়নি। এবার অন্তত গণতান্ত্রিক জার্মানি দিচ্ছে, কয়েক ঘণ্টার জন্যে। কিন্তু তার শর্ত আছে:
১. প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বা খাদ্যের সন্ধানে বিরতি অনুমোদিত। অন্যথায় এই অটোবানে থামা নিষিদ্ধ। এই যাত্রাপথে দু’টি রেস্তোরাঁ পড়বে। সেখানে একমাত্র ডয়েচ মার্ক গ্রহণ করা হয়। অন্য কোনো মুদ্রা নয়।
২ . প্রবেশের এই অনুমতি কেবলমাত্র স্থলপথে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র অতিক্রমণে (ট্রানজিট) সীমাবদ্ধ। চালক অথবা আরোহীগণ পথ-মধ্যবর্তী রেস্তোরাঁ ব্যতিরেকে কোথাও থামলে, সেটি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
যদিও এইসব তদন্ত খোলা আকাশের নীচে চলছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে মনে হল যেন কালো কুঠুরি থেকে ছাড়া পেলাম। বাইরে সেই একই দেশ। জার্মানি। তাদের আকাশ, তাদের বাতাস, তাদের বৃক্ষরাজি – সেই একই রকম। মনে পড়ল, হায়, একদিন প্যারিসে নির্বাসিত হাইনরিখ হাইনে লিখেছিলেন, ‘কাল রাতে জার্মানি থেকে ভেসে এল পূর্বের বাতাস, আমার সঙ্গে কথা বলে গেল জার্মান ভাষায় (স্প্রাখ মিট মির আউফ ডয়েচ)’।
এতক্ষণে আমরাও কথা খুঁজে পেলাম। নরক দর্শন শেষ হল যেন। আশিসদা বললেন, ফেরার সময় একই নাটক হবে সিনহারায়। এটা ড্রেস রিহার্সাল, মনে রাখবেন। সবচেয়ে জরুরী সতর্কতা – মুখ খুলবেন না। নিশ্বাসটাও নাক দিয়ে নেবেন।
অটোবানের ভিত্তিপ্রস্তর হিটলার স্থাপন করেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ভাইমার সরকার সেটির পরিকল্পনা করেছিলেন। পয়সা ছিল না বলে কাজ এগোয়নি। দেশের দুর্দশার জন্য বিগত সরকারকে দায়ী করাটা সকল সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য। তেমনি পুরোনো সরকারের ভালো প্ল্যানিংকে নিজের বলে বাহাদুরি নেওয়াটাও চালু রেওয়াজ। এটি তার ব্যতিক্রম নয়। তবু হিটলারের যে শুভ কীর্তি সময়ের গণ্ডি উত্তীর্ণ হয়েছে, তার নাম অটোবান। পাশাপাশি দুটো গাড়ি এক মুখে যেতে পারে। কোথাও বা চারটে গাড়ি। গতি বাঁধনশূন্য, নিত্য মুক্তির সন্ধানে ধাবিত। পূর্বের অটোবানে লক্ষ করা গেল, আসা-যাওয়ার মাঝে কোনো বেড়া নেই। আছে ঘাসে ভরা জমি। যদি কোনো কারণে গাড়ির চালক ভারসাম্য হারান, তাঁর গাড়ি বিপরীতমুখী গাড়ির পথে পৌঁছে সরাসরি মোকাবিলা করতে পারে। ফলাফল সহজেই অনুমেয়। পশ্চিমে অন্তত একটা লোহার রেলিং আছে। মাঝখানে বিপথগামী হলে সেই লৌহ বলয়ে চোট খাবার সম্ভাবনা বিপুল, উলটো পথের গাড়ির সম্মুখীন হবার নয়। পশ্চিমে গতির সীমানা বাঁধা নেই। পূর্ব জার্মানিতে গাড়ির উচ্চতম গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার।
আশিসদা বললেন, ধুর মশায়, গরুর গাড়ি চালাচ্ছি মনে হয়।
আমাদের ঔৎসুক্য ও কৌতূহলের শেষ নেই। প্রথম একটা কমিউনিস্ট দেশে গাড়ি চড়েছি। রাস্তার দু’দিকে কেবল চাষের মাঠ, দূরে গাছপালা। একটা শহর বা গঞ্জের চেহারা দেখা যায় না। এরা এমনভাবে রাস্তা বানিয়েছে, যাতে সেসব বিদেশিদের চোখে না পড়ে (ভারতে শুনেছি আজকাল পর্দা বা দেওয়াল গেঁথে সেসব দৃশ্য গণ্যমান্য বিদেশি ভ্রমণকারীর চোখের আড়াল করা হয়)। অটোবান থেকে নির্গমনের একটা নিশানা (আউসফার্ট) চোখে পড়ে ক্বচিৎ। সে রাস্তাগুলো খুব ভালো বলে মনে হল না। পশ্চিমে অটোবান আর সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা একই উপাদানে তৈরি! নির্গমনের পথে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে একটা ঝরঝরে গাড়িতে বসে। এদের নাম ফোল্কসপোলিৎসাই। সংক্ষিপ্ত আদরের নাম ফোপো। জনগণের রক্ষী। মতিভ্রমবশত যদি কোনো চালক অটোবানের নিশ্চিত সুরক্ষা ফেলে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে বিপথে রওনা হয়, তাকে নিরস্ত করা – মতান্তরে গ্রেফতার করা – তাদের কাজ।
আশিসদা বললেন, খুব বোর হয়ে যাচ্ছি। মহিলারা বললেন, আমাদের লক্ষ্য বার্লিন পৌঁছানো। কমিউনিস্ট গারদে নিশিযাপন নয়।
প্রথম সরকারী ভোজনালয় পড়তেই সেখানে থামা গেল। খুব সাদাসিধে ইটের বাড়ি। বাইরের রঙ উঠে গেছে বহুকাল। বসবার ব্যবস্থা শক্ত কাঠের চেয়ারে। স্কুলের ক্যান্টিনের চেহারা এর চেয়ে ভালো। চা পাওয়া যায়, কফি নয়। সসেজ আর রুটি মেলে। মেনু সেখানেই শেষ। বাথরুমের ব্যবস্থা আছে – তবে সেটি মাটির গভীরে। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি নামতে হয়, আলো নেই। একটু আধো অন্ধকার মত, এই দিনের বেলায়। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কয়েকটি ছায়ামূর্তি যেন সেই সিঁড়ির দেয়ালে সেঁটে আছে। একটি মূর্তি ফিসফিস করে বলল, ডয়েচ মার্ক? আইনস তসু জেকস? একের বদলে ছয়?
সরকারী হিসেবে পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানির মার্ক সমমূল্য। পশ্চিমের এক মার্কে পুবের এক মার্ক। বিনিময়ের বাজারে অবিশ্যি পূর্ব জার্মানির মুদ্রার কোনো কদর নেই। দেশের সীমানার বাইরে সেটা কেউ নেবে না। কিন্তু উপায় কী? রেস্তোরাঁয় আমরা সেই একের বদলে এক হিসেবে চায়ের দাম দিয়েছি। মুদ্রার বাজারে তাদের টাকার আসল ভাও কী – সেটা জানলাম বাথরুমের পথে। রয়টার বা ব্লুমবের্গ টার্মিনালের প্রয়োজন হয় না। এক পশ্চিমী মার্কের বদলে ওরা ছ’ মার্ক দেবে। দরদাম করলে হয়তো বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু এই কর্মটি সম্পূর্ণ বেআইনি। ধরা পড়লে হাজতবাস। অধিক লোভে তাঁতি ডোবে – এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে আইনভঙ্গের প্ররোচনা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম।
চায়ের দাম দেবার আগে এই প্রস্তাব পেলে এবং সাহসে কুলোলে, আমরা রেস্তোরাঁর তাবৎ জনগণকে মুফতে চা খাওয়াতাম!
আবার অটোবান। দু’পাশে চাষের মাঠ। গাছপালা। পুলিশ দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আশিসদা বললেন, ‘চেকে ঢুকতে দিল না বজ্জাতেরা। সিনহারায়, আসুন এবারে একটা অ্যাডভেঞ্চার করি’।
চার দশক কেটে গেছে। পরবর্তী ঘটনাক্রম আজো বিশ্বাস হয় না।
মহিলারা ব্যাপারটা বোঝার আগেই এক জায়গায় আউসফার্ট দেখে আশিসদা অটোবান হতে নিষ্ক্রান্ত হলেন। বেলা দশটা। মোড়ে পুলিশ নেই। আমরা নামলাম গ্রামের রাস্তায়, সেখানে আসা ও যাওয়ার একটি মাত্র ট্র্যাক। এবার সম্পূর্ণ অজানার উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা। কোথায় যে যাচ্ছি, এরপরে কী যে ঘটতে পারে – জানি না। চিত্ত ভাবনাহীন। মহিলারাও বাধা দিলেন না। দেখাই যাক না – কী হয়। যদি পুলিশ ধরে, বলব না হয় – ভাষা বুঝি না। আমরা দরিদ্র, মূর্খ ভারতবাসী। দিকভ্রম হয়েছিল। ভুল করেছিনু, এবার ভুল ভেঙেছে।
কয়েক কিলোমিটার নির্জন রাস্তায় যাওয়ার সময় মনে হল, পুলিশ না হোক – কোনো স্থানীয় লোক যদি দেখে, একটা ফ্রাঙ্কফুর্টের ‘এফ’ অক্ষর-মার্কা রেজিস্ট্রেশনের ফোল্কসভাগেন গাড়ি ঢুকে পড়েছে, সে তৎপর হয়ে কাউকে খবর দেবে। কোনো গাড়ি বা বাড়ি চোখে পড়ল না। কয়েক কিলোমিটার গেলে একটি ছোট জনপদের নিশানা – হলুদের ওপর কালোতে সাইনবোর্ডে লেখা - হ্যার্মসডর্ফ। বাড়িঘর দেখছি, কিন্তু পথ জনশূন্য। অতঃকিম? রাস্তার ধারে সাদা বা হলুদ কোনোরকমের লাইন টানা নেই, অর্থাৎ গাড়ি যত্রতত্র দাঁড় করানো যায়। সেখানে পার্ক করে, সিগারেট ধরিয়ে আশিসদা বললেন, এবার যান দিকি, উলটো দিকের বাড়ির দরোজায় গিয়ে ঘণ্টি বাজিয়ে বলুন, আমাদের সহযাত্রিণী মহিলার শিশুটির বেবি ফুড বানাতে গরম জল লাগবে। তাই আপনাদের শরণাপন্ন হয়েছি।
উথমানস্ত্রাসের পাঁচ নম্বর বাড়ির দরোজায় কোনো ঘণ্টি দেখতে পেলাম না। অগত্যা কড়া নাড়া। যে ভদ্রমহিলা দরোজা খুললেন, তাঁর মুখে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং শঙ্কা। তাঁকে আমার শ্রেষ্ঠ জার্মানে জানালাম, আমরা হিরশবের্গ থেকে বার্লিনের পথে যাচ্ছিলাম। আমাদের সঙ্গে একটি শিশু আছে, তার বেবি ফুড বানাতে গেলে গরম জল লাগবে। তার কোনো ব্যবস্থা আমাদের সঙ্গে নেই, তাই অগত্যা অটোবান ছেড়ে আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি।
সেই মহিলার পিছনে এবার এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোককে দেখা গেল। তাঁরা দু’জনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তৎক্ষণাৎ গাড়ির দিকে ধাবিত হলেন। গ্রামের সেই অপ্রশস্ত রাস্তায় একটিমাত্র গাড়ি। দুই মহিলা গাড়িতে। নাটের গুরু আশিসদা ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেন না – এমন মুখ করে গাড়ির চালকের আসনে বসে আছেন। ভাবটা এমন, আমাকে নিয়ে কেন টানাটানি করছেন, ওই বাছার জন্যে গরমজল হলেই হবে।
আহা, কী যে বলেন, তা হয় নাকি? এই মহিলারা আমাদের বাড়িতে পদধূলি দেবেন না – এ কেমনধারা কথা? আহা কী চাঁদমুখ ছেলেদু’টি গো!
দুনিয়ার সব দেশের সব মায়েরা সব ভাষায় ঠিক এই কথাই বলে থাকেন। ঠিক এই সুরে।
বাঙালি মায়ের অন্তরের আবেগ ঝরে পড়ল থুরিঙ্গেনের একটি ছোট গ্রামের মহিলার কণ্ঠে। সবার উপরে মায়েরা সত্য!
পরের দু’ ঘণ্টার স্মৃতি কোনোদিন মুছে যাবে না।
আমাদের সকলকে রান্না ঘরে বসানো হল। তাঁদের নাম ক্রোসটভিতস। এরিকা এবং হ্যারবের্ট। দু’জনেই স্থানীয় কারখানায় কাজ করেন। এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে উদিতা হলেন তাঁদের কন্যা, হাইকে। বয়েস আঠারো। গ্রামের গিমনাসিয়াম, মানে উচ্চ বিদ্যালয়ে শেষ পরীক্ষা দেবে শিগগির। আমরা সকলে বসেছি রান্নাঘরের টেবিল ঘিরে। বহু বছর ধরে বাড়ির রান্নাঘরই ছিল জার্মান পরিবারের বসার ঘর। হাইমাত নামে একটি অসাধারণ জার্মান টিভি সিরিজ আছে – আমাজনে পাবেন – সাব টাইটেল সহ দ্রষ্টব্য। রাইন পেরিয়ে হুনসরুক অঞ্চলের কাছাকাছি একটি গ্রামের এক পরিবারের একশ’ বছরের গল্প। তাতে প্রথম দেখি, জার্মান জীবনে রান্নাঘর ছিল লিভিং রুম! সেইসব লোকেশনে যাওয়া যায়।
প্রাথমিক চমকটা কেটে গেলে ঘটনার গভীরতা মাথার ভেতরে ঢুকতে আরম্ভ করল। আমাদের নির্ধারিত পথ ছেড়ে বিপথে আসাটা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। ঠিক তেমনি, এই পরিবার আরও অন্যায় করেছেন বিদেশি লোককে বাড়িতে আসতে দিয়ে, তাঁদের সঙ্গে বাক্যালাপ করে। আমরা মার্জনা চাইলাম। কর্তা-গিন্নি দু’জনেই বললেন, তাঁরা বিস্মিত হয়েছেন প্রথমে, কিন্তু এখন ভীষণ খুশি। তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এমন ঘটনা অকল্পনীয়। যদি কেউ কিছু বলে, সে পরে দেখা যাবে। ক্ষমা চাওয়ার আরেকটা কারণ আছে। আমরা হয়তো তাঁদের কাজের ব্যাঘাত করছি। তাঁরা প্রতিবাদ করে জানালেন, মোটেও না। আজ তো শনিবার। হাইকের একটা খেলা আছে স্কুলে, তা সেটা বিকেলের দিকে।
শিশুর জন্যে গরম জলের বাহানা নিয়ে আমাদের আগমন। সেটি সম্পন্ন হলে ’পর, তাঁরা চা খাওয়ালেন। আহা আরেকটু বসুন। কিছু খেয়ে যান।
না, না, থাক – এসবের আর কী দরকার (আখ ডাস ওয়েরে জো উমস্টেনডলিখ ফুয়ের জি, ডখ নিশট নোয়েটিগ), আপনাদের অসুবিধে হবে – এ ধরনের স্বভাবসিদ্ধ বাঙালি ভণ্ডামিকে তাঁরা উপেক্ষা করলেন।
রান্নাঘরে ওভেন, ফ্রিজ আছে। সাদাসিধে। যা যা মানুষের প্রয়োজন, সবই। কাজ চালানোর মতন। ইতিমধ্যে আমাদের গল্প চলেছে অন্তহীন। ভারতীয় বা আমাদের গায়ের রঙের মানুষ কখনো তাঁরা চোখে দেখেননি। আমরা জার্মান শিখেছি কোথায়? দেশে? আমরা কী খাই? শাড়ি-পরা মহিলা এক বিপুল বিস্ময়। ফ্রাঙ্কফুর্ট কত বড় শহর? কত লোক থাকে? সেখানের বিমানবন্দরে নাকি দু’মিনিট অন্তর প্লেন নামে বা ওড়ে? রঙিন টেলিভিশন? গাড়ি চালানোর কোনো গতি-সীমা নেই? তাঁদের সাদা-কালো টেলিভিশনে বিদেশের কোনো খবর থাকে না। জানালাম, আমি একটি ভারতীয় ব্যাঙ্কে কাজ করি। আশিসদা হোকস্ট নামের এক বিশ্ববিখ্যাত ওষুধের কোম্পানিতে কাজ করেন। মহিলারা গৃহলক্ষ্মী। প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। ফ্রাঙ্কফুর্ট মাত্র দেড়শ’ কিলোমিটার দূরে! আমরা যেন অন্য গ্রহের মানুষ। নিজেদের কথা বললেন। যুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেকদিন। তাঁরা শুধু এই গ্রামটাই চেনেন। এখানেই কাজকর্ম। জীবনধারণের জন্য যা প্রয়োজন – সবই মেলে। বিলাসিতা বা দূরদেশে ছুটি কাটানো সম্ভব নয়। বড়জোর উত্তর সাগরতীরে যান। একটি ত্রাবান্ত গাড়ি আছে। পোল্যান্ড বা চেক যাওয়ার বাধা নেই, তবে রোমানিয়া বুলগারিয়া যাওয়া শক্ত। পশ্চিমের কথা তুললাম না। চিন্তার বাইরে।
উনুনে রান্না হচ্ছে। বাইরের দরোজা খোলাই আছে। একজন দু’জন করে প্রতিবেশিরা এলেন। রান্নাঘর ভরে গেল, বসার জায়গা নেই। টেবিল ঘিরে অনেকে দাঁড়িয়ে। আমি আর আশিসদা যত উঠে গিয়ে অন্তত দু’জনকে বসতে বলি, তাঁরা তত প্রতিবাদ করেন – আপনারা আমাদের অতিথি! তাঁদের বিস্ময়, চমক কাটতেও সময় লাগে। আমরা বেআইনি কাজ করেছি অটোবান ছেড়ে এসে, ক্রোসটভিতস পরিবার আইন ভেঙেছেন আমাদের আপ্যায়ন করে। এবার এইসব প্রতিবেশি তার সাক্ষী! কিন্তু মনে হল, আইন ভাঙার ভয়, ভাবনা ততক্ষণে কেটে গেছে। দু’ পক্ষেরই!
যা হবার তা হবে!
রুটি, স্যুপ, সসেজ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন। কথা আর খাওয়া সমান তালে। হাইকের সঙ্গে অনেক কথা এবং ঠিকানা বিনিময় হল। টেলিফোন নম্বর নিয়ে লাভ নেই। বিদেশের সঙ্গে দূরভাষ প্রায় অসম্ভব। আজ শুনলে বিশ্বাস হবে না, ছয়ের দশকে পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিনের দূরভাষ প্রথমে যেত লন্ডন, সেখান থেকে রি-রুট করে সে বার্তা যেত পূর্ব বার্লিনে। আমাদের দেশের ট্রাঙ্ক কলের মতন।
এই আড্ডার ভেতরেও মনের মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে – চক্রব্যূহে ঢুকেছি বটে, বেরুব কেমন করে?
হ্যারবের্ট বললেন, বিকেলের দিকে ফোপোদের ঘোরাঘুরি বাড়ে। কিন্তু তিনি আরেকটি অটোবান প্রবেশপথ জানেন, যেখানে সাধারণত কোনো পুলিশ থাকে না। নিরালা জায়গা। তিনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। যেমন হঠাৎ এসেছিলাম, তেমনি বিদায় নেবার পালা এল। কত অজানাকে জানা হল। হাইকের সঙ্গে যে যোগাযোগ হল, সেটি তেতাল্লিশ বছর যাবত অটুট আছে।
হ্যারবের্ট তাঁর ত্রাবান্ত গাড়ি বের করলেন। আমাদের আগে আগে যাবেন পথ দেখিয়ে। একটা মেঠো রাস্তা অটোবানে গিয়ে উঠেছে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সেখানে কোনো সাইনবোর্ড অবধি নেই। আমাদের গাড়ি যাবে তাঁর সঙ্গে খানিকটা দূরত্ব রেখে। তিনি সেই অটোবানের মোড় পর্যন্ত গিয়ে দেখে নেবেন পুলিশ আছে কিনা। তারপর ইশারা করলে আমরা বার্লিনগামী রাস্তায় উঠে পড়ব।
ফুটপাথে একটি ছোটখাট জনতা সমবেত। এরিকা আমাদের সকলকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন। হাইকে বললে, চিঠি লিখবেন। পুলিশ খুলে দেখতে পারে। তা দেখুক না হয়। হ্যারবের্ট ক্রোসটভিতসকেও এখানেই বিদায় জানাতে হল, কারণ অটোবানে পৌঁছে দিয়েই গাড়ি ঘোরাবেন। সেখানে বিদায়ের ঘনঘটা বিপজ্জনক হতে পারে।
উথমানস্ত্রাসের পাঁচ নম্বর বাড়িটিতে আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই বাড়ি, সেই দিনটির স্মৃতি থেকে গেছে মনের গভীরে।
একটি অসম্ভব ধূলি-ধূসরিত গ্রাম্য পথ দিয়ে হ্যারবের্ট ক্রোসটভিতসের ত্রাবান্ত গাড়িটির সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব রেখে চলল আমাদের ফোল্কসভাগেন। অটোবানের মোড় পৌঁছুনোর আগেই গাড়িটি ঝোপের আড়ালে পার্ক করলেন হ্যারবের্ট। তারপর হেঁটে এগিয়ে গেলেন অটোবানের কাছাকাছি। এদিক-ওদিকে তাকিয়ে হাত তুলে অভয় দিলে, আমরা মেঠোপথ ছেড়ে পাকারাস্তা ধরলাম। হ্যারবের্ট ক্রোসটভিতস দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তা থেকে একটু দূরে। তাঁর উত্তোলিত হাত দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল একসময়। তাঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না কোনোদিন।
এবার বার্লিন।