মাঠে তিল ধারণের স্থান হয়তো আছে মনুষ্য ধারণের জন্য নেই। আইনত্রাখত ফ্রাঙ্কফুর্ট বনাম জব্রোইয়ভকা ব্রনোর ইউ ই এফ এ কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। সহকর্মী শ্রীধরকে তার চিরাচরিত নিয়মনিষ্ঠা থেকে বিচ্যুত করে আগে ভাগে অফিস থেকে নিয়ে এসেছি – যেমন এককালে স্টেট ব্যাঙ্ক কেটে মোহন বাগানে মাঠে খেলা দেখতে গেছি।
মোহনবাগান স্থাপনার দশ বছর বাদে ফ্রাঙ্কফুর্টের ফুসবাল ক্লুব ভিক্টোরিয়া ও কিকারস এই দুটি স্থানীয় দল মিলে আইনত্রাখত (সম্মিলনী /ইউনাইটেড ) ফ্রাঙ্কফুর্ট দল স্থাপনা করে। সে আমলে গোটা দেশে উত্তর দক্ষিণ আঞ্চলিক লিগের খেলা হতো – ধরে নিন বীরভূম বর্ধমান বাঁকুড়া মিলে একটা লিগ! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার ন বছর বাদে জার্মান ফুটবল টিম বিশ্বকাপ জেতে (বার্নের বিস্ময় – জার্মানি ৩-হাঙ্গেরি ২) কিন্তু সিনিয়র লিগ শুরু ১৯৬৩ সালে, যাকে আমরা বুন্দেসলিগা বলে চিনি এবং বায়ার্ন মিউনিক প্রায় প্রতি বছরে চ্যাম্পিয়ন হয়। একাধিকবার জার্মান কাপ (ডে এফ বে পোকাল) জিতলেও ইউরোপীয় মঞ্চে আইনত্রাখত তখন (১৯৮০) অবধি কোন ট্রফি জেতে নি। বিশ বছর আগে ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে রানার্স আপ হওয়াটা একমাত্র মাইলস্টোন। এবার তাদের টিম জবরদস্ত – আগের রাউনডে টপ ডাচ টিম রটারডামের ফাইনুরদকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে, অতএব উত্তেজনা তুঙ্গে।
প্রতিপক্ষের নাম উচ্চারণ করতে দন্ত কৌমুদী বিধ্বস্ত হবার সম্ভাবনা। ইউরোপে ইতিমধ্যে আমার বছর দুয়েক কেটেছে। ইংল্যান্ড হল্যান্ড ফ্রান্স জার্মানির বাইরে পূর্ব ইউরোপের কিছু ফুটবল টিমের খবরাখবর রাখি যেমন ডিনামো কিভ, লোকোমোটিভ সোফিয়া, ডিনামো ড্রেসডেন, রেড স্টার বেলগ্রেড, স্টেউয়া বুখারেসট, স্পারতাক মস্কো। কিন্তু জব্রোইয়ভকা ব্রনের নাম শুনিনি।
সে সময়ে ট্রেনে বা গাড়িতে শহর থেকে এয়ারপোর্ট যাবার পথে দেখা বনানী পরিবৃত ভালড স্টাডিয়নের সঙ্গে আজকের বহু অর্থে স্পন্সর করা ডয়েচে ব্যাঙ্ক পার্কের কোন তুলনা চলে না। সেখানে এবারে ইউরো ২৪ প্রতিযোগিতার কিছু খেলা হয়তো আপনারা দেখেছেন (জার্মানি- সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম -স্লোভাকিয়া ইত্যাদি)। সাতের আটের দশকে আমরা সিমেন্ট বাঁধানো গ্যালারিতে বসে বা দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম। দাদাকে একবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বনাম লেভারকুসেনের লিগ ম্যাচ দেখাতে নিয়ে যাই- দাদা বলেন হ্যাঁরে, মোহনবাগানের কাঠের গ্যালারি এর চেয়ে আরামের।
খেলা শুরুর অনেক আগেই হাজির হয়েছি – অ্যাটমসফিয়ারের স্বাদ গন্ধ নেওয়ার জন্য। আমার পাশে যিনি বসেছিলেন তাঁকে বাকি স্টেডিয়ামের উন্মত্ত জনতার অংশ বলে মনে হল না। জার্মানে প্রশ্ন করলে পরিষ্কার ইংরেজিতে জবাব দিলেন, নাম ফ্রান্তিসেক, শিক্ষক, এসেছেন ওই ব্রনো শহর থেকে। বার্লিন দেওয়াল ভাঙ্গা পড়তে তখনো প্রায় দশ বছর বাকি – চেক সীমান্ত পার হওয়া নিশ্চয় কঠিন ব্যাপার ছিল? সে কথা ঠিক জিজ্ঞেস করা গেলো না।
যখন ইউরোপ এসেছি শীতল যুদ্ধ একেবারে তুঙ্গে। লাল নীল দুই পক্ষ কোন কারখানায় বসে কোন ছুরি শানাচ্ছেন বা কত বড়ো পেটো বাঁধছেন এ নিয়ে কানাকানি চলে, মানুষের ভয় ভীতি বাড়ে ; সত্যি মিথ্যে কেউ জানে না। কিন্তু এই কঠিন সময়েও ফুটবলের মাঠে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশের খেলা চলেছে বাধা বন্ধহীন।
আলাপ জমে গেলো ফ্রান্তিসেকের সঙ্গে। টি টুয়েন্টি নামক দানবের দুরাচার শুরু হবার আগে টেস্ট ক্রিকেটের মাঠে গল্প বেশি জমতো - অনেকক্ষণ যাবত মাঠে কিছুই ঘটে না, স্যাকরার ঠুক ঠাক চলে ব্যাটে বলে। ফুটবলের মাঠে সেটা সম্ভব নয়। তবু খেলার আগে, মাঝে, হাফ টাইমে কিছু কথা। আমরা তাঁকে একাধিক বিয়ারে আপ্যায়িত করেছি, কিছুতেই দাম দিতে দেব না! ভারত ও পূর্ব ইউরোপের ভাইচারা যুগ যুগ স্থায়ী হোক। দুজন ভারতীয়ের সঙ্গে এই ফ্রাঙ্কফুর্টের মাঠে দেখা হবে তিনি ভাবতে পারেন নি! আমার ট্রিভিয়া লাইব্রেরির শ্রীবৃদ্ধির জন্য যত না প্রশ্ন, ভারত সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানস্পৃহা অনেক বেশি। ততক্ষণে তাঁর টিম আইনত্রাখত ফ্রাঙ্কফুর্টের হাতে বেশ ঝাড় খাচ্ছে, ৩-০ গোলে পিছিয়ে এবং তাঁর মনোযোগ বিভ্রান্ত। তাই প্রস্তাব দিলাম- তিনি যদি চান আমরা একত্র হেঁটে শহরে ফিরতে পারি, এক ঘণ্টার পথ। ট্রামে বেজায় ভিড় হবে। ফ্রান্তিসেক বললেন যদি আমরা তাঁকে ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি অবধি সঙ্গ দিতে পারি তাঁর খুব উপকার হয়, রাতের ট্রেন ধরবেন। সেটাই আমাদের লজিস্টিক, ফ্রাঙ্কফুর্ট হাউপটবানহফের সামনে আমরা বারো নম্বর ট্রাম ধরে বাড়ি ফিরব।
ব্রনো ৪-১ গোলে হারল কিন্তু আমাদের একটি বন্ধু লাভ হলো। মার্চ মাসের সন্ধ্যে, সবে কারনেভাল শেষ, শীত বিদায় নিয়েছে। ভালড স্টাডিয়ন ছাড়িয়ে, রেসের মাঠ পেরিয়ে গাছে ঢাকা পথ দিয়ে আমরা তিনজন গল্প করতে করতে হাঁটলাম। আরও অনেকে চলেছেন, একটি সুখী জনতার মিছিল।
জানতে চাইলাম এই যে আপনাদের টিমের যে কঠিন নাম, তার অর্থ কি?
জব্রোইয়ভকা কথাটার মানে অস্ত্রাগ্রার ( আমাদের আর্সেনাল!)। আসলে এই নামের একটি কোম্পানি আছে যারা রাইফেল বন্দুক ইত্যাদি হাতিয়ার বানায়,,তাদের নামে দলের নাম।
শহরের নাম BRNO! উচ্চারণ করেন কি করে?
ফ্রান্তিসেক হাসলেন, “ চেক এবং স্লোভাক ভাষা ভাওয়েলের ব্যবহারে বিশেষ কার্পণ্য করে! আপনাদের চেনা কোন ভাষার মতন নয়। এই দেখুন ফরাসিরা সতেরোটা অক্ষর লিখে চারটে উচ্চারণ করে কিন্তু তারা স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণের সঙ্গে সদাচার করে থাকে। আমরা করি না। জেনে রাখুন ঘাড়ের চেক KRK এক মুঠো হলো čtvhrst বৃহস্পতিবার čtvrtek! উচ্চারণের চেষ্টা করবেন না!
অনিবার্যভাবেই প্রশ্ন করলেন, আপনারা প্রাগ গেছেন?
কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়? কিন্তু এই মউকা! একজন চেক নাগরিকের কাছে মনের যাবতীয় দুঃখের কথা উজাড় করে দেওয়া যাক।
জানালাম সে চেষ্টা শ্রীধর করে নি। তবে আমি এই মাত্র ন মাস আগে কয়েকজন বন্ধু সহ আপনাদের সীমান্ত থেকে ফিরে এসেছি, ভিসা থাকা সত্ত্বেও ঢুকতে দেয় নি। প্রথম দিন বলেছে ঠিক সম্মতি দেওয়া যাবে কিনা তার খবর নেবেন প্রাগ থেকে, একদিন বাদে আসুন। আমরা কাছের গ্রাম ভালডসাসেনে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে আবার হাজিরা দিয়েছি। এবার আমাদের পরিষ্কার বলা হলো, আপনাদের ভিসা থাকলেও প্রবেশের অনুমতি নেই! শুনে ফ্রান্তিসেক বেশ অবাক হলেন, সীমান্ত চৌকির নাম জানতে চাইলেন -বললাম জার্মান এগার, চেক খেব। বললেন তিনিও সেই বর্ডার পেরিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রেন ধরেছেন। কড়াকড়ি আছে সে দেশের লোকের আসা যাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু ভিসা সমেত বিদেশিকে আটকাবে কেন? তিনি একটু বিভ্রান্ত হলেন।
আর চেষ্টা করেন নি? পারলে একবার আসুন,প্রাগ আপনাদের খুব ভালো লাগবে।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে আমাদের নির্ধারিত তিন বছর কাল প্রায় উত্তীর্ণ হতে চলেছে। আমাদের কি আর সে সুযোগ হবে? পশ্চিম ইউরোপটাই তখনো দেখা হয়ে ওঠে নি। ম্যাপ দেখি আর ভাবি দেশে ফিরে গিয়ে কি মুখ দেখাব? স্পেন পর্তুগাল আয়ারল্যান্ড ডেনমার্ক সুইডেন নরওয়ে ফিনল্যান্ড অবধি দেখি নি, হ্যাটা হয়ে যাব। প্রাগ তো অনেক দূরের নক্ষত্র।
‘এ দেশে পাওয়া যায় কিনা জানি না তবে একবার আমাদের দেশে এসে চেক বিয়ার টেস্ট করে দেখুন!’
যুদ্ধোত্তর চেক জার্মান সম্পর্ক এবং সুদেতেনল্যান্ডের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম।
ফ্রাঙ্কফুর্ট ট্রেন স্টেশনে প্রায় পৌঁছে গেছি এখান থেকে সিধে খেবের ট্রেন যায়। তখন রাত্তির দশটা বেজে গেছে। তবে ফ্রান্তিসেক বললেন বেশি রাতে ট্রেন আছে, ঘুমিয়ে চলে যাবেন, ছ ঘণ্টা লাগে।
বিদায় নেবার সময়ে বললেন প্রাগ নামের ভেতরে প্রয়াগ শব্দ নিহিত আছে, যেখানে দুটি নদীর ধারা মিশে যায় - ভ্লাতাভা ও লাবেম (যাদের জার্মান নাম মলদাউ ও এলবে)।
শুনে বিস্মিত এবং একই সঙ্গে উৎসাহিত হয়েছিলাম কিন্তু পরে অনেক খোঁজ খবর করেও এই মন্তব্যের সারবত্তা উদ্ধার করতে পারি নি।
হাউপটবানহফের সামনে উষ্ণ করমর্দন করে শুভযাত্রা জানালাম। আর কোনদিন দেখা হবে না তাঁর সঙ্গে কিন্তু সন্ধ্যাটি মনে রয়ে যাবে।