পোল্যান্ডের একটি গ্রামে কিছু পোলিশ ব্যাংকারকে জড়ো করে আমরা পশ্চিমি মুক্ত অর্থ ব্যবস্থার যে ঢক্কা নিনাদের সূচনা করেছিলাম সেটি নিঃসন্দেহে ফলপ্রসূ হয়। স্টচনিয়া গদিনিয়া নামক এক প্রায় দেউলে সরকারি জাহাজ নির্মাতার জন্য সিটি ব্যাঙ্ক যে সামান্য এক কোটি ষাট লক্ষ ডলার বাজার থেকে তুলতে পেরেছিল, সেটিকে পূর্ব ইউরোপের প্রথম আন্তর্জাতিক কর্পোরেট ডিলের সম্মান দেওয়া হয়ে থাকে। সেটা ১৯৯৪।
পশ্চিমের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশে অচেনা বাণিজ্য সংস্থায় কিছু ব্যাঙ্ক আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ডলার লগ্নি করার সাহস দেখালেন; আমার উন্মাদনা তখন তুঙ্গে, ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে গ্রাহাম বওলির ফোন পেয়ে রীতিমত গর্বিত বোধ করি। তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমরা কিভাবে এই ডিলের ফি নির্ধারণ করেছি। তুলনামূলক দর বা মার্কেট রিডের কোন প্রশ্ন ওঠে না কারণ এ ধরণের ঋণের আয়োজন কখনো হয় নি।
বলতে পারতাম আঙ্গুল গুণে। বলতে হলো বাজারে কোন ডিল না হয়ে থাকলেও আমরা কিছু এমপিরিকাল তথ্যের সহায়তা নিয়েছি। সেটা একেবারে বাজে কথা। ভিত্তিহীন। বাট হু কেয়ারস!
এদিকে আমাদের কর্তা ব্যক্তিরা ঘটনাটা যে কি, কিভাবে ঘটল সে সব না বুঝেই চতুর্দিকে প্রশংসা কুড়োচ্ছেন, পারস্পরিক পিঠ চাপড়ানো হচ্ছে। পাবলিকের ধারণা আমরা কোন নতুন স্বর্ণ খনির সন্ধান পেয়েছি। স্বাভাবিক। পশ্চিম ইউরোপে মন্দার বাজার বাড়িঘরের দাম কম, শেয়ার বাজার অতল জলের সন্ধানে ধাবিত ; সেই কিছু বাঁধাধরা খদ্দের, দু পয়সা সুদ বাড়ালে তারা চোখ রাঙ্গাবে। তাই ছাড়িয়া নিশ্বাস, যতো বকরা পুবের মাঠে এই তাদের বিশ্বাস। কিন্তু ব্যাঙ্কের ঋণ যারা মঞ্জুর করেন সেই সব গুরুরা সেটা মানলে তবেই না তাঁরা সে মাঠে নামতে পারেন।
পূর্ব ইউরোপে ঋণের আয়োজন এবং তার বিক্রি বাটা করতে গিয়ে আমাদের মনে অন্য প্রশ্ন জেগেছিল। আমাদের হিসেবে পূর্ব ইউরোপে ঋণ নেবার যোগ্য কর্পোরেট, ব্যাঙ্ক বা সরকারি সংস্থার অভাব নেই কিন্তু অন্য ব্যাঙ্কেরা কি ভাবে? তাদের ক্রেডিট গুরুরা তো ‘না’ বলার জন্য মুখিয়ে আছেন। এক নরওয়েজিয়ান ব্যাংকার বলেছিলেন আপনারা এমন সব ঋণের প্রস্তাব আনেন, খদ্দের দূরের কথা, সেই সব দেশের সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানি না যে।
আমরা অদম্য, চাই বিজনেস বাড়াতে। প্রয়োজন আরও ডলার। সেই অতিরিক্ত ডলার জোগাবে কে বা কারা? সিটি ব্যাঙ্ক যে কোন ঋণের দশ শতাংশ নিজের খাতায় রাখতে রাজি - টু দি বিটার এন্ড। পরিমাণ হয়তো বেশি নয় কিন্তু আমরা সেই ঋণ গ্রহীতার ঝক্কি শেষ দিন অবধি বহন করব, লোনের থলি অন্যের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়ব না। শুধু তাই নয়, এই সব দেশে আমাদের আপিস, লোকজন আছে, তারা দেশ ও মক্কেলের খবরাখবর রাখবে, গোলযোগের ইঙ্গিত পেলে বিলিতি খবর কাগজে জানাজনি হবার আগেই সেটা আমাদের জানাবে। বাকি নব্বুই শতাংশের জন্য বাজার নামক একটা ধোঁয়াটে ময়দানে খেলতে হবে।
পোল্যান্ডে স্টচনিয়া গদিনিয়ার সঙ্ঘবদ্ধ ঋণে লগ্নিকারক ছিল একটি অস্ট্রিয়ান বাণিজ্যিক এবং একটি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক, জার্মান সেভিংস ব্যাঙ্ক ও নিতান্ত আশ্চর্যজনক ভাবে, একটি ইন্দোনেশিয়ান ব্যাঙ্কের আমস্টারডাম শাখা। কাসাব্লাঙ্কা ছবির ক্যাপ্টেন লুইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী আমরা কোন ‘ ইউসুয়াল সাসপেকটসের’ দেখা পাই নি, যেমন ব্রিটিশ, অন্য আমেরিকান, ফরাসি, ডাচ ইতালিয়ান বা স্প্যানিশ অথবা কোন নরডিক ব্যাঙ্ক।তখন এদের প্রায় কারোর কোন শাখা নেই পূর্ব ইউরোপে। একজন দুজন রিপ্রেজেনটেটিভ মাঝে মধ্যে হাওয়াই জাহাজে উড়ে যান ওয়ারশ প্রাগ বুদাপেস্ত। সেখানে সম্ভাব্য মক্কেলকে আপ্যায়ন করে ও আপ্যায়িত হয়ে এক বোতল হাঙ্গেরিয়ান উনিকুম বা পোলিশ ভদকা বগলদাবা করে বাড়ি ফেরেন। খদ্দের ও তার ব্যবসা কতটা বোঝেন কে জানে। এখন এই সিটি ব্যাঙ্কের ঋণ মেলার মার্কেটিং প্যাকেজের সঙ্গে সরবরাহ করা বার্ষিক ব্যাল্যান্স শিট দেখেই, খদ্দেরের অফিসে বসে চা কফি পান না করেই টাকা ধার দেবেন কেন তাঁরা? অস্ট্রিয়ান বা জার্মানদের না হয় খানিকটা ঐতিহাসিক পূর্ব পরিচয় আছে কিন্তু সেই একই দুয়োরে কতবার যাবো? তাদেরও সাধ যতোই থাক না কেন, সাধ্য সীমিত। ওদিকে রোম প্যারিস মাদ্রিদ থেকে মস্কো, মিন্সক অনেক দূর। আমাদের চাই আরও অনেক লগ্নিকারকের ঠিকানা। কোথায় পাবো তারে?
আরও একটা সমস্যা ছিল। সেটা আমাদের একান্ত নিজের। যে কোন ঋণের আয়োজনে আমরা একলা হিরো বনতে চাই, আলাপ আলোচনা দর দস্তুর আমরাই করবো ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে, স্থির হবে পারিশ্রমিক ও সুদের হার। তারপরে অবশ্যই পারিশ্রমিকের মোটা অংশটা আমাদের ট্যাঁকে গুঁজে নিয়ে বাকিটা ভাগ করে নেবো অন্য লগ্নিকারকদের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সুদের হারটায় কাট ছাঁট করে নিজের কোলে ঝোল টানা যায় না, ওটা পাবলিক ডকুমেন্ট। বাকি ব্যাঙ্কেরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না,বেশ বোঝে সিটি ব্যাঙ্ক অনেকটা মালাই খেয়ে নিচ্ছে তলে তলে। তবে সেটা হজম করত অন্যেরা, কারণ তারা মানতে বাধ্য যে সিটি ব্যাঙ্ক এই সব দেশে ব্রাঞ্চ খুলে, গুষ্টির লোক মোতায়েন এবং প্রচুর মেহনত করে এই ডিল যোগাড় করে এনেছে। অন্যদের মুরোদে সেটা কুলতো না।
আমাদের দাদাগিরি চলল আরও কিছুদিন। হাঙ্গেরি (বুদাপেস্ত ব্যাঙ্ক) রোমানিয়া (ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ রোমানিয়া ) স্লোভাকিয়া (স্লোভাক টেলিকম) এবং চেকিয়ার(চেক ইলেকট্রিক ) অর্থনীতিক ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক ঋণের আয়োজন করেছে সিটি ব্যাঙ্ক। তিরিশ বছর বাদে আজ সে সব ইতিহাস হয়ে গেছে জানি তবু ইউরোউইক, ইন্টারন্যাশনাল ফাইনান্সিং রিভিউ, ব্লুমবেরগে সবেরই উল্লেখ আছে। গুল দিয়ে পার পাবো না।
আমরা সহযোগী খুঁজছি, প্রতিযোগী নয় কিন্তু এটাও পরিষ্কার হতে থাকে এ বাজারে সবারই ফ্রি এন্ট্রি আছে যদি অবশ্য সাহসে কুলোয়। একলা চলার দিন হয়তো ফুরিয়ে এলো – আমাদের আবিষ্কৃত শাকের খেতে অনেক চিড়িয়া উড়তে থাকে।
এই সময়ে আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করা গেলো। এতদিন নামকরা ইউরোপীয় অর্থনীতিক পত্র পত্রিকা, যেমন ফাইনান্সিয়াল টাইমস, টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান কাগজের অর্থনীতি ও বাজার ক্রোড়পত্র আমাদের এই পূর্বের অভিযানকে বিশেষ পাত্তা দিতো না।
এবার তারাও নড়ে চড়ে বসলো।
প্রথম সেন্ট্রাল অ্যান্ড ইস্টার্ন ইউরোপ সিনডিকেটেড লোন কনফারেন্সের আয়োজন করল ইউরোমানি। স্থান প্রাগের ইন্টারকনটিনেনটাল হোটেল – যেখানে আমার প্রাগের প্রথম রাত্রিবাস। সেই পারিস্কা ৩০, স্তারে মিয়াসতো (পুরনো শহর ), প্রাগ। জানলা দিয়ে সেই সিনাগগ দেখা যায় যেখানে বাবার সন্তুষ্টি সাধনের জন্য কাফকা বছরে অন্তত চারদিন হাজিরা দিতেন। সমাপতন আর কাকে বলে?
সাল ১৯৯৭।
কর্ম জীবনে অনেক ব্যাংকিং কনফারেন্সে যোগ দিয়েছি। তবে প্রাগের এই অনুষ্ঠান আমার কাছে একাধিক কারণে স্মরণীয় – আমাদের কর্মকাণ্ডের কাহিনী শোনাবার প্রথম পাবলিক প্লাটফর্ম পেলাম। পূর্ব পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা মিলিয়ে চল্লিশের বেশি ব্যাঙ্ক আমন্ত্রিত- এই প্রথম একই রঙ্গমঞ্চে তাদের প্রতিষ্ঠানকে দেখা গেল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কিছু ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যে এই অঞ্চলে সবে শাখা খুলেছে বা ব্যাঙ্ক কিনেছে। ডাচ ব্যাঙ্ক আই এন জি, এ বি এন পোল্যান্ড রোমানিয়াতে চুটিয়ে স্থানীয় বাণিজ্য করছে গাড়ির বিমা থেকে এস এম ই ঋণ অবধি। মস্কোগামী প্লেনে সে সময় সিট পাওয়া যায় না। আমেরিকান ইংরেজিতে যাকে বলে এভরিবডি অ্যান্ড হিজ ব্রাদার রাশিয়াতে ব্রাঞ্চ খুলেছে। প্রাগের কনফারেন্সের স্টেজে, লাঞ্চ রুমে, ককটেল লাউঞ্জে তুমুল গজল্লা চলছে -এই তো সুদিন! অচ্ছে দিন!
এক সময়ে মনে হয়েছে এতো ব্যাঙ্ক যে কোন না কোন ভাবে ফিল্ডে নেমেছে কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যটা কি? আমি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের লোক- এর টাকা ওকে দিয়ে ফি পকেটস্থ করে লন্ডন ফেরত যাবো। সে দেশের সিটি ব্যাঙ্ক ব্রাঞ্চ বাকি ঝক্কি সামলাবে। আমরা বসন্তের সাথী। কিন্তু এই যে ব্যাঙ্কগুলি দেশে দেশে বিশাল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি খুলেছে, তারা কোন ব্যবসা ধরবে?
পূর্ব ইউরোপের ব্যাঙ্কগুলি অত্যন্ত কৌতূহলী – পশ্চিমের কোন ব্যাঙ্ক তাদের জন্যে বাজারে নামতে চায়?
বক্তার তালিকায় মুখ্যত সিটি, ডয়েচে, হল্যান্ডের এ বি এন, আই এন জি, ফ্রান্সের সসিতে জেনেরাল বঙ্ক নাসিওনাল দু পারি। ব্রিটিশ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান, নরডিক, অন্য আমেরিকান ব্যাঙ্কের দেখা নেই। মেরিল লিঞ্চ, সলোমন ব্রাদারস, গোল্ডম্যান, লেমান ব্রাদারস এখানে ভাষণ দিয়ে সময় নষ্ট করার জন্য আসবে না সেটা জানা কথা।
তিন বছর আগে বার্লিন থেকে গাড়ি চালিয়ে এক নভেম্বরে সন্ধ্যার অন্ধকারে পোল্যান্ডের একটি ছোট্ট গ্রামে হাজির হয়েছিলাম। সেদিনই যে আমার পূর্ব ইউরোপে পথ চলা শুরু হল জানতাম না। নিতান্ত ভাগ্যচক্রে ইতিহাসের পালা বদলের খেলার এক্সট্রার ভূমিকা পেয়েছি। অনেকদিন পরে সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডনের এক উচ্চ আধিকারিক, পরে হংকং অফিসের কর্ত্রী, ক্যাথি ওয়ের আমাকে লিখেছিলেন, তোমরা সেদিন জানতে না তোমরা ইতিহাস লিখছিলে।
সেই উন্মাদনা আমাকে তখনও চালিত করেছে –প্রাগে আরেক বসন্ত জাগ্রত হলো দ্বারে।
আমার স্লট ছিল প্রথম দিন বিকেলে। সে আমলে এমনি সভায় উপস্থাপনার মাধ্যম, আজ সম্পূর্ণ অজানা, অ্যাসিটেটের স্লাইড- সেখানে মোটা কলমে বুলেট পয়েন্ট লেখা। তার ওপর তাপস সেনের স্টাইলে আলোক নিক্ষেপ করে পর্দায় সেটি পেশ ও ব্যাখ্যা করা। একজন সহকারী সেখানে হাজির, একটা স্লাইড দেখানোর পর তাঁকে বলব, নেক্সট স্লাইড।
কি যে মাথায় এলো জানি না, সর্ব সমক্ষে সেই স্লাইডগুলি সরিয়ে রেখে বললাম, এই সেশনের জন্য বানানো এই সব বাণী বাকসো বন্দি থাকুক। আজ আমাদের অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। আমরা সবাই পশ্চিমে যে আন্তর্জাতিক ঋণের ব্যবসা করে থাকি তার ব্যাকরণ এক, প্রথা এক, ডকুমেন্ট, দলিল, কারেন্সি এক। কিন্তু আমরা পোল্যান্ডে যখন পা রাখি, দেখি পশ্চিমের নানান কায়দা কানুন সেখানে অজানা! কমিউনিস্ট আমলের অ্যাকাউনটিং ছিল অন্য রকম। অবাক হবেন না, পেন্সিলে লেখা ব্যাল্যান্স শিট পেয়েছি। আমাদের সব লোন সই হয় ইংলিশ ল অনুযায়ী -এই ল তাঁদের সম্পূর্ণ অচেনা। এদের কোন সি ই ওকে কখনো কারো সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের ব্যবসার ব্যাখ্যান করতে হয় নি, নিজের কাজ করেছেন আপিসে বসে। রোড শোতে যখন তাঁদের নিয়ে গেছি ভাষার সমস্যা হয়েছে, বিদেশি ব্যাঙ্কারদের সামনে দাঁড়ানোটাই একটা চ্যালেঞ্জ।
আমরা কেউ মাষ্টারস অফ দি ইউনিভার্স নই তবে এই ইউনিভার্সে আপনাদের একটু আগে হাঁটতে শুরু করেছি, যেটুকু বুঝেছি বলে মনে করি সেই গল্পটা শোনাতে চাই। আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর কি সেখানে পাওয়া গেছে? না, প্রশ্নগুলো ঠিক কি হওয়া উচিত তাই তো জানি না। ভারত, ব্রাসিল বা দক্ষিণ আফ্রিকাও উন্নতিশীল দেশ ; তাদের অর্থনীতি খুব শক্ত পোক্ত না হলেও সে সব দেশের আইন কানুন, ট্যাক্স ব্যবস্থা আমাদের অচেনা নয়, তাদের বিজনেস স্কুলে ইউরোপ আমেরিকার টেক্সট বই পড়ানো হয়। পূর্বের দেশে অনেক কিছু যে বেশ আলাদা; যেমন অ্যাকাউনটিং বছর শেষের ছ মাসের ভেতরে অডিটেড ব্যাল্যান্স শিট ছাপানোর কড়া কানুন, সেই অ্যাংলো স্যাক্সন জারিজুরি পূর্ব ইউরোপে খাটে না। আমাদের ঋণ প্রস্তাব নিয়ে যে ক্রেডিট গুরুদের সামনে দাঁড়াবো তাঁরা তো সেই পশ্চিমের আকাদেমিক ব্যাংকিং সিলেবাস পড়ে এসেছেন। সিটি ব্যাঙ্কেও তার কিছু অন্যথা হয় নি, তবে ওই সব দেশে আমাদের উপস্থিতি হয়তো কর্তাদের বাড়তি আশ্বাস দিয়েছে। আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন কিছু সহযোগী ব্যাঙ্ক, তাঁদের জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। তাঁরা সকলে এই সভাগৃহে উপস্থিত।এঁরা তাঁদের দেওয়া ঋণ ফেরত পেয়েছেন, সুদ সহ ( হলের ভেতরে হাস্যরোল)। আমরা একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। কেমন করে অনেকটা সময় যে কেটে গেলো। শেষে বলেছিলাম,
“ আমি মনে করি আমার জীবৎকালে আইরিশ সমুদ্র থেকে বেরিং প্রণালী অবধি বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে একই মুক্ত বাজারের অংশ হতে দেখব ( I believe in my life time I will see a free market stretching from the Irish Sea to the Bering Strait) “ .
গুস্তাভ দেকেমেনট নামের এক জার্মান ব্যাংকার ( বর্তমানে কে এফ ডব্লিউতে কর্মরত ) আমাকে সম্প্রতি মনে করিয়ে দিয়ে বলল স্রেফ আবেগের ওপরে তুমি এক ঘণ্টা চালিয়ে দিয়েছিলে!
এই সমাবেশে কিছু ব্যাঙ্ক তাদের লোকজন পাঠায়, অবজারভার হিসেবে। বাজারে কি হচ্ছে জেনে এসো, সবটাই কি আর খবর কাগজ পড়ে জানা যায়! আমার আবেদন ছিল সেই সব সম্ভাব্য সহযোগী ব্যাঙ্কের কাছে, আসুন যোগ দিন। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম- কিছু পূর্ব ইউরোপীয় ব্যাঙ্ক অন্য প্রাক কমিউনিস্ট দেশে অর্থ লগ্নি করতে ইচ্ছুক – ভালোয় মন্দয় সুখে দুঃখে পাশাপাশি বাস করেছেন,, তাঁদের প্রতিবেশীদের বিলক্ষণ চেনেন!
ভালো খবর। এসো হে নতুন লগ্নিকারক! বউনি করি!
উত্তর কথন
আইরিশ সমুদ্র থেকে মুক্ত বাজার বেরিং প্রণালী অবধি আজো পৌঁছুতে পারে নি, আটকে গেছে ইউরাল পাহাড়ে। পরের বছর (১৯৯৮) প্রথম ব্যাপক ব্যাংকিং বিপর্যয় দেখা দিলো রাশিয়াতে, পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে একের পর দুর্যোগের ঘনঘটা। আমরা কয়েক কদম পিছিয়ে দম নিয়ে আবার দু পা বাড়িয়েছি। আমার জীবৎকালের সীমানাও শেষ হতে চলল। তবু স্বপ্ন দেখার অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না।
সেই স্বতঃস্ফূর্ত নাটকীয় ভাষণের একটা অপ্রত্যাশিত ফল হয়েছিল। লন্ডনে ফিরে আসার পরে ইউরোমানি বুক পাবলিশিং কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভাগিদারী আন্তর্জাতিক ঋণ বা সিনডিকেটেড লোন ব্যবসা পশ্চিমের ব্যাংকারদের অজানা নয় কিন্তু তার পদ্ধতি, কায়দা কানুন পূর্ব ইউরোপে একটু অন্য রকম চেহারা নিচ্ছে, সেগুলো নিয়ে চর্চা হোক। আপনারা এক অর্থে পথিকৃৎ,আপনাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।। ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকিং প্রাকটিশনারদের হয়তো একটু অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। এই নিয়ে কিছু ব্যাঙ্কারের সঙ্গে একযোগে একটি বই সম্পাদনা করার কথা ভাবা হচ্ছে, ;একটু অন্য মানের বই যেটি অন্যান্য ব্যাংকিং পাঠ্য পুস্তকের পাশে স্থান পেতে পারে।
আমি কি সেখানে সহযোগিতা করতে পারি?
সে যাবত বাজারে সবচেয়ে চালু বই, প্রায় অবশ্যপাঠ্য ‘ সিনডিকেটেড লেনডিং : প্র্যাকটিস অ্যান্ড ডকুমেন্টেশান ‘ গ্রন্থের লেখক, হংকং সাংহাই ব্যাঙ্কের টোনি রোডস খবরটা শুনে অত্যন্ত রুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেন দেশ বা উন্নয়নের লেভেলের ভিত্তিতে ব্যবসার প্রথা পদ্ধতি বদলায় না।
ইউরোমানি সম্পাদকরা এই প্রতিবাদ উপেক্ষা করেছিলেন।
দুটি অধ্যায় লিখেছিলাম -কিভাবে সিনডিকেশন করা হয় এবং একটি কেস স্টাডি ( বুদাপেস্ত ব্যাঙ্ক, পূর্ব ইউরোপের প্রথম ব্যাঙ্ক লোন সিনডিকেশান )।
ছাপার অক্ষরে সেই আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ।
Syndicated Lending
A Handbook for Borrowers in Emerging Markets
Euromoney Publications.