পাঁচ বছর হয়ে গেলো ফ্রাঙ্কফুর্ট ছেড়েছি। সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডনে কাজ করি। নতুন ঠিকানা ৩৩৬ স্ট্র্যানড। ওয়াটারলু ব্রিজ পেরুলেই যে মোড়টা পড়ে তার বাঁ দিকে গেলে ট্রাফালগার স্কোয়ার সোজা লন্ডন সিটি আর ডান কোণায় সিটি ব্যাঙ্ক। পাশেই ভারতীয় হাই কমিশন, তার পরের বাড়িটি বি বি সি বুশ হাউস যেখান থেকে বেতারে প্রচারিত ওয়ার্ল্ড সার্ভিস শুনেছি বাল্য ও যুবা বয়েসে। সিটির এই আইকনিক (চলতি ভাষায়) সৌধ এককালে ছিল গেইটি থিয়েটার। একতলার লাঞ্চ রুম গুলি বিখ্যাত অভিনেতৃদের নাম বহন করতো। আজ সে বাড়ি একটা হোটেল।
ইহুদি পাড়ায় বাস। নর্দার্ন লাইনের নিত্যযাত্রী - ক্যামডেন টাউনে ট্রেন বদলে কভেনট গার্ডেনে নামি। সেই কভেনট গার্ডেন যেখানে এলাইজা ডুলিটলকে ফুল বেচতে এবং কর্নেল পিকারিং ও হেনরি হিগিনসকে ভাষা নিয়ে বাক্যালাপ করতে দেখেছিলাম মাই ফেয়ার লেডি ছবিতে, এলিট সিনেমার ৬৫ পয়সার সিটে বসে। জীবনে পরিবর্তন - বিবাহ, মর্টগেজ, দুটি সন্তান। আরেকটি নতুন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি- এ দেশে আসার আগে মনে করতাম ইংরেজিটা জানি। সেই ভুল ধারণা ভাঙ্গলো খুব তাড়াতাড়ি।
আমার নতুন চাকরিতে জার্মানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ সীমিত। অরটউইনের মতন বন্ধুরা টেলিফোনে যোগাযোগ রাখে, গল্প গুজব করে জার্মান চর্চা বজায় রাখি। এক দশক আগে জার্মানি গিয়ে ইংরেজি বই খুঁজতাম- এখন ইংল্যান্ডে এসে জার্মান বই পত্রিকার সন্ধান করি। স্যাটেলাইট টেলিভিশন আসতে কয়েক বছর, ইনটারনেট আসতে এক যুগ বাকি। বই পড়ার সুযোগ কম হলেও হাইকের সঙ্গে নিয়মিত চিঠি পত্র আদান প্রদানের কারণে লিখিত পঠিত জার্মানের যোগসূত্র বহাল থেকেছে। পূর্ব জার্মান গোয়েন্দা দফতর স্টাজি হয়তো খাম আর খোলে না –অক্ষত দেহে তার চিঠি আমার কাছে উপনীত হয়। কিন্তু অন্যদিকে আমার যে চিঠি সে পায় সেটি আরও কয়েকজন ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছেন বলে হাইকে মনে করে। সাম্যবাদের স্বর্গরাজ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপব্যয় করা হতো এই পত্রাবলী পাঠাভ্যাসের প্রয়োজনে! চিঠির ধারা রুদ্ধ হয় নি। আমাদের দু জনের জন্মদিন ডিসেম্বরে, কাছাকাছি দিনে। পালা পরবে কার্ড পাঠানোর প্রথা থেকেছে অব্যাহত। হাইকের বিয়ে হয়েছে পনেরো কিলো মিটার দূরের শহর স্টাডরোডাতে। তার নতুন পরিচয় হাইকে গোয়েরকে, ঠিকানা মাক্স শিফারডেকারস্ত্রাসে ১৩ (আক্ষরিক অর্থে শিফার মানে স্লেট পাথর)। এরিকা আর হ্যারবেরট অবসর নিয়ে হ্যারমসডরফের সেই উথমানস্ত্রাসের পাঁচ নম্বর বাড়িতে থাকেন।
কলকাতা (১৯০২) ব্রাঞ্চ খোলার প্রায় সিকি শতাব্দী বাদে সিটি ব্যাঙ্ক বার্লিনে আবির্ভূত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি প্রায় কাটিয়ে উঠেছে জার্মানি। উদ্দাম বিশের দশক : বব ফসের পরিচালনায় এবং লাইজা মিনেলির অসাধারণ অভিনয়ে মূর্ত ছবি ক্যাবারে ছবি এই সময়কার শ্রেষ্ঠ দলিল (সময় সুযোগ পেলে ক্রিস্টোফার ঈশারউডের গুডবাই বার্লিন অবশ্যই পড়বেন)। অর্থে, শিল্পে, ক্রীড়ায়, নোবেল প্রাইজ জেতায় জার্মানি আবার জগতসভায় উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। সিনেমা জগতে ভিকটর / ভিকটোরিয়া, ব্লু এঞ্জেল বার্লিনের সিনেমা জগতে আলোড়ন তুলেছে। মারলিনে দিয়েত্রিশের চিত্রপটে আত্মপ্রকাশ!। পরের তিন বছরের মধ্যে এই সুসময়ের অবসান – ওয়াল স্ট্রিট ক্র্যাশ, হিটলারের উত্থান, সিটি ব্যাঙ্কের প্রস্থান। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের শেষে সিটি ব্যাঙ্ক যখন জার্মানিতে ফিরে এলো, পশ্চিম বার্লিনের বাণিজ্যিক মূল্য প্রায় শূন্য। রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে বন নগরে। জার্মান ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ের নতুন কেন্দ্রবিন্দুর নাম ফ্রাঙ্কফুর্ট,মাইন নদীর তীরবর্তী চার লক্ষ মানুষের শহর, জনসংখ্যায় দেশের সপ্তম। পশ্চিম জার্মানির অলৌকিক অর্থনৈতিক জাগরণের উৎসবে যোগ দিয়ে পারিশ্রমিক ও সুদ আদায়ের সদিচ্ছায় ফ্রাঙ্কফুর্ট সহ হামবুর্গ, মিউনিক, ডুসেলডরফে সিটি ব্যাঙ্কের শাখা খোলা হয় – বার্লিনে একটি ছোট অফিস, আমরাও আছি জানিয়ে সাইন বোর্ড টাঙ্গানোর জন্য!
আটের দশকে সেই বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং জার্মানির ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনার আশায় সিটি ব্যাঙ্ক অতিরিক্ত শাখা খুলেছে স্টুটগারট, মানহাইম, কলোন, নুরেমবেরগে। জার্মানির অন্য দিকে লাইপজিগ বা ড্রেসডেনে দোকান খোলার কোন প্রশ্ন ওঠে না। পূর্ব জার্মানির নেতা এরিখ হোনেকার পশ্চিমি পদক্ষেপ ছাড়াই শ্রমজীবীর স্বর্গ গড়ে তুলছেন। সিটি ব্যাঙ্কের নাক গলানোর সুযোগ নেই।পূর্ব জার্মানি কেন, কমিউনিস্ট ইউরোপের কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পশ্চিমের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার যোগাযোগ ছিল অকল্পনীয়। সরকারি লেভেলে ঋণের আদান প্রদানের কথা শোনা গেছে বটে কিন্তু সেখানে সুদের হার কোন হিসেবে মাপা হতো, ফি নামক মালাইটি কে খেতেন সে সব গোপন তথ্য গোপনেই রয়ে গেছে। আমাদের কপালে ঢু ঢু!
সিটি ব্যাঙ্কে কর্পোরেটের সেবা পরিত্যাগ করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যবসায় লেগে পড়েছি। আমার দিগন্ত ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে। পশ্চিম ইউরোপ,আফ্রিকা, আরব দেশগুলির সঙ্গে নতুন পরিচয়। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের দেড়শ কিলো মিটার পূবে কি ঘটে তা জানার আগ্রহ বা অনুমতি দুটোরই অভাব। লৌহ যবনিকা কেউ টাঙ্গিয়ে দিয়ে যায় নি। অন্তত পশ্চিমে সেটা ছিল আমাদের অনুভূতিতে। তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পোল্যান্ড।
উনিশশো আশি সালের পয়লা সেপ্টেম্বর গদ্যানসক (ডানজিগ)ও শ্চেচিনে (স্টেটিন) জাহাজ বানানোর কারখানায় লড়াকু শ্রমিকদের সতেরো দিনের স্ট্রাইকের শেষে শ্রমিক সঙ্ঘ (সলিদারনশ) এবং পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। শ্রমিকরা পার্টিকে সরকারের একক রাজনৈতিক প্রতিভূ রূপে মেনে নিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিকের একমাত্র প্রতিভূ নন- সে ভূমিকায় দেখা দিলো এক স্বাধীন দলনিরপেক্ষ শ্রমিক সংগঠন যার নেতৃত্ব দিলেন গদ্যানসক লেনিন শিপ ইয়ার্ডের ইলেকট্রিক মিস্ত্রি লেখ ওয়ালেনসা (যিনি পরে পোল্যান্ডের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হবেন)। এটা কি আপোষে রফা, এক অপরকে মেনে নেওয়ার কমপ্রোমাইজ? যাই বলি না কেন, ১৯৪৯ সাল থেকে সারা পূর্ব ইউরোপে চালু “এক দল এক মত এক সরকার” এই ধারণায় চিড় ধরল। চিংক ইন দি আরমার।
অশনি সঙ্কেত?
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বার্লিন দেওয়াল ভাঙ্গাকে লৌহ যবনিকা উত্তোলনের দিন বলে চিহ্নিত করার ট্রাডিশন আজ সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু চার দশক বাদে স্বীকার করে নিতে কোন দ্বিধা নেই যে পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সেই যবনিকা তোলার প্রথম ঘণ্টি বেজেছিল। আমরা কি শুনেছিলাম?
বিশ্ব রাজনীতির কথা বাদ দিই। অকুস্থলের মাত্র নশো কিলো মিটার দক্ষিণে ফ্রাঙ্কফুর্টের অথবা আরও দূরে নিউ ইয়র্ক লন্ডনের ব্যাঙ্কিং জগত কি এই সঙ্কেত লক্ষ করেছিল? পূর্ব ইউরোপে পট পরিবর্তনের পালা আসন্ন? বাণিজ্যে যদি আমরা যেতেই না পারি তবে তাহলে লক্ষ্মী বা অলক্ষ্মী কোনোটাই যে জুটবে না। বেল পাকিলে কাকের কি?
কমিউনিস্ট দুনিয়াকে ধার না দেবার প্রচলিত প্রথাটি ভঙ্গ করে ১৯৮৮ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক পোল্যান্ডকে একটি ঋণ মঞ্জুর করলেন – মনে আছে কিছু ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার বলেছিলেন ডলার না দিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্ক যদি গ্যারান্টি দিতেন আমরা এই ঋণ সাফল্যের সঙ্গে বাজারে বেচতে পারতাম! নিজেদের ঢাক নিজে পিটিয়ে আজও বলি পোল্যান্ড তথা পূর্ব ইউরোপের প্রথম বাণিজ্যিক ঋণ (স্টচনিয়া গদিনিয়া) আমরা কোনো সরকারি গ্যারান্টি ব্যতিরেকে নিবেশকদের কাছে বিক্রি করেছিলাম (মথি লিখিত পোল্যান্ড পর্ব পশ্য)।
আন্তর্জাতিক দ্রব্য বেচা কেনার বাজারে ততদিনে সিটি ব্যাঙ্কের ঝাণ্ডা নিয়ে নেমে পড়েছি – যেখানে দেখি আমদানি রপ্তানি সেখানেই ছাই উড়াইয়া দেখি যদি দু পয়সা জোটে। আমার সহকর্মী নীল স্পেরিন খাস মেলবোর্নের মানুষ। একদিন সে জানালে সিটি অস্ট্রেলিয়া অফিস জানিয়েছে মস্কোর এক সরকারি দফতর অস্ট্রেলিয়ান উল কেনে। আমরা কি সোভিয়েত ইউনিয়নের ঝুঁকি নিয়ে সেই উল বিক্রেতার প্রাপ্য টাকা আগাম দিতে পারি? পথে বাধা বহুবিধ। মস্কোয় আমাদের শাখা বা সেখানে ঝুলন্ত শাখামৃগ অবধি নেই। কথা বলব কার সঙ্গে?
একটি পূর্ব ইউরোপীয় ব্যাঙ্ক এবং পল মিলসের নাম মনে পড়লো।
৮১ নম্বর কিং উইলিয়াম স্ট্রিটের মস্কো নারোদনি তখন লন্ডনে অধ্যুষিত সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা পূর্ব ইউরোপের একমাত্র ব্যাঙ্ক (মহান অক্টোবর বিপ্লবের দশ বছর আগে স্থাপিত, ১৯১৭ সালে অধিগৃহীত)। পল মিলস তাদের আন্তর্জাতিক আমদানি রপ্তানি দেখে। দু বছর আগে অবধি ডাচ ব্যাঙ্ক এবিএনে কাজ করতো পল। সেখান থেকে চেনা। তার ডেস্ক চিলে কোঠার মতন একটা ঘরে, খুব নিচু সিলিং। পলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মস্কো নারোদনি ব্যাঙ্কে কাজ করতে গেলে রাশিয়ান জানাটা জরুরি কিনা। পল হেসে বললে তার কোন প্রয়োজন নেই। তবে কি বাজারে আজকাল রাশিয়ান টু ইংলিশ অভিধান খুব বিকোচ্ছে। কারণ সুপ্রিম সোভিয়েতের নতুন নেতা মিখাইল গরবাচেভ দুনিয়াকে চমকে দিয়ে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কারের (পেরেসত্রয়কা) ঘোষণা করেছেন।কোন কোন সরকারি সংস্থাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে আপন উৎপাদন ও বণ্টনের। ছোটখাটো ব্যবসায়ের বে সরকারি মালিকানা মঞ্জুর। তার সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা (গ্লাসনসত)। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শোনা যৌথ খামার, চিরন্তন মৈত্রী এ সবের অর্থ আমরা এতদিনে উদ্ধার করে ফেলেছি। তবে এই নতুন দুটি শব্দ হৃদয়ঙ্গম করতে মানুষজন উদগ্রীব তাই অভিধান নিয়ে টানাটানি। এমনকি মিসেস থ্যাচার অবধি বলেছেন সেক্রেটারি গরবাচেভের সঙ্গে কাজ করা যায় (ওয়ান ক্যান ডু বিজনেস উইথ হিম)।
সোভিয়েত ইউনিয়নের এক ব্যাঙ্কের ভেতরে বসে স্বাধীন মতামত প্রকাশ করে পলকে বিপদে ফেলার কোন বাসনা ছিল না। তবু বললাম এই যে সেদিন প্রেসিডেন্ট রেগান বার্লিন দেওয়ালটি ভেঙ্গে ফেলার সুপরামর্শ দিয়েছেন গরবাচেভকে – মিস্টার গরবাচেভ টিয়ার ডাউন দি ওয়াল। সেটা কি ওই গ্লাসনস্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে? পল বললে ও সব ছাড়ো, আরেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিশ বছর আগে ওই একই দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ‘ইখ বিন আইন বেরলিনার’ বাণী দিয়ে গেছিলেন, কি হলো? লোকে ঠাট্টা করে বলে তিনি বেরলিনার বলতে একটি বিশেষ গোলাকৃতি জার্মান রুটির কথা বলেছিলেন!
অস্ট্রেলিয়ান উল প্রসঙ্গ উঠল। মস্কো নারোদনি ব্যাঙ্ক কি আমাদের অভিলাষ মস্কোয় পৌঁছে দিতে পারে? সে দেশে সবই যখন সরকারি, এই উলের দাম চোকানোর জন্য গ্যারান্টি পাওয়া যায় কি? তাহলে আমরা কাজে নামতে পারি। পল বললে সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্যারান্টির কথা ভুলে যাও, এক্ষেত্রে উল কিনছে একটি সরকারি দফতর, কোন কোম্পানি নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে গ্যাস অবধি বিক্রি করে গ্যাস মন্ত্রক।। তারা আবার আলাদা করে গ্যারান্টি দেবে কেন? তোমার ঝুঁকির নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা কখনো কথার, ঋণের বা সুদের খেলাপ করে না।
সেটা মানতে হলো। অক্টোবর বিপ্লবের পরে ১৯১৭ সালে রাশিয়া বিদেশি নিবেশকদের বহু টাকা ডুবিয়ে ছিলো - তারপর থেকে তাদের সেলেট নিতান্ত পরিষ্কার। খাবার জুটুক না জুটুক, সব বিদেশি দেনা ঠিক সময়ে শোধ করেছে। সেটি পূর্ব ইউরোপের সব দেশের ব্যাপারেই প্রযোজ্য। চাউচেস্কুর বিদায়কালে রোমানিয়ার একটি ডলার ধার ছিল না।
প্রস্তাব দিলাম – মস্কোর উল মন্ত্রক আমাদের সঙ্গে কাগজে কলমে চুক্তি করলে আমরা তাদের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। জাহাজে উল তুলে দেওয়া মাত্র অস্ট্রেলিয়ান বিক্রেতাকে তাদের প্রাপ্য টাকা চুকিয়ে দেবে আমাদের মেলবোর্ন শাখা আর সে টাকা উদ্ধারের জন্য সিটি ব্যাঙ্ক লন্ডন উল মন্ত্রকের ঝুঁকি নেবে। তৎক্ষণাৎ দামটা পেয়ে যাচ্ছে বলে উল বিক্রেতা তার দরে কিঞ্চিৎ ছাড় দিতে পারে, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাভ।। পলের পরবর্তী প্রশ্ন – কতদিনের জন্য, কত ধার দেবে সিটি ব্যাঙ্ক আর সুদের হার কি হবে?
এতক্ষণ সেতারে টুং টাং আলাপ চলছিল। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের ভাষায় যাকে বলি মাছ ধরার প্রয়াস (ফিশিং ফর এ ডিল) বা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া (শুটিং দি ব্রিজ)- যদি লেগে যায়! পল এবার জোড় ঝালা এবং গৎ বাজাতে চায় যে! সেতারটাকে তাহলে সুরে বেঁধে আনতে হয় - আমাদের কর্তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য করতে কতদূর প্রস্তুত, লন্ডন সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি? না, যেতে হবে নিউ ইয়র্কে ৩৯৯ পার্ক এভিনিউয়ের চার তলায়? আমাদের ক্রেডিট গুরুদের আশীর্বাদ মিলবে কি?
লম্বা গপ্পকে ছোট করে বলি কিঞ্চিৎ দ্বিধা সত্ত্বেও সিটি ব্যাঙ্কের স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা এই ডিলের সমর্থনে উদ্বাহু হলেন, নিউ ইয়র্ক যাবার কোন প্রয়োজন অনুভব করলেন না। আমার দীর্ঘ ব্যাঙ্কিং জীবনে দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রেডিট বেত্তা একদা ক্যালিফোর্নিয়ার, অধুনা মেয়দা ভেলের বাসিন্দা আর্ট (আরথার) গ্র্যান্ডি নীতিগত ভাবে অগ্রসর হবার আজ্ঞা দিলেন। কিন্তু আমার উৎসাহের জোয়ারে ভাঁটা পড়লো যখন উল মন্ত্রণালয় তিনটি কঠিন দাবির তালিকা পেশ করলেন-
ঋণের পরিমাণ হবে ন্যূনতম তিন কোটি জার্মান মার্ক, মেয়াদ হবে পাঁচ বছর এবং সুদের হার, এখনো স্পষ্ট মনে আছে, লন্ডন ইনটারব্যাঙ্ক দরের ওপরে ৮২ পয়সা! আপনার কথা থাক, আমার কথাও থাক এ ধরনের কোনো আলোচনার সুযোগ তাঁরা দেন নি।
আর্টের অফিসে গিয়ে ভগ্ন দূতের মতন এই বার্তা দিলে তিনি বলেছিলেন আশা করি শক্ত ভাবে না বলে এসেছো (হোপ ইউ সেড ইট ইজ এ ডেফিনিট নো)!
জানুয়ারী ১৯৮৯।
দু বছর বাদে রাশিয়ান সরকার ৮৫% হারে সুদ দিয়ে দেশ চালাবেন।
কীসের সঙ্কেত বাতাসে?
১৯৮৯ সালের মে মাসে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির চল্লিশ বছর পূর্তির মহা সমারোহ। বার্লিনের কার্ল মার্ক্স আলেতে গরবাচেভ, হোনেকার, চাউচেস্কু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পূর্ব জার্মানির পতাকাকে স্যালুট করলেন। বছর না ঘুরতেই চাউচেস্কু প্রাণ, হোনেকার চাকরি এবং গরবাচেভ প্রতাপ হারাবেন।
আমাদের মত ক্ষুদ্র মানুষের জীবনে তার কোন ছায়া পড়ে না। হাইকে লিখল সব আগের মতই (আলেস বাইম আলটেন)। এর বেশি লিখলে বিপদ আছে।
একদিন রয়টারে খবর এলো (মে ১৯৮৯) - ম্যাকডোনালডকে বেজিঙ্গে দোকান খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে আমাদের অর্থলগ্নির কোন সুযোগ নেই। এ সামান্য টাকা তাদের শিকাগো অফিস দেবে। শোনা গেলো অনুমতি পেতে বছর খানেক সময় লেগেছে (দোকান খুলতে আরও ছ মাস)। পরের মাসে এই খবরকে ছাপিয়ে গেলো একটি আশ্চর্য ছবি – একটা গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে একজন একটি ট্যাঙ্কের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে – স্থান তিয়ানানমেন স্কোয়ার (স্বর্গীয় শান্তির দ্বার)। তারপরে আর কোন খবর নেই টেলিভিশনে।
যুদ্ধোত্তর কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপে সিটি ব্যাঙ্কের একটি মাত্র অফিস ছিল - ব্রাঞ্চ নয়, সিটি ব্যাঙ্কের মালিকানাধীন এক কোম্পানি। ঠিকানা ভাসি উতসা। পেস্টের লোহার সেতু পেরিয়ে ইনটার কনটিনেনটাল হোটেলকে পাশ কাটিয়ে ডাইনে গেলে কেবলমাত্র পথচারীদের জন্য নির্দিষ্ট যে পথ সিধে দক্ষিণে চলে গেছে তারই নাম ভাসি উতসা- সব সময় গমগম করছে! অধ্যক্ষ ছিলেন রবিন উইঞ্চেসটার, স্থানীয় সহযোগী গাবি রেডেই। তাঁরা মাঝে সাঝে আসতেন লন্ডনে। ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষ কিছু হতো কিনা কে জানে। সহকর্মী মার্ক অ্যাটকিনস বলতো ওটা সি আই এর আড্ডা। তবে গল্প শুনতাম তাঁরা কি করতে চান। পুবের সীমানা পেরুতে আমার তখনও তিন বছর বাকি!
রবিন একদিন লন্ডন অফিসে কাকে যেন খবর দিয়েছেন হাঙ্গেরিয়ান সরকার আড়াইশো কিলো মিটার ব্যাপী অস্ট্রিয়ান সীমান্তে লাগানো বৈদ্যুতিক কাঁটা তারের বিজলি কানেকশান কেটে দিয়েছেন। স্বভাবসিদ্ধ ইংরিজি ঠাট্টা চালু হল বাজারে –বিজলির বিল দেবার পয়সা নেই! হাঙ্গেরি সরকার দেউলে হল বলে! সিটি ব্যাঙ্ক হাউসের ছ তলায় উদ্যোগী ব্যাঙ্কাররা সস্তায় হাঙ্গেরিয়ান বন্ড কিনে কিছু মুনাফা করা যায় কিনা তার ধান্দায় লেগে পড়লেন।
২৭শে জুন এক নাটকীয় ঘটনা দেখা গেলো টেলিভিশনে, লাইভ নয়, রেকর্ডেড। হাঙ্গেরি এবং অস্ট্রিয়ার বিদেশ মন্ত্রীরা মহা আড়ম্বরে বড়ো কাঁচি দিয়ে সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া কাটছেন! দেশে থাকতে শুনেছিলাম মন্ত্রীরা কাঁচি কেটে সেচ প্রকল্প অথবা সেতুর আবরণ উন্মোচন করতেন।
আজ এই গ্রীষ্মকালের দুপুরবেলায় এ কোন খেলায় করলে নিমন্ত্রণ?
হাঙ্গেরি? খুব অল্প বয়েসে সেতুর ওপারে মুক্তি (জেমস মিচেনারের দি ব্রিজ অ্যাট আন্দাউ এর অনুবাদ) পড়েছিলাম। অক্টোবর ১৯৫৬ সালে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে প্রথম সরব প্রতিবাদের কাহিনি। বুদাপেস্টে ছাত্ররা পথে নেমেছিলেন কমিউনিস্ট একনায়কত্বের প্রতিবাদে, শেকল ভাঙ্গার দাবিতে। তাদের নেতৃত্ব যিনি দিয়েছিলেন সেদিন সেই ইমরে নজ এক মুক্ত হাঙ্গেরিকে বাঁচানোর আবেদন জানিয়েছিলেন মুক্ত বিশ্বের কাছে, রাষ্ট্রসংঘের কাছে। কেউ জবাব দেয় নি। তিন দিনের মধ্যে রাশিয়ান ট্যাঙ্ক সে আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেয়। ইমরে নজকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। তাঁর স্মারক আজ দেখবেন মারগারেট সেতুর কাছে।
আজ আবার হাঙ্গেরি? আবার সোভিয়েত ট্যাঙ্কের দুর্বার আগমন? আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো? দেজা ভু?
কিন্তু কিছুই হল না। গাবি জানালে হাঙ্গেরি অস্ট্রিয়া সীমান্তে এক আন্তর্জাতিক পিকনিকের আয়োজন হয়েছে যেখানে পূর্ব জার্মানির অনেক তরুণ তরুণী হাজির। সেটা কি করে? উত্তর সহজ। পূর্ব জার্মানি ও হাঙ্গেরি এই দুই সাম্যবাদী দেশের মধ্যে আসা যাওয়ার কোন বাধা নেই। হাজার হাজার মানুষ পূর্ব জার্মানি থেকে হাঙ্গেরি এসেছেন – এখানে সীমান্ত পেরিয়ে হয়ে অস্ট্রিয়া ঢুকলে পশ্চিম জার্মানি আর কতদূর?
রাশিয়ান ট্যাঙ্ক এলো না। ক্রেমলিনের উঁচু দেওয়াল থেকে প্রতিবিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত অগ্নিগর্ভ ভাষণ শোনা গেলো না।
জুন ১৯৮৯ – বাঁধ ভাঙ্গছে।
আমরা কতটুকু আঁচ পেয়েছিলাম? পশ্চিম ইউরোপ আর বাকি পৃথিবী নিয়ে আছি - পূর্ব ইউরোপের কোন ছায়া সেখানে নেই। আমার সে বছরের অফিস ক্যালেন্ডার তার সাক্ষী! আমার দিন তেমনি কাটে যেমন আগে কাটতো। হাঙ্গেরিতে যা হচ্ছে সেটা ওই দূরে কোথায়, দূরে দূরে। সেখানে আমার মন ঘুরে বেড়ায় না।
শুক্রবার, বাইশে নভেম্বর ১৯৬৩ সালে কে কোথায় কখন কি করছিলেন সেটা নানান আড্ডায় আলোচনার একটা বিষয় ছিল বহুদিন। পরের দিন, শনিবার সকালে আমাকে খুব সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাবা বলেছিলেন জন কেনেডিকে কে বা কারা গুলি করে মেরেছে।
ছাব্বিশ বছর পরে নয়ই নভেম্বর ১৯৮৯ সালে কে কোথায় কখন কি করছিলেন তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা শুনি নি। হয়তো হাঙ্গেরিয়ান সীমান্তে সেই কাঁচি কাটা থেকেই আমরা ধরে নিয়েছিলাম এই জলতরঙ্গ রুধিবে কে? পরবর্তী কালে এই ঘটনার গুরুত্ব নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, আলোচনা, ফিলিম হয়েছে কিন্তু আমরা এতো কাছে থেকেও কতটা বুঝেছি সেদিন?
মনে পড়ে কোথায় যেন পড়েছিলাম – আমেরিকায় একটি মেয়ে ডায়েরিতে লিখেছিল "গতকাল খুব হাওয়া উঠেছিল। আমাদের কুকুর বিলি সারাদিন দারুণ লাফালাফি করে বেড়িয়েছে। কাল ইউরোপের যুদ্ধ শেষ হয়েছে।"
ডায়েরির তারিখ ৯ মে, ১৯৪৫
আমাদের দেশের হালখাতার মতন বছরের শেষে বড়ো খদ্দেরদের ডেকে আপ্যায়ন করার একটা রীতি সিটি ব্যাঙ্কে প্রচলিত ছিল। প্রতি বছর নতুন নতুন জায়গা খোঁজা হতো। জন ম্যাকফারলেন (পরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, এ এন জেড ব্যাঙ্ক) ছিলেন সিটি ট্রেজারি অধ্যক্ষ। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে বোঝালেন তাঁর দেশের ব্যাঙ্ক হিসেবে সিটি ব্যাঙ্ককে সেবারের বাৎসরিক উৎসব উপলক্ষে দূতাবাসটি খুলে দেওয়া হোক! আমাদের খদ্দেররা চমৎকৃত – গ্রভেনর স্কোয়ারের আমেরিকান দূতাবাসে খানা পিনা! আজ সেই আমন্ত্রণ পত্রটি চোখে পড়লো। তার সঙ্গে মনে হল বার্লিন প্রাচীরের পতনের একমাস বাদে সেই অনুষ্ঠানে আমেরিকান বাণিজ্যিক কাউনসিলর অথবা জন ম্যাকফারলেন তাঁদের বক্তৃতায় দুনিয়ার আর দশটা বিষয় নিয়ে আপন মতামত জাহির করলেও পূর্ব ইউরোপ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। সেটা কূটনীতিতে আটকেছিল কিনা জানি না তবে সমবেত জনতার মধ্যেও দেখি নি বিশেষ কৌতূহল।
কোথায় অশনি? কীসের সঙ্কেত?
ইতিমধ্যে আমার জীবনে আরেকটি পালাবদলের সূচনা হল।
জার্মানির জন্যে মন কেমন করত। তাকে আমি আজও দ্বিতীয় মাতৃভূমি বিবেচনা করি। আবেগের সঙ্গে বাস্তবের ব্যবধান বিশাল তা জানি। তবু স্বপ্ন দেখার বাধা নেই। সিটি ব্যাঙ্কের এই বিশ্বব্যাপী সংসারের ভেতরে বাসা বদল না করেও আমার জার্মান জ্ঞানটি ভাঙ্গিয়ে কোন কাজ জোটে কিনা সেই চেষ্টায় লেগেছিলাম।
বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। সিটি ব্যাঙ্কের একটি বিশেষ ব্যবসা ছিল অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য ইলেকট্রনিক সুবিধা বিক্রি করার। এই ব্যবসায়ের কর্ণধার হ্যারব মাইয়ার এমন কাউকে খুঁজছিলেন যে লন্ডন অফিস থেকে সারা জার্মানি অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডে এটি বেচতে পারে। সেখানকার সিটি ব্যাঙ্ক ব্রাঞ্চের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভাবে সম্পর্ক বিহীন - আমাদের নিজেদের খদ্দের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। এ ধরনের কাজ আগে বা পরে কখনো করিনি। বার্লিন দেওয়াল ভাঙ্গার পরের সপ্তাহে জানলাম হ্যারব আমাকে সে কাজে মনোনীত করেছেন। যোগ দিতে হবে মিশরের লুক্সর শহরে, জানুয়ারী মাসে। সেখানে তখন চলবে এক সেমিনার। জার্মান ভাষাভাষী দুনিয়াতে আধুনিক ব্যাঙ্কিং পদ্ধতি বেচার সঙ্গে মিশরের কি সম্পর্ক তা নিয়ে প্রশ্ন না করে লুক্সর যাবার দিন স্থির করলাম।
জার্মানি! আবার আসিব ফিরে!
কাজের ব্যপারটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ইউরোপে যে ঘটনাগুলো দ্রুতগতিতে ঘটছে তার সঙ্গে আমার জীবন অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে পড়বে সেটা ছিল স্বপ্নের অতীত।
হাইকের সঙ্গে আবার দেখা হবে। মুক্ত জার্মানিতে।