দেড় দশক আগে ব্লেদের গ্র্যান্ড হোটেল টপলিচের বয়স্ক কনসিয়ারজ বলেছিলেন, যদি পারেন গ্রীষ্মের দিনে আসুন, দেখবেন কী গভীর নীল এই ব্লেদ লেকের জল।
ইতিমধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডে এসেছি – তার চরিত্র কলোনিয়াল। ইউনিয়ন জ্যাক যেখানে কখনও ওড়েনি – সে সব দেশে এ ব্যাঙ্কের বিশেষ আগ্রহ বা প্রতিপত্তি ছিল না। পূর্ব ইউরোপে আমার আসা যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। এমন সময়ে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্ক কেনা হল। যার ফলে না চাহিতেই পূর্ব ইউরোপে মস্কো-কিভ-আলমাতি সহ বেশ কয়েকটা শাখার মালিকানা জুটে গেল। আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক ব্যাবসা মুখ্যত ব্যাঙ্ককেন্দ্রিক – নিউ ইয়র্কে ডলার ক্লিয়ারিং, লেটারস অফ ক্রেডিট, কিছু ফরেন এক্সচেঞ্জ। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং নামক অনিশ্চিত পথে তারা পা বাড়ায়নি। আমাদের তো পলিসিতে আটকায় না। অতএব আমরা সেইসব দেশের ব্যাঙ্কের সঙ্গে বন্ড এবং আন্তর্জাতিক ঋণের আমড়াগাছি শুরু করি। রাশিয়া-কাজাখস্তানে কিছু অর্থসংগ্রহ করার ফলে আমাদের ব্যাঙ্কের মার্গদর্শকেরা উৎসাহিত হলেন – আদেশ দিলেন পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য খদ্দেরের জন্য ‘ডলার দেবে গো’ বলে মাধুকরী ভিক্ষায় নেমে পড়ার পথে বাধা নেই – এগিয়ে যাও ফি-আদায়ের সন্ধানে। তাঁরা অবশ্য বোঝেন না, এই ভিক্ষার অনুমতি আমার ব্যাঙ্ক নয় – কোনো খদ্দের দিতে পারে।
অতঃপর চলো স্লোভেনিয়া। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ লুবলিয়ান্সকা বাঙ্কা।
স্লোভেনিয়ার নোভে মেসতো (নতুন শহর) হতে ক্রোয়েশিয়ার কারলোভাচ শহর আধ ঘণ্টা, এ-পাড়া ও-পাড়া। ইয়ুগোস্লাভিয়ার রিপাবলিকের ছিল না কোনো নির্দিষ্ট সীমান্ত। লিলিয়ানাদের নোভা লুবলিয়ান্সকা বাঙ্কা ক্রোয়েশিয়ার সব বড়ো শহরে খাতা খুলেছিল। এক দেশ, এক দিনার। আটের দশকের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ১৯৯১ সালে দেশভাগের পরে সে ব্যাঙ্ক বললে, আমরা এখন আলাদা দেশ। ক্রোয়েশিয়ান আমানতকারিদের জমা টাকার কোনো দায়িত্ব আমাদের নেই (কিছু মামলা আজও ঝুলে আছে)। ইতিমধ্যে তাদের নিজের অবস্থাও সঙ্গিন। স্বাধীনতার পরে স্লোভেনিয়ান সরকার করদাতার পয়সায় লুবলিয়ান্সকা বাঙ্কাকে পুনর্জীবন দিলেন। সঙ্গত কারণেই নতুন নাম হল নোভা (নতুন) লুবলিয়ান্সকা বাঙ্কা। পুরোনো ব্যাঙ্কের নামে যারা মামলা করেছে ,আইনি হিসেবে তারা এটাকে সহজে আক্রমণ করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত – করাচীর চুন্দ্রিগর রোডে পুরোনো অট্টালিকার দেওয়ালে আগের নাম লেখা দেখেছি - ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ভারত ভাগের পরে দুই দেশের আমানতকারিদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হয়েছিল জানি না।
স্বাধীনতার পরে উন্নয়নের গতি দুর্বার। অচিরে স্লোভেনিয়ার ক্রেডিট রেটিং – আপনার আমার ক্রেডিট স্কোর – গ্রিস-আয়ারল্যান্ড-পর্তুগালকে ছাড়িয়ে যায়। সরকারি মালিকানাধীন নোভা লুবলিয়ান্সকা দেশের পয়লা নম্বর ব্যাঙ্কের তকমা অর্জন করে। বাঙ্কা মারিবর (জার্মান মারবুর্গ) দু নম্বরে। পাশার দান উলটে গেলো – যাদের পাত্তা দেওয়া হতো না এতদিন, তাদের ডলার অ্যাকাউন্ট খোলার জন্যে সিটি ব্যাঙ্ক হামলে পড়ে। সিটি ব্যাঙ্কে আমার প্রাক্তন সহকর্মী রজার নিত্যি চক্কর কাটে লুবলিয়ানা মারিবরে সেই সব ব্যাঙ্কের অফিসে। কেমন করে যে দুনিয়া বদলিয়ে যায়! প্রাক্তন ইয়ুগোস্লাভিয়ার প্রথম রিপাবলিক হিসেবে ২০০৪ সালে স্লোভেনিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য পদ অর্জন করেছে। প্রায় এক দশক বাদে ক্রোয়েশিয়া এই কেলাবে ঢোকে। সার্বিয়া এখনও কড়া নেড়ে যাচ্ছে।
একদিন আমাদেরও কপাল ফিরল। বিজনেসের উদ্দেশ্যে অনেক ঘোরাঘুরি, চা-কফি পান করার পরে নোভা লুবলিয়ান্সকা ব্যাঙ্কের ইনভেস্টমেন্ট প্রধান ওলেঙ্কা একদিন বললেন, ‘অন্যত্র আপনারা কর্মব্যস্ত জানি, কিন্তু এই এলাকায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের নাম তেমন শুনিনি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের জন্য অর্থসংগ্রহের একটা সুযোগ দিচ্ছি। কিন্তু একা আপনাদের ওপরে ভরসা রাখতে পারি না, আরও তিনটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিলে মিশে কাজ করুন’।
সিটি ব্যাঙ্কের হয়ে একদা একছত্র ছড়ি ঘুরিয়েছি। আজ ফি বা পারিশ্রমিক ভাগাভাগি করে নিতে হবে আরও তিনটে ব্যাঙ্কের সঙ্গে? মানুষ তবে বাঁচে কিসে? ইজ্জত ঢিলে। আমার নেতা এবং অন্নদাতা ফিলিপ বললে, ‘ও সব ভুলে গিয়ে একসঙ্গে কাজকর্ম করো। এলেম দেখাও আগে। এশিয়া আফ্রিকায় প্রচুর আয় করি আমরা। এটাকে সমাজ সেবা মনে করে লেগে পড়ো। শুনেছি দেশটা খুব সুন্দর। একবার যাব স্কি করতে’।
কীভাবে কত ডলার অর্জিত হয়েছিল, সে গল্পের স্থান এটা নয়। তবে আমাদের সমবেত প্রচেষ্টায় তাঁদের তিজৌরি ভরে যায়। ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে ওলেঙ্কা সেই ঋণের কাগজপত্র সই করার জন্যে আমাদের স্লোভেনিয়াতে পদার্পণের আমন্ত্রণ জানালেন। উন্নয়নশীল দেশে কাজ করার এই লাভ – ইংল্যান্ড-জার্মানি-ফ্রান্সে কোনো খদ্দের এমন আপ্যায়ন করেন না। তাঁরা মনে করেন টাকার থলিটি তাঁদের ঘরে পৌঁছে দেওয়াটাই আমাদের কর্তব্য। দু পয়সা ফি দিচ্ছেন যখন!
লুবলিয়ানা বিমান বন্দরে আমরা একত্রিত - বায়ারিশে লান্দেসব্যাঙ্কের উলরিখ, ইন্তেসা সান পাওলোর পাউলো, লয়েডস ব্যাঙ্কের সাইমন এবং আমি। এক ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছেছি ব্লেদ। গাড়িতে যাওয়ার সময়ে নাতাশা জানালেন আমাদের প্রোগ্রাম একেবারে ঠাসা – ব্লেদ দুর্গ, সেন্ট মেরির গিরজের দ্বীপ, একটি সারপ্রাইজ আইটেম, সবশেষে খাঁটি স্লোভেনিয়ান ডিনার।
আবার ব্লেদ! একদিন দেখেছি কুয়াশায় ঢাকা হ্রদ, প্রায় নিথর জল। একটি দ্বীপ, কোথাও যেন পাথরে গাঁথা একটা দুর্গ। কোনো ভোরের অন্ধকারে যেখান থেকে বিদেয় নিয়েছিলাম! সেখানে আসিব ফিরে?
অনেক দূরের যে দুর্গ সেদিন দেখা হয়নি, জুন মাসের এক সূর্যকরোজ্বল দিনে তার প্রাকারে দাঁড়িয়ে ওলেঙ্কা আমাকে ব্লেদ লেকের আখ্যান শোনাচ্ছিলেন। ব্লেদের দুর্গ হাজার বছর আগে জার্মান সম্রাট দ্বিতীয় হাইনরিখের বানানো। ‘আহা, ১৮৭১ সালের আগে জার্মানদের কোনো দেশ ছিল না গো’ এই গল্প আমরা করে থাকি, কিন্তু ভুলে যাই যে তথাকথিত পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য আসলে ছিল একটি বিশাল জার্মান জমিদারি – সেখানে দাগ ও খতিয়ান নম্বর আলাদা করা ছিল না এই মাত্র। প্রত্যেক সম্রাট জার্মান। তারা সুন্দর জায়গা পেলে মহল বানান, উঁচু জায়গা পেলে প্রতিরক্ষার জন্য দুর্গ। ব্লেদ এই দুইয়ের আশ্চর্য সমন্বয়। পাহাড়ে-সবুজে-জলে মিলে মনভোলানো রেসর্ট, আবার দেওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে কামান গুঁজে দিয়ে চলে প্রতিরক্ষার কাজ! সমতল থেকে অনেকটা উঠে কয়েকটা পাথরের গেট পেরিয়ে গেলে রাজকীয় বাসস্থান, দেওয়ালের নিচের অংশে দাস দাসীদের আস্তানা। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মধ্যযুগের হাতে ঘোরানো ছাপার মেশিন। আপনিও সেখানে হাত লাগাতে পারেন। ফল দেখবেন তৎক্ষণাৎ।
দুর্গের দেওয়াল থেকে ব্লেদ হ্রদের দৃশ্য অতীব মনোরম। নীল জল বলতে শুনি ভূমধ্যসাগরের বা ফিওর্ডের মত নীল অথবা প্রিয়ার চোখের মতন নীল! শেষেরটা অবশ্যই আপেক্ষিক! কেতাবি মতে কোন হ্রদের জল কতটা নীল, তার একটা র্যাঙ্কিং আছে – কানাডার পেইতো, আইসল্যান্ডের ব্লু লেগুনের পরেই ব্লেদের স্থান। জুলিয়ান আল্পস থেকে নেমে আসা গ্লাসিয়ার এখানে আবদ্ধ। ব্লেদ দুর্গের ব্যালকনি থেকে দেখা সেই আশ্চর্য ঘন নীল জলের হ্রদ আমার দেখা টপ টেন দৃশ্যের মধ্যে পড়ে।
ষোড়শ শতক।
ব্লেদ দুর্গের বাসিন্দা পোলোনার স্বামী কয়েকদিন যাবত নিখোঁজ। খবর পাওয়া গেল, বনের পথে দুর্বৃত্তেরা অর্থের লোভে তাঁর স্বামীকে হত্যা করে ব্লেদ হ্রদের জলে ফেলে দিয়ে গেছে। পোলোনা স্থির করলেন, তিনি তাঁর সকল অলঙ্কার বেচে দিয়ে একটি ঘণ্টা বানিয়ে দ্বীপের গিরজেতে দান করে যাবেন। ইতালির পাদুয়াতে সে ঘণ্টা তৈরি হল, কিন্তু পোলোনার দুর্ভাগ্যের শেষ নেই। দ্বীপে পৌঁছুনর পথে নৌকাডুবি – অতলে তলিয়ে গেলো সে ঘণ্টা। দুঃখিনী পোলোনা তাঁর সর্বস্ব পোপকে দান করে একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। পোপ বললেন, মহিলার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ হোক – তাঁর আদেশে একটি ঘণ্টা ব্লেদ হ্রদের দ্বীপে সন্ত মেরির গিরজেয় প্রতিষ্ঠিত হল। প্রবাদ – লম্বা দড়িটি টেনে এই ঘণ্টা বাজালে আপনার প্রার্থনা সিধে প্রভুর কানে পৌঁছে যাবে। করুণাময় প্রভু নিশ্চয় শুনবেন। কেসটা দেখবেন।
নাম হয়ে গেল ডুবো বা ইচ্ছে ঘণ্টা।
দুর্গের নিচের জেটি থেকে নৌকা বেয়ে আমাদের সেই দ্বীপে যাত্রা। সাঁতার ভালো জানি না। লাইফ ভেসট আছে জেনে তবে দাঁড় বাওয়ার পাল্লা হাতে ধরেছি!
এখানে রোমের ফন্তানা দেই ত্রেভির মতন আবার যেন রম্যা আসা হয় এই প্রার্থনা করে নিয়ে উলটো মুখে পয়সা ছোঁড়ার ব্যাপার নেই। সেখানে রোমের পৌরপিতাদের ডেলি কালেকশন তিন হাজার ইউরো, বছরে দশ লক্ষ। তবে সন্ত মেরির গিরজের বাকসোতে কিছু দিয়ে যেতে পারেন। আপনার মনোবাসনাটি যেন পাঁচ কান করবেন না – তাহলে ডেটা ব্রিচ হবে। প্রভু ব্যক্তিগত আবেদন শোনেন – সামাজিক মাধ্যমের নয়।
ওলেঙ্কা, মাতেই থেকে শুরু করে বায়ারিশে লান্দেসবাঙ্কের উলরিখ – দলের সবাই দড়ি ধরে একবার ঝুলে গেলেন। উলরিখের মতো শক্তিমান জার্মান যখন ঝুললেন, ভাবছিলাম আশা করি দড়িটি এঁরা মাঝেসাঝে বদলান। নইলে ছিঁড়ে গিয়ে বিপদ বাধতে কতক্ষণ!
সারপ্রাইজ আইটেম ছিল হাতে-কলমে স্লোভেনিয়ান হেঁসেলের পরিচিতি। দলে পড়ে তাতে যোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু সে দেশের অসাধারণ ওয়াইনের গুণে আজ কিচ্ছু মনে নেই।
- গড গিভ মি ভেরা অর গিভ মি ডেথ!
একদিন সকালবেলা গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে মিকলোসেচিয়েভা সেস্তায় (রাস্তা) ফ্রান্সিস্কান গিরজের পাশ দিয়ে হাঁটছি – পুরোনো শহরের কেন্দ্রবিন্দু সেটা। তিন সেতু দেখতে যাব। দু পা গিয়েই চোখে পড়ল ডান দিকে গিরজের নিচু দেওয়াল বরাবর ঈশ্বরের কাছে কেউ তার প্রার্থনা লিখে রেখেছে কালো চক দিয়ে, একবার নয়, পরপর দু বার। দেওয়ালের এ মুড়ো থেকে ওমুড়ো অবধি। বড়ো বড়ো অক্ষরে এক প্রেমিকের গাড় কালো রঙে লেখা আকুল আবেদন – হয় ভেরাকে, নয় মৃত্যু দাও প্রভু। স্লোভেনিয়ান ক্যাথলিক গিরজের দেওয়ালে ঈশ্বরের কাছে সে ইংরেজিতে অ্যাপ্লিকেশন পাঠাল কেন?
দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই সকালে রাস্তা প্রায় জনশূন্য। কবে সে লিখেছে কে জানে। তারপর কী হল? ঈশ্বর ভেরাকে কি তার কাছে পৌঁছে দিলেন? কী পেল সে? ভেরা না মৃত্যু? সে কি আবার সকলকে জানাবে, এইখানে গিরজের দেওয়ালের বোর্ডে?
‘আপনি ভেরাকে দিয়েছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ’, অথবা ‘ভেরাকে পাইলাম না, অতএব লুবলিয়ানাচা নদীতে লাফাইয়া পড়িয়া মৃত্যু বরণ করিতে চলিলাম’?
হাতে সময় কম। দেড় দিনের জন্য লুবলিয়ানা এসেছি আপিসের কাজে। কাল সকালে এই দেওয়ালে কোনো আপডেট আছে কিনা দেখতে হবে।
আজকের ইতালিয়ানদের দেখলে বিশ্বাস হয় না – গুগল, এক্সেল শিটের সাহায্য ছাড়াই তাদের পিতৃপুরুষ একদিন সারা ইউরোপে প্রকাণ্ড কনস্ট্রাকশনের বিজনেস খুলে ফেলেছিল। এত শহর, বাড়ি, ঠান্ডা-গরম স্নানের এলাহি ইমারত, আনন্দ বিনোদনের জন্য তিরিশ হাজার মানুষ বসার স্টেডিয়াম, হাজার মাইল ব্যাপী রাস্তা যার প্রস্থের অনুসারে আপনার আমার গাড়ির অ্যাক্সেল নির্ধারিত হয়েছে। রোম থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে জার্মানির ট্রিয়ার শহরে গিয়েছিলাম গত মাসে। বাইশশ বছর আগের গেট পোরতা নিগ্রা এখনও দাঁড়িয়ে আছে – তারাপদ রায়ের লাইন ধার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, কী গেট বানালে এত বছরেও একটা পাথর খসে ভেঙ্গে পড়ল না! *
রোমানরা লুবলিয়ানাতে পা ফেলেন দু হাজার বছর আগে। এখানে বাড়ির তৈরির ভিত খুঁড়তে গেলেই পাওয়া যাবে তাদের সেই সংসারের হদিশ। আর দাঁড়িয়ে আছে অজস্র জার্মান ও খানিক ইতালিয়ান স্থাপত্য। বিগত বারশ বছর লুবলিয়ানা ছিল ব্যাভেরিয়ান ডিউক থেকে অস্ট্রিয়ান সম্রাট, বিভিন্ন জার্মান ভাষী প্রভুদের বাগান বাড়ি। তাঁরা নাম দিয়েছিলেন লাইবাখ (বাখ অর্থ জলের ধারা, স্ট্রিম)। আমার অভিজ্ঞতায় ভিয়েনার কফি হাউসে এ নাম আজও প্রচলিত। স্লোভেনিয়া সেই অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ, এক্সটেনশন মাত্র (ক্লাগেনফুর্ট থেকে গাড়িতে লুবলিয়ানা আসার পথে বোঝাই যায় না কোনটা অস্ট্রিয়ার শেষ আর স্লোভেনিয়ার প্রথম গ্রাম)। লুবলিয়ানা তার বৈঠকখানা। মনে রাখা ভালো – জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি সীমাবদ্ধ থেকেছে বর্ধিষ্ণু জমিদার, সেনাপতি, অধ্যাপকের মধ্যে, শহর অঞ্চলে। গ্রামের চাষি মজুর সম্পূর্ণ অবজ্ঞাত, অবহেলার পাত্র। বহু বছর বাদে একদিন গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে জার্মান উচ্ছেদ হবে।
বিশ বছর আগের জনগণনায় মাত্র দেড় হাজার মানুষ জানিয়েছেন জার্মান তাঁদের প্রথম ভাষা!
আড়াই লক্ষ লোকের বাস এই শহরে। লুবলিয়ানা ইউরোপের সবচেয়ে ছোটো রাজধানী শহর - অ্যান্ডোরা, সান মারিনো ভাদুজকে বাদ দিয়ে – ওগুলো ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। পুরোনো শহর একটা ওপেন এয়ার মিউজিয়ামের মতন। কোনো সুস্থ সবল মানুষের পক্ষে এক ঘণ্টার ভেতরে টুরিস্ট ম্যাপের অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখা সম্ভব (পাহাড়ের ওপরের কেল্লাটি বাদে)। তবে সেটা ঐ শুধু ‘দেখে ফেলা’-ই হবে। আমেরিকানরা যাকে বলে, বিন দেয়ার, ডান দ্যাট। প্রথম দর্শনে ভেরার খবরটা দেখা হইলেও যেমন জানা হয় নাই, লুবলিয়ানাও দেখা হয় নাই! দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারে চক্ষু মেলেছিলাম।
যেমন তিন সেতু অথবা তিন সেতুর পথ (ত্রমস্তভিয়ে)।
ফ্রান্সিস্কান গিরজের সামনে প্রেশারেন চত্বর ; তিনি স্লোভেনিয়ার রবীন্দ্রনাথ। মাঝখানে তাঁর পূর্ণাবয়ব স্ট্যাচু, চেয়ে আছেন লুবলিনিয়াচা নদীর পানে। আমার পক্ষে একে নদীর গৌরব দেওয়া কঠিন – প্রস্থ অতি ক্ষীণ, আদি গঙ্গার আকার। পার হবার জন্য তৈরি ছশ বছরের এক পুরোনো কাঠের সেতু ভেঙে ইতালিয়ান স্থপতি জিওভানি পিকো একটি পাথরের ব্রিজ বানান (১৮৪২), উৎসর্গ করেন অস্ট্রিয়ান সম্রাট ফ্রান্তসকে। বিগত শতাব্দীতে সেই সেতুতে ঘোড়ার গাড়ি ও মানুষের চলাচলে যানজট সৃষ্টি হতে দেখে স্লোভেনিয়ার খ্যাতনামা স্থপতি ইয়শে প্লেচনিক পদব্রজে নাগরিকদের নদী পারাপারের জন্য দু পাশে দুটি সেতু জুড়ে দেন। তাদের আকৃতি ত্রিভঙ্গ। মূল সেতুর সমান্তরাল নয়, সমতল তো নয়ই! আজ গাড়ি ঘোড়া নয়, প্রধান সেতুটি কেবল পথচারীর প্রয়োজনে ব্যবহৃত। অন্য দুটি বিশেষ কাজে লাগে বলে মনে হয় না, সেলফির আকর্ষণ বাড়ানো ছাড়া। তবে মনে রাখবেন কোনো সেলফিতেই তিনটি সেতুকে একত্রে ধরা যায় না। ‘দ্রোণা’-চার্যের সহায়তা আবশ্যক। লুবলিয়াচা নদীর ওপরে প্লেচনিকের দুটি এবং পিকোর একটি সেতু মিলে মিশে যে অসামান্য ছবি সৃষ্টি করেছে তার তুল্য ইউরোপের কোথাও দেখিনি। হালে ইউনেস্কোর সুরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভের তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
যেমন প্রেশারেন স্কোয়ারের কোনায় হাউপ্টমান হাউস।
দেড়শ বছরের পুরোনো আডলফ হাউপ্টমানের ছতলা বাড়িটি কোনো নিয়মিত ভূমিকম্পে ধরাশায়ী হয়নি। আর্ট নুভোর (জার্মানে ইয়ুগেনড স্টিল) এহেন উদাহরণ লুবলিয়ানা কেন, স্লোভেনিয়াতে বিরল। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা – ছ তলা অথবা একুশ মিটারের বেশি হবে না কিন্তু তার মধ্যেই লক্ষণীয় স্থপতির খেলা। লাটভিয়ার রিগা শহরে আলবার্ট ইয়েলাতে দেখবেন আর্ট নুভো অট্টালিকার সমারোহ – এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ। সবচেয়ে স্মরণীয় নাম মিখাইল আইজেনস্টাইন (তাঁর পুত্রকে আপনারা চেনেন - চলচিত্র নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইন)। অস্ট্রিয়ান স্থপতি হুনডারটওয়াসারের (আসল নাম স্টোওয়াসার) কর্মকাণ্ড বা তার অনুকরণে ভিয়েনা বুদাপেস্ত ভরে আছে। গাউদি বার্সেলোনাকে সাজিয়েছেন। রিগা, বুদাপেস্ত এবং এই লুবলিয়ানা বাদে পূর্ব ইউরোপের আর কোন বড়ো শহরে আর্ট নুভো তেমন দেখিনি।
১৯২৫ সনের প্যারিস প্রদর্শনীর পরে দেখা দিলো আর্ট ডেকো যার উচ্চতা বেশি, আকার দৃঢ়, একটু রঙচঙে। মায়ামিতে হাজার খানেক দেখা যায়, একেবারে মোচ্ছব লেগে গেছে। পূর্ব ইউরোপে লিথুয়ানিয়ার কাউনাস, বুখারেস্টে। আমার চোখে কলকাতার ভিক্টোরিয়া হাউস আর্ট ডেকোর দুর্দান্ত উদাহরণ।
যেমন চার কোনায় চারটি মূর্তি সহ ড্রাগন সেতু। ড্রাগন লুবলিয়ানার প্রতীক। লুবলিয়ানার রক্ষক।
গত শতাব্দীর গোড়ায় অস্ট্রিয়ান সম্রাট ফ্রান্তস ইওসেফের রাজত্বের জয়ন্তী উপলক্ষ্যে তাঁর নামে এই শক্তিশালী (রি এনফোরসড) কংক্রিটের এই সেতু উৎসর্গ করা হয়। শুনলে অবাক লাগে এই ক্ষীণ নদীর ওপরের সেতুর আর্চ ছিল সে আমলে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম! খোদ ভিয়েনায় তখন এই ধরণের কোন কংক্রিটের সেতু ছিল না। অস্ট্রিয়ানরা বিদায় নিলে নব নামকরণ হয় ড্রাগন সেতু – চারটে কংক্রিটের ড্রাগনকে আর্ট নুভোর অসামান্য উদাহরণ বলে মান্য করা হয়। নদী ছোটো ক্ষতি নেই, ব্রিজ খ্যাতিময়!
যেমন কসাইয়ের সেতু।
ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে চাবিটি ফেলিও লুবলিয়ানাচার জলে। প্রেমিক প্রেমিকা তাদের প্রেমকে তালায় বন্ধ করে চাবি ছুঁড়ে ফেলে নদীর জলে। সে চাবি হারিয়ে যায়, প্রেম রয়ে যাবে অটুট। এই বন্ধ তালার চাবি ছুঁড়ে ফেলার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখবেন জাগ্রেব আমস্টারডাম প্যারিস বুদাপেস্তে – তালার বিক্রি বাড়ছে কোন সন্দেহ নেই। নিতান্ত বেখাপ্পা শোনাবে জেনেও বলি- লক্ষ করেছি তালাগুলো প্রায় একই চেহারার – মানে এর আশে পাশে কোন সুপার মার্কেটে তালার সেল চলছে!
স্লোভেনিয়া সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি নিতান্ত স্বল্প পরিসরে পাহাড় বন নদীর এহেন সমন্বয় দেখতে হলে সুইস অস্ট্রিয়ান জার্মান নয়, জুলিয়ান আল্পসে আসুন! ফিলিপকে বলেছিলাম ফ্রান্সের কুরশেভেল, মেরিবেলের মতন দামি আখড়া ছেড়ে এ দেশ দেখে যান। সেই একই আল্পস, একই স্নো, স্কিইঙ্গের খরচাও কম!
দেশের মাপে স্লোভেনিয়া, রাজধানী হিসেবে লুবলিয়ানা কোনোটাই বড়ো নয়, কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ক্লাগেনফুর্ট থেকে ইউলিখার আল্পসের পাহাড়ি পথ যখন নিচে নামে, চোখে পড়ে ইতস্তত ছড়ানো লাল টালির ছাদ, সবুজ বাগান, শান্তির নীড়। সেই ছবিটি ডেভেলপ করা যায় না। মনে থেকে যায়।
পুঃ লিলিয়ানার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। ইয়ুগোস্লাভিয়াতে গৃহযুদ্ধ বাধার অব্যবহিত পরে সে একজন ক্রোয়াটকে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। আজ আড়াই লক্ষ ক্রোয়াট অস্ট্রেলিয়াবাসী।
* “কী কল বানিয়ে দিলে, ফিলিপস অসরামের চেয়ে ঢের ভালো
এখনও তোমার সূর্য লক্ষ বৎসরেও ফিউজ হ’লো না
সাবাস ওস্তাদ”
-- তারাপদ রায়