নাপোলেওঁর রাশিয়া অভিযানের সাত দিন আগে সিটি ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা। সাল ১৮১২ (তার দু বছর আগেই ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা প্রতিষ্ঠিত)। পরের দুই শতাব্দী ধরে ব্যাঙ্ক ব্যবসা করেছে পুরনো বিশ্বাসে। খরিদ্দার আমাদের প্রভু, তা তিনি বড়ো বাজারী হোন আর তেলের কারবারি হোন। দেশি মুদ্রায় ঋণ, বিদেশি মুদ্রার বিনিময়, ক্রেতা ও বিক্রেতার প্রাপ্য অর্থ সময়মত সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি যাহা প্রয়োজন সেটি সাধ্যমত জোগানোর জন্য আমাদের প্রাণ নিবেদিত। দুনিয়ার একশ একটা দেশে ছড়ানো আমাদের ক্রিয়া কলাপ। নিউ ইয়র্ক শহর ও রাজ্য যদিও আমাদের আদত মোকাম সেখানে এই ব্যবসায়ে অনেক প্রতিযোগী, মার্জিন কম। ১৯৯৬ সালের পয়লা এপ্রিল টোকিওতে সিনডিকেশন কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন আমাদের তৎকালীন সি ই ও জন রীড। সেখানে তিনি বললেন সিটি আমেরিকান নয়, একটি বিশ্ব জোড়া ব্যাঙ্ক, তার হেড অফিস নিউ ইয়র্কে মাত্র। আরও বললেন আমেরিকায় বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক রাজ্যে ব্রাঞ্চ বন্ধ করতে তিনি দ্বিধা করবেন না (ইতিমধ্যে অনেক শাখা বন্ধ হয়েছে) কিন্তু আফ্রিকা, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যবসা বিস্তারিত করবেন।
ব্যাঙ্কের আধিকারিকরা নানান দেশের লোক। সিটি ব্যাঙ্কের মালিকানা আমেরিকান কিন্তু পরিচালনা সার্বজনীন। ইরানের রেজা ঘাফারি পোল্যান্ডের ক্রেডিট কর্তা, গোয়ার মেনেজেস গোটা ব্যাঙ্কের দু নম্বর প্রধান, চেক দেশের তুরেক দক্ষিণ আফ্রিকার বড়ো সাহেব, পাকিস্তানের শাউকত আজিজ ইউরোপ আফ্রিকার মালিক। আমার নিজের বিভাগে পনেরো জনের মধ্যে আছে এগারটি দেশের নাগরিক। সব মিলিয়ে পনেরোটির বেশি ভাষা বলা বোঝার ক্ষমতা আছে। প্রায় সকল উন্নয়নশীল দেশে আমাদের অবস্থিতি। পৃথিবীর ভার আমাদের স্কন্ধে আসীন নয় জানি কিন্তু একটা ভূমিকা আমরা নিজেদের হাতে তৈরি করে নিয়েছি। শুধু আমাদের দপ্তর থেকে আন্তর্জাতিক ঋণের আয়োজন হয়েছে পোল্যান্ড, রাশিয়া, চিলি, কলম্বিয়া, সেনেগাল, মরক্কো, স্লোভাকিয়া, ভারত, শ্রী লঙ্কায়। অপরিচিত দেশের নাম এনেছি পরিচিত লগ্নিকারকের কাছে। ১৯৯৬ সালে জাপানের অর্থ ব্যবস্থায় যখন গোলযোগ চলেছে, আমাদের ইয়োকোহামা শাখার সামনে জাপানি আমানতকারিদের লাইন পড়েছে। জাপানি ব্যাঙ্ক নয়, সিটি ব্যাঙ্কের প্রতি বিশ্বাস বেশি -সেখানে টাকা জমা রাখতে চান বলে। দুটো পয়সা করার জন্যে রোজ সকালে কাজে যাই, দেশে দেশে ঘুরি। দিন কাটে খুশীতে।
এমনি কাটছিল বটে কিন্তু জানি এমনি সহজে দিন কাটার কথা নয়। বাগড়া আসবেই মুক্ত ব্যবসায় একমাত্র নিশ্চিতি এই যে কিছুই নিশ্চিত নয়। দু বছর আগে নিউ ইয়র্কের সলোমন ভ্রাতৃ বৃন্দ সিটি ব্যাঙ্ক কিনে নেওয়ার পর সিটি ব্যাঙ্কের আমূল পরিবর্তন শুরু হল।
তারপর যেমন হয়। নিউ ইয়র্কের চতুর বুদ্ধি সম্পন্ন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কাররা আমাদের মালিক হলেন। কেনার আগে আমাদের খাতা পত্র নিশ্চয়ই দেখেছেন – এবার কর্ম পদ্ধতি দেখে বললেন তোমরা এ সব কি করেছ এত বছর ধরে? কি নির্বোধের কাজ! এই যে জর্ডানের আমান শহরে তোমাদের শাখা আছে বিশ বছর। কাজ করে শ খানেক লোক। সেখানে সিটি ব্যাঙ্কের বার্ষিক আয় এক কোটি ডলার। সলোমন ভ্রাতৃ বৃন্দের একজন শেয়ার বাজারের বেচা কেনার কর্মী বা ট্রেডার ব্যাঙ্কের জন্য সে অর্থ আয় করতে পারে এক দিনে । এতো খরচা করে এতো শাখা খুলে কি তোমরা শাখামৃগ পুষছ?
হিন্দি সিনেমার ভাষায় 'বন্দ করো ইয়ে বকওয়াস'!
মনে পড়লো আমাদের শেষ সি ই ও জন রীড বলতেন আমি এই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারদের বুঝি না। এরা এক বছর প্রভূত আয় করে, পরের দু বছরে সবটাই ডোবায়। নিজেদের বোনাসটা অবশ্য পকেটস্থ থেকে যায়।
যে সিটি ব্যাঙ্ককে দু দশক যাবত চিনেছিলাম, সে ব্যাঙ্ককে বদলে যেতে দেখলাম। প্রতিটি দিন ছিল অনিশ্চিত কিন্তু উন্মাদনায় ভরা। নতুন কিছু করার, ভাবার জন্য পেয়েছি অভয় প্রশ্রয় - এক আশ্চর্য স্বাধীনতা (জার্মানে নারেন ফ্রাইহাইট – পাগলের স্বাধীনতা) ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের মাঠে যখন নামলাম, কর্তারা নিত্যি মনে করিয়ে দিয়েছেন – সব ডিলের পেছনে আছে খরিদ্দার, যার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দু দিনের নয়। ডিলের পয়সা আসবে যাবে, খরিদ্দারকে যেন হারিও না।
সলোমন ভ্রাতৃবৃন্দ আমাদের জানালেন – তোমাদের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে ঋণ বা সেবা গ্রহীতা খদ্দের। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কে অর্থবান নিবেশক খদ্দের। প্রত্যহ বাঘ সিংহী খাটাশ দেখানো আমাদের কাজ, যদি নিবেশক কেনেন। আবার তিনি যদি গ্রিক বন্ড বা রাশিয়ান ট্রেজারি কাগজ কিনে হঠাৎ আরও বড়লোক হতে চান বা নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গরিব হতে চান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার সেগুলি সংগ্রহ করে দেন, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সকলই সম্ভব।
মন উচাটন। এমন সময় ডাক এলো একটি ব্যাঙ্কের কাছ থেকে যারা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কাজে ব্রতী। বিধি আবার মুখ তুলে চাইলেন।
জার্মানি আর দ্বিখণ্ডিত নয়, অখণ্ড এক দেশ। মিলিত জনসংখ্যা আট কোটি। এক লাফে রাশিয়ার পরে ইউরোপের দু নম্বর দেশ। হাইকের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক বেশী। স্টাডরোডা থেকে এখন সরাসরি নম্বর ডায়াল করা যায়। পূর্ব জার্মানির মানুষ বিদেশে ফোন করার এই স্বাধীনতা পেয়ে প্রথমে অসম্ভব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন। মোবাইল আসে নি তখনো। কিন্তু বাড়ির ফোনের নম্বর ডায়াল করে মিউনিক আখেনের হারানো আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তখন নবলদ্ধ মুক্তির প্রকাণ্ড প্রতীক। প্রথমটায় তাঁরা বোঝেন নি যে এই দূরভাষে খরচা অনেক! কমিউনিস্ট আমলে স্থানীয় কল ছিল করমুক্ত (এমনকি ধনতান্ত্রিক ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে প্রথম আট মিনিটের লোকাল কলের রেট বাঁধা ছিল)। পয়সা লাগত না। কিন্তু স্টাডরোডা থেকে লন্ডন দূরস্থান, এমনকি ফ্রাঙ্কফুর্ট ফোন করতে গেলে দু মার্ক লাগে।
ফোন করার ভারটা আমি নিয়েছিলাম। যোগাযোগ বাড়ে, হাইকের খরচা নয়।
দুই জার্মানির পুনর্মিলনের সময়ে চ্যান্সেলর হেলমুট কোল জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন (সব সময় ভাষণ শুরু করতেন লিবে নাতশিওন বা প্রিয় দেশ বলে) 'আমরা একত্র কাজ করে মেকলেনবুরগ, ব্রানডেনবুরগ, জাখসেন (যা থেকে স্যাক্সন শব্দটা এসেছে) থুরিঙ্গেনকে প্রস্ফুটিত জমিতে পরিণত করব। মানুষ সেখানে সুখে আনন্দে বসবাস করবে। দেশ ফুলে ফলে ভরে উঠবে'।
সেই বিখ্যাত শব্দ – ব্লুইহেনডে লানডশাফট।
এই বাক্যে দুটো ইঙ্গিত নিহিত ছিল।
একত্র মানে পূব আর পশ্চিম দুই জার্মানিকে মিলে মিশে কাজ করতে হবে। পূব যেন না ভাবে তাদের উন্নয়নের কাজটা বড়ো ভাই মানে পশ্চিম জার্মানি করে দেবে। পূবের পেশীর বলের সঙ্গে যুক্ত হোক পশ্চিমের অর্থ।
দ্বিতীয় ইঙ্গিত - পূবের ভাই বোন তোমরা যে যেখানে আছো সেখানেই থাকো। পশ্চিমে যত সুখ আমার বিশ্বাস ভেবে কেমনিতস, ড্রেসডেন ছেড়ে ডুসেলডরফ, ব্রেমেনের পানে ধাওয়া কোরো না। তোমার পাড়ার বাগানেই আমরা ফুল ফোটাব।
অবশ্যই ধনী দাদার কাজ হবে গরিব ভাইকে সাহায্য করা। পশ্চিমের জনগণের ওপরে জারী হল একটি সংহতি কর (তসলিডারিটেটসতসুশ্লাগ)। পশ্চিমে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার হবে পূবের অর্ধেক। পূবের শুকনো বাগানে ফুল ফোটানোর খরচা আছে।
পূবের মানুষরা এতদিন খেটে এসেছেন। বিনিময়ে আবশ্যিক জিনিসগুলো জুটেছে। এখন তাঁরা বুঝলেন জান লগাকে হাইসা বলে কাজ করলে অধিকন্তু কিছু পাওয়া যাবে। বি এম ডবলু গাড়ি, স্পেনে ছুটি, দেনিম জিনস।
মুখে মুখে দুটো নতুন শব্দ জন্ম নিলোঃ ওয়েসি (ওয়েস্ট বা পশ্চিমের জার্মান) আর অসি (ইস্ট বা পূবের জার্মান)। এদের বিরোধ আসন্ন।
আরও দুটো কথা চালু হল – পুরনো রাজ্য (১০) – ব্রেমেন হামবুর্গ থেকে বায়ার্ন ও নতুন রাজ্য (৫) – মেকলেনবুরগ -ফোরপমারন থেকে জাখসেন - আলটে বুন্দেসলেনডার ও নয়ে বুন্দেসলেনডার।
সিটি ব্যাঙ্কের শেষের দিনগুলিতে কাজের বাহানা করে বার্লিন গেলাম- তেইশ বছরের স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে। একদিন খুব সকালে উঠে বার্লিনের শ্রেষ্ঠ প্রতীক ব্রানডেনবুরগার টোরের সামনে হাঁটছি- দেখি একদল ইংরেজ স্কুল ছাত্র ছাত্রী নিয়ে দুই শিক্ষিকা পুরনো দেওয়ালটা কোথায় ছিল সেটা খুঁজছেন। তাঁদের জানালাম রাস্তা বরাবর লক্ষ করুন- চকচকে পাথর কুচি গাঁথা আছে সেই দেওয়ালের ভিত ধরে। ইচ্ছে করলে প্রায় একটি ম্যারাথন দৌড় লাগাতে পারেন। দেওয়াল ছিল সাতাশ মাইল লম্বা!
পুবের সঙ্গে পশ্চিমের দেখা হয় রোজ, অলিতে গলিতে বাজারে দোকানে। ফ্রাঙ্কফুর্টের বিখ্যাত কেমিক্যাল কোম্পানি হোয়েক্সটের এক পরিচিত মানুষের কাছে একটা গল্প শোনা গেল। হোয়েক্সটে মধ্যাহ্ন বিরতি (মিটাগসপাউজে) ৪৫ মিনিটের। লাইপতসিগ থেকে সদ্য আগত এক কর্মচারী বললেন, 'সে কি, তাহলে আমরা দৈনিক প্রয়োজনের জিনিস কেনা কাটা কখন করব?’ সে আমলে নাকি মধ্যাহ্ন কালে বিভিন্ন সমবায়িকা পরিক্রমের প্রথা চালু ছিল- কোনো রাষ্ট্রীয় সমবায়ে আকস্মিক কমলা লেবুর আবির্ভাব হতে পারে, নিয়মিত ঘোরাঘুরি না করলে সেটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
সেপ্টেম্বর, ১৯৯৩। কনফারেনসে গেছি লাইপতসিগ।
এক ট্যাক্সিওলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি বদলাতে দেখলেন? তফাৎ কেমন বুঝছেন'? তিনি বললেন 'আপনারা অনেক লেখা পড়া জানা মানুষ, দেশ দুনিয়া ঘোরেন, আপনারা ভাল জানবেন। আমি সামান্য ট্যাক্সি চালক আমি এটুকু বলতে পারি আগের সময়ে (দামালস) আমাদের যা প্রত্যহের প্রয়োজন সেগুলোর দাম ছিল কম যেমন রুটি, বাড়িভাড়া। আর যা প্রত্যহের প্রয়োজন নয় যেমন ধরুন রঙ্গিন টি ভি, জিনস, এ সব হয় পাওয়া যেত না বা তার দাম ছিল খুব বেশি'।
'আর এখন?'
'এখন আমাদের জরুরি জিনিসের দাম বেড়েছে, এই ধরুন ঘর ভাড়া। আমার চারটি ছেলে মেয়ে। সে আমলে চার ঘরের ভাড়া দিতাম আশি অষ্ট মার্ক। এখন দিতে হয় ছ শো ডয়েচে মার্ক আর যে সব জিনিস আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় নয় যেমন রঙ্গিন টি ভি বা জিনস পাওয়া যায় এবং সস্তায়'।
১৯৯৭ সালে আমার ইউরোপ প্রবাসের শ্রেষ্ঠ বন্ধু অরটউইন আক্রান্ত হল কঠিন কর্কট রোগে। শুরু হল এক অসম সংগ্রাম। কিন্তু সে হাল ছাড়ে নি। ডাক্তার দিয়েছিল ছ মাস সময়। সে লড়েছিল আঠার বছর। মাঝে মধ্যেই তাকে যেতে হয় সানাটোরিয়ামে। জার্মানিতে সেটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাওয়া যায়। যতবার হোক।
আমার নতুন চাকরির পাকা কথা হয়ে গেছে। সেপ্টেম্বর মাসে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কে যোগ দেব। এমন সময় অরটউইনকে পাঠানো হল বাদ ব্যরকা নামক একটি সানাটোরিয়ামে। বাদ ব্যরকা পূর্ব অঞ্চলে। ঐতিহাসিক শহর, ভাইমারের পাশেই। গোয়েথে আসতেন। তাঁর নামে ফোয়ারা আছে।
অরটউইন যখনই কোনো সানাটোরিয়ামে গেছে আমি দেখতে গেছি। শুরুটা হয়েছিল নিদার জাখসেনের বাদ নেনডরফ থেকে। তাকে সঙ্গ দেওয়া আর একটা নতুন জায়গা দেখা! নিউজিল্যান্ড, কানাডা, চিলি আর জাপান বাদে সবচেয়ে বেশী উষ্ণ জলের কুণ্ড আছে জার্মানিতে। সেই সব শহরের নাম শুরু বাদ শব্দ দিয়ে (ব্যতিক্রম ভিসবাদেন আর বাদেন বাদেন)। আক্ষরিক অর্থে স্নান। সব জলের গুন এক রকম নয়। ডাক্তারি মতে একেক কুণ্ডের জলে একেক ধরনের রোগ দূরীভূত হয়।
এবারে ব্যাঙ্কের কাজ নয়। বন্ধুর পাশে দাঁড়াব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে বা রাজদ্বারে না হোক হাসপাতালে চ।
আর হাইকে।
লন্ডন থেকে সন্ধ্যে নাগাদ ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নেমে গাড়ি ভাড়া করেছি। সাধারণত এয়ারপোর্ট ছেড়ে অটোবান ধরে যাত্রা উত্তর পশ্চিমে কলোন ডুইসেলডরফ বা কাইজারসলাউটারন অভিমুখে। বাদ হেরসফেলডের কাছে যে আরেক রাস্তা গেছে পূব মুখে সে দিকে কোনোদিন তাকাই নি। লৌহ যবনিকা ছিল সেখানে, প্রকাশ্যে নয়, মনের ভেতরে। ওদিকটা দেখার উপায় বা ইচ্ছে ছিল না। এখন সে যবনিকা উন্মুক্ত। এবারের যাত্রা নতুন দিগন্তের পানে।
আগস্ট মাসের শেষ। অন্ধকার নামে তাড়াতাড়ি। জার্মান অটোবানে সরকারি বাতি জ্বলে না। একমাত্র ব্যতিক্রম কলোন বিমান বন্দর থেকে পুরনো রাজধানী বন যাবার পথটুকু। ইউরোপে কেবল বেলজিয়ানরা তাদের ছোট দেশের অটোবানের প্রতিটি সেন্টি মিটার আলোকিত করে রাখে মধ্যরাত্রি অবধি।
যে পথে চলেছি তার মুখ চলতি নাম বুরগেনস্ত্রাসে বা দুর্গময় পথ। আইসেনাখ পার হলাম। সময় থাকলে একটা চক্কর মারা যেতো। য়োহান সেবাস্তিয়ান বাখের জন্ম সেখানে, মারটিন লুথার গ্রিক থেকে জার্মানে বাইবেল অনুবাদ করে পাদরিদের বিতৃষ্ণার কারণ হয়েছেন, বি এম ডবলু সেখানে প্রথম মোটর বাইক বানিয়েছে। কমিউনিস্ট জার্মানিতে সেটি পশ্চিম প্রান্তের শেষ জনপদ।
এমন সময় পথের পাশে তিন পাহাড়ের তিন দুর্গে একই সঙ্গে জ্বলে উঠল প্রাসাদ বাতি! সন্ধ্যের ঘনীভূত অন্ধকারে দূর পাহাড়ের মাথায় দীপাবলির আলোর মালায় সাজানো দুর্গ! সামনে তাকাতে চোখে পড়লো আরেক পাহাড়। তার চুড়ো আলোকসজ্জায় সজ্জিত। বাঁয়ে আরেক পাহাড় সেখানেও কি উৎসব শুরু হবে? রাতের অন্ধকারে পর্বত শীর্ষে আলোকিত প্রাসাদ বা দুর্গ দেখা যায় আকছার। কিন্তু পথের পাশে তিনটে একই রকমের পাহাড়, একই উচ্চতায় তিনটে দুর্গ?
সেই সন্ধ্যের আশ্চর্য দীপমাল্যের কাহিনি জেনেছি পরে। প্রতিরক্ষার কারণে পাহাড়ের ওপরে কেল্লা বানিয়ে শানিত চোখে শত্রুর আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করা হতো।একাদশ শতাব্দীতে পাশাপাশি পাহাড়ে গড়ে ওঠে এমনি অনেক দুর্গ। শোনা যায় ডি গ্লাইখে , ম্যুলবুরগ এবং ভাখসেনবুরগ এই তিনটি দুর্গে একদা নাকি মশাল জ্বলে ওঠে একসঙ্গে। তাই এদের নাম দ্রাই গ্লাইখেন বা একই চেহারার ত্রি মূর্তি! আজ মশাল নয়, বিদ্যুতের বাতি। তিনটি আলোক স্তম্ভ আকাশের পানে ধাবিত হয় তিন পাহাড়ের চুড়ো হতে।
যাচ্ছি থুরিঙ্গেন, গোয়েথের এরফুরট, গথা, ভাইমার – জার্মানির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সব নাম। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৯ থুরিঙ্গিয়া রাজ্য ছিল পূর্ব জার্মানির প্রদেশ। ধনতান্ত্রিক পশ্চিম থেকে সিটি ব্যাঙ্কের তকমা লাগিয়ে এখানে আসার কোন বাণিজ্যিক কারণ দেখানো আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল- – গোয়েথের আস্তানা দেখতে যাব বললে পুবের গণতান্ত্রিক সরকার বলে দিতেন ফ্রাঙ্কফুর্টে গিয়ে তাঁর জন্মস্থান দেখুন ! আমি অবশ্য সেই সব মনিষীর পদ চিহ্ন ধরে আসি নি। আমি এসেছি আমার বন্ধু অরটউইনকে দেখতে।
মাটি ফুঁড়ে যে জল বাদ ব্যরকায় উঠে আসে অনেক দিন স্বয়ং গোয়েথে তার গুণ পরোক্ষ করেছেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে সেবাসটিয়ান কনাইপ (Sebastian Kneipp) এখানকার লৌহ আকরের আশীর্বাদ ধন্য জল দিয়ে রোগ সারানোর আরও নতুনতর প্রথার উদ্ভাবন করেন।
বাদ ব্যরকা থেকে স্টাডরোডা আধ ঘণ্টার রাস্তা। সানাটোরিয়াম থেকে একবেলার ছুটি করিয়ে অরটউইনকে গাড়িতে তুললাম। থুরিঙ্গেন প্রদেশ অত্যন্ত সবুজ। নিচু টিলা আর নদীতে ভরা। বাদ ব্যরকা লিম নদীর ওপরে, স্টাডরোডা রোডা নদীর তীরে।এগারো বছর আগে এসেছিলাম ইয়েনা থেকে। এবার একটু অন্য পথে, ইয়েনাকে পাশ কাটিয়ে। এই রাস্তায় পড়ে মাগদালা গ্রাম। এর ইতিহাস ঠিক খুঁজে পাই নি। তবে ইসরায়েলে গালিলি হ্রদের পাশে আছে মাগদালা। ক্রিশ্চিয়ান বাইবেলের মারি মাগদালেনা যেখানে জন্মেছিলেন।
এগারো বছর আগে যে রেলওয়ে লেভেল ক্রসিঙে ঝরঝরে ট্রেন দেখেছিলাম সেখানে প্রকাণ্ড ফ্লাই ওভার। অরটউইনের সঙ্গে গল্প করছি। এমন সময় একটা চেনা গ্রামের নাম দেখলাম। তসলনিতস। এগারো বছর আগে এই পথে গেছি। রংচটা হলদেটে বাড়ি, দেয়ালে শ্যাওলা। একটা দুটো মুদীর দোকান ছিল। এ কি চেহারা! রাস্তা ঘাট বাড়ি ঘর পরিষ্কার, ঝকঝকে! এখানে লিডল মার্কেট ওখানে আপুথেকে (ফারমাসি)। এরপরে লাসফেলড। তেমনি সুন্দর সাজানো। স্টাডরোডা ঢুকে চমক লাগলো। হাজার বছরের পাথরে বাঁধানো পথ হয়েছে সংস্কৃত। প্রাচীন টাউনহল যেন ফিল্মের সেট। নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। গতবারে লক্ষ করেছিলাম ভাঙ্গা টালির ছাত। এবারে দেখলাম সব বাড়ির চালে চকমক করছে টালি। অরটউইন জানালে ওগুলো সেরামিক নয়, প্লাস্টিক বা কৃত্রিম টালি। তার আয়ু অনেক বেশী। রাস্তার নাম, বাড়ির নম্বর লেখা।
আর গাড়ি! দুনিয়ার যাবতীয় মডেলের গাড়ি চরে বেড়াচ্ছে অথবা ড্রাইভে রাখা আছে। কত রকমের দোকান। পিতসেরিয়া।রিসতোরানতে লা ভেনেৎসিয়া। সুপার মার্কেট। ডাক্তার খানা। ব্যাঙ্ক। সারি দিয়ে গাছ। কেয়ারি করা ফুলের ঝাড়। পথ জনশূন্য। সবাই কোন কাজে গেছে
আউগুসট বেবেল স্ত্রাসের মোড়- এখানে একদিন জানতে চেয়েছিলাম মাকস শিফারডেকার স্ত্রাসে কিভাবে যাব।দশ বছর আগে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একজনকে প্রশ্ন করলে তিনজন হাজির হতেন এখন একজন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দূরের কথা দর্শন পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। নীল শাদা অক্ষরে লেখা আছে মাক্স শিফারডেকার স্ত্রাসে। চেনা বাড়ি চেনা মুখ। তেরো নম্বর কিন্তু আমূল পরিবর্তিত। সেই চকচকে টালি, রাস্তা থেকে ওঠার ধাপ গুলো সুন্দর রঙ করা। হাইকে খুব খুশী হল আমাদের দেখে। জাখসেন / থুরিঙ্গেনের উচ্চারণে একটা বড়ো আদরের টান আছে। অনেকটা আমাদের বীরভূম বর্ধমানের বাংলার মতন। জানি 'কতদিন পরে এলে গো 'এ বাক্যের সম্যক অনুবাদ হয় না কিন্তু হাইকের কণ্ঠে আমি সেই সুর শুনলাম।
বাড়ির ভেতরটা দারুণ সাজানো। আগে মেঝেতে ছিল কাঠের পারকেট। এখন চমৎকার নকশা করা টাইলে বাঁধানো। প্রকাণ্ড রঙ্গিন টেলিভিশান। সোফা এতো বড়ো সেখানে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। বসতে নয়।
গতবারে হাইকের মা, এরিকার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি মারা গেছেন তিন বছর আগে। বাবা হ্যারবেরট একা থাকেন হ্যারমসডরফের সেই বাড়িতে। ছোট টরস্টেন ফিরল স্কুল থেকে ব্যাগ কাঁধে! মারকুস অল্প সময়ের জন্যে কিনডারগারটেনে ঢুঁ মারে। বিকেল গড়ালে ফ্রাংক ফিরে এলো কাজ থেকে। গাড়ী সারানোর ব্যবসা। সবাই বেশ ভালো আছে। স্টাডরোডার অনেক উন্নতি হয়েছে। দোকান পাট। শহর ছেড়ে যাবার উন্মাদনা নেই । যদিও কেউ কেউ অন্যত্র যায় চাকরির সন্ধানে। হাইকে বলল তোমাকে বলেছিলাম না? আমরা কোথাও যাব না। ভালমন্দ যা হবে থেকে যাব এই ভিটেতে। ঠিক বলি নি?
ফুটবলের কথা উঠল অবধারিত ভাবেই।
হাইকের বর ফ্রাংক স্থানীয় দল কার্ল-তসাইস ইয়েনার ফ্যান। আমাদের পশ্চিমের বুন্দেসলিগার সমতুল্য ছিল পূর্ব জার্মানির ওবারলিগা। সেখানে ইয়েনা উঁচু আসনে থাকতো। আমি ১৯৯০ সালে ফ্রাংককে বলেছিলাম এতদিন সেই দল তোমার দেশে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে যারা ভালো খেলেছে! এবার ফুটবলে দেখবে টাকার খেলা – নতুন বুন্দেসলিগাতে হয়তো ওবারলিগার দু চারটে টিম টিকে থাকবে। ফ্রাংক বললে ঠিক তাই হয়েছে। হান্সা রস্তক আর ডিনামো ড্রেসডেন ছাড়া বাকিরা উড়ে গেলো। ধরে নিন বার্লিনের ময়দানে যারা খেলেছে দেওয়াল ভাঙ্গার আগে অবধি তারা খেলতে গেলো নয় কলোনের মাঠে – কলকাতার ময়দান ছেড়ে শালকের কচু বনে।
আরেকটা অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ উঠল- আমার সময়ে পশ্চিম জার্মানির ফুটবল মাঠে দু দলের সমর্থকদের মধ্যে বাক বিতণ্ডা অবশ্যই হতো মার পিট খুন খারাবি নয়। কেভিন নামক ওয়েরডা ব্রেমেনের এক সমর্থকের ছুরিকাঘাতে মৃত্যু ছাড়া। এবার পূর্ব জার্মানিতে নানান গুন্ডাগরদির গল্প শোনা যাচ্ছে! ফ্রাংকের মতে দোষটা কার বলা শক্ত। তবে ফুটবলের গ্যালারিতেই ওয়েসি আর ওসির প্রথম সাক্ষাৎকার হচ্ছে!
এমনি গল্পে সময় কেটে গেলো। আমরা চার জন আর দুটি কৌতূহলী বালক!
কোন পাড়া পড়শি আসে নি।
বাইশ বছর আগে বেআইনি অনুপ্রবেশ করেছিলাম হ্যারমেসডরফে – পুলিশ বা পার্টির ভয় তুচ্ছ করে পাড়া ভেঙ্গে পড়েছিল হাইকেদের রান্নাঘরে। সেটাই বসার ঘর। সেখানে আসবাব সামান্য। এগারো বছর আগে এই মাক্স শিফারডেকারস্ত্রাসেতে এসে আমরা রান্নাঘরে বসি নি, সোফায় বসেছি বসবার ঘরে। প্রতিবেশীরা এসেছিলেন, সংখ্যায় কম, কৌতূহল অনেক বেশি। আজ আমরা আরও সুন্দর সাজানো বৈঠক খানায় আড্ডা দিলাম। দারুণ বাড়ি। বাইরে ঝকঝকে গাড়ি।
আজ কোন প্রতিবেশী আসেন নি।
অরটউইনকে সানাটোরিয়ামে জমা করে দিতে হবে সন্ধ্যে সাতটায়। মাথা গুনতি হবে তখন। ইচ্ছের বিরুদ্ধেও বিদায় নিতে হল। আবার আসব বলে এলাম।
আগস্ট ২০০১
পুঃ সেদিনের মারকুসের বিয়ে হল গত বছর। সে স্টাডরোডায় থাকে। হাইকের নাতনি হয়েছে। টরষ্টেন এখন নুরেমবেরগ বাসী। এগারো বছর অন্তর হাইকের সঙ্গে আমার দেখা দেখা হয়েছে তিন বার আপাতত, তিন অঙ্ক নাটিকার মতন। ২০১২ সালটা বাদ পড়ে গেল। আমি বলেছি ২০২৩ সালে হয়তো আবার ...