প্রস্তাবনা
মানব সভ্যতার প্রথম তিনটে যুগান্তকারী আবিষ্কার – চাষ, চাকা, আগুনের ব্যবহার। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ফিনিশিয়ানরা ধাতব মুদ্রা প্রচলন করলেন – সেটা চতুর্থ মহান আবিষ্কার! নইলে ব্যাঙ্কিং ঠিকমত শুরুই হত না! গোরু জমা রেখে ছাগল ধার দিয়ে কি আর ব্যবসা হয়?
সিটি ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্ক, কালক্রমে সিটিব্যাঙ্ক নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানের আদি ঋণ সংহিতা প্রণীত হয় ম্যানহাটানে। সাল ১৮১২। কালক্রমে সেই সংবিধানের অনেক সংশোধন, সংযুক্তি হয়েছে, মূল মন্ত্রটি বদলায়নি। অপরের গচ্ছিত টাকায় ব্যবসা করি, সেটি যেন মারা না যায় (১৯৯৮ সালে সলোমন ব্রাদারস নামক হঠকারীদের দ্বারা কবলিত হলে ’পর সিটিব্যাঙ্কের সেই সংবিধানটি অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয় – শেয়ারের দাম ৫৮ ডলার থেকে ৯৯ সেন্টে নেমে আসে)।
য়োখেনের কাছে রাশিয়াতে নতুন বাণিজ্যের সম্ভাবনার কথা শুনে খুব একটা উৎসাহিত হইনি। বরং ফ্রাঙ্কফুর্টের পথসভার গল্পটা বলে যোগ করলাম – ‘তোমার আমার দুই ব্যাঙ্কেই ঋণ দেবার কিছু নিয়মাবলী আছে! রাশিয়াতে কোনো প্রতিষ্ঠান পশ্চিমি ধারায় তৈরি বিগত অন্তত দু’ বছরের হিসেবপত্র দিতে অপারগ। আয়-ব্যয়ের খাতা না খুলে দেখালে কার ট্যাঁকে কী আছে কেমন ভাবে জানা যাবে? আমাদের ক্ষেত্রে নিউ ইয়র্ক এবং তোমাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট – দু’ শহরেই ক্রেডিট গুরুরা প্রশ্ন করবেন, জানো কি – ধার দিচ্ছ কাকে আর শোধ দেবে কে, কীভাবে? কোন মুদ্রায়? আপাতত ধরে নিচ্ছি ধারটা ডলারে। এবার অতএব আমার বাংলা কথা (আউফ ডয়েচ গেজাগট) – খদ্দেরটি কে?
য়োখেন আমার গভীর সংশয়ের আখ্যান শুনে বললে, জ্ঞান দিও না। ধার দেওয়ার ব্যাপারে আমরা জার্মানরা সিটিব্যাঙ্কের চেয়ে আরও দু’ কদম এগিয়ে ভাবি! এ সমস্যার সমাধান তখনই হতে পারে, যদি ধার দেওয়া ডলার ফেরত পাওয়ার ভারটা আমরা রাশিয়ার বাইরে সরিয়ে আনতে পারি।
এই যেমন তোমরা সিটি ব্যাঙ্ক থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার যোগাড় করে আফ্রিকার ঘানা কোকো বোর্ডকে ধার দিচ্ছ, আর সেটা ফেরত পাচ্ছ কোকো বোর্ডের নেসলে প্রমুখ খ্যাতনামা ইউরোপীয় চকোলেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। ঘানা কোকো বোর্ডকে চেনে দুনিয়ার কোন বান্দা? কিন্তু এক বিলিয়ন ডলার দিতে বাজার পিছপা হচ্ছে না – কারণ তারা চেনে নেসলেকে, যারা কোকো থেকে চকোলেট বানায়। কোকো গেছে নেসলের ঘরে। তোমার আমার ছেলেমেয়ের দাঁতের সর্বনাশকারী চকোলেট বেচে তারা ঠিক টাকা দেবে। আমরা সেরকম একটা কিছু করতে চাইছি।
সিটি ব্যাঙ্কের অসাধারণ ক্রিয়াশীল বুদ্ধিমত্তার প্রতি জার্মান ড্রেসনার ব্যাঙ্কের এবম্বিধ আস্থার পরিচয় পেয়ে আহ্লাদে আটখানা না হোক, চার খানা হলাম।
খদ্দেরটি কে?
সুধী, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিংয়ের বাজার অতি ক্রূর, কঠোর। প্রেম-প্রীতি-বন্ধুত্ব-ভ্রাতৃত্বের কোনো স্থান নেই। ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল। নতুন ঋণ গ্রহীতা খোঁজা, তার দফতরে ঘোরাঘুরি, জুতোর সুকতলা খইয়ে ফেলে বাজার থেকে টাকা তোলার ডিলটি পাকাপাকি করে ম্যানডেট নিয়ে তার সঙ্গে সুদের হার, পারিশ্রমিকের মান নির্ধারণ শেষ হলে তবে কোনো ব্যাঙ্ক অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করবে। আর সে আলোচনার আগেই পারিশ্রমিকের একটা আলাদা অংশ আপন পকেটে ভরবার ব্যবস্থা পাকা করে রাখবে। অন্য সকলকে জানাবে, এই মাত্তর এক পারসেন্ট ফি দিচ্ছে কঞ্জুস খদ্দের। ইতিমধ্যে পঞ্চাশ পয়সা আগেই হজম করে ফেলেছে নিজেরা। আগেভাগে খদ্দেরের নাম জানলে আপনার প্রতিপক্ষ সটান হাজির হয়ে যাবে সেই মক্কেলের কাছে, “কেন আপনারা এই ডিল সিটিব্যাঙ্ককে দিচ্ছেন? আমরা দুনিয়ার সকল নিবেশককে ওদের চেয়ে ঢের ভালো চিনি। জানি না আপনারা কত ফি দিচ্ছেন, তবে আমরা তার থেকে দশ পয়সা কম নিতেও রাজি”।
জানি। আমরা নিজেরা কিছু ধোয়া তুলসী পাতা নই। সেই দুষ্কর্ম করে থাকি। গোপন ডিলটি রবে না গোপনে। সামান্যতম গুজব হাওয়ায় উড়লেই প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাঙ্কের লাইন পড়ে যাবে খদ্দেরের দরোজায়। তবে এর ব্যতিক্রম আছে। যখন বুঝি একাকি গায়কের নহে তো এ গান – যখন মনে করি ঋণের পরিমাণটা ও ঝুঁকিটা খুব বড়, তখন আপন গর্ব, অহংকারকে শিকেয় তুলে রেখে মাঠে নামার আগেই একজন চুনি গোস্বামীকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করি। পরিণাম জানি – পারিশ্রমিক ভাগ করে নিতে হবে আরেকটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে। প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে হাত মেলানোর প্রবণতা অকারণ পুলকে জাগে না। আরেকটা সুবিধে এই, যে, দুই প্রতিপক্ষ একত্র হলে পালটা প্রস্তাব জমা হবার সম্ভাবনা কমে যাবে বাই দি ফ্যাক্টর অফ ওয়ান! ড্রেসনারের অবস্থান কি সেইরকম?
শাদেনফ্রয়ডের মত শোনাবে, কিন্তু এমন কিছু বীরপুঙ্গবের দেখা পেয়েছি, যারা ঋণ গ্রহীতার দইটি (ফি) মেরে একাই বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছিলেন, ল্যাজ গুটিয়ে ফিরেছেন। জিভের ডগায় এসে গেলেও প্রফেশনাল কার্টসি বশত সেই সব ব্যক্তির নাম করতে পারি না, আজ এত বছর কেটে গেলেও। কিছু ডিলের নাম করতে পারি – বুলগারিয়া টেলিকম, বাভারিয়া ইয়ট ইত্যাদি। আগ্রহী পাঠক রয়টার টমসন ডাটাবেসে এমনি বহু ব্যর্থ অভিযানের সুলুক সন্ধান পাবেন।
য়োখেন জানাল, ঋণ গ্রহীতা গাজপ্রম (যার পুরো নাম গাজভায়া প্রমিশেলনস্ত বা গ্যাস শিল্প)।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাগাদ রাশিয়ানরা প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পায় দেশের নানা জায়গায়, বিশেষ করে সাইবেরিয়াতে। ক্রমে সেটিকে কেন্দ্রীভূত করে গ্যাস মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনা হল ১৯৬৫ সালে। পেরিসত্রয়কার সূচনা হয়েছে। ১৯৮৯ সালে গাজপ্রমকে সরকারি মালিকানার অধীনে একটি সংস্থা বানানো হল (আমাদের হিসেবে পিএসইউ)। নতুন রাশিয়াতে সেই কোম্পানির খানিকটা মালিকানা বন্টিত হয়েছে কর্মীদের মধ্যে। তবে অবশ্যই কিছু ধুরন্ধর ব্যক্তি সেখানে ঢুকে পড়েছেন – অচিরে তাঁরা অলিগার্ক আখ্যায় বিভূষিত হবেন। সরকারের দখলে অর্ধেকের কিছু কম। পশ্চিম ইউরোপে গ্যাস পাইপলাইন গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে জার্মানি, ইটালি, ফ্রান্সে। সেখানে বছরে বিক্রি দেড় লক্ষ কোটি কিউবিক মিটার গ্যাস। য়োখেন যত বলে, তত সংখ্যাগুলি বিশাল আকার ধারণ করছে! গাজপ্রম চাইছে ১৭৫ কোটি ডলার। এতাবৎ কোনো রাশিয়ান কোম্পানি আন্তর্জাতিক ঋণের বাজারে একশ’ মিলিয়নের সন্ধানেও আসেনি। আর প্রথম আবির্ভাবে এত বড় একটা পরিমাণ! মারি তো গণ্ডার?
মেয়াদ?
য়োখেন বললে চেয়ারে বসে আছ তো? তা না হলে পড়ে যেতে পার। ওরা চাইছে সাত বছরের মেয়াদ! দরদামের কথা চলছে, যেখানে সিটিব্যাঙ্ক স্বছন্দে তাদের বক্তব্য রাখতে পারে গাজপ্রমের সামনে। তার মতে ফি বা পারিশ্রমিক সহ সব মিলিয়ে লাইবরের* (লন্ডন বাজারে যে দরে এক ব্যাঙ্কেরা একে অপরকে টাকা ধার দেয়) ওপরে আড়াই শতাংশের বেশি দেবে না।
তৈল, মতান্তরে গ্যাস বেচে তণ্ডুলের সন্ধানে চলেছে রাশিয়া। পথে পথে কুপন হাতে জনতার লাইন। সরকারি ভাঁড়ার শূন্য।
পরিকল্পনা
কোনো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার আমার এই গল্প পড়ার জন্য সময় নষ্ট করবেন না জানি, তাঁদের সময়ের দাম আছে। বিনম্র প্রণতি জানিয়ে বলি, তাঁদের কাজকর্মে সফল হতে গেলে কোনো আণবিক পদার্থবিদ্যার মত কঠিন বিষয় পড়তে বা জানতে হয় না। ঋণের বাজারে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারের কাজ দ্বিবিধ – ঋণ গ্রহীতা খোঁজা, তার ঋণের রূপ দেওয়া (অরিজিনেশন/ স্ট্রাকচারিং) এবং সেটি বেচা (ডিস্ট্রিবিউশন)। আজ বেশিরভাগ ব্যাঙ্কে এই দু’টি কর্ম দু’টি বিভিন্ন বিভাগকে দেওয়া হয়ে থাকে। সে আমলে আমরা একা সবটাই করেছি।
অতএব য়োখেন বা আমার কাজ শুধু ঋণ গ্রহীতার সন্ধানে তার দুয়োরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা নয়। ঋণের একটা চেহারা বা পরিকাঠামো দেওয়া, বাজারে সে ঋণ কতটা বিক্রি হতে পারে, কী দামে, তার তত্ত্ব তালাশ করা আমাদের কাজ। সামগ্রিক পরিমাণ যাই হোক না কেন, সিটি বা ড্রেসনার তার ১০% এর বেশি আপন খাতায় রাখবে না। অর্থাৎ আমাদের দুই ব্যাঙ্ক মিলে কেঁদে ককিয়ে ৩৫০ মিলিয়ন ধরে রাখব আমাদের খাতায়। বাকিটা বাজার থেকেই তুলতে হবে। আমাদের কাজ সেই বাজার নামক এক ধোঁয়াটে বস্তুকে বোঝা, তার একটা সঠিক চেহারা আমাদের প্রভুদের সামনে উপস্থাপিত করা। কতটা বিক্রি হবে? দুই ব্যাঙ্ক মিলে বাকিটা তুলতে পারব কি? আমাদের ক্রেডিট কর্তারা বলবেন, খদ্দেরকে আজ আমরা ১০০ টাকা দেব। তবে তিন মাস কাল দিলেম সময়। তারপর ফিরে আসিয়া জানাইবে, যে বাকি ৯০ টাকা বাজারে বিক্রিত হইয়াছে।
আমরা কি জ্যোতিষী? আসাম লটারিতে জয় অবধারিত বলে আপনার কপালে তিলক লাগিয়ে আমার দক্ষিণা আদায় করে কেটে পড়তে পারি না। লটারির রেজাল্ট জানা অবধি লেগে থাকতে হবে। নম্বর না মিললে প্রহারেণ ধনঞ্জয়!
সমস্যা বহুবিধ। ব্যাঙ্ক তার খাতায় কতটা ধার রাখবে শেষদিন অবধি (ফাইনাল টেক) সেটি জানি, কিন্তু সেই লক্ষ্যে না পৌঁছুতে পারলে? অবনত মস্তকে কর্তাদের কঠোর বক্তৃতা শুনতে হবে। সেটি শেষ হবে একটি চেতাবনি দিয়ে – প্রাথমিক বাজারে যে ঋণ সম্পূর্ণ বেচতে পারনি, সেটি এবার খোলা বাজারে গিয়ে বিক্রি কর (সেকেন্ডারি মার্কেট)। বোনাস এবং চাকরি দুটোর মাথায় খাঁড়া উদ্যত।
ঠ্যালায় পড়লে যে কোনো দরে মাল বিক্রি করে ব্যবসাদার – তার নাম স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল। দোকানের সামনে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘সেল সেল সেল’ লেখা দেখেছি বাল্যকাল থেকে। জিনিস বিক্রি হয়নি – কেনা দামের কথা ভুলে যান, ওই মাল (ইনভেন্টরি) দোকানে ভরে রাখারও খরচা আছে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ঠিক তাই। লাভজনক দামে বিক্রি করে মুনাফা কামাব – এই সঙ্কল্পে আমরা ধন (অ্যাসেট) সংগ্রহ করেছিলাম এক দামে। এখন সেটিকে গুদামে বা ব্যাল্যান্স শিটে ভরে রাখাটাও সাধ্যে কুলচ্ছে না। ব্যাঙ্কের সামনে সেল চলিতেছে লেখা শালু বা ফ্লেক্স টাঙাতে পারি না – আমানতকারিরা আতঙ্কিত হবেন, জমা টাকা উদ্ধারের উদ্দেশ্যে রান অন দি ব্যাঙ্ক শুরু করবেন।
তখন শুরু হবে টেলিফোনের ডায়াল ঘোরানোর খেলা। রাম-শ্যাম-টম-ডিক-হ্যারিকে জানাব – আমাদের কাছে একটি অসাধারণ সম্পদ আছে, যেটি আমরা একান্ত সুলভে তাঁদের মতন প্রিয়জনকে বিক্রি করতে চাই (বিগ শর্ট, টু বিগ টু ফেল অথবা শুধু মার্জিন কল দেখুন)। এই সুবর্ণ সুযোগ নহি মিলেগা দোবারা – এই একই মিথ্যে একবার, দু’বার, হাজারবার আউড়ে যেতে হবে। লাভ-লোকসানের চেয়ে ব্যাল্যান্স শিটের ভূমিকা বড় হয়ে দাঁড়ায় (লেমান ব্রাদারসের অন্তিম দিনে তাদের ধার বনাম আপন ধনের অনুপাত ছিল ৩৩ : ১)।
নাইফ’স এজ বা ছুরির ফলা বোধহয় একেই বলে! রাত্রিদিন একাকার করে দুনিয়া চষে আমাদের জোগাড় করতে হবে ৯০ টাকা। আমি অবশ্য রাতে ঘুমিয়েছি। আমার সাতাশ বছরের সহধর্মিণী বলেন, কেবলমাত্র একরাতে নাকি আমি ঘুমের মধ্যে বলে উঠেছি ‘হোয়ের আর দি আই এন জি পিপল?’। কাজটা কঠিন তবে অসম্ভব নিশ্চয় নয়। নইলে আমার মত বিদেশি ডিগ্রিবিহীন, স্বল্পশিক্ষিত, সিঁথি বরানগর এসবিআইয়ের প্রোডাক্ট এই কম্ম করে শেষ ২৫ বছর চাকরিটি বজায় রেখেছিল কী প্রকারে?
১৯৯৫ সালে বিশ্বের কোনো ব্যাঙ্ক রাশিয়ানদের এই পরিমাণ ডলার সাত বছরের জন্য দেবে না – সেটা বোঝার জন্য পণ্ডিতের দ্বারস্থ হতে হয় না। অতএব এই প্রস্তাবকে অন্য চেহারা দিতে হবে – ধার দিলাম রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানকে, কিন্তু তা শোধ হবে গ্যাসের ক্রেতাদের কাছ থেকে। ভাল করে হয়তো নয়, তবু কাজ করতে গিয়ে নতুন কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে বারবার। ব্যাঙ্কিং ব্যবসার কাছে এ কারণে আমি কৃতজ্ঞ। জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সে নিজেদের বাড়িতে গ্যাসের ব্যবহার দেখেছি। কিন্তু জানতাম না, তার কতটা রাশিয়া থেকে আসে। সেই সময় ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে সরাসরি পাইপলাইনে রাশিয়ান গ্যাস রপ্তানির আর্থিক পরিমাণ ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি। ক্রেতার তালিকায় সবার উপরে জার্মানির রুর গাস, তারপরে ফ্রান্সের গাজ দে ফ্রঁস, ইতালির স্নামপ্রজেতি। এঁরা সকলেই বিত্তবান সংস্থান। জার্মান ফরাসি আর ইতালিয়ান উপভোক্তা পরিবার তাদের গ্যাসের বিল সরবরাহকারীকে ঠিক মেটাবে। আর তার খানিকটা আমরা, ঋণ দাতারা সুদ ও আসল হিসেবে ফেরত পাব। আমাদের ঋণ গ্রহীতা গাজপ্রম তার ক্রেতাদের লিখিতভাবে জানাবে ও তারা লিখিতভাবে স্বীকার করবে তাঁরা তাদের দেয় পরিমাণের একটা নির্দিষ্ট অংশ গাজপ্রমকে নয়, নিউ ইয়র্কের সিটিব্যাঙ্কে জমা দেবেন।
পথসভা পদযাত্রা
ঋণের পরিমাণ বড়। ঋণগ্রহীতা অচেনা। সাহসে কুলোয় না। প্যারিস গেলাম। পদযাত্রা শেষে আরও দু’টি ব্যাঙ্ককে প্রাথমিক পর্যায়ে আনা গেল। মানে লাভের গুড়ের আরও দু’জন ভাগিদার! তারপর ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, প্যারিসে পথসভা। চেনা-অচেনা সকল ব্যাঙ্কের কাছে হাজিরা দেওয়ার জন্য আকুল ডাক পাঠানো হল। গাজপ্রমের কর্তাদের কাছে আমাদের এলেম প্রতিপন্ন করতে হবে – দেখুন, কত লোককে আকৃষ্ট করতে পেরেছি আপনাদের সেবার অভিপ্সায়! প্যারিস ফ্রাঙ্কফুর্টে পরিচিত ব্যাঙ্কারদের কাছে আকুল আর্তি – তোমরা ধার দাও না দাও, এস, অফিস কেটে হোটেলের কনফারেন্স রুমের চেয়ার গরম কর। অনেকদিন দেখা নেই, আড্ডা হবে, ভালমন্দ খাবার আছে, সন্ধ্যেয় পাব!
দ্বারে দ্বারে মাধুকরীর মত ঋণভিক্ষার গান।
গানের গতটি এই রকম -
ঋণ গ্রহীতা | গাজপ্রম |
ব্যবসা | গ্যাস বিক্রি |
ক্রেতা | রুর গ্যাস, গাজ দে ফ্রঁস সহ একটি পূর্ণ তালিকা |
ক্রয় চুক্তির মেয়াদ | সাত বছর |
চুক্তির মুদ্রা | আমেরিকান ডলার |
ঋণের পরিমাণ | ১.৭৫ বিলিয়ন |
ঋণের মেয়াদ | সাত বছর |
সুরক্ষা | নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী গ্যাসক্রেতাদের কাছে থেকে সুদ এবং আসল আমাদের অ্যাকাউন্টে জমা করার জন্য গাজপ্রমের নির্দেশ এবং ক্রেতার শর্তবিহীন প্রতিশ্রুতি |
সুদের হার | ৭.২৫% (তিন মাসের লন্ডন ইনটারব্যাঙ্ক সুদের হার তখন ৫.৫% – তার ওপরে ১.৭৫% যোগ হল) এটি ৫.৫% থেকে ৭% এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করেছে সাত বছরে) |
সুদ দেয় | প্রতি তিন মাসে |
ঋণ পরিশোধ | ২৮টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে |
ফি | যে ঋণদাতা যেমন দেবেন, তার ওপরে। বেশি দিলে বেশি ফি। |
চুক্তির আইন | ইংলিশ ল |
বিনিময় ঝুঁকি | শূন্য। রুবলের সঙ্গে এ ঋণের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি কোনো কারণে রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ডলারের গতিবিধির ওপরে কড়াকড়ি করেন, তাতে আমাদের ধার উশুলে কোনো বাধা পড়বে না। |
আমাদের প্রাপ্য ডলার আসবে ক্রেতার দেশ থেকে।
মাস কয়েক আগে অন্য ব্যাঙ্ক দ্বারা অনুষ্ঠিত ফ্রাঙ্কফুর্টের সেই পথসভার কথা মনে রেখে আমাদের আলোচনায় গাজপ্রমের মানুষজনকে বেশি বাক্য ব্যয়ের সুযোগ না দিয়ে আমরা নিজেরা মূল গায়েনের ভূমিকায় নামি। আমাদের গল্পটা তো সলিড!
পদসঞ্চার
নিবেশক খোঁজার ব্যাপারে আমার একটি থিওরি আছে – শত প্রতিবন্ধক সত্ত্বেও চেনাজানার বা বাণিজ্যিক পরিচিতির একটা ভূমিকা থাকে। মাত্র এক বছর আগে, ম্যান্ডেলার মুক্তির পরে নতুন দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম আন্তর্জাতিক ঋণ সংগ্রহে (অধমর্ণ – র্যান্ড মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক) যখন নেতৃত্ব দিয়েছিল একা সিটিব্যাঙ্ক – সবার আগে গিয়েছিলাম তাইওয়ানিজ, জাপানি ও জার্মান ব্যাঙ্কের কাছে। আপারটহাইডের দিনগুলিতে, যখন প্রায় সকল সভ্য দেশ সাদা দক্ষিণ আফ্রিকার ছায়া মাড়াতে অরাজি, এই তিনটে দেশের বিবেকে বা ব্যাঙ্কে কোনো দংশন দেখা দেয়নি। কেউ তাদের জোহানেসবুর্গ শাখা বন্ধ করেনি। যেমন পুরনো রেজিমকে সমর্থন করেছিলেন, তেমনি ১৯৯৪ সালে, উন্মুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার দিনেও এঁরা সকলেই অকাতরে আমাদের ডিলে অর্থ সরবরাহ করেন।
গাজপ্রম সেটি আবার সাব্যস্ত করলে।
আমাদের আবেদনের সাড়া এল অভাবনীয় ভাবে – মুখ্যত সেই সব ইউরোপীয় ব্যাঙ্কের কাছ থেকে, যাঁরা গাজপ্রম চেনেন, যাঁদের দেশে রাশিয়ান গ্যাসে রান্না হয়। স্বাভাবিক কারণেই জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ানরা সেখানে উপস্থিত (সে আমলে ইতালির অবস্থা পদে ছিল)। অনুপস্থিতের তালিকায় স্পেন পর্তুগাল এবং সারা নর্ডিক। কারণটা সহজবোধ্য – ফিনল্যান্ড বাদে এই দেশগুলি রাশিয়ান গ্যাসের ওপরে নির্ভরশীল ছিল না। আর ফিনল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সে সময়ে বিপন্ন। পূর্ব ইউরোপের কোনো ব্যাঙ্ক যোগ দেয়নি – তারা গ্যাস কেনে বটে, তবে তাদের কোষাগার ডলারশূন্য। কিছু জাপানি ব্যাঙ্ক। সিটি বাদে আর একটি মাত্র আমেরিকান ব্যাঙ্ক, অনেকবার নাম বদলে আজ সেটি জে পি মরগান নামে আখ্যাত। ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়াল আর ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সঙ্গে খানিকটা ভাঙল চল্লিশ বছরের লালিত অপরিচয়ের ভীতি, সন্দেহ, সংশয়, শঙ্কা। মানুষ তবু মানুষেরই সঙ্গে বাস করে। ব্যবসাবাণিজ্য তো সেই সামাজিক ব্যবহারের প্রতিফলন মাত্র। নিতান্ত তথ্যের খাতিরে সংখ্যাগুলি জানাই। ২১টি ব্যাঙ্ক মিলে সাকুল্যে ২ বিলিয়নের বেশি ঋণ যোগাড় হয়, কিন্তু বেশি ডলার জুটেছে বলেই ঋণের পরিমাণ বাড়াইনি। তবে তৎক্ষণাৎ আমাদের নিজেদের খাতায় ধারের পরিমাণ ১২৫ মিলিয়ন ডলার করে ফেলি, স্বভাবসিদ্ধ দশ শতাংশ বা ১৭৫ মিলিয়ন নয়।
সে আমলের আন্তর্জাতিক ঋণের বাজারে সাড়া জাগানো সংখ্যা।
বসন্তকালের এক সুন্দর সোনালি দুপুরে সেই ঋণ স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান হল। স্মরণীয় দিন। গালুসআনলাগেতে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের ফ্রাঙ্কফুর্ট অফিসের বাইরে উড়ছে অনেক পতাকা। সবচেয়ে উঁচুতে জার্মান ও রাশিয়ান পতাকা। তার দু’পাশে ঋণদাতাদের সম্মানে আমেরিকান, ফরাসি, ইতালিয়ান, ইউনিয়ন জ্যাক, ডাচ, বেলজিয়ান, ইত্যাদি সকল ঋণদাতা ব্যাঙ্কের দেশের পতাকা। আজকের দিনে ইতিহাস কে মনে রাখে? আমি কৌতূহলী এক বিদেশি। মন চলে যায় ইতিহাসের পাতায় – বরানগরে সত্যপ্রিয় স্যারের ক্লাসঘরে। ১৯৩৯ সালে পয়লা সেপ্টেম্বর জার্মানি ও সতেরোই সেপ্টেম্বর রাশিয়া তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ১৯৪১ সালে জার্মান বন্দুকের নল ঘুরল রাশিয়ার পানে। জার্মানি এবং রাশিয়ার নিশানের পাশাপাশি একটু নিচে যাদের পতাকা উড়ছে, তারা সবাই জার্মানির দিকে একদিন বন্দুক তাক করেছে। এই তো সেদিন, পঞ্চাশ বছর আগে।
মন ভরে গিয়েছিল। বিশাল সভাগৃহে সমবেত অর্ধেক ইউরোপ। প্রোটোকল ভেঙে আমন্ত্রিত কিছু রাজপুরুষ ও রাজদূত তাঁদের ভাষণে দিলেন এক মৈত্রীর বাণী। একজন বললেন, রাজনীতি ও অর্থনীতি মানুষেরই জন্য। চণ্ডীদাস মনে পড়ল ফ্রাঙ্কফুর্টের সমাবেশে। সবার উপরে মানুষ সত্য। হয়তো এক অর্থহীন আবেগ নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। এর দু’বছর বাদে, ১৯৯৭ সালে প্রাগে উন্নয়নশীল দেশগুলির কনফারেন্সে ভাষণে বলেছিলাম, আমার জীবৎকালে হয়তো আইরিশ সমুদ্র হতে বেরিং প্রণালী অবধি বিস্তৃত এক অভিন্ন ইউরোপ আমি দেখে যাব।
স্বপ্ন দেখার কোনো বাধা নেই। হয়তো একদিন। কোনোদিন।
পুনশ্চ: প্রথম লোন মেলাতে আশাতীত সাফল্য অর্জনের পরে আবার আমরা পথে নামি। ১৯৯৬ সালে একই মাধুকরী ভিক্ষার পুনরাবৃত্তি হল। এবার সুদ একটু কম, ঋণের পরিমাণ বেশি। দু’বিলিয়ন। আরও বেশি ব্যাঙ্ক অংশ নিলেন।
১৯৯৭ সালে গাজপ্রম বন্ডের বাজারে এসেই আড়াই বিলিয়ন তুললেন।
পরিশিষ্ট:
*লাইবর (লন্ডন ইনটার ব্যাঙ্ক অফারড রেট): মনে রাখা দরকার ব্যাঙ্কের নিজের কোষাগারে সব সময় ধার দেওয়ার মতন উদ্বৃত্ত টাকা থাকে না! বাজার থেকে তুলতে হয়। যে দরে ব্যাঙ্কেরা একে অপরকে ধার দেয় তার নাম লাইবর। এক্ষেত্রে লাইবর আর গাজপ্রমের দেয় সুদের ব্যবধান সেই ব্যাঙ্কের লাভ নির্ধারণ করে।
লন্ডনে শেষ যে ব্যাঙ্কে কাজ করেছি তার ডলার ডিপোজিট এতই স্বল্প, যে বাজারে হাত না পাতলে বাণিজ্য অসম্ভব ছিল।