এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  ইতিহাস  শনিবারবেলা

  • পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি – বসনিয়া হার্জেগোভিনা এবং রেপুবলিকা স্রাপসকা ১

    হীরেন সিংহরায়
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ০৪ মার্চ ২০২৩ | ১৫৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • সারবিয়ান গ্রাম - হারজেগোভিনা



    সারায়েভো থেকে সারের সবজির দোকান

    এক বিশেষ সবজি কেনবার জন্য আমরা পাশের গ্রাম হরসেলে যাই। সবজির নাম জেরুসালেম আরটিশক – দেখতে মুলোর মতন, খেতে মিষ্টি, মাটির তলায় গজায়, কার্বোহাইড্রেট ইনসুলিনে ভরপুর। আমাদের ন্যাপহিল গ্রামে সেইনসবেরির দোকানে তা নাকি মেলে না বলে রোদিকা জানিয়েছে। এ অবধি কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই, কিন্তু জেরুসালেম কেন? সেখানে চারিদিকে পাথরের টিলা, এ বস্তু সেখানে গজাবে কীভাবে? জ্ঞান ফলিয়ে কোনো লাভ নেই জানি। তবে এটি দুর্মূল্য নয়। এক কিলোর দাম তিন পাউন্ড, কিন্তু দুষ্প্রাপ্য। রোদিকার মতে এই বিশিষ্ট সবজিটির অপার গুণাবলী একটি লুক্কায়িত রহস্য—সিক্রেট ক্লাসিক—খুব কম লোক সেটি চেনে, আরও কম দোকানে তা পাওয়া যায়।

    আমার কৈশোরকালের কথা মনে পড়ে। সরষের তেল কখনো দুর্লভ হয়ে উঠতে দেখেছি। পাড়ার আনন্দ ভাণ্ডার বা আশু বাবুর বাজারে পাওয়া যায় না। হঠাৎ শোনা গেল—কাশীপুরে রিজেন্ট সিনেমার পাশের গলিতে নাকি মাথাপিছু দুশো গ্রাম পাওয়া যাচ্ছে। অতএব সাইকেলে চড়ে কাশীপুর যাত্রা। সেই দুশো গ্রাম সরষের তেলের ছোট্ট টিন মায়ের হাতে তুলে দিয়ে যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ পেয়েছি।

    হরসেলের সবজির দোকানের পরিসর নিতান্ত ক্ষুদ্র, হয়তো তিরিশ বর্গমিটার হবে। কিন্তু ফুটপাথ দখল করে তার বিস্তার প্রায় রাস্তা অবধি। সেটি স্থানীয় পৌরসভার অনুমতি প্রাপ্ত কিনা—সে প্রশ্ন অবান্তর। পথচলতি জনতা মুক্ত ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার গণতান্ত্রিক অধিকার হারানোর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেন না। দাঁড়িয়ে যান দোকানের মালিকের ভাষণ শুনতে। মালিক ইংরেজ। পূর্ব লন্ডনের ককনি উচ্চারণে কথা বলেন। সংলাপ নয়, তিনি একা বাক্য কয়ে যাবেন, অন্যে রবে নিরুত্তর। কলা-মুলোর সঙ্গে আরটিশকও বেচেন। হঠাৎ খুব নাটকীয় ভাবে চিৎকার করে বলেন, “বন্ধুগণ, আমার এই দুহাতে কী ধরা আছে? কী দেখছেন? না, জবাব দিতে হবে না, আমি বলে দিচ্ছি। আপনারা দেখছেন পাঁচটা বাক্স। তার ভেতরে কী আছে? আছে গোল্ডেন ডিলিশাস আপেল। মাত্র পাঁচ পাউন্ডে এই পাঁচ বাক্স পাবেন, যদি আপনি পরবর্তী পাঁচ মিনিটের মধ্যে কেনেন”।

    একান্ত কৌতূহলবশত বোঝবার চেষ্টা করেছি তাঁর এই বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত বাণিজ্যের কতটা কাগজে কলমে লেখা বা ছাপা হয়। অনেকটাই ক্যাশের কারবার – জিএসটি বা ভিএটি লাগে না! অন্যান্য বস্তু অবশ্যই কাউন্টারে রসিদ সহ বিক্রি হয়ে থাকে, যেমন আরটিশক।

    হরসেল গ্রামের এই সবজির দোকানে আমি এক নির্বাক দ্রষ্টা—এই নাটকে আমার কোনো ডায়ালগ নেই। বাজারের থলেটি গাড়ি অবধি নিয়ে যাবার দায়িত্ব আছে।
    আজ কোনো দৈববলে পাশা উল্টে গেল।

    আর কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে নীরবে রোদিকার পাশে দাঁড়িয়ে ফলমূলের ভালো-মন্দ বোঝার ভান করছি। এমন সময় আরেকজন ক্রেতা একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন,
    “আপনাকে কি আমি আগে কোথাও দেখেছি? আঃ, কোথায় বলছি কেন? আপনি তো সেই লোক যিনি রাস্তার ধারের কাফেতে বসে বিয়ারের শীতলতা নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন এই সেদিন? পরিবেশিকাকে প্রায় কাঁদাতে বাকি রেখেছিলেন!”

    স্বভাবসিদ্ধ মৃত সৈনিকের ভূমিকা থেকে সরাসরি মূল মঞ্চে অবতরণ করে বাক্যিহারা হয়ে গেলাম। দোকানি, তাঁর দুই সহকর্মী শুদ্ধু যাবতীয় জনতা সিধে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। রোদিকা খানিকটা বিভ্রান্ত। একটু ভাববার চেষ্টা করছি দেখে তিনি নিজেই বললেন

    - বাসারসিয়া মনে পড়ে? সারায়েভো?

    স্মৃতির রিল খানিকটা পিছনে ঘুরিয়ে দিতেই ঘটনাবলি মনের কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল। আগস্ট মাসে সারায়েভো শহরের পুরানো বাজার বাসারসিয়া অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছিলাম। জানি সারায়েভোর নাম শোনামাত্র সকলে এক বন্দুকবাজের কথা স্মরণ করেন, যার দুটি গুলিতে অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ভাবি রাজা ফ্রান্তস ফারদিনান্দ এবং তাঁর পত্নী সোফি নিহত হন। মিলিয়াকা নদীর ওপরে ল্যাটিন ব্রিজের কোণায় গাভরিলো প্রিঞ্চিপের গুলিতে শুধু আর্কডিউক এবং তাঁর পত্নী প্রাণ হারাননি – প্রাণ হারান অন্তত পনেরো লক্ষ মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ট্রিগার সেখানেই দাবানো হয়েছিল।

    বাসারসিয়া সেখান থেকে মাত্র দু-কদম দূরে।



    বাসারসিয়া সারায়েভো


    দীর্ঘ পাঁচশ বছরের শাসনকালে অটোমান রাজারা এখানে প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ, মাদ্রাসা। তার পাশাপাশি গড়ে উঠেছে অর্থডক্স গির্জা, ক্যাথলিক গির্জা, আছে সুপ্রাচীন সিনাগগ। সারায়েভোকে তাই পশ্চিমের জেরুসালেম আখ্যা দেওয়া হয়। এমনি এক সর্বধর্মের মিলনমেলায় পথের ধারের কাফেতে বসে বিয়ারের অর্ডার দিয়েছিলাম। পেলাম উষ্ণ এক পানীয়। প্রতিবাদ করায় মেয়েটি এনে দিল আরেকটি গ্লাস ভর্তি সারায়েভস্কা বিয়ার। এটিও ঠিক ঠান্ডা নয়, বলে পুনরায় প্রতিবাদ করেছি। মেয়েটি খানিকটা সকরুণ সুরে বলল, আচ্ছা, আমি না হয় আমি এই গ্লাসটা খানিকক্ষণ একটু ফ্রিজে রাখি? তাতেই হয়তো বিয়ার ঠান্ডা হবে।

    পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছড়ার দুটো লাইন লেখা আছে বাইরে: কোল্ড বিয়ার সোল্ড হিয়ার। বিয়ার যদি সোল্ড হতে চায় তাকে কোল্ড হতে হবে—তার পন্থা অন্য, ফ্রিজে সাময়িক অবস্থান নয়।।

    ততক্ষণে এই বাক্যালাপ এবং সেই প্রায় রোরুদ্যমানা বালিকা অনেকের দৃষ্টি এবং মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলেছে। রোদিকা বকাবকি করে কোনোমতে আমার শুভবুদ্ধিকে জাগিয়ে আমাকে নিরস্ত করল। অস্ট্রিয়ান রাজকুমার এখানে প্রাণ দিয়েছেন, আমি না হয় নিতান্ত উষ্ণ বিয়ার পান করব। শহিদ হতে হবে না।

    হরসেলের সবজির দোকানের এই মানুষটি তখন সেইখানে স্থানীয় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বসে দু-পাত্তর হাতে নিয়ে গজল্লা করছেন আর মহা কৌতূহলে এই দৃশ্য অবলোকন ও উপভোগ করেছেন! আজ এই দোকানে তিনি সেই গল্প ছাড়লেন: দোকানি থেকে খরিদ্দার সকলেই এই কিস্সার অংশীদার! এমন ধারা আকস্মিক যোগাযোগ ক্বচিৎ আমার জীবনে হয়েছে! আলাপ হল: সেদিনের সেই দ্রষ্টার নাম আলি, বসনিয়াক। বহু বছর ইংল্যান্ডে বাস করেন। এ বছরের আগস্ট মাসে তিনি তাঁর আপন শহরের ফুটপাথে বসে যখন আমার বালখিল্যতা উপভোগ করেছেন, ভাবেননি সেই অর্বাচীনের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ হবে, অন্য পটভূমিকায়, তাঁরই পাড়ার সবজির দোকানে, সারেতে।

    একেই বোধহয় বলে ওয়ান ইন এ মিলিয়ন চান্স!

    মেজুগোরিয়ে – মেরি মাতার অঙ্গনে



    দুবরোভনিক পিছনে ফেলে


    পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে একান্ত বাণিজ্যিক কারণে, কোনো প্রাক পরিকল্পনা ছাড়াই। প্রচলিত ভ্রমণ প্রথা বর্জন করে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে বার্লিন থেকে গাড়িভাড়া নিয়ে পোল্যান্ডের একটি নগণ্য গ্রামে যেদিন পৌঁছুই, জানতাম না সেদিনই শুরু হয়েছিল আমার পূর্ব ইউরোপ পর্ব। কখনো সে সাক্ষাৎ ঝালিয়ে নিয়েছি ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক সফরে। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনা করেও বসনিয়া যাওয়ার সরকারি অজুহাত খাড়া করতে পারিনি—কোনো ব্যাঙ্ক বা কর্পোরেটের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় অবধি নেই। তাই আমার এ যাত্রা একান্ত নিজস্ব। অফিসের কাজ ছিল ক্রোয়েশিয়ার দুব্রোভনিকে। সেটা সম্পন্ন হবার পরে রোদিকা সেখানে যোগ দিলে একটা গাড়ি ভাড়া করে শুরু হল বিশ বছর আগের মতো আবার অজানার খোঁজে যাওয়া—তবে গুগল এবারে সঙ্গে আছে !

    বহু বছর আগে সুইস এয়ারে জুরিখ থেকে আফ্রিকা যেতে এক অসম্ভব ঝলমলে দিনে আকাশ থেকে দেখেছিলাম আদ্রিয়াতিকের গাড় নীল জল, অজস্র দ্বীপ আর তার বাঁ দিকের এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড—যাকে আমরা বলকান বলে জানি। তুর্কী ভাষায় বলকান মানে পাহাড়। পাঁচশ বছর আগে কনস্টানটিনোপেল থেকে অটোমান (ওসমানলি) রাজারা এই পাহাড়ি অঞ্চল জয়ের অভিযানে যে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন তাদের প্রাথমিক দানাপানি জুটেছিল বসনিয়াতে। সম্পূর্ণ ঘটনাচক্রে সেই বলকানে আমার শ্বশুরবাড়ি—কাজে না হোক অকাজে এই বলকানকে চেনার বাসনা রয়ে গেছে। আমার পূর্ব ইউরোপের আখ্যানে বসনিয়ার ভূমিকা শুধু অর্থনীতি নিয়ে নয়, ইতিহাসকে নিয়েও।

    আদ্রিয়াতিক সমুদ্রের মণি দুব্রোভনিক (তার গল্প ক্রোয়েশিয়া পর্বে) শহর ও তার বন্দরকে ডান পাশে রেখে ইয়াদ্রান্সাকা চেষতা নামের পথ চলে যায় সিধে কালো পাহাড়ের দেশে, মনটিনিগ্রো। কিন্তু আমরা আপাতত সেদিকে নয়, যাবো পুবে। এই পথের উৎরাই বেশ শঙ্কাজনক, ডান দিকে অনেক নিচে সমুদ্র, বাঁয়ে খাড়া পাথরের দেওয়াল।

    পাহাড় পেরিয়ে যাব হার্জেগোভিনা, জার্মানে হেরতসোগ বা হেরজোগের অর্থ ডিউক, গৌরবার্থে হার্জেগোভিনা মানে ডিউকের জমিদারি। ট্রাক এ রাস্তায় খুব একটা চলে না, তারা আদ্রিয়াতিক সমুদ্রের উপকূল ধরে মোটামুটি সমতল পথ দিয়ে সোজা উত্তরে যায়।

    ক্রোয়েশিয়ান চৌকির পুলিস কিঞ্চিৎ কৌতূহলী। আমার চেহারার সঙ্গে আমার পাসপোর্টের রঙ, গাড়ির নম্বর প্লেট এবং পার্শ্ববর্তিনীর মুখ কোনটাই মেলে না, প্রায় কখনোই। চার দশক কেটে গেছে, পুলিশের বিস্ময় আমাকে আর বিস্মিত করে না। এখন কেবল পরবর্তী সংলাপের অপেক্ষা। পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে জানতে চাইলেন ঠিক কোথায় যাচ্ছি—মস্তার? বললাম, মস্তার যাবো, তবে মেজুগরিয়ে হয়ে। রোদিকাকে দেখিয়ে বললাম ইনি যে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা মহিলা, একবার মা মেরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান!

    তৎক্ষণাৎ মনে হল—এই নিতান্ত ছেলেমানুষি মন্তব্য না করলেই ভালো হত। আজকের বসনিয়া হার্জেগোভিনায় তিনটে ধর্মের একটা অস্বস্তিকর সহাবস্থান চলছে, সদ্য একটা প্রকাণ্ড গৃহযুদ্ধ ঘটে গেল। তার ওপরে আমি দৃশ্যত বিধর্মী। ক্রোয়েশিয়ানরা ক্যাথলিক, সারবিয়ানরা অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান। পাশাপাশি বাস, কিন্তু তাদের তেমন বনিবনা নেই—রোদিকা নিজে আবার অর্থডক্স। সে কথাটা অবিশ্যি তার পাসপোর্ট অথবা মুখে লেখা নেই কী ভাগ্যে! ক্রসেরও রকমফের আছে!

    ফল হল বিপরীত। সীমান্তরক্ষী এবার সরাসরি রোদিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, মেরি মাতা আপনার মঙ্গল করুন। আর একটা কথা বলি, ওদেশে খুব ভালো খাবার পাবেন, আর দামে আমাদের অর্ধেক! আমি আর আমার স্ত্রী সুযোগ পেলেই যাই।

    ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিদায় নিয়ে বসনিয়া হার্জেগোভিনা ঢুকতে কোনো সমস্যা হল না। সীমান্তের প্রহরী পাসপোর্টে ছাপ মারলেন বিনা বাক্যব্যয়ে।

    মেরি মাতার প্রসঙ্গটা কেন উঠল বলে নেওয়া যাক। আমরা যাচ্ছি যে গ্রামে, তার নাম মেজুগরিয়ে (অর্থ পাহাড়ের মাঝখানে)। লোকগাথা অনুযায়ী চল্লিশ বছর আগে ভার্জিন মেরি এই মেজুগরিয়ের একটি পাহাড়ের টিলায় ছটি বালক বালিকার সামনে আবির্ভূত হয়ে এক শান্তির বার্তা দিয়েছিলেন, “আমি তোমাদের জানাতে এসেছি ঈশ্বর আছেন। তিনি প্রাণবন্ত। এই জীবনের শান্তি ও পূর্ণতা অনুভব করতে হলে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাও।” বালক বালিকাদের নাম ও বয়েস যথাক্রমে মিরিয়ানা (১৫), ভিকা (১৬), ইয়াকভ (১০), ইভাঙ্কা (১৫), মারিয়া (১৬), এবং ইভান (১৬)। এঁরা এখন প্রাপ্তবয়স্ক। সকলেই নিয়মিত মেরি মাতার দর্শন পান, কেউ প্রত্যহ, কেউ বছরে একবার, দফায় দফায়। মেরি মাতার এই আবির্ভাবকে ক্যাথলিক গিরজে অথবা পোপ সঠিক মান্যতা দেননি, আবার অস্বীকারও করেননি। অর্থাৎ ইহা সত্য হইতে পারে আবার না হইতেও পারে, হয়তো ঘটিয়াছে অথবা ঘটে নাই। রাজশেখর বসু কোথাও বলেছিলেন, এয়াও হয় আবার ওয়াও হয়; বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, মেরি মাতার দর্শনের কাহিনী ধর্মের পক্ষে খুব আশাজনক (ব্যাবসার জন্যে তো বটেই)।





    মেজুগোরিয়ে ভক্তজনে দেহ আলো


    পাহাড় পেরিয়ে পথ নামল সমতলভূমিতে। দুটি ট্র্যাক, একটি আসার, একটি যাওয়ার। গাড়ি তেমন চোখে পড়ে না। গ্রামগুলি দূরে দূরে। তেলের লেভেল চেক করলাম—ট্যাঙ্ক ফুল, গন্তব্যস্থল মাত্র ১৩০ কিমি। গাড়ির তেল ফুরলে সর্বনাশ, কোনো পেট্রোল স্টেশন কেন, সুপার বা মিনি মার্কেট চোখে পড়ে না। ল্যান্ডস্কেপ মনে করিয়ে দেয় এককালে দাদার কর্মস্থল মধ্য প্রদেশের ছিন্দওয়ারা থেকে পিপারিয়া যাবার পথের কথা। দূরে দূরে গ্রাম আর অসংলগ্ন পাহাড়ের মিছিল। চোখে পড়ে অকস্মাৎ সিরিলিকে লেখা গ্রামের নাম—আমরা কি দেশান্তরে এসেছি? এই তো আগেরটা রোমান হরফে লেখা ছিল? পুরনো ইয়ুগোস্লাভিয়া ভেঙে গিয়ে আজকের যে রিপাবলিকগুলি গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে সবচাইতে বিতর্কিত অঞ্চল এই বসনিয়া হার্জেগোভিনা (কসভোর কথা বাদ দিলে)। মার্শাল ইওসেপ ব্রজ টিটো যে কোন জাদু মন্ত্রবলে চার দশক এই ছটি রিপাবলিককে একত্রে বেঁধে রেখেছিলেন—ভেবে পাওয়া শক্ত। জনসংখ্যার হিসেবে স্লোভেনিয়া মূলত প্রটেস্টান্ট, ক্রোয়েশিয়া ক্যাথলিক, মাসিদনিয়া, মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া—অর্থোডক্স। সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, মাসিদনিয়া তাদের ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে লেখে সিরিলিক অক্ষরে (তাদের সিরিলিক রাশিয়ান হরফ থেকে কিছু আলাদা)। ইয়ুগোস্লাভিয়াতে যদিও রিপাবলিকগুলির নিজস্ব পতাকা, সংবিধান ছিল, দেশের রাজধানী সার্বিয়ার বেলগ্রেড। সারবিয়ানরা সর্বত্র দাদা গিরি করেছে। সোভিয়েত আমলে বাকি চোদ্দটি রিপাবলিকে দলে দলে রাশিয়ান মানুষ এক্সপোর্ট করা হয়েছিল (এস্টোনিয়ার ২৭% নাগরিক রাশিয়ান), সার্বিয়া ঠিক তাই করে গেছে চল্লিশ বছর। ফলে নব্বুইয়ের দশকে ধর্ম ও ভাষার ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও, মিশ্রিত এলাকায় ভবিষ্যতের অশান্তির বীজ রোপিত হল, যার নির্মম নিদর্শন বসনিয়া হারজেগোভিনা—আজকের সে রিপাবলিকে ক্যাথলিক মুসলিম এবং অর্থোডক্স দেশটাকে ভাগ করে নিয়েছেন এবং পালা করে দেশ শাসন করেন যেখানে সিরিলিকে গ্রামের নাম দেখলাম সেটা রেপুবলিকা স্রাপসকার (সারবিয়ান রিপাবলিক) অংশ।

    মেজুগোরিয়ে দু-হাজার মানুষের একটি গ্রাম – প্রায় সকলেই ক্রোয়াট, ক্যাথলিক। আজ এই জুলাই মাসের রোদ ঝলমলে দিনে অন্তত হাজার দশেক যাত্রী এসেছেন, যদিও অনেক পেনশন, হোটেল চোখে পড়ে! অনেকে এসেছেন ক্রোয়েশিয়ার স্প্লিট (দু-ঘণ্টা) বা দুব্রোভনিক (দেড় ঘণ্টা) থেকে, অনেকে এসেছেন আধঘণ্টার দূরত্বে মস্তার থেকে—সেখানে এখন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর আছে। দু-হাজার মানুষের গ্রামে আছে হাজারটি হোটেল শয্যা আছে, বছরে দশ লক্ষ মানুষ এই তীর্থযাত্রায় আসেন, যদিও মা মেরির প্রথম দর্শনের সংবাদে ইয়ুগোস্লাভ সরকার বিশেষ প্রসন্ন বোধ করেননি – বরং এই ধার্মিক প্ররোচনায় ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে দু-চার জন ক্যাথলিক পুরোহিতকে জেলে পাঠান। মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পরে এই কড়াকড়ি শিথিল হয়ে আসে। বছর দশেকের মধ্যে কমিউনিস্ট রাজত্বের অবসানে এবং গৃহ যুদ্ধের সূচনায় মেজুগোরিয়ের শান্তির বানী শুনে রোসারির মালা ঘুরোতে আরও অনেক মানুষ এই তীর্থক্ষেত্রে আসতে শুরু করেন, যেমনটা শুরু হয়েছিল ফ্রান্সের লুরদে (১৮৫৮) এবং পর্তুগালের ফাতিমায় (১৯১৭), যেখানে মেরি মাতা দর্শন দিয়েছিলেন। ধর্মকর্মের সঙ্গে বাণিজ্যের যে অঙ্গাঙ্গী যোগ আছে সেটি আরেকবার প্রমাণিত হল। মেজুগোরিয়ে আজ ইউরোপের তৃতীয় অলৌকিক আবির্ভাবের জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র।



    মাদার মেরি


    অর্থোডক্সের সঙ্গে ক্যাথলিকের যে বিবাদই থাক না কেন, মাদার মেরিকে নিয়ে নেই—তিনি এসবেরই ঊর্ধ্বে। সেদিনের সেই রৌদ্রময় দিনে, শত শত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে পায়ে পায়ে ঘুরেছি, গিরজেতে মোমবাতি জ্বালিয়েছি আমার সন্তানদের পরিবারের শুভ কামনায়—পাহাড়ের সেই টিলায় গিয়েছি, যেখানে ছটি বালক বালিকা কোনো স্বর্গীয় শান্তির সন্ধান পেয়েছিলেন।

    হোয়েন আই ফাইন্ড মাইসেলফ ইন টাইমস অফ ট্রাবল
    মাদার মেরি কামস টু মি
    স্পিকিং ওয়ার্ডস অফ উইসডম, লেট ইট বি, লেট ইট বি




    ক্রমশ: এবার মস্তার - একটি সেতুর সন্ধানে

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৪ মার্চ ২০২৩ | ১৫৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১৪:২০517006
  • "মেরি মাতার দর্শনের কাহিনী ধর্মের পক্ষে খুব আশাজনক (ব্যাবসার জন্যে তো বটেই)।" দারুণ হীরেনদা। খুব ভাল লাগছে এই সিরিজ। ইউরোপের এই জেরুজালেমকে চেনানোর জন্য আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা অনিঃশেষ। 
  • Tapan Kumar SenGupta | ০৭ মার্চ ২০২৩ ১২:০৭517084
  • ...এ লেখার এমনই এক গুণ,... আমরাও সঙ্গে থাকি, ঘুরেফিরে দেখি জানি শিখি কত অজানারে, মনোমুগ্ধের মতন।
  • Kishore Ghosal | ০৭ মার্চ ২০২৩ ১৪:৪৮517090
  • ধর্মের সঙ্গে  সব যুগেই  অঙ্গাঙ্গী জুড়ে থাকে অধর্ম - অনেক অজানা বিষয় জানছি আপনার লেখা থেকে।  নিজের  অপরিমেয় অভিজ্ঞতার কথা  এমন সাবলীলভাবে লিখতে পারেন - বেশ ঈর্ষা অনুভব করি।   
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন