শহরের সাইনবোর্ডে দেখাচ্ছে BRNO
মায়া বললে উচ্চারণ কি?
বহু বছর আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট ভালড স্টাডিওনে ইউ এ এফ এ কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে আইনত্রাখত ফ্রাঙ্কফুর্ট বনাম জব্রোইয়ভকা বরনোর ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে এই নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় (চেকিয়া প্রথম পর্ব পশ্য)। সেটা তিরিশ বছর আগের কথা। বেশি বয়সের একটি সমস্যা হলো একটা গল্প শুরু করতে গেলে তিনটে প্রাচীন কাহিনিকে টেনে আনা আবশ্যক বলে মনে হয়। সেখানে আরেকটা বিপদ – আগের ট্রেলারগুলো হয়ত ছেলে মেয়েদের দেখা আছে, রিপিট করলে বিরক্ত হবে।
মায়াকে সংক্ষেপে জানালাম চেক আলফাবেটে যদিও অক্ষর বেয়াল্লিশটি, স্বর বর্ণ সাতটি, তারা এই সীমিত স্বর বর্ণগুলি অনেক ভেবে চিন্তে খরচা করেন, যেমন মৃত্যুর প্রতিশব্দ Smrt, শোনায় স্মরত্। এর পিছনে মুখের ব্যায়াম ছাড়া আর কোন যুক্তি আছে জানি না। BRNO উচ্চারণ বরনো অথবা ব্রনো। জার্মানরা অবশ্য এর একটা সহজ ভার্শন রেখে গেছে, ব্রুইন। এই রাজ্যের নাম মোরাভিয়া, চেকে মোরাভা, সেখানে ভাওয়েল আছে মাঝে ও শেষে। জার্মান আরও সহজ, মেহরেন।
মেয়েকে আরেকটা ট্রিভিয়া শোনানোর সুযোগ ছাড়া গেলো না।
চেক ভাষায় আনো (ano, শুনলে নো মনে হয়) হলো হ্যাঁ! আরেকটিমাত্র ইউরোপীয় ভাষায় এমনি গোলমেলে ব্যাপার আছে - গ্রিকে নে মানে হ্যাঁ!
ব্যবসায়ের নামে পূর্ব ইউরোপ বেড়ানোর দিন ফুরিয়েছে। ভিয়েনায় আমার অনাদি ব্যাঙ্কের বোর্ড মিটিং সেরে গাড়ি ভাড়া করেছি চেক সন্দর্শনের বাসনায়। প্রথম স্টপ ব্রুইন, ভিয়েনা থেকে মাত্র একশ মাইল। গাড়িতে বা ট্রেনে দেড় ঘণ্টা (ভাড়া আটশো টাকা!) ইতিহাসে পড়া হাবসবুরগ সাম্রাজ্যের দিগন্ত খুলে যায় চোখের সামনে, তাকে সত্বর চেনা হয়ে যায়। ভিয়েনার শোয়েখাত হাওয়াই আড্ডা থেকে বেরিয়ে শহরে যাবার পথে নির্দেশিকা চোখে পড়ে – এই দিকে প্রাগ, ব্রুইন,ওই বুদাপেস্ত, জাগ্রেবের রাস্তা- হাবসবুরগ রাজত্বের পুরনো জেলা সদর! এককালে কাঁটাতার, ওয়াচ টাওয়ার ছিল এখন সীমানা অবধি নেই। চেনা অচেনা জায়গা পার হয়ে যাই, এমনি হঠাৎ কখন পার হয়েছি আর্কডিউক ফ্রান্তস ফারদিনান্দের স্ত্রী সোফি ফন হোহেনবুরগের পৈত্রিক জমিদারি।
চেকোস্লোভাকিয়া নামের দেশ কোন কালে ছিল না; ছিল কয়েকটি রাজ্য বোহেমিয়া, মোরাভিয়া, চেক সাইলেসিয়া, আপার হাঙ্গেরি (আজকের স্লোভাকিয়া), আটশ বছর পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, তারপর হাবসবুরগ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাজত্বের (১৮৬৭-১৯১৮) অংশ। আমরা বোহেমিয়া এবং মোরাভিয়াকে বেশি চিনি, এদের নাম প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে। বোহেমিয়া আয়তনে বড়ো, প্রাগ তার রাজধানী, ব্যাভেরিয়ার সঙ্গে গায়ে লাগা, জার্মান ভাষা সংস্কৃতি ও শিক্ষার পীঠস্থান; মোরাভিয়া আজকের চেক রিপাবলিকের এক তৃতীয়াংশ, রাজধানী বরনো, চেকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর,ইউরোপের ষাট নম্বরে।
শারলামেনের আমল থেকেই পশ্চিমে আখেন, পুবে স্লাভিক অঞ্চল অবধি বিস্তৃত পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজ ভাষা ছিল জার্মান। ল্যাটিনের স্থান লাইব্রেরীর র্যাকে, গিরজেয়। বোহেমিয়ার মত মোরাভিয়াতেও জার্মান ভাষী জনতা বাস করেছেন মূলত শহরাঞ্চলে। তাঁরাই ডাক্তার, বদ্যি, উকিল, মোক্তার, জমিদার; তাঁদের পরিচারক, চাষি চেক। বিহারে সারা জীবন কাটিয়েও আমার মায়ের হিন্দি যেমন পঞ্চাশটা শব্দের গণ্ডি পেরোয় নি তেমনি নিতান্ত কাজ চালানোর জন্য খানিক চেক ভাষা শিখেছেন জার্মানরা, তাঁদের শতকরা দশ শতাংশ হয়তো চেক ভাষায় গপশপ করার এলেম অর্জন করেন। কাফকার মতন কিছু গুণী ব্যক্তি দুটো ভাষাই ভালো জানতেন, তবে সেটা ব্যতিক্রম। পবিত্র রোমান রাজে আম জনতা ল্যাটিন বলতেন না তাই এবার সেটি বদলে অস্ট্রিয়ান রাজ হলেও স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ বদলায় নি। মনে রাখা দরকার এঁদের ভাষা জার্মান কিন্তু ছিলেন অস্ট্রিয়ান প্রজা, প্রাগ তাঁদের বিদ্যাপীঠ। উচ্চ শিক্ষার্থে কেউ বার্লিন মিউনিক যেতেন না, যেতেন ভিয়েনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, ১৯৪৫ সালে এই বরনো শহরে চেক রাষ্ট্রপ্রধান এদুয়ারদ বেনেশ যখন ঝাড়ে বংশে জার্মান বিতাড়নের সার্বজনিক ঘোষণাটি করলেন, দেখা গেল দেশের চব্বিশ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা জার্মান বটে, কিন্তু তাঁদের পাসপোর্ট একদা ছিল অস্ট্রিয়ান, পরে চেক। চেম্বারলেন নাৎসিদের হাতে বোহেমিয়া মোরাভিয়া তুলে দিলে হিটলার তাঁদের জন্য জার্মান পাসপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বটে তবে সে দেশে সুদেতেন জার্মানদের খুড়ো জ্যাঠা কেউ বাস করেন না। যুদ্ধোত্তর জার্মান প্রজাতন্ত্র একটা স্বতন্ত্র দেশ। তাঁরা যাবেন কোথা? বেনেশ তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়, তাঁর দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন স্থান নেই (বর্তমানে চেকিয়ার গন গণনায় মাত্র উনত্রিশ হাজার মানুষ জার্মানকে মাতৃভাষা ঘোষণা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন)।
শুরু হলো জার্মান নিষ্কাশন (ফেরত্রাইবুং/ এক্সপালশন)।
আমার বন্ধু অরটউইনের মায়ের দেওয়া একটি স্মারক ফ্রান্সের বাড়ির দেওয়ালে টাঙ্গিয়েছি। তাতে লেখা
তোমার দেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখো সকল বিদেশির জন্য। তোমার স্বদেশেকে কখনো কোরো না বিদেশ
(LASS DIE FREMDE IN DEINER HEIMAT REIN, ABAR LAS DEINE HEIMAT NIE FREMD WERDEN)
পাঁচ বছর পরে চেক থেকে বিতাড়িত তিরিশ লক্ষ জার্মানের প্রতিনিধিরা স্টুটগারট শহরের সম্মিলনীতে এক ঘোষণাপত্রে সই করেন:
বিগত যুদ্ধের দায় দায়িত্ব সমানভাবে বন্টিত হোক সকল জার্মান জাতির ওপরে, তারা যে যেখানেই থাকুক না কেন
সকল নাগরিকের হোক সমান অধিকার শুধু আইনের চোখে নয়, জীবনের মাত্রায়
স্বদেশ হারানো এই আমাদের মতন মানুষদের সুযোগ দেওয়া হোক তাঁদের আপন পেশা অনুযায়ী নতুন জীবন গঠনের
ইউরোপের সার্বিক পুনর্গঠনে দেওয়া হোক ছিন্নমূলদের সমান অধিকার
স্টুটগারট
৬ আগস্ট ১৯৫০
ইতিমধ্যে নতুন জার্মান সংবিধান গৃহীত হয়েছে, যার প্রথম লাইন
মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয় (Die Würde des Menschen ist unantastbar)
পরবর্তী উনিশটি ধারায় সুরক্ষিত হয়েছে মানবিক অধিকার। সংবিধান রচয়িতাদের কাছে তার গুরুত্ব সবার ওপরে।
এক ভয়ানক যুদ্ধের পরে যখন পূর্ব পশ্চিম ভাগ হয়ে গেলো রাজনীতিক মতবাদের ভিত্তিতে, কেউ জানল না ইয়ালটা পটসডাম তেহেরানে তিন নেতা কোন অ্যালগোরিদমে স্থির করে নিলেন কার সেনা ঠিক কোন খানে গিয়ে থেমে যাবে, কেন পশ্চিমি ফৌজ এলবে নদী পার হবে না, যখন খুন কা বদলা খুন হলো সামাজিক বিচারের নাম, মানুষের জীবনের মূল্য পুনরায় শূন্য, সে সময়ে কার বিতাড়ন কে করেছে, কেন, কার অপরাধে বা কার অধিকারে সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। সে হিসেব করার দায় আমার ওপরে বর্তায় না।
আমি দূত মাত্র। অতএব অবধ্য।
বরনো/ স্লাভকভ উ বরনা
বরনোর শহর সীমানায় ঢুকতেই একটি টিলার (পেত্রভ) ওপরে খানিকটা কলোনের মতন যে জোড়া গিরজেটি চোখে পড়ে তার নাম সেন্ট পিটার ও পলের ভজনালয়। প্রায় হাজার বছর আগে তার পত্তন, সপ্তদশ শতাব্দীর ধর্মযুদ্ধের সময়ে এই শহর সুইডিশ সৈন্য বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও গিরজেটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখান থেকে বরনোর পুরনো শহরের দৃশ্যটি অতি মনোরম, কে যেন আদিগন্ত বিছিয়ে রেখেছে লাল টালির ছাতের মেখলার মালা। সেই পুরনো শহরের কেন্দ্রে - নেমেস্তি স্বভোদি -স্বাধীনতা চত্বরে একটি এস্ট্রোনোমিকাল ঘড়ি অবশ্য দর্শনীয়। নিকটবর্তী সেন্ট জেমস (ইয়াকুবা) গিরজের ভল্টের দেওয়ালে সাজানো আছে অন্তত পঞ্চাশ হাজার নরমুণ্ড। না, এরা কোনো সামগ্রিক বলিদানের শিকার নন এর একটা নিতান্ত ব্যবহারিক কারণ আছে।
এটি কোন সুখপ্রদ আলোচনার বিষয় নয়, শুধু তথ্যের খাতিরে জানাই- ধর্মানুসারে গিরজের পিছনের মাঠে (চার্চইয়ার্ড) পুণ্যভূমি বোধে মৃতদের গোর দেওয়ার রীতি দীর্ঘদিনের (এমনি সুইডেনের উপসালায় ভাইকিং বীর বর্গ বিশাল মাটির স্তূপের তলায় সমাহিত আছেন)। মৃতেরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেও বেশ খানিকটা জমি দখলে রাখতেন। ফলত পরবর্তী প্রজন্মের জীবনান্ত হলে গিরজের মাঠে গোর দেওয়ার স্থান অকুলান। এই জমি সমস্যার বিহিত করতে বিভিন্ন দেশে নানান পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, যেমন একই সমাধিতে থাকে থাকে একাধিকের স্থান দেওয়া, নতুন সমাধি ক্ষেত্র তৈরি করা। কিন্তু বরনোতে এক অস্ট্রিয়ান রাজা অন্য আদেশ দিলেন - গিরজের মাঠে চিরনিদ্রায় শায়িত মানুষের হাড়গোড় তুলে নিয়ে চার্চের গুহায় সংরক্ষন করে সেই জমি খালি করে দেওয়া হোক। আরেক দল মৃতের স্থান হবে সেখানে। এই কঙ্কাল সংরক্ষণ প্রথার নাম অসুয়ারি। প্যারিসে মঁপারনার অনতিদূরে প্লাস দেনফা রশেরুতে আছে ইউরোপের বৃহত্তম অসুয়ারি। হেলসিঙ্কি বন্দরের পাশেই পাবেন আরেক অসুয়ারি, হাড়গোড় দিয়ে অলঙ্কৃত গিরজে। চতুর্দিকে ঝুলছে অজস্র হাড়ের মালা!
আমরা যাচ্ছি বরনোর অনতিদূরে একটি ছোট্ট শহর বা গ্রাম স্লাভকভ উ বরনা। আমরা ইতিহাসে তাকে জানি অন্য নামে – আউস্টারলিতস! ফ্রান্সের সম্রাটরূপে অভিষিক্ত হওয়ার এক বছর বাদে, ১৮০৫ সালে ডিসেম্বর মাসের পাঁচ তারিখে এইখানে একটি টিলার ওপরের সমতল ক্ষেত্রে তাঁর গ্র্যান্ড আরমের লাখ খানেক সৈন্য সমাবেশ করে রাশিয়ান এবং অস্ট্রিয়ান দুই সম্রাটের বাহিনীর সম্মুখীন হলেন নেপোলিয়ন। তিন সম্রাটের লড়াই। চার ঘণ্টার লড়াইতে সংখ্যায় বৃহত্তর প্রতিপক্ষ বাহিনীকে পরাস্ত করে গ্র্যান্ড আরমে। রণবিদ্যার গ্রন্থে নেপোলিয়নের এই বিজয়কে অতুলনীয় ট্যাকটিকাল মাষ্টারপিস বলে আখ্যাত করা হয়। কৃতজ্ঞ সম্রাট দীর্ঘ ভাষণের শেষে তাঁর সৈন্যদের বলেছিলেন,
‘তোমরা আমার সঙ্গে ফ্রান্সে ফিরবে মাথা উঁচু করে। আমার প্রজারা জানাবেন আন্তরিক অভিনন্দন। তাঁদের শুধু বোলো ‘আমি আউস্টারলিতসে লড়েছি’। তখন তাঁরা সমস্বরে বলবেন, আপনি আমাদের জাতীয় বীর’।
যেখানে দাঁড়ালাম সেটি আজ চাষের খেত।
পুরনো কাসুন্দি মতান্তরে ইতিহাসের গল্প শোনার বিষয়ে রোদিকার অনীহা (ফরাসিতে সম্ভবত অনুই বলে) একান্ত সহজাত। কিন্তু সেই রানিং কমেন্টারির একজন শ্রোতা, মায়া, পেছনের সিট থেকে মাঝে মাঝে দুটো প্রশ্ন করে জানান দেয় সে শুনছে বা জেগে আছে। জানতাম না মায়া সেদিন শুধু কানেই শুনছিল না।
যদিও তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি নয় তবু হাজার বছর আগে শারলামেন এক ছেলেকে রাইনের বাঁ দিক, অন্য জনকে ডানদিকটা লেখাপড়া করে দিয়ে ইউরোপের যে ম্যাপ এঁকেছিলেন, সেটাকে নেপোলিয়ন বদলে দিলেন। তার অগ্নিস্বাক্ষর এই আউস্টারলিতসের যুদ্ধ।
প্রেসবুরগে (ব্রাতিস্লাভা) সন্ধি স্বাক্ষরিত হবার কয়েক মাসের মধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত পবিত্র রোমান সম্রাট ফ্রান্সিস মহামান্য পোপকে চিঠি লিখে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলেন- তিনি আর রোমান নয় অস্ট্রিয়ান সম্রাট সেজে বাকি দিনগুলো কাটাতে চান। ইউরোপীয় ইতিহাসে পত্র মারফত সম্রাটের চাকরি ছাড়ার প্রথম নমুনা। রাশিয়ান জার নাস্তানাবুদ হয়ে মস্কো বাসী হলেন। বহু জার্মান রাজ্যকে অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মাতব্বরি থেকে আড়াল করে নেপোলিয়ন যে জার্মান রাষ্ট্র সমবায় তৈরিতে মদত দিলেন তার নাম রাইনবুনড (কনফেডারেশন অফ দি রাইন) – একদিন সেই রাইনবুনড আরও বৃহৎ আকার নেবে, ষাট বছর পরে প্রথম যে জার্মান রাষ্ট্র দেখা দেবে সেটির জনক প্রকৃত প্রস্তাবে নেপোলিয়ন।
নেপোলিয়নের ইতালি অধিকার ইতিমধ্যেই সে দেশের ম্যাপটা বদলে দিয়েছে। অস্ট্রিয়ান সম্রাটের অজস্র অনুগত রাজা রাজড়ার মৌরসিপাট্টা দিলেন তিনি উড়িয়ে (ভেনিস নামক রাজ্যকে একদিনে), মিলানে গিয়ে ভেঙ্গে দিলেন ইহুদি ঘেটোর দেওয়াল, প্রতিষ্ঠা করলেন আইন, কর, সার্বজনিক শিক্ষার ব্যবস্থা। ইতিহাসে এই প্রথম দেখা দিলো এক ইতালিয়ান রাষ্ট্র (কিংডম অফ ইতালি) ; গারিবালডি মাতসিনি কাভুর সেটিকে আরেক মাত্রায় নিয়ে যাবেন, যাকে আমরা আজকের ইতালি দেশ বলে চিনি। মাত্র এগারো বছরের শাসনকালে ইউরোপকে বদলে যে চেহারা দিয়েছিলেন, সেটি এখনও দৃশ্যমান।
এই নেপোলিয়ন মিশর অভিযানে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ১৬৭ জন বৈজ্ঞানিক, ইতিহাসবেত্তা, প্রত্নতাত্ত্বিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ। ইংরেজ গিয়েছিল ফারাওদের সম্পত্তি লুঠ করতে। পিরামিডের স্ফিংক্স বা লুক্সরের মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে আমরা যেন সেই সম্রাটকে স্মরণ করি যিনি এঁদের বালুকা সমাধি থেকে আলোয় নিয়ে এসেছিলেন।
গাড়ির মধ্যে রোদিকা ততক্ষণে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। মায়া জেগে।
এবার প্রাগের পথে।
দশ বছর পরে
উচ্চ মাধ্যমিকে (ইংল্যান্ডের এ লেভেলকে আমি তাই বলি) ফিজিক্স কেমিস্ট্রি সাইকোলজি পড়ে মায়া যে হলওয়ে কলেজে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো অকাজের পরার জন্য নাম লিখিয়েছে তার জন্য রোদিকার কাছে আমি পূর্বেই আমাকে দোষী হয়েছি। বি এ তে ভালো রেজাল্টের সুবাদে মায়া লন্ডনের কিংস কলেজে তার মাস্টার্সের পাঠ শুরু করেছে। মায়ার মুখ থেকে জানবার জন্যে জিজ্ঞেস করেছিলাম ন্যাচারাল সায়েন্স পড়ে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা, মাইগ্রেশন, পলিটিকাল ইকনমি, আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজকর্ম ইত্যাদি ধোঁয়াটে বিষয় নিয়ে কেন লেগে রইলে?
এর উত্তরে মায়া লিখেছে
জানি এটা তোমার পুরনো প্রশ্ন। এবার আরও পরিষ্কার করে বলি।
সেটা তোমার কারণে, বাবা।
ছোটবেলা থেকে শোনা তোমার সব গল্প, বরনো, আউসটারলিতস সব মনে আছে। তুমি যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানান কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে নানা দেশের গল্প, ইউরোপের ইতিহাসে নেপোলিয়নের প্রভাবের কথা না শোনাতে, আমি হয়তো এই বিষয় নিয়ে পড়তে আসতাম না। তুমি এখনও হয়তো মনে করো আমি ছোট্ট মেয়ে ছিলাম, সব শুনি নি, সেটা ঠিক নয়। শুনেছি। সেটা কাজে লাগছে এখন।*
বই ছবি সহ ক্রাইবিখ পরিবারের যাবতীয় সংগ্রহ আমাদের হেফাজতে। পরশু দিন ভালটার এফারটের ইন বোয়মিশেন ভিনড বইটা খুঁজতে গিয়ে একটা কাগজের মোড়কে পেলাম একগুচ্ছ বিয়ার ম্যাট – ব্রুইন শহরে ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সুদেতেন জার্মান ক্লাবের শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠানের, ১৯৭৯ সালে তার স্মারক রূপে বন্টিত হয়েছিল এই বিয়ার ম্যাট। ঠিক সেই বছরে চেকোস্লোভাকিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়- ফ্রাঙ্কফুর্ট ভালড স্টাডিওনে জব্রোইয়ভকা বরনো ফুটবল দলের সমর্থক ফ্রান্তিসেকের সঙ্গে আলাপ। অরটউইনের সঙ্গে সদ্য মেলামেশা শুরু তার চেক ইতিহাস জানি না। সে দেশ বা তার কোন নাগরিকের সঙ্গে আর কোনদিন সাক্ষাৎ হবে ভাবি নি ; ভিসা হাতে নিয়েও চেকোস্লোভাকিয়ার দুয়োর হতে ফেরত এসেছি। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্ট ব্রাঞ্চে কাজ করি, চুক্তি মোতাবেক পরের বছর দেশে ফেরার কথা। আবার চেকোস্লোভাকিয়া যাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না অথচ কোথাও যেন তাই লিখে রেখেছেন কেউ।
কবে কোথায় কোন দূর দেশে জন্মেছি,চেকোস্লোভাকিয়া দেশ ম্যাপে দেখেছিলাম সেখানে সশরীরে পৌঁছুনর কোন কথাই ছিলো না। অথচ আজ, মায়ার এই চিঠি, একই দিনে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া ক্রাইবিখ পরিবারের বিয়ার ম্যাট মনে করিয়ে দেয় বরনোর ফুটবল দল জব্রোইয়ভকার ফ্যান ফ্রান্তিসেককে, মোরাভিয়ার সেই দুটো দিন,। বরনো, ব্রুইন, আউসটারলিতসের মাঠ আমাকে কোথায় যেন নিয়ে গেলো, এক সুতোয় গেঁথে দিলো চেকিয়ার অজস্র স্মৃতি- পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ভিসা থাকা সত্ত্বেও ইয়েগারে চেক সীমান্ত প্রহরীর শীতল প্রত্যখ্যান, প্রথম বিদেশি বস, প্লজেনের কারেল সোভার অফিসে পিলসেনের সোনালি বিয়ার, হেসেনে আমার প্রিয়তম জার্মান বন্ধু অরটউইনের সঙ্গে মেদোনসতে তার পৈত্রিক বাড়ি যাওয়া, জানলা দিয়ে মানুষ ছোঁড়ার গল্প শোনা টাওয়ার, কারলস ব্রুইকেতে দাঁড়িয়ে দেখা আলোকিত প্রাগ প্রাসাদ, মলদাউ নদীর সাতটা ব্রিজ, ওয়েনসেসলাস স্কোয়ারে সন্ধ্যা,,স্মেতানার মা ভ্লাসট -আমার স্বদেশ-, তিরিশ নম্বর পারিসকার জানলা দিয়ে দেখা কাফকার সিনাগগ, তাঁর প্রাইমারি স্কুল বাড়ি ; সব মিলে এক আশ্চর্য মোজাইক। চোখ বন্ধ করলেই সব দেখতে পাবো।
সব।
প্রসঙ্গত, মোরাভিয়ার কয়েকজন কৃতী সন্তান
জিগমুণ্ড ফ্রয়েড, গিওরগ মেনডেল (মেনডেলিয়ান ল অফ জেনেটিকস), টোমাস বাটা (জুতো!), অস্কার শিনডলার (শিনডলারস লিস্ট), ইওসেফ শুমপেটার, অয়গেন ফন বাম বাভারক (অর্থনীতিবিদ) মিলান কুন্দেরা, এমিল ইয়াটোপেক (দূর পাল্লার দৌড়বীর), ইভান লেনডল (টেনিস)
আলবেরতো মোরাভিয়া এই তালিকায় পড়েন না। তিনি ইতালিয়ান (বেরনারদো বেরতোলুচির কনফরমিষ্ট, বোলোনিনির গোস্ট অ্যাট নুন ছবি তাঁর লেখা অবলম্বনে চিত্রায়িত হয়েছে), রোমে জন্মেছিলেন। আসল নাম আলবেরতো কিনকেরলে। অনুমান করা হয় আলবেরতো তাঁর ইহুদি দিদিমার জন্মভূমির স্মৃতিতে খটোমটো কিনকেরলে পরিত্যাগ পূর্বক মোরাভিয়া নামটি গ্রহণ করেন।
অথ চেকিয়া পর্ব সমাপ্ত
Maya’s mail
Baba
I know, this is your old query. Let me be specific.
It was only because of you, Baba.
I remember every little story, Brno, Austerlitz. All. If you hadn’t been telling me stories of so many countries, impact of Napoleon on European history, I would not have followed this line of education. Perhaps you still think I was just a little girl then, I didn’t hear. That’s not true. I did. That’s paying off now.
Maya