আকাশ থেকে তোলা ছবিতে কেপ টাউন
কেপ টাউন পর্ব ২
অন্তরীপ যাত্রা
পশ্চিম আফ্রিকার কেপ ভারদ নামক যে দেশকে (পর্তুগিজ কাবো ভেরদের ইংরেজি উচ্চারণ) আর্সেনাল ও ফ্রান্সের ফুটবলার প্যাত্রিক ভিয়েরা দুনিয়ার কাছে পরিচিত করিয়েছেন, সেটি কোনো অন্তরীপ নয়, সবুজ (পর্তুগিজে ভেরদে) তো নয়ই। একটি আগ্নেয়গিরি হতে উৎপন্ন সাতটি দ্বীপের সমষ্টির নাম কেপ ভারদ। গিয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম- আফ্রিকার
নিকটতম উপকূল সেনেগাল সেখান থেকে পাঁচশো মাইল পুব দিকে, একে কেমন করে অন্তরীপ বলা যায়?
তেমনি কেপ টাউন একটি টাউন বটে কিন্তু এর সঠিক অবস্থান কেপ বা অন্তরীপে নয়। আফ্রিকার শেষ ভূমিখণ্ড, কেপ অফ গুড হোপ এই শহর থেকে অন্তত পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে। যাওয়া যায় টেবল মাউন্টেনের পাদপ্রান্তে ভিক্টোরিয়া অ্যালবার্ট ওয়াটারফ্রন্ট থেকে বাঁয়ে মুড়ে সিগনাল হিলের নিচ দিয়ে ক্লিফটন, ক্যাম্পস বে হয়ে, সেখানে বসত এলাকা পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। ক্যাম্পস বে মুম্বাইয়ের মালাবার হিলসের মতন, অতি মহার্ঘ্য! সেখানে একবার নিমন্ত্রণ হয়েছিল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন চেয়ারম্যান ওমি ভাটের মেয়ের বিয়েতে, বাড়ির নাম ডানেডিন, কয়েক একর জমির ওপরে তৈরি সে বাড়ি নাকি ভারতের সবেচেয়ে মূল্যবান স্থাবর সম্পত্তি।
একর দূরের কথা, ক্যাম্পস বে তে আমাদের হিসেবে তিরিশ কোটি টাকার কমে সমুদ্রমুখী ব্যালকনি-ভিউ সহ সামান্য দু কামরার বাসভবন মেলে না। আমাদের এক প্রাক্তন নাইজেরিয়ান সহকর্মী ডেলে বাবাদের ফ্ল্যাট দেখে ঈর্ষা বোধ করেছি; বারান্দায় বসে উদাস ভাবে সে বললে, আর সব ভালো বুঝলে, তবে কি দুটো সিকিউরিটি গার্ড রাখতে হয়েছে। আমরা সবাই জানি বিকেল পাঁচটার পরে অকস্মাৎ কেপ টাউনের পথ ঘাট জনশূন্য হয়ে যায়, ওয়াটার ফ্রন্ট ছাড়া বাকি শহর জনমানব শূন্য। আপনার নিরাপত্তার ভার আপনার নিজের হাতে না নিতে পারলে দেহরক্ষী মোতায়েন করুন।। তবু ডেলের বাসার বারান্দায় বসে বাউটেন ফেরআখতিং (আফ্রিকানস, অনুবাদে আশার অতীত ) নামের শ্বেত মদ্যের পেয়ালা হাতে অনন্ত আটলান্টিকের দিকে যখন চেয়ে থেকেছি, তার রক্ষীবাহিনীর খরচার হিসেব আমার মনে কোনো করুণার উদ্রেক করেনি।
অন্তরীপ যাত্রা
কোনো না কোনো কনফারেন্সের দৌলতে অন্তত বার চারেক এসেছি কেপ প্রদেশে। ক্যাম্পস বে, স্যানডি বে পেরিয়ে দেখেছি মাইলের পর মাইল সাদা বালির বিচ, হাউট বে-তে অর্ধ চন্দ্রের আকারে বালুকাবেলা। এই পথে পড়ে চ্যাপম্যান পয়েন্ট – সপ্তদশ শতাব্দীতে কনসেন্ট নামের একটি ব্রিটিশ জাহাজ আটলান্টিকের বালিতে আটকে গিয়েছিল। এটি সেকালের দৈনন্দিন ঘটনা। দিশা হারানোর আশঙ্কায় জাহাজ যেত তীর ঘেঁষে। মহাসমুদ্র অশান্ত অস্থির, কখনো জেগে ওঠে বালির চর, কখনো উত্তাল জলঝঞ্ঝা টেনে নিয়ে যায় জাহাজ। অনেকটা উত্তরে নামিবিয়ার তটে, জলে বা বালিতে মগ্ন হয়েছে বহু নৌ-যান- স্থানীয় উপকথা বলে, এক ক্রুদ্ধ ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন এই তট; রবীন্দ্রনাথ কি তাই লিখেছিলেন, “স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে নতুন সৃষ্টিকে বার বার করছিলেন বিধ্বস্ত।”
ক’দিন বাদে কনসেন্ট জাহাজে খাবার ফুরুলে ক্যাপ্টেন বললেন, জাহাজ কবে আবার জলে ভাসবে জানি না। অপেক্ষা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। তবে কূল দূরে নয়, দেখো যদি এই অচেনা অজানা জায়গা থেকে তোমরা কিছু অন্নসংস্থান করতে পারো, আর পেলে আমার জন্যেও এনো!’ এই রুক্ষ, পাথুরে দেশ কেউ চেনে না, কারা বাস করে জানা নেই; জাহাজের মাল্লারা না খেয়ে মরবে কিন্তু বিদেশ বিভূঁইতে কোন নরমুণ্ড শিকারির লাঞ্চ মেনুতে অন্তর্ভুক্ত হতে রাজি নয়। এমন সময় সেকেন্ড অফিসার (মতান্তরে পাইলট ) জন চ্যাপম্যান বলেন, “স্যার জাহাজ যখন আটকেই আছে, অনুকূল জলরাশির অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোনও কাজ নেই, আমাকে তীরে যাবার অনুমতি দিন।
দেখি কিছু যদি জোটে।” গল্প অনুযায়ী অকুতোভয় জন চ্যাপম্যান ডাঙায় পৌঁছে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে সদ্ভাব সদাচার দ্বারা (ইংরেজিতে নিশ্চয় নয়!) র্যাশন যোগাড় করে এনে মাল্লাদের ও ক্যাপ্টেনের ক্ষুধা নিবৃত্তি করেন। পরে সমুদ্রের ঢেউ কনসেন্ট জাহাজকে বালির গ্রাস থেকে মুক্ত করলে তার যাত্রা আবার শুরু হয়।
গল্প ফেক কিনা সেটা যাচাই করার কোন উপায় নেই, কেন না আমাদের একমাত্র সোর্স ডকুমেন্ট স্বয়ং চ্যাপম্যানের ডায়েরি, তিনিই এই ছবির চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক ও পরিচালক! এমনটা তো আকছার হয়েছে। সেই যে দেড়শো বছর আগে টাঙ্গানিকা হ্রদের তীরে উজিজি গ্রামে হেনরি মর্টেন স্ট্যানলি একজন বৃদ্ধ স্কটিশ মানুষকে দেখে “ডক্টর লিভিংস্টোন, আই প্রিজিউম” বলেছিলেন, সেটা তো স্ট্যানলির নিজের বয়ান। নভেম্বর ১৮৭১ সালে তাঁর লেখা সেই সাতদিনের ডায়েরির পাতা অবধি কখনো পাওয়া যায়নি।
চ্যাপম্যান পয়েন্ট, চ্যাপম্যান বে
কনসেন্ট জাহাজের পাইলটের এই অসামান্য সাহসিকতার কাহিনি কালে কালে চাউর হয়, উপসাগরের নাম হয়ে যায় চ্যাপম্যানস চান্স, পরে চ্যাপম্যান বে। পাহাড় চুড়োর নাম চ্যাপম্যান পিক। তাঁর স্মরণে পাহাড়ের পাকদণ্ডীর ওপরে আছে চ্যাপম্যান পয়েন্ট; এখান থেকে সেই অকুস্থলটি অনুমান করে নেওয়া যায় যেখানে কনসেন্ট জাহাজ আটকে গিয়েছিল। খাবারের সন্ধানে কূলে এসে তিনি নিজে সেখানে দাঁড়িয়ে সেটা দেখেছিলেন কিনা এমন বেমক্কা প্রশ্ন করে আমার ড্রাইভারের কাছে কোন জবাব পাই নি।
হেলিকপ্টার উড়ান
কেপ টাউন থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ যাওয়ার এই রুট অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ কিন্তু নীল আটলান্টিক, একটানা সাদা বিচ, চ্যাপম্যান পয়েন্ট থেকে দেখা উপসাগরের দৃশ্য (বিশেষ করে হেলিকপ্টার হতে দেখা ) মনে থেকে যায়। আরেকটা কথা মনে হয়েছে। সকল ইউরোপিয়ান কলোনিতে কোনো গ্রাম, শহর পরিচিত হয়েছে তাদের রাজা রানি, জেনারেল, গভর্নর, প্রেসিডেন্ট নিদেন পক্ষে সরকারি আমলার নামে যেমন পাহাড় (মাউনট এভারেস্ট) জলপ্রপাত(ভিক্টোরিয়া ফলস)। অন্তত দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ব্রিটিশ জাহাজের দু নম্বর অফিসারের নামে উপসাগর, পাহাড় সরকারি অফিসের খাতায় রেজিস্টার্ড হয়েছে; এক বিরল দৃষ্টান্ত।
চ্যাপম্যান পয়েন্ট ছাড়ালে পাবেন নুরডহয়ক (আফ্রিকানস, উত্তরের কোণ), দীর্ঘ সমুদ্রবেলা, ছুটির দিন বাদে জনশূন্য। সেখানে আছে আরেক সমুদ্রবাহী জাহাজের স্মৃতি চিহ্ন। ১৯০০ সালে ব্রিটিশ স্টিমার কাকাপো সিডনি যাবার পথে থেমেছিল কেপ টাউনে। অন্তরীপ ঘুরে তার যাওয়ার কথা কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ে ক্যাপ্টেন পথ গুলিয়ে ফেলে চ্যাপম্যান পয়েন্টকেই উত্তমাশা অন্তরীপ ভেবে জাহাজ বাঁয়ে ঘোরানোর চেষ্টা করেছিলেন, ফলং বালুকা সমাধি। সোয়াশো বছর কেটে গেছে, এখনওএই দিগন্ত বিস্তৃত শুভ্র সমুদ্রতটে কাকাপো জাহাজের বয়লার রুমের কঙ্কালটি লৌহ সভ্যতার প্রাচীন প্রতীক রূপে মুখ ব্যাদান করে আছে; জাহাজের বাকি খোল-নলচে জাতীয় সম্পত্তি বিধায় যে যার প্রয়োজনমত বাড়ি নিয়ে গেছে। সুন্দরের পাশাপাশি ভয়ঙ্করের অবস্থান।
হাউট বে
একটি সতর্কতা বাণী দেওয়া প্রয়োজন - ক্যাম্পস বে থেকে চ্যাপম্যান পয়েন্ট হয়ে হাউট বে’র পথ গেছে পাহাড়ের গা কেটে কেটে। ওপর থেকে বিভিন্ন সাইজের খুচরো পাথর কখনো সখনো গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের পানে ধাওয়া করে থাকে, সে যাত্রায় কোনও গাড়ির মাথায় সেটি অবতরণ করার সম্ভাবনা প্রবল। আমার সঙ্গী, গাইড ও ড্রাইভার লিও যখন এমনি সুসমাচার শোনাচ্ছিলেন, মনে হল এখানে কোনও অকস্মাৎ প্রস্তরবর্ষণ ও তৎজনিত কোনো অঘটন ঘটলে সিটি ব্যাঙ্কের বিমার একটি পয়সাও স্ত্রী পুত্র পাবে না ( অফিশিয়াল কাজে প্রাণদান করলে তখন বার্ষিক বেতনের পাঁচ গুণ ছিল আমার অনাথ সন্তান সন্ততি তথা স্ত্রীর প্রাপ্য!)। চ্যাপম্যান পয়েন্ট কেন, এ তল্লাটে ব্যাঙ্কের কোনও খদ্দেরের বাস নেই; প্রশ্ন উঠবে, তবে কোন কাজে আমি গিয়েছিলাম সেখানে? বিচে কোন কাস্টমার ইভেন্ট হচ্ছিল? আমার অনাথ সন্ততির আবেদন পত্রপাঠ নাকচ।
মাঝে মাঝে এ রাস্তা বন্ধ রাখা হয় মেরামতির জন্য; তবে যদি যেতে চান, আশ্বস্ত থাকতে পারেন এই মোবাইল টেলিফোনের যুগে আপনার কেপ টাউনের ড্রাইভার বিশদ খোঁজ খবর না নিয়ে বেরুবে না। তারও দারা পুত্র পরিবার আছে, সে নিয়মিত ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম জমা দিয়ে থাকে।
অর্ধ চন্দ্রাকৃতি হাউট বে এই পথের সবচেয়ে বড়ো বিচ-শহর। সেখান থেকে হঠাৎ পথ উঠে আসে সমতলে, সেখানে ভূখণ্ড ক্রমশ সঙ্কীর্ণ, দু দিকেই সমুদ্র উত্তাল; টেবল মাউন্টেন ন্যাশনাল পার্কের শেষ সীমা, সামনে মহা সমুদ্রের দিশা।
পর্তুগালের রাজার কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পরে স্পেনের তরুণ রাজা, রানিকে শর্টকাটে ভারত পৌঁছুনোর গল্প শুনিয়ে তাঁদের তিজোরি থেকে অর্থ হস্তগত করে জেনোয়ার ক্রিস্টফো কলমবো বা ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন সোনার ভারতের সন্ধানে আজকের দক্ষিণ আমেরিকার সান সালভাদরে পৌঁছে জঙ্গলের আগাছা কেটে এগুচ্ছেন, তার অনেক আগেই পর্তুগিজ নাবিক জলপথে সঠিক নিশানায় ভারত দর্শনের পথে অগ্রসর হয়েছেন। কলম্বাসের চার বছর আগে বারতালোমিউ দিয়াস আফ্রিকার কূল ধরে ধরে দক্ষিণ গোলার্ধে প্রবেশ করেছেন, আজকের কেপ টাউনে পর্তুগালের রাজার নামে ক্রস পুঁতেছেন, সে মহাদেশের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন; অঙ্ক কষে এও জেনেছেন যে এবার বদর বদর বলে আফ্রিকার বাকিটুকু প্রদক্ষিণ সারা হলেই ভারতের পথ উন্মুক্ত। দিয়াস এখানে পেয়েছিলেন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি, আর এগোননি, এর নাম দিলেন ঝোড়ো অন্তরীপ ( কাবো তরমেনতোসো)। কিন্তু পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন এ খবরে উল্লসিত হয়ে বললেন, তুমি না হয় একদিন ঝটিকা দেখেছ কিন্তু এই অন্তরীপ দিচ্ছে আমাদের ভারত পৌঁছুনোর আশা, তাই নাম দিলাম কাবো দা বোয়া এসপেরেনসা (কেপ অফ গুড হোপ / উত্তমাশা অন্তরীপ )।
সেই নামটা টিঁকে গেল।*
উত্তমাশা অন্তরীপ
কোনও এক অন্তহীন সূর্যালোকিত দিনে ফিনল্যান্ডের রোভানিয়েমিতে আর্কটিক সার্কেল পেরিয়ে, আরেকদিন রাশিয়ার উত্তর প্রান্তে শেষ মনুষ্য বসতি কোলা উপসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল এই কি পৃথিবীর সীমান্ত? দি এজ অফ দি ইউনিভার্স? এর পরেই তো উত্তর মেরু, ট্রু নর্থ।
প্রথম বার আফ্রিকা মহাদেশের অন্তিম স্থল বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আদিগন্তব্যাপী জলরেখা দেখে মনে হলো এই পৃথিবীর পায়ের তলার মাটি কী এখানেই শেষ – এবার জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত মোর হবে বিকল?
অন্তরীপ হতে ফেরা
বরানগরে স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে একটা কথা চালু ছিল- ফলস দেওয়া। কেন ফলস দিচ্ছিস? মানে কেউ বাজে কথা বলছে। কিংবা খেলার মাঠে, মোটেই কারো সঙ্গে ধাক্কা লাগেনি তবু একজন প্লেয়ার বাবা গো, মা গো বলে নাটকীয় ভাবে ভূমি শয্যা নিল, মানে ফলস দিল। আরেক ভ্যারিয়েশন, ফলস দিচ্ছিস না তো? শাড়ির ফলস অবশ্যই অন্য ব্যাপার। আজকের কিশোর যুবকেরা হয়তো এই ফলস দেওয়ার কম্মটি সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে করে থাকেন, তার নাম ফেক নিউজ। বিদ্যাপীঠের নাম হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি।
কথাটা আবার মনে পড়ল কেপ পয়েন্ট থেকে ফেরার সময়ে।
কেপ পয়েন্ট
অন্তরীপ থেকে কেপ টাউন ফেরার উত্তরমুখী দ্বিতীয় পথটি খানিক গিয়েই নেমে যায় উপকূলবর্তী সমতলে, মোটেও দুর্গম নয়, সে পথ অতীব মনোরম। আটলান্টিকের দিকের রাস্তার মতো চড়াই উতরাই নেই, মাথার ওপরে পাথর গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
অন্তরীপ মানে এক ফালি ভূখণ্ড যা বল্লমের ফলার মতো জলরাশির মধ্যে প্রবেশ করে – অতএব দু দিকে জল। আসার সময়ে দেখেছি আটলান্টিক, সেটা ছিল ডাইনে, তাহলে আবারও আমার ডাইনে এই যে সমুদ্র বা উপসাগর যাই হোক না কেন, এটি নির্ঘাত ভারত মহাসাগর, কোন দেশের নামে পরিচিত একমাত্র মহাসাগর? উত্তর পেলাম, “না, এর নাম ফলস বে। ভারত মহাসাগর এখান থেকে আরও দেড়শো কিলোমিটার দক্ষিণে”
আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরের মিলন ঘটে, দুই রঙের জল, একটি শীতল অন্যটি খানিক উষ্ণ। বর্ণনা সম্পূর্ণ অসত্য নয়, তবে সেটা দেখতে গেলে যেতে হয় আরও অনেকটা উজানে।
জন চ্যাপম্যান নামক এক জাহাজি অফিসারের সাহসী কাণ্ডকারখানার জন্যে তাঁর নামাঙ্কিত চ্যাপম্যান বে দেখে এসেছি সকালবেলা। এই বিকেলবেলার উপসাগর কি ফলস নামের কোন ব্যক্তির স্মরণে? ইনি কে? আমার সঙ্গী লিও হেসে বললে, এই প্রশ্নটা অনেকেই করেন, জানতে চান ফলস লোকটি কে? কোনো মানুষের স্মৃতিতে নয়, এর নাম হয়েছে নাবিকদের একটি ভুলের কারণে। আমার মতে সঠিক নাম হওয়া উচিত ছিল, রং বে, ভুল উপসাগর’।
ফলস বে
এই ভুল উপসাগরের নামের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে আমাদের দেশ। ভারত সন্ধানী পর্তুগিজ নাবিকরা জানতেন লিসবন থেকে সে দেশের উপকূল পৌঁছুতে গেলে একটি প্রকাণ্ড মহাদেশের পরিক্রমা করতে হয়। গুগল, ইন্টারনেট নেই তখন। তাঁদের রেফারেন্স পয়েন্ট ছিল দুটি – আকাশের ধ্রুবতারা, নর্থ স্টার (কঙ্গো নদীর মোহনা পেরিয়ে দক্ষিণ গোলার্ধে প্রবেশ করলে সাদার্ন ক্রস) এবং আফ্রিকার কোস্ট লাইন, তটরেখা। ভারত যাওয়ার সময়ে সেটি পড়বে বাঁয়ে, ফেরার সময়ে ডাইনে। সেদিকে চোখ রেখে শুধু বেয়ে যাওয়া। এখানে ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনা শূন্য, আফ্রিকার উপকূল চলে একটানা, প্রায় অভগ্ন ( মহাদেশের সুদীর্ঘ তটরেখার তুলনায় প্রাকৃতিক বন্দর- ন্যাচারাল হারবার – খুবই কম), একেবারে কেপ অফ গুড হোপ পৌঁছে টার্ন নেওয়া, আবার সেই মহাদেশের উপকূল ধরে পর্তুগাল ফেরা।
এইখানে প্রকৃতি একটি ফাঁদ পেতে রেখেছেন। আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে আরেকটি অন্তরীপ আছে তার নাম হাং ক্লিপ। নাবিক জানে ফেরার সময়ে মহাদেশের শেষ বিন্দুতে এসে জাহাজ যাবে উত্তর মুখে,সাদার্ন ক্রসকে চোখে রেখে, আফ্রিকার উপকূল যথারীতি রইবে ডান দিকে। তিনশো বছর আগে কিছু নাবিক ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের সময়ে এই হাংক্লিপ অন্তরীপকে কেপ অফ গুড হোপ ভেবে জাহাজের মুখ ঘুরিয়েছেন উত্তর দিকে, ফলে অনেকটা ঘুরে এসে আবার বুঝেছেন, উত্তর নয় এখন তাদের জাহাজের মুখ ঘোরাতে হবে দক্ষিণে, তবে পৌঁছুবেন আসল কেপ অফ গুড হোপে। এই ভ্রান্তির কারণে উপসাগরের নাম ফলস বে যার নাম হওয়া উচিত ছিল দি রং বে! হেলিকপটার থেকে দেখলে মনে হবে ফলস বে যেন একটি প্রকাণ্ড প্রাকৃতিক বাথটাব, প্রায় একটি বর্গক্ষেত্র, তিরিশ বাই তিরিশ কিলোমিটার!
ফেরত যাত্রায় মুইজেনবার্গে থামা একেবারে আবশ্যিক। কেপ টাউনের অনতিদূরে একটি আশ্চর্য সুন্দর বিচ শহর, ট্রেন আসে এই অবধি। বাড়ি ঘরের চেহারা সম্পূর্ণ ইউরোপিয়ান। আমস্টারডামে প্যারিস ব্রাসেলসের স্টাইলে কফি হাউসে দেখেছি আফ্রিকান, ভারতীয় জনতা, যাদের এই মাত্র তিরিশ বছর আগেও এই সুরম্য বৈঠকে প্রবেশ অধিকার ছিল না।
দক্ষিণ আফ্রিকার আপারথাইড জমানা চোখে দেখিনি, ইন্টারনেট ছিল না। খবরের কাগজে কখনো কিছু পড়েছি যেমন শার্পভিল হত্যাকাণ্ড, স্টিভ বিকো। ইঞ্চি বা কলামের মাপে তার স্থান ছিল সীমিত; কলকাতা থেকে সেই অনেক দূরে কোথায় কি হচ্ছে কে জানে।
এক সময়ে ওয়েলসের ছেলে ক্রিস সাটক্লিফ আমার দপ্তরে কাজ করত। তার বাবা নিজের দেশে স্টিল মিলের কাজ হারিয়ে আটের দশকের গোড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকায় আসেন সপরিবারে। ক্রিসের কাছে শুনেছি সেইসব দিনের গল্প – সব কিছুই যেন একেবারে নর্মাল, এই যে কালোরা সাদাদের বাসে উঠবে না, বিচে আলাদা জায়গায় জলে নামবে, ট্রেনের কামরা আলাদা, টয়লেট আলাদা; এই রকমই তো কথা, এখানে দুনিয়া এই ভাবেই চলে; অবাক হবার কি কারণ? আল ইজ ওয়েল!
এমনি করেই তখন দিনটিন কেটে গেছে, সাদা মানুষ রেখেছে কালো মানুষদের অনেক দূরে। শুধু আটলান্টিকের খানিক কৃষ্ণবর্ণ শীতল জল মিশে গেছে ভারত মহাসাগরের হালকা রঙের উষ্ণ ধারার সঙ্গে।
পুনশ্চ:
*প্রসঙ্গত, দক্ষিণ আফ্রিকাতে পর্তুগিজরা রাজত্ব করেননি, জাহাজ নিয়ে চা জলখাবার ও রসদ সংগ্রহের জন্যে হাজির হয়েছেন, যাত্রা বিরতি করেছেন মাত্তর। তবু তাদের দেওয়া আরেকটা নাম টিঁকে গেছে। প্রথমবার ভারতের পথে ১৪৯৭ সালের বড়দিনে প্রভুর জন্ম দিবসে, ভাস্কো দা গামা সমুদ্র হতে আফ্রিকার যে স্থলভূমি অবলোকন করেছিলেন তার নাম দিলেন টেরা নাতালিস (পর্তুগিজ, ক্রিসমাস ভূমি), বন্দরের নাম পোর্ট নাটাল (ক্রিসমাস)। বর্তমানে সে বন্দরের নাম ডারবান, ভাস্কো ডা গামা গিয়েছিলেন ভারতে; তার সাড়ে তিনশো বছর বাদে, ১৮৬০ সালে, উলটো পথে, সেই ভারত থেকে এক জাহাজ ভর্তি, প্রায় তিনশো জন চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় মজদুর প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকায় পা রাখেন। দশ লক্ষের বেশি ভারতীয় মূলের অধিবাসী নিয়ে ডারবান আজ ভারতের বাইরে বৃহত্তম ‘ভারতীয় শহর’। সেই প্রদেশের নাম কোয়াজুলু নাটাল।
এ যাবত জুলুরা সে নাম পরিবর্তনের দাবি তোলেন নি।