পরের সাড়ে তিনশো বছর ৬ এপ্রিল দিনটি সগৌরবে উদযাপিত হবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে।
দেড়শো বছর বাদে উস্তাদোঁ কে উস্তাদ ইংরেজ বোম্বেটে এসে হাজির হয়ে হল্যান্ডের নন-রেসিডেন্ট জনতার স্বর্গসুখ চুরমার করবে, কিন্তু তারাও মহা উৎসাহে ডাচদের চালু করা ‘কালা আদমি তফাৎ রহো’ আইন বলবত রাখবে (আপারথাইডের কপিরাইট ও সদ্ব্যবহার ডাচ একা দাবি করতে পারে না)। ততদিনে ডাচ জনতা রিফর্ম গিরজেয় নতজানু হয়ে শপথ নিয়েছে হল্যান্ডে তারা আর ফিরবে না, এই আফ্রিকা তাদের দেশ এবং উটরেখট, লাইডেন, রটারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, তাদের মুখের বুলি হবে জাতির ভাষা। আফ্রিকানার জাতি ও আফ্রিকানস ভাষার জন্ম হল কেপ টাউনে।
একদিকে ইংরেজের উৎপাত অন্যদিকে অচেনা মহাদেশ। ইংরেজ আপদকে পেছনে ফেলে এবং পুব দিকে চোখ রেখে আফ্রিকানরা বেরুল রোটি কাপড়া মকান ও জমি-জিরেতের খোঁজে – এক সুদীর্ঘ পদযাত্রা (গ্রেট ট্রেক/ ঘ্রটে ট্রেক – প্রিটোরিয়া শহরে ঢোকার মুখে বাঁ দিকে পাবেন ফোরট্রেকার মনুমেন্ট, আমার ছেলে ইন্দ্রনীলের পক্ষে আফ্রিকানারদের সেই শৌর্য-গাথার মুরাল দেখাটা অসহনীয় হয়েছিল)। ট্রান্সভালে (ভাল নদী পেরিয়ে) পৌঁছে আবার তারা উচ্ছেদ করবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে, রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে জুলুদের দেশে – ব্লাড রিভার নামে যা আজও খ্যাত। মানুষের মাঝে বিভাজনের যে বীজ রোপিত হয়েছিল কেপ টাউনে, পরের তিনশো বছরে তার চারাগাছ পোঁতা হয়ে গেল দেড় হাজার কিলোমিটার পূর্বে, ডারবান অবধি।
১৯৪৮ সালে ন্যাশনাল পার্টি ক্ষমতায় এলে নতুন সংবিধান মোতাবেক আপারথাইড রুল প্রতিষ্ঠিত হল। উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ, সাদা কালো, ধর্ম বেধর্ম নিয়ে দুনিয়াতে সমাজের ভাগাভাগি হয়েছে চিরকাল এবং হবে। আজকের ভারতবর্ষ অথবা ইজরায়েল তার কোনো ব্যতিক্রম নয়; উত্তরভারতে দলিত ঘোড়ায় চড়লে, হেব্রনে কোনো আরব ইহুদি এলাকার দিকে জানলা খুললে তার শাস্তি হয়। তবে সংবিধানে এর সমর্থন নেই। আপারথাইড আইনের তুলনা হয়তো আমেরিকান সংবিধান, যা শুরু হয় ‘অল মেন আর বর্ণ ইক্যুয়াল’ বলে, কিন্তু মানুষকে শিকলে বাঁধার বা লিঞ্চিং-এর বিরুদ্ধে কোনো আইন ছিল না। সেই সংবিধানপ্রণেতার নিজস্ব দাসের সংখ্যা ২৮৪। তিনি বা মহান জর্জ ওয়াশিংটন এখানে কোনো আপাতবিরোধ দেখেন নি। তাঁর গেটিসবার্গ ভাষণে, মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা, মানুষের যে সরকার আব্রাহাম লিঙ্কন চাইলেন সে সরকারের নির্বাচনে কালো মানুষদের অংশ নেবার অধিকার ছিল না।
দক্ষিণ আফ্রিকার ‘সাদা’দের দ্বারা নির্বাচিত পার্লামেন্ট বসে কেপ টাউনে, সেখানে নিত্য প্রণীত হয় কঠোরতর অশ্বেতকায় দমনবিধি। ইউরোপ আমেরিকার গণতান্ত্রিক চেতনা তখন ঘুমন্ত। বাকি দুনিয়া যখন কোনো সম্পর্কই রাখতে চায় না দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে তখন ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট, রাগবি দল সানন্দে নিয়মিত নামে লর্ডস, টুইকেনহ্যাম, সিডনি, মেলবোর্ন, অকল্যান্ড, কেপ টাউনের নিউল্যান্ডসে, জোহানেসবার্গের এলিস স্টেডিয়াম, ওয়ান্ডার্সের ক্রীড়াঙ্গনে। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় টিম সে দেশের মাত্র পনেরো শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা আপন দেশে অবধি কোনো অশ্বেতকায় দলের বিরুদ্ধে খেলে না, তবু অলিম্পিকে তারা স্বাগত, কমনওয়েলথ গেমসেও। আপারথাইড রেজিমকে গুঁড়িয়ে দেবার প্রচেষ্টা অন্তত খেলার মাঠ থেকে শুরু হোক বলে অশ্বেতকায় দেশগুলিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কট করার আওয়াজ উঠলে ইংল্যান্ড আমেরিকার বিজ্ঞ রাজনীতিকরা বললেন, সেটা হবে হঠকারিতা। স্পোর্ট অ্যান্ড পলিটিক্স শুড নট বি মিক্সড।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে স্পোর্ট আর পলিটিক্স একদিন মিশে গেল। অনেক দূরে, কলকাতা শহরে বসে খবরে, বি বি সির স্পোর্টস রাউন্ডআপে ক্রমশ সেই নাটক যেন আমাদের চোখের সামনে অনুষ্ঠিত হতে দেখলাম। জানতাম না এই নাটকের পরিসমাপ্তি হবে কলকাতায়।
বিধির এমনই বিধান কেপ টাউনেরই একজন মানুষ হয়তো তাঁর নিজের অজ্ঞাতে হানবেন আপারথাইডের কঠিন দুর্গের দেওয়ালে প্রথম আঘাত। ১৯৩১ সালে কেপ টাউনের সিগনাল হিলে জন্মালেন ব্যাসিল লুইস ডলিভেইরা (একদিন যেখানে দাঁড়িয়েছি ব্যাঙ্কের কোনো সান্ধ্য উৎসবে)। তাঁর মাতৃকুল ভারতীয়; একশো বছর আগে আখের খেতে কাজ করার চুক্তিবদ্ধ দরিদ্র ভারতীয় শ্রমিকদের উত্তরসূরি। পিতা পর্তুগিজ। সাদা বাদে বাকি মনুষ্যজাতিকে আফ্রিকানার সরকার চার ভাগে ভাগ করেন : কালো, চিনে, মালয়ী, ভারতীয় এবং কেপ টাউনে যোগ হয় একটি বিচিত্র ক্যাটেগরি, ‘কেপ কালারড’। আফ্রিকানাররা তাদের রক্তের শুদ্ধতা রক্ষা করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু কেপ এলাকায় ডাচ, ইংরেজ ছাড়া অন্য ইউরোপীয়রা (কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখেছি গ্রিক, পর্তুগিজ,ফরাসি বংশোদ্ভূত) নয়। তাদের সন্তানসন্ততি ঠিক কালো নয়, সাদাও নয়, সে জন আছে মাঝখানে! তাদের জন্য লেখা হল আরেকটা খাতা – মিশ্রিত জাতি (কেপ কালারড / কাপসে ক্লয়রলিঙ্গে)। কার্যত এঁরা অর্ধেক সাদা হওয়ার কোনো সুবিধে পেলেন না, অর্ধেক কালো হবার সকল অসুবিধের ভাগিদার হলেন। ডলিভেইরাকে দেখতে প্রায় ইউরোপিয়ান, পিতৃ পদবি খাস পর্তুগিজ, কিন্তু মায়ের দিকটা গোলমেলে, তাঁরা ভারতীয়। পড়াশোনা ও খেলাধুলা করলেন কালো, চিনা, ভারতীয় অথবা অন্য মিশ্রিত জাতির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে। ছোটবেলা থেকে প্রথমে ফুটবল পরে ক্রিকেটে অসাধারণ দক্ষতা দেখালেন; আপারথাইড আইনের দরুন কোনো প্রদেশ বা জাতীয় ক্রিকেট দলে তাঁর স্থান হল না। উনত্রিশ বছর বয়েসে গেলেন ইংল্যান্ডে, ল্যাঙ্কাশায়ার লিগের অখ্যাত টিম মিডলটনে প্রফেশনাল ক্রিকেট খেলে নাম কুড়োলেন, ব্যাটিং করেন ভালো, চেঞ্জ বোলার, দুর্দান্ত স্লিপ-ফিল্ডার। শিগগির উরস্টারশায়ার কাউন্টি দলে খেলার ডাক পেলেন, চার বছরের মধ্যে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব, অচিরে ইংল্যান্ড টেস্ট টিমে অভিষেক। ১৯৬৭ সালে সফররত ভারতীয় টেস্ট টিমের বিরদ্ধে সেঞ্চুরি করে আমাদের মনে দাগা দিলেন (সেই একই ইনিংসে অসম্ভব মন্থর গতিতে ডাবল সেঞ্চুরি করে জেফ্রি বয়কট দল থেকে বাদ পড়েন)। তখন কলেজে পড়ি, ২৫ মিটার ব্যান্ডে শর্ট ওয়েভ রেডিওতে কান লাগিয়ে বি বি সি’র টেস্টম্যাচ স্পেশাল শুনি, বিকেল চারটে থেকে রাত্তির এগারোটা অবধি! সে বছরে ডলিভেইরা উইজডেনের পাঁচ ক্রিকেটারের অন্যতম মনোনীত হলেন (অন্য চার জন ক্লাইভ লয়েড, আসিফ ইকবাল, মাইক প্রোক্টর, টম কার্টরাইট)। পরের বছর পাঁচটি টেস্ট খেলার জন্য ইংল্যান্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর - ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে ডলিভেইরার নাম আসে অবিসংবাদিত ভাবেই। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ইতিমধ্যেই প্রমাদ গুনেছেন, সর্বনাশ সমুৎপন্ন! কেপ কালারড ব্যাসিল ডলিভেইরা খেলবে শ্বেত-শুভ্র দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, কেপ টাউনের পবিত্র নিউল্যান্ডসে! তাঁরা কলকাঠি নাড়লেন; প্রধানমন্ত্রী ফর্স্টার বললেন মিশ্রিত দল দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণ করতে পারে, তাঁর গৃহমন্ত্রী পিট লে রু বললেন, সেটা সম্ভব নয়। কারেরাস নামের এক তামাক কোম্পানি অকস্মাৎ ডলিভেইরাকে দক্ষিণ আফ্রিকায় কালোদের ক্রিকেট ট্রেনিং কোচের পদ অফার করলেন, রীতিমত মোটা মাইনেয়। শর্ত হল তিনি এম সি সি কে জানাবেন আসন্ন সফরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের জন্য টিমে নির্বাচিত হলেও তিনি যাবেন না। ডলিভেইরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মনে আছে ১৯৬৮ সাল, বি এ পরীক্ষা হয়ে গেছে, পদুমা গ্রামের বাড়িতে আছি। শ্রাবণ মাস, চাষের জন্য মা সে সময়টা সেখানে থাকতেন; বর্গা হতে দেরি আছে। বিজলি বাতি আসেনি, সন্ধ্যে নেমে এলে ট্রানজিস্টার রেডিওতে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ টেস্ট ম্যাচের কমেন্ট্রি শুনি বি বি সির টেস্ট ম্যাচ স্পেশালে, ব্রায়ান জনস্টন, জন আর্লটের কণ্ঠে। তাঁরা আমাকে নিয়ে যান লর্ডস, ওভালের মাঠে, যেখানে নিজে হয়তো কোনোদিন পৌঁছুতে পারব না।
পঞ্চম টেস্ট ওভালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে আগের সিরিজে খুব খারাপ খেলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম টেস্টেও ফল ভালো নয় কিন্তু অন্যদের চোট থাকার জন্য আগের তিনটি টেস্টে বাদ পড়া ডলিভেইরা খেললেন ওভালে, সাত নম্বরে নেমে রান করলেন ১৫৮। চতুর্থ দিনের শেষে ইংল্যান্ড বহু রানে এগিয়ে কিন্তু সিরিজ ড্র করার পথে বাদ সাধল পঞ্চম দিনের বৃষ্টি, বোলিং-এর রান আপে জল জমেছে। ম্যাচ শেষ অবধি চলে কিনা সন্দেহ। তখন বল বাই বল ধারা বিবরণীর মজা ছিল, মাঠে কিছু ঘটছে না কিন্তু আর্লট, জনস্টন গল্প করে যাচ্ছেন! সে আমলে মাঠ শুকোনোর এত রকমের যন্ত্রপাতি নেই, অবাক হয়ে শুনলাম জন আরলট বলছেন, ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন কলিন কাউড্রে মাঠের দর্শকদের অনুরোধ করলেন, আপনারা যে যে ভাবে পারেন, মাঠ শুকোনোর কাজে হাত লাগান! জনতা হাতের কাছে যা পেয়েছিল তাই নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে, আশেপাশের বাড়ি থেকে কেউ দেন কম্বল, বিছানার চাদর, কেউ কেউ নিজের জামা, রুমাল, কোট অবধি কাজে লাগান। আহা সে এক সময় ছিল, ক্রিকেট ছিল খেলা, সার্কাস নয়। খেলা শুরু হল। আধ ঘণ্টা বাকি থাকতে ইংল্যান্ড সে ম্যাচ জিতে সিরিজ ড্র করে, আন্ডারউড ৭-৫০ ডলিভেইরা ১-১। খবরের কাগজে টেলিভিশনে ডলিভেইরার জয়জয়কার। কিন্তু তিন দিন বাদে উরস্টারশায়ারের হয়ে সাসেক্সের বিরুদ্ধ ১২৮ রান করে প্যাভিলিয়নে ফিরে ডলিভেইরা রেডিওতে শুনলেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তিনি নির্বাচিত হননি। কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব? আমার মতো ক্রিকেট বাফ বা পাগল মানুষেরা তাতে বিশ্বাস করিনি। বহু বছর বাদে জেনেছি তৎকালীন এম সি সি প্রেসিডেন্ট আর্থার গিলিগান একদা ব্রিটিশ ফ্যাসিস্ট দলের সদস্য ছিলেন, দল নির্বাচন কমিটির অন্যতম সদস্য বিখ্যাত ফাস্ট বোলার আলেক বেডসার ছিলেন অতি দক্ষিণপন্থী, ট্রেড ইউনিয়ন বিরোধী। নির্বাচন কমিটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার হামদরদি মানুষ ছিলেন কেউ কেউ।
বি বি সি সে আমলে নিরপেক্ষ ছিল, স্পোর্ট রাউন্ডআপে (আমাদের সময়ে বিকেল ৪.৪৫ মিনিটে, শর্ট ওয়েভ রেডিওতে) নিয়মিত শোরগোল শুনি। প্রেস ক্ষিপ্ত- কি কারণে ডলিভেইরা বাদ? জবাব দাও! এম সি সি ডলিভেইরাকে প্রস্তাব দেয় তিনি যদি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হয়ে বি বি সির জন্যে এই সিরিজ কভার করেন! সেটাও দক্ষিণ আফ্রিকার মঞ্জুর নয়, খাদ্য পানীয় পরিবেশক বাদে সে দেশের প্রেস বক্সে অশ্বেতকায়দের প্রবেশ নিষেধ।
এম সি সি মোটামুটি জানালেন, তোরা যে যা বলিস ভাই, এই আমার টিম! ক্যাপ্টেন কাউড্রে, গ্রেভনি, ব্যারিংটন, বয়কট, এডরিচ, নট, ফ্লেচার, স্নো, আন্ডারউড, মারে, কটাম, পোকক, প্রিদো এবং অন্যতম উইজডেন ক্রিকেটার অফ দি ইয়ার, ফাস্ট বোলার টম কার্টরাইট। টিম ঘোষণার পরে বাজার উত্তপ্ত, এমন সময়ে একটি আশ্চর্য ঘটনা - টম কার্টরাইট কাঁধের চোট লেগেছে বলে টিম থেকে নাম তুলে নিলেন। এম সি সির ডান হাত বাঁ হাত থাকলেও আর কোন অজুহাত রইল না- কেপ কালারড ক্রিকেটার ব্যাসিল লুইস ডলিভেইরা দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নির্বাচিত হলেন।
খড়ের আগুন এতদিন ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল, কেপ টাউনের পার্লামেন্টে একের পর এক বক্তা সেটিকে প্রজ্বলিত করলেন – এ আর খেলা নয়, এম সি সি নয়, ডলিভেইরাকে টিমে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার আপারথাইড পলিসির বিরোধিতা করেছেন, সে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। তৎক্ষণাৎ ইংল্যান্ড সফর বাতিল হল। ক্রমশ বোঝা গেল এই নির্বাসন ক্রিকেট এবং ডলিভেইরাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। পরের পর আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থাগুলি দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্পোর্টিং নির্বাসনে পাঠালেন, অলিম্পিক থেকে দাবা খেলা অবধি। সর্বত্র সে দেশ ব্রাত্য।
নয়ের দশকে কেপ টাউনের আরেকজনের সঙ্গে আলাপ হয়। জেরার্ড এরেনস্টাইন কাজ করত আই এন জি ব্যাঙ্কে, আমস্টারডামে, ভালো সাঁতারু হিসেবে খ্যাত ছিল। সে একদিন গল্প করছে, ‘আমি কেপ টাউনে ইন্টারন্যাশনাল সুইমিং মিটে সাঁতার কেটেছি।’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সে সময় কোন দেশ টিম পাঠাতো দক্ষিণ আফ্রিকায়?’ জেরার্ড বললে, ইজরায়েল আর তাইওয়ান! শুনলে পেত্যয় হবে না, এই তথ্যটি আমার কাজে লেগেছিল! নতুন দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম লোন সিন্ডিকেশন করার সময়ে এই দুটি দেশের ব্যাঙ্কের কাছ হাত পাতি!
পরের দশ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপরে অর্থনৈতিক স্যাংশন বসানো সমীচীন কিনা এ নিয়ে ইউরোপ আমেরিকার রাজনীতিকরা সুদীর্ঘকাল বিচার বিবেচনা করছেন। আমি সে সময়ে বিলেতবাসী, প্রায় ফি শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকার ওপরে স্যাংশন ও ‘ফ্রি ম্যানডেলা’ দাবি করে মিছিল বেরোয়; মিসেস থ্যাচার বলছেন স্যাংশন কোনো কাজের কথা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকান সরকারের সঙ্গে বসে আলোচনা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত স্যাংশন প্রযোজ্য হল। তার ফলও নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু আমার আফ্রিকানার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিশে ও একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে স্পোর্টের প্রতি আফ্রিকানারের অনুরাগ, ভালবাসা এবং পাগলামির কোনো তুলনা হয় না। হয়তো স্যাংশনের চেয়েও স্পোর্টিং বয়কট দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা মানুষদের বেশি আঘাত করে, প্রেস ক্রমশ প্রবলভাবে সরকার বিমুখী হয়ে ওঠে।
বিশ বছর আগে সিটি ব্যাঙ্কের রবিন স্মেডি তার দুই ছেলেকে কোন বোর্ডিং স্কুলে পাঠাবে তাই নিয়ে আলোচনা করছিল রুয়ান্ডায় বসে। অ্যাকাডেমিক রেকর্ড এহ বাহ্য, তার প্রধান চিন্তার বিষয় - কোন স্কুলের রাগবির কতটা খ্যাতি। ইংল্যান্ডে আসা ইস্তক ক্রিকেট নিয়ে আমার সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে ভারতীয় বা পাকিস্তানি নয়, সিটি ব্যাঙ্কের সূত্রে চেনাজানা আফ্রিকানারদের সঙ্গে। তাদের ক্রিকেট ইতিহাস-জ্ঞান, ঠাট্টা-ইয়ার্কি, অ্যানেকডোট ও তার পরিবেশন অতুলনীয়! তখন প্রথম শুনেছি টেস্ট ম্যাচের আফ্রিকানস ভাষায় ধারা বিবরণীর টেপ (কেমন করে বলি ইংরেজি নয়, আমার মাতৃ ভাষায় ব্যাটে বলে ক্রিকেট চিনেছি কমল ভট্টাচার্য, অজয় বসুর কাছে, চল্লিশ বছর আগে)। ব্যাঙ্কের সামনে, টেমসের ধারে হর্নিমান পাবের বাইরে বিয়ারের গ্লাস হাতে অথবা টেমসের অপর পারে, দক্ষিণ আফ্রিকান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্কের ছাদের ওপরে দক্ষিণ আফ্রিকান ব্রাই (গ্রিল) ফেসটে কেটেছে অনেক বিকেল। এক সময়ে রে ফরসাইথকে বলেছিলাম, হয়তো একদিন আমার শহর কলকাতায় ক্রিকেট খেলবে তোমার দেশের টিম। তখন আমারা কেউ জানতাম না ঠিক সেই ঘটনাটি ঘটবে।
কেপ টাউনের কালারড মানুষ ব্যাসিল লুইস ডলিভেইরা আরেক দেশে গিয়ে নানান বর্ণের মানুষদের সঙ্গে ক্রিকেট খেললেন, যা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় নিষিদ্ধ। যে বছর তিনি অর্জন করলেন তাঁর স্বাধীনতা, পেলেন ব্রিটেনের পূর্ণ নাগরিকত্ব সেই বছরে নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর স্বাধীনতা হারিয়ে কেপ টাউনের অনতিদূরে কুখ্যাত রবেন আইল্যান্ডের কারাগারে বন্দি হলেন; আপারথাইড রেজিমের বলি।
শার্পভিল হত্যা, স্টিভ বিকো, অনেক বেদনাময় পরিচ্ছেদ পেরিয়ে একদিন সেই আপারথাইডের অবসান হল, তার প্রথম নিনাদ এই কেপ টাউনে।
১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি রবিবার, এক রৌদ্রজ্বল গ্রীষ্মের দিনে, রবেন আইল্যান্ডের খাতায় ১৯৬৪ সালের ৪৬৬ নম্বর কয়েদি মুক্তি পেয়ে দাঁড়ালেন কেপ টাউন পৌরসভার সামনে (বন্দি নম্বর ৪৬৬/৬৪)। সমবেত জনতাকে নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, “যা ঘটে গেছে তা ঘটে গেছে” (আফ্রিকানসে “ওয়াট ইজ ভেরবাই ইজ ভেরবাই”)। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ নয়, আমরা গড়ব নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা, রামধনু রঙের এক দেশ (রেনবো নেশন – পৃথিবীর একমাত্র জাতীয় সঙ্গীত, এনকোসি সিকেলেলাই আফ্রিকা-গড ব্লেস আফ্রিকা - যেটি গাওয়া হয় চারটি ভাষায়, জুলু, সেসোথো, আফ্রিকানস ও ইংরেজিতে)।
তার ঠিক একুশ মাস বাদে আপারথাইড ও ক্রীড়া জগত হতে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসন ভঙ্গ হল একটি খেলার মাঠে।
মিশ্রিত বর্ণের ক্রিকেটার ভরা টিম নিয়ে এক অশ্বেতকায় মানুষের দেশে দক্ষিণ আফ্রিকা তেইশ বছরের বনবাস শেষে প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার মাঠে নামল - আমার কলকাতায়, ইডেন গার্ডেনসে।
সেদিন ১০ নভেম্বর, ১৯৯১
উন্মুক্ত হল আরেক দিগন্ত।
তীব্র বর্ণবৈষম্যের কারণে সাদা মানুষের পরম প্রিয় রাগবিকে ঘৃণা করেছেন সকল অশ্বেতকায় আফ্রিকান। ১৯৯৫ সালে জোহানেসবার্গ এলিস পার্ক স্টেডিয়ামে রাগবি বিশ্বকাপ ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা রাগবি দলকে সম্মান জানাতে যখন অধিনায়ক পিনারের সাত নম্বর জার্সি গায়ে মাঠের ভেতরে দৌড়ে গেলেন, এক লহমায় তিনি খেলার মাঠের সকল ভেদ দূর করে দিলেন। বড়ো মেয়ে ঐন্দ্রিলার সঙ্গে টেলিভিশনে দেখা সেই বৈদ্যুতিক ক্ষণটি মনে রাখব আজীবন, সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেওয়া এক প্রতীকী মুহূর্ত। যে খেলা আফ্রিকানরা বয়কট করে এসেছে শতাব্দী যাবত, নেলসন ম্যান্ডেলা তাকে পৌঁছে দিলেন সমস্ত দেশের কাছে। মাত্র বিশ বছরের মধ্যে সেই রাগবিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপ বিজয়ে নেতৃত্ব দিলেন পোর্ট এলিজাবেথের কালো মানুষ সিয়া কোলিসি; জোহানেসবার্গের সেই কাপ জয়ের দিনে কোলিসি ছিলেন চার বছরের শিশু, তাঁকে রাগবি খেলানোর কথা ছিল পিতামাতার দুঃস্বপ্নের বাইরে। ২০১৯ সালে ডারবানে সেই বিশ্ববিজয়ী দলের সম্বর্ধনা দেখেছি – রাগবি ওয়ার্ল্ড কাপ হাতে বাসের মাথায় কোলিসি!
পাসপোর্টে নিষেধ নেই, দক্ষিণ আফ্রিকার দুয়োরে কুলুপ নেই। আমার মতো মানুষের সে দেশে যাওয়া সম্ভব হল; একদিন কেপ টাউন ওয়াটারফ্রন্টে দাঁড়িয়েছি, ভেবেছি ইয়ান ফান রিবেক এইখানে আটলান্টিককে পেছনে রেখে সামনে খাড়া পাহাড়ের কি ঠিক এই ছবি দেখেছিলেন?
যেদিন নব দিগন্তে ইউরোপীয় সূর্যোদয়, পরের সাড়ে তিনশো বছরের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার কালসন্ধ্যার সূচনা।
সেখানেই আরেক যুগের সূর্যোদয় দেখে গেলাম।