কেপ টাউন ৩
পাহাড় সেথা বসে আছে মহামুনি
কোচিনের পথে উত্তমাশা অন্তরীপের সন্ধানে অতি দূর সমুদ্র হতে দাঁড় বেয়ে চলেছিল তিনটি পর্তুগিজ জাহাজ। ঝড় ঝঞ্ঝায় তারা কখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, কেউ কারো মাস্তুল দেখতে পায় না আর। পথ হারিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে জাহাজ চালিয়ে এক সময় কাস্তিলের আন্তনিও দা সালদানিয়া সমুদ্র থেকে দেখলেন এক আশ্চর্য দৃশ্য – সামনে একটি স্থির জলের বন্দর, তার পেছনে পাহাড়, সেখানে সেই আধেক আকাশের ওপরে চাদর বিছিয়ে বসে আছেন কোনো মহামুনি। সকাল সন্ধ্যায় সেই চাদরের রঙ বদলিয়ে যায়, কখনো শ্বেত শুভ্র মেঘের আড়ালে হারায় সে পাহাড়, কখনো প্রখর সূর্যের আলোয় ঝলমল করে। তাঁর হারিয়ে যাওয়া দুই সাথী রুই লোরেনসো ও দিওগো পেরেরার জাহাজ গুলির খোঁজে আন্তনিও সালদানিয়া চড়লেন সেই রহস্যময় পর্বত শীর্ষে। এমন কোন পর্বত তিনি কখনো দেখেন নি যার শিখরদেশ সম্পূর্ণ সমতল, অজস্র অপরিচিত ফুল, উদ্ভিদের সম্ভারে ভরা বিস্তৃত দিগন্ত। জনশূন্য। তাঁর চর্ম চক্ষে তিনি অন্য দুটি পর্তুগিজ জাহাজের মাস্তুলের নিশানা অবধি পেলেন না, তবে নেমে এসে পাহাড়টির নাম দিলেন তাবুয়া দে কাবো, অন্তরীপের টেবিল (প্রথম পর্তুগিজ অভিযাত্রী বারতলোমিউ দিয়াস কোন অজ্ঞাত কারণে এই পর্বতের বিষয়ে কিছু লিখে যান নি)। দেড়শ বছর বাদে ডাচ অভিযাত্রীরা সে নাম খারিজ করে দিলেন নতুন নাম, টাফেলবার্গ (টেবল মাউন্টেন)। হাজার বছর যারা সেথায় বসবাস করেছে সেই খোয়খোয় বা খোয়সান জাতি এই পাহাড়কে জানত হোয়েরিকওয়াগো বা সমুদ্রের পর্বত নামে। কিন্তু ইতিহাসে যেমনটা হয়ে থাকে, ইউরোপিয়ানদের দেওয়া ওই টেবল মাউন্টেন নামটাই টিকে গেলো। তা হবে না কেন? তাঁরাই তো সব কিছু ‘আবিষ্কার’ করেছেন, এই যেমন কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার।
টেবিল মাউন্টেনে লেখক, পিছনে সিংহ মস্তক, দূরে রবেন আইল্যান্ড
প্রথম বার টেবল মাউন্টেনের মাথায় উঠে মনে পড়েছিল অনেকদিন আগে দেখা তপন সিংহের ‘কালামাটি’ ছবির একটি দৃশ্য: অরুন্ধতী দেবী একটি কয়লাখনির জলের ট্যাঙ্কের মাথায় চড়েছেন – নিচ থেকে অনিল চট্টোপাধ্যায় বললেন, ওই অতটা উঁচু থেকে কি দেখছো? অরুন্ধতী বললেন, ‘বিশ্বরূপ দেখছি।’
কোনো পাহাড়ের চুড়োয় উঠলে আমরা পাই ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ; টেবল মাউন্টেন একদিকে উঠে গেছে খাড়া, অন্যদিকে সমতল। তাই এখানে দেখি ১৮০ ডিগ্রি, এক অনন্য ১৮০ ডিগ্রি ভিউ। পাথরের দেওয়ালের সিধে শার্প ড্রপ - দূরে আটলান্টিক, বন্দরে জাহাজের, নৌকোর সমাবেশ, চারিদিকে শান্ত বাতি। কোথাও চোখ আটকে যায় না, যেন একটি বহুতল বাড়ির পেন্ট হাউস থেকে সামনে ছড়ানো দুনিয়া দেখছি।
আর বাতাস! কোথা হতে ছুটে আসে বাতাস, নিরন্তর। পালামৌ পাহাড়ে উঠে সঞ্জীবচন্দ্র যেমন দেখেছিলেন, “ এই পাহাড়ের ক্রোড় অতি নির্জন, কোথাও ছোট জঙ্গল নাই,তাহাও বাতাস আসিয়া নিত্য ঝাড়িয়া দেয়”।
কেপ টাউন শহরে হয়তো ঠা ঠা করছে রোদ্দুর, ড্রাইভার বা গাইড বারবার বলে চলেছেন, “গরম জামা, জ্যাকেট নেবেন।” তাঁদের কথা মানা খুব জরুরি। শহরের আলোক এবং উত্তাপ দেখিয়া ভ্রমিত হইবেন না! যে কোন সময়ে যে কোন দিনে টেবল মাউন্টেনের ওপরের তাপমাত্রা কেপ টাউনের অন্তত পাঁচ ডিগ্রি নিচে যেতে পারে – তার সঙ্গে জুড়ে নিন উইন্ড চিল ফ্যাক্টর। অতএব সাধু সাবধান!
নৌকা থেকে লায়ন্স হেড ও টেবিল মাউন্টেন
ভিক্টোরিয়া আলবার্ট ওয়াটারফ্রন্ট থেকে হাজার মিটার উঁচু টেবল মাউন্টেনে পৌঁছুনোর তিনটে পথ আছে – শর্ট কাট যাত্রা, বাসে বা ট্যাক্সিতে টাফেলবার্গ রোডে লোয়ার কেবলওয়ে স্টেশন, সেখান থেকে শূন্যে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরন্ত কেবিনে ঝুলে দশ মিনিটে। দেওঘরের নন্দন পাহাড় ছাড়া আর কোন পাহাড় পর্বত হেঁটে উঠিনি; সারা দুনিয়ার যন্ত্র কলাকুশলীদের উপরে অগাধ আস্থা রেখে উঠে পড়েছি কোন ফানিকুলার রেল বা কেবল কারে সে সুইজারল্যান্ড হোক আর জার্মানি হোক। এইটেই আমার একমাত্র পছন্দের পথ। সাহসী ও শক্তিমান অভিযাত্রী পাহাড়ের পথ বেয়ে হেঁটে কিংবা খাড়া পাহাড়ের গা দিয়ে হাইকিং করে, দুই থেকে তিন ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছুতে পারেন। কেবল কারের সুরম্য নিরাপদ কেদারায় বসে রুদ্ধশ্বাসে দেখেছি দড়িতে নিলম্বিত মানুষকে পাথরের দেওয়ালের গায়ে গাঁইতি মেরে ওপরে উঠতে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে অ্যান বার্নার্ড নাম্নী এক স্কটিশ মহিলা তিন ঘণ্টার কম সময়ে নাকি এই কর্মটি সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি সেদিন পাহাড়ের ওপরে উঠে খড় কুটো জ্বালিয়ে বন্য প্রাণীর মাংস রান্না করে খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে অন্ধকার হবার আগেই তাঁর পতিগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। হেরতসতসগেনআউরাখ গ্রামের আডলফ দাসলার নামক এক জার্মান কুশলী জেসি ওয়েন্সের পায়ে স্পোর্টিং জুতো বেঁধে দেওয়ার দুশ বছর আগে অ্যান বার্নার্ড তাঁর শৌখিন বিলিতি জুতোর ওপরে শক্ত করে দড়িদড়া বেঁধে নিয়ে দুর্গম গিরিপথ আরোহণ করেছিলেন। স্থানীয় ইতিহাস অনুযায়ী অ্যান বারনারড প্রথম ইউরোপীয় মহিলা যিনি এই দুর্গম গিরিশীর্ষে আরোহণ করেন।
সালদানিয়া ও অ্যান বার্নার্ড -এর মাঝের ব্যবধান পুরো তিনশো বছরের।
লায়নস হেড এ সূর্যাস্ত
তাবুয়া দে কাবো থেকে আন্তনিও দে সালদানিয়া বাঁদিকে আরেকটি পাহাড় দেখেছিলেন - সেটি কোন মুনি, কোন সন্ত নয়, যেন একটি সিংহ, মাথা তুলে পর্যবেক্ষণ করছে পায়ের তলার বন্দর, দূরের আটলান্টিককে। একেই কি বলে সিংহাবলোকন? যেমনটি কাবুল পাহাড়ে বাবরের সমাধি দেখে মুজতবা আলী সায়েবের মনে হয়েছিল? সেকালের প্রচলিত পর্তুগিজ প্রথামত আন্তনিও এই সিংহের মাথায় রেখে এলেন এক ক্রুশ চিহ্ন; এই বর্বর দেশে প্রভুর এক সেবকের আবির্ভাবের প্রথম ঘোষণা। ডাচ ঔপনিবেশিক নাম দিয়েছিলেন লিউয়েন কপ (সিংহের শির) এখন তার ইংরেজি নামটি বাজারে বেশি চালু - লায়নস হেড। এখানে আরও একটি মজার ব্যাপার আছে; টেবল মাউন্টেনের উচ্চতা থেকে দেখলে লায়ন্স হেডের পেছনে চোখে পড়ে আরেকটি টিলা, সিগনাল হিল (যার পাশেই ক্রিকেটার ব্যাসিল ডলিভেইরার জন্ম ভিটে), যেন সেই সিংহের পুচ্ছ! সিগনাল হিলের অরিজিনাল ডাচ নাম ছিল লিউয়েন স্টারট, সিংহের ল্যাজ। এ নামটা অবিশ্যি ধোপে টেকে নি।
ছায়ায় ঢাকা সিংহ শির
আমি দূর হতে কিছু অকুতোভয় যুবক যুবতীকে সেই সিংহের মাথায় চড়তে দেখেছি, পরে তাঁরা নিঃসন্দেহে সেলফি তুলে ফেসবুকের অজস্র পৃষ্ঠা আলোকিত করেছেন। আমার সাহসে কুলোয় নি। কেপ টাউন অতীব মনোরম কিন্তু তাই বলে এখানে বেঘোরে ছবি হয়ে যেতে চাইনি - ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিদের সঙ্গে আরও খানিক সময় কাটানোর বাসনা বাকি রয়ে গেছে।
সিংহাবলোকনের ঠিক নিচে বো কাপ (আক্ষরিক অর্থে অন্তরীপের ওপরে) পাড়া, একদা সেটি ছিল মালয়, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশের দাসত্ব চুক্তিবদ্ধ মুসলিম মজুরদের বাস এলাকা। তাঁদের জান মালের মালিক প্রভুরা আদেশ দিয়েছিলেন, দাসেদের বাড়ির দেওয়ালের রঙ হবে সাদা। কেউ যদি সেই ফরমানের অন্যথা পূর্বক হলুদ বা লাল বা অন্য কোন রঙ লাগান, পৌর সভার মিস্তিরি এসে তৎক্ষণাৎ বাড়ির দেওয়ালে সাদা রঙ চুনকাম করে দেবে – তার খরচ অবশ্যই গৃহকর্তার প্রদেয়। তৎসহ শাস্তি - অর্থদণ্ড অথবা কারাদণ্ড, অথবা যুগপৎ। অবাক হতে হয়। যে প্রভুরা নিজেরা শ্বেত বর্ণের মর্যাদা ও বৈষম্য প্রতিষ্ঠায় সতত নিষ্ঠাবান, অন্য বর্ণের মানুষদের রাখেন দূরে, তাঁরাই আদেশ দিলেন কালো মানুষরা যেন সাদা রঙের বাড়িতে বাস করে! কেপ কলোনিতে দাস প্রথা উচ্ছেদের (১৮৩৪) সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেলো প্রতিবাদী বর্ণের বিপ্লব - সব্বাই সাদা ছাড়া অন্য যে কোন রঙে দেওয়াল চুনকাম করছেন! পাশাপাশি দুটো বাড়ির রঙ কদাচ এক নয়, হলদের পরে সবুজ! কতো যে রঙের খেলা! ইতিহাস বর্ণাঢ্য হয়ে যায় এখানে।
বো কাপের বর্ণময় আবাসন
কারার ওই লৌহকপাট
টেবল মাউন্টেনের ওপর থেকে পশ্চিমপানে তাকালে অদূরে আটলান্টিকের নীল জলের মাঝে চোখে পড়ে ডিম্বাকৃতি ছোট একটি সবুজ দ্বীপ। ষোড়শ শতাব্দীতে জাহাজের হাল ভেঙ্গে খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজনে এখানে নেমেছিলেন পর্তুগিজ অভিযাত্রী বারতলোমিউ দিয়াস, পরে সেই একই কারণে ভারত আসা যাওয়ার পথের ধারে থেমেছে অগুনতি জলযান। এই দ্বীপ আটলান্টিকের প্রথম অরিজিনাল ধাবা!
ভ্রাম্যমাণ নাবিকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে; দুশো বছর বাদে কেপ কলোনিতে একদিন ডাচেরা এই বেওয়ারিশ জমিতে বন্দুক তরবারির সহায়তায় আপন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন।
হল্যান্ডের মানুষের কৃপণতা ইউরোপে সর্বজন বিদিত, একমাত্র স্কটিশরা তার ধারে কাছে আসতে পারে। ‘গোয়িং ডাচ’ কথাটি এখন ইংরেজি ভাষার অলঙ্কার। বরানগরে আমরা এটি জানতাম না। সেখানে অন্য ভার্শন চালু ছিল – চায়ের দোকানে দাম দেওয়ার সময়ে বলা হতো ‘ হিজ হিজ, হুজ হুজ’।
এরিক ফান রিবেকের ডাচ অনুগামীরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই দ্বীপে জেলখানা বানিয়ে শাস্তি প্রাপ্ত অপরাধী, অবাঞ্ছিত, পূর্ব এশিয়া, মাদাগাস্কার ও কেপ কলোনির রাজনৈতিক বন্দিদের যদি সেখানে নির্বাসন দেওয়া হয় তাহলে ডাঙ্গায় ইট গেথে কাঁটা তার ঘিরে জেলখানা বানানো ও ডজন ডজন প্রহরী পোষার খরচাটা বাঁচে। রোবেন আইল্যান্ড কেপ টাউন থেকে দূরে নয়, বাইনোকুলার দিয়ে নজর রাখা যায়, কিন্তু পথ দুর্গম; তার আশে পাশে অজস্র মগ্ন মৈনাক, ঝোড়ো হাওয়ায় আকস্মিক উচ্ছলিত আটলান্টিকের জলরাশি, পালাবার পথ নাই। অন্তত দু ডজন জাহাজ ডুবেছে এখানে নোঙর বাঁধতে গিয়ে। কারাগারে পাহারাদার লাগবে কম। ওই দ্বীপ থেকে কেউ সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুতে তো পারবেই না বরং হাঙরের মেনুতে পরিণত হবে। চিন্তাটি সঠিক। তিনশো বছরে নৌকা যোগে মাত্র দুটি সফল পলায়নের কাহিনি জানা যায়, তবে কোন বন্দীর সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুনোর রেকর্ড নেই।
ডাচ এ বিষয়ে অবশ্যই মার্গ দর্শক। পৃথিবীতে তাদের পথ অনুসরণ করেছে ফরাসি (গায়ানার ডেভিলস আইল্যান্ড দ্বীপে যেখানে দ্রাইফুস বন্দী ছিলেন, পাপিলঁ বই বা ডাস্টিন হফমানের ছবিটির কথা মনে করুন) এবং ইংরেজ (আন্দামান)। বৃহত্তর অর্থে টাস মানিয়া, অস্ট্রেলিয়াকে এই পর্যায়ে হয়তো ফেলা যেতে পারে!
একদিন তিমি ও সিল মাছের ব্যবসা করতে এলেন স্কটিশ মানুষ জন মারে; মারে’স বে এখনও তাঁর নাম বহন করে। দুশ বছর আগে এর এক অংশে গড়ে উঠেছিল কুষ্ঠ কলোনি। পূর্ব এশিয়ার, মাদাগাস্কারের মুসলিম কয়েদিদের জন্য তৈরি হয়েছিল মাজার যেখানে আজও শ্রদ্ধালু মানুষেরা মাথা ঠেকান। কিন্তু এই দ্বীপের প্রকৃত খ্যাতি - দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেত শাসক গোষ্ঠীর পেনাল কলোনি নামে।
ডাচ/ আফ্রিকানার ভাষায় সিলকে বলে রোবেন, তা থেকে রোবেন আইল্যান্ড (Robeneiland)। ১৯৬৪ সালে সেখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে এলেন এমন একজন মানুষ যার কারাকক্ষটি দেখতে এখন বছরে হাজার হাজার মানুষ কেপ টাউনের ভিক্টোরিয়া আলবার্ট ওয়াটার ফ্রন্ট থেকে ছোটো বোটে পাড়ি দিয়ে থাকেন। সিল মাছ নয়, এই দ্বীপটির চিরকালীন পরিচিত হবে এক মহান মানুষের নির্বাসনের সঙ্গে।
রবেন আইল্যান্ড এর ফেরি
রোহলিলাহলা ম্যান্ডেলা, প্রথামাফিক স্কুলে প্রদত্ত ক্রিস্টিয়ান নাম, নেলসন। গোষ্ঠীগত (ক্ল্যান) নাম মাদিবা।
আফ্রিকান উচ্চারণ মান্ডেলা (জোহানেসবুরগ অফিসে একজন সহকর্মী ছিলেন সিজওয়ে মান্ডেলা, এই নামটির বোঝা বইতে মরমে মরে থাকতেন); আমি প্রচলিত ম্যান্ডেলা বানানটি ব্যবহার করছি।
ভিতসওয়াটারর্যানড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কালো মানুষের মালিকানায় ওকালতি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। সবার সমান অধিকার চেয়ে লড়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা, মাঝে মাঝে ধরা পড়েন, ছাড়াও পেয়ে যান কারণ শেকল পরানো যায় এমন কোন অপরাধ সাব্যস্ত করতে পারে না আপারথাইড সরকার। আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। জাল ইথিওপিয়ান পাসপোর্টে নানান দেশে গেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো সাদার বিভাজন ঘুচিয়ে এক মানুষ এক ভোটের সমর্থন চেয়ে, এমনকি ইংল্যান্ড অবধি। ১৯৬৩ সালে জোহানেসবুরগের রিভোনিয়াতে একটি গুপ্ত আড্ডায় হানা দিয়ে পুলিশ তাদের প্রাপ্ত (অথবা অপ্রাপ্ত) তথ্যের ভিত্তিতে নেলসন ম্যান্ডেলা সহ আরও সাত জনের নামে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনার অভিযোগে মামলা দায়ের করে (এটি রিভোনিয়া ট্রায়াল নামে খ্যাত, আমাদের ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ছিল সেখানে)। বিচারের রায় - যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, রোবেন আইল্যান্ডে নির্বাসন।
নেলসন ম্যান্ডেলার পরিচয়পত্র
ওয়াটারফ্রন্ট হতে রোবেন আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে দিনে তিনবার জাহাজ ছাড়ে, ঘণ্টা খানেকের জল যাত্রা। সেখান থেকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখা কেপ টাউনের দৃশ্যটি অতীব মনোরম, ছোটো জাহাজ জল কেটে এগিয়ে চলে একটি সবুজ দ্বীপের দিকে, ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, জাহাজের লাউঞ্জে বাজছে মিরিয়াম মাকেবার গান, পাতা পাতা (খোসা ভাষায় ইও মামা ইও মামা নান্তস ই পাতা পাতা)। আটলান্টিকের নীল জল, কোথাও সিল মাছ লাফাচ্ছে। আহা এমনি দিন যদি রোজ জোটে।
স্বপ্নভঙ্গ হয় দ্বীপের জেটিতে নেমে। সামনে পাথরে বাঁধানো দেওয়াল, খানিকটা হাঁটলে গেট, তার ওপরে আফ্রিকানসে লেখা ‘ রোবেনআইল্যান্ড’ অন্স দিয়েন মেট ত্রতস – রোবেন আইল্যান্ড ; আমরা গর্বের সঙ্গে সেবা করি।
প্রবেশ পথ
১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন এই সগর্ব সেবা উপভোগের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলা এবং তাঁর ছ জন সঙ্গীকে। কোমরে বেড়ি, পায়ে শিকল পরিয়ে হাঁটিয়ে আনা হল জেটি থেকে কারাকক্ষ অবধি, আঠারো হতে বিশ বছর কেটে যাবে সেখানে ; তারপর সকলেই কারার এই লৌহ কপাট অতিক্রম করে মুক্ত হবেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসকে বদলে দেবেন সেই সাত জন:
নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর ছয় সঙ্গী- ওয়াল্টার সিসুলু (আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের সহ সভাপতি), আহমেদ কাঠরাদা (ট্রান্সভালের গুজরাতি বোহরা মুসলিম, পরে প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার উপদেষ্টা), গোভান এমবেকি (এ এন সি চেয়ার পারসন, তাঁর পুত্র থাবো এমবেকি নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হবেন), রেমনড মালাবা (পরে ইস্টারন কেপ প্রদেশের প্রধান মন্ত্রী, উগান্ডায় রাষ্ট্রদূত), এলিয়াস মতসোলেদি (ম্যান্ডেলার শপথ গ্রহণের আগের দিন মারা যান) এবং অ্যানড্রউ এমলাঙ্গেনি (নতুন পার্লামেন্টের দুই টার্মের সাংসদ – ২০১৩ সালে ম্যান্ডেলার শোকসভাকে তিনি সম্বোধিত করেন)।
রিভোনিয়া ট্রায়ালে আরও একজন অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। সেই অষ্টম কয়েদির নাম ডেনিস গোল্ডবার্গ, ‘সন্ত্রাসবাদী ‘ সঙ্ঘের একমাত্র শ্বেত বর্ণ সদস্য; লিথুয়ানিয়ান মূলের ইহুদি পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা মাতা দুজনেই কট্টর কমিউনিস্ট, দক্ষিণ আফ্রিকান সরকারের কাছে অত্যন্ত বিপদজনক। সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেওয়ার অপরাধে নেলসন ম্যান্ডেলা সহ সাতজনের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে জেনে ডেনিস তাঁর উকিল ব্রাম ফিশারকে বলেছিলেন, এই কাণ্ডের জন্য তিনি একা দায়ী, তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হোক। সরকারি কৌঁসুলি এতে ভোলেন নি, তাঁরা আটজনকেই জীবন মরণের সীমানার ওপারে পাঠাতে বদ্ধ পরিকর। বিচারক অবশ্য সে আবেদন খারিজ করে সাদা কালো মিলিয়ে আটজনকে একই সাজা দিলেন –যাবজ্জীবন কারাবাস।
এইখানে সরকারের সামনে আরেকটি বিড়ম্বনা উপস্থিত হলো। বর্ণ বৈষম্যের প্রতিবাদী, ধৃত সকলেই অশ্বেতকায় মানুষ, ডেনিস গোল্ডবার্গ বাদে। তিনি সাদা মানুষ, তায় আবার ইহুদি (ইজরায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এমনকি খেলার মাঠে কখনো কোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নি); এঁকে তো কালো ম্যান্ডেলার সাঙ্গোপাঙ্গদের পাশাপাশি পাথর ভাঙতে বা একপাতে খেতে বসতে পাঠানো যায় না, তাঁর অপরাধ যাই হোক না কেন। আপারথাইডের আইন সম্যক মান্য করে কারাগারেও সাদা মানুষের বর্ণশুদ্ধতা রক্ষার জন্য ডেনিসকে পাঠানো হয় প্রিটোরিয়া কারাগারে। অন্য কড়াকড়ি অবশ্য ঢিলে হয় নি, জেলে কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখা মানা, বছরে দু দিন তাঁর পত্নীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার অনুমোদিত।
রোবেন আইল্যান্ডে বন্ধু পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ মঞ্জুর ছিল তবে বছরে একদিন, সময় সীমা তিরিশ মিনিট। প্রতি ছ মাসে একটি চিঠি পাঠানোর অথবা পাবার অধিকার। তার বেশি কোনমতেই নয়।
সেবা দানের প্রতিশ্রুতিমণ্ডিত তোরণটি অতিক্রম করে মানুষের প্রতি মানুষের ক্রুরতা ও কঠোরতার এক নগ্ন চেহারার মুখোমুখি হতে হয়। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের মতো উঁচু ইট পাথরের দেওয়াল, মাঝে জমায়েত হবার জায়গা, ছোটো সেল তার বাইরে লাইম কোয়েরি যেখানে বন্দিরা ছেনি হাতে পাথর ভাঙতেন।
লাইম কোয়েরি
‘ সকাল সাড়ে পাঁচটায় ওয়ার্ডারের ডাক, “ জাগো, উঠে পড়ো”। সেল পরিষ্কার, মাদুর, চাদর গোটানো। কলের জল ছিল না, টয়লেট লোহার বদনা আকৃতির একটি বস্তু, যার আফ্রিকানস নাম ‘বালিস’ তার মাথায় একটি পোর্সিলিনের ঢাকনা। সেখানে সামান্য জল। সেল থেকে বেরিয়ে আমাদের প্রথম কাজ সেই ‘বালিস’ গুলি নর্দমায় উপুর করে ধোয়া, তার দুর্গন্ধে চারিদিক ভরে যায়। কিন্তু পাশাপাশি এই কাজটি করার সময়ে আমরা অন্তত অন্য বন্দিদের সঙ্গে ফিসফিস করে দুটো কথা বলতে পারতাম (যেটি অন্যথায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ)। ওয়ার্ডাররা এই পুতি গন্ধময় নর্দমার অনেকদূরে দাঁড়িয়ে থাকতো।’ (নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ থেকে অনুদিত)।
আন্দামানের সেলুলার জেল আমি দেখিনি, তবে অনেকদিন আগে পড়া মহান বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ‘জেলে ত্রিশ বছর’ নামের এক অনন্য দলিলে বন্দিদের প্রাতঃকৃত্যের এইরূপ বর্ণনা পেয়েছি। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে মুখর বিনায়ক দামোদর সাভারকার তাঁর বন্দিদশায় সেলুলার জেলের ঈদৃশ জীবনযাত্রায় বড়োই পীড়া বোধ করেন। মুচলেকা লিখে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে সরকারি ভাতায় সুখে আপন গৃহে কালাতিপাত করতঃ নিজেকে ‘বীর’ আখ্যায় বিভূষিত করেন।
রোবেন আইল্যান্ড মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনা জরা ব্যাধির অন্তহীন দিনলিপি। আর তারই মাঝে এক প্রখর গ্রীষ্মের দিনে আমাদের গাইড, এক মালয় মহিলা নিয়ে গেলেন মাদিবার সেলে, সেখান থেকে হাঁটলাম চত্বর পেরিয়ে লাইম কোয়েরি যেখানে একদিন ছেনি হাতুড়ি পিটিয়েছেন আমার মতে বিগত শতকের শ্রেষ্ঠ জননেতা। তারপর আর কথা হয় না। একান্ত বাকরুদ্ধ হয়ে সেই দিন সেই মহিলাকে জড়িয়ে ধরে পরিণত বয়েসে প্রথমবার সর্ব সমক্ষে অশ্রু বর্ষণ করেছিলাম।
গাইডের সঙ্গে লেখক
পুনশ্চঃ
প্রসঙ্গত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের উজ্জ্বল রত্ন, আমার অনুজ প্রতিম অধ্যাপক অমিত রায় অগ্নিযুগের এক অসাধারণ ইতিহাস লিখে চলেছেন। রোবেন আইল্যান্ডের সগোত্র আন্দামানের জেলের বিস্তৃত কাহিনি জেনেছি অমিতের ‘কালাপানি’ ও ‘সেলুলার জেলে অগ্নিযুগের বিপ্লবী’ বই দুটি পড়ে।
কারাগার
মাদিবার কারাকক্ষ
কারাগারের অভিজ্ঞতা
কারাগারের মেনু